॥ আট ॥
এক মাস ছুটির পর বৈদ্যনাথ বিয়ে করে একাই কলকাতা ফিরে এসেছে। চেহারা দেখে চেনবার উপায় নেই। তসরের পাঞ্জাবি তাতে সোনার বোতাম, হাতে হাতঘড়ি, আঙ্গুলে সোনার আংটি। এ বৈদ্যনাথ আরেক মনুষ।
ডাঃ রায়ের সঙ্গে দেখা করতেই বললেন—‘বুঝেছে। বৈদ্যনাথ, তোমার চেহারা আর সাজপোশাক দেখে এই বুড়ো বয়সে আমারো লোভ হচ্ছে। এই অপাত্রে কেউ পাত্রী দেবে না, এই যা দুঃখ। তা কেমন বউ হল বল। পছন্দ হয়েছে তো?’
বৈদ্যনাথ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল, মুখে সলজ্জ হাসি।
ডাঃ রায় হাসতে হাসতে বললেন—‘বুঝেছি, পছন্দ তা হলে হয়েছে। স্বাস্থ্য ভালো তো?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘মা খুশি হয়েছেন?’
‘মা খুবই খুশি।’
ডাঃ রায় মৃদু হেসে বললেন—‘এবার মাকে আর বউমাকে কলকাতায় নিজের কাছে এনে রাখো।’
পুজোর সময় ক’দিনের ছুটিতে দেশে গিয়ে বৈদ্যনাথ মা ও স্ত্রীকে কলকাতায় এনে তুলল বেলেঘাটার বাড়িতে। এখন আর বৈদ্যনাথকে ডালহৌসির হেড অফিসে যেতে হয় না, শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের দোকানে ঘুরে ঘুরে ওষুধের স্টক মিলিয়ে রিপোর্ট দেওয়াই একমাত্র কাজ। এই কাজ করতে করতেই ও টের পেয়েছিল যে করনক্ সাহেব বড়বাবুর সঙ্গে যোগ-সাজসে এক বিরাট চুরির জাল বিস্তার করে কোম্পানিকে ফোঁপরা করে এনেছে, কিন্তু হাতেনাতে ধরা পড়ার মতো কোনো নজির কোথাও রাখেনি। ইতিমধ্যে বৈদ্যনাথের মাইনে আরো কুড়ি টাকা বেড়ে আশী হয়েছে, এখন ওর বেশ স্বচ্ছল অবস্থা। অল সেকশন ট্রামের টিকিট, যখন খুশি যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ায়, সময়ে অসময়ে বিভিন্ন দোকানে গিয়ে স্টক চেক করে। চুরির আঁচ পেলেও বড় প্রমাণ পাচ্ছে না বলে করনক্ সাহেবকে ও ঘাঁটায় না, তক্কে তক্কে আছে।
ডাঃ রায় তখন একজন সর্বশ্রেষ্ঠ ডাক্তারই শুধু নন, আজ তিনি সর্ব-ভারতীয় নেতা। প্রতিদিন সকালে বৈদ্যনাথ ডাঃ রায়ের বাড়ি যায়, কিন্তু কথা বলার ফুরসত বড় একটা হয় না। এদিকে বেলেঘাটায় যে পাড়ায় বৈদ্যনাথ থাকে সেখানে ওর খাতির সম্মান বেড়ে গেছে, যেহেতু সে ডাঃ রায়ের প্রিয়পাত্র। তাঁর বাড়িতে ওর নিত্য যাওয়া-আসা এ-খবরটা পাড়ার ছেলেছোকরা থেকে মাতব্বরদেরও জানা হয়ে গিয়েছে। পাড়ার পুরোনো বাসিন্দা অঘোরবাবু কঠিন অসুখে তিন মাস শয্যাশায়ী। অত্যন্ত গরিব। বড় ডাক্তার ডেকে দেখাবার সামর্থ্য নেই, ধরপাকড়ের মাতব্বরেরও অভাব। পাড়ার ডাক্তার হাল ছেড়ে দিয়ে বলে গেল, বৈদ্যনাথবাবুকে ধরে একবার ডাঃ রায়কে দেখান। অঘোরবাবুর স্ত্রী বৈদ্যনাথের মা’র কাছে কেঁদে পড়ল। বৈদ্যনাথ আজ পর্যন্ত এসব ব্যাপারে ডাঃ রায়কে কখনো কোনোদিন অনুরোধ করেনি, কিন্তু মায়ের পীড়াপীড়িতে ডাঃ রায়কে সে-কথা বলতে বাধ্য হল।
ডাঃ রায় সব শুনে বললেন—‘তোমার মা যখন কথা দিয়েছেন, যতই কাজ থাক, আমাকে যেতেই হবে। আজই বিকেলে যাব, পাঁচটার সময় এসে আমাকে নিয়ে যেয়ো। যে-ডাক্তার এতদিন ওঁর চিকিৎসা করছিলেন তাঁকে থাকবার জন্যে একটা খবর পাঠিয়ে দাও।’
বিকেল বেলা বৈদ্যনাথ এসে ডাক্তার রায়কে নিয়ে গেল বেলেঘাটায় রুগীর বাড়ি। ভাল করে পরীক্ষা করে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করে দিয়ে যে-ডাক্তার দেখছিলেন তাঁকে বললেন—‘বৈদ্যনাথকে দিয়ে খবর পাঠাবে রুগী কেমন থাকে না থাকে।’
রুগীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠবার সময় বৈদ্যনাথ বলল— ‘স্যার, আমার বাড়ি তো এই পাড়ায়, বেশী দূর নয়। যদি একবার আসেন—’
বৈদ্যনাথের পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে ডাঃ রায় বললেন—‘হবে হবে। এ-বাড়িতে নয়, তুমি যখন নিজে বাড়ি করবে তখন সেই বাড়িতে যাব।’
কথাটা বৈদ্যনাথের মনের মধ্যে গেঁথে গেল। কঠিন সংকল্প সে করল, ডাঃ রায়কে ওর বাড়িতে একদিন আনতেই হবে। ইতিমধ্যে ভবানীপুরে একটা ফ্ল্যাট পেয়ে গেল বৈদ্যনাথ। দু’খানা ঘর, ভাড়া চল্লিশ টাকা।
কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের চেহারা গেল পালটে। ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, বাংলাদেশ দ্বিখণ্ডিত। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় এখন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী। সকাল বেলা আর বৈদ্যনাথের ডাঃ রায়ের বাড়ি যাবার প্রয়োজন হয় না, একমাত্ৰ ছুটির দিন ছাড়া। ভবানীপুরের ফ্ল্যাটের চেহারা বদলেছে। দুই ঘরে পাখা এসেছে, রেডিও-সেট এসেছে, নিয়ন বাতি জ্বলছে। স্ত্রীর গায়ে সোনার গয়নাও উঠেছে। বৈদ্যনাথ এখন দুটি সন্তানের পিতা। ইতিমধ্যে এক কাণ্ড ঘটে গেল।
বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে সাহেব-পাড়ায় কোম্পানির যে ওষুধের দোকান আছে, সেখানে হিসেবের প্রচুর গলদ ধরা পড়েছে। বড় সাহেব বৈদ্যনাথকে ভার দিলেন সে-দোকানের সব স্টক আর পুরোনো ক্যাশ মেমো ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে। রাত আটটায় দোকান বন্ধ হয়ে গেলে বৈদ্যনাথের কাজ শুরু হয়, রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে পরীক্ষা করে, অবশেষে নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে সে বাড়ি ফেরে। পুরোনো কাগজপত্র দেখতে দেখতে বেরিয়ে পড়ল করনক্ সাহেবের চোরাকারবারের মোক্ষম প্রমাণ। হেড আপিসের নির্দেশে কারখানা থেকে যে-মাল দোকানে এসেছে তার কোনো নির্দেশ হেড আপিসের খাতায় নেই, দোকানের খাতায়ও তার এনট্রি নেই। অথচ কারখানার চালানে দেখা যাচ্ছে হেড আপিসের খাতায় যে-মাল এই দোকানে ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে বলে এনট্রি করা আছে তার চারগুণ মাল প্রতি মাসে এই দোকানে এসেছে, অথচ খাতাপত্রে দেখানো হয়েছে যে স্টকে যা মাল ছিল তা খালি হয়নি বলেই মাল পাঠানো হচ্ছে না। এক দোকানের এই গরমিল ধরা পড়তেই ভবানীপুর ও শ্যামবাজারের দোকানে খোঁজ নিয়েও বৈদ্যনাথ দেখল সেখানেও ঐ একই ব্যাপার।
আর কালক্ষেপ না করে বৈদ্যনাথ নথিপত্রের প্রমাণসহ এক গোপন রিপোর্ট সরাসরি পাঠিয়ে দিল ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কাছে। কিছুদিনের মধ্যেই তোলপাড় হয়ে গেল হেড আপিসে। করনক্ সাহেব ডি-গ্রেডেড হলেন—শুধু তাই নয়, অনুকম্পাবশত বড় সাহেব তাকে পুলিসে ধরিয়ে দেননি বটে, বহু টাকার খেসারৎ দাবী করলেন এবং করনক্ সাহেব আর বড়বাবুকে খেসারতের টাকা দিতেও হল। করনক্ সাহেব টের পেয়েছিলেন যে এ-কাজটা বৈদ্যনাথ ছাড়া আর কারুর নয়। রাগে গজরাতে লাগলেন তিনি, সুযোগ পেলে প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বেন না।
সুযোগ পেয়েও গেলেন। চাঁদপুর থেকে বৈদ্যনাথের মামা তার কাছে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, প্রাণ আর সম্মান নিয়ে ওদেশে এখন আর বাস করা অসম্ভব। আতঙ্কে দিনেরাত্রে ওদের চোখে ঘুম নেই। চিঠি পেয়েই মা কেঁদে পড়লেন বৈদ্যনাথের কাছে।
‘একবার যা বৈদ্যনাথ, দেখে আয় ওরা কী অবস্থায় আছে। হাজার হোক আপন মামা, এই বিপদে তুই ছাড়া ওদের আর দেখবার কে আছে!
মায়ের অনুরোধ, এড়ানো কঠিন বড়। দশ দিনের ছুটি নিয়ে চলে গেল বৈদ্যনাথ প্রথমে ঢাকায়। ডা: রায়ের দৌলতে সুরাবর্দী সাহেব ও ফজলুল হকের সঙ্গে পরিচয় ছিল বৈদ্যনাথের। দুজনের কাছ থেকেই চিঠিপত্র নিয়ে চাঁদপুরে এসে এস ডি ও-র সঙ্গে দেখা করল। এস ডি ও প্রচুর খাতির সম্মান করলেন বৈদ্যনাথকে। এমন কি নিজে বৈদ্যনাথের মামার সঙ্গে দেখা করে অভয় দিয়ে বললেন যে, ওঁরা নিশ্চিন্ত হয়ে চাঁদপুরে থাকতে পারেন। গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগতে দেবেন না। এই সব বন্দোবস্ত করে কলকাতায় ফিরতে দশ দিনের জায়গায় হয়ে গেল বাইশ দিন। ইত্যবসরে করনক্ নতুন সেলস্ ম্যানেজারকে হাত করে ফেলেছে, তাকে বুঝিয়েছে বৈদ্যনাথকে এ আপিস থেকে না তাড়াতে পারলে নেটিভের হাতে ওদের পদে পদে অপমান সহ্য করতে হবে।
চাঁদপুর থেকে ফিরে এসে প্রথম সে গেল হেড আপিসে। সেখানে গিয়েই সে শুনতে পেল তার নামে নাকি চার্জ—শীট আনা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে—সে কাজে ফাঁকি দেয়, উপরন্তু উইদাউট নোটিশ সে বারো দিন আপিস কামাই করেছে। বৈদ্যনাথ সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিল যে এটা করনকের কীর্তি। খবরটা শুনে সে প্রথমে সেলস্ ম্যানেজারের ঘরে যেতেই তিনি বড় সাহেবের সই-করা চার্জশীট তার হাতে তুলে দিলেন। রাগে ক্ষোভে দুঃখে বৈদ্যনাথের হাত-পা ঠক ঠক করে কাঁপছে। বললে—‘চাঁদপুর থেকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম যে আমার ফিরতে দিন দশ-বারো দেরী হতে পারে।’
ম্যানেজার বললেন—‘সরি, আমাদের দফতরে তোমার কোনো চিঠি এসে পৌঁছয়নি।’
বৈদ্যনাথের আর বুঝতে দেরী হল না যে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে জোট পাকিয়ে, এই চার্জ-শীট আনা হয়েছে এবং করনক্ সাহেবই এর মূলে।
বৈদ্যনাথের মাথায় তখন রক্ত চড়ে গেছে। একবার মনে করল সটান বড় সাহেবের কাছে গিয়ে সে কৈফিয়ৎ চাইবে। পরক্ষণেই তার অভিমানে ঘা লাগল। চার্জ শীট-এ বড় সাহেব যখন সই করেছেন তখন বিশ্বস্ততার কোনো মূল্যই এদের কাছে নেই। এ আপিসে আর একদিনও তার পক্ষে চাকরি করা সম্ভব নয়, তা সে আগেই বুঝে গিয়েছিল। তবু চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে যাবার আগে করনকের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নিতে হবে!
ম্যানেজারের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঝড়ের বেগে সুইং ডোর খুলে করনকের ঘরে ঢুকেই বৈদ্যনাথ ফেটে পড়ল। বৈদ্যনাথের চোখে মুখে একটা হিংস্র মারমূর্তি ভাব। চাপা আক্রোশপূর্ণ কণ্ঠে বৈদ্যনাথ বললে—‘আমার নামে মিথ্যা চার্জ—শীট দিয়েছ কেন?’
করনক্ নির্বিকার কণ্ঠে উত্তর দিল—‘আমি কি জানি। আস্ক দি ম্যানেজার।’
‘কিন্তু আমি জানি, তোমার ইন্ষ্টিগেশনেই এটা করা হয়েছে।’
করনক্ আবার মোলায়েম কণ্ঠে বললে—‘বিকজ ইউ আর গিল্টি।’
টেবিলের উপর প্রচণ্ড ঘুষি মেরে চীৎকার করে উঠল বৈদ্যনাথ— ‘হোয়াট? চুরি করবে তোমরা আর সেই চোর ধরিয়ে দেবার জন্যে গিলটি হলাম আমি?’
করনক্ প্রথমে ঘাবড়ে গেল বৈদ্যনাথের মারমূর্তি দেখে। ওদিকে চীৎকার শুনে আপিসের বয়, বেয়ারা ও অন্যান্য কেরানীরা ছুটে এসেছে। করনক্ তখন বীরত্ব দেখাবার জন্য গর্জন করে উঠল—‘গেট আউট ফ্রম মাই রুম ইউ সোয়াইন। ডাঃ রায়ের লোক বলে তুমি যে আমাদের উপর চোখ রাঙাবে তা চলবে না।’
বৈদ্যনাথ বললে—‘ডাঃ রায়ের নাম উচ্চারণ করেছো তো তোমার জিভ ছিঁড়ে ফেলে দেব।’
করনক্ মুখটা যতদূর সম্ভব বিকৃত করে বললে—‘রেখে দাও তোমার ডাক্তার রায়।’ এই বলেই করনক্ এমন কতগুলি কথা বলল যে বৈদ্যনাথ দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হয়ে এক কাণ্ড করে বসল। পোর্টফোলিও ব্যাগ ছিল ওর হাতে। সেটা খুলেই খোপ থেকে একটা পিস্তল ক্ষিপ্রবেগে বের করেই করনকের কপাল লক্ষ করে একেবারে খাস চাঁদপুরী জবানীতে চীৎকার করে বলল—‘আইজ তরে শ্যাশ করুম কুত্তার বাচ্চা। তরে আইজ আমি মাইরাই ফালামু।’
করনক্ এক লাফে ঘর থেকে বেরিয়েই হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে চেঁচাচ্ছে, ‘হেল্প, হেল্প।’
পিছনে পিস্তল নিয়ে তাড়া করেছে বৈদ্যনাথ, মুখে এক কথা—‘তরে আইজ মাইরাই ফালামু।’
অফিসের যে বেয়ারাগুলি প্রথমে এ-দৃশ্য দেখে হক্চকিয়ে গিয়েছিল, পরমুহূর্তেই তারা একজোটে ঝাঁপিয়ে পড়ল বৈদ্যনাথের উপর। ওদিকে সঙ্গে সঙ্গে লালবাজারে ফোন করে দেওয়া হয়েছে, পুলিস এসে পিস্তলসহ বৈদ্যনাথকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল।