॥ দুই ॥
ছেলেবেলায় বেশ কিছুকাল আমাকে পূর্ববঙ্গে চাঁদপুর শহরে কাটাতে হয়েছিল। কাজের উপলক্ষে বাবাকে প্রায়ই চাঁদপুর যেতে হত, মাঝে মাঝে আমিও যেতাম। চাঁদপুরে পুরান বাজারে আমার এক দূর সম্পর্কের পিসি থাকতেন, তাঁর কাছে আমাকে রেখে বাবা বেরিয়ে পড়তেন গ্রাম থেকে গ্রামে আদায়পত্তরের কাজে। ওখানে সঙ্গী সাথী বড় একটা কেউ আমার ছিল না। আমি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার গ্রামের ছেলে, তাই স্বাভাবিক সংকোচবশতই সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গ এড়িয়ে চলতাম। যে পাড়ায় থাকতাম সেই পাড়ারই কয়েকটা বাড়ির পরে থাকত বৈদ্যনাথ। মায়ের একমাত্র সন্তান, সে-ও আমারই মতো নিঃসঙ্গ। তার একটা কারণও ছিল। বৈদ্যনাথের জন্মের পর ওর বাবা স্ত্রী-পুত্র পরিত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়। নিঃসহায় নিঃসম্বল মা একমাত্র পুত্র বৈদ্যনাথকে বুকে করে আশ্রয় নিলেন ভাইয়ের বাড়িতে। উদয়াস্ত পরিশ্রম, তবু লাঞ্ছনার শেষ নেই। জ্ঞান হওয়া অবধি মায়ের নীরব চোখের জল শুধু দেখেছে বৈদ্যনাথ কিন্তু কারোর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে কখনো শোনেনি।
বৈদ্যনাথ ইস্কুলে যেত আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে। গায়ে তালি দেওয়া ইজের-কামিজ, কিন্তু তার জন্য কোনো সংকোচ ওর ছিল না। তেজী ও তাজা ঘোড়ার বাচ্চার মতন ছুটতে ছুটতে ও স্কুলে যেত, আবার ছুটতে ছুটতেই ফিরত।
এক শনিবার দুপুরে স্কুল থেকে ফিরছে, রাস্তায় ওকে ধরলাম।
‘ভাই, চাঁদপুর স্টীমারঘাটে আমার বড় বেড়াতে যাবার ইচ্ছে কিন্তু পিসিমা আমাকে একা যেতে দিতে চান না। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে?’
আমার অনুরোধ তাকে বেশ কিছুটা অবাক করে দিল। আমাকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বললে—‘তুমি কলকাতা থেকে এসেছ?’
‘না, ঠিক কলকাতা নয়, এসেছি বর্ধমান থেকে। তবে কলকাতা হয়ে যাওয়া-আসা করতে হয়।’
রাজী হয়ে গেল বৈদ্যনাথ। বললে, ‘আমি একবার মাকে বলে এক্ষুনি আসছি।’।
ছুটে চলে গেল বৈদ্যনাথ। পিসিমাকে কথাটা বলতেই খুশি হয়ে বললেন—‘বৈদ্যনাথ বড় ভাল ছেলে। ওর মায়ের দুঃখের শেষ নেই, কিন্তু এই ছেলের মুখ চেয়ে নীরবে সব সহ্য করছে।’
কিছুক্ষণ পরেই বৈদ্যনাথ এল। পিসিমা সস্নেহে মুড়ি-নারকোল খেতে দিলেন, বৈদ্যনাথ কিছুতেই খাবে না। অনেক সাধ্যসাধনার পর দুজনে একসঙ্গে খেলাম, কিন্তু এটা ওর মনঃপূত নয় তা বুঝতে বিলম্ব হয়নি।
রাস্তায় চলতে চলতে কলকাতা সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করে গেল বৈদ্যনাথ। ওর ছোটো মামা কলকাতায়। পুজোর ছুটিতে যখন বাড়ি আসে তখন তার কথাবার্তা, চালচলন, সাজপোশাক দেখে বৈদ্যনাথ ধারণা করে নিয়েছে যে কলকাতায় গেলেই অনেক টাকা রোজগার করা যায়, বড়লোক হওয়া যায়, আর বড়লোক হতে পারলে বাড়িতে আদর যত্ন খাতির সম্মান তার বেশি।
ওর ছেলেমানুষী নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে দুজনে স্টমারঘাটায় যখন এসে পৌঁছলাম তখন বিকেল হয়েছে। মেঘনা নদীর কূল দেখা যায় না, সমুদ্রের মতই বিশাল। দূরে মাঝনদীতে স্টীমার চলে যাচ্ছে, বৈদ্যনাথ সেই দিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
মেঘনা নদীর বুকে সোনার আলো ছড়িয়ে সূর্য অস্ত যেতেই আমরা উঠে পড়লাম। ফেরার পথেও বৈদ্যনাথ কলকাতা সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করল, জানবার কৌতূহল তার অসীম। বৈদ্যনাথের সঙ্গে সেদিন আমার প্রথম পরিচয়, সে-পরিচয় অচিরে গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হল। সেদিন থেকে বৈদ্যনাথই ছিল আমার নিত্যসঙ্গী।
মাস দুই পর চাঁদপুরে আদায়পত্তরের কাজ শেষ করে বাবা চলে এলেন নিজেদের গ্রামে। বিদায় দেবার জন্যে স্টমারঘাট পর্যন্ত এসেছিল বৈদ্যনাথ। যতক্ষণ স্টীমার দেখা যায় সে জেটী থেকে এক পাও নড়েনি।