একটি বীজমন্ত্রের তাৎপর্য
০১.
ধর্মকে ধারণ করেই মানুষ ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নির্ঘ ও নির্বিঘ্ন জীবনযাত্রার পথ করে নিতে চায়। অবশ্য এ ব্যাপারে সে কোনো স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্য কামনা করে না। সে জন্মসূত্রে তার ঘরোয়া ও সামাজিক পরিবেশ থেকে যা পায়, তা-ই সে নির্বিচারে গ্রহণ করে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করবার চেষ্টা করে। আশৈশব লালিত সংস্কারই তার এ বিশ্বাসের ভিত্তি। এবং তার জীবন ও জগৎ চেতনাও অনেকাংশে এই বিশ্বাস-সংস্কার প্রসূত। ধর্মের ক্ষেত্রে মানুষ কৃচিৎ জ্বিজ্ঞাসু–এর জন্যে কিছুটা ব্যক্তিগত ঔদাসীন্য আর অনেকটা সামাজিক অসহিষ্ণুতা ও শাস্ত্রীয় নিষেধই দায়ী। এই অসহিষ্ণুতা ও নিষেধের গোড়ায় রয়েছে জীবনের পথ ও পাথের সম্পর্কে নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত হবার আগ্রহ। এ কারণেই কোন-না-কোনো জ্ঞানী-মনীষী প্রদত্ত দিশার অনুসরণে সে নিশ্চিন্ত নির্বিঘ্ন জীবন-দর্শন গ্রহণে অভিলাষী। তাই মানুষ সাধারণভাবে পরবুদ্ধিজীবী।
কিন্তু ধর্ম বলতে কোনো অবিমিশ্র একক মত বা শাস্ত্র বুঝায় না। আদিম আরণ্য মানবের আঞ্চলিক জীবন ও জীবিকা পদ্ধতির প্রভাবে গড়ে উঠেছিল যে জীবন-চেতনা ও জগৎ-ভাবনা, তাই প্রতিবেশিক ও জৈবিক প্রয়োজনে ক্রমবিকাশের ও ক্রমবিবর্তনের ধারায় কালিক রূপান্তর লাভ করেছে। মানব-চেতনার বিকাশ ও ব্যবহারিক প্রয়োজনের প্রসারই তার সর্বাত্মক ও সর্বাঙ্গীণ বৃদ্ধি ও ঋদ্ধির মূলে ক্রিয়াশীল। এ কারণে এর উপর স্থানগত ও কালগত জীবিকা-পদ্ধতির প্রভাব অপরিমেয়। তাই ধর্মের স্থানিক ও কালিক অবয়ব ও বিকাশ ছিল–দেশ-কাল নিরপেক্ষ রূপ ছিল না। এমনকি এর মধ্যে প্রকৌশল, অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনবোধের প্রভাব এত অধিক ছিল বলেই আরণ্য মানবের ধর্মে আর সভ্য ও সভ্যতার মানুষের শাস্ত্রে জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও প্রয়োজনগত পার্থক্য এবং মনন ও রুচির উৎকর্ষ ও অপকর্ষ সর্বক্ষেত্রে সুপ্রকট।
অতএব, ধর্ম বলতে ঈশ্বর, ভূত-প্রেত, জীন-যাদু, সুখ-দুঃখ, রোগ-শোক এবং স্বর্গ-মর্ত পাতাল সমন্বিত এক বিরাট-বিপুল চির রহস্যাবৃত মায়াময় কল্পনোক বা মানস-জগৎ বোঝায়–যার জটিল আলো-আঁধারীর মধ্যে রয়েছে–আমাদের বাস্তব জীবনের সম্পদ ও সমস্যার, আনন্দ ও যন্ত্রণার, স্বপ্ন ও সত্যের রহস্যসূত্র। অজ্ঞ অসহায় মানুষ অনুমানে ও অনুভবে এই রহস্যভেদে ছিল প্রয়াসী। যা বুঝেছে তার ভিত্তিতেই সে জীবনের ও জীবিকার সেই অদৃশ্য অরি ও মিত্র শক্তিগুলোর সঙ্গে একটা আপোষ-রফা করবার চেষ্টা করেছে পূজা-পার্বণ ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এর জন্যেই প্রয়োজনীয় হয়েছে নিয়ম-নীতি। যৌথ জীবনের অবচেতন প্রেরণায় ও প্রয়োজনে সে চুক্তিতে এসেছে মানুষেরও সামাজিক ও বৈষয়িক জীবনের নিয়ম-নীতির শৃঙ্খল। তাই এ চুক্তি ত্রিপক্ষীয়–দেব, দানব ও মানুষের পারস্পরিক অধিকার, দাযিত্ব ও কর্তব্য নির্ধারিত হয়েছে মানুষের ব্যক্তিক আনুগত্যের অঙ্গীকারে দেবতা-দানবের অনুগ্রহ, সহযোগিতা ও সহিষ্ণুতার ভিত্তিতে।
এখানেই কিন্তু মানুষ থামেনি। নিশ্চিন্ত হতে পারেনি এ ব্যবস্থায়। তার প্রসারমাণ জীবনের প্রয়োজনে সে নৈতিক, সামাজিক, বৈষয়িক ও প্রশাসনিক নিয়ম-নীতির মধ্যে নিজকে নিবদ্ধ করে যৌথ জীবনের নিরাপত্তা ও শান্তি কামনা করেছে। এমনি করে মানুষ এক বিপুল ও বিচিত্র জীবন যন্ত্র এবং জটিল-জীবিকা যান তৈরি করে এগিয়ে এসেছে আজকের দিনে। আজ ধার্মিক, নৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক নিয়মকানুনের নিগড়ে মানুষ স্বেচ্ছাবন্দী। এ বন্দিত্ব বরণ করেছে সে শান্তি, স্বস্তি, প্রগতি ও কল্যাণ আকাঙ্ক্ষায়। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে ও প্রকৌশলে মানুষের বিস্ময়কর অগ্রগতি পৃথিবীকে করেছে সংহত এবং মানুষের সমাজ করেছে সংমিশ্রিত।
আত্মপ্রত্যয়ী যন্ত্রী মানুষ আজ আর কোনো ব্যাপারেই দৈব-নির্ভর নয়। দেব-দানবের সঙ্গে তার চুক্তি ভেঙে গেছে। জীবনের কোনো প্রয়োজনের জন্যে সে আর আসমানের অনুগ্রহ-প্রত্যাশী নয়। মানতেই হবে, যারা মানব-শক্তির এমনি অচিন্ত্য বিকাশ সাধন করেছেন, তাঁরা চিত্ত-সম্পদে অতুল্য। এদের সাধনা ও শ্রমের, এদের ভাব, চিন্তা ও কর্মের দান যে যন্ত্রজ বস্তু-সম্পদ–তা অকাতরে দ্বিধাহীনচিত্তে পরম আগ্রহে গ্রহণ করেছে কর্তব্যে উদাসীন, পরচিন্তাজীবী ও পরশ্রমজীবী ভোগেছু মানুষ। কিন্তু মানুষ নির্বোধের মতো পরিহার করে চলে তাদের চিত্ত-সম্পদ, অবজ্ঞা করে তাদের মননের মহাঅবদানকে। ব্যবহারিক-বৈষয়িক জীবনে তারা বরণ করেছে বাস্তব জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যকে, চলমানতাকে; কিন্তু মানস-জীবনে গ্রহণ করেনি এই যান্ত্রিক বস্তুর জনন-শক্তিকে, সেখানে তারা ধরে রেখেছে স্থিতিশীলতাকে। জীবন-ভাবনায় ও জগৎ- চেতনায় মানুষের এই অসঙ্গতি, বস্তু-সম্পদে এই আগ্রহ এবং চিত্ত-সম্পদ অর্জনে এই অনীহাই আজকের দিনের সব চাইতে মৌলিক মানবসমস্যা। এ সমস্যার সমাধান হলে, আমাদের বিশ্বাস অন্য সব মানবিক সমস্যার সমাধান হবে অনায়াসলভ্য।
.
০২.
আমাদের পাকিস্তানে এই সমস্যা আরো বিকৃত হয়ে দেখা দিয়েছে। সে কথা এখন বলব।
ধর্ম-বিরহী দেশ নেই। এবং শাস্ত্রীয় ধর্ম ও আচারিক, আনুষ্ঠানিক আর পার্বণিক ধর্ম মানুষের আটপৌরে জীবনে চেতন-অচেতনভাবে জড়িয়ে রয়েছে! এতকালের পুরোনো ধর্ম মানুষের ব্যবহারিক-বৈষয়িক জীবনে কোনো সহায়তাও করে না, স্বস্তি-শান্তির বিঘ্ন ঘটায় না। এ একরকম গৌরব-গর্বের ও প্রবোধ-প্রশান্তির অবলম্বন হয়েই আভরণের মতো জীবনে সংলগ্ন।
কিন্তু পাকিস্তানের সরকার, সরকারি লোক ও জননেতার কাছে ধর্ম একটি তরতাজা প্রাত্যহিক ও বৈষয়িক সম্পদ ও সমস্যা। তাঁরা যেন ইসলাম ও মুসলমানের প্রাচীনত্ব–সাড়ে তেরোশ বছর বয়স–স্বীকার করতে চান না। উন্মেষ যুগের সাহাবী-প্রচারকদের মতো তারা যেন সদ্যোজাত ইসলাম প্রচারে এবং নও-মুসলিম রক্ষণে সদাবিব্রত। তাঁদের চোখে ইসলাম ও মুসলমানের ভয়ঙ্কর সঙ্কটজনক অবস্থা। উভয়েরই যেন এখন-তখন হাল। কখনো ইসলাম ডোবে, কখনো মুসলমান মরে, আবার কখনো বা সিরাজুল ইসলাম নিবে!
তাদের ঘরোয়া জীবনে ইসলামের প্রতি ঔদাসীন্য সাধারণ লোকের চাইতে বেশি বলেই শোনা যায়। কিন্তু তাঁদের দফতর ও ময়দানী-জীবনে তারা ইসলামের সমর্পিত চিত্ত, ইসলাম-সর্বস্ব ও ইসলামের জন্যে উৎসর্গিতপ্রাণ। তাই তারা ইসলামী রাষ্ট্র, ইসলামী জীবন-পদ্ধতি, ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠাকামী। তাঁদের অভিপ্রায় অতি উত্তম এবং আপাত দৃষ্টিতে সবটাই ভালো।
কিন্তু তাঁদের উৎসাহের আতিশয্য দেখে মনে হয় পৃথিবীর আর কোথাও ইসলাম ও মুসলিম নেই। কেবল পাকিস্তানেই বিপন্ন ইসলাম ও মুমূর্ষ মুসলমান শিবরাত্রির সলতের মতো সধূম শিখা নিয়ে টিকে রয়েছে এবং তাও নির্বাণোন্মুখ। তাই জননেতা ও সরকারের এই বিচলন এবং তজ্জাত উদ্বেগ ও উত্তেজনা। অছির দায়িত্ব চিরকালই গুরু ও মহৎ দায়িত্ব। সে দায়িত্বে অবহেলা অসম্ভব!
.
০৩.
এবার পাকিস্তানীর হালফিল অবস্থা বিবেচনা করা যাক। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রায় সবাই এবং পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা নব্বই জন অধিবাসীই মুসলমান। সরকার ও জননেতারা বলেন ইসলাম ও ইসলামী জীবনযাত্রার প্রতি আকর্ষণ বশেই তারা পাকিস্তান তথা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র কামনা করেছিলেন। এর মধ্যে তথ্যের ভুল যা-ই থাক, তাদের অভিপ্রায়ের অকৃত্রিমতায় আস্থা রাখতে আমাদের আপত্তি নেই।
বিগত কয় বছর ধরে পাকিস্তানও ইসলামী রাষ্ট্র। এবং ঘরে-বাইরে তা সগৌরবে ও সগর্বে প্রচারও করা হয়। পাকিস্তানী মুসলমানদের সবাই শাস্ত্রে সুপণ্ডিত না হোক, প্রাত্যহিক জীবনে -আচরণীয় ও অবশ্য পালনীয় শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধ সম্পর্কে শিক্ষিত, অশিক্ষিত কিংবা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অবহিত। অন্তত শাস্ত্রীয় পাপ-পুণ্য ও ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে কেউই অজ্ঞ নয়।
তবু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর যুগে স্বাধীনতা-প্রাপ্ত আফ্রো-এশিয়ার অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে, কোন্ পাপ কোন্ অন্যায় কম! ওরা অবশ্য পাকিস্তানীদের মতো অত ধর্মভীরু বা ধর্মপ্রিয় নয়, তাদের রাষ্ট্রও ধর্মরাষ্ট্র নয়। তবু সততায়, ন্যায়পরায়ণতায়, কর্মনিষ্ঠায়, দায়িত্বশীলতায় কিংবা কর্তব্যবুদ্ধিতে ধর্মে অনুরক্ত ও অনুগত ইসলাম সর্বস্ব পাকিস্তানীদেরকে ঘরে-বাইরে কোথাও আমরা বিজাতি-বিধর্মীদের চেয়ে ভালো দেখিনে। ঘরোয়া জীবনে, সামাজিক অঙ্গনে, অফিসে-আদালতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে-মিথ্যার বেসাতি, অন্যায়ের নির্লজ্জ প্রকাশ, বিবেকের অবমাননা সর্বত্র দৃশ্যমান। দ্বেষ-দ্বন্দ্ব-সংগ্রাম ও পীড়ন-লুণ্ঠন হনন প্রভৃতি নিত্যকার ঘটনা। চোরাকারবারী, কালোবাজারী, চুরি, ডাকাতি, কর্তব্যে অবহেলা, অন্যায়-প্রবণতা, ঘুষ, ছল, প্রতারণা, মিথ্যাচার, জুয়া প্রভৃতি সর্বপ্রকার শাস্ত্রীয় পাপে পাকিস্তানীদেরকে যে-সংখ্যায় আসক্ত দেখি, তার চাইতে বেশি সংখ্যায় পাপে লিপ্ত ব্যক্তি অন্যদেশে আছে বলে আমাদের জানা নেই।
এ ব্যাপারে গণ-অভিভাবকদের মনোভাবও অদ্ভুত। এসব কিছুতেই যেন ইসলামের ক্ষতি হয় না, মুসলমানের জাত যায় না। কিংবা কোনো বিদেশী-বিজাতির আচারে-প্রভাবেই তাদের আপত্তি নেই–সর্বনাশ হয় কেবল ভারতীয় প্রভাবে ও হিন্দুয়ানী আচারে! আবার মুসলমান চোরা-ডাকু মিথ্যুক-লম্পট-বদমাশ হলে সমাজের কিংবা ইসলামের যেন কোনো ক্ষতি নেই,–ক্ষতি হয় কেবল কেউ নাস্তিক হলে। তারা আমাদের ভাত-কাপড়-ওষুধের দায়িত্ব নেন না, আমাদেরকে শুধু ভেহেস্তে পাঠানোর কর্তব্য পালনেই তাদের আগ্রহ। আর তাও সর্বত্র এবং সর্বদা নয়–কেবল দফতরে ও ময়দানে এবং সরকারি সমস্যার কালে ও নির্বাচন সময়ে।
তাহলে এই আদর্শিক ইসলাম-প্রীতির রহস্য অন্যত্র সন্ধান করতে হবে।
প্রথমত, ধরা যাক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে কী কী পাপ ও অনাচার থাকে, যা ধর্ম-রাজ্যে চালু নেই। বলতেই হবে তেমন পার্থক্য নির্দেশ করা দুঃসাধ্য। ইসলামে নিষিদ্ধ বা ধিকৃত সিনেমা, জুয়া, ঘোড়দৌড়, সঙ্গীত, সুদ, নারী-স্বাধীনতা, বেশ্যাবৃত্তি, মাদকদ্রব্য, বীমা প্রভৃতি পাকিস্তানেও চালু রয়েছে। তবে ইসলামী শাসনতন্ত্রের বা সরকারের বৈশিষ্ট্য কি?
দ্বিতীয়ত, ইসলামী শাস্ত্রে সুপণ্ডিত হলেই মুসলমান চরিত্রবান হবে, ধার্মিক হবে এমন ধারণার স্বপক্ষে যুক্তিও প্রবল নয়। চুরি, ঘুষ, সুদ, মিথ্যাচার, পীড়ন প্রভৃতি সম্বন্ধে সামাজিক পাপবোধ জাগানোর জন্যে কোনো বিশেষ শাস্ত্রীয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করা দুঃসাধ্য। কেননা দুনিয়ার কোনো সভ্য-অসভ্য, আস্তিক-নাস্তিক সমাজেই এসব দুষ্কর্মের সমর্থন নেই। তাছাড়া বিদ্যা বা শিক্ষা কিংবা জ্ঞান মানুষের চরিত্র গড়ে না। বৃত্তি-প্রবৃত্তি সংযত রাখার সদিচ্ছাই ব্যষ্টিকে চরিত্রবান, নীতিনিষ্ঠ ও আদর্শপরায়ন করে। বিদ্বান বা জ্ঞানী হলেই চরিত্রবান হবে–এমন কথা শাস্ত্রীয় তত্ত্ব হলেও সামাজিক তথ্য নয়। তার প্রমাণ আমাদের শিক্ষিত লোকের মধ্যে চরিত্রহীনের সংখ্যা যত বেশি, অশিক্ষিত সমাজে তত নেই।
আমাদের দুর্নীতির সমস্যা তো শিক্ষিত ব্যবসায়ী ও চাকুরিজীবী সমাজেই সীমিত। বরং নিরক্ষর লোকেরা আজন্মলালিত ঘরোয়া বিশ্বাস-সংস্কারের প্রভাবে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে বলেই বিশেষভাবে দৈবনির্ভর ও নিয়তি-ভীরু। জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে দৈব রোষ ও প্রসন্নতা-সচেতন বলেই তারা ভয়ে ভয়ে বাঁধা নিয়মে ও নীতিতে নিষ্ঠ থেকে জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে নির্বিঘ্ন ও নির্ঘ হতে প্রয়াসী। তাদের বিশ্বাসের ধর্ম তাদেরকে যান্ত্রিক-জীবন যাপনে উৎসাহ দেয়। এতে তাদের মানসক্ষেত্র বন্ধ্যা থাকে বলে চিত্ত-সম্পদ অর্জনের পথ রুদ্ধ থাকে বটে, কিন্তু সংস্কারলব্ধ ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়ম-নীতির আনুগত্যে তাদের পতন-পথও থাকে বন্ধ। সুতরাং তাদের আত্মিক উৎকর্ষ-উন্নয়ন যেমন নেই, তেমনি অবনতিও নেই।
অতএব, চরিত্র গঠনের জন্যে শাস্ত্র-শিক্ষার যৌক্তিকতা সামান্য। আর রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, মৃৎবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজ-বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ভূগোল, বাণিজ্য, দর্শন, ইতিহাস, ভাষা প্রভৃতিতে ধর্মীয় শিক্ষানীতির সম্পর্ক ও সংলগ্নতা আবিষ্কার অসম্ভব। এসব জ্ঞানজ বিদ্যার সঙ্গে বিশ্বাসভিত্তিক শাস্ত্ৰনীতির কী সম্পর্ক রয়েছে যে শিক্ষানীতিও শাস্ত্রীয় হবে?
শাসনতন্ত্র ইসলামী করার সার্থকতাও দুর্লক্ষ্য। আমরা জানি, মুসলমান বা যে কোনো ধর্মাবলম্বীর শাস্ত্রীয় জীবন ও আচার সব সময়েই শাস্ত্রীয় আইনে নিয়ন্ত্রত হয়। এর জন্যে হিন্দু বা মুসলিম আইন রয়েছে। এর বাইরে বৈষয়িক জীবনে শাস্ত্র শাসন অনভিপ্রেত নয় কেবল, অকেজোও বটে। বাণিজ্য, দেশরক্ষা, যোগাযোগ, স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা, অর্থ, উন্নয়ন, সেচ, কৃষি প্রভৃতি সরকারি দায়িত্বে ও কর্তব্যে শাস্ত্রীয় কী কাজ আছে যে শাসনতন্ত্র শাস্ত্রীয় হওয়া দরকার?
অতএব পাকিস্তানীদের সবক ও সরব ইসলাম প্রীতির অন্তরালে তিনটে কারণ অনুমান করা সম্ভব।
এক, অজ্ঞ জনসাধারণ যেহেতু চিত্তলোকে মধ্যযুগীয় জীবন-চেতনা লালন করে; সেজন্যে তাদের স্বাতন্ত্র, গৌরব-গর্ব, জীবন-ভাবনা ও জগৎ-চেতনা আজো স্বধর্মকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। তারা স্বধর্মের মাহাত্ম্য এবং স্বজাতির কৃতিত্বে ও সংখ্যাধিক্যে গৌরব-গর্বের আনন্দ ও কৃতাৰ্থমন্যতা লাভ করতে চায়। তাই তারা ইসলামী ও মুসলিম শাসনেই তুষ্ট। লাভ-ক্ষতির কথা তাদের মনে জাগে না।
দুই. মোহাজেরমাত্রেই নিরাপত্তার অবচেতন প্রেরণায় ইসলাম, ইসলামী শাসন ও ইসলামী জাতীয়তা-প্রবণ। কেননা বিদেশে বিভাষীর মধ্যে বসবাসের পক্ষে এটাই তাদের একমাত্র Locus Standi–স্বাধর্মের অধিকারেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের স্থিতি। এই ইসলাম ও মুসলিম প্রীতির পশ্চাতে অবশ্য বিধর্মীর নিষ্ঠুর পীড়নে ধন-জন-বাস্তু হারানোর ক্ষোভ আর বেদনাও সক্রিয়। আমাদের পরিচিত মোহাজেরদের প্রায় সবাই ইসলামী তথা মুসলিম জাতীয়তায় ও ইসলামী শাসনতন্ত্রে আস্থাবান।
তিন. অভিন্ন জাতীয়তার নামে সম্পূর্ণ ভিন্ন দেশের, গোত্রের, ভাষার, সংস্কৃতির ও জীবিকা পদ্ধতির মানুষকে এক রাষ্ট্রভুক্ত করে শাসন ও শোষণ করার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তানীদেরও Locus standi হচ্ছে ইসলাম। কাজেই সে সুপরিকল্পিত সামাজিক নীতি অনুসৃতির ফলে বাঙালিকে তারা ভাষা বদলাও, হরফ বদলাও, বানান বদলাও, শব্দ বদলাও, পোশাক বদলাও, আচার বদলাও, দেশ ও দেশবাসীর নাম বদলাও বলে বলে উদ্বস্ত করেছিল; সেই নীতিরই আর এক চাল হচ্ছে ইসলামের জিকর, তথাকথিত ইসলামী শাসনতন্ত্রের মাহাত্ম্য ঘোষণা ও ইসলাম-ভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তার অপরিহার্যতা বয়ান। শুনে শুনে শুধু গণ-মানব নয়, শিক্ষিতলোকও বিচলিত, বিব্রত ও বিগলিত। এতে বাঙালির দ্বিবিধ ক্ষতি : এক, এই ইসলামী বেরাদরীর মোেহবশে সে কখনো স্বস্থ ও স্বতন্ত্র হতে পারবে না। দুই. অমুসলিম-অধ্যুষিত এই পাক-ভূমে ইসলাম জোশ বিধর্মী-বিদ্বেষ জিইয়ে রাখবে।
আর নাগরিকত্বের সহজ অধিকারে বঞ্চিত বিধর্মীরাও স্বভূমে প্রবাসী হয়ে বাস করার লাঞ্ছনা ও গ্লানি এখনো মন থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। তাদের মানস-বিরূপতা এ অঞ্চলের শান্তি, শক্তি ও প্রগতি বিঘ্নিত ও বিপন্ন রাখবে। রাষ্ট্রনীতিতে ইসলামী চেতনা, ইসলামী শাসনতন্ত্র, এবং ইসলামী জাতীয়তা প্রভৃতির মতো বাঙালির সংহতি বিনষ্টির এবং ভেদনীতি প্রয়োগের এমন মোক্ষম উপায় সম্প্রতি আর একটিও জানা নেই।
এ ছাড়াও অমুসলিমকে জিম্মিরূপে আলাদা করে রাখলে ভারতে তাদের জ্ঞাতি হত্যার প্রতিশোধ নেয়া যাবে, আবার বাঙলা থেকে হিন্দু উচ্ছেদ হলে বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নষ্ট হবে–এ দ্বিমুখী লাভের চিন্তাও যে তাদের প্রশ্রয় পায় না, তা নিঃসংশয়ে বলা যাবে না। তার উপর, বাঙালি মুসলিম মনে হিন্দু-বিদ্বেষ যে পরিমাণে তাজা ও প্রবল থাকবে, মুসলিম বেরাদরীভাবও সেই অনুপাতে ঠাঁই করে নেবে বাঙালি চিত্তে এমন একটা আশাও হয়তো উঁকি মারে মনের কোণে। এমনি করে নানা ছল-চাতুরীর মায়াজালে জড়িয়ে,নানা ছদ্মবাঁধনে অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে বাঙালি সত্তার ইতি সাধনে তৎপর রয়েছে কায়েমী স্বার্থবাদী বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদীরা।
শাসন-শোষণের এমন যাদু-যন্ত্রের সঙ্গে ইতিপূর্বে বাঙালির কোনো পরিচয় ছিল না। তাই এই বিভ্রান্তি ও অভিভূতি আজ তাদের পেয়ে বসেছে। এক্ষেত্রে ইতিহাসবিদ মনীষী ইবন্ খলদুনের মূল্যবান মন্তব্য স্মরণ করলে আজকের দিনেও আমরা হয়তো উপকৃত হব। ইবন্ খলদুন বলেছেন–ধর্মশাস্ত্রকে মানুষ নিজের বৈষয়িক স্বার্থসিদ্ধির অভিপ্রায়ে টুকরো টুকরো করে কাজে লাগায়–তাতে ধর্মও মাহাত্ম্য হারায়, কাজও নষ্ট হয়। ১
এ-ও স্মর্তব্য যে আজ বিজ্ঞান দূরকে করেছে নিকট, তাই দেড় হাজার মাইলের ব্যবধান সত্ত্বেও দুটো বিচ্ছিন্ন দেশ নিয়ে পাকিস্তানরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সমস্বার্থে সহযোগিতা ও সহঅবস্থানের ভিত্তিতে অকৃত্রিম ও অকপট প্রীতির পরশে পরকে ভাই করার সাধনা না করলে তা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।