একটি নায়কের কাহিনি
আমাদের বর্তমান কাহিনির নায়ক কানে কালা বদ্ধ কালা। ইংরেজিতে যাকে বলে stone deaf.
নায়কের অনেক ভালো ভালো গুণের সঙ্গে কিছু দোষ ত্রুটি পাঠক-পাঠিকারা স্নেহের সঙ্গে মেনে নিতে পারেন; কিন্তু কানে কালা নায়ক? উঁহু, অনেক পাঠক-পাঠিকা নায়কের এমন একটা মারাত্মক শারীরিক ত্রুটি সহ্য করতে পারবেন না। তবে পাঠক-পাঠিকারা সইতে-না পারলেও বাড ব্রানহাম পেরেছিল। তার প্রিয় কুকুর কেনাই যখন হঠাৎ কানে কালা হয়ে গেল বাড় তাকে অনাদর করেনি। হ্যাঁ, এই কেনাই নামধারী কুকুরটি আমাদের কাহিনির নায়ক।
কেনাই ছিল একটা মস্ত বড় কুকুরদের দলপতি এবং ওই কুকুরগুলির মালিকের নাম হল বাড ব্রানহাম। বাড আগে ছিল উড়োজাহাজের চালক। পরবর্তী জীবনে সে অবলম্বন করলে শিকারির পেশা। শিকারি-জীবনের কর্মস্থল হিসেবে বাড় বেছে নিল আলাস্কার তুষার-আবৃত, শীতার্ত অঞ্চল।
আলাস্কা শীতপ্রধান দেশ। এই অঞ্চলে ঠান্ডা এত বেশি যে তাপমাত্রা অনেক সময় শূন্যের নীচে নেমে যায়। সেই প্রচণ্ড ঠান্ডায় শিকারিদের কর্মজীবনের অপরিহার্য সঙ্গী হচ্ছে কুকুর। তাদের জিনিসপত্র, সাজসরঞ্জাম, খাদ্য ও ঔষধ প্রভৃতি সব কিছুই বহন করে কুকুরের দল। ওই সব মাল টানার জন্য এক ধরনের চক্ৰহীন শকট ব্যবহার করা হয় যার নাম স্লেজ। জমাট বরফের উপর দিয়ে শক্তিশালী কুকুরের দল মালসুদ্ধ স্লেজ টেনে নিয়ে ছুটতে থাকে। অনেক সময় মানুষও এই কুকুর-বাহিত শকটে আরোহণ করে, তবে নিতান্ত প্রয়োজন না হলে শিকারিরা স্লেজ গাড়িতে উঠতে চায় না, কারণ কুকুরগুলির পক্ষে একটা মানুষকে টেনে নিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টকর ব্যাপার। এই ধরনের কাজের জন্য যে কুকুরগুলিকে ব্যবহার করা হয় তারা অত্যন্ত শক্তিশালী এবং কষ্টসহিষ্ণু জানোয়ার। তাদের বৃহৎ দেহের উপর ছড়িয়ে থাকে ঘন রোমের উষ্ণ আবরণ, তাই আলাস্কার দুরন্ত শীত তাদের সহজে কাবু করতে পারে না। যে কুকুরের দল পূর্ববর্ণিত স্লেজ গাড়ি টানার কাজে নিযুক্ত হয় তাদেরও একটি দলপতি থাকে। বাড ব্রানহামের কুকুরবাহিনীর দলপতি ছিল কেনাই, যাকে নিয়ে আমাদের কাহিনি। এই কুকুরদের দলপতি বা নায়কের দায়িত্ব খুব বেশি। স্লেজ গাড়ি নিয়ে কুকুররা যখন ছুটতে থাকে তখন কুকুরদের মালিক তাদের সঙ্গে থাকে বটে, কিন্তু সারমেয় বাহিনীর দলপতি হয় তাদের একমাত্র নায়ক– তার নির্দেশ পালন করে সমগ্র কুকুরবাহিনী। আলাস্কা অঞ্চলের এই কুকুরগুলি পোষা জানোয়ার হলেও অতিশয় হিংস্র। শক্তি হল তাদের একমাত্র যুক্তি। তাই কেনাই তার ধারালো দাঁত আর শক্ত চোয়ালের জোরে অধিকার করেছিল দলপতির আসন। মালিক বাড় ব্রানহামের হুকম ছিল তার কাছে একমাত্র আইন।
কেটে যায় কয়েকটি বৎসর… নিখুঁতভাবে প্রতিটি আদেশ পালন করে কেনাই… ক্রমে ক্রমে সে হয়ে উঠল প্রভুর একান্ত প্রিয়পাত্র, শিকারি-জীবনের অপরিহার্য সঙ্গী। হঠাৎ একদিন বাড অবাক হয়ে দেখল যে কেনাই তার আদেশ পালন করছে না, তার প্রিয় কুকুর হয়ে উঠেছে নিতান্ত অবাধ্য। বাড প্রথমে আশ্চর্য হল, তারপর সে কেনাই-এর অবাধ্যতার কারণ অনুসন্ধান করতে লাগল। কয়েক সপ্তাহের বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার ফলে বাড় ধীরে ধীরে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। কেনাই হঠাৎ কালা হয়ে গেছে। প্রভুর আদেশ সে শুনতে পায় না। বাড় অত্যন্ত দুঃখিত হল; কিন্তু কানে কালা কুকুর নিয়ে গাড়ি চালানো সম্ভবপর নয়; কারণ কুকুর যদি চালকের নির্দেশ শুনতে না পায় তবে দুর্ঘটনা অনিবার্য। কেনাইকে বাড়িতে রেখে বাড অন্য কুকুরগুলিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শিকার অভিযানে। ঘরের মধ্যে অগ্নিকুণ্ডের ধারে মোটা গালিচার উপর শুইয়ে বাডের ভৃত্যবর্গ কেনাইকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলে।
বাইরে প্রচণ্ড শীত; আলাস্কার কনকনে ঠান্ডা হাওয়া যেখানে শরীরের চামড়া ভেদ করে রক্তমাংস জমিয়ে দিতে চায় সেখানে ঘরের ভিতর জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের উত্তাপ এবং রোমশ গালিচার উষ্ণ আলিঙ্গন অতিশয় লোভনীয়। কিন্তু কেনাই খুশি হল না। বাড এবং তার কুকুরের দল বেরিয়ে যেতেই কেনাই অস্থির হয়ে উঠল। তীব্র আর্তস্বরে সে জানাতে লাগল প্রতিবাদ। কেটে গেল একটি দিন ও একটি রাত্রি, ক্রমে ক্রমে ক্ষীণ হয়ে এল কেনাই-এর উচ্চকণ্ঠ, অবশেষে পরিশ্রান্ত দেহে ক্ষুব্ধ ও ক্ষুণ্ণ কুকুরটি গালিচার উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও সে বোধ হয় শান্তি পায়নি। বাডের চাকররা শুনতে পেল নিদ্রিত অবস্থায় করুণ কণ্ঠে যুঁপিয়ে উঠছে কেনাই, বার বার দীর্ঘশ্বাস ফেলছে অথবা ঘুমের মধ্যেই চিৎকার করে উঠছে উচ্চস্বরে… পরের দিন কেনাই পালিয়ে গেল। একজনের পায়ের ফাঁক দিয়ে সে আধখোলা দরজার ফাঁকে শরীরটা গলিয়ে দিলে তারপর তাকে ধরে কার সাধ্য। তিরের মতো ছুটল কেনাই। কানে শুনতে না পেলে কী হয়, তার ঘ্রাণশক্তি তো নষ্ট হয়নি। রাত্রিবেলা বাড় যেখানে তার কুকুরের দল নিয়ে বিশ্রাম করছিল একেবারে সেইখানে এসে কেনাই উপস্থিত হল। বাডের তো চক্ষুস্থির। কিন্তু এমন অনুগত বন্ধুকে কি তাড়িয়ে দেওয়া যায়? বা তার গলা জড়িয়ে ধরে বললে, ঠিক আছে কেনাই, তোকে আর ফিরে যেতে হবে না। তুই দলপতি থাকবি বটে, কিন্তু গাড়ি টানা তোর পক্ষে সম্ভব নয়– তুই বরং আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চল। ইতিমধ্যে একটা ঘটনা ঘটেছে, সেই কথাই বলছি।
আলাস্কা অঞ্চলে শিকারিরা বিভিন্ন জায়গায় কাঠের ঘর বানিয়ে রাখে, শিকার-অভিযানে বেরিয়ে ওইসব ঘরে তারা সাময়িকভাবে আশ্রয় নেয়। বাড় এইরকম একটা ঘর বানিয়েছিল। আগের দিন রাত্রে নির্দিষ্ট দিনে বাড় দেখল ঘরটা ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে আছে। ঘরের জানলাগুলো একেবারে লোপাট, মাথার উপর থেকে উড়ে গেছে ছাত- মনে হয় যেন এক বিরাট দৈত্য ঘরের উপর তাণ্ডব নৃত্য করে গেছে। বাড অভিজ্ঞ শিকারি– ঘটনাস্থল পরীক্ষা করে সে বুঝল ধ্বংসলীলার জন্য দায়ী একটি প্রকাণ্ড ভালুক। জন্তুটা শুধু ঘর ভেঙে ক্ষান্ত হয়নি। ঘরের মধ্যে যে লোহার উনুন ছিল সেটাকে থাবা দিয়ে পিটিয়ে একেবারে চ্যাপ্টা করে দিয়েছে- চাল, শাকসবজি এবং ময়দার বস্তা ছিঁড়ে সব করেছে লণ্ডভণ্ড- এমনকি যেসব টিনের বাক্সে শুকনো খাদ্য মজুত ছিল সেই বাক্সগুলিকে ফুটো করে সব কিছু নষ্ট করে দিয়েছে। বেচারা বাড় একপাত্র কফি পর্যন্ত তৈরি করতে পারল না, কারণ– কফির কৌটা পর্যন্ত ভালুকের সুনজর এড়িয়ে যেতে পারেনি
ঋক্ষরাজের গায়ের গন্ধ পেয়ে কুকুরগুলো গজরাতে শুরু করলে খুব সম্ভব তারা তাদের জাতীয় ভাষায় ভাল্লুকটাকে গালাগালি দিচ্ছিল। তাদের মালিকও তার নিজস্ব ভাষায় ভালুকের শ্রাদ্ধ করলে। কিন্তু অপরাধী যখন অনুপস্থিত, তখন আর কী করা যায়? কোনোরকমে বাড ভাঙা ঘরটাকে মেরামত করে নিল। ইতিমধ্যে কেনাই এসে হাজির হয়েছে। সকাল বেলা বাড় জায়গায় জায়গায় ফাঁদ সাজিয়ে রাখল জন্তু ধরার জন্য, তারপর কুকুরগুলিকে নিয়ে স্লেজ ছুটিয়ে দিল শিকারের উপযুক্ত দূরবর্তী স্থানের উদ্দেশে। হঠাৎ কুকুরদের কান হয়ে উঠল খাড়া তাদের গতি হয়ে উঠল দ্রুত হতে দ্রুততর ঝড়ের মতো গাড়িটাকে উড়িয়ে নিয়ে ছুটে চলল সারমেয়-বাহিনী। বাড সচমকে গাড়ির ব্রেক চেপে ধরলে, কুকুরগুলি বাধ্য হয়ে থামল। কী ব্যাপার! কুকুরগুলো কি বুনো জানোয়ারের গন্ধ পেয়েছে? বাড নিজের মনেই স্বগত উক্তি করলে, বোধ হয় বনবিড়াল, নেকড়ে কিংবা মুজ হরিণের গন্ধ পেয়েছে কুকুরের দল- হঠাৎ তারা এমন খেপে গেল কেন? কুকুরগুলি মালিকের নির্দেশে কিছুটা সংযত হল। স্বাভাবিক গতিতে তারা আবার ছুটে চলল সামনের দিকে। আচম্বিতে চমকে থেমে গেল কুকুর-বাহিনী। এমন আচমকা তারা থামল যে বরফের উপর কয়েকটা কুকুরের পা পিছলে গেল। কেনাই-এর পরিবর্তে যে কুকুরটিকে বাড দলপতির পদে নিযুক্ত করেছিল সেই জন্তুটার অভিজ্ঞতা ছিল সীমাবদ্ধ। তাই উত্তেজিত দলটাকে সে সংযত করতে পারল না– ভারসাম্য হারিয়ে গাড়ি, লাগাম, কুকুর- সব তালগোল পাকিয়ে জড়াজড়ি করতে লাগল বরফের উপরে- কেলেঙ্কারি কাণ্ড আর কি! কোনোরকমে জন্তুগুলোকে সামলে নিয়ে বাড় দেখল, গাড়ির একটা অংশ বেঁকে গেছে। অতিকষ্টে সেই বাঁকাচোরা অংশটিকে বাড় সোজা করলে, তারপর এগিয়ে রাস্তাটা পরীক্ষা করে এই অশান্তির কারণ অনুসন্ধান করতে লাগল– কুকুরগুলো এমন আচমকা থামল কেন? পোষা জন্তুগুলোর বিসদৃশ ব্যবহারের কারণ বুঝতে বাডের খুব বেশি সময় লাগল না– পথের উপর যে বিরাট পদচিহ্নগুলি রয়েছে সেগুলি দেখেই কুকুররা ঘাবড়ে গেছে।
বাড অভিজ্ঞ শিকারি, পায়ের ছাপগুলির উপর একবার নজর বুলিয়ে সে বুঝল, যে ভাল্লুকটা তার ঘরে হানা দিয়েছিল সেই পাজি জানোয়ারটাই হচ্ছে বর্তমান পদচিহ্নগুলির মালিক। বরফের উপর পায়ের ছাপগুলো থেকে তখনও ধোঁয়া উঠছে, অখ্যাত জন্তুটা একটু আগেই এই পথ দিয়ে হেঁটে গেছে। খানিকটা দূরে পুঞ্জ পুঞ্জ তুষারের বুক চিরে ছুটে চলেছে একটি ক্ষুদ্র জলধারা। সেইদিকে ঘুরে মুখ উঁচু করে কেনাই বাতাসে সশব্দে ঘ্রাণ গ্রহণ করতে লাগল। বাড তার নীরব ভাষা বুঝতে পারল। আমি তোমার কথা বুঝেছি কেনাই। আমাকে একজন পথপ্রদর্শক বলেছিল যে একটু দূরে যে খাদটা রয়েছে সেই কারণে তারা একটা মুজ হরিণ শিকার করছে। ভাল্লুকটা নিশ্চয় ওই মুজটার মৃতদেহ দেখতে পেয়েছে, আর খুব সম্ভব সে এখন খাতের ভিতর বসে মনের সুখে মৃগ মাংস চর্বণ করছে। বাড স্লেজ গাড়ি থেকে একটা রাইফেল টেনে নামিয়ে নিল। ভাবল, ভালুকটাকে মারতে হবে। আমার ফাঁদের মধ্যে যেসব জানোয়ার ধরা পড়বে, ভাল্লুকটা সেগুলোকে শেষ করবে, কাঁদগুলোকে ভাঙবে আর আমার অনুপস্থিতিতে আমার অস্থায়ী ঘরগুলো ভেঙেচুরে সর্বনাশ করবে- নাঃ, এই হতভাগা ভাল্লুকটাকে না মারতে পারলে আমার অনেক টাকা লোকসান হয়ে যাবে। তাকে মারতেই হবে।
ডিসেম্বর মাস। কনকনে ঠান্ডা আলাস্কা অঞ্চলের ভাল্লুকরা এই সময় শীতের নিদ্রা শুরু করে এবং সমস্ত শীতটা ঘুমিয়ে আবার বসন্তকালে শূন্য উদরে জ্বলন্ত ক্ষুধা নিয়ে ওই সময়ে তারা হয়ে ওঠে অতিশয় বিপজ্জনক। কিন্তু ডিসেম্বর মাসে এই আপদটা বাড়কে জ্বালাতে এল কেন? কোনো এক ভদ্র ভাল্লুক এই সময় জেগে থাকে না, ওই সৃষ্টিছাড়া ভাল্লুকটা হচ্ছে নিয়মের ব্যতিক্রম। অদূর ভবিষ্যতেও সে যে বাডের বিষয়সম্পত্তির উপর নজর না দিয়ে চটপট নিদ্রাদেবীর আরাধনায় মনোনিবেশ করবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই— অতএব বাড় ব্রানহাম গুলিভরা রাইফেল হাতে ভাল্লুকের পদচিহ্ন অনুসরণ করলে। যাওয়ার আগে অবশ্যই সে কেনাই এবং অন্য কুকুরগুলিকে বেধে রাখতে ভুলল না। কেনাই প্রভুর সঙ্গে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বাড় তাকে নিতে রাজি হল না। উঁহু, তোমাকে আমি বেঁধে রাখব। তুমি এখন বদ্ধ কালা, আমি চিৎকার করলেও তুমি শুনতে পাবে না। তা ছাড়া ভাল্লুকের নখের আঘাতে তোমার ছিন্নভিন্ন শরীরটা দেখার ইচ্ছা আমার নেই। অতএব হে বন্ধু তুমি এইখানেই আমার জন্য অপেক্ষা কর। এইবার বা তার প্রিয় কুকুরকে ধাপ্পা দেওয়ার চেষ্টা করলে। গাড়ির সঙ্গে কুকুরদলের সামনে সে কেনাইকে বাঁধল। কেনাই বুঝল শকট-চালনার কাজে আবার বুঝি তাকে নায়কের পদমর্যাদা দেওয়া হল। বাড় যখন রাইফেল হাতে ভাল্লুকের সন্ধানে পদচালনা করলে তখন আর কেনাই প্রতিবাদ করলে না। ভাল্লুকের পদচিহ্ন অনুসরণ করতে করতে গভীর খাদের কাছে এসে পড়ল বাড়। খাদের ভিতর দিয়ে ছুটে চলেছে একটা অগভীর জলধারা, আর সেই জলস্রোতের দুই ধারে উঁচু হয়ে আছে শক্ত মাটি ও বরফ। খুব সাবধানে উপর থেকে খাদের ভিতর উঁকি মেরে বাড় দেখল তার অনুমান সঠিক খাতের মধ্যে পডে আছে একটা মস্ত মুজ হরিণের মৃতদেহ এবং সেই মৃগ-মাংসের সদব্যবহার করছে বিশালবপু এক বাদামি ভাল্লক। ঠিক সেইসময় বাড় অনুভব করলে তার হাঁটর পিছন থেকে কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে, আর সেইসঙ্গে তার শ্রবণেন্দ্রিয় প্রবেশ করলে সারমেয় কণ্ঠের মৃদু স্বর-লহরি। সচমক পিছ ফিরল বাড়, তার ললাটে জাগল ক্রোধ ও বিরক্তির কঞ্চনরেখা। সামনে দাঁড়িয়ে আছে কেনাই, বন্ধন রঞ্জুর ছিন্ন অংশটা তার গলবন্ধ থেকে ঝুলছে। রজ্জবদ্ধ অবস্থায় প্রভুর জন্য অপেক্ষা করবে- এই ধরনের পরিকল্পনা কেনাই-এর ভালো লাগেনি। কেনাই তার সারমেয় বুদ্ধিতে বুঝেছিল যে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দ সব কিছু যেখানে নিয়ন্ত্রণ করছে একগাছা দড়ি, সেখানে শক্ত চোয়াল আর ধারালো দাঁত থাকা সত্ত্বেও একখণ্ড তুচ্ছ রঞ্জুর শাসন মেনে চলা নিতান্তই নির্বোধের কাজ। কেনাই নিজেকে নির্বোধ মনে করে না, অতএব বন্ধনরঙ্কুকে উপেক্ষা করে জয়ী হয়েছে দুই সারি শ্ব-দন্তের ধারালো যুক্তি এবং কানে কালা হলেও যেহেতু তার ঘ্রাণশক্তি ছিল অতিশয় জাগ্রত তাই প্রভুর গায়ের গন্ধ অনুসরণ করে অকুস্থলে হাজির হতে তার কিছুমাত্র বিলম্ব হয়নি। অস্ফুট কন্ঠে কেনাই তার প্রভুর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলে। খুব সম্ভব কুকুরদের জাতীয় ভাষায় সে বলতে চেয়েছিল, দেখো, দেখো, আমি এসেছি। বাড় দেখেছিল, কিন্তু মোটেই খুশি হয়নি। মনে মনে সে কেনাই-এর মুণ্ডপাত করতে লাগল। হতচ্ছাড়া কুকুর! আহ্লাদে আওয়াজ করে আবার সোহাগ জানানো হচ্ছে। হতভাগা জানে না যে ভাল্লুকের ক টা কী ভীষণ সজাগ, বহুদূর থেকেও সামান্য শব্দ সে শুনতে পায়। বাড তাড়াতাড়ি কেনাই-এর মুখ চেপে ধরে তার আওয়াজ বন্ধ করে দিলে। বুদ্ধিমান কুকুর বুঝল যে এখন একটুও শব্দ করা উচিত নয়, সে তৎক্ষণাৎ মৌনব্রত অবলম্বন করলে। খুব সাবধানে রাইফেল তুলে বাড় ভাল্লুকের উপর নিশানা স্থির করলে। তারপর টিপে দিলে রাইফেলের ঘোড়া। কিন্তু রাইফেলের মুখে জাগল না অগ্নিশিখা, সগর্জনে অগ্নিবৃষ্টি করল আগ্নেয়াস্ত্র! বাডের হাতের অস্ত্র সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে। ভীষণ ঠান্ডায় যেখানে তাপমাত্রা শুন্যের নীচে নেমে যায় সেখানে অনেক সময় আগ্নেয়াস্ত্র বিকল হয়ে পড়ে। এই তথ্য বাডের অজানা ছিল না, সে মনে মনে নিজেকেই অভিশাপ দিলে অস্ত্রটাকে আগে পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত ছিল। ইতিমধ্যে ভাল্লুক মাথা তুলে বাডের দিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করেছে। হাতের রাইফেল যখন করে বিদ্রোহ ঘোষণা এবং নিকটবর্তী ভাল্লুক (তার ওজন হবে প্রায় ১০০০ পাউন্ড) যখন আহার-কাজ অসমাপ্ত রেখে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করতে থাকে তখন বুদ্ধিমান ব্যক্তিমাত্রেই স্থানত্যাগ করতে চায়। বাড ব্রানহাম বুঝল মানে মানে সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ সে ধীরে ধীরে পিছু হটতে লাগল। কিন্তু ভাল্লুক বোধ হয় কোনো শব্দ শুনতে পেয়েছিল, সে হঠাৎ বাডের দিকে ছুটে এল। বাড আবার রাইফেলের ঘোড়া টিপল। অকেজো যন্ত্র কোনো সাড়া দিল না– ভীত শিকারি একটা গাছ লক্ষ করে প্রাণপণ ছুটল। ভাল্লুক তৎক্ষণাৎ তাকে অনুসরণ করলে। গুরুভার দেহ নিয়েও জন্তুটা যে এত তাড়াতাড়ি ছুটতে পারে চোখে না দেখলে সেকথা কেউ বিশ্বাস করবে না বাড় নির্ঘাত ভাল্লুকের কবলে ধরা পড়ত, কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে দিল কেনাই। প্রভুভক্ত কুকুরটি হঠাৎ ভালুকের সামনে এসে চিৎকার করে উঠল এবং ক্রুদ্ধ ভাল্লুক তাকে ধরার আগেই সে চটপট থাবার নাগালের বাইরে সরে এল। কয়েক মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত হল হিংস্র শ্বাপদ, আর সেই কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যেই দ্রুত পা চালিয়ে বাড গাছটার খুব কাছে এসে পড়ল। আলাস্কার অরণ্য সম্রাট অবশ্য বেশিক্ষণ একটা তুচ্ছ কুকুরকে নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইল না, সে আবার বাডের পিছু নিল। কেনাই কিন্তু নাছোড়বান্দা, সে এবার কামড় বসিয়ে দিলে ভাল্লুকের পশ্চাৎদেশে। ক্রুদ্ধ ভাল্লুক থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে শত্রুর দেহ লক্ষ করে প্রচণ্ড চপেটাঘাত করলে। দাঁড়িয়ে মার খাওয়ার মতো বোকা নয় বাডের কুকুর- ভালুকের শানিত নখগুলি শূন্যে আঘাত করে শূন্যতাকেই খুঁজে পেল কেনাই তখন সেখানে নেই, বিদ্যুদবেগে সে সরে গেছে একপাশে। কুকুর নিয়ে সময় নষ্ট করলে না ভাল্লুক, সে আবার বাডের পিছনে ছুটল। ইতিমধ্যে বাড গাছ বেয়ে কিছুটা উঠে পড়েছে বটে, কিন্তু তখনও সে ভাল্লুকের নাগালের বাইরে যেতে পারেনি। সগর্জন ছুটে এল ভাল্লুক- শিকার বুঝি হাতছাড়া হয়। কেনাই অবশ্য তৎক্ষণাৎ ছুটে এসে শত্রুর পিছনদিকে কামড় বসিয়েছে, কিন্তু ভাল্লুক তার দিকে নজরই দিলে না। একটা সামান্য কুকুরের কামড় আমলেই আনলে না ভালুক। পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়াল এবং প্রকাণ্ড দুই থাবা বাড়িয়ে দিল মানুষটাকে ধরার জন্য। ঠিক সেই মুহূর্তে বোধ হয় এর দাঁত ভাল্লুকের পুরু চামড়া ভেদ করে মাংসের ভিতর বসে গেল হঠাৎ ভীষণ গর্জন করে দ্বিপদ ঋক্ষ-অবতার সামনের দুই থাবা মাটিতে নামিয়ে আনল সশব্দে, পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়িয়ে সে কুকুরটাকে লক্ষ করে থাবা ছুড়ল। ভাল্লুকের নিশানা এবারও ব্যর্থ হল। তিরবেগে সরে এসে আত্মরক্ষা করলে কেনাই। ক্রুদ্ধ ভাল্লুক এইবার কুকুরের দিকে মনোনিবেশ করলে। সে বুঝেছিল এই শত্ৰু ক্ষুদ্র হলেও তুচ্ছ নয়। মহা আক্রোশে গর্জন করে সে তেড়ে গেল কেনাই-এর দিকে প্রায় ১০০ গজ ধরে শুরু হল কুকুর আর ভাল্লুকের দৌড় প্রতিযোগিতা। ছুটোছুটিই হল সার, ভাল্লুক কিছুতেই শত্রুকে ধরতে পারল না। কুকুরটাকে ধরতে না পেরে ভাল্লুক মানুষের দিকেই মনোযোগ দিলে। সে আবার বাডের উদ্দেশে গাছের নিচে এসে দাঁড়াল আর সঙ্গেসঙ্গে সেখানে এসে উপস্থিত হল কেনাই। পরক্ষণেই একটা সনখ থাবা মাটির উপর আছড়ে পড়ল সশব্দে। হাড় কাঁপানো শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সব কিছুই লক্ষ করছিল বাড। তুষারের উপর দিয়ে অনায়াসে ছুটে চলছিল লঘুভার কুকুরটি, কিন্তু ভাল্লুকের মস্ত বড়ো শরীরের ভারে তার পায়ের তলায় বরফ ভেঙে পড়ছিল, ফলে ভারসাম্য হারিয়ে তার গতি হয়েছিল অতিশয় মন্থর। শরীরী বিদ্যুতের মত ধাবমান কেনাইকে সে কিছুতেই গ্রেপ্তার করতে পারল না। বাড় প্রায় কয়েক ঘণ্টা গাছের উপর বসে রইল। প্রচণ্ড শীতে তার সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে এল, কিন্তু গাছ ছেড়ে মাটিতে নেমে আসার উপায় তার ছিল না। উপর থেকে সে ভালুক ও কুকুরের যুদ্ধ দেখতে লাগল। অবশেষে ভালুক ক্লান্ত হয়ে পড়ল। আলাস্কার অরণ্য সম্রাট বাদামি ভাল্লুক একটা কুকুরকে ভয় করে না। তার থাবার আঘাতে বৃষস্কন্ধ মুজ হরিণের ঘাড় ভেঙে যায়। কিন্তু এ কেমন শত্রু! এই শত্ৰু কামড় বসায়, সরে যায়, সরে যায় আর কামড় বসায়– একে দেখা যায় বটে, ধরা যায় না; কিন্তু তার দংশনে শরীর হয়ে যায় ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত। নাঃ, এমন শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা মুশকিল। ভাল্লুক হতাশ হয়ে পড়ল। তিন-তিনবার সে কেনাইকে তাড়া করেছে আর তিনবারই সে হয়েছে ব্যর্থ। চতুর্থবার তাড়া করলে ভাল্লুক, কেনাইও তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরে ছুট দিল। দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে দেখতে লাগল বাড।
ছুট! ছুট! ছুট!
দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে কেনাই আর তার পিছনের মূর্তিমান মৃত্যুর মতো তাড়া করেছে আলস্কার বিভীষিকা বাদামি ভাল্লুক। অবশেষে বাডের চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল দুই জানোয়ার। গাছের উপর আড়ষ্ট হয়ে বসে শীতে কাঁপতে লাগল বাড, নীচে নামতে তার সাহস হল না। কী জানি, শয়তান ভাল্লুকটা যদি ফিরে আসে? না, ভাল্লুক আর এল না। এল কেনাই। দারুণ উত্তেজনায় কেনাই-এর শরীর তখনও কাঁপছে, গাছের তলায় বসে ভাল্লুকের চলার পথে সে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলে। অনেকক্ষণ কেটে গেল, ভাল্লুক আর ফিরল না। বাড় এইবার গাছের নীচের দিকে নেমে এসে তার প্রিয় কুকুরকে জড়িয়ে ধরলে। বাড এবং কেনাই আস্তানার দিকে ফিরে চলল। অবশ্য তারা একটুও অসাবধান হয়নি, চলার পথে বাড় একটা গাছের তলা থেকে আর একটা গাছের তলায় দ্রুতবেগে হেঁটে আশ্রয় গ্রহণ করছিল। হতভাগা ভাল্লুকটা যদি আবার ফিরে আসে তাহলে অনর্থক ছুটোছুটি করে সে জীবন বিপন্ন করবে না, চটপট গাছে উঠে পড়বে। কেনাই মাঝে মাঝে থেমে পিছন দিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করছিল, তার ভাব দেখে মনে হয় যুদ্ধটা আবার শুরু হলে তার আপত্তি নেই। কিন্তু ভাল্লুকের বোধ হয় আপত্তি ছিল। তুচ্ছ কুকুরের কামড় খেয়ে সে লজ্জা বোধ করেছিল কি না বলতে পারব না। তবে সে আর সম্মুখে আত্মপ্রকাশ করেনি… আমাদের কাহিনির চতুষ্পদ নায়ক যে কতখানি বীরত্ব সাহস ও চাতুর্যের পরিচয় দিয়েছিল সেকথা বুঝতে হলে পাঠককে বুঝতে হবে আলাস্কার বাদামি ভাল্লুক কী জাতীয় জীব। এই জন্তুটির দেহের ওজন কমবেশি প্রায় ১০০০ পাউন্ড, স্বভাব অত্যন্ত হিংস্র, দৈহিক শক্তি অসাধারণ। সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগার বা আফ্রিকার সিংহকে আমরা অত্যন্ত ভয়ংকর জন্তু মনে করি, কিন্তু এই বাদামি ভাল্লুক সিংহের চাইতে অনেক বেশি হিংস্র, অনেক বেশি সাহসী, অনেক বেশি শক্তিশালী জানোয়ার। নিম্নলিখিত ঘটনাটি পড়লেই ভাল্লুকের শারীরিক শক্তি সম্বন্ধে পাঠক একটা স্পষ্ট ধারণা করতে পারবেন।
ইংল্যান্ডের একটি সার্কাসে সিংহ এবং ভাল্লুকের খেলা দেখানো হচ্ছিল। হঠাৎ সিংহের মেজাজ গেল বিগড়ে, সে ভাল্লুকের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে এক থাবা বসিয়ে দিলে। পরক্ষণেই রক্তাক্ত দেহ নিয়ে ভাল্লুক হল ধরাশয্যায় লম্বমান। দর্শকরা ভাবল, হয়ে গেল। পশুরাজের কবলে বেচারা ভাল্লুকের প্রাণটা বুঝি গেল। অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে ভাল্লুক হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। সে একটুও ঘাবড়ায়নি ভূমিশয্যা ছেড়ে সে পিছনের দুই পায়ে খাড়া হয়ে উঠল এবং মারমুখী পশুরাজের স্কন্ধদেশে করলে প্রচণ্ড চপেটাঘাত। সেই চড় খেয়ে সিংহ মাটিতে ছিটকে পড়ল, আর উঠতে পারল না। বিস্ফারিত দুই চোখ মেলে দর্শকরা নিরীক্ষণ করলে, পশুরাজের ঘাড় বেয়ে ঝরে পড়ছে তপ্ত রক্তের ধারা… ভালুক কয়েকদিনের মধ্যেই আরোগ্য লাভ করলে। কিন্তু সিংহকে বাঁচানো গেল না। পরের দিনই তার অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে পড়ল যে অনর্থক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সার্কাসের কর্তৃপক্ষ তাকে গুলি করে মারতে বাধ্য হলেন। অন্য উপায় ছিল না। ভাল্লুকের একটি থাপ্পড়ে পশুরাজের স্কন্ধের অস্থি হয়েছিল স্থানচ্যুত এবং প্রধান রক্তবাহী শিরাগুলি হয়েছিল ছিন্নভিন্ন।