একটি পেরেকের কাহিনী – ৯

॥ নয় ॥

পুলিস অফিসার বারবার করে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগল বৈদ্যনাথকে, কোনো উত্তর নেই। অনেক ধমক, অনেক ভয় দেখানো হল, বৈদ্যনাথ বোবা হয়ে বসে আছে। শুধু বললে—‘আপনার টেবিলের টেলিফোনটি একবার ব্যবহার করতে দেবেন?’

অফিসার বললে—‘আপনার গুণ্ডার দলকে খবর দিতে চান তো? ওসব এখন হবে না! আজকের দিনটা তো লক-আপে থাকুন, পিস্তল কোথায় পেয়েছেন স্বীকার না করলে বেশ ভাল রকম কম্বল-ধোলাই হোক, তারপর দলবলকে খবর দেওয়া। তাছাড়া কাল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করার পর বেইল নেবার প্রশ্ন।’

অনেকক্ষণ ধরে বৈদ্যনাথকে অকথ্য-কুকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে পুলিস অফিসার ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। একটু বিশ্রাম নেবার জন্য টেবিলের উপর পা দুটো তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে মনের সুখে ধোঁয়া ছাড়ছিলেন। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভারটা তুলে নিলেন।

‘হ্যালো!’

ওদিক থেকে কী একটা কথা হতেই স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো অফিসার চেয়ারে খাড়া হয়ে বসলেন আর বলতে লাগলেন—‘হ্যাঁ স্যার, এখানেই আছে স্যার, ভালই আছে স্যার, এক্ষুনি নিয়ে যাচ্ছি স্যার, দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাচ্ছি স্যার, ও কিছু ভাববেন না স্যার।’

টেলিফোনটা রেখেই বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখে পুলিস অফিসার বললেন —‘ওরে বাবা! আপনি যে দেখছি খোদ কর্তার লোক! উঠুন, এক্ষুনি দশ মিনিটের মধ্যে আপনাকে খোদ কর্তার কাছে হাজির করতে হবে।’

পুলিস অফিসার রুমাল বার করে ভালো করে কপালের ঘাম মুছলেন, টেবিল থেকে হ্যাটটা মাথায় দিতে দিতে বললেন—‘গোড়াতে বললেই হত, মিছিমিছি আপনার উপর এত চোটপাট করলাম।’

বৈদ্যনাথ বললে—‘আপনি আমাকে টেলিফোন করতে দিলেন কোথায়!’

‘যাক, যা হবার হয়ে গেছে। আপনি মশাই দয়া করে কর্তার কাছে আমাদের বিরুদ্ধে আবার নালিশ করবেন না।’

বৈদ্যনাথ ঠিকই অনুমান করেছিল যে ডাঃ রায়ের কাছ থেকে তলব এসেছে। ওষুধ কোম্পানির বড় সাহেব নিশ্চয় টেলিফোন করে ডাঃ রায়কে খবরটা দিয়েছে। বৈদ্যনাথ অফিসারকে বললে—‘আপনাদের বিরুদ্ধে আমার কি বলবার থাকতে পারে, আপনারা আপনাদের কর্তব্যই করেছেন!’

রাইটার্স বিল্ডিং-এ ডাঃ রায়ের ঘরে পুলিস অফিসারের সঙ্গে ঢুকল বৈদ্যনাথ। ডাঃ রায় নিবিষ্ট মনে একটা চিঠি পড়ে ডিকটেশন দিচ্ছিলেন স্টেনোকে। থেমে গেলেন। বৈদ্যনাথের দিকে একবার তীক্ষ্ম দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিলেন। স্টেনোকে বললেন চলে যেতে, বললেন পুলিশ অফিসারকেও। পুলিস অফিসার স্যালুট দিয়ে বিদায় নিতেই ডাঃ রায় বজ্রগম্ভীর গলায় বললেন—‘তুমি আমার নাম ডুবিয়েছ বৈদ্যনাথ, আমার মুখে চুনকালি দিয়েছ। আমি ধারণাই করতে পারিনি তুমি এমন জঘন্য কাজ করবে।’

বৈদ্যনাথ নম্র কাতর কণ্ঠে বলল—‘আমার কথাটা একবার শুনবেন স্যার?’

ডাঃ রায় আরো গম্ভীর গলায় বললেন—‘আমি তোমার কোনো কথাই আর শুনতে চাই না। তুমি আমার সামনে থেকে এখনি চলে যাও।’

ডাঃ রায়ের চোখে মুখে একটা তীব্র বিরক্তি। বৈদ্যনাথ বুঝল ডাঃ রায়ের কাছে আর সে স্নেহের পাত্র নয়, ঘৃণার পাত্র। তবু আরেকবার সাহস করে বলল—‘আপনি আমার একটা কথাও কি শুনবেন না স্যার?’

‘না, একটা কথাও না।’ বজ্রকঠোর কণ্ঠের আদেশ। ‘তোমার সঙ্গে আর আমার কোনো সম্পর্ক নেই, থাকতে পারে না। তুমি যেতে পার।’

বৈদ্যনাথ নীরবে মাথা নীচু করে দরজা খুলে বেরোতে যাবে, ডাঃ রায় কাগজের উপর থেকে মুখ না তুলেই বললেন—‘যাবার আগে আর একটা কথা শুনে যাও। আর কোনদিন আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করো না।’ একটু থেমে চাপা অথচ দৃঢ়স্বরে বললেন—‘যাবার সময় দরজাটা নিজের হাতে বন্ধ করে চলে যেও।’

ডালহৌসি স্কোয়ারের রাস্তায় বেরিয়ে বৈদ্যনাথ বুঝতে পারল ডাঃ রায়ের দরজা তার কাছে চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে গেল। বিকেল পাঁচটা বেজে গিয়েছে। আপিস ছুটির পর বাড়ি ফেরার তাগাদায় লোকজন ব্যস্ত হয়ে ছুটে চলেছে, বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া বা তাগাদা নেই শুধু বৈদ্যনাথের।

রাইটার্স বিল্ডিং-এর পূর্ব পাশের গির্জার রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বৈদ্যনাথ। আজ এই জনাকীর্ণ শহরে সে নিঃসঙ্গ, অসহায়, আশাহত। সামনে অন্ধকার ভবিষ্যৎ, পিছনে ফেলে এল এক বিশাল মহীরুহের স্নেহাচ্ছাদন। কোথায় যাবে সে, তার গন্তব্য স্থল সে হারিয়েছে। সামনে কয়েক পা হেঁটে গেলেই ওষুধ কোম্পানির হেড আপিস। সে দরজাও চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ঘরে ফেরার আজ আর কোনো তাড়া নেই। ঘরে ফিরে মা’র কাছে, স্ত্রীর কাছে, পুত্র-কন্যাদের কাছে সে মুখ দেখাবে কি করে? চোখের সামনে বিরাট শূন্যতা নিয়ে কার্জন পার্কের নির্জন কোণায় চুপচাপ বসে রইল বৈদ্যনাথ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *