॥ এক ॥
উনিশ শ বাষট্টি সাল, পয়লা জুলাই।
পশ্চিমবাংলার বুকের উপর দিয়ে গত পনেরো বছর যে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে চলেছে সেই ঝড়ে বিরাট মহীরুহের অকস্মাৎ পতন ঘটল।
পয়লা জুলাই, রবিবার। সূর্য তখন মাথার উপর। নির্মেঘ নীলাকাশ। বিনা মেঘে বজ্রপাত যদিও হয়নি কিন্তু বিদ্যুতের চেয়েও সূক্ষ্ম এক অদৃশ্য শক্তিতরঙ্গে প্রচারিত একটি সংবাদে কলকাতা মহানগরী স্তম্ভিত।
নতুন বাংলার রূপকার কর্মযোগী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় অপ্রত্যাশিত ভাবে মৃত্যুর কোলে চির বিশ্রাম নিলেন তাঁরই জন্মজয়ন্তী উৎসবের দিনে। তড়িতাহত হওয়ার মতই তীব্র অতর্কিত সে সংবাদের আঘাতে অসংখ্য সমস্যাপীড়িত দেশকে এক মুহূর্তে এক অখণ্ড সত্তায় বিচলিত হয়ে উঠতে দেখলাম। এই মহীরুহের আশ্রয়ে নিশ্চিন্ত ছিল আঘাত-সংঘাতে জর্জরিত পশ্চিম বাংলার সাড়ে তিন কোটি নরনারী। আজ তারা আশ্রয়হীন, শোকবিহবল। তাদের নীরব ক্রন্দন আমি শুনেছি, আমি দেখেছি মহানগরীর উদ্বেল জনতাকে শান্ত হয়ে নম্র হয়ে তাদের মহানায়ককে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
পরদিন সকালে বিষণ্ণ ও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে ডাঃ রায়ের কর্মজীবনের ঘটনাবলী ও আলোকচিত্র দেখতে দেখতে একটা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরছে—এই অসাধারণ মানুষটির প্রতি আমার শেষ প্রণতি কী ভাবে নিবেদন করব। জনতার ভিড়ের সঙ্গে মিশে যেতে পারলে, তাদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারলেই আমি তৃপ্তি পেতাম। কিন্তু ভিড় আমি চিরকাল ভয় করি। কোলাহল থেকে দূরে থাকাই আমার স্বভাব।
সেদিনের প্রায় সবগুলি দৈনিক সংবাদপত্র আমার সামনে খোলা। বাংলার এই মহানায়কের বিদায়-দিনে প্রত্যেকটি কাগজের প্রথম পাতায় অষ্টকলমব্যাপী হেড লাইনে লেখা হয়েছে—
“নবীন বাংলার রূপকার বিধানচন্দ্রের তিরোধান”
“অমিতবীর্য প্রবীণতম মহানায়কের ত্যাগ ও কর্মদীপ্ত জীবনের অবসান…”
“জন্মদিন মৃত্যুদিন; একাসনে দোঁহে বসিয়াছে, দুই আলো মুখোমুখি মিলেছে জীবন প্রান্তে।”
তাঁর আবির্ভাব-দিনেও এমনি ‘হেড লাইন’ নিয়েই তিনি এসেছিলেন। বাংলার রাজনৈতিক জীবনে প্রথম অবতীর্ণ হলেন ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় ১৯২৩ সালের পয়লা ডিসেম্বর।
আনন্দবাজার পত্রিকায় হেড লাইন বেরোলোরঃ
“নির্বাচনের ফলাফল
মন্ত্রীদের কেল্লাফতে
সুরেন্দ্রনাথ কুপোকাত…”
সারা ভারতের সংবাদপত্রেই সেদিন ডাক্তার বিধানচন্দ্র ছিলেন এক বিস্ময়কর শ্রেষ্ঠ সংবাদ। অমৃতবাজার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাব্যাপী বড় বড় অক্ষরে ছিল চারটি লাইনঃ
“Sri Surendranath Banerjee Defeated.
An object lesson to Supporters of Bureaucracy.
Dr. Bidhanchandra Roy Elected.
People’s Victory in Barrackpore.”
ব্যারাকপুরে স্বরাজ্য দল সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী বিধানচন্দ্র সেদিন যাঁকে পরাজিত করে প্রথম আইনসভায় প্রবেশ করেছিলেন তিনি ছিলেন বাংলার মুকুটহীন রাজা রাষ্ট্রগুরু স্যার সুরেন্দ্রনাথ।
রেডিওটা খোলা। ধারাবিবরণীর ঘোষক আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বলে চলেছেন শোকযাত্রার মর্মস্পর্শী দৃশ্য। রাস্তায় রাস্তায় উত্তাল জনসমুদ্র, ফুলের তোড়া আর ফুলের মালা শবাধারকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বেতার ঘোষণায় বলা হল বেলা ১১টায় শবাধার রাসবিহারী অ্যাভিনিউর মোড়ে এসে পৌঁছবে। বাড়ির সবাই চলে গেছে। এক পরিচিত ভদ্রলোকের গাড়ি-বারান্দার ছাতে দাঁড়িয়ে তারা ডাঃ রায়কে শেষ দেখা দেখবে। একা বাড়িতে বসে খবরের কাগজের পাতাগুলির উপর চোখ বুলিয়ে চলেছি। বিদায় নেবার আগের দিনের একটি কৌতুককর ঘটনার বিবরণ বেরিয়েছে সংবাদপত্রে।
শনিবার রাজ্যপাল শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু এসেছেন অসুস্থ মুখ্যমন্ত্রীকে দেখতে। তিনি বললেন—‘কাল আপনার জন্মদিন, অনেক লোকের ভিড় হবে। আপনি কিন্তু কারও সঙ্গে দেখা করবেন না আবার।’
—‘কেন?’ কারণ জানতে চাইলেন বিধানচন্দ্র।
—‘কারণ, স্বাস্থ্য।’ রাজ্যপাল ধীরস্বরে জবাব দিলেন।
—‘আপত্তি যদি স্বাস্থ্যগত কারণেই হয় তবে সম্ভবত আমি তোমার চেয়ে যোগ্যতর বিচারক। নয় কি?’ ডাঃ রায় লঘুভাবে বিতর্কের উদ্বোধন করলেন। শ্ৰীমতী নাইডু জানেন, তর্কে ডাঃ রায়ের সঙ্গে পেরে ওঠা দায়। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ডাঃ রায়ের ভ্রাতুস্পুত্র সুবিমল রায়।
রাজ্যপাল অসহায়ের মতো তাঁর দিকে তাকালেন।
—‘আপনি তো একজন মস্তবড় ব্যারিস্টার মিঃ রায়। আচ্ছা আপনিই বলুন এ-বিষয়ে আমাদের শাসনতন্ত্র কি বলে? কোনো রাজ্যের চীফ মিনিস্টার কি সে রাজ্যের গভর্নরের আদেশ অমান্য করতে পারেন?’
এবার হাল ছাড়তে বাধ্য হলেন ডাঃ রায়। হাসতে হাসতে বললেন— ‘আচ্ছা, তাই হবে। মাননীয় রাজ্যপাল যখন আদেশ করছেন—’
বিজয়িনী রাজ্যপালের দুই চোখ খুশিতে উজ্জ্বল।
একদিন এই খুশিই দেখা গিয়েছিল আমাদের রাজ্যপালের জননী স্বৰ্গতা সরোজিনী নাইডুর চোখে মুখে। তবে বিজয়ের গর্বে নয়, পরাজয়ের গৌরবে।
এলাহাবাদের ‘আনন্দ ভবনে’ অন্তরঙ্গদের আসর বসেছে। উপস্থিতদের মধ্যে আছেন গান্ধীজী, ডাঃ আনসারী, বিধানচন্দ্র এবং সরোজিনী নাইডু।
হঠাৎ সরোজিনী দেবী বলে উঠলেন—‘ডাঃ রায়, বয়স তো আপনার পঞ্চাশে পৌছল। কিন্তু কী আশ্চর্য, এখনও দেখছি হাসলে আপনার গালে টোল পড়ে।’
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন ডাঃ রায়—
‘আর আপনি তো জানি পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু কী আশ্চর্য, এ-সব আপনার নজর এড়ায় না!’
গান্ধীজী সেদিন হো হো শব্দে হেসে উঠেছিলেন।
এই ছোট্টো কৌতুককর ঘটনাটি পড়বার পরই মনে পড়ে গেল দূর অতীতের আর এক কাহিনী। সেদিনও মহাত্মা গান্ধী বিধানচন্দ্রের কথায় এই ভাবেই সশব্দে হেসে উঠেছিলেন।
গান্ধীজীর সঙ্গে বিধানচন্দ্রের প্রথম পরিচয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর তাঁর ভবানীপুরের বাড়িতে। তার আগে গান্ধীজীকে আরও দুবার তিনি দেখেছেন। একবার ১৯২৫ সালে মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর বাসভবনে, আর একবার, তার পাঁচ বছর পরে, ওয়েলিংটন স্কোয়ারে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে। কিন্তু সাক্ষাৎ পরিচয় সেই প্রথম। আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন বাসন্তী দেবী। সেইদিন থেকেই বিধানচন্দ্র মহাত্মা গান্ধীর একজন একনিষ্ঠ অনুরক্ত শিষ্য হয়ে গেলেন। যখনই যেখানে গান্ধীজীর অসুস্থতার সংবাদ পেতেন সেখানেই তাঁর শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়।
আগস্ট আন্দোলনের পরের কথা। গান্ধীজী তখন পুণায় আগা খাঁর গৃহে বন্দী। ক’দিন আগে সবে তিনি তাঁর একুশ দিনের অনশনব্রত ভঙ্গ করেছেন। ডাঃ রায় সেবারেও তাঁকে দেখে গিয়েছেন। এবার নিজের কাজেই তিনি বোম্বাই এসেছিলেন, ভাবলেন একবার মহাত্মার সঙ্গে দেখা করে যাই।
কিন্তু বিধানচন্দ্রকে দেখে গান্ধীজী খুশি হলেও তাঁর চিকিৎসার প্রস্তাব শুনে মোটেই খুশি হলেন না। বললেন—
‘ডাক্তার, তোমার চিকিৎসা তো আমি নিতে পারি না।’
—‘আমার অপরাধ?’ জানতে চাইলেন বিস্মিত বিধানচন্দ্র।
‘আমার দেশের চল্লিশ কোটি দীন-দুঃখীর অসুখে যখন চিকিৎসা করতে পার না, তখন আমিই বা তোমার চিকিৎসা কেন নেব?’ সহজ সরল বিশ্বাস নিয়েই উত্তর দিলেন গান্ধীজী।
ডাঃ রায় বললেন—‘ও, এই কথা! আমি চল্লিশ কোটি নরনারীর চিকিৎসা করতে পারি না সত্য—কিন্তু এই চল্লিশ কোটি মানুষের আশা-ভরসা যিনি, যিনি বাঁচলে চল্লিশ কোটি বাঁচবে—তাঁর চিকিৎসার ভার তারাই আমার হাতে তুলে দিয়েছে। সুতরাং আপনি আপত্তি করলেও আমি তা মানব কেন?’
গান্ধীজীর মুখে এবার কৌতুকের হাসি দেখা দিল। তিনি বললেন—
‘আচ্ছা, তা না হয় হল। কিন্তু ডাক্তার, তোমার অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা আমি মেনে নিতে পারি না।’
তৎক্ষণাৎ ডাঃ রায় বললেন—‘মহাত্মাজী, আপনিই না বলেন পৃথিবীর সব কিছু, এমন কি ধূলিকণাটি পর্যন্ত ঈশ্বরের সৃষ্টি।’
‘নিশ্চয়; এবং অন্তরের সঙ্গে এ-কথা আমি বিশ্বাস করি।’ দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিলেন গান্ধীজী।
এবারে বিধানচন্দ্রের পাল্টা জবাবের পালা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন—
‘তাহলে মহাত্মাজী, অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসাও কি তাঁর সৃষ্টি নয়?’
এবার মহাত্মাজী হেসে বললেন—‘তোমার উকিল-ব্যারিস্টার হওয়া উচিত ছিল ডাক্তার।’
সপ্রতিভ ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় বললেন—‘ভগবান তা না করে আমাকে চিকিৎসক করেছেন, কারণ তিনি জানতেন, এমন একদিন আসবে যেদিন তাঁর সেরা ভক্ত মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর চিকিৎসার ভার আমার উপর পড়বে।’
হো হো শব্দে হেসে উঠলেন গান্ধীজী। বিধানচন্দ্রকে সস্নেহে কাছে টেনে নিয়ে বললেন—‘তোমার সঙ্গে পেরে ওঠা দায়। কি ওষুধ দেবে দাও, খাই।’
কখন বেলা দশটা বেজে গিয়েছে টের পাইনি। আমার বাড়ির ছোকরা চাকর কালিদাস বললে—‘দাদাবাবু, আপনার কি বেরোতে দেরী হবে?’
‘কেন বল তো?’
সঙ্কোচের সঙ্গে কালিদাস বললে—‘আপনার যদি আপিসে বেরোতে দেরী থাকে আমি তাহলে ছুটে গিয়ে একবার ডাক্তারবাবুকে দেখে আসতাম। কোনোদিন তাঁকে দেখি নাই।’
অবাক বিস্ময়ে কালিদাসের মুখের দিকে তাকালাম। চব্বিশ পরগণার এক অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে কালিদাস। কলকাতা শহরে প্রথম এসে আমার বাড়িতেই কাজে লেগেছে আজ সাত-আট মাস হল। শহরের সে কিছুই জানে না, চেনে না। ডাঃ রায় কে ছিলেন, কিছুই তার জানবার কথা নয়। তবু তার দিকে তাকিয়ে মনে হল সে-ও যেন তার আপনজনকে হারিয়েছে! তার বিষণ্ণ মুখ আর ব্যথাতুর দৃষ্টি সেই স্বাক্ষর বহন করছে।
‘আমার আপিসের জামাকাপড় গুছিয়ে দিয়ে তুই চলে যা। আমি পরেই বেরোবো।’
সম্মতি পেয়ে তাড়াহুড়ো ক’রে কাজ সেরেই কালিদাস ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল।
সংবাদপত্রে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের কর্মময় জীবনের কত আলেখ্য, কত ঘটনা, কত কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে—যার অনেক কিছুই সাধারণ মানুষের অজানা। প্রচারবিমুখ এই মানুষটি মুখ্যমন্ত্রী হবার আগে পর্যন্ত নিজেকে সর্বদাই নেপথ্যে রেখেছিলেন। এতকাল তাই চিকিৎসাবিদ্রূপে তাঁর বিপুল সাফল্যই লোকে জেনেছে, তাঁর জীবনের কঠোর সংগ্রামের কথা অনেকেরই জানা ছিল না।
১৯০৪ সালের কথা। বিধানচন্দ্র তখন মেডিকেল কলেজে সবে ভর্তি হয়েছেন। সেবার ছুটিতে ওঁরা কয় বন্ধু মিলে বেড়াতে গিয়েছেন বর্ধমানে। ফেরার পথে ট্রেনে উঠতে গিয়ে দেখেন ইন্টার ক্লাস কামরায় যাত্রীরা সব দাঁড়িয়ে। কী ব্যাপার? এ সময়ে তো ভিড় হবার কথা নয়। ওঁরা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন। ঢুকে দেখেন ভিড়ের কারণ এক অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান দম্পতি। স্বামী-স্ত্রী দুজনে দুটি বেঞ্চ দখল করে বসে আছেন, অন্যরা বসতে গেলেই অকথ্য কুকথ্য ভাষায় গালিগালাজ। তখন রেল কোম্পানিতে ছিল অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের রাজত্ব, দাপটও ছিল প্রচণ্ড। বিধানচন্দ্র ও তাঁর বন্ধুরা ব্যাপার দেখে স্তম্ভিত। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুদের মধ্যে ইশারা হয়ে গেল। বসে পড়লেন সাহেব আর মেমসাহেবের পাশে। বলা বাহুল্য সাহেব আপত্তি জানালেন, কিন্তু বিধানচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে মেডিকেল কলেজের সেই ছাত্রদের কাছে সাহেবকে পরাজয় স্বীকার করতেই হল। সবাইকে বসবার জায়গা দিতে বাধ্য হলেন। পরবর্তী জীবনে সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে বিধানচন্দ্র বলতেন—সেদিন আমাদের কী আনন্দ, আমরা যেন ইংরেজ প্রভুদেরই হারিয়ে ফিরছি।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি যে এই ঘটনার পরেও পুরোদস্তুর সাহেব হবার বাসনায় বিধানচন্দ্র নিজেই নিজের নাম নিয়েছিলেন—‘বেঞ্জামিন চার্লস রয়।’
কিন্তু বেঞ্জামিন চার্লস রয় থেকে বিধানচন্দ্র রায়ে ফিরে আসার ঘটনাটি আরো চমকপ্রদ। এম. বি. পরীক্ষার মাত্র দিন পনেরো বাকি। সকালে মেডিকেল কলেজের গেট-এ দাঁড়িয়ে আছেন বিধানচন্দ্র। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনি দেখছেন ধাত্রীবিদ্যার অধ্যাপক কর্নেল পেক্-এর ব্রুহাম গাড়িটা কলেজের দিকে আসছে। বেশ আসছিল, কিন্তু আচমকা মোড় ঘোড়াতে গিয়ে কোচম্যান বিপত্তি ঘটাল। তখন সবে ঘোড়ার বদলে বৈদ্যুতিক ট্রাম চালু হয়েছে। কর্নেল পেক্-এর গাড়ি ধাক্কা খেয়ে ভেঙে-চুরে একাকার হয়ে গেল। সৌভাগ্যবশত কর্নেল ও কোচম্যান দুজনেই অক্ষত অবস্থায় বেঁচে গেলেন। গাড়ি থেকে নেমেই সাহেব বিধানচন্দ্রকে সাক্ষী মানলেন—‘আচ্ছা, তুমিই বল, ট্রামটা কি ঘণ্টায় তিরিশ মাইল বেগে যাচ্ছিল না?’
‘না।’ উত্তর দিলেন বিধানচন্দ্র। তিনি বললেন—‘আমার মতে দোষ আপনার কোচম্যানের স্যার, ট্রামের নয়।’ সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে ভিতরে চলে গেলেন
সাত দিন পর আবার ডাক পড়ল ছাত্র বিধানচন্দ্রের। কর্নেল পেক্ বললেন—‘তোমাকে আদালতে সাক্ষী দিতে হবে।’
‘দিতে পারি, তবে দুঃখের বিষয় আমার সাক্ষ্য আপনার পক্ষে যাবে না স্যার।’ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন ছাত্র বিধানচন্দ্র।
কর্নেল পেক্ অপমানে ও রাগে কিছুক্ষণ গুম্ হয়ে বসে থেকে বললেন, ‘আচ্ছা। তুমি যেতে পার।’
এই ঘটনার সাত দিন পরেই পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষা ভালোভাবেই চুকে গেল, এবার মৌখিক পরীক্ষার পালা। পরীক্ষা দেবার জন্য ঘরে ঢুকতেই দেখলেন কর্নেল পেক্ বসে। বিধানচন্দ্রকে দেখেই কর্নেল পেক্ ক্ষেপে গিয়ে চীৎকার করে উঠলেন—‘গেট আউট, গেট আউট।’ অবাধ্য ছাত্রের পরীক্ষা কিছুতেই তিনি নিলেন না। মাথা নীচু করে বেরিয়ে এলেন বিধানচন্দ্র। জীবন-সংগ্রামে সেইটিই তাঁর প্রথম ও শেষ পরাজয়।
বেলা এগারোটা বেজেছে। এবার আমাকে আপিসে বেরোতে হবে। রসা রোডে এসে দেখি ট্রাম-বাস বন্ধ, জনস্রোত বন্যার মতো ছুটে চলেছে রাসবিহারী অ্যাভিনিউর দিকে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কিশোর-কিশোরী, দীন-দরিদ্র সাধারণ মানুষ থেকে প্রাসাদোপম গৃহের যাঁরা বাসিন্দা, যাঁরা কদাচ পথচারীদের ভিড়ে নেমে আসেন, আজ তাঁরাও সবাই রাস্তার মানুষদের সঙ্গে এক সত্তায় মিলে গিয়ে চলেছে উদ্গ্রীব আগ্রহে। সবারই চোখে নীরব প্রশ্ন, ভিড়ের মধ্যে কি তাঁকে একবার দেখতে পাবো?
সাদার্ন অ্যাভিনিউর মোড় পার হয়ে আমি আর এগোতে পারিনি। বিপুল জানতার দুর্ভেদ্য প্রাচীর। বাড়ির ছাদ, কার্নিশ, বারান্দা, ফুটপাথ থেকে যানবাহন চলাচলের সদর রাস্তা সব ঢেকে গেছে কালো মাথায়। দুপুরের প্রচণ্ড কড়া রোদ উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ নরনারী আজ পথে বেরিয়ে পড়েছে। কোনো ক্লেশ, কোনো ক্লান্তি, কোনো কষ্টই তারা গ্রাহ্য করছে না।
সাদার্ন অ্যাভিনিউর মোড়ে একটা গাছের ছায়ায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে শোকহ্বিল জনতার মিছিল দেখছি আর ভাবছি ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি কোনোদিনই তথাকথিত জনতার নেতা ছিলেন না। অথচ তাঁর এই বিপুল জনপ্রিয়তার মূল কারণটি কি? কারণ বোধহয় তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্ব যা ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার সম্পদ এবং যে-সম্পদ এই মানুষটির তিরোধানের সঙ্গে বাংলা দেশ থেকে লুপ্ত হয়ে গেল। রাজনীতিক নেতারূপে নয়, চিকিৎসাবিদ্রূপে এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন মানুষরূপে জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলা দেশে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন। বিধানচন্দ্রের অনেক কাহিনীই আজ শুধু বাংলা দেশ নয়, ভারতবর্ষেরও ঘরে ঘরে প্রচলিত।
১৯১১ সালের জুলাই। বিধানচন্দ্র বিলাত থেকে যেদিন কলকাতায় পৌঁছলেন, তখন তাঁর পকেটে আছে মাত্র পঁচিশ টাকা। তা হোক, তবু তিনি ভারতের মাটিতে পা দেবার আগেই স্থির করে বসে আছেন যে কোনও ওষুধের দোকানে বসে কমিশনের জন্য প্রেসক্রিপশন লিখবেন না। বিশেষ কারও অধীনে চাকরিও করবেন না। ধার-দেনা করে তিনি ৮৪ নম্বর হ্যারিসন রোডের উপর একটি বাড়ি ভাড়া করে ফেললেন। তখন তাঁর দু-দুটি বিলাতী ডিগ্রি—এম আর সি পি এবং এফ আর সি এস। সুতরাং ফী দু’টাকা থেকে বেড়ে হল আট টাকা।
এই অবস্থায় বেশ কয়েকমাস কেটে গেল। পসার তখনও ভালো করে জমেনি, আট টাকাকে ষোল টাকা করার অবস্থা তখনও হয়নি। একদিন এই কলকাতারই এক ধনী ব্যক্তি এসে বললেন—‘আপনাকে আমি আমার পারিবারিক চিকিৎসক নিযুক্ত করতে চাই।’ সেদিনও কলকাতার বনেদি ধনী পরিবারে বিলেত-ফেরত গৃহ-চিকিৎসক রাখাটা ছিল কৌলিন্যের অন্যতম মাপকাঠি।
বিধানচন্দ্র সেটা জানতেন বলেই উত্তর দিলেন—‘মাপ করবেন। আমি কারও—’
আগেই বলেছি কলকাতার বনেদি বাবু-কালচারের ইনিও একজন বিশিষ্ট প্রতিভূ, তাই ছোকরা ডাক্তারের উদ্ধত জবাবে কিঞ্চিৎ মেজাজ দেখিয়েই বললেন—‘জানেন কত পেতেন আপনি?’
‘কত?’ কৌতূহলী বিধানচন্দ্ৰ লোকসানের পরিমাণটা শুনতে চান।
‘বছরে দেড়শ টাকা।’ ভদ্রলোক টাকার অঙ্কটা এমন ভঙ্গিতে বললেন যেন শুনেই ডাক্তারের চোখ ছানাবড়া হয়।
টাকার অঙ্ক শুনেই বিধানচন্দ্র প্রচণ্ড শব্দ করে হেসে উঠলেন।
‘অর্থাৎ মাসে বারো টাকা? এমন দিনও হতে পারে আপনি একবারের ভিজিট বাবদই আমাকে দেড়শ টাকা দিচ্ছেন।’ হাসতে হাসতে কথাগুলি ছুঁড়ে মারলেন সেই গর্বান্ধ ধনীর মুখে।
রাগে গজরাতে লাগলেন তিনি, মুখ দিয়ে আর কথা বেরলো না। কাঁপতে কাঁপতে গাড়িতে উঠে বসলেন।
এই ঘটনার কয়েকমাস পরেই হঠাৎ কাছাকাছি একটি বাড়ি থেকে ‘কল’ এল। এক ধনীর মেয়ে আফিম খেয়েছেন। বেলা তখন পাঁচটা। বিধানচন্দ্র তখনি ছুটলেন। পরদিন সকালে আবার তিনি রোগী দেখলেন। মেয়েটি তাঁরই চিকিৎসার গুণে সেরে উঠেছেন। কৃতজ্ঞতায় ধনী পিতার চোখে জল।
‘কত ফী দেব ডাক্তার আপনাকে?’
বিধানচন্দ্র এক মুহূর্ত ভাবলেন। তারপর বললেন—‘এই বিশেষ কেসটিতে দেড়শ টাকা পেলেই আমি খুশি।’
তক্ষুনি চেক লেখা হয়ে গেল। চেকটি হাতে নেবার সময় ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকিয়ে বিধানচন্দ্র বললেন—‘মনে পড়ছে আমাকে? আমি সেই ডাক্তার যাকে আপনি বছরে দেড়শ টাকায় পুষতে চেয়েছিলেন।’
ডাঃ রায়ের চরিত্রের বজ্রকঠোর দিকটির পরিচয় এখানে দেওয়া হল, কিন্তু অপর দিকটি ছিল কুসুম-কোমল।
যাঁরা পয়সা দিতে পারতেন না, বিধানচন্দ্র তাঁদের কাছে কোনোদিনও পয়সা নেননি। কিন্তু যাঁদের দেবার ক্ষমতা আছে অথচ ভিজিট দিতে কার্পণ্য দেখান, তাঁদের বলতেন—‘চেম্বারে গিয়ে দিয়ে আসুন, সেখানে আমার ‘পুওর-বক্স’ আছে।’
ভিড়ের চাপে আর এক পাও এগোনো সম্ভব নয়। রাসবিহারী আর আশুতোষ মুখার্জি রোডের মোড়ে কাতারে কাতারে লোক। ট্রামগাড়ি-গুলি দাঁড়িয়ে, তার ভিতরে আর ছাতে লোকে লোকারণ্য। মধ্য দিনের প্রচণ্ড রোদ মাথায় নিয়ে অধীর প্রতীক্ষায় তারা দাঁড়িয়ে আছে, জনতার মধ্য থেকে আকুল আবেদন উঠছে—‘জল ঢালুন, জল ঢালুন।’ রাস্তার দুই পাশে বাড়ির ছাতে কার্নিশে বারান্দায় সমবেত মানুষদের কাছেই তাদের আবেদন। যে পারছে উপর থেকে বালতি বালতি জল ঢালছে রাস্তায় ফুটপাথে জমাট বাঁধা মানুষদের উপর।
আমি বিস্মিত হয়ে আবার ভাবছিলাম এই মানুষটির প্রতি জনতার এত শ্রদ্ধা ও ভালবাসার উৎসটি এতকাল কোথায় লুকিয়ে ছিল, আজ বাঁধভাঙ্গা বন্যার মতো উত্তাল হয়ে যা ছড়িয়ে পড়ল মহানগরীর রাস্তায় রাস্তায়!
মনে পড়ে গেল বিধানচন্দ্র রায়ের জীবনের আরেকটি ঘটনা। বিলেত থেকে ফেরার পর বিধানচন্দ্ৰ ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলে শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছেন। ইংলণ্ডের সর্বোচ্চ ডিগ্রীর অধিকারী হলেও মাইনে তাঁর সব মিলিয়ে মাসে তিনশ তিরিশ টাকা। তা হোক। সরকারী হাসপাতালে কাজ, অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগবে। বিধানচন্দ্রের চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, যে-কাজে হাত দিতেন তাতেই সম্পূর্ণ ডুবে থাকতেন তিনি। এ-ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না।
কিছুদিন পরেই হঠাৎ ক্যাম্বেলের অধ্যক্ষ হয়ে এলেন ভারতীয় মেডিকেল সার্ভিসের সদস্য জনৈক মেজর রাইট। ক’দিন যেতে না যেতেই বিধানচন্দ্রের ডাক পড়ল তাঁর ঘরে। সাহেব বললেন—‘কি কাজ করো তুমি এখানে?’
বিধানচন্দ্র তাঁর কাজের ফিরিস্তি দিলেন।
মেজর রাইট বলে উঠলেন—‘আমার মনে হয় কাজের তুলনায় তুমি মাইনে একটু বেশী পাচ্ছ। নয় কি?’
‘তা বটে।’ উত্তর দিলেন বিধানচন্দ্র। ‘একজন এম আর সি পি (লণ্ডন), এফ আর সি এস (ইংলণ্ড) এবং কলকাতার এম ডি বেতন পাচ্ছেন মাসে তিনশ তিরিশ টাকা। কিন্তু অন্যজন এডিনবরার ফেলোশিপ ফেল করে পাচ্ছেন মাসে দেড় হাজার টাকা। সুতরাং প্রথম জনকে কিছু বেশিই দেওয়া হচ্ছে বইকি।’
মেজর রাইট সেই তীক্ষ্ম ব্যঙ্গোক্তির আর কোনো জবাব খুজে পেলেন না। কারণ তিনি দেড় হাজার টাকার মাইনে পেলেও ফেলোশিপ ফেল করা ডাক্তার।’
ইংবেজের পদানত ভারতবাসীর সেদিন গ্লানির শেষ ছিল না। কিন্তু ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। পরাধীন দেশের মানুষ হলেও আত্মমর্যাদাবোধ ছিল তাঁর অপরিসীম। তাঁর ঐ এক সংকল্প ছিল— ‘হতে পারি দীন তবু নহি মোরা হীন’। সাদা চামড়ার কাছে তাই কোনোদিন তিনি নতি স্বীকার করেননি, যতই দোর্দণ্ড প্রতাপ তার থাকুক। মেরুদণ্ড সোজা রেখেই তিনি আজীবন সমানে টক্কর দিয়ে এসেছেন তাদের সঙ্গে।
এই মেজর রাইট প্রসঙ্গেই আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন বিধানচন্দ্রের উপর। ফলে ক’দিনের মধ্যেই অধ্যক্ষ রাইটের কাছ থেকে নির্দেশ এল বিধানচন্দ্রের কাছে যে, ক্যাম্বেলের ফিজিওলজি বিষয়ের শিক্ষককে বেলা বারোটা থেকে তিনটে পর্যন্ত নিজের বিভাগে উপস্থিত থাকতে হবে। কেননা তাই নিয়ম। নতুন নির্দেশের সমর্থনে মেজর রাইট পঞ্চাশ বছর আগেকার একটি নোটি-ফিকেশনের অংশ-বিশেষ উদ্ধৃত করেছেন।
চিঠিটা হাতে নিয়েই বিধানচন্দ্র অধ্যক্ষের ঘরে ঢুকলেন—‘এ নির্দেশ কি আক্ষরিক অর্থেই পালন করতে হবে আমাকে?’
‘হ্যাঁ।’ মেজর রাইটের কণ্ঠে বজ্রনির্ঘোষ।
বিধানচন্দ্র বললেন—‘না, অন্য রকমও হয় কি না, তাই বলছিলাম। আমরা যখন তৃতীয় শ্রেণীর ঠিকে গাড়ি ভাড়া করি তখন ভাড়া দিই ঘণ্টা হিসাবে, কিন্তু ট্যাকসির বেলা দিতে হয় দূরত্ব হিসাবে।’
মেজর রাইট ক্ষিপ্তকণ্ঠে বললেন—‘না, এক্ষেত্রে নির্দেশটা আক্ষরিক অর্থেই নিতে হবে।’
‘আচ্ছা স্যার।’ বিধানচন্দ্র তখনকার মতো বিদায় নিলেন।
ক’দিন পরেই অধ্যক্ষের নতুন চিঠি। তিনি জানতে চেয়েছেন বিধানচন্দ্র বেলা চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত অন্য একটা ক্লাসের দায়িত্ব নিতে পারেন কিনা। ডাঃ রায় চিঠিটা পড়লেন, তারপর নিঃশব্দে সেটি ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। মাসখানেক পরে ফিজিওলজির ক্লাসে হঠাৎ মেজর রাইট উপস্থিত।—‘তুমি তো এখনও আমার চিঠির উত্তর দিলে না?’
‘আপনার চিঠি!’ বিধানচন্দ্র গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলেন—‘সে তো সেদিনই ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি।’
‘মানে!’ গর্জন করে উঠলেন মেজর রাইট।
‘মানে অতি স্পষ্ট। সরকারী কাজ যখন, তখন তা আমি আক্ষরিক অর্থেই করতে চাই। চাকরি আমার তিনটায় শেষ, নয় কি?’
মেজর রাইট ঢোঁক গিললেন। কোন্ কথার জবাবে এই উত্তর, মেজর রাইটের তা বুঝতে বিলম্ব হল না।
এই মেজর রাইটের সঙ্গে ক্যাম্বেলেই আরেকটি ঘটনা। বাংলার গভর্নর ফ্রেজার সাহেব আসবেন হাসপাতাল পরিদর্শন করতে। মেজর রাইট হাস-পাতালের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মীদের নিয়ে সেজেগুজে গেট্-এ দাঁড়িয়ে আছেন গভর্নরকে অভ্যর্থনা করবার জন্যে।
এমন সময় গাড়ি হাঁকিয়ে বিধানচন্দ্র সেখানে এসে হাজির। গাড়ি থেকে নেমে কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই তিনি সোজা গিয়ে তাঁর বন্ধুর দলে মিশে গেলেন। কিন্তু মেজর রাইট-এর ধারণা ডাঃ রায় তাঁকে ইচ্ছে করেই অবজ্ঞা করেছেন।
হাসপাতাল পরিদর্শন হল, লাটসাহেব বিদায় নিলেন। পরমুহূর্তেই ডাক পড়ল বিধানচন্দ্রের। ক্ষিপ্ত হয়ে মেজর রাইট বললেন—‘তুমি যে তখন আমাকে দেখে টুপি খুললে না?’
বিনীত কণ্ঠে বিধানচন্দ্র বললেন—‘আমি আপনাকে লক্ষ করিনি স্যার! লক্ষ করলেও টুপি খুলতাম না, শুধু বলতাম ‘গুড মরনিং’। কেননা ইংলণ্ডের আদব-কায়দায় এইটিই রীতি, নিজের চোখে দেখে এসেছি।’
উত্তপ্ত কণ্ঠে মেজর রাইট বললেন—সেটা ইংলণ্ডের কথা, এটা ইণ্ডিয়া নয় কি?’
বিধানচন্দ্র উত্তর দিলেন—‘বেশ, আপনি সেই মর্মেই একটা লিখিত আদেশ জারী করুন, এবার থেকে টুপি খুলেই আপনাকে অভিবাদন জানাব।’
বলা বাহুল্য, রাইট এ প্রস্তাবে রাজী হননি। তিনি বুঝেছিলেন যে এই নেটিভ ডাক্তারের মতলব হচ্ছে ওকে আরও হাস্যকর করে তোলা।
আর একবার মেজর রাইট লক্ষ করলেন যে ছাত্ররা তাঁকে দেখে শুধু ‘গুড মরনিং’ বলে দিব্যি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, কেউ ছাতা বন্ধ করছে না। অথচ ক্যাম্বেলে তখন কড়া নিয়ম ছিল সামনে কোনো অধ্যাপক এলে তাঁকে সম্মান দেখাবার জন্য ছাতা বন্ধ করতেই হবে, কিন্তু বিস্মিত হয়ে তিনি কিছুদিন ধরে লক্ষ করছেন যে তাঁকে দেখে তো নয়ই, কোনো অধ্যাপককে সামনে দেখে ছাত্ররা ছাতা বন্ধ করছে না।
ছাত্রদের ডাক পড়ল অধ্যক্ষের আপিস-ঘরে। হম্বিতম্বি করার পরই জানা গেল এই বিদ্রোহের নায়ক বিধানচন্দ্র। বিধানচন্দ্রকে ডেকে পাঠিয়ে মেজর রাইট জানতে চাইলেন যে, অধ্যাপক হয়ে ডিসিপ্লিন না মানবার জন্যে ছাত্রদের উস্কানি দেবার অর্থ কি।
উত্তরে বিধানচন্দ্র মেজর রাইটকে জানিয়ে দিলেন যে, ওটাকে ডিসিপ্লিন বলে না, ওটা একটা বিরক্তিকর প্রথা।
মেজর রাইট আর কথা বাড়ালেন না, অপমানটা হজম করেই গেলেন। এতদিনে তিনি বিধানচরিত্রের খানিকটা আঁচ পেয়ে গিয়েছিলেন, বুঝেছিলেন, এ মেরুদণ্ডকে নত করা ওঁর সাধ্য নয়।
ইংরেজ চরিত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, পরাজিত হলেও বিপক্ষের মহত্ত্বকে স্বীকৃতি জানাতে সে কার্পণ্য করে না। মেজর রাইটও তাই করেছিলেন। অবসর নেবার সময় হবার বেশ কয়েক বছর আগেই তিনি চাকুরিতে ইস্তফা দিলেন। শুধু তাই নয়, যাবার আগে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে ডেকে পাঠিয়ে সস্নেহে হ্যান্ডশেক্ করে বলেছিলেন—
‘আমি অসময়ে কেন অবসর নিচ্ছি জান? আমি জানি এই প্রতিষ্ঠানে আমার চেয়ে বহুগুণ বেশি যোগ্য শিক্ষক থাকতে আমার পক্ষে এ-কাজ করা অনুচিত।’
সহসা আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে রব উঠল—‘ওই আসছেন, ওই এসে গেছেন।’
মুহূর্তের মধ্যে ছড়ানো ছিটানো বিক্ষিপ্ত জনতা চৌমাথার উপর মৌচাকের মতো জমাট বেঁধে গেল। আমি তখনো সাদার্ন অ্যাভিনিউর মোড়ের মেহগনি গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়ে ভাবছিলাম যে খাঁটি মানুষকে চিনতে জনতা ভুল করেনি। নইলে, বেশ-ভূষা আচারে ব্যবহারে যিনি একান্ত সহজ সরল অনাড়ম্বর ছিলেন, রাজনীতির প্রকাশ্য-মঞ্চে সস্তা হাততালি কুড়োবার কোনো ভূমিকা যিনি কখনো নেননি, দেশ-মাতৃকার সেই নীরব সাধকের প্রতি অলক্ষে সঞ্চিত এত শ্রদ্ধা প্রীতি অনুরাগ সহসা স্বতোৎসারিত প্রস্রবণের মতো উদ্বেল হয়ে উঠল কী করে!
হঠাৎ দেখি আমার সামনে বিশুদা দাঁড়িয়ে। আমাদের পত্রিকা আপিসের শনিবারের আডডার সেই বিখ্যাত না-লিখে-সাহিত্যিক বিশুদা। চেহারা দেখে প্রথমে আমি চিনতেই পারিনি। অবিন্যস্ত চুল, গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গরমে ঘামে গায়ের গেরুয়া পাঞ্জাবি ভিজে শপ শপ করছে, মুখে থমথমে গাম্ভীর্য। বিশুদার এ চেহারা আমি কোনোদিন দেখিনি।
বিশুল্কমুখ বিশুদা আমাকে গম্ভীর হয়ে বললেন—‘চলুন আপনার বাড়ি। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, কিছুই দেখতে পাবেন না’।
বিস্মিত হয়ে বললাম—‘কিন্তু আপনি এখানে? আর এ কী চেহারা হয়েছে আপনার—’
আরো গম্ভীর গলায় বিশুদা বললেন—‘সব বলছি, আগে চলুন আপনার বাড়ি।’
আপিস যাওয়া হল না। বিশুদাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
সারা পথ বিশুদা নীরব, একটি কথাও বললেন না। বসবার ঘরে ঢুকেই তাকিয়াটা মাথায় দিয়ে খাটের উপর ধপাস করে শুয়ে পড়লেন। চোখ দুটি বন্ধ, মুখে কোনো কথা নেই।
বিশুদ। হঠাৎ শোকে এতটা মুহ্যমান হয়ে পড়বেন আমি তা ভাবতেও পারিনি। ব্যাঙ্কে সামান্য বেতনে কেরানীর চাকরি করেন বিশুদা, বৃহৎ সংসার নিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে তাঁর নিত্য সংগ্রাম। তবু বিশুদার বিষণ্ণ মুখ কোনোদিন আমি দেখিনি।
বিশুদা তখনো চোখ বুজে চুপচাপ শুয়ে আছেন । এই অসহনীয় নীরবতা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে আমি বললাম, ‘বিশুদা, এক কাপ চা খাবেন?’
বিশুদা এবার চোখ খুললেন। খাটের উপর উঠে বসে বললেন—‘না, চা খাবো না। এক গেলাস জল দিন।’
এক গেলাস জল এনে দিতেই নিমেষে তা নিঃশেষ করে বললেন— ‘আরেক গেলাস দিন, বড় তেষ্টা পেয়েছিল।’
আরেক গেলাস জল খেয়ে বিশুদা এবার ধাতস্থ হলেন। তাকিয়াটার উপর ক্লান্ত দেহটাকে এলিয়ে দিয়ে বললেন—‘টালিগঞ্জে গিয়েছিলাম বৈদ্য-নাথের সঙ্গে দেখা করতে দেখা পেলাম না। কাল দুপুর থেকেই সে ডাঃ রায়ের বাড়িতে পড়ে ছিল, রাত্রেও বাড়ি ফেরেনি, এখনও না। বোধহয় প্রসেশনের সঙ্গেই ও আছে।’
কে এই বৈদ্যনাথ! এর কথা বিশুদার মুখে কোনোদিন শুনিনি। তাছাড়া আজকের দিনের ঘটনার সঙ্গে বৈদ্যনাথের সম্পর্কই বা কি! আমার চিন্তার জাল ছিন্ন করে বিশুদ। আবার বললেন—‘বৈদ্যনাথের ছেলেমেয়ে তিনটে আমাকে দেখেই কেঁদে আকুল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বলছে— কাকাবাবু, আমাদের আপনি নিয়ে চলুন, দাদুকে শেষবারের মতো একবার দেখব।’
আমার মুখে কোনো প্রশ্ন নেই, বৈদ্যনাথ সম্পর্কে অপার বিস্ময় নিয়ে বসে আছি।
দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বিশুদা বললেন—‘বৈদ্যনাথের মা কাল থেকে জল পর্যন্ত মুখে দেননি, কেঁদে কেঁদে শয্যা নিয়েছেন। ওর স্ত্রী পাথরের মতো ঘরের এক কোণায় স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল, আমাকে দেখেই পাগলের মতো চীৎকার করে কান্না! কোথায় গেলাম বৈদ্যনাথকে একটু সান্ত্বনা দিয়ে আসব, কিন্তু কী পরিস্থিতির মধ্যেই গিয়ে পড়লাম বলুন তো।’
বৈদ্যনাথ ও তার পরিবার আমার কাছে বিরাট রহস্য হয়ে দেখা দিল। কৌতূহল আর চেপে রাখতে না পেরে বৈদ্যনাথের পরিচয় জানবার জন্যে উৎসুক হয়ে বিশুদাকে প্রশ্ন করতে যে কাহিনী সেদিন বিশুদা আমাকে শুনিয়েছিলেন তা যেমন বিস্ময়কর তেমনি মর্মস্পর্শী। বিশুদার জবানীতেই সে-কাহিনী আপনাদের কাছে উপস্থিত করলাম।