1 of 2

একটি নিঃস্ব যৌবনের মৃত্যু – স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়

একটি নিঃস্ব যৌবনের মৃত্যু – স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়

রহস্য কাহিনি আমি কখনও লিখি না। একটি রহস্যের ঘটনা মানুষের স্নায়ুকে সাময়িকভাবে উত্তেজিত করতে পারে মাত্র। তার বেশি কিছু স্থায়ী মূল্য এর কী আছে জানিনে। তবু রহস্য কাহিনিই একটি লিখতে হবে।

একটি হত্যার রহস্য আমি জানি। হত্যাকারী কে তাও আমি জানি। তার কথাই বলব।

হত্যাটি অত্যন্ত রহস্যময়। সবাই একে হত্যা বলে ভাবতেই পারেনি। ভোরবেলা দেখা গেল সবিতা ট্রেনে কাটা পড়েছে। এটাকে হত্যা বলা যায় কী করে? এ তো আত্মহত্যা! এতে রহস্যই বা কী থাকতে পারে?

আমি জানি এটা হত্যা। এ-হত্যার পেছনে রহস্য আছে।

সবিতা মরেছে। লাইনের বাইরে তার কাটা মাথা, ভেতরের দিকে মাথা থেকে বিচ্ছিন্ন দেহ। রেলের চাকার তলায় কি এমন গলা কেটে যায়? তা হয়তো যায়। তবু এটা হত্যা।

দুটি মানুষ তাকে মারতে পারে। এক তার স্বামী, আর না হয় ব্রজদুলালবাবু। কে মেরেছে বুঝতে হলে তাদের দুজনের কথাই আমাকে বলতে হবে।

সবিতা রূপবতী। গায়ের রং বেশ ফরসা, কিন্তু ফ্যাকাসে। যৌবন ছিল, কিন্তু এখন সে-যৌবনকে বিধ্বস্ত বলা যায়। নানা কঠিন চাপে পড়ে যেন থেঁতলে গেছে ওর যৌবন। মুখে হাসি থাকত সর্বদাই। কিন্তু সে-হাসি একটু লক্ষ করলে বোঝা যেত, বড়ই ম্লান। চাপা বেদনায় ভরা।

কে-ই বা লক্ষ করত?

স্বামীর লক্ষ করা উচিত ছিল। কিন্তু সংসারে যা উচিত, তা বেশিরভাগ সময়ই হয় না।

বিয়ে হয়েছিল ওর পনেরো বছর বয়েসে। মণীন্দ্র ছেলে ভালো। দরিদ্র হলেও কয়েক ভাই মিলে কোনওমতে চলে যেত। মণীন্দ্র শক্ত-সমর্থ, বলিষ্ঠ, কিন্তু বদমেজাজি।

কাজে লাগালে কাজ করতে পারত, কিন্তু কেউ জোর করে কাজে না লাগালে নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে-বসে থাকতে পারত। এটা ওর চিরকালের স্বভাব।

বিয়ের পর সবিতা বছরকয়েক বেশ ভালোই ছিল। মণীন্দ্র গ্রামের একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাস্টারি করত। রেগে গেলে ছেলেদের প্রচুর মার দিতে পারত। ছেলেরা যমের মতো ভয় করত। বিয়ের পর বউও তাকে ভয় করবে, এমন একটা আশা তার ছিল। এটা তার একটা গর্বও বটে। সবিতা কিন্তু ভয় করল না।

মাঝে-মাঝে সামান্য ব্যাপারে মণীন্দ্র মেজাজ দেখালে সবিতা কিছুই বলত না। তার এই কিছুদিন না-বলাটা অনেকদিন পর্যন্ত চলত। একটা কথাও বলত না স্বামীর সঙ্গে।

অগত্যা বদমেজাজি মণীন্দ্রকেই মেজাজটা ঠান্ডা করে সাধাসাধি করতে হত।

তাতেও কি রেহাই আছে?

একবার সকালে তার খাওয়া নিয়ে রাগারাগি করেছিল মণীন্দ্র।

—সকালে দুটিখানি ভাত খেয়ে নেবে।

সবিতা ঠান্ডা চোখ দুটো তুলে বললে, সকালে ভাত খাওয়া আমার অভ্যেস নেই।

—আমি যা বলছি শুনতে হবে। তোমার জন্যে সকালবেলায় সন্দেশ-রসগোল্লা দিতে পারব না।

সবিতা বুঝল কথাটা স্বামীর কানে তুলেছে ওর মেজ জা।

বললে, আমি তো সন্দেশ-রসগোল্লা আনতে বলিনি! শুধু চা খাব।

—ফের কথার ওপর কথা!

ইস্কুলের ছাত্রের মতো একটা জোর ধমক দিয়ে বসেছিল মণীন্দ্র।

ব্যস! সেই যে সবিতা মুখ বন্ধ করল, সে-মুখ খোলাতে মণীন্দ্রের কালঘাম ছুটে গেল। ফরসা মুখখানা রাঙা হয়ে উঠল সবিতার। কিছুতেই কথা বলল না।

শেষপর্যন্ত মণীন্দ্র ওর পায়ে ধরতে বাকি রেখেছে।

—বেশ, আমার অন্যায় হয়েছে। তোমার ভালোর জন্যেই বলেছিলাম। সকালে ভাত খেলে শরীর ভালো থাকে। শুধু চা খেলে শরীর খারাপ হবে তাও বোঝো না? বেশ, আর কখনও বলব না।

সবিতা নীরব। ছোটখাটো ধবধবে ফরসা নিটোল দেহটি বাঁকিয়ে বসে রইল।

—না হয় মাপ চাইছি।

সবিতা কঠিন।

মণীন্দ্র ওর হাতে ধরে শেষপর্যন্ত কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, মাপ করো আমায়! আমি আর থাকতে পারছি না। সত্যি বলছি, তোমার মুখ ভার দেখলে আমার কিছু ভালো লাগে না।

এতক্ষণে সবিতা কথা বলে,—হাত ছাড়ো।

—ছাড়ব না।

সবিতার চোখ দুটো এতক্ষণে জলে ভরে ওঠে।

আরও অনেক সাধ্য-সাধনার পর সবিতা স্বাভাবিক হতে পারে।

এমনি ভীষণ জেদি স্বভাব সবিতার।

বছরপাঁচেক এমনি করেই কাটল। তিনটি মেয়ে হল ওর। তিন মেয়ের মা হলেও সবিতার শরীর দেখে কিছু বোঝবার জো নেই। ছোটখাটো আঁটসাট গড়ন। ফরসা রং। চোখ দুটো বাদামি।

মণীন্দ্র মাস্টারির ওপরেও দু-একটা ছেলেকে পড়ায়। তাতেও কুলিয়ে ওঠে না।

মেজ জা মাঝে-মাঝে দু-চারটে কথা শোনাতে শুরু করল। মেজ ভাশুর রোজগার করত সবচেয়ে বেশি, তাই কথাবার্তা বলতে-কইতে মেজ জা সর্বেসর্বা।

একদিন বলে বসল, কারও যদি না পোষায়, চলে যেতে পারে যেখানে খুশি।

সবিতা রান্নাঘরে ছিল। বাইরে বেরিয়ে এসে বললে, এ-কথাটা আরও আগে বললেই পারতেন, মেজদি।

মেজ জা ছাড়বার মেয়ে নয়, বললে, সব কথাই কি স্পষ্ট করে বলতে হয়!

—বেশ, চলেই যাব।

যে কথা সেই কাজ। মণীন্দ্র ফেরবার পর বললে সবিতা, এ-বাড়িতে আর সে জলগ্রহণ করবে না। এ-বাড়ি থেকে চলে যেতেই হবে।

মহা বিপদে পড়ল মণীন্দ্র। তার যা বিদ্যে, তাতে চাকরি ছাড়লে আর কি চাকরি পাবে?

—চলে যাব বললেই তো হয় না। পকেটে যে পয়সা নেই!

খুব হবে।—বললে সবিতা, চলো, কলকাতায় গিয়ে আমার বাপের বাড়ি উঠি। আমার ভাইরা একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।

মণীন্দ্র জানত, সূর্য ভেঙে যাওয়া সম্ভব, কিন্তু সবিতার জেদ ভাঙবে না। তবে যাওয়াই যাক।

কলকাতায় চলে এল ওরা। বাপের বাড়িই উঠল সবিতা। ভাইয়েরা যখন শুনলে, স্বামীর কাজকর্ম কিছু নেই, কিছু একটা না হওয়া পর্যন্ত এখানে থাকবে, শুনে বিরক্ত হল। তবু রয়ে গেল সবিতা।

অতি কষ্টে ভাই-বউদের মন জুগিয়ে চলতে হত। তবু শ্বশুরবাড়ি আর সে কিছুতেই যাবে না। যা বলেছে তা করবেই।

বড় ভাই এক বন্ধুর প্রেসে মণীন্দ্রকে কম্পোজিটরের কাজ জুটিয়ে দিলে। প্রথম তিন মাস শিখতে হবে। তারপর মাইনে পাবে।

এর ভেতর আর-একটি বাচ্চা হল সবিতার। এটি ছেলে।

মাসপাঁচেক কাটাবার পর ভাইরা বললে আলাদা বাসা করতে—যদি প্রয়োজন হয়, তারা না হয় মাঝে-মাঝে কিছু সাহায্য করবে।

বাসা খুঁজতে লাগল মণীন্দ্র। সত্তর টাকা মাইনে পায় মণীন্দ্র। কলকাতায় এ-টাকায় কী করে চলবে?

সবিতা বললে, তবে না হয় কলকাতার একটু বাইরের দিকেই ঘর দ্যাখো।

—তাই হবে।

কলকাতার বাইরে ঘর পাওয়া গেল খড়দায়। মণীন্দ্রকে ট্রেনে যাতায়াত করতে হবে। তাই করবে মণীন্দ্র। ঘরখানি পেয়েছে ভালো আর ভাড়াটাও সস্তা। দরিদ্র ব্রাহ্মণ দেখে ভদ্রলোক দয়া করে ভাড়া দিয়েছে।

এই ভদ্রলোকের নাম ব্রজদুলাল।

ব্রজদুলাল পয়সা করেছে, পয়সা রাখতেও জানে। তার পুরোনো লোহার দোকান আছে।

এ-ব্যবসায় প্রচুর পয়সা। তার ওপর ব্যবসা করতে বসে যে সাধু হলে চলবে না এ-কথা ব্রজদুলাল ভালোভাবেই জানত। তাই ব্যবসাই করত। খাঁটি ব্যবসা।

সবিতা চারটি সন্তান নিয়ে উঠল এই বাড়িতে। ব্রজদুলালের নিঃসন্তান স্ত্রী এসে কোলে টেনে নিলে বাচ্চা ছেলেটিকে। আদর করে অস্থির করে তুলল।

—আহা! কেমন গোপালের মতো চ্যায়রা দেখেচো?

ব্রজদুলাল হাসল। সবিতাও হাসল।

ব্রজদুলাল তাকাল। সবিতাও তাকাল।

ওর স্ত্রী কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। সে ছেলে নিয়ে ব্যস্ত রইল। মণীন্দ্রও কিছু দেখতে পেল না। সে ঘর গোছাতে ব্যস্ত ছিল।

ব্রজদুলাল ভাবল, ব্রাহ্মণ কন্যাটি পরমাসুন্দরী—যেন স্বয়ং লক্ষ্মী।

কী জানি কেন মনে হল স্বয়ং লক্ষ্মী তার ঘরে এল।

সবিতা ভাবল, ভদ্রলোক বেশ সদাশয়। ধনী।

তাদের ওপর যদি সুনজর পড়ে, তবে এতদিনে একটা আশ্রয় পাওয়া গেল।

ব্রজদুলালের বন্ধ্যা, কালো স্ত্রী ভাবল, এতদিনে কয়েকটি বাচ্চা ঘরে এল তার। বড় ভালো হল। সে এতদিনে বাঁচল।

মণীন্দ্র কিছুই ভাবল না। ওর সব ভাবনা ও সবিতার ওপর ছেড়ে দিয়েছে বহুদিন থেকে।

কিছুদিনের ভেতরেই ব্রজদুলালের স্ত্রী আপন করে নিলে সবিতাকে। তার কারণটা সবিতার ওপর ভালোবাসা নয়। ছোট ছেলেটির ওপর ভালোবাসা। ছেলেটিকে দিনরাত কোলে-কাঁখে রেখে ছানা-দুধ খাইয়ে একেবারে নিজের করে নিলে ব্রজদুলালের স্ত্রী।

সবিতা বাঁচল।

শরীরেও আর সবিতার সয় না। শেষ সন্তানটি হওয়ার পর সবিতা যেন রক্তশূন্য হয়ে পড়েছে। শরীর দুর্বল লাগে। ফরসা রং এখন ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে।

ব্রজদুলালের সঙ্গে মণীন্দ্রর বন্ধুত্ব বেশ পাকা হয়ে উঠেছে, সেই সুবাদে ব্রজ সবিতাকে বলে, বামুনগিন্নির শরীর রোগা হচ্ছে কেন?

সবিতা হাসে। ঠাট্টা করেই বলে, যাকে ভালোবাসি, তাকে ভেবে-ভেবে।

—সে সশরীরে বর্তমান রয়েছে তো!

সবিতা বলে, শরীরটাই কি সব?

ব্রজদুলাল হাসে। কথাটার যে-মানে বুঝে ব্রজ হাসে সেই মানে বুঝেই হয়তো সবিতা হাসে। ওরা হাসে বলে মণীন্দ্র হাসে।

শুধু ডাল আর ভাত, একটি হয়তো তরকারি। এ ছাড়া আর কিছুই হয় না সত্তর টাকায়। তাও তিন মাসের ঘরভাড়া বাকি পড়ে।

মণীন্দ্র বলে, শেষকালে যদি উঠিয়ে দেয়।

—সে আমি বুঝব।

মণীন্দ্র মুখ বুজে ডাল-ভাত খেয়ে প্রেসের কাজে বেরিয়ে যায়।

দুপুরে ছেলে নিতে এসে সবিতা দেখে ব্রজদুলাল খেতে বসেছে। সামনে বসে।

ব্রজ বলে, কী খবর বামুনগিন্নি?

সবিতা মিষ্টি হেসে বলে, অপরাধ হয়ে যাচ্ছে, তাই জানাতে এলাম।

—কী আবার অপরাধ?

—ভাড়াটা এ-মাসেও দিতে পারলুম না।

ব্রজ হেসে ওঠে।—এই কথা। ভাড়া না হয় না-ই দিলেন। আপনি আসবার পর ব্যবসা আমার ফেঁপে উঠেছে। শিগগিরই আর-একখানা বাড়ি কিনব।

—এ তো আনন্দের কথা!

ব্রজ গলাটা নিচু করে বলে, আমি জানি এ আপনার বরাতে। আপনাকে আমি ছাড়ব না কখনও।

সবিতা খিলখিল করে হেসে ওঠে। —পরের বউকে কি ধরে রাখা যায়?

ব্রজ কী একটা বলতে যাচ্ছিল, ওর স্ত্রী ঘরে ঢুকতেই চুপ করে যায়।

ব্রজর এই চুপ করে যাওয়াটা সবিতার একটু অদ্ভুত লাগে। মুখখানা ওর রাঙা হয়ে ওঠে। এ কী আশ্চর্য কাণ্ড! তার বুকটাও যেন কাঁপছে। মনটা যেন এক অভূতপূর্ব আবেগে ভরে উঠেছে।

সে চারটি সন্তানের মা। এ কথাও কি ভুল হয়ে গেল?

সবিতা ওখান থেকে উঠে চলে আসে।

ঘরে এসেও সবিতার বুকের কাঁপুনি থামে না। এ কী বিস্ময়! নিজের মনের দিকে তাকিয়ে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে সবিতা।

সত্তর টাকায় নিদারুণ অনটনে মাসকয়েক কাটে। তবু ব্রজদুলালকে কিছু বলে না। মণীন্দ্রকেও বলে না।

সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে, ব্রজদুলালকে সবিতা প্রশ্রয় দেয় ধীরে-ধীরে, একটু-একটু করে। কেন যে ও প্রশ্রয় দিচ্ছে নিজেই বুঝে উঠতে পারে না। অথচ নিজের অভাবের কথা, কষ্টের কথা কিছুই বলে না।

ব্রজদুলালই একদিন সন্ধ্যায় বলে, বামুনগিন্নি, আমি যদি তোমাকে মাসে একশো টাকা দিই তোমার আপত্তি আছে?

—কেন দেবে?

ব্রজর স্ত্রী বাড়ি ছিল না। ছেলেটাকে নিয়ে বেরিয়েছিল আশেপাশের বাড়ি।

ব্রজ একটু এগিয়ে এসে বলে, সত্যি কথা বলব?

—বলো।

—তোমার কষ্ট আমি আর চোখে দেখতে পাচ্ছি না!

সবিতা হাসে। দুর্বল শরীরে হাসির প্রচণ্ড বেগে কাঁপতে-কাঁপতে বসে পড়ে।

ব্রজ বলে, কিন্তু আমার স্ত্রী যেন না জানে।

সবিতা আরও হাসে। হাসতে-হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

এরপর থেকে প্রত্যেক মাসেই একশো টাকা করে দিয়েছে ব্রজ। সবিতা নিয়েছে। কী জানি কেন ওর মনে হয়েছে এটা ওর প্রাপ্য।

মণীন্দ্র খাবার-দাবার ভালো দেখে জিগ্যেস করেছে, টাকা কোথায় পেলে?

সবিতা হেসে গড়িয়ে পড়ে।

—কী হল, অত হাসছ কেন?

—ব্রজবাবু আমার ছেলেমেয়েদের দুধ খেতে টাকা দেয়।

মণীন্দ্র আর কথা বলে না।

কথা হয়তো মণীন্দ্র কোনওকালেই বলত না—একদিন সন্ধ্যায় যদি নিজে চোখে ওই দৃশ্যটি না দেখত। সন্ধের দিকে ব্রজর স্ত্রী বেড়াতে বেরোয় পাড়ায়।

এই সময়টায় সবিতা ব্রজর কাছে আসে। দুজনে গল্প করে। সবিতা হাসে। ব্রজ মুগ্ধ নয়নে দ্যাখে।

সেদিনও তেমনি এসেছিল।

ব্রজ ঘরের নীল আলোটা জ্বালিয়ে সবিতার গা ঘেঁষে বসল। সবিতা সরে বসল। হাসতে লাগল। ব্রজ বলল, একটু কাছে বসতেও পারো না?

—পরের বউয়ের কাছে বসতে নেই।

তুমি কি সত্যিই আমার পর?—ব্রজর কথায় একটু নাটকীয় ঢং ছিল।

সবিতা হাসতে লাগল। হাসিটা ওর রোগ হল কি না কে জানে?

ব্রজ সরে এসে ওর কাঁধের ওপর মুখটা রাখল। সবিতা কিছু করার, কিছু বলবার আগেই দেখতে পেল, মণীন্দ্র দরজার সামনে থেকে সরে গেল।

মুহূর্তে ওর হাসি বন্ধ হয়ে গেল। উঠে দাঁড়াল ও। ব্রজকে একটা কথা বলবার অবসর না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

নিজের ঘরে গিয়ে দেখল মণীন্দ্র জামা পরনে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। সবিতাকে দেখে একবার তাকাল শুধু। চোখদুটি বেশ রাঙা।

সবিতা ইচ্ছে করেই দু-চারবার ঘরের ভেতর এটা-ওটা নিতে ঢুকল, বেরোল, কিন্তু মণীন্দ্র ওর দিকে আর তাকালও না। কথাও বলল না।

রাতের পূর্বাভাষ। সবিতা আশঙ্কা করছিল, বদমেজাজি মণীন্দ্র কখন ওর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠবে। চিৎকার কিন্তু করল না মণীন্দ্র।

সবিতা একটু বিস্মিত হল, ভীতও হল।

সাহস করে একবার জিগ্যেস করলে, শরীর খারাপ লাগছে? শুয়ে পড়লে যে?

মণীন্দ্র তাকাল। তেমনি রক্তবর্ণ চোখ। বললে, এমনি।

সবিতা আর কথা বলল না। মণীন্দ্র তখন আর কথা বলল না। কথা বললে খাওয়ার সময়। সবিতা বললে, খেতে চলো।

মণীন্দ্র গম্ভীর স্বরে শুধু বললে, তোমার হাতে খেয়ে কি জাতটা দোব?

সবিতা ভ্রু দুটো কুঁচকে বললে, তার মানে?

—মানেটা খুবই সোজা। ন্যাকা সাজবার কোনও প্রয়োজন নেই। কাল থেকে আমি হোটেলে খাব।

—বেশ, খেয়ো।

সবিতা আর কথা না বলে চলে গেল।

এরপর থেকে সবিতা সন্ধের পর পর্যন্ত ব্রজদুলালের কাছে থাকত। মণীন্দ্র এলেও গ্রাহ্য করত না। অগ্রাহ্যটা ইচ্ছাকৃত।

মণীন্দ্র কী ভাবত কে জানে! শুধু ওর কানে আসত ব্রজর সঙ্গে ওর টুকরো-টুকরো কথা আর সবিতার খিলখিল হাসি। আশ্চর্য এই যে, মণীন্দ্র কিছুদিন পর্যন্ত এ সবই সহ্য করল, কিছুই বলল না। সবিতা অবাক হল।

একদিন রাত ন’টা বেজে গেছে।

সবিতা তখনও ঘরে ফেরেনি। ছেলেপুলেরা না খেয়ে শুয়ে পড়েছে। মণীন্দ্র শুয়ে আছে তেমনি।

এত দেরি সবিতা কখনও করে না। হয়তো ব্রজদুলালের স্ত্রী এখন নেই বলেই এত দেরি করছে। ওর স্ত্রী গেছে বাপের বাড়ি। সঙ্গে সবিতার ছোট ছেলেটাকে নিয়ে গেছে। ছেলেটা সবিতার কাছে এখন থাকেই না। ব্রজদুলালের স্ত্রীর কাছেই থাকে। তাকেই মা বলে।

সবিতার এতে একটু ক্ষোভ তো নেই-ই উলটে যেন ঝামেলা থেকে রেহাই পেয়েছে মনে হয়। বাড়াবাড়িটা তাই বড় বেশি হচ্ছে। এই যে এতদিন মণীন্দ্র হোটেলে খাচ্ছে, একটা কথাও বলছে না। তাতে সবিতার যেন কোনও ভ্রুক্ষেপও নেই। মাথার চাঁদিটা জ্বলতে থাকে মণীন্দ্রর।

ইচ্ছে হয় সবিতার গলাটা টিপে মেরে ফেলে।

রাত দশটা বেজে যায়।

আর অপেক্ষা করা যায় না। মণীন্দ্র ওঠে।

বাইরে এসে দ্যাখে দরজাটা ভেজানো। দরজাটা খুলতে ওর সাহস হয় না। জানালাটাও বন্ধ। রাগে-ক্ষোভে কাঁপতে-কাঁপতে এসে শুয়ে পড়ে মণীন্দ্র।

রাত এগারোটা বেজে গেছে।

সবিতা ঘরে ঢোকে। আলোয় একটু লক্ষ করলে দেখা যায় মুখখানা ওর কাগজের মতো সাদা। এসে মণীন্দ্রকে ধাক্কা দেয়।—শুনছ?

সবিতার হাতদুটো বরফের মত ঠান্ডা।

শুনছ।—সবিতার গলা কাঁপছে।

মণীন্দ্র গর্জন করে ওঠে।—ছুঁয়ো না। ও-ঘরে রাতটা কাটিয়ে সকালে কিছু টাকা নিয়ে এলেই পারতে?

তুমি ইতর।—সবিতার গলা এখনও কাঁপে উত্তেজনায়।

—চোপ! আর একটা কথা বললে গলা টিপে কথা বন্ধ করে দোব।

সবিতার কথা শোনা যায় না আর।

মণীন্দ্র হঠাৎ উঠে সবিতাকে ধরে কাঁপায়।—একটা কথা আমার কাছে আজ স্বীকার করো। আমাকে কি কখনও একটু ভালোবাসনি? বলো।

সবিতা পাথর হয়ে গেছে।

—আমি কথা দিচ্ছি, কাল আমি ছেলেদের নিয়ে এ-বাড়ি থেকে চলে যাব। তোমাকে ব্রজদুলালের কাছে দিয়ে যাব। বলো, একটুও ভালোবাসনি আমাকে?

সবিতা কঠিন কণ্ঠে বলে, না।

মণীন্দ্র হতাশ হয়ে শুয়ে পড়ে।

এর পরদিনই ভোরে সবিতাকে রেল লাইনের ধারে গলা কাটা অবস্থায় পাওয়া গেছে। তবে কি মণীন্দ্রই ওকে রাত্রে গলা টিপে মেরে লাইনের ওপর গলাটা পেতে ওকে শুইয়ে এসেছিল!

মণীন্দ্রই ওকে মেরেছে তবে?

এত বড় অপরাধ মণীন্দ্র কেন করল? ও তো সবিতাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। তবে?

ব্রজদুলালের সঙ্গে সেদিন রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত কী কথা হয়েছিল সবিতার?

রাত সাড়ে ন’টার পর থেকে সবিতা বারবার উঠতে গিয়েছিল। ব্রজদুলাল বাধা দিয়েছে।

—রাত অনেক হল। এবার যাই।

ব্রজদুলাল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সবিতার হাতদুটো চেপে ধরে বলে, যেতে দেব না।

আপনার কী মতলব?—সবিতা কঠিন স্বরে হঠাৎ ওকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছিল।

ব্রজদুলাল একটুও না ঘাবড়ে বলেছিল, আমার মতলব কি তোমার অজানা? আমার টাকা আছে কিন্তু আমি অত্যন্ত অসুখী। আমার স্ত্রী আমাকে সুখী করতে পারেনি।

—তা আমি কী করতে পারি?

—তুমি আমার হও, সবিতা।

—কী যা-তা বলছেন। ছাড়ুন।—সবিতা জোর করে।

হাতদুটো জোর করে চেপে ধরে ব্রজদুলাল বলে, না, ছাড়ব না।

সবিতা ভয় পেয়ে বলে, ছাড়ুন, নইলে আমি চেঁচাব। ও-ঘরে আমার স্বামী আছে, জানেন?

ব্রজ হাসে।—তোমার স্বামীকে আমি একটা পোকার মতো টিপে মেরে ফেলতে পারি।

—আপনি এত নীচ। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। গরিবকে দয়া করেন, ভালোবাসেন বলে ভাবতাম। আপনার সাহায্য করবার পেছনে এত নীচ মতলব ভাবতেও পারিনি।

—মাসে-মাসে একশো টাকা করে দিয়েছি, সে কি ভেবেছ তোমরা খেতে পাওনা বলে দয়া করে?

—তাই ভেবেছিলাম। তাই আপনাকে শ্রদ্ধা করেছিলাম। আপনার অনেক অন্যায় আবদার সহ্য করেছিলাম। এখন দেখছি সহ্য করে ভালো করিনি।

ব্রজদুলালের মুখ রাঙা হয়ে ওঠে।—দ্যাখো, লোহার কারবার করি। মনটাও লোহার মতো। তোমাকে আমি চাই। যদি না পাই, তোমাকে জন্মের মতো মেরে ফেলব, আর কাউকে ভোগ করতে দেব না।

সবিতা হেসে ফেলেছিল।—মারবেন? আপনি কি পাঁচবছরের মেয়ে পেয়েছেন?

ব্রজদুলালের গলা কাঁপে।—তুমি আমাকে চেনো না সবিতা। খুন না করলেও আধমরা আমি অনেক মেয়েকে করেছি। টাকায় সব হয়। তুমি তো রাস্তার ভিখিরি, তোমাকে আর তোমার ওই স্বামীকে মেরে পুঁতে ফেললেও কেউ টের পাবে না।

সবিতা সত্যি-সত্যি ভয় পায়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, বেশ, আসব, এখন ছাড়ুন। রাত তিনটের সময় আসব।

—আসবে? না এলে রাত তিনটেয় আমি যাব। জ্যান্ত না পারি তোমাকে মেরে নিয়ে আসব।

সবিতা আর কথা না বলে বেরিয়ে এসেছিল।

রাত তখন সওয়া এগারোটা। ঘরে ঢুকে ও মণীন্দ্রকে ডেকে ব্যাপারটা বলতে যাচ্ছিল। বলতে যাচ্ছিল যে, পুলিশে খবর দাও। আর না হয় চলো আমরা এখুনি কলকাতায় ভাইদের ওখানে চলে যাই।

বলবার সুযোগ মণীন্দ্র দেয়নি। তার আগেই চিৎকার করে উঠল।

বুকটা ভেঙে গেল সবিতার। পাথর হয়ে বসে রইল।

পরদিন ভোরে রেললাইনের ধারে কাটা অবস্থার পাওয়া গেল ওকে। তবে কি ব্রজদুলালই ওকে মেরে ফেলল! রাত তিনটের সময় ঘরে গিয়ে মুখ চেপে ধরেছিল। সবিতা হয়তো ধস্তাধস্তি করতে গিয়েছিল। পাছে মণীন্দ্রর ঘুম ভেঙে যায় তাই ব্রজদুলাল হয়তো ওর মুখ-নাক-গলা চেপে ধরেছিল। পরে যখন দেখল মরে গেছে, তখন রেললাইনের ওপর গলাটা দিয়ে ওকে শুইয়ে রেখে চলে এসেছিল। নিজে বাঁচবার জন্যে। তাই কি?

আমি জানি কে সবিতাকে মেরেছে। আপনারাও জানেন কিন্তু—হয়তো তাকে চিনেও চেনেন না। সে অতি ভীষণ, অতি বীভৎস।

আমি নিশ্চিত জানি, সে-ই সবিতাকে মেরেছে।

ব্রজদুলাল তাকে মারেনি। ব্রজদুলাল মুখে যা-ই বলুক। তার পয়সা আছে, কিন্তু সে ভিতু। সে কাপুরুষ। সে মারতে পারে না।

মণীন্দ্র মারেনি। মণীন্দ্র সবিতাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসত। মণীন্দ্র গরিব, কিন্তু মণীন্দ্র তার সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছিল সবিতাকে। মণীন্দ্র ওকে মারতে পারে না। মণীন্দ্র বরং নিজে মরতে পারত, কিন্তু ওকে মারতে পারত না।

ওকে যে মেরেছে সে অতি ক্রুর অতি নিষ্ঠুর, ভীষণ ভয়াবহ তার স্বভাব।

আমি তার নাম জানি। বহু অসহায় জীবন সে হত্যা করেছে। এই নিষ্ঠুর বীভৎস হত্যাকারীটিকে আমি চিনি।

আমি তার নাম জানি।

কে জানে না? তার নাম দারিদ্র্য।

সে-ই সবিতাকে মেরেছে।

মাসিক রহস্য পত্রিকা

পুজো সংখ্যা, ১৯৬০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *