একটি প্রতারক প্রত্যয়
ইসলাম সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। এবং উন্মেষ যুগে তা আক্ষরিকভাবে অনুসৃতির প্রয়াস ছিল। তবু স্বার্থের ব্যাপারে সে-শিক্ষা ও সৌজন্য অবহেলিত হয়েছে বারবার। এতে একটি সত্য প্রতিষ্ঠা পায় : লোভের ও লাভের ক্ষেত্রেই হয় আদর্শের পরীক্ষা, আর লিপ্সার সঙ্গে দ্বন্দ্বে এবং স্বার্থের সংগ্রামে আদর্শ সাধারণত হার মানে। লোভ ও লাভ-চেতনা চিরকালই প্রবল এবং সে কারণেই বাস্তব। আদর্শবাদ ও নীতিবোধ সুন্দর বটে, কিন্তু সহজলভ্য নয়। বোধগত আদর্শ আবেগগত না হলে জীবনে আচরণ-সাধ্য হয়ে উঠে না। ইসলামী সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বও তাই বৈষয়িক ও রাষ্ট্রিক ব্যাপারে কার্যকর হয়নি। এর কার্যকর হয়তো অসম্ভব ছিল না, কিন্তু বাস্তব জীবনে তা অস্বাভাবিকই প্রমাণিত হয়েছে।
যেমন, রসুলের ওফাত-মুহূর্তেই নেতৃত্বের দাবিতে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় আনসারে-মোহাজেরে। অবশেষে রসুলের স্বজনের দাবীই স্বীকৃতি পায়। প্রথম চার খলিফার চার জনই মক্কী এবং যথাক্রমে রসুলের দুই শ্বশুর ও দুই জামাতা। পরবর্তীকালে খিলাফতে আব্বাসীয় প্রতিষ্ঠাও আসে রসুলের জ্ঞাতিত্বের দাবিতে। তাছাড়া হযরত উসমানের পতনের কারণ ও হযরত আলীর প্রতিষ্ঠার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় মুখ্যত গোত্র-দ্বেষণা। এ দ্বেষ-দ্বন্দ্ব ও বিরোধ-বিবাদ ইসলাম-সংপৃক্ত মুসলিম ইতিহাসকে ম্লান করেছে।
হাশেমী-উম্মাইয়ার এ জ্ঞাতি-বিদ্বেষ আব্বাসীয়দের পতনকাল অবধি তীব্র ছিল। এবং তা কেবল উক্ত দুই বংশে সীমিত ছিল না। রসুলের স্বজন ও আত্মীয় হিসেবে হাশেমীরা পায় বিশ্ব মুসলিমের সহানুভূতি ও আনুগত্য। আর চিরঘৃণ্য হয়ে থাকে উম্মাইয়ারা। এ সহানুভূতি বশেই কারবালার যুদ্ধে নিহত হোসেন মুসলিম জগতে প্রিয়তম হয়ে উঠেন এবং কারবালা পায় তীর্থের মর্যাদা।
যদিও ইসলামী শাস্ত্রকে সুসংবদ্ধকরণ, ইসলামী সমাজকে পূর্ণাবয়ব দান, মুসলিম সাম্রাজ্যের কলেবর বৃদ্ধি প্রভৃতি প্রায় সবকিছু উম্মাইয়াদেরই কৃতি এবং কীর্তি, আর হাশেমীদের দান প্রায় দুর্লক্ষ্য, তবু রসুলের আত্মীয় হিসেবে শ্রদ্ধেয়তার সুযোগে মুসলিম জগতে তারা উম্মাইয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ-বিষ ছড়িয়ে ছড়িয়ে জনমনে উম্মাইয়াদের প্রতি গভীর ঘৃণার সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল, যা চিরকাল দুরপনেয় হয়ে থাকবে। এ কারণেই ইসলাম ও মুসলিম সমাজের প্রতি উসমান-মালেক-উমর-ইয়াজিদ প্রমুখ কীর্তিমান শাসকদের অবদানও প্রায় অস্বীকৃত। এজন্যেই দেখতে পাই, সমাজে শ্রদ্ধেয়তা অর্জনের জন্যে যেমন হাশেমী কুলবাচি গ্রহণে মুসলিম সমাজে আগ্রহের আজো অভাব নেই, তেমনি মুসলিম সমাজের ঘৃণা এড়ানোর জন্যে আসল উম্মাইয়ারাও কুলবাচি পরিহার করে সমাজে আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়েছিল।
অন্য ক্ষেত্রেও সাম্য, সমদর্শিতা ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শ অনুসৃত হয়নি। সাম্রাজ্যিক স্বার্থে উমর আরবদের পক্ষে বিজিত আজমে বসবাস ও বিবাহ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। তেমনি ইরানী মায়ের সন্তান বলেই আল-মামুন সিংহাসনে বঞ্চিত হন। এবং মাতৃকুলের সাহায্যে বাহুবল প্রয়োগে তাকে দখল করতে হয় খিলাফৎ। আবার তা আয়ত্তে রাখার জন্যেও ফাতেমীদের তোয়াজ করতে হয় তাঁকে। এমনি দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে রয়েছে ইসলামের ও মুসলমানদের ইতিহাসের সর্বত্র। বৈষয়িক ও রাজনৈতিক জীবনে সাম্য, সহযোগিতা কিংবা সহ-অবস্থানের দৃষ্টান্ত মুসলিম ইতিহাসেও গোড়া থেকেই বিরল। এক্ষেত্রে ইসলাম গোত্ৰ-চেতনা যেমন বিলোপ করতে পারেনি, তেমনি স্বধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্রিক জাতীয়তাও গড়ে উঠেনি কখনো। যদি তাই সম্ভব হত; তাহলে খলিফা বা আমীরুল মুমেনীনের কর্তৃত্বে দুনিয়ায় সব সময় একটি মাত্র মুসলিম রাষ্ট্র থাকত।
আজো আরবেরা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তায় আস্থাবান নয়–গৌত্রিক কিংবা ভাষিক অভিন্নতা ভিত্তিক জাতীয়তার সাধক। ইরানীরা আর্য-চেতনাতেই সংহত। তাই দেশের নাম ইরান এবং শাসক আর্যমিহির ও পহলবী। পাক-ভারতের ইতিহাসে আফগান-তুকী-মুঘলের দ্বন্দ্ব ও বিরোধ আকস্মিক ও নয়, একদিনেরও নয়। অতএব ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রিক জাতীয়তা মুসলিম-ইতিহাসেও অনুপস্থিত।
পাক-ভারতে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হল ইংরেজ আমলে ও প্রতীচ্য প্রভাবে। ইংরেজ আমলেই নেপাল থেকে সিংহল এবং বার্মা থেকে খাইবারপাস অবধি ভূ-ভাগ ব্রিটিশের একচ্ছত্র শাসনে আসে। বিদেশী শাসকের একচ্ছত্র শাসন ও শোষণ এবং যন্ত্রণার সমানুভূতি এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের শাসিত জনদেরকে ঐক্য দান করে। ইতিপূর্বে এত বড় মহাদেশ কখনো এক-কেন্দ্রিক শাসনে ছিল না। এর নতুন নাম হল ভারত সাম্রাজ্য।
উৎপীড়িত শাসিত জনেরা একক জাতি রূপে সংহত হয়ে স্বাধীনতা অর্জনে হল উৎসুক। কিন্তু অসংখ্য গোত্রে, নানা ধর্মে, বহু ভাষায় ও বিভিন্ন আঞ্চলিক পরিবেশে বিভক্ত এখানকার মানুষেরা সম সংখ্যার ও সম স্বার্থের অভাবে একই মিলন ময়দানে দাঁড়াতে পারল না। অসম সংখ্যা ও বিষম স্বার্থ সংহতি ও সংগ্রামের অন্তরায় সৃষ্টি করল। জাতীয় কংগ্রেস পরিণামে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর সংগ্রাম-সংস্থার রূপ নিল। সাম্রাজ্যভুক্ত মুসলমানরাও স্বাধর্মের আশ্রয়ে সংগ্রামী শক্তি অর্জনে হল তৎপর। ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের এ সংগ্রাম ছিল প্রত্যক্ষত ধন-মানের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী হিন্দুর বিরুদ্ধে। স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে এর শুরু আর উনিশশ সাতচল্লিশে এর সমাপ্তি।
আমাদের এ ধারণার সমর্থনে প্রবল প্রমাণ উপস্থিত করতে পারি। পলাশীর যুদ্ধে বিদেশী খ্রস্টানদের হাতে বাঙলার সুবাদারের পরাজয় ভারতের কোনো রাজন্যকেই বিচলিত ও বিব্রত করেনি। তারও প্রায় দুশ বছর আগে বিদেশী বিধর্মী বেনেরা গোয়া-দামন-দিউ-কারিকল-মাহে দখল করেছিল। কিন্তু কোনো দেশী রাজন্যের আত্মসম্মানে তা আঘাত করেনি। তারা বরং ওদেরকেও কাড়াকাড়ি আর শাসন-শোষণের খেলায় নবাগত প্রতিযোগীরূপেই গ্রহণ করেছিল। খেলোয়াড়-সুলভ প্রতিযোগিতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা অবশ্য ছিল। কিন্তু বিদেশী-বিধর্মী-বিজাতি বলে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছিল না। কেননা, শাসক বা শাসিত জনের মধ্যে স্বাদেশিক কিংবা স্বাজাতিক চেতনা ছিল অজাতমূল। তাই পলাশীর যুদ্ধের পরেও একশ বছর ধরে গোটা ভারত গ্রাসকালে স্বাজাতিক বা স্বাদেশিক প্রেরণা বশে ব্রিটিশকে বাধা দেবার চিন্তাও করেনি কেউ। সিপাহী বিদ্রোহের সুযোগও তাই নিতে চায়নি অনুগত ও অনুরক্ত রাজন্য কিংবা ইংরেজি শিক্ষিত সৃজ্যমান ধনী ও মানী সমাজ।
অতএব দৈশিক জাতীয়তাবোধ পাশ্চাত্যশিক্ষার দান। এই শিক্ষার মাধ্যমে দেশী লোকের মনে ক্রমে যে আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়, যে-জীবন-চেতনার উদয় ঘটে, তারই ফলে বিশ শতকের গোড়া থেকে স্বাধীনতার স্পৃহা ঘনীভূত হতে থাকে। এ স্পৃহা যে কেবল ব্রিটিশ ভারতেই জেগে ছিল তা নয়, বিশ শতকের উষাকাল থেকে গোটা দুনিয়ার শাসিত-শোষিত জনেরা দৈশিক জাতীয়তার মাধ্যমে মুক্তি ও সংগ্রামের সংকল্প গ্রহণ করেছিল। এই দৈশিক জাতীয়তার প্রেরণায় আরব মুসলিমরাও তুর্কী খলিফার আনুগত্য ও শাসন অস্বীকার করেছিল। অতএব স্বাধৰ্ম সংহতির সহায়ক নয়। আসলে ঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে সমস্বার্থ। এবং এই স্বার্থ সবক্ষেত্রেই ভৌগোলিক অবস্থানগত। পৃথিবীর সর্বত্র তাই আজ আঞ্চলিক ফলত ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ ও রাষ্ট্রচিন্তা প্রিয় ও প্রবল।
ব্রিটিশ ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানরাও–স্বাধ বশে নয়, সম-স্বার্থেই সংহত হয়েছিল সংখ্যাগুরু হিন্দুর প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে। সুযোগ ও সম্পদের নিরাপত্তা-বাঞ্ছই তাদেরকে সংহতি দিয়েছিল। ব্রিটিশ ভারতে এই অভিন্ন লক্ষ্যে নিয়োজিত তাদের সঙ্- শক্তি ফলপ্রসূ হয়েছিল। লক্ষ্য বা গন্তব্যের অভিন্নতা যে-সাহচর্য ও সহযোগিতার আবেগ ও আগ্রহ জাগিয়েছিল, গন্তব্যে উত্তরণের পর তাতে স্বভাবতই শৈথিল্য এল। এর কারণ দুটো। এক. সাফল্যে প্রয়াসের প্রেরণা এখন অপগত। দুই. আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা ও ভাষিক বিভিন্নতার দরুন সমস্বার্থের সমতল ভূমি এখন দুষ্প্রাপ্য।… কাজেই বন্ধনসূত্র এখন শিথিলগ্রন্থি। বৈষয়িক স্বার্থের যে-মানস-প্রেরণা সংহতি দিয়েছিল, দৃশ্যত তার বাহ্যিক আবরণ ছিল স্বাধর্ম। যদিও তা ত্রাণের বর্মরূপে ক্রিয়া করেনি, তবু বক্তব্যের আবরণ রূপে কেজো ছিল।
আমাদের এ ধারণার সমর্থনে সাক্ষ্যও রয়েছে। ইংরেজি শিক্ষা ও বিধর্মী-বিরল তখনকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থাৎ এখনকার পশ্চিম পকিস্তানে মুসলিম লীগের প্রচারণা সত্ত্বেও মুসলিম জাতীয়তার আহবানে সাড়া মেলেনি। এ আবেদন বিপুল বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল হিন্দু-অধ্যুষিত অঞ্চলের শোষিত মুসলিম সমাজে ও চাকুরি-বঞ্চিত শিক্ষিত মুসলিম মনে। কাজেই স্বাধর্মের অঙ্গীকার জাতীয়তার প্রতিজ্ঞায় প্রত্যয় ছিল না ব্রিটিশ ভারতের সর্বাঞ্চলের মুসলিম মনে। সুতরাং স্বাধর্মভিত্তিক জাতীয়তার নজির মেলে না ইতিহাসে।
অতএব রাষ্ট্রিক প্রয়োজনে মিলনের অন্য ময়দান খুঁজতে হবে। ইসলামের দোহাইতেও যখন আত্মীয়তা গড়ে উঠছে না, তখন ঐক্যের সূত্ৰ সন্ধান করতে হবে অন্যত্র ও অন্যভাবে। সুযোগ ও সম্পদের ক্ষেত্রে সুবিচার ও সমদর্শিতার অঙ্গীকারে অবশ্য মিলন স্থায়ী ও স্বস্তিকর করা সম্ভব। প্রীতিপ্রসূত পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভরসাই কেবল মিলন-রাখী অটুট রাখতে পারে। নইলে মিশর সিরিয়ার মিলনের মতো তা নশ্বর হতে বাধ্য। আজকের আরব রাষ্ট্রগুলো যেমন স্বতন্ত্র থেকেও স্ব স্ব স্বার্থে অভিন্ন শত্রু ইসরাইলকে ঘায়েল করবার জন্যে আরব জাতীয়তার নামে ও আবেগে ঐক্য ও সংহতি কামনা করছে, ব্রিটিশ ভারতেও স্ব স্ব আঞ্চলিক স্বার্থে মুসলিমরা স্বাধর্মের নামে আবেগ সঞ্চয় করে সঙ্বদ্ধ হতে চেয়েছিল আপাত উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই।
তাছাড়া ধর্মীয় জাতীয়তার পথে একটি গুরুতর সমস্যও রয়েছে। এক ধর্মের লোক কেবল এক অঞ্চলে বাস করে না, সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে। কাজেই স্বধর্মীকে নিয়ে যদি জাতি-চেতনা লালন করতে হয়, তাহলে রাষ্ট্রিক জাতীয়তা জন্মাতে পারবে না, অথচ এটি এ-যুগে রাষ্ট্রিক স্বার্থে জরুরী। তাছাড়া দুনিয়ার কোনো দেশেই কেবল এক ধর্মাবলম্বী বা এক মতাবলম্বী মানুষ বাস করে না। নানা জাত-মত ও বর্ণ-ধর্মের মানুষ নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরু ধর্মীয় জাতীয়তাই যদি রাষ্ট্রিক জাতীয়তার নামান্তর হয়, তাহলে রাষ্ট্রে বিধর্মীরা স্বাধীনতার স্বস্তি বা গৌরব বোধ করে না। তখন তারা সংখ্যাগুরুর পাশে থেকেও পড়শী হয় না। জাতীয় কিংবা সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক ঐতিহ্যে অনধিকার তাদেরকে প্রবাসীর মতো পর ও আশ্রিতের মতো অসহায় অনুগ্রহজীবী করে রাখে।
ফলে বাইরে তাদেরকে রাষ্ট্রানুগত দেখায় বটে, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক কারণেই অন্তরে থাকে বিরূপতা, এবং রাষ্ট্রের সঙ্কটকালে তা সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। পোল্যান্ড ও রাশিয়ার ইহুদী বিতাড়ন এবং প্রথম মহাযুদ্ধকালে জার্মান-ইহুদীর ভূমিকা এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে জার্মানিতে ইহুদী-নিধন এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য। এ যুগে জাতীয়তা দেশগত না হলে রাষ্ট্রিক জীবনে স্বস্তিকর হয় না।
এক্ষেত্রেও পূর্ব বাঙলার সমস্যা ও দুর্ভাগ্য বিবেচ্য। মুসলমানের পক্ষে ইসলামী শাসনতন্ত্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মতো কাম্য বিষয়েও নিহিত রয়েছে বাঙালি মুসলিমের অস্বস্তির ও অমঙ্গলের বীজ। এখানে অমুসলিম প্রতিবেশী নিয়ে ঘর করি আমরা। ইসলামী বিধি ও রাষ্ট্ৰাদর্শের অঙ্গীকারে যে নাগরিকত্বে আমাদের উল্লাস, তাতে তারা মনে মনে বঞ্চিতের বেদনা ও অপমানিতের ক্ষোভ অনুভব করে। এভাবে আমরা ঘরের মানুষকে পর ও বিরূপ করে তাদের প্রীতি ও শুভেচ্ছার ফসল থেকেই যে কেবল নিজেদেরকে বঞ্চিত করছি, তা নয়, আমাদের স্বস্তি-সুখও বিঘ্নিত ও বিপন্ন। থাকছে। মাঝে-মধ্যে বিধর্মী-হত্যা–যার ভদ্র নাম দাঙ্গা, এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। অতঃপর দেশপ্রাণতায় ও রাষ্ট্রানুগত্যে কী হবে তাদের প্রেরণার উৎস ও অবলম্বন? জিম্মি-জীবনের গ্লানি ঘুচবে কোন্ অনায়াসলভ্য চিত্ত-সম্পদের ঐশ্বর্যে? বিধর্মীবিরল পশ্চিম পাকিস্তানে এ সমস্যা অনুপস্থিত। তবে কী ইসলামী শাসনতন্ত্র ও রাষ্ট্রাদর্শ গ্রহণের মতো মহৎ অভিপ্রায়ের মধ্যেও ভেদনীতির প্রশ্রয়ে পূর্ব বাঙলায় স্থায়ী শাসন ও কায়েমী শোষণের অভিসন্ধি নিহিত!
পূর্বকালের রাজ্যে এ সমস্যা ছিল না। কেননা তখন রাজ্য ছিল রাজার, প্রজা ছিল শাসন শোষণের ও কৃপা-পীড়নের পাত্র। রাজ্য ছিল রাজার আয়ের ও আরামের জমিদারী। রাজস্বের জন্যেই তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান ও প্রজারক্ষণ। কেননা সুখ-সৌভাগ্যে যেমন থাকত তার একাধিকপত্য, তেমনি দুঃখ-দুর্ভাগ্যও তাঁকেই বহন করতে হত। আজ মানবাধিকারের সীমা দূরবিস্তৃত। তাই আজ মানুষ আর প্রজা নয়–পৌরজন। এ যুগে দেশগত বা রাষ্ট্রগত জাতীয়তা জরুরী নয় কেবল, রাষ্ট্রের ভিত্তিও। অতএব ধর্মীয় জাতীয়তা একটি আত্মধ্বংসী প্রতারক প্রত্যয়।