একটি দো-নলা গোয়েন্দা গল্প

একটি দো-নলা গোয়েন্দা গল্প
A Double-Barreled Detective Story

০১.

প্রথম দৃশ্য ভার্জিনিয়ার গ্রাম; কাল ১৮৮০। একটি সুদর্শন স্বল্প-উপায়ী যুবক এবং একটি ধনবতী যুবতীর বিয়ে হয়েছে-প্রথম দর্শনেই প্রেম ও তড়িঘড়ি বিয়ে; মেয়েটির বিপত্নীক পিতার ঘোরতর আপত্তি ছিল বিয়েতে।

বর জ্যাকব ফুলারের বয়স ছাব্বিশ বছর; একটি প্রাচীন কিন্তু নগণ্য পরিবারে তার জন্ম; রাজ জেমসের টাকার লোভে পরিবারটি বাধ্য হয়ে সেজমুর থেকে চলে এসেছিল। কনের বয়স উনিশ, দেখতে সুন্দরী। মেয়েটি যেমন রোম্যান্টিক তেমনই অভিজাত বংশ-গৌরবে গর্বিত, আবার স্বামীকে ভালও বাসে তীব্র অনুরাগে। ভালবাসার জন্য সে বাবার অসন্তোষের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, তাঁর ভসনা সহ্য। করেছে, অবিচলিত আনুগত্যের সঙ্গে তাঁর সব সাবধান-বাণী মন দিয়ে শুনেছে, তাঁর আশীর্বাদ ছাড়াই বাড়ি থেকে চলে এসেছে, অন্তরের ভালবাসার গভীরতার এই সব প্রমাণ দিতে পেরে সুখী ও গর্বিত বোধ করেছে।

বিয়ের পরদিন সকালেই সে একটা অপ্রত্যাশিত আঘাত পেল। তার সব রকম আদরকে উপেক্ষা করে স্বামী বলল:

বস, তোমাকে কিছু কথা বলার আছে। আমি তোমাকে ভালবাসতাম। সেটা তোমাকে আমার হাতে তুলে দিতে তোমার বাবাকে অনুরোধ করবার আগেকার কথা। তাঁর আপত্তি আমার দুঃখের কারণ নয়-সেটা আমি সইতে পারতাম। কিন্তু আমার সম্পর্কে তিনি তোমাকে যা বলেছেন-সেটা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। না-তোমাকে কিছু বলতে হবে না; সে কথা আমি ভাল করেই জানি, খুব। নির্ভরযোগ্য সূত্রেই আমি সে সব কথা জেনেছি। অন্য অনেক কথার মধ্যে তিনি এ কথাও বলেছেন যে, আমার মুখেই আমার চরিত্র লেখা আছে; আমি বিশ্বাসঘাতক, কপটাচারী, ভীরু, করুণা বা সহানুভূতিহীন একটা পশু : সেজমুরের ছাপ নাকি আছে আমার মুখে। আমার অবস্থায় পড়লে অন্য কোন লোক সোজা তাঁর বাড়ি গিয়ে তাঁকে কুকুরের মত গুলি করে মারত। আমিও তাই করতে চেয়েছিলাম; মনস্থির করেছিলাম। পরে আরও ভাল একটা মতলব মাথায় এল; তাঁকে অপমান করব, তাঁর মন ভেঙে দেব; তিলে তিলে তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেব। কি করে তা করব? তোমার প্রতি ব্যবহারের দ্বারা, তুমি যে তাঁর প্রাণের পুতুলী! আমি তোমাকে বিয়ে করব; তারপর-ধৈর্য ধরে থাক! সব দেখতে পাবে।

সেই মুহূর্ত থেকে তিন মাস ধরে দৈহিক পীড়ন ছাড়াও স্বামীটির পরিশ্রমী উদ্ভাবনী মন যত রকম অসম্মান ও নির্যাতন আবিষ্ণুর করতে পেরেছে তরুণী বধূটি সে সব সহ্য করেছে। তার প্রখর গর্ববোধই তাকে সাহায্য করেছে, সব কথা সে গোপন রেখে চলেছে। মাঝে মাঝেই স্বামী বলত, বাবার কাছে গিয়ে সব কথা বলে দিচ্ছ না কেন? তারপর নতুন নতুন নির্যাতনের উপায় বের করে আবার সেই একই কথা বলেছে। বধূটি বারবার একই জবাব দিয়েছে, আমার মুখ থেকে তিনি কিছুই জানতে পারবেন না, আর তার পরেই যুবকটি র বংশ নিয়ে বিদ্রূপ করেছে; বলেছে, সে তো দাস-বংশের আইনসম্মত দাসী, তাই সবই সে সহ্য করবে, মানবে, কিন্তু ওই পর্যন্তই তার বেশী নয়; ইচ্ছা করলে স্বামী তাকে মেরে ফেলতে পারে, কিন্তু তাকে নোয়াতে পাবে না; সেজমুর-বংশের সাধ্যে তা কুলোবে না। তিন মাস পার হয়ে গেলে কালো মুখ করে স্বামী একদিন বলল, সব রকম চেষ্টা করে দেখেছি, শুধু একটি বাদে-তারপর জবাবের জন্য অপেক্ষা করে রইল। স্ত্রী বলল, বেশ তো, সেটাই চেষ্টা করে দেখ, তার ঠোঁট বিদ্রুপে বাঁকা হয়ে গেল।

সেদিন মাঝ রাতে উঠে স্বামীটি পোশাক পরে স্ত্রীকে বলল:

ওঠ, পোশাক পরে নাও!

কোন কথা না বলে বধূটি আগের মতই তার কথামত কাজ করল। বাড়ি থেকে আধ মাইল দূরে গিয়ে বড় রাস্তার পাশে একটা গাছের সঙ্গে স্ত্রীকে বেঁধে স্বামী তাকে চাবুক মারতে লাগল, আর বধূটি ও চীৎকার করতে শুরু করল। সে তখন স্ত্রীর মুখটা বন্ধ করে দিয়ে গরুর চামড়ার চাবুক চালাতে লাগল তার মুখে আর লোভী শিকারী কুকুরগুলো লেলিয়ে দিল তার দিকে। কুকুরগুলো তার কাপড় টেনে খুলে ফেলল। তখন কুকুরগুলোকে ডেকে নিয়ে সে বলল:

যাতায়াতের পথে সব লোক তোমাকে দেখতে পাবে। এখন থেকে প্রায় তিন ঘন্টা পরে এ পথে লোক চলাচল করবে, আর তারাই

সংবাদটা ছড়িয়ে দেবে-শুনতে পাচ্ছ? বিদায়। এই আমার শেষ দাওয়াই।

সে চলে গেল। বধূটি গোঙাতে গোঙাতে আপন মনেই বলল:

আমার একটি সন্তান হবে-তারই সন্তান। ঈশ্বর করুন সে সন্তান যেন ছেলে হয়!

যেমন হয়ে থাকে, এক সময় কৃষকরা তাকে মুক্ত করে দিল এবং সংবাদটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সারা দেশ যুবকটি কে শাস্তি দিতে ছুট ল, কিন্তু ততক্ষণে পাখি উড়ে গেছে। তরুণী বধূটি বাবার বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে রইল; বাবাও নিজেকে লুকিয়ে রাখল; কারও সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করত না। তার অহংকার চূর্ণ হয়েছে, বুক ভেঙে গেছে। দিনের পর দিন তার শরীর শুকিয়ে যেতে লাগল; এমন কি মৃত্যু এসে যেদিন তাকে সব যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি দিল সেদিন তার মেয়েও খুসি হয়েছিল।

বিষয়-সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে মেয়েটি উধাও হয়ে গেল।

.

০২.

১৮৮৬-তে নিউ ইংলণ্ডের একটি গ্রামের একটা সাধারণ বাড়িতে একটি যুবতী নারী একটি বছর পাঁচেকের ছেলেকে নিয়ে বাস। করছিল। নিজেই নিজের সব কাজ করত, কারও সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করত না, বন্ধুবান্ধবী কেউ ছিল না। কসাই, রুটি ওয়ালা ও আর যারা স্ত্রীলোকটির কাজ করে দিত তারাও গ্রামবাসীদের শুধু এইটুকুই বলতে পারত যে স্ত্রীলোকটির নাম স্টিলম্যান, আর ছেলেটিকে সে ডাকে আর্চি বলে। সে কোথা থেকে এসেছে তা কেউ জানে না, তবে তার কথাবার্তায় একটা দক্ষিণী টান আছে। মা ছাড়া। ছেলেটির কোন খেলার সঙ্গী নেই, বন্ধু নেই, শিক্ষয়িত্রী নেই। সে কষ্ট করে তাকে লেখাপড়া শেখাত, ফলাফল দেখে খুসিই ছিল-এমন কি কিছুটা গর্ববোধও করত। একদিন আর্চি বলল:

মামণি, আমি কি অন্য ছেলেদের থেকে আলাদা?

না তো! কিন্তু কেন বল তো?

 একটি মেয়ে এদিক দিয়ে যেতে যেতে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ডাক-পিয়ন এসেছিল কি না; আমি বললাম হ্যাঁ; সে তখন বলল, কতক্ষণ আগে আমি তাকে দেখেছি। আমি বললাম, আমি তাকে মোটে ই দেখি নি; তখন সে বলল, তাহলে আমি জানলাম কেমন করে ডাক-পিয়ন এসেছিল; আমি বললাম, আমি যে গলিতে তার চলার গন্ধ পেয়েছিঃ তখন সে বলল যে আমি একটা আকাট মুখখু, আর আমাকে মুখ ভেঙচে দিল। সে ও রকম করল কেন?

যুবতীটি সাদা হয়ে গেল; নিজের মনে মনে বলল, এটা জন্ম-লক্ষণ! রক্তলোভী শিকারী কুকুরের প্রকৃতি-দত্ত শক্তি এর মধ্যে আছে। ছেলেটি কে বুকের মধ্যে টেনে এনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ঈশ্বরই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন! তার দুই চোখ ঝ ঝ ক্ করে জ্বলতে লাগল, উত্তেজনায় ঘন ঘন শ্বাস পড়তে লাগল। নিজেকেই বলল: এতদিনে সমস্যার সমাধান হয়েছে; অন্ধকারে ছেলেটি যে সব কাজ করত এতদিন সেটা আমার কাছে রহস্যময় ছিল, কিন্তু আজ সবই পরিঙ্কর হয়ে উঠেছে।

তাকে ছোট চেয়ারটায় বসিয়ে স্ত্রীলোকটি বলল:

আমি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর সোনা; তারপর সব কথা বলব।

নিজের ঘরে গিয়ে ড্রেসিং-টেবিল থেকে কতকগুলি টুকিটাকি জিনিস নিয়ে সেগুলিকে লুকিয়ে রাখল: নখ-ঘসার উ খোটাকে রাখল মেঝেতে বিছানার নীচে; এক জোড়া নখ-কাটার কাচি রাখল বুরোটার নীচে; একটা ছোট হাতির দাঁতের কাগজ-কাটা ছুরি রাখল কাপড়ের আলমারির তলায়। তারপর ফিরে গিয়ে বলল:

এই যা! কয়েকটা জিনিস ফেলে এলাম যে! জিনিসগুলোর নাম উল্লেখ করে বলল, যাও তো সোনা, ওগুলো নিয়ে এস।

ছেলেটা ছুটে চলে গেল এবং একটু পরেই জিনিসগুলি নিয়ে ফিরে এল।

কোন অসুবিধা হয়েছিল কি সোনা?

না মামণি; তুমি যেখানে যেখানে গিয়েছিলে আমিও সেখানে সেখানে গিয়েছি।

ছেলেটির অনুপস্থিতিতে সে বুক-কেসের কাছে গেল, নীচের তাক থেকে খানকয় বই নিল, প্রত্যেকটি বই খুলে একটা পাতার উপর হাত বুলিয়ে পৃষ্ঠা-সংখ্যাটা মনে করে রাখল, এবং তার পর বইগুলোকে যথাস্থানে রেখে দিল। এক সময় বলল, দেখ আর্চি, তুমি যখন এখান থেকে চলে গিয়েছিলে তখন আমি কিছু কাজ করেছি। সেটা কি কাজ আমাকে বলতে পার?।

ছেলেটি বুক-কেসের কাছে গেল, যে বইগুলোতে হাত দেওয়া হয়েছিল সেগুলো টেনে বের করল, আর বই খুলে ঠিক সেই পাতাগুলি বের করল।

মা তাকে কোলে নিয়ে বলল:

এবার তোমার প্রশ্নের জবার দেব সোনা। আমি বুঝতে পেরেছি, একদিন থেকে তুমি অন্য ছেলেমেয়েদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তুমি অন্ধকারে দেখতেও পাও, অন্য লোকে পারে না এমন গন্ধ শুঁকতে পার, একটা রক্তলোভী শিকারী কুকুরের শক্তি আছে তোমার মধ্যে। শক্তিটা মূল্যবান, থাকা ভাল, কিন্তু কথাটা তুমি গোপন রাখবে। লোকে টের পেয়ে গেলে তোমাকে বলবে আজগুবি ছেলে, অদ্ভুত ছেলে, অন্য ছেলেরা তোমাকে পছন্দ করবে না, তোমাকে আজে-বাজে নামে ডাকবে। অন্যের ঘৃণা বা ঈর্ষাকে এড়াতে হলে এ পৃথিবীতে তোমাকেও অন্য সকলের মতই হতে হবে। তোমার মধ্যে যে শক্তি জন্ম নিয়েছে সেটা ভাগ্যের কথা, আর সেজন্য আমি খুসি; কিন্তু মামণির জন্য কথাটা তুমি গোপন রাখবে; রাখবে তো?

না বুঝে শুনেই ছেলেটি কথা দিল।

তারপর সারাটা দিন মায়ের মাথার ভিতরটা উত্তেজনায় কিলবিল করতে লাগল; কত মতলব, কত ফন্দি, কত পরিকল্পনা; সবই উদ্ভট, অস্বাভাবিক, ভয়ংকর। তথাপি তাতেই তার মুখটা জ্বলজ্বল করতে লাগল; একটা নারকীয় দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। একটা অস্থিরতা তাকে পেয়ে বসল; সে স্থির হয়ে বসতে পারে না, দাঁড়াতে পারে না, পড়তে পারে না, সেলাই করতে পারে না; অনবরত চলে বেড়ানো ছাড়া কিছুতেই স্বস্তি নেই। ছেলের শক্তিকে সে বিশ রকমভাবে পরীক্ষা করে দেখল, আর সারাক্ষণই অতীতের মধ্যে ডুবে গিয়ে নিজেকে বলতে লাগল: সে আমার বাবার বুকখানা ভেঙে দিয়েছিল, আর এতকাল ধরে দিন রাত আমি বৃথাই খুঁজে মরেছি, কেমন করে তার বুকটা ভেঙে দিতে পারব। আজ পথ খুঁজে পেয়েছি-পথ খুঁজে পেয়েছি।

রাত হল। অস্থিরতার শয়তান তখনও তাকে ভর করে আছে। আরও পরীক্ষা সে করবে। একটা মোমবাতি হাতে নিয়ে সে বাড়ির নীচের তলা থেকে চিলেকোঠা পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতে লাগল, আর পিন, সুচ, অঙ্গুলিত্ৰাণ, সুতোর গুলি,-সব কিছু লুকিয়ে রাখল বালিশের নিচে, কার্পেটের নীচে, দেয়ালের খাঁজে, কয়লার পাত্রের নীচে; তারপর ছোট ছেলেটি কে অন্ধকারে পাঠিয়ে দিল সে সব খুঁজে বের করতে। খুঁজে সে বেরও করল; তাই দেখে মা যখন তার প্রশংসা করতে লাগল, আদর করতে লাগল, তখন সেও খুসি হল, গর্ববোধ করল।

সেই দিন থেকে স্ত্রীলোকটির জীবনের রূপই বদলে গেল। সে বলল, ভবিষ্যৎ নিরাপদ-এখন আমি অপেক্ষা করতে পারি, আর সে প্রতীক্ষাকে উপভোগ করতে পারি। জীবনের সব রস বুঝি ফিরে এল। সে আবার গান গাইতে শুরু করল; ভাষা শেখা, ছবি আঁকা, প্রভৃতি কুমারী জীবনের সে সব সাধ-আহ্লাদা সে অনেক দিন ছেড়ে দিয়েছিল সে সব কিছুতেই আবার নতুন করে হাত দিল। আবার সুখ ফিরে এল; ফিরে এল জীবনের স্বাদ। বছর পার হতে লাগল, ছেলে ও বড় হতে লাগল, আর তাই দেখে সেও খুসি হয়ে উঠল।

অনেক বছর পার হয়ে গেল। আর্চি এখন সৌম্য, সুদর্শন, সুঠাম যুবক; খেলাধূলায় পারদর্শী, ভদ্র, মর্যাদাসম্পন্ন, রুচি বান; বয়সের তুলনায় কিছুটা বড় দেখায়। বয়স ষোল বছর। একদিন সন্ধায় মা তাকে বলল, একটা গুরুতর কথা তাকে বলবার আছে; সে কথা শুনবার মত বয়স তার হয়েছে; বেশ কয়েক বছর ধরে সে ভয়ংকর পরিকল্পনাকে সে একটু একটু করে গড়ে তুলেছে তাকে বাস্তবে রূপ দেবার মত বয়স ও চরিত্রের অধিকারীও সে হয়েছে। তখন সে খোলাখুলিভাবেই তার তিক্ত কাহিনী ছেলেকে শোনাল। কিছুক্ষণের জন্য ছেলেটি বিমূঢ়ের মত কাটাল। তারপর বলল:

বুঝতে পেরেছি। আমরা দক্ষিণী; আমাদের রীতিতে ও প্রকৃতিতে প্রায়শ্চিত্তের একটি মাত্র পথ আছে। আমি তাকে খুঁজে বের করে হত্যা করব।

হত্যা করবে? না! মৃত্যু তো মুক্তি, মোক্ষলাভ; মৃত্যু তো তার প্রতি করুণা। তাকে আমি করব করুণা? তার মাথার একগাছি চুলেও তুমি হাত দিতে পারবে না।

ছেলেটি নিজের চিন্তায়ই ডুবে গিয়েছিল; এবার বলল:

তুমি আমার পৃথিবী; তোমার ইচ্ছাই আমার কাছে বিধান, আমার সুখ। তুমি বলে দাও কি করতে হবে, আমি তাই করব।

মায়ের চোখ দুটি খুসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল; বলল:

তুমি যাও, তাকে খুঁজে বের কর। এগারো বছর ধরে সে কোথায় লুকিয়ে আছে আমি জানি; পাঁচ বছর ধরে তাকে খুঁজেছি, অনেক অর্থ ব্যয় করেছি, তবে তার সন্ধান পেয়েছি। কলোরাডোতে সে এখন আগ্নেয়শিলার খনির মালিক; প্রভূত বিত্তশালী। ডেনভার-এ থাকে। নাম জ্যাকব ফুলার। দেখ-সেই অবিস্মরণীয় রাতের পর এই প্রথম আমি এ কথা বলছি। ভেবে দেখ! ঐ নাম তোমারও হতে পারত। আমি তোমাকে দিয়েছি পরিচ্ছন্ন জীবন, তোমাকে রক্ষা করেছি সেই লজ্জার হাত থেকে। সেখান থেকে তাকে তুমি তাড়াবে; তার পিছনে ধাওয়া করে আবার তাড়াবে, আবার, আবার, আবার, অনবরত, প্রতিনিয়ত তাকে তাড়া করে ফিরবে; তার জীবনকে বিষময় করে তুলবে, রহস্যময় আতংকে ভরে তুলবে, শ্রান্তি ও দুর্দশার শেষ সীমায় ঠেলে দেবে; সে যেন মৃত্যুকে কামনা করে, যেন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়; তাকে এক চির-পথিক ইহুদিতে পরিণত করবে; জীবনে সে বিশ্রাম পাবে না, মনে শান্তি পাবে না, নিশি ত ঘুম আসবে না তার চোখে; ছায়ার মত তুমি তাকে অনুসরণ করবে, তার পিছনে লেগে থাকবে, তাকে নির্যাতন করবে, আর যে ভেবে সে আমার বাবার ও আমার বুক ভেঙে দিয়েছে সেই ভাবে তার বুকটাও ভেঙে দেবে।

তোমার কথামতই আমি কাজ করব মা।

আমি তা জানি বাবা। আয়োজন সমাপ্ত; সব কিছু প্রস্তুত। এই নাও প্রত্যয়-পত্র; ইচ্ছামত খরচ কর; টাকার অভাব নেই। কখনও কখনও তোমাকে লুকিয়ে থাকতে হতে পারে; সে ব্যবস্থাও করে রেখেছি; আরও অনেক রকম সুবিধার ব্যবস্থাও রয়েছে। টাইপরাইটার-টেবিলের টানা থেকে কয়েক পাতা কাগজ বের করল। সব কটাতেই এই কথাগুলিই টাইপ করা হয়েছে:

১০,০০০ পাউ শু পুরস্কার

যতদূর জানা গেছে, এমন একটা লোক এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে যাকে কোন পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্রে খোঁজ করা হচ্ছে। ১৮৮০-র রাত্রিকালে সে তার তরুণী স্ত্রীকে বড় রাস্তার পাশে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে গরুর চামড়ার চাবুক দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে, কুকুর লেলিয়ে দিয়ে তার পোশাক ছিঁড়ে নেয়, তাকে উলঙ্গ করে রাখে। তরুণীটি কে সেইখানে রেখে সে দেশ থেকে পালিয়ে যায়। মেয়েটির রক্ত-সম্পর্কের । কোন একজন সতেরো বছর ধরে তাকে খুঁজছে। ঠিকানা…… ডাকঘর। উক্ত সন্ধনকারীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে কেউ যদি অপরাধীর ঠিকানা জানাতে পারে, তাহলে তাকে উপরোক্ত পুরস্কার দেওয়া হবে।

তুমি যখন তাকে খুঁজে পাবে, তার কিছু খোঁজ-খবরও জানতে পারবে, তখন আমরা রাত্রিবেলা গিয়ে তার বাড়িতে একটা প্ল্যাকার্ড মারব, এবং ডাক-ঘরে অথবা অন্য কোন প্রকাশ্য স্থানে আর একটা প্ল্যাকার্ড মেরে দেব। এই কথা নিয়ে সকলেই আলোচনা করবে। প্রথমে তাকে কয়েক দিন সময় দেবে যাতে তার জিনিসপত্র গুলি সে অল্প দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। আমরা তাকে ধ্বংস করব, কিন্তু একটু একটু করে; একবারেই তাকে দারিদ্র্যের মধ্যে ঠেলে দেব না, কারণ তাতে তার মনে নৈরাশ্য দেখা দেবে, তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়বে, হয়তো বা তার মৃত্যু ঘটবে।

আর তিন-চারখানা টাইপ-করা কাগজ-একই প্রতিলিপি-টানা থেকে বের করে সে পড়তে লাগলঃ

জ্যাকব ফুলারকে:

সব কিছু মিটিয়ে ফেলবার জন্য তোমাকে…দিন সময় দিচ্ছি। ততিদন পর্যন্ত তোমাকে বিরক্ত করব না।…মাসের.তারিখ…টা বাজলেই সেই সময় পার হয়ে যাবে। তখনই তোমাকে চলে যেতে হবে। উল্লেখিত সময়ের পরেও যদি তুমি সেখানে থাক, তাহলে সব দেয়ালে তোমার নামে প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে দেব, তাতে থাকবে তোমার অপরাধের বিবরণ, তার ঘটনাস্থল ও তারিখ, এবং তোমার নামসহ সংশ্লিষ্ট সকলের নাম। দৈহিক আঘাতের ভয় করো না, কোন অবস্থাতেই সে রকম আঘাত তোমাকে করা হবে না। একটি বৃদ্ধ মানুষকে তুমি কষ্ট দিয়েছ, তার জীবনটা নষ্ট করেছ, তাঁর বুক ভেঙে দিয়েছ। যে কষ্ট তিনি সয়েছেন, সেই কষ্ট তোমাকে সইতে হবে।

তোমার নাম স্বাক্ষর করো না। সকলে ঘুম থেকে ওঠার আগে পুরস্কারের ঘোষণাটা জানবার আগেই তাকে এই প্ল্যাকার্ড টা পেতে হবে-নইলে তার মাথা খারাপ হয়ে যেতে পারে।

আমার ভুল হবে না।

শুরুতে এই সব লেখা তোমার দরকার হবে-একবার হলেই যথেষ্ট। পরে যখন তাকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে, তখন তাকে নতুন যে সব কাগজ ধরিয়ে দেবে তাতে শুধু লেখা থাকবে:

এখান থেকে চলে যাও। তোমার হাতে আছে…..দিন।

সেই কথামতই সে চলবে। সেটা নিশ্চিত।

.

০৩.

মাকে লেখা কয়েকটা চিঠির অংশবিশেষ:

ডেনভার,
এপ্রিল ৩, ১৮৯৭

কয়েকদিন যাবৎ জ্যাকব ফুলার-এর সঙ্গে এক হোটেলেই আমি আছি। তার গন্ধ শুঁকে নিয়েছি; দশ ডিভিশন পদাতিক সৈন্যের ভিতর থেকেও তাকে আমি খুঁজে বের করতে পারব। অনেক সময়ই তার খুব কাছাকাছি গিয়েছি, তাকে কথা বলতে শুনেছি। সে একটা ভাল খনির মালিক; খনি থেকে তার উপার্জনও ভাল; কিন্তু সে ধনী নয়। খনির কাজ সে ভালভাবে শিখেছে-খনির মজুর হয়ে কাজ করেছে। লোকটা হাসিখুসি; তেতাল্লিশ বছর বয়স তাকে কাবু করতে পারে নি; তাকে দেখলে বয়স অনেক কম বলেই মনে হয়-ধরো ছত্রিশ বা সাঁইত্রিশ। আর বিয়ে করে নি, বিপত্নীক বলেই নিজের পরিচয় দেয়। সে ভালই আছে; সকলে পছন্দ করে, জনপ্রিয়, আর অনেক। বন্ধুবান্ধবও আছে। এমন কি আমি নিজেও যেন তার প্রতি একটা টান অনুভব করছি-আমার মধ্যে যে পিতৃরক্ত আছে সে যেন কথা বলতে চাইছে। প্রকৃতির নিয়ম-কানুন কত অন্ধ যুক্তিহীন আর খেয়ালী। আমার কাজ এখন কঠিন হয়ে উঠছে-বুঝতে পারছ তো?-ব্যাপারটা ভাল করে বুঝতে চেষ্টা করছ তো?-আর ইচ্ছার বিরুদ্ধেও বুকের আগুন যেন অনেক ঠান্ডা হয়ে এসেছে। কিন্তু আমি কাজ চালিয়েই যাব। কাজের সুখ কমে গেলেও কর্তব্য তো রয়েছে; আমি তাকে ছেড়ে দেব না।

যখনই ভাবি যে এত বড় জঘন্য অপরাধ করেছ একমাত্র সেই তার জন্য কোন কষ্ট ভোগ করে নি এখনই একটা তীব্র ক্ষোভ আমার মধ্যে জেগে ওঠে। স্পষ্টতই জীবনের শিক্ষা তার চরিত্রকে সংশোধন করেছে, আর সেই পরিবর্তনের ফলে আজ সে সুখী। অপরাধ করেছে সে অথচ সেই অব্যাহতি পেয়েছে সব যন্ত্রণার হাত থেকে; আর নির্দোষ হয়েও যন্ত্রণায় তুমি দগ্ধ হচ্ছ। কিন্তু তুমি আশ্বস্ত থাকো-তার পাপের ফ ল তাকে ভোগ করতেই হবে।
—সিলভার গুলচ,
১৯ মে

এপ্রিলের ৩ তারিখ মাঝ রাতে ১নং কাগজটা ঝুলিয়ে দিয়েছি; এক ঘণ্টা পরে ২নং কাগজটা তার ঘরের দরজার নীচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছি; তাতে জানিয়ে দিয়েছি, ১৪ই রাত ১১-৫০ মিনিটে বা তার আগে তাকে ডেনভার ছেড়ে চলে যেতেহবে।

সংবাদপত্রের জনৈক প্রতিবেদক বিলম্বে আসা পাখির মত আমার একটা প্ল্যাকার্ড চুরি করে এবং সারা শহর খুঁজে আরও একটা পেয়ে। সেটাও চুরি করে। এইভাবে খবরের কাগজের ভাষায় যাকে স্কুপ বলে তাই সে করে, অর্থাৎ একটা দামী সংবাদ বানিয়ে ফেলে, আর অন্য কোন কাগজ যাতে সেটা না পায় সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্ট রাখে। এইভাবে তার কাগজ- শহরের এটাই বড় কাগজ-পরদিন সকালে সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় খবরটা বড় বড় অক্ষরে ছেপেছে, আমাদের অভাগা লোকটি সম্পর্কে এক কমলব্যাপী অগুদগার করেছে এবং আমাদের ঘোষণা করা এক হাজার ডলার পুরস্কার যে তার কাগজের হিসাবেই জমা পড়বে এই মন্তব্য করে শেষ করেছে! ব্যবসার খাতিরে কোন্ কাজ কি ভাবে করতে হয় এখানকার সংবাদপত্রগুলি সেটা ভালই জানে।

প্রাতরাশের সময় আমার নির্দিষ্ট আসনটি তে গিয়ে বসলাম-এই আসনটি আমি বেছে নিয়েছি কারণ এখান থেকে বাবা ফুলার-এর মুখটা ভাল দেখা যায় আর তার টেবিলে কোন কথা হলে তাও শোনা যায়। পঁচাত্তর থেকে একশ জন লোক ছিল ঘরে; সকলের মুখেই ঐ এক আলোচনা; সকলেই আশা করছে যে, অনুসন্ধানকারী রাস্কেলটাকে খুঁজে পাবে এবং লোহার গরাদে, বা বুলেট, বা অন্য কিছুর সাহায্যে তার উপস্থিতির নোংরামির হাত থেকে শহরটাকে বাঁচাবে।

ফুলার যখন ঢুকল তখন এক হাতে ভাঁজ করা ছিল শহর ছাড়বার নির্দেশটা, আর অন্য হাতে ছিল খবরের কাগজ; তাকে দেখে আমার বেশ কষ্ট হল। কোথায় গেল সেই হাসিখুসি ভাব; সে যেন বুড়িয়ে গেছে, ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেছে। আর তারপরই-ভেবে দেখ কী সব কথা তার কানে আসতে লাগল! মামণি, তার নিজের বন্ধুরাই অজান্তে এমন সব ভাষায় তারই বর্ণনা দিতে লাগল যা একমাত্র শয়তানের নিজস্ব শব্দ-কোষেই পাওয়া যায়। তার চাইতেও বড় কথা, সেই সব বাণী তাকে হজম করতে হয়েছে। সে জন্য সকলকে প্রশংসাও করতে হয়েছে। সে প্রশংসা যে তার নিজের মুখে তেতো লেগেছে সেটা আমার চোখকে এড়ায় নি। আরও দেখলাম, তার ক্ষিধে পর্যন্ত চলে গেছে; শুধু নাড়াচাড়াই করল, কিছুই খেল না। শেষ পর্যন্ত একজন বলল:

এটা খুবই সম্ভব যে আত্মীয়টি এই ঘরেই আছেন এবং সেই অখাদ্য বদমাশটা সম্পর্কে এই শহর কি ভাবছে তাও শুনছেন। আমি তো তাই আশা করছি।

মাগো, ফুলার যে ভাবে কুঁকড়ে গেল এবং ভয়ার্ত চোখে চারদিকে তাকাতে লাগল, তা দেখলে সত্যি কষ্ট হয়। সে আর সইতে না পেরে উঠে ঘর থেকে চলে গেল।

কয়েক দিনের মধ্যেই সে প্রচার করে দিল, মেস্কিকোতে একটা খনি কিনেছে; তাই নিজে সেই সম্পত্তি দেখাশুনা করবার জন্য। এখানকার সবকিছু বেচে দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখানে চলে যাবে। খেলাটা সে ভালই খেলল; জানাল, দাম হিসাবে সে ৪০,০০০ পাউন্ড নেবে-চার ভাগের এক ভাগ নগদে এবং বাকিটা নিরাপদ নোটে; কিন্তু যেহেতু নতুন সম্পত্তিটা কিনতে অনেক টাকার দরকার তাই সবটা নগদে পেলে সে দামটা কমিয়ে দেবে। ৩০,০০০ পাউন্ডে সে বেচে দিল, তার তারপরে কি করল বল তো? সে দামটা চাইল গ্রীণব্যাক-এ (প্রচলিত কাগজের নোট) আর নিল ও তাই; বলল, মেক্সিকোর একজন নিউ-ইংল্যাণ্ডার, তার মাথায় গোবর ভর্তি, সোনা বা ড্রাফটের পরিবর্তে সে গ্রীণব্যাকই পছন্দ করে। লোকে ভাবল ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত, কারণ নিউ ইয়র্কের উপর ড্রাফট থাকলে সহজেই তাকে গ্রীণব্যাক-এ পরিবর্তিত করা যায়। এ নিয়ে অনেক কথা হল, কিন্তু সে ঐ একদিনের জন্য; অর্থাৎ ডেনভার-এ একটা বিষয় নিয়ে যতক্ষণ আলোচনা চলে থাকে।

সারাক্ষণই আমি কড়া নজর রেখেছিলাম। বিক্রির ব্যাপারটা পাকা হয়ে দেনাপাওনা যেই মিটে গেল-সেটা ১১ই তারিখের কথা-অমনি আমি ফুলারের পিছনে লেগে রইলাম, মুহূর্তের জন্যও তাকে চোখের আড়াল করলাম না। সেই রাতেই-না, ১২ই তারিখ মাঝ রাতের কিছু পরে-তার পিছু নিয়ে তার ঘরটার সন্ধান করলাম; ঘরটা বাড়ির একই অংশে আমার ঘর থেকে চারটে দরজা পরে; তারপর আমার ঘরে ফিরে গেলাম, দিন-মজুরের ধুলো-মাখা ছদ্মবেশটা নিলাম, গায়ের রং কালো করে ফেললাম, এবং কিছু ভাঙানি-ভর্তি একটা ছোট হলে নিয়ে ঘরের দরজাটা হাট করে খুলে রেখে অন্ধকারে ঘরের মধ্যে বসে রইলাম। কারণ আমার সন্দেহ হয়েছিল যে পাখি এখনই পাখা মেলবে। আধ ঘন্টা পরেই একটি বুড়ি একটা থলে নিয়ে চলে গেল। ব্যাপার বুঝতে পেরে আমার থলে নিয়ে তার পিছু নিলাম, কারণ ঐ বুড়িটাই ফুলার। পাশের দরজা দিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে মোড়ের মাথায় পৌঁছে সে এমন একটা পথ ধরল যে পথে লোকজনের চলাচল খুবই কম। ঝিরঝির বৃষ্টি ও গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে কিছুক্ষণ পথ চলে সে একটা দুই-ঘোড়ার ছেকড়া গাড়িতে চেপে বসল। গাড়িটা অবশ্যই পূর্ব-ব্যবস্থা মত তার জন্য সেখানে অপেক্ষা করেই ছিল। আমিও পিছনের পা-দানিতে চেপে বসলাম (বিনা নিমন্ত্রণে) এবং ছুটে এগিয়ে চললাম। দশ মাইল চুলবার পরে ছেকড়া গাড়িটা পথের পাশে একটা স্টেশনে থামল। সেখানেই গাড়িটাকে ছেড়ে দেওয়া হল। ফুলার সামিয়ানার নীচে একটা ঠেলাগাড়িতে আশ্রয় নিল। আমি ভিতরে ঢুকে টিকিট–ঘরের খোঁজ করলাম। ফুলার টিকিট কিনল না, আমিও কিনলাম না। ইতিমধ্যে ট্রেন আসতেই সে একটা কামরায় উঠে পড়ল; আমিও অন্য দিক দিয়ে সেই একই কামরায় উঠে পাশ দিয়ে এসে তার পিছনেই একটা আসনে বসে পড়লাম। সে যখন কণ্ডাক্টরকে টাকা দিয়ে তার গন্তব্যস্থানের কথা জানাল, তখন আমি কয়েকটা আসন পিছনে সরে গিয়ে বসলাম এবং কণ্ডাক্টর এলে সেই একই জায়গার টিকিট কাটলাম। জায়গা প্রায় একশ মাইল পশ্চিমে।

সেই থেকে প্রায় এক সপ্তাহ আমাকে নাচিয়ে বেড়াতে লাগল। এখানে, সেখানে, যেখানে খুসি যাচ্ছে। তবে সব সময়ই গতিটা পশ্চিম দিকে-আর প্রথম দিনের পর থেকেই সে আর স্ত্রীলোক নেই। সেও আমার মতই একজন মজুর সেজেছে, আর মোটা নকল গোঁফ লাগিয়েছে। সাজ-পোশাক একেবারে খাঁটি, আর অভিনয়ও করে চলল পাকা, কারণ পয়সার বিনিময়ে এ কাজ সে একসময় করেছে। নিকটতম বন্ধুও তখন তাকে দেখলে চিনতে পারত না। অবশেষে সে এখানে-মন্টানার এই অজ্ঞাত ছোট পাহাড়ী শিবিরে এসে। আস্তানা গেড়েছে। একটা ছোট ঘর নিয়েছে সারা দিন খনির খোঁজে ঘুরে বেড়ায়; লোকজনকে এড়িয়ে চলে। আমি থাকি খনি-মজুরদের একটা বোডিং-হাউসে; ভয়াবহ জায়গা; তক্তপোষ, খাবার, নোংরা-সবই সাংঘাতিক।

চার সপ্তাহ হল আমরা এখানে আছি; এর মধ্যে মাত্র একদিন তাকে দেখেছি; কিন্তু প্রতি রাতেই আমি তার পিছু নেই এবং ঘাপটি মেরে থাকি; যেই সে এখানে একটা ঘর নিল অমনি আমি পঞ্চাশ মাইল দূরে একটা শহরে গিয়ে টেলিগ্রাম করে ডেম্বার হোটেলকে জানিয়ে দিলাম যে আমি চেয়ে না পাঠানো পর্যন্ত আমার মালপত্র যেন সেখানেই রেখে দেওয়া হয়। শুধু সামরিক পোশাকটা পাল্টানো ছাড়া এখানে আর কিছু আমার দরকার নেই, আর সে পোশাক আমি সঙ্গেই এনেছি।

সিলভার গুলচ,
১২ জুন

মনে হচ্ছে ডেনভার-এর ঘটনার সংবাদ এখানে পৌঁছয় নি। শিবিরের অধিকাংশ লোককে আমি চিনি; তারা কেউ ই সে ঘটনার কথা উল্লেখ করে নি; অন্তত আমি তো শুনি নি। এ অবস্থায় ফুলার নিজেকে খুবই নিরাপদ মনে করছে। এখান থেকে মাইল দুই দূরে। পাহাড়ের মধ্যে একটা একটে রে জায়গায় একটা খনির খোঁজ সে পেয়েছে, আর সেখানেই দিন রাত কাজ করে চলেছে। কিন্তু কী পরিবর্তন তার হয়েছে! কখনও হাসে না, নিজের মনেই চলাফেরা করে, কারও সঙ্গে মেশে না-অথচ দুমাস আগেও সে লোকজন কত ভালবাসত, কত ফুর্তিতে ছিল। সম্প্রতি কয়েক দিনই তাকে পথ দিয়ে যেতে দেখেছি- কেমন যেন ঝুঁকে পড়েছে, সর্বদাই সঙ্গীহীন, চলনে সেই সজীবতা নেই, দেখলে দুঃখ হয়। নিজের পরিচয় দেয় ডেভিড উইলসন বলে।

আমরা কোন রকম বিরক্ত না করলে সে এখানেই থাকবে বলে মনে হচ্ছে। যেহেতু তুমি বারবার বলছ, তাই আমি আবার তাকে এখান থেকে তাড়াব; কিন্তু এখন সে যতটা অসুখী আছে তার চাইতে খারাপ আর কি হবে বুঝতে পারছি না। এবার ডেন্ভার-এ ফিরে যাব। কিছুদিন আরাম করব। ভাল খাবার, ভাল বিছানা ও শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যে কিছুদিন কাটিয়ে সব জিনিসপত্র নিয়ে এখানে ফিরে আসব এবং তখন বেচারি উইলসন বাপিকে তল্লাশি গু টোবার নির্দেশ জারী করব।

ডেনভার,
১৯ জুন।

এখানে সকলেই তার অভাব বোধ করছে। সকলেই আশা করছে, মেক্সিকোতে সে অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেছে; এ কথা শুধু মুখেই বলছে না, অন্তর দিয়ে বিশ্বাসও করছে। স্বীকার করছি, এখানে আমি বড় বেশী দিন কাটাচ্ছি। কিন্তু তুমি যদি আমার জায়গায় থাকতে তাহলে এটুকু ক্ষমা করতে। হ্যাঁ, আমি জানি তুমি কি বলবে, আর তুমি যা বলবে তাও ঠিক: আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম, আর মনের মধ্যে বয়ে নিয়ে বেড়তাম তোমার জ্বলন্ত স্মৃতির দাহ–

আগামী কাল রাতের ট্রেনেই আমি ফে রে যাব।

ডেনভার,
২০ জুন।

মা, ঈশ্বর আমাদের ক্ষমা করুন, আমরা একটা ভুল লোককে তাড়া করে ফিরছি। সারারাত ঘুমুতে পারি নি। এখন এই ভোরে সকালের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি-সময় যেন আর কাট তে চাইছে না, মোটে ই কাটতে চাইছে না!

এই জ্যাকব ফুলার আসল দোষীর জ্ঞাতি ভাই। আমরা কী বোকা যে এ কথাটা একবারও আমাদের মে হয় নি যে ঐ শয়তানী কাণ্ডকারখানার পরে দোষী লোকটা কখনও স্বনামে পরিচয় দিতে পারে না। এই ডেভার ফুলার অপর ফুলার অপেক্ষা বয়সে চার বছরের ছোট; অল্প বয়সে বিপত্নীক অবস্থায় সে এখানে এসছিল ৭৯-তে; তখন তার বয়স একুশ, আর সেটা তোমার বিয়ের এক বছর আগেকার কথা; এ কথা প্রমাণ করবার মত তথ্য ও দলিলও অসংখ্য। এখানে আসার দিন থেকে তাকে চেনে এ রকম অনেক বন্ধুর সঙ্গে গত রাতে আমি কথা বলেছি। আমি কিছু বলি নি, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই আমি তাকে আবার এই শহরে ফিরিয়ে আনব, এবং খনির ব্যাপারে তার যা ক্ষতি হয়েছে সেটাও পূরণ করে দেব; এই উপলক্ষে একটা ভোজসভা হবে, একটা মশাল-শোভাযাত্রা হবে, আর সে সব খরচ ই বহন করব আমি। তুমি কি একে বাজে বকবকানি বলতে চাও? তুমি তো ভালই জান যে আমি এখনও ছেলেমানুষ; সেটাই তো আমার সুবিধা। ভাল কথা, আর আমি ছেলেমানুষ থাকব না।

সিলভার গুলচ্‌
 ৩ জুলাই

মা, সে চলে গেছে! উধাও হয়ে গেছে; কোন চিহ্ন রেখে যায় নি। আমি যখন এলাম তখন সব ঠান্ডা হয়ে গেছে। সেই থেকে আজই আমি প্রথম বিছানা ছেড়ে উঠেছি। আমি যদি ছেলেমানুষ না হতাম তাহলেই ভাল হত, কারণ তাহলে আঘাতটা আমি আরও ভালভাবে সইতে পারতাম। সকলেই বলছে, সে পশ্চিমে গেছে। একটা মাল-গাড়িতে চেপে আজ রাতেই যাত্রা করব- দু তিন ঘন্টা চলবার পরেই একটা ট্রেন পেয়ে যাব। কোথায় যাব জানি না, কিন্তু আমাকে যেতে হবেই: চুপচাপা থাকা মানেই তো যন্ত্রণা।

অবশ্যই ছদ্মবেশ ধরে নতুন নাম নিয়ে সে নিজেকে মুছে ফেলেছে। তার অর্থই তাকে খুঁজতে আমাকে হয় তো সারা পৃথিবী চষে বেড়াতে হবে। সত্যিই তাই ঘটবে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছ মা? আমাকেই হতে হবে যাযাবর ইহুদী। ভাগ্যের কি পরিহাস! আমরা তো চেয়েছিলাম অপর কারও ভাগ্যে সেটা ঘটুক।

অসুবিধার কথাগুলিও ভাব! কারও নামে যে বিজ্ঞাপন দেব তারও উপায় নেই। আর যদি কোন উপায়ও থাকে, তাতে তার ভয় পাবার কোন কারণ ঘটবে না। আমি তো কোন পথ খুঁজে পাচ্ছি না; ভাবতে ভাবতে আমার মাথাই গুলিয়ে গেছে। যে ভদ্রলোক সম্প্রতি মেক্সিকোতে একটা খনি কিনেছেন এবং ডে ভারে একটা খনি বিক্রি করেছেন তিনি যদি তার ঠিকানাটা পাঠান, (কাকে পাঠাবে মা!) তাহলে তাকে বুঝিয়ে বলতে পারব যে সবটাই ভুল হয়ে গেছে; তার কাছে ক্ষমা চাওয়া হবে এবং একটা বিশেষ ব্যাপারে তার যা ক্ষতি হয়েছে তাও পূরণ করে দেওয়া হবে। বুঝতে পারছ তো? সে তো এটাকে ফদি বলেই মনে করবে। যে কোন লোকই মনে করত। আবার আমি যদি লিখি, এখন জানা গেছে যে তাকে নয়, আমরা খোঁজ করছি অন্য লোকের-একদা যার ঐ নামটাই ছিল, কিন্তু যথেষ্ট কারণবশত পরবর্তীকালে তিনি ঐ নাম ত্যাগ করেছেন-তাতেও সাড়া মিলবে? কিন্তু ডেভার-এর লোকজন তখন জেগে উঠবে, বলবে ওহো! আর সেই সন্দেহজনক গ্রীণব্যাক-এর কথা তাদের মনে পড়ে যাবে; তারা বলবে, সে যদি আসল লোকই না হবে তাহলে পালিয়ে গেল কেন?-এটা তো সরল কথা। আণি যদি তাকে খুঁজে না পাই, তাহলে যেখানেই থাকুক সেখানেই তার সর্বনাশ হবে-অথচ এখন সে সেখানে নিলুষ অবস্থায় আছে। তোমার মাথা তো আমার চাইতে পরিঙ্কর। আমাকে সাহায্য কর।

একটি সূত্র আমার হাতে আছে, মাত্র একটি। তার হাতের লেখা আমি চিনি। হোটেল-রেজিস্টারে সে যদি তার নতুন ছদ্মনামটা লেখে, আর হাতের লেখা লুকোবার জন্য খুব কারিকুরি না করে, তাহলে কখনও যদি সেই হাতের লেখা দেখতে পাই তো আমার খুব কাজে। লাগবে।

সান ফ্রান্সিস্কো,
 ২৮ জুন, ১৮৯৮

কলোরাডো থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত সারা যুক্তরাষ্ট্র তন্ন তন্ন করে তাকে যে আমি কত খুঁজেছি তা তো তুমি ইতিমধ্যেই জেনেছ; একবার যে তাকে প্রায় ধরে ফেলেছিলাম তাও জেনেছে। দেখ, আরও একবার অল্পের জন্য সে ফ সূকে গেছে। সেটা ঘটেছে এখানে, গতকাল। রাস্তায় তাকে দেখতে পেয়ে তার পিছনে ছুটতে ছুটতে একটা সস্তা হোটেলে গিয়ে উঠলাম। কিন্তু সেখানেই মস্ত বড় ভুল হল; একটা কুকুরও এ ভুল করত না। কিন্তু আমি তো আধা কুকুর, আর উত্তেজিত হলেই আমার বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পায়। সে বাড়িটাতে সে দশ দিন ছিল; কিন্তু আমি তো জানি যে গত ছ আট মাস ধরে সে কোন জায়গায় বেশী দিন থাকে না, সব সময় চঞ্চল হয়ে ছুটে বেড়ায়। তার মনের অবস্থা তো আমি বুঝি। ন মাস আগে একবার যখন তাকে প্রায় ধরে ফেলেছিলাম তখন তার নাম ছিল জেমস ওয়াকার; সেই নামটাই সে এখনও ব্যবহার করে। সিলভার গুলচ থেকে পালাবার সময়ও ঐ নামটাই সে নিয়েছিল। সাদাসিধে মানুষ, ভাল নামের ধার ধারে না। কিছুটা ছদ্মবেশ ধরলেও হাত দেখেই আমি চিনতে পেরেছিলাম। সরল মানুষ, ছল-চাতুরির ধার ধারে না।

সকলে বলল, সে বেড়াতে বেরিয়ে গেছে; ঠিকানা রেখে যায় নি; কোথায় যাচ্ছে তাও বলে যায় নি; ঠিকানা চাওয়াতে বেশ ভয়। পেয়েছিল; একটা সস্তা দামের থলে ছাড়া আর কোন মালপত্র সঙ্গে ছিল না; সেটা কাঁধে করে পায়ে হেঁটে ই চলে গেছে-একটা কঞ্জু ষ বুড়ো মানুষ, চলে যাওয়ায় কারও কোন ক্ষতি হয় নি। বুড়ো! হয় তো এখন তাই সেজেছে। কথাটা কানে গেল কি গেল না, সেই মুহূর্তে তার পিছু নিলাম, ছুটতে ছুটতে জাহাজঘাটায় পৌঁছে গেলাম। মাগো, যে স্টীমারে সে পাড়ি দিল তার ধোঁয়া তখন সবে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। গোড়াতেই যদি ঠিক পথে যেতে পারতাম তাহলে আধ ঘন্টা সময় বেঁচে যেত। তাহলেই একটা দ্রুতগামী নৌকো ধরে ঐ স্টীমারটাকে ধরবার একটা সুযোগ পেতাম। স্টীমারটা মেলবোর্ণ যাচ্ছিল।

হোপ ক্যানন, ক্যালিফোর্নিয়া,
৩ অক্টোবর, ১৯০০

তুমি নিশ্চয় অভিযোগ করতে পার। বছরে একখানি চিঠি  খুবই অপ্রচুর; আমি স্বীকার করছি; পরাজয় ছাড়া লিখবার মত কিছুই যখন থাকে না তখন কি লিখবে? এ অবস্থা অসহ্য; মনকে ভেঙে দেয়।

আমি তোমাকে লিখেছিলাম-মনে হচ্ছে যেন কত যুগ আগে-যে মেলবোর্নে অল্পের জন্য তাকে ধরতে পারি নি; তারপর থেকে মাসের পর মাস সারা অস্ট্রেলেসিয়া তার পিছনে ঘুরেছি।

হ্যাঁ, তারপর তার সন্ধানে ভারতবর্ষে গেলাম; বোম্বাইতে প্রায় দেখাও পেয়েছিলাম; সর্বত্র তাকে খুঁজেছি-বরোদা, রাওয়ালপিণ্ডি, লক্ষ্মী, লাহোর, কানপুর, এলাহাবাদ, কলকাতা, মাদ্রাজ-সর্বত্র; সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস, অনেক ধুলো পেরিয়ে, অনেক ঘাম ঝরিয়ে-সব সময় তার পিছনে লেগে ছিলাম, কখনও খুব কাছাকাছিও গিয়েছি, কিন্তু কোন সময়ই তাকে ধরতে পারি নি। সেখান থেকে গেলাম সিংহলে, আর সেখান থেকে-সে কথা থাক; ক্রমে ক্রমে সবই তোমাকে লিখে জানাব।

তাকে তাড়া করে আবার স্বদেশে ক্যালিফোর্নিয়াতে নিয়ে এলাম; সেখান থেকে মেস্কিকো, এবং আবারও ক্যালিফোর্নিয়া। সেই থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র তাকে তাড়া কে ফিরছি গত ১লা জানুয়ারি থেকে এক মাস আগে পর্যন্ত। আমি প্রায় নিশ্চিত যেসে হোপ ক্যানন-এর কাছাকাছিই আছে; এখান থেকে ত্রিশ মাইল দূরে তার খোঁজ পেয়েছিলাম, কিন্তু তার পরেই সে হারিয়ে গেল; মনে হয়, কেউ তাকে মাল-গাড়িতে তুলে নিয়েছিল।

হারানো পথ খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে এখন আমি বিশ্রাম করছি। মা, ক্লান্তিতে আমি একেবারে ভেঙে পড়েছি, মন-মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে; অনেক সময়ই সব আশা ছেড়ে দেবার মত অবস্থা হয়েছে; কিন্তু এই ছোট খনি-শিবিরের লোকগুলি বড় ভাল; অনেকদিন পরে তাদের কাছে এসে বড় ভাল লাগছে; তাদের হাসিখুসি জীবনযাত্রা মানুষকে তাজা করে তোলে, তার দুঃখকষ্ট ভুলিয়ে দেয়। এক মাস হল এখানে এসেছি। স্যামি হিলেয়ার নামের একটি যুবকের সঙ্গে এক ঘরে আছি। তার বয়স প্রায় পঁচিশ বছর; আমার মতই মায়ের একমাত্র ছেলে; মাকে খুব ভালবাসে আর প্রতি সপ্তাহে মাকে চিঠি লেখে-অনেকটা আমার মতই। ছেলেটি ভীরু স্বভাবের, আর বুদ্ধিশুদ্ধির ব্যাপারে-দেখ, নদীতে আগুন ধরিয়ে দেবার মত ব্যাপারে তার উপর নির্ভর করা যায় না; কিন্তু সে যাই হোক, সকলে তাকে পছন্দ করে, খুব ভাল ছেলে, তার সঙ্গে কথা বললে, বন্ধুত্ব করলে মন খুসি থাকে, আনন্দে ভরে ওঠে। মনে হয় এ রকম বন্ধু যদি জেমস ওয়াকার-এর থাকত। তারও বন্ধুবান্ধব ছিল; সেও সকলের সঙ্গে মিশতে ভালবাসত। প্রথম যখন তাকে দেখেছিলাম সেই সময়কার ছবি মনে পড়ে। কী দুঃখের কথা! সে ছবি মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। আর সেই সময়ই আমি কিনা কোমর বেঁধে লেগেছিলাম তাকে নিয়ে বেড়াতে!

হিলেয়ার-এর মনটা আমার চাইতে ভাল, আমাদের সমাজের যে কোন লোকের চাইতে ভাল, কারণ শিবিরের কদাচারী মানুষ ফ্লিন্ট বাকনার-এর সেই একমাত্র বন্ধু শুধু তার সঙ্গেই ফ্লিণ্ট কথাবার্তা বলে। সে বলে, ফিন্ট–এর ইতিহাস সে জানে; অনেক দুঃখ-কষ্টেই তার এই অবস্থা হয়েছে, আর তাই তার প্রতি যথাসম্ভব উদার ব্যবহার করাই সকলের উচিত। ফ্রি ণ্ট বাকনার সম্পর্কে যে সব কথা। আমি শুনেছি তাতে এটুকু বুঝেছি যে খুব উদার হৃদয়ের লোক না হলে তার মন লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারে না। আমি তো মনে করি, অনেক কষ্ট করে তার পরিচয় দেবার চেষ্টা না করে একটি কথা বললেই তুমি স্যামির চরিত্র সম্পর্কে একটা সপষ্ট ধারণা করতে পারবে। কথা প্রসঙ্গে সে বলেছিল: ফ্লি  আমার আত্মীয়, তার সব দুঃখের কথাই সে আমাকে বলে-মাঝে মাঝে বুকের বোঝাট। হাল্কা করে, নইলে হয় তো বুকটা ফেটে ই যেত। তার মত অসুখী লোক হয় না; মনের দুঃখ দিয়েই তার জীবনটা গড়া-যত বুড়ো তাকে দেখায় আসলে ততটা বয়স্ক সে নয়। অনেক অনেক বছর আগেই সে তার মনের সুখ শান্তি সব হারিয়েছে! সৌভাগ্য কাকে বলে তা সে জানে না-কোনদিন তার দেখা পায় নি; এই পৃথিবী তার কাছে এতই দুঃসহ হয়ে উঠেছে যে প্রায়ই সে বলে, যদি অন্য কোন নরকেও তার স্থান হত তো সেও ছিল ভাল।

.

০৪.

কোন খাঁটি ভদ্রলোকই মহিলাদের উপস্থিতিতে নগ্নসত্যকে প্রকাশ করে না। প্রথম অক্টোবরের একটি ঝরঝরে সুগন্ধি সকাল। লিলাক ও সোঁদাল গাছের মাথায় ঝলমল করছে ফুলের রাশি; সে সব পাখীহীন বন্য প্রাণী গাছের মাথায় বাসা বেঁধে থাকে, দয়ালু প্রকৃতি যেন তাদের জন্য রূপকথার সেতু তৈরি করে রেখেছে। ঢালু বনভূমিতে বন-ঝাউ ও ডালিম ফুলের লাল-হলুদ রঙের বাহার ছড়িয়ে আছে দূর-দূরান্তে; বাতাস ভরে উঠেছে অসংখ্য স্বল্পস্থায়ী ফুলের তীব্র সুরভিতে; বহুদূর ফাঁকা আকাশে একটি নিঃসঙ্গ ইসোফেগাস নিশ্চল পাখায় ভর দিয়ে ঘুমিয়ে আছে; সর্বত্র বিরাজ করছে একটা বিষঃ নিস্তব্ধ তা, গাম্ভীর্য ও স্বর্গীয় প্রশান্তি।

রিপাব্লিকনে পত্রিকার সম্পাদক সমীপেষু:

আপনার জনৈক নাগরিক ইসোফেগাস সম্পর্কে আমাকে একটি প্রশ্ন করেছেন; আপনার মারফ ৎ তাকে আমারে জবাবটা জানাতে চাই। আশা করছি, এই জবাব যথেষ্ট প্রচার লাভ করবে এবং কিছু কলমবাজীর হাত থেকে আমাকে বাঁচাবে; কিন্তু ইতিমধ্যেই একাধিকবার এই একই প্রশ্নের জবাব আমি দিয়েছি এবং তার ফলে যতটা অবসর আমার দরকার তা পাচ্ছি না।

সম্প্রতি আমি একটি ছোট গল্প প্রকাশ করেছি, আর তাতেই ইসোফেগাস কথাটা ব্যবহার করেছি, আপনাকে বলি, এটা নিয়ে কিছু লোক মাথা ঘামাবে সেটা আমি জানতাম-আসলে সেটাই ছিল আমার অভিপ্রায়-কিন্তু তার ফসল সে পরিমাণ জমে উঠেছে এতটা আমি বুঝতে পারি নি। ইসোফেগাস সম্পর্কে দোষী নির্দোষ সকলেই এককাট্টা হয়েছে, অথচ আমি ভেবেছিলাম কিছু গোবেচারী লোকই এটা নিয়ে মাথা ঘামাবে ও আমাকে চিঠি লিখে ব্যাপারটা জানতে চাইবে; তাতে আমার বিশেষ কোন অসুবিধা ঘটবে না; কিন্তু জ্ঞানী-গুণী-বিদ্যজ্জনেরাও যে এ ব্যাপারে আমার সাহায্যপ্রার্থী হবেন ততটা আমি আশা করি নি। যাহোক, কার্যক্ষেত্রে তাই ঘটেছে, কাজেই এ বিষয়ে আমার বক্তব্য পেশ করে সম্ভব হলে এই খোঁজ-খবরের স্রোত বন্ধ করার সময় এসে গেছে, কারণ চিঠি লেখাট। আমার কাছে আরামদায়ক কাজ নয়, আর এ ব্যাপারে যতটা মজা পাব বলে আমি আশা করেছিলাম তাও পাচ্ছি না। আপনি যাতে পরিস্থিতিটা অনুধাবন করতে পারেন সেজন্য সংশ্লিষ্ট খোঁজ-খবরের দুটি নমুনা এখানে উল্লেখ করছি। প্রথমটি এসেছে ফিলিপিনস্-এর জনৈক শিক্ষকের কাছ থেকে:

সান্টা ক্রুজ, ইলোকস, সুর, পি, আই,
১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯০২

প্রিয় মহাশয়,-দোনলা গোয়েন্দা গল্প শীর্ষক আপনার সাম্প্রতিক গল্পটি এই মাত্র পড়লাম, আর পড়ে খুব ভাল লাগল। হাপার্সা। ম্যাগাজিন-এর জানুয়ারি সংখ্যার চতুর্থ খণ্ড ২৬৪ পৃষ্ঠায় এই অনুচ্ছেদটি রয়েছে: বহুদূর ফাঁকা আকাশে একটি নিঃসঙ্গ ইসোফেগাস নিশ্চল পাখার ভর দিয়ে ঘুমিয়ে আছে; সর্বত্র বিরাজ করছে একটা বিষণ্ণ নিস্তব্ধতা, গাম্ভীর্য ও স্বর্গীয় প্রশান্তি। এখন, একটি শব্দের অর্থ আমি বুঝতে পারছি না-শব্দটি ইসোফেগাস। আমার হাতের কাছে রয়েছে স্ট্যাণ্ডার্ড ডিকশনারী, কিন্তু তা থেকেও অর্থটা বোধগম্য হচ্ছে না। রচনার ঐ অংশটিকে আমি খুবই হৃদয়গ্রাহ ও সুন্দর বলে মনে করি, তাই আপনি যদি সময় করে অর্থটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলেন তাহলে সুখী হব। আপনার কাছে ব্যাপারটা অর্থহীন মনে হতে পারে, কিন্তু লুজন-এর উত্তর অঞ্চলে থেকে আমার অসুবিধাটার কথাটা বিবেচনা করে দেখবেন।
—আপনার একান্ত বশংবদ

লক্ষ্য করেছেন কি? ঐ একটি শব্দ ছাড়া অন্য কিছুতেই কোন অসুবিধা নেই। তাতেই বোঝা যাচ্ছে, পাঠককে ধোঁকা দেবার উদ্দেশ্য নিয়ে অনুচ্ছেদটি রচিত হয়েছিল, সেটা বেশ ভাল ভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। আমার ইচ্ছা ছিল, রচনাটি পাঠ করে যেন সকলে যুক্তিযুক্ত বলে মনে করে; এখন দেখা যাচ্ছে তা করেছে; আমার ইচ্ছা ছিল রচনাটি আবেগময় ও হৃদয়গ্রাহী হোক; আপনি নিজেই তো দেখতে পাচ্ছেন যে এই শিক্ষকমহাশয়টির হৃদয়ে নাড়া লেগেছে। হায়, ঐ একটি বিশ্বাসঘাতক শব্দ যদি আমি বাদ দিতাম, তাহলে তো বাজী মাৎ হয়ে যেত! এই অনুচ্ছেদটি তেলের মত প্রতিটি পাঠকের ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত, কারও মনে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকত না।

অপর নমুনাটি এসেছে নিউ ইংলণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপকের কাছ থেকে। তার মধ্যে একটি খারাপ শব্দ আছে (কথাটা আমি চেপে রাখতে পারলাম না), কিন্তু যেহেতু তিনি ধর্মশিক্ষা বিভাগের লোক নন তাই তাতে কোন ক্ষতি নেই:

প্রিয় মিঃ ক্লিমেন্স, বহুদুর ফাঁকা আকাশে একটি নিঃসঙ্গ ইসোফেগাস নিশ্চল পাখায় ভর দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।

সাময়িক পত্রিকা পড়বার মত যথেষ্ট সময় আমি পাই না। অত্যন্ত বিলম্বে হলেও আপনার দো-নলা গোয়েন্দা গল্পটি এই মাত্র পড়ে শেষ করেছি এবং যথেষ্ট আনন্দ ও শিক্ষা লাভ করেছি।

কিন্তু ঐ ইসোফেগাস বস্তুটা কি? আমার নিজেরও ঐ বস্তুটা আছে, কিন্তু সেটি তো শূন্যে বা অন্য কোথাও কখনও ঘুমোয় না। কথা নিয়েই আমার কাজ, আর তাই ইসোফ গাস কথাটা শোনা মাত্রই আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। কিন্তু আমার একজন বন্ধু বলল, এ। কথাটার অর্থ যদি আমি উদ্ধার করতে না পারি তাহলে আমি শাশ্বত অনন্তকাল ধরে অভিশপ্ত হয়ে থাকব। শব্দটা কি একটা পরিহাস, না কি আমিই একটি মহামূর্খ?

শুধু আপনাকে বলছি, ঐ লোকটিকে বোকা বানিয়েছি বলে আমার লজ্জাই হয়েছিল। তাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলাম, এটা একটা ঠাট্টা-আর এখন আমার প্রিংফিল্ড–প্রশ্নকর্তাকেও সেই একই কথা জানাচ্ছি। তাকে আরও লিখেছি, তিনি যেন সযত্নে সমস্ত অনুচ্ছেদটাই পড়েন; তাহলেই দেখতে পাবেন যে তার মধ্যে বিন্দুমাত্র অর্থও কোথাও নেই। স্প্রিংফিল্ড–এর প্রশ্নকর্তাকেও আমার ঐ একই জবাব।

এই আমার স্বীকারোক্তি। আমি দুঃখিত-কিছুটা। এ রকম আর কখনও করব না-আপাতত আমাকে আর প্রশ্ন করবেন না; ইসোফে গাসকে একটু বিশ্রাম করতে দিন-সেই পুরনো নিশ্চল পাখায় ভর দিয়ে।

-মার্ক টোয়েন
নিউ ইয়র্ক সিটি, ১০ এপ্রিল, ১৯০২

[সম্পাদকীয়]

হার্পার্স ম্যাগাজিন-এর গত জানুয়ারি ও ফুে বুয়ারি সংখ্যায় দোনলা গোয়েন্দা গল্প নামে যে গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে সেটি গোয়েন্দা। উপন্যাসের হাস্যকর প্রহসনের একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত, অতি নাটকীয় সব অনুচ্ছেদের মধ্যে আসল কথাটাকে এমন নিপুণতার সঙ্গে আড়াল করে রাখা হয়েছে যে সেটা ধরাই পড়ে না। কিন্তু ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রথম ঘটনার পরেও সেই ভ্রান্তিটা থাকা উচিত নয়। আর যে অনুচ্ছেদে মিঃ ক্লিমেন্স-এর গল্পের সামগ্রিক রূপ গড়ে তুলবার দক্ষতা এবং পাঠকের উদাসীনতা আশ্চর্যভাবে প্রকাশ পেয়েছে সেটি হল:

প্রথম অক্টোবরের একটি ঝরঝরে সুগন্ধি সকাল। লিলাক ও সোঁদাল গাছের মাথায় ঝলমল করছে ফুলের রাশি; যে সব পাখাহীন বন্য প্রাণী গাছের মাথায় বাসা বেঁধে থাকে দয়ালু প্রকৃতি যেন তাদের জ্য একটি রূপকথার সেতু তৈরি করে রেখেছে। ঢালু বনভূমিতে বন-ঝাউ ও ডালিম ফুলের লাল-হলুদ রঙের বাহার ছড়িয়ে আছে দূরদূরান্তে; বাতাস ভরে উঠেছে অসংখ্য স্বল্পস্থায়ী ফুলের তীব্র সুরভিতে; বহুদূর ফাঁকা আকাশে একটি নিঃসঙ্গ ইসোফেগাস নিশচুল পাখায় ভর দিয়ে ঘুমিয়ে আছে; সর্বত্র বিরাজ করছে একটা বিষঃ নিস্তব্ধ তা, গাম্ভীর্য ও স্বর্গীয় প্রশান্তি।

মার্ক টোয়েনের পরিহাসের এই সাফল্য দেখে মনে পড়ছে তার গুহায় অবস্থিত শিলীভূত মানুষের গল্পটার কথা; কী সূক্ষ্ম বিবরণ; প্রথমে দিয়েছেন পরিবেশের একটি একটি চিত্র, তার নির্জনতা ইত্যাদি; তারপর দিয়েছেন তার বিরাট দেহের বিবরণ,-প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছেন যে তার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি তার নাকের একটা পাশকে ছুঁয়ে আছে; তারপর ডান হাতের আঙুল গুলি বরাভয় মুদ্রায় প্রসারিত হয়ে আছে; এবং পুরো মূর্তিটা একটা আশ্চর্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত-এই কথার বর্ণনা করে প্রসঙ্গত উল্লেখ করেছেন যে বাঁ হাতে বুড়ো আঙুলটি ডান হাতের কনিষ্ঠাকে স্পর্শ করে আছে-ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এতই দক্ষতার সঙ্গে কথাগুলি লেখা হয়েছিল যে অনেক বছর পর অতীতের বিখ্যাত পত্রিকা গ্যালাক্সিতে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধমার্ক সেই লোকটির ইতিহাস লিখতে গিয়ে জানিয়ে দিলেন যে ঐ গল্পের পরিহাসটা আজও পর্যন্ত কেউ ধরতে পারে নি; এমন কি, আমাদের যতদূর মনে পড়ে-সেই আশ্চর্য পুরনো পরিহাসের ঘটনাস্থলস্বরূপ নেভাদা পত্রিকার সম্পাদ হিসাবে যে স্থানটি কে নির্দেশ করেছিল অনেক লোক সত্যি সত্যি সেখানে গিয়ে হাজির হয়ে মূর্তিটির খোঁজ করেছিলেন। একথাও নিশ্চত যে মার্ক টোয়েন-এর লাফানো ব্যাঙের চাইতে বেশী পাইট মাল থাকে।

কাল-অক্টোবর, ১৯০০: স্থান হোপ ক্যানন-এর এসূমেরাল্ডা অঞ্চলের একটি রূপার খনির শিবির। স্থানটা নির্জন, উঁচু ও প্রত্যন্তবর্তী; খুব সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে; অধিবাসীদের ধারণা জায়গাটা ধাতব সম্পদে সমৃদ্ধ-দু এক বছর খননকার্য চালালেই সেটা সঠিকভাবে বোঝা যাবে। অধিবাসীদের মধ্যে আছে প্রায় দু শ খনি-কর্মী, একটি শ্বেতাঙ্গিনী ও তার শিশু, কিছু চীনা ধোপা, পাঁচটি আদিম অধিবাসিনী, আর খরগোসের চামড়ার পোশাক, ছেঁড়া টু পি ও টিনের চাকতির নেকলেস পরা ড জন খানেক যাযাবর আদিম মার্কিন ফুলবাবু। এখনও কোন কারখানা গড়ে ওঠে নি; গির্জা এবং সংবাদপত্রও নেই। মাত্র দু বছর হল শিবির পড়েছে; বড় কোন কাজ এখনও হয় নি; তাই পৃথিবীর লোক জায়গাটার নাম-ধাম জানে না।

গিরি-নালার দুই দিকে তিন হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের প্রাচীর উঠে গেছে; নিচের ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুঁড়েঘরগুলির উপর সূর্যের স্নেহষ্পর্শ পড়ে সারা দিনে মাত্র একটি বার-সূর্য যখন থাকে মধ্যগগনে দিবা দ্বিপ্রহরে। গ্রামটি মাইল দুই লম্বা, বাড়িগুলো অনেক দূরে দূরে অবস্থিত। সরাইখানাটাই একমাত্র কাঠামোওয়ালা বাড়ি-প্রকৃতপক্ষে শুধু সেটাকেই বাড়ি বলা চলে। গ্রামের ঠিক মাঝখানে বাড়িটা অবস্থিত-গ্রামের লোকদের সন্ধাবেলার আড়াখানা। সকালে সেখানে মদ খায়, সেভেন-আপ ও ডোমিনো খেলে; বিলিয়ার্ড খেলাও চলে, কারণ জোড়াতালি দেওয়া একটা টেবিল ও কয়েকটা লাঠি ও আছে; আর আছে গোটাকয় ফাটা বল; সশব্দে চলতে চলতে হঠাৎ থেমে যায়, একেবারে বসে পড়ে যে লোক এক দানে ছ পয়েন্ট করতে পারে তাকে সরাইওলার পয়সায় মদ দেওয়া হয়।

ফ্রিল্ট বাকনার-এর ঘরটা গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের একেবারে শেষে অবস্থিত; তার সন্তাবিত রূপোর খনিটা আছে উত্তর দিকের শেষ বাড়িটা ছাড়িয়ে আরও কিছু দূরে। লোকটি খিট খিটে, অসামাজিক, নির্বান্ধব। যারাই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবার চেষ্টা করেছে তারাই হতাশ হয়ে সে চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছে। তার অতীত ইতিহাস কেউ জানে না। কেউ মনে করে, স্যামি হিলেয়ার সেটা জানে, কেউ বলেনা। হিলেয়ারকে জিজ্ঞাসা করলে সেও বলে, না, সে কিছু জানে না। ফ্রি ণ্ট–এর সঙ্গে একটি ষোল সতেরো বছর বয়সের ভীরু ইংরেজ ছেলে ছিল। তার সঙ্গে সে প্রকাশ্য ও গোপনে খুব খারাপ ব্যবহার করত। সেই ছেলেটার কাছেও খোঁজ করা হয়েছিল, কিন্তু কোন ফল হয় নি। ফে টুলক জোন্স-ছেলেটির নাম-বলেছে, খনির সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতেই ফ্লন্ট তাকে সঙ্গে নিয়েছিল। আর তারও আমেরিকায় ঘরবাড়ি, বন্ধুবান্ধব কিছু না থাকায় বার-এর সঙ্গে থাকা এবং মাংস-মটরশুটির পেট–ভাতায় তার ঠেঙানি সহ্য করাটাকেই সে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেছে। একটু কু ছাড়া আর কিছুই সে বলতে পারে না।

এক মাস হল ফেটলক এই দাসত্ব করে চলেছে। বাইরে সে যতই চুপচাপ থাকুক না কেন মনিবের এই অপমান ও লাঞ্ছ না তার মনের মধ্যে ক্রমেই তুষের আগুনের মত জ্বলতে শুরু করেছে। যারা চুপচাপ থাকে, আঘাতের যন্ত্রণা তাদেরই বেশী করে বেঁধে; যারা একটু বেশী সাহসী, সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেলে তারা পাল্টা কথা বলে বা আঘাতে ফেটে পড়ে মনে জ্বালা অনেকটা মেটাতে পারে। কিছু হৃদয়বান লোক ফেটুলককে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে চেয়েছে, বাকনার-এর হাত থেকে তাকে বাঁচাতে চেয়েছে; কিন্তু ছোকরা সে কথা ভাবতেই ভয়ে আঁতকে উঠে ছে; বলছে, তা সে পারবে না। প্যাট রিলে তাকে বলেছিলঃ

বদমাশটাকে ছেড়ে তুমি আমার কাছে চলে এস। কোন ভয় নেই, আমি ওকে দেখে নেব।

ছেলেটি চোখের জল ফেলতে ফেলতে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, এ ঝুঁকি কি সে নিতে পারবে না; ফ্রন্ট কোনদিন তাকে রাত-বিরেতে একলা পেলে তখন-ওঃ, মিঃ রিলে, সে কথা ভাবলে ও আমার ভয় করে।

অন্যরা বলল, পালিয়ে চলে এস; আমরা আছি; রাতের বেলা পাঁচিল ডিঙিয়ে সমুদ্রতীরে চলে এস। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নি; সে বলেছে, ফ্লিণ্ট তাকে খুঁজে বের করবেই, আর তারপরে চলবে আরও নির্যাতন।

এ ব্যাপারটা কেউ বুঝতে পারত না। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ছেলেটার দুঃখ-দুর্দশা বেড়েই চলল। মনে হয়, ছেলেটা তার বাড়তি সময়টা কি ভাবে কাটায় সেটা জানতে পারলে লোকজনরা ব্যাপারটা বুঝতে পারত। ফিন্ট–এর ঘরের কাছেই একটা বাইরের ঘরে ছেলেটা ঘুমোয়। রাত হলেই সেখানে ঢুকে ছেলেটাকে তার আঘাত ও ঘায়ের পরিচর‍্যা করে আর একটা সমস্যা নিয়েই সর্বদা মাথা ঘমায়-কেমন করে ফ্লিন্ট বাকনারকে খুন করবে কিন্তু ধরা পড়বে না। সেটাই তার জীবনের একমাত্র আনন্দ; চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ঐ সময়টুকুর জন্যই সে সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে এবং মনের সুখে কাটায়।

বিষের কথা ভেবেছিল। না-তাতে হবে না; বিষ কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং কে সংগ্রহ করেছিল সেটা তদন্তে ধরা পড়ে যাবে। একবার ভাবল, গভীর রাতে ফ্লন্ট যখন বাড়ি ফেরে তখন কোন নির্জন জায়গায় পিছন থেকে তাকে গুলি করবে। না-কাছাকাছি কোন লোক থাকতে পারে, আর তার ফলে সে ধরা পড়ে যেতে পারে। ঘুমের মধ্যে ছুরি মারার কথাও ভেবেছে। না-ঘাতটা জোরদার না হতেও পারে, আর সেক্ষেত্রে ফ্লিন্টই তাকে ধরে ফেলবে। কার্য উদ্ধারের একশউ পায়ের কথা সে ভেবেছে-কিন্তু কোনটাই মনঃপূত হয়নি; কারণ তলে তলে যত গোপনেই সে কাজ করুক না কেন, ধরা পড়বার একটু ঝুঁকি, একটা সম্ভাবনা সব সময়ই থেকে যাচ্ছে। কাজেই ওসবের কোন পথেই সে যাবে না।

তবে তার খুব ধৈর্য ছিল, অসীম ধৈর্য। নিজেকে বলত, তাড়াতাড়ি করার কিছু নেই। ফ্লিন্ট–এর লাশ না ফেলে সে তার কাছ থেকে যাবে না; তাড়াহুড়ার কিছু নেই-পথ একটা পেয়ে যাবেই। পথ নিশ্চয়ই আছে; যতদিন সেটা খুঁজে না পাবে ততদিন এই লজ্জা, যন্ত্রণা ও দুঃখ-সব সে সহ্য করবে। হ্যাঁ, এমন একটা উপায় নিশ্চয় আছে যাতে খুনীর চিহ্নমাত্র থাকবে না-থাকবে না তুচ্ছতম কোন সূত্র-তাড়াহুড়ার কিছু নেই-একদিন না একদিন পথের হদিস সে পাবেই, আর সেইদিন-ওঃ, সেই দিনই সে বুঝতে পারবে বেঁচে থাকার কী আনন্দ! ইতিমধ্যে আপ্রাণ চেষ্টায় সে তার ভীরুতার খ্যাতিকে অক্ষুণ্ণ রেখে চলবে; আর তাই এখন থেকে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে তার মুখ থেকে একটাও প্রতিহিংসা বা আক্রমণাত্মক কথা কেউ কখনও শুনতে পাবে না।

পূর্বের উল্লেখিত অক্টোবরের সকাল বেলায় দুদিন আগে ফ্ল টু কিছু জিনিস কিনেছিল; সে আর ফে টুলক মিলে সেগুলো ফ্রন্ট–এর। ঘরে বয়ে এনেছিল; মোমবাতির একটা বাক্সকে রেখে দিল ঘরের কোণ; বিস্ফোরক ভর্তি একটা টিনের পাত্র রাখল মোমবাতির বাক্সটার উপরে; বিস্ফোরক গুঁড়োর একটা পিপে রেখে দিল ফ্রিন্টের তক্তপোষের নীচে; একটা লম্বা পলতকে ঝুলিয়ি রাখল কাঠের গজালে। ফেটু লক বুঝতে পারল, খনির কাজ আরম্ভ করবার সময় হয়েছে; শিগগিরই পাহাড় ফাটাবার কাজ আরম্ভ হবে। পাহাড় ফাট বার কাজ সে দেখেছে; সে বিষয়ে তার কিছুটা ধারণাও আছে; কিন্তু নিজের হাতে সে কাজ কখনও করে নি। তার অনুমানই ঠিক-পাহাড় ফাটাবার সময় এসেছে। সকালে দুজনে মিলে, পতে, ড্রিলিং-এর যন্ত্র, বিস্ফোরকের পাত্র-সব কিছু গর্তের কাছে বয়ে নিয়ে গেল; গর্তটা আট ফুট গভীর; সেখানে ওঠা নামা করবার জন্য একটা ছোট মই লাগানো হয়েছে। দুজনে নেমে গেল; নির্দেশ মত ফেটু লক ড্রিলটা ধরল-কি ভাবে সেটাকে ধরতে হয় তাও সে জানে না। আর ফ্ল টু আঘাত করতে লাগল। হাতুড়িটা নেমে এল; যা হবার কথা ঠিক সেইভাবেই ফে টুলক-এর হাত থেকে ড্রিলটা ছিট কে লাফিয়ে উঠল।

এই নিগারের ঘেয়ো বাচ্চা, এ ভাবে বুঝি ড্রিল ধরে? তুলে নে! এই ভাবে ধ! শক্ত করে ধরিস্। ব্যাটা! মজা বোঝাব পরে!

একঘন্টা পরে ড্রিলিং শেষ হল।

এবার গুঁড়োটা ঢাল।

ছেলেটা গুঁড়ো ঢালতে শুরু করল।

গাধা!

চোয়ালে একটা মোক্ষম থাপ্পড় কসিয়ে ছেলেটাকে সরিয়ে দিল।

উঠে যা! এখানে পড়ে পড়ে নাকে কাঁদতে হবে না। এবার আগে পতেটা গুঁজে দে। এবার গুঁড়োটা ঢালু। থাম, থাম, তুই কি পুরো গর্তটাই ভারে ফেলবি নাকি? এমন মাথা-মোটা গাধাও তো কখনও-কিছু ময়লা ফেলে দে! কিছু পাথরের টুকরো ফেলে দে! এবার ঢেকে দে! থাম্‌! থা! হায় স্কট! ভাগ এখান থেকে! লোহাটা কেড়ে নিয়ে ছেলেটাকে অকথ্য গালাগালি করতে করতে নিজেই ভাল করে চেপে দিতে পাগল। তারপর পতেয় আগুন দিয়ে গর্তের ভিতর থেকে উঠে এসে এক দৌড়ে পঞ্চাশ গজ দূরে চলে গেল। ফে টুলকও পিছন পিছন ছুটল। দাঁড়িয়ে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করল, আর তারপরেই বজ্রের মত শব্দ করে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধোঁয়ার কুণ্ডলি ও পাথর ফেটে আকাশে ছিটকে পড়তে লাগল। কিছু সময় পরেই সেই পাথরের টুকরো গুলি বৃষ্টির ফোঁটার মত পড়তে লাগল; তারপর আবার সব চুপচাপ।

ঈশ্বর করতেন তুই যদি ওর মধ্যেই থেকে যেতিস, মনিব মন্তব্য করল।

আবার তারা গর্তের মধ্যে নেমে গেল, সব কিছু পরিষ্কার করল, এবং নতুন করে আর একটা ছিদ্র করে তার মধ্যে বিস্ফোরক ভরে দিল।

এদিকে শোন্‌! আর কত পতে এভাবে নষ্ট করবি? পতেয় কি করে আগুন ধরাতে হয় তাও জানিস না?

না স্যার।

জানিস্ না! ঠিক আছে, পিঠের উপর দুঘা না পড়লে কিছুই হবে না।

লোকটি গর্তের ভিতর থেকে উঠে এসে বলল:

আরে গাধা, সারাটা দিনই লাগাবি না কি? পতেটা কেটে আগুন ধরা।

বেচারি কাঁপতে কাঁপতে বলল:

দয়া করে যদি-মানে-আমি-

আবার কথা! কেটে ধরিয়ে দে!

ছেলেটা পলতে কেটে আগুন ধরিয়ে দিল।

হায় স্কট! এক মিনিটের পতে! তোকে এই গর্তের মধ্যে-

রেগে গর্তের ভিতর থেকে মইটা তুলে সে দৌড়তে লাগল। ছেলেটা ভয়ে কাঠ!

হায় ঈশ্বর! বাঁচাও! বাঁচাও! কে আছ! বাঁচাও! হায়, আমি কি করব? আমি কি করব? ছেলেটা চেঁচাতে লাগল।

যতটা সম্ভব দেয়াল ঘেঁসে সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল; জ্বলন্ত পতে দেখে ভয়ে তার বারোধ হয়ে গেল; নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল; অসহায়ের মত হাঁ করে তাকিয়ে রইল; দু সেকেণ্ড, এইবার সে ছাতু হয়ে উড়ে যাবে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। লাফ দিয়ে পতের কাছে উপুড় হয়ে পড়ল, পতের যে ইঞ্চি খানেক মাটির উপরে ছিল সেটা কেটে দিল; সেও বেঁচে গেল।

ভয়ে আধমরা হয়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। উঠে দাঁড়াবার শক্তিও নেই। তবু গভীর আনন্দে বিড়বিড় করে বলল:

সেই আমাকে শিখিয়ে দিল! পথ একটা খুঁজে পেয়েছি; এখন শুধু অপেক্ষা।

মিনিট পাঁচেক পরে বাকনার গর্তের কাছে গিয়ে ভয়ে ভয়ে নীচে উঁকি দিল। অবস্থাটা বুঝতে পেরে সে মইটা নামিয়ে দিল; ছেলেটি কোন রকমে কাঁপতে কাঁপতে মই বেয়ে উঠে এল। ভয়ে একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তাকে দেখে বারও অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। সহানুভূতি জানিয়ে অনুশোচনার সঙ্গে বলল:

ব্যাপারটা হঠাৎ ঘটে গেল বুঝলি। এ কথা কাউকে বলিস না; উত্তেজনার মুখে কি যে করেছি আমি নিজেই বুঝতে পারি নি। তোর শরীরও ভাল দেখাচ্ছে না; আজকের মত যথেষ্ট কাজ হয়েছে; আমার ঘরে চলে যা; যা ইচ্ছে হয় খেয়ে বিশ্রাম করগে। ব্যাপারটা নেহাৎই দুর্ঘটনা বুঝলি? আমি এতই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে কি বলব।

ছেলেটা যেতে যেতেই বলল, আমিও ভয় পেয়েছিলাম, তবে আমারও একটা শিক্ষা হল; আমি কিছু মনে করি নি।

তার গমন-পথের দিকে তাকিয়ে বাকনার আপন মনেই বলল, কত সহজেই ওকে তুষ্ট করা যায়! জানি না আবার বলে বেড়াবে কিনা। বলতেও তো পারে!…আহা, যদি ওখানেই মরে যেত!

ছেলেটি কিন্তু বিশ্রামের সুযোগ নিল না; নিজের কাজ নিয়েই মনের সুখে মেতে রইল। পাহাড়ে কোল থেকেই একটু ঘন জঙ্গল ফ্লিণ্ট–এর ঘর পর্যন্ত চলে গেছে; ফে টু লক-এর অধিকাংশ কাজই চলল সেই ঘন জঙ্গলের মধ্যে; বাকি জাজ তার নিজেরই ঘরে। সব কাজ শেষ করে সে বলল:

যদি আমার মতলব সে টের পেয়ে যায় তাহলে আর বেশীদিন ওগুলো ফেলে রাখবে না। তাকে বোঝাতে হবে যে আমি আগেকার মত মাথা-মোটা গাধাই আছি-অন্তত আজ সারাদিন ও কাল। তারপরের দিন রাতেই তার ভবলীলা সাঙ্গ হবে; কে তাকে শেষ করল, আর কেমন করেই বা শেষ হল তা নিয়ে কেউ সন্দেহ করবে না। মতলবটা তো সেই আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে; বেড়ে মতলব!

.

০৫.

পরের দিনটা এল, চলেও গেল।

প্রায় মাঝ রাত। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দেখা দেবে নতুন দিনের সকাল। ঘটনাস্থল সরাইখানার বিলিয়ার্ড খেলার ঘর। লোহার স্টোভটা। আগুনে তেতে লাল হয়ে উঠে ছে; সেটার গা থেকে গরম হাওয়া বের হচ্ছে; চাষাড়ে লোকগুলি মোটা পোশাক পরে, ঝোলানো টুপি মাথায় দিয়ে, উঁচু বুটের মধ্যে ট্রাউজারের তলাটা গুঁজে দিয়ে, গায়ে ভেসট চড়িযে কোট বিহীন অবস্থায়ই স্টোভটার চারপাশে। জমায়েত হয়েছে। বিলিয়ার্ড-বলের কর্কশ শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই-অর্থাৎভিতরে নেই; বাইরে চলেছে বাতাসের আর্তনাদ। লোকগুলি অস্বস্তির সঙ্গে কিসের যেন অপেক্ষায় আছে। একটি কদাকার মাঝ বয়সী চওড়া-কঁধ খনির লোক উঠে দাঁড়াল। তার গোঁফ–জোড়া ধূসর, অসামাজিক মুখে বিরূপ দুটি চোখ। একটা পতের তাল বগলের নীচে লুকিয়ে আরও কিছু টুকিটাকি জিনিস নিয়ে সে চলে গেল। একটা কথাও বলল না, কাউ কে অভিবাদনও জানাল না। লোকটি ফ্রিণ্ট বার। সে চলে যাবার পরে দরজাটা বন্ধ হতেই সকলে নানা মন্তব্য করতে লাগল।

কামার জেক পার্কার বলল, এ রকম সময়-মাফিক লোক দেখা যায় না। তাকে চলে যেতে দেখলেই বোঝা যায় বারোটা বেজেছে, ওয়াটারবেরি-ঘড়ি দেখার দরকার হয় না।

খনি-মজুর পিটার হয়ে বলল, আমি যতদূর জানি, ওটাই তার একমাত্র গুণ।

ওয়েলস-ফার্গো-র লোক ফার্গুসন বলল, সে তো সমাজের বালাই স্বরূপ। আমি যদি এ দোকান চালাতাম তো সোজা বলে দিতাম, খামার খালি করে দাও বাপু।

হ্যাম স্যান্ডুইচ বলল, তোমরাই বল বাছারা, সে কখনও কাউকে এক পাত্তর খাইয়েছে বলে তোমাদের মনে পড়ে কি?

সে খাওয়াবে? ফ্লিন্ট বাকনার? হায় লরা!

চারদিক থেকে লোকটির উদ্দেশ্যে নানা রকম বিদ্রূপ বর্ষিত হতে লাগল। তারপর কিছু সময় চুপ করে থেকে খনির লোকটা প্যাট রিলে বলল:

সে হচ্ছে ১৫নং ধাঁধা। আর এক ধাঁধা ঐ ছেলেটা। আমি তো ওদের বুঝেই উঠি না।

হ্যাম স্যান্ডুইচ বলল, কেউ বোঝে না। আচ্ছা, তারা যদি ১৫নং ধাঁধা, তাহলে সেই অপর লোকটির নম্বর কত হবে? তার তো সবটাই রহস্যে ঢাকা-এদের দুজনকেই সে টেক্কা মারে। তাই না?

তাহলে বাজি!

সকলে একই কথা বলল। শুধু একজন বাদে। সে নবাগত পিটার্সন। সকলের জন্য পানীয়ের হুকুম দিয়ে সে জানতে চাইল, অপর লোকটি কে। সকলে একসঙ্গে জবাব দিল, আর্চি স্টিলম্যান!

সেও কি রহস্যময়? পিটার্সন জিজ্ঞাসা করল।

ওয়েলস-ফার্গো-র লোক ফাণ্ডসন বলল, সে রহস্যময় কি না? আর্চি স্টিলম্যান রহস্যময় কিনা? আরে, তার বোকামি তো চতুর্থ-তালিকা।

ফার্ণ্ডসন লেখাপড়া জানে।

পিটার্সন তার সম্পর্কে সব কথা জানতে চাইল; সকলেই জানাতে উদগ্রীব। কিন্তু মদের দোকানের মালিক বিলি স্টিভেন্স সবাইকে চুপ করতে বলে নির্দেশ দিল যে এক এক করে বলাই ভাল। সকলের জন্য পানীয় পরিবেশন করে সে ফার্গুসনের উপরেই কাজের ভারটা। দিল। ফার্গুসন বলতে লাগল:

দেখুন, সে একটা ছেলে। তার সম্পর্কে আমরা এইটুকুই শুধু জানি। তার কাছ থেকে কথা বের করতে আপনি নাজেহাল হয়ে যাবেন, কিন্তু কোন ফল হবে না, কিছুই জানতে পারবে না অন্তত তার মনে কি আছে, সে কি কাজ করে, কোথা থেকে এসেছে, এই সব কথা তো বটেই। আর তার প্রধান বড় রহস্যের ব্যাপারে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করলেই সে প্রসঙ্গটা পাল্টে দেবে। বাস, হয়ে গেল।

সেই বড় রহস্যটা কি?

দৃষ্টি হতে পারে। শ্রবণ হতে পারে। অন্তদৃষ্টি হতে পারে। যাদুও হতে পারে। যেটা খুসি বেছে নিন-বয়স্ক, পাঁচ শ; শিশু ও ভৃত্য-অর্ধেক দাম। এবার বলছি সে কি করতে পারে। আপনি এখন থেকে উধাও হয়ে গেলেন; যেখানে ইচ্ছা গিয়ে আপনার মাথায়ই আঙুলটা। রাখাবে।

কি যে বলেন!

ঠিকই বলছি। আবহাওয়া তার কাছে কিছুই না-প্রাকৃতিক পরিবেশকে সে গ্রাহ্যই করে না।

বলেন কি! অন্ধকার? বৃষ্টি? বরফ? আঁ?

ও সবই তার কাছে সমান। গ্রাহ্যই করে না।

আচ্ছা-কুয়াসার বেলায়ও তাই?

কুয়াসা! তার চোখ বুলেটের মত কুয়াসাকে ভেদ করে চলে যেতে পারে।

কি জানেন স্যার, সে যখন এখানে বসে সকলের সঙ্গে কথা বলতে থাকবে তখন আপনি লুকিয়ে আপনার ঘরে চলে যান, সেখানে একটা বই খুলুন-হ্যাঁ, স্যার, এক ডজন বই-তার পৃষ্ঠা সংখ্যাটা মনে করে রাখুন, দেখবেন সে এখান থেকে বেরিয়ে সোজা সেই ঘরে গিয়েই ঢু কবে, প্রতিটি বইয়ের সঠিক পাতাটি খুলবে, বলে দেব; কখনও ভুল করবে না।

সে তো তাহলে শয়তান।

তার চাইতেও বড় এবার আপনাকে একটা আশ্চর্য ঘটনার কথা বলব। সেদিন রাতে সে-

হাঠাৎ বাইরে একটা সোরগোল শোনা গেল; দরজাটা খুলে গেল; উত্তেজিত জনতা ভিতরে ঢুকল; সকলের আগে শিবিরের একটি শ্বেতাঙ্গ মহিলা। সে চেঁচিয়ে বলে উঠল:

আমার মেয়ে! আমার মেয়ে! তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে হারিয়ে গেছে! ঈশ্বরের দোহাই, আর্চি স্টিলম্যানকে খুঁজে বের করতে আমাকে সাহায্য করুন। আমরা তাকে সর্বত্র খুঁজেছি।

মদের দোকানের মালিক বলল :

বসুন, বসুন মিসেস হোগান। চিন্তা করবেন না। তিনি ঘন্টা আগে এখানে এসে একটা সে ঘুরোবার জায়গা চায়। তারপরই দোতলায় উঠে গেছে। হ্যাম স্যান্ডুইচ, দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে নিয়ে এস। ১৪নং ঘরে আছে।

যুবকটি অবিলম্বেই নীচে নেমে এল। মিসেস হোগানের কাছ থেকে সব বিবরণ জেনে নিল।

বিবরণ আর কি দেব। সন্ধা সাতটায় তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম; ঘন্টা খানেক আগে নিজে শুতে গিয়ে দেখি মেয়ে নেই। সঙ্গে সঙ্গে তোমার ঘরে ছুটে গেলাম বাবা, তোমাকে পেলাম না। হেন জায়গা নেই যেখানে তোমার খোঁজ করি নি। শেষ পর্যন্ত এখানে। তোমাকে পেলাম। আমি আর আমাতে নেই বাবা। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তোমাকে পেয়ে গিয়েছি। তুমি আমার মেয়েকে বের করে দাও। এস! দেরি করো না!

এগিয়ে চলুন ম্যাডাম, আমি আপনার সঙ্গে আছি। আগে আপনার ঘরে যান।

গোটা দলই খোঁজায় যোগ দিল. গ্রামের দক্ষিণ অংশের সকলেই জেগে উঠেছে, শ খানেক লোক বাইরে অপেক্ষা করে ছিল, জ্বলন্ত লণ্ঠে ন হাতে কালো কালো মূর্তিগুলো নড়াচড়া করছে। তিন-চার জন সারি বেঁধে সকলে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেল হোগানদের বাড়িতে।

মিসেস বলল, ঐ যে তক্তপোষটা দেখছ, এখানেই শুয়ে ছিল; সাতটার সময় এখানেই মেয়েকে শুইয়ে দিয়েছিলাম; কিন্তু এখন সে যে কোথায় আছে তা ঈশ্বরই জানেন।

আর্চি বলল, একটা লণ্ঠন দিন। শক্ত মাটির মেঝের উপর লণ্ঠনটা রেখে মাটি টা পরীক্ষা করে দেখার ভান করে সে হাঁটু গেড়ে বসল। মাটির এখানে-ওখানে আঙুল ছুঁইয়ে সে বলতে লাগল, এই তো তার পায়ের দাগ। দেখতে পাচ্ছেন?

দলের কয়েকজন হাঁটু ভেঙে বসে দেখবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। কয়েকজনের মনে হল, পায়ের দাগের মত কিছু যেন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে; অন্যরা মাথা নেড়ে স্বীকার করল যে পরিষ্কার শক্ত মাটিতে তাদের চোখে কোন দাগই ধরা পড়ছে না। একজন বলল, মাটিতে কোন শিশুর পায়ের দাগ হয় তো পড়তে পারে, কিন্তু আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

যুবক স্টিলম্যান বাইরে পা বাড়াল, আলোটা মাটিতে রাখল, বাঁ দিকে ঘুরে তিন পা এগোল, ভাল করে পরীক্ষা করল; তারপর বলল, দিক নির্ণয় করে ফেলেছি-চলে আসুন; কেউ একজন লণ্ঠ নটা নিন।

সে দ্রুতপায়ে দক্ষিণ দিকে চলতে লাগল; পিছনে জনতা; পাহাড়ের সংকীর্ণ খাদ ধরে তারা এঁকে-বেঁকে এগোতে লাগল। এই ভাবে এক মাইল চলে খাদের মুখে পৌঁছে গেল; সামনেই জঙ্গলে-ঢাকা প্রান্তর-প্ৰকাণ্ড, অস্পষ্ট। সকলকে থামিয়ে স্টিলম্যান বলল, ভুল পথে যাওয়া চলবে না; আবার দিক-নির্ণয় করতে হবে।

লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে বিশ গজ জায়গা ভাল করে পরীক্ষা করল; তারপর বলল, চলে আসুন ঠিক আছে। লণ্ঠনটা একজনের হাতে দিল। সেই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সিকি মাইল এগিয়ে গেল খানিকটা ডান দিক বরাবর; তারপর দিক পরিবর্তন করে একটা অর্ধবৃত্ত পরিক্রমা করল; তারপর আবার ঘুরে গিয়ে পশ্চিম দিকে প্রায় আধ মাইল এগিয়ে থামল।

এখানেই তার পথ শেষ হয়েছে, বেচারি শিশু টি। লণ্ঠ নটা তুলে ধরুন, সে কোথায় বসেছিল দেখতে পাবেন।

কিন্তু জায়গাটা নিছক ক্ষারদ্রব্যে ভরা এতই ইস্পাতের মত শক্ত যে দলের মধ্যে কারও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি ছিল না যাতে তার মধ্যে কারও বসবার মত কোন চিহ্ন আবিষ্কার করতে পারে। শুধু সন্তানহারা জননী হাঁটু ভেঙে বসে বিলাপ করতে করতে জায়গাটাতে চু মো খেতে লাগল।

একজন বলে উঠল, কিন্তু তাহলে সে কোথায়? সে যে এখানে নেই অন্তত সেটা তো দেখতে পাচ্ছি।

স্টিলম্যান লণ্ঠন হাতে নিয়ে স্থানটাতে চক্কর দিতে লাগল, যেন পায়ের ছাপ খুঁজছে।

তারপর চিন্তাক্লিষ্ট সুরে বলল, কিছুই বুঝতে পারছি না তো। আবার পরীক্ষা করল। কোন লাভ নেই। সে যে এখানেই ছিল সেটা নিশ্চিত। সে যে এখান থেকে হেঁটে কোথাও যায় নি-সেটাও নিশ্চিত। এ তো দেখছি গোলক ধাঁধা; বের হবার পথই পাচ্ছি না।

মায়ের সব আশা মিলিয়ে গেল।

হায় ঈশ্বর! হায় পবিত্র মেরী! নিশ্চয় কোন উড়ন্ত পশু তাকে নিয়ে গেছে। আর আমি তাকে দেখতে পাব না।

আর্চি বলল, আমি আশা ছাড়ছি না। তাকে পাবই-হতাশ হবেন না।

এই কথা গুলির জন্যই ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ করবেন আর্চি স্টিলম্যান, বলতে বলতে মহিলাটি তার হাতটা ধরে আবেগের সঙ্গে চুমো খেল।

নবাগত পিটার্সন বিদ্রুপের সুরে ফার্গুসনের কানে কানে বলল, এই স্থানটা খুঁজে বের করাই এক মোক্ষম নাটক, তাই না? কিন্তু এত পথ ছুটে আসার তো কোন দরকারই ছিল না; এ কাণ্ড তো অন্য যে কোন স্থানেই করা যেত, না কি বলেন?

কথার এই প্যাঁচ ফার্গুসনের ভাল লাগল না। সে আবেগের সঙ্গে বলে উঠল, আপনি কি বলতে চান যে মেয়েটি ছিল না? আমি বলছি সে এখানেই ছিল। এখন আপনি যদি এ দিয়ে একটা গোলমাল পাকাতে চান তো-

স্টিলম্যান বলে উঠল, ঠিক আছে। আসুন, আপনারা প্রত্যেকে এসে এটা দেখুন! এটা তো সারাক্ষণই আমাদের চোখের সামনেই ছিল, তবু আমরা দেখতে পাই নি।

যে স্থানটা সে দেখাল সকলেই তার উপর ঝুঁকে পড়ল। আর্চির আঙুল যেখানে ছিল সেখানে ঈপ্সিত বস্তুটি দেখাবার জন্য সকলেই আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপরেই শোনা গেল বহুজনের হতাশার দীর্ঘশ্বস। প্যাটে রিলে ও হ্যাম স্যাণ্ডুইচ এক নিঃশ্বাসে বলে উঠল, কোথায় আর্চি? এখানে তো কিছু নিই।

কিছু নেই? একে আপনারা বলছেন কিছু নেই? সঙ্গে সঙ্গে সে আঙুল দিয়ে মাটি তে একটা ছবি এঁকে ফেলল। এই যে-এখনও চিনতে পারছেন না? এটাই ইনজুন বিলি-র চিহ্ন। সেই মেয়েটি কে পেয়েছে।

ঈশ্বরের জয় হোক! মা বলে উঠল।

লণ্ঠনটা সরিয়ে নিন। পথের হদিস পেয়ে গেছি। আমার পিছনে আসুন!

ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সে ছুটতে লাগল; তিন শ গজ পথ ছুটে গিয়ে একটা বালিয়াড়ির ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল। সকলেই তার পিছন পিছন ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলল। সে অপেক্ষা করছিল। দশ পা দূরে একটা ছোট কুঁড়েঘর-পুরনো কাঁথা-কম্বল দিয়ে তৈরি একটা খুপড়ি মত; তার ফাঁক দিয়ে একটা আবছা আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে।

যুবকটি বলল, মিসেস হোগান, আপনি আগে যান। প্রথম দেখার সৌভাগ্য আপনারই হোক।

মিসেস হোগানের পিছনে পিছনে গিয়ে সকলেই সেই খুপড়ির মধ্যে উঁকি দিল। সে কী দৃশ্য! ঈজুন বিলি মাটিতে বসে আছে; আর শিশু টি তার পাশেই ঘুমিয়ে আছে; উন্মাদ আলিঙ্গনে মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরল। আর্চি স্টিলম্যানও বাদ গেল না। চাপা ভগ্ন কণ্ঠে তার মুখ দিয়ে আন্তরিক প্রশংসার যে স্রোত বইতে লাগল তা একমাত্র একটি আইরিশ জননীর পক্ষেই বুঝি সম্ভব।

বিলি বলতে লাগল, দশটা নাগাদ আমি একে দেখতে পাই। ওখানেই ঘুমিয়ে ছিল। খুব ক্লান্ত-মুখটা ভেজা, বোধ হয় কাঁদছিল। এবার বাড়ি নিয়ে যান, কিছু খাইয়ে দিন, নিশ্চয় ওর খুব ক্ষিধে পেয়েছে।

অসীম কৃজ্ঞতায় মা তাকেও ছদ্মবেশী দেবদূত বলে জড়িয়ে ধরল। সে মর্যাদার অধিকারী হলেও সত্যসত্যই সে ছদ্মবেশেই ছিল। ঐ ভূমিকায় অভিনয়ের সাজেই সে তখন সেজেছিল।

সকালে দেড়টা নাগাদ জনি যখন বিজয়গৌরবে বাড়ি ফিরে আসে গাইতে গাইতে শোভাযাত্রা গ্রামে ঢুকল। তাদের হাতে লণ্ঠ ন; সারা পথ তারা মদ খেতে খেতে এসেছে। সকলে এসে সরাইখানায় জড়ো হল; সকালের যেটুকু সময় বাকি ছিল তাকেও রাত করে তুলল।

.

০৬.

পরদিন বিকেলে সমস্ত গ্রাম প্রচণ্ড উত্তেজনায় ফেটে পড়ল। একটি গম্ভীর, মর্যাদাসম্পন্ন বিদেশী সরাইখানায় এসে উঠেছে। তার চালচলনে ও চেহারায় বিশিষ্টতার ছাপ। রেজিস্টারে লিখিয়েছে দুধর্ষ নাম:

শার্লক হোমস

এক ঘর থেকে অন্য ঘরে, এক খনি থেকে অন্য খনিতে খবরটা গুনগু নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল। সকলের হাতের যন্ত্রপাতি থেমে গেল। সারা শহর সেখানে এসে জমায়েত হল। প্যাট রিলে-র খনিটা ছিল ফ্লিন্ট বারের ঠিক পরেই। গ্রামের উত্তর প্রান্ত থেকে বেরিয়ে এসে। একটা লোক প্যাট রিলেকে চীৎকার করে কথাই বলল। সেই সময় ফেটু লক জোন্সকে যেন অসুস্থ মনে হল। নিজের মনেই সে বিড়বিড় করে বলল:

শার্কল খুড়ো! কী দুর্ভাগ্যরে বাবা!-ঠিক এই সময়েই সে এসে হাজির হল! আর এদিকে আমি… সে নিজের চিন্তায় ডুবে গেল। তারপর ভাবল: কিন্তু তাকে ভয় পাবার কি আছে? আমি তাকে যতটা জানি সে রকম ভাবে তাকে যারা জানে তারা ভাল করেই জানে যে, আগে থেকে পরিকল্পনা করে, সূত্র সাজিয়ে রেখে, তার নির্দেশমত কাজ করবার জন্য একটা লোককে ভাড়া করে এনে অপরাধটা করলে তবেই সে-অপরাধীকে সে ধরতে পারে, অন্যথা নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তো কোন সূত্রই থাকবে না, কাজই কোন্ কেরামতিটা সে দেখাবে? কিছুই না। না স্যার, সব কিছুই প্রস্তুত। এখন কাজটাকে ফেলে রাখলে..না, সে ঝুঁকি আমি নিতে পারি না। ফ্লিট বাকনারকে আজ রাতে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতেই হবে। তারপরেই আর একটা অসুবিধা দেখা দিল। শার্লক খুড়ো আজ রাতেই বাড়ির খবরাখবর জানতে চাইবে; তাহলে তার হাত থেকে ছাড়া পাব কেমন করে? অথচ আট টা বাজার দুএক মিনিট আগে থেকেই যে আমাকে আমার ঘরে হাজির থাকতে হবে। ব্যাপারটা বড়ই গোলমেলে; তাকে মহা চিন্তায় ফেলে দিল। কিন্তু একটা পথও সে বের করে ফেলল। আমরা বেড়াতে বেরিয়ে যাব; তারপর মিনিট খানেকের জন্য তাকে রাস্তায় রেখে আমি চলে যাব, আর তাহলেই আমি কি করি না করি কিছুই সে দেখতে পাবে নাঃ কোন কাজ করবার সময় গোয়েন্দাকে তোমার পিছু নেওয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখার শ্রেষ্ঠ পথই হল তাকে তোমার সঙ্গে রাখা। হ্যাঁ, সেটাই সব চাইতে নিরাপদ-তাকে আমার সঙ্গে নিয়েই যাব।

ইতিমধ্যে সরাইখানার সামনেকার পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে; সেই মহাপুরুষকে এক নজর দেখবার আশায় গ্রামবাসীরা সেখানে এসে ভিড় করেছে। সে কিন্তু ঘরের মধ্যেই আছে, বাইরে বের হয় নি। ফার্শ্বসন, জেক পার্কার ও হ্যাম স্যাণ্ডুইচ ছাড়া আর কারও তাকে । দেখবার সৌভাগ্য হয় নি। মহান বৈজ্ঞানিক গোয়েন্দার এই অত্যুৎসাহী ভক্তরা সরাইখানার মালগু দামটা ভাড়া নিয়েছে; দশ বারো ফুট চওড়া ছোট গলিটার ওপারের সেই ঘর থেকে গোয়েন্দার ঘরটা দেখা যায়। তারা তিনজন সেই ঘরে লুকিয়ে আছে এবং জানালার পর্দায় কয়েকটা ফুটো করে রেখেছে। মিঃ হোমসের পর্দাটা নামানোই ছিল; কিন্তু এক সময় সে পর্দা তুলে দিল। ফলে যে অসাধারণ লোকটির লৌকিক ক্রিয়াকলাপের খ্যাতিতে সারা জগৎ ভরে গেছে তাকে মুখোমুখি দেখবার একটা লোমহর্ষক অথচ সুখকর উত্তেজনা লাভের সুযোগ এই গুপ্তচরদের কপালে জুটে গেল। ঐ তো সে বসে আছে-রূপকথা নয়, ছায়ামূর্তি নয়, আসল, জীবন্তু, দেহধারী মানুষটি প্রায় তাদের ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে।

ভীত গলায় ফার্গুসন বলল, মাথাটা দেখ! সত্যি, একখানা মাথা বটে!

গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে কামার বলল, নাকটা দেখ! চোখটা দেখ! বুদ্ধি? যেন বুদ্ধির একটা ভাণ্ডার!

হাম স্যান্ডুইচ বলল, আর মুখের ঐ পারতা। অতিরিক্ত চিন্তা ভাবনা করলেই ও রকমটা হয়ে থাকে। আমরা বাজে লোকেরা আসল চিন্তার তো খবর রাখি না।

ফার্গুসন বলল, তা তো রাখিই না। আমাদের যত চিন্তা ভাবনা তো তিমির তেল আর চর্বি নিয়ে।

ঠিক বলেছ ওয়েলস্ ফার্গো। আর ঐ কুটি টা দেখ-ওটাই তো গভীর চিন্তার লক্ষণ-নীচে, আরও নীচে, চল্লিশ বাঁও নীচে–বস্তুর একেবারে গভীরে। কি যেন একটা খুঁজছে।

সে তো নিশ্চয়ই। তাছাড়া-ঐ ভয়ংকর গাম্ভীর্য আর পাণ্ডুর ভাবটা দেখ-কোন মানুষের ও রকমটা হয় না।

না, ডলার দিয়ে এটা কেনা যায় না। অথচ ওটা তার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। এর মধ্যেই চারবার তার মৃত্যু হয়েছে; সে কথা সকলেই জানে। তিনবার স্বাবাবিক মৃত্যু, আর একবার দুর্ঘটনায় মৃত্যু। শুনেছি, কবরের মত সেও স্যাঁতসেঁতে ও ভিজে জিনিসের গন্ধ শুঁকতে পারে। আর

শ-শ! তাকিয়ে দেখ! সে বুড়ো আঙুলটা রেখেছে কপালের এক কোণে, তর্জনীটা রেখেছে আর এক কোণে। মনে মনেই সে কাজ শুরু করে দিয়েছে।

ঠিক বটে। এবার সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে গোঁফে তা দিচ্ছে, আর-

এবার সে উঠে দাঁড়িয়ে; সবগুলো সূত্রকে ডান হাতের আঙুল দিয়ে বাঁ হাতের আঙুলের উপর সাজিয়ে রাখছে। দেখেছে? ঐ সে হাত দিল তর্জনীতে-ঐ মধ্যমায়-ঐ অনামিকায়-

কী অহংকার।

আর ভ্রূকুটি টা দেখ! সূত্রটা যেন ধরতে পারছে না, তাই-

দেখ, দেখ-সে হাসছে!-বাঘের মত–অন্য আঙুলগুলোকে এমন ভাবে মেলাচ্ছে যেন কিছুই হয় নি! সূত্রটা খুঁজে পেয়েছে; নিশ্চয় পেয়েছে।

মিঃ হোমস টেবিলটাকে জানালার কাছে টেনে নিয়ে এল; গুপ্তচরদের দিকে পিছন দিয়ে বসল; তারপর লিখতে শুরু করল। গুপ্তচররা গর্ত থেকে চোখ সরিয়ে নিল, পাইপ ধরাল, তারপর আরাম করে ধূমপান করতে করতে কথা বলতে লাগল। ফার্গুসন দৃঢ়তার সঙ্গে বলল:

বাছারা, কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই, সে একটি আশচর্য মানুষ! তার সারা দেহে তারই চিহ্ন ছড়িয়ে আছে।

জেক পার্কার বলল, যা বলেছ ওয়েলস্ ফার্গো; এ রকম খাঁটি কথা তুমি আর কখনও বল নি।

ফার্গুসন বলল, তার আসল শক্তিই হল চোখ-পাঁচার মত তীক্ষ্ণ। আমি তো যতদূর বুঝে ছি, এটা একটা প্রকৃতিগত প্রচণ্ড জান্তব ক্ষমতা। তোমাকে তাহলে বুঝিয়ে বলছি। মনে কর তুমি মিসেস হোগান। আমি তোমাকে তার মত করে প্রশ্ন করছি, তুমি জবাব দাও।

ঠিক আছে। তাই কর।

ম্যাডাম, দয়া করে মনটাকে এদিকে দিন। এবার বলুন, ছেলে না মেয়ে?

মেয়ে প্রভু।

হুম-মেয়ে। খুব ভাল। বয়স?

ছয়ে পড়েছে প্রভু।

হুম-ছেলেমানুষ, দুর্বল-দু মাইল। খুবই ক্লান্ত হবার কথা। শুয়েই ঘুমিয়ে পড়বে। দু মাইল দূরে বা কাছাকাছি কোথাও তাকে পাওয়া যাবে। দাঁত?

পাঁচ টা প্রভু; আর একটা উঠছে।

খুব ভাল, খুব ভাল, খুব ভাল। আর মোজা? জুতো?

হ্যাঁ প্রভু, দুইই ছিল।

বোনা তো? মরোক্কো?

বোনা প্রভু। আর ছোট পশুর চামড়া।

হুম-ছোট পশু। ব্যাপারটা ঘোরাল হয়ে উঠল। যা হোক, যেতে দিন, ও আমরা ঠিক করে নেব। ধর্ম?

ক্যাথলিক প্রভু।

খুব ভাল। বিছানার কম্বল থেকে একটা টুকরো আমাকে ছিঁড়ে দিন তো। ধন্যবাদ। আধা পশমী-বিদেশী মাল। খুব ভাল। মেয়েটির পোশাক থেকে একটু কিছু দিন তো। ধন্যবাদ। সুতী। চমৎকার সূত্র, চমৎকার। দয়া করে মেঝের ধুলো একপাত্র আমাকে দিন তো। ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ। প্রশংসনীয়, প্রশংসনীয়! মনে হচ্ছে, এতক্ষণে ব্যাপারটা ঠিকমত ধরতে পেরেছি।-দেখ বাছারা, এতক্ষণে দরকারী সব সূত্রই সে পেয়ে গেছে। আর দরকার নেই। তারপর এই অসাধারণ লোকটি কি করবে? ওই টুকরোগুলো আর ধূলোর পাত্রকে টেবিলের উপরে রেখে দুই কনুইতে ভর দিয়ে সেগুলোর উপর ঝুঁকে পড়ে জিনিসগুলোকে পাশাপাশি রেখে পরীক্ষা। করবে-দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে নিজের মনেই বলবে মেয়ে; জিনিসগুলোকে অন্যভাবে সাজিয়ে বলবে ছ বছর বয়স; আবার নতুন করে সাজিয়ে আবার চিবিয়ে চিবিয়ে বলবে পাঁচ টা দাঁত-একটা উঠছে-ক্যাথলিক-হাতে বোনা-সুতী-ছোট পশুর চামড়া-যাকগে। তারপর শরীরটা খাড়া করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে-চুলের ভিতরে হাত চালাতে চালাতে বলবে ছোট পশুর চামড়াটাই গোলমেলে! তারপর উঠে দাঁড়াবে ভ্রুকুটি করবে, আঙুল ধরে ধরে সূত্রগুলো মেলাতে থাকবে-এবং অনামিকায় গিয়ে থামবে। কিন্তু শুধু মুহূর্তের জন্য-উজ্জ্বল হাসিতে আগুন-লাগা ঘরের মত তার মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠবে; রাজকীয় ভঙ্গীতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জনতাকে বলবে, আপনারা দুজন একটা লণ্ঠন নিয়ে ইন্জুন বিলির কাছে গিয়ে শিশুটিকে নিয়ে আসুন-বাকি সকলে শুতে চলে যান; গুড নাইট ম্যাডাম; গুড নাইট ভদ্রজনরা। তারপর ম্যাটারহর্ণ-এর ভঙ্গীতে অভিবাদন জানিয়ে সে সরাইখানার পথে পা বাড়াবে। এই তার কায়দা-একমাত্র কায়দা-বৈজ্ঞানিক, বুদ্ধিগত-পনেরো মিনিটে ই সব শেষ-লোকজন সঙ্গে করে দেড় ঘন্টা ধরে সারা ঝোপ-জঙ্গল খুঁজে বেড়াবার কোন দরকারই হয় না। কি বল তোমরা?

হ্যাম স্যান্ডুইচ বলল, জ্যাকসনের দিব্যি, খাসা! ওয়েলস্-ফার্গো, ঠিক যেন সেই লোকটি ই এখানে হাজির-হুঁবহু এক। তার এর চাইতে ভাল ছবি বইতেও ছাপা হয় নি। জর্জের দিব্যি, আমি যেন তাকে দেখতে পাচ্ছি-তোমরা পাচ্ছ না বাছারা?

নিজের সাফল্যে ফার্গুসন যেমন খুসি তেমনই কৃতজ্ঞ। নীরবে বসে এই খুসিটুকু উপভোগ করে তারপর ভয়ে ভয়ে বলল:

আমি তো ভাবছি সে ঈশ্বরের সৃষ্টি তো?

এক মুহূর্ত কেউ কোন জবাব দিল না; তারপর হ্যাম স্যান্ডুইচ সশ্রদ্ধ ভঙ্গীতে বলল:

মনে হয়, একদিনে সবটা নয়।

.

০৭.

সেদিন সন্ধা আট টা নাগাদ তুষারপাতের মধ্যে দুটি লোক সতর্ক পা ফেলে ফ্লিণ্ট বাকনারের ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। লোক দুটি শার্লক হোমস ও তার ভাই-পো।

ফেটলক বলল, এখানে একটু দাঁড়াও খুড়ো; ছুটে একবার আমার আমার ঘরে যাব; এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসব।

সে কি যেন চাইল-খুড়ো সেটা দিল-আর সেও অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু একটু পরেই ফিরে এল। দুজনে কথা বলতে বলতে চলতে শুরু করল। নটা নাগাদ তারা সরাইখানায় ফিরে গেল। এই মহাপুরুষটি কে দেখবার জন্য বিলিয়ার্ড-রুমে তখন অনেক লোক জড়ো হয়েছে। তারা সেই ঘরের ভিতর দিয়েই গেল। জনতা রাজকীয় সম্বর্ধনায় চেঁচিয়ে উঠল। মিঃ হোমস বারবার সবিনয়ে মাথা নুইয়ে এই প্রশংসাকে গ্রহণ করল, আর ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে তার ভাই-পোটি সমবেত জনতাকে উদ্দেশ করে বলল:

ভদ্রমশাইরা, খুড়ো শার্লকের হাতে কিছু কাজ আছে; আমি তাকে বারোটা একটা পর্যন্ত আটকে রাখব; তখন না পারলে আরও আগে তিনি আবার নীচে নামবেন; তিনি আশা করেন, তখন আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ তার সঙ্গে পানীয় গ্রহণ করবেন।

ফার্গুসন চেঁচিয়ে উঠল, হায় জর্জ, তিনি তো একজন রাজাবিশেষ। সর্বশ্রেষ্ঠ মানব শার্লক হোমসের জন্য তিনবার জয়ধ্বনি কর। হিপ, হিপ, হিপ-

হুররে! হুকুরে! হুররে! বাঘ!

সমবেত গর্জন বাড়িটা বুঝি কেঁপে উঠল। দোতলায় উঠে খুড়ো ভাই-পোকে মৃদু ভর্ৎসনা করে বলল:

আমাকে আবার এই গোলমালে জড়ালে কেন?

দেখ খুড়ো, আশা করি তুমি জনপ্রিয়তা হারাতে চাও না? তা যদি হয় তো খনি-অঞ্চল এসে কখনও সকলের থেকে দূরে সরে থাকতে চেয়ো না। লোকগুলো তোমার প্রশংসা করছে, কিন্তু তুমি যদি তাদের সঙ্গে বসে একটু পান না করেই তাদের যেতে দাও তাহলে তারা ভাববে তুমি একটি সুব। তাছাড়া, তুমিই তো বলেছ, অর্ধেক রাত আমাদের জাগিয়ে রাখবার মত গল্প তোমার স্টকে মজুত আছে।

খুড়ো স্বীকার করল, ছেলেটি ঠিকই বলেছে, তার বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। আর একদিক থেকেও সে যে বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে সে কথা। ভাই-পোটি কাউ কে বলে নি; শুধু নিজেকেই বলেছে: খুড়ো ও অন্যান্যদের দিয়ে একটা অ্যালিবাই প্রমাণ করবার মওকা এতে মিলে যাবে।

তিন ঘন্টা ধরে খুড়ো-ভাইপোতে জোর কথা-বার্তা চলল। তারপর মাঝ রাতের পরে ফে টুলক সিঁড়ি দিয়ে নীচে এল এবং সরাইখানা থেকে দশ বারো দশ বারো পা দূরে একটা জায়গা বেছে নিয়ে অন্ধকারে অপেক্ষা করতে লাগল। পাঁচ মিনিট পরেই ফি ল্ট বাকনার বিলিয়ার্ড-রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল এবং প্রায় তার গা ছুঁয়ে চলে গেল।

এইবার তাকে বাগে পেয়েছি! ছেলেটা বিড়বিড় করে বলল। ছায়া-মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বলল, বিদায়-চির-বিদায় ফ্লিণ্ট বাকনার; একদিন আমার মাকে বলেছিলে-থাক সে কথা: এবার শোধবোধ; এই তোমার শেষ পথচলা বন্ধু।

বলতে বলতে সে সরাইখানায় ফিরে গেল। এখন থেকে একটা পর্যন্ত ঠিক এক ঘন্টা সময়। এই সময়টা সকলের সঙ্গে কাটাব: খাসা অ্যালিবাই হবে।

শার্লক হোমসকে নিয়ে সে বিলিয়ার্ড-রুমে গেল। উৎসাহী সপ্রশংস খনির লোকদের উপস্থিতিতে ঘরটা তখন ঠাসা; অতিথি পানীয় আনবার হুকুম দিল, আর শুরু হয়ে গেল হৈ-চৈ। সকলেই খুসি; সকলেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ; গান, গল্প, পানীয় পর পর চলতে লাগল। সময় উড়ে চলল। একটা বাজতে ছ মিনিট বাকি; হৈ-হল্লা চরমে উঠে ছে; এমন সময়

বুম!

সঙ্গে সঙ্গে সব চুপ। খাদের মাথায় পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় সেই গম্ভীর শব্দটা কাঁপতে কাঁপতে ভেসে গেল; তারপর ধীরে ধীরে কমতে কমতে একসময় থেমে গেল। স্তব্ধ তা ভেঙে লোকজন সব দরজার দিকে ছুটে গেল। বলে উঠল: একটা বিস্ফোরণ হয়েছে।

বাইরে অন্ধকারের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, হয়েছে দূর পাহাড়ের খাদে; আগুনের ঝলক আমি দেখেছি।

জনতা ছুটে বেরিয়ে গেল-হোমস, ফে টু লক, আর্চি স্টিলম্যান, প্রত্যেকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা এক মাইল পথ পার হয়ে গেল। লণ্ঠনের আলোয় দেখতে পেল, ফ্রি ট বাকনার-এর ঘরের মেঝে টা আবর্জনা-পে ভর্তি ঘরটার চিহ্নমাত্র নেই-না একটা কঁথা-কম্বল, না একটু করো কাঠ। ফ্লিন্টে রও দেখা নেই। সকলেই ইতস্তত খোঁজাখুঁজি শুরু করল। ইতিমধ্যে কে যেন চীৎকার করে উঠল;

এই যে সে!

সত্যিই তাই। খাদের পঞ্চ শি গজ নীচে তাকে পাওয়া গেল-অর্থাৎ পাওয়া গেল একটা বিচু র্ণিত প্রাণহীন মাংসপিণ্ড। সকলের সঙ্গে ফেটুলক জোন্সও ছুটে গিয়ে দেখতে লাগল।

পনেরো মিনিটেই বিচার বিভাগীয় তদন্ত সারা হল। জুরীদের মুখপাত্র হ্যাম স্যান্ডুইচ রায়টা ধরিয়ে দিল। অশিক্ষিত ভাষার কারুকার্যে ভরা সেই রায়ের উপসংহারে বলা হল: নিজের দ্বারা অথবা এই জুরীর অপরিচিত কোন মানুষ বা মানুষের দ্বারা মৃত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটিয়াছে; একখানি ঘর ছাড়া তার কোন পরিবার বা সম্পত্তি ছিল না; ঘরখানিও সম্পূর্ণ উড়িয়া গিয়াছে; ঈশ্বর তাহার আত্মার শান্তি বিধান করুন। আমেন।

তারপর ধৈর্যহীন জুরী আবার জনতার সঙ্গে মিশে গেল, কারণ আসল লক্ষ্যস্থল তো সেখানেই উপস্থিত-শার্লক হোমস। খনির লোকেরা নীরবে সশ্রদ্ধভাবে অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে পড়ল বিধ্বস্ত বাড়িটার দিকে অনেকখানি জায়গা খোলা রেখে। সেই খোলা জায়গাটায় লণ্ঠনহাতে ভাই-পোটি কে নিয়ে মহাপুরুষটি ইতস্তত ঘুরতে লাগল। যেখানে ঘরটা ছিল একটা ফিতে দিয়ে সে জায়গাটার মাপ-জোক করল; ঝোপ-জঙ্গল থেকে রাস্তার দূরত্ব মাপল; জঙ্গলের উচচতা এবং আরও কিছু কিছু জিনিসেরও মাপ নিল। এখান থেকে একটু করো ছেঁড়া ন্যাকড়া নিল, ওখান থেকে নিল একটু করো কাঠ, আবার সেখান থেকে নিল এক চিম্‌টে মাটি। গম্ভীরভাবে সেগুলোকে পরীক্ষা করে নিজের কাছেই রেখে দিল। পকেট–কপাসের সাহায্যে জায়গাটার একটা নকসা আঁকল। ঘড়ি দেখে সময় নিল। আর পকেট থার্মোমিটারের সাহায্যে তাপের অংকটাও জেনে নিল। শেষ পর্যন্ত রাজকীয় ভঙ্গীতে অভিবাদন করে বলল:

কাজ শেষ। ভদ্রজনরা, এবার কি আমরা ফিরে যাব?

সে সরাইখানার পথ ধরল। জনতা চলল তার পিছনে। সকলেরই মুখে এই মহাপুরুষটির আলোচনা, তার প্রশংসা। মাঝে মাঝে এই শোচনীয় ঘটনার কারণ এবং কে এর কর্তা তা নিয়েও নানা রকম মতামত প্রকাশ চলতে লাগল।

ফার্গুসন বলল, আমাদের মহা ভাগ্য যে তাকে এখানে পেয়েছি, কি বল হে তোমরা?

হ্যাম স্যাণ্ডুইচ বলল, এটাই তো এই শতাব্দীর সব চাইতে বড় ঘটনা। কথাটা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। বুঝলে তো আমি কি বলছি?

কামার জেক পার্কার বলল, এই খনি-শিবিরের নাম ছড়াবে। তাই নয় কি ওয়েলস্ ফার্গো?

দেখ, আমার মতামত যখন চাইছ তখন আমি শুধু এইটুকুই বলতে পারি: কালই স্ট্রেট ফ্লাশ খনির দাম ছিল ফুট প্রতি দু ডলার; আর আজ তো কেউ ষোল ডলারেও পাবে না।

ঠিক বলেছ ওয়েলস্ ফার্গো! একটা নতুন খনি-অঞ্চলের এত বড় ভাগ্য কদাচিৎ দেখা যায়। দেখলে তো, ছেঁড়া ন্যাকড়া, ধুলো-ময়লা সবই কুড়িয়ে নিলেন? কী চোখ! কোন সূত্রই তার চোখ এড়ায় না।

ঠিক বলেছ। অন্যের কাছে এগুলোর হয় তো কোন অর্থই নেই; কিন্তু তার কাছে এরাই যেন একটা পুঁথি-বড় বড় অক্ষরে ছাপা।

এ কথা তো বেদ-বাক্যের মত সত্যি। কিন্তু কাজটা কে করেছে বলে মনে হয়?

শক্ত প্রশ্ন। নানা রকম জল্পনা-কল্পনা চলতে লাগল। অনেকের নামই করা হল, আবার সেগুলো একে একে বাতিল করাও হল। ফ্লিণ্ট বাক্‌নারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল তো শুধু হিলেয়ারের সঙ্গে কারও সঙ্গে তো তার ঝগড়া-বিবাদও ছিল না; আসলে কেউ আলাপ-পরিচয় করতে গেলেও সে আমলই দিত না; অবশ্য কারও সঙ্গে সে এমন খারাপ ব্যবহার করত না যার ফলে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটতে পারে। তবু গোড়া থেকেই একটা নাম সকলের জিভের ডগায়ই এসেছিল, যদিও উচ্চারিত হলে একেবারে সকলের শেষে-সে নামটি ফেটলক জোন্স। প্যাট রিলেই কথাটা বলে ফেলল।

সঙ্গে সঙ্গে সকলে বলে উঠল, আরে, তার কথা তো আমরা সকলেই ভেবেছি, কারণ ফ্লিণ্ট বাকনারকে মেরে ফেলবার মত হাজার কারণ তার ছিল, আর সে এ কাজ করলে অন্যায় ও কিছু হত না। কিন্তু একটা কথা তো থেকেই যাচ্ছে-ঘটনাস্থলের ত্রিসীমানাতেও তো সে ছিল না।

প্যাট বলল, তা জানি; ঘটনার সময়ে সে তো বিলিয়ার্ড-রুমে আমাদের সঙ্গেই ছিল।

হ্যাঁ, ঘটনাটা ঘটবার একঘন্টা আগে থেকেই সেখানে ছিল।

ঠিক তাই। বেচারির কপাল ভাল। তা না হলে তো সঙ্গে সঙ্গেই সন্দেহটা তার উপর গিয়েই পড়ত।

.

০৮.

সরাইখানার খাবার ঘরের সব আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে; আছে শুধু পাইন কাঠের ছ ফুট একটা টেবিল আর একটা চেয়ার। টে বিলটাকে ঘরের এক পাশে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর একটা চেয়ার পাতা হয়েছে তার উপরে। রাজকীয় গম্ভীর ভঙ্গীতে চেয়ারে বসে আছে শার্লক হোমস। অন্য সকলে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটা লোকে ভর্তি। তামাকের ধোঁয়া ঘন হয়ে উঠেছে। সর্বত্র গভীর স্তব্ধতা।

সকলে যাতে আরও চুপচাপ থাকে সেজন্য মহাপুরুষটি হাত তুলে ইসারা করল; কয়েক মিনিট হাতটাকে সেই ভাবেই রাখল; সংক্ষেপে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগল আর হু-হুম বলে একের পর এক উত্তর গুলো লিখতে নিতে লাগল। এই ভাবেই উপস্থিত লোকজনদের কাছ থেকে সে ফ্লিণ্ট বাকনারের স্বভাব, চরিত্র ও অভ্যাস সম্পর্কে সব খবরই জেনে নিল। তার থেকে এটাই জানা গেল যে, ফ্লিণ্ট বাকনারকে খুন করবার মত রাগ গোটা শিবিরে একমাত্র মহাপুরুষটির ভাই-পোরই থাকা সম্ভব। মিঃ হোমস মৃদু হেসে ধীর। গলায় প্রশ্ন করল;

বিস্ফোরণের সময় ফেটলক জোন্স কোথায় ছিল আপনারা কেউ জানেন কি?

সকলে সশব্দে জবাব দিল:

এ বাড়ির বিলিয়ার্ড-রুমে।

ওঃ। সে কি তখন সবে সেখানে এসেছিল?

একঘণ্টা আগে থেকেই সেখানে ছিল।

আচ্ছা। এটা তো প্রায়-প্রায়-আচ্ছা, বিস্ফোরণের জায়গাটা এখান থেকে কতটা দূর?

মাইল খানেক।

ওঃ। খুবই ভাল অ্যালিবাই এটা নয়, কিন্তু-যাকগে। তাহলে এই ঘটনার সঙ্গে জোন্স ছেলেটার যে দূর সম্পর্কও ছিল সেটাও বাতিল হয়ে গেল। এবার এই দুর্ঘটনার যারা চাক্ষুস সাক্ষী তাদের ডাকা যাক; তাদের বক্তব্য আমরা শুনতে চাই।

ছোট ছোট সূত্রগুলোকে বের করে হোমস সেগুলোকে একটা কার্ডবোর্ডের উপর সাজিয়ে হাঁটুর উপরে রাখল। ঘরভর্তি লোক রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রইল।

আমরা লঘিমা ও দ্রাঘিমার মাপ মোটামুটি পেয়েছি, আর তা থেকেই দুর্ঘটনার সঠিক স্থানটাও নির্ণয় করতে পেরেছি। সেখানকার উচ্চ তা, তাপমাত্রা ও বাতাসের আর্দ্রতাও আমরা জেনে নিয়েছি-এগুলি অত্যন্ত মূল্যবান, কারণ সেদিন রাতে ঠিক ঐ সময়টাতে খুনীর মানসিক অবস্থা কেমন ছিল সেটা জানবার পক্ষে এই তথ্যগুলি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

(জনতার সপ্রশংস গুঞ্জন: জর্জের দিব্যি, কী গভীর চিন্তাধারা!)

হাঁটুর উপরকার সূত্রগুলোর উপর আঙ্গুল রেখে সে বলল, এবার এই সব নীরব সাক্ষীকে তাদের বক্তব্য বলতে আহ্বান করা যাক।

এখানে আছে সুতীর একটা খালি শিকারের থলে। এটা কি বলে? বলে: প্রতিহিংসা নয়, ডাকাতিই উদ্দেশ্য। আর কি বলে? বলে: খুনীর বুদ্ধিশুদ্ধি কম-অথবা বোকাও বলা যায় না কি? এ কথা কেমন করে বুঝলাম? কারণ কোন সুস্থ বুদ্ধির লোক বাকনারের মত একটি প্রায় নিঃসম্বল লোককে খুন করার কথা ভাবত না। কিন্তু খুনী তো কোন অপরিচিত লোকও হতে পারে? এবারও থলেটাই জবাব দিক। ওটার ভিতর থেকে এই জিনিসটা বের করে নিলাম। এটা রূপোয় মোড়া এক খন্ড আগ্নেয় শিলা। জিনিসটা অদ্ভুত। পরীক্ষা করে দেখুন, আপনি-আপনি-আপনি। এবার ওটা ফিরিয়ে দিন। এ অঞ্চলের মাত্র একটি আকরিক ধাতু প্রবাহেই এ ধরনের আগ্নেয় শিলা পাওয়া যায়, আর সে প্রবাহটা প্রায় দু মাইল বিস্তৃত। আমার মতে অদূর ভবিষ্যতে এই আকর-প্রবাহটি বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করবে আর তার ফলে এই অঞ্চলের দুশ জন মালিক স্বপ্নাতীত ঐশ্বর্যের অধিকারী হবে। আচ্ছা, সেই আকর-প্রবাহটির নাম বলুন তো দয়া করে।

সম্মিলিত খৃস্টীয় বিজ্ঞান ও মেরী আন! সঙ্গে সঙ্গে জবাব এল।

সকলে উন্মাদ আনন্দে জয়ধ্বনি করে উঠল। অশ্রুসজল চোখে একে অন্যের সঙ্গে করমর্দন করতে লাগল।

অবস্থা শান্ত হলে মিঃ হোমস আবার বলতে আরম্ভ করল:

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, তিনটি তথ্য প্রতিষ্ঠিত হল; যথা খুনী কিছুটা অল্পবুদ্ধি; সে কোন অপরিচিত লোক নয়; তার উদ্দেশ্য ডাকাতি, প্রতিহিংসা নয়। এবার শুরু করা যাক। আমার হাতে একটু করো পতে আছে, তাতে আগুনে পোড়ার গন্ধ এখনও পাওয়া যাচ্ছে। এটা কি সাক্ষী দিচ্ছে? আগ্নেয় শিলার পরিপূরক সাক্ষী হিসাবে বিবেচনা করলেই এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে খুনী একজন খনি-কর্মী। আর কি বলছে? বলছে: খুনীর হেপাজতে বিস্ফোরকদ্রব্য ছিল। আর কি? এই বিস্ফোরকদ্রব্য বাড়ির রাস্তার দিকে বসানো হয়েছিল-বাড়ির সম্মুখ দিকে-কারণ ঘটনাস্থলের ছ ফুটের মধ্যে আমি সেটা দেখতে পেয়েছিলাম।

সুইডেনে তৈরি দেশলাইয়ের একটা কাঠি আমার আঙ্গুলে ধরা আছে-যে ধরনের কাঠি বাক্সের গায়ে ঘসে জ্বালানো হয়। বিধ্বস্ত ঘরটা থেকে ছ শ বাইস ফুট দূরে রাস্তার উপর আমি এটা পেয়েছি। এটা কি বলে? বলে: ঐখানেই পতেয় আগুন দেওয়া হয়েছিল। আর কি বলে? বলে: খুনী লোকটি ন্যাটা। কি করে জানলাম? সেটা আপনাদের ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না; চিহ্নগুলো এতই সূক্ষ্ম যে এইমাত্র দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও গভীর অভিনিবেশের ফলেই সেটা বোঝা সম্ভব। কিন্তু লক্ষণগুলো সবই এখানে রয়েছে, আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এমন একটি ঘটনা যেটা যে কোন ভাল গোয়েন্দা কাহিনীতেই আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন-সেটা হল, সব খুনীরাই ন্যাটা হয়।

সশব্দে নিজের উরুতে একটা থাপ্পড় কসিয়ে হ্যাম স্যাণ্ডুইচ বলে উঠল, জ্যাকসনের দিব্যি, তাই তো বটে! কী আশ্চর্য, এ কথাটা আমি আগে ভেবে দেখি নি।

আরও কয়েকজন বলে উঠল, আমিও না! আমিও না! কিছুই ওর চোখ এড়ায় না-চোখ দুটোর দিকে তাকাও!

ভদ্রজনরা, নিহত শিকারের কাছ থেকে খুনী যত দূরেই থাকুক না কেন, তবু সে আঘাতের হাত থেকে সম্পূর্ণ রেহাই পায় নি। এই যে কাঠের টুকরোটা এখন আপনাদের দেখাচ্ছি এটা তাকে আঘাত করেছিল। ফলে রক্ত ঝরেছিল। সে যেই হোক এই আঘাতের গোপন চিহ্ন তার শরীরে দেখতে পাওয়া যাবে। আগুন ধরাবার সময় সে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই আমি এটাকে কুড়িয়ে পেয়েছি। উঁচু আসন থেকে সে সকলের দিকে চোখ ফেরাল; তার মুখ কালো হয়ে উঠল; ধীরে ধীরে হাত তুলে একজনকে দেখিয়ে বলল:

ঐ যে খুনী দাঁড়িয়ে আছে!

মুহূর্তের জন্য সারা ঘরটা যেন বিস্ময়ে পঙ্গু হয়ে রইল। তার পরেই বিশটি কণ্ঠ একসঙ্গে ফেটে পড়ল:

স্যামী হিলেয়ার? কী সাংঘাতিক, না! সে? এ যে চূড়ান্ত বোকামি!

খুব সাবধানে ভদ্রজনরা-ব্যস্ত হবেন না। দেখুন-ভুরুতে রক্তের দাগ।

হিলেয়ার ভয়ে ফাঁকাসে হয়ে গেল। বুঝি বা কেঁদেই ফেলবে। এদিক ওদিক তাকাতে লাগল; যেন প্রত্যেকের কাছেই সাহায্য ও সহানুভূতি চাইছে; তারপর হোমসের দিকে হাত বাড়িয়ে বলতে লাগল:

বলবেন না, বলবেন না! আমি এ কাজ করি নি; আমার কথা বিশ্বাস করুন, এ কাজ আমি করি নি। কপালের এই ঘা-টা কেমন করে হয়েছিল-

হোমস চেঁচিয়ে বলল, কনস্টেবল, একে গ্রেপ্তার কর। কথা দিচ্ছি, পরোয়ানাটা পরে দেব।

কস্টেবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও কিছুটা এগিয়ে গেল-ইতস্তত করল–তারপর দাঁড়িয়ে পড়ল।

হিলেয়ার পুনরায় কাতর আবেদন জানাল: আর্চি, এ কাজ করতে ওদের দিও না; এর ফলে আমার মায়ের মৃত্যু হবে! এ আঘাতটা কেমন করে পেয়েছি তা তো তুমি জান। ওদের সে কথা বল; আমাকে বাঁচাও আর্চি; আমাকে বাঁচাও!

ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে স্টিলম্যান বলল:

হ্যাঁ, আমি তোমাকে বাঁচাব। ভয় পেয়ো না। তারপর জনতাকে লক্ষ্য করে বলল, ও যেভাবেই আঘাতটা পেয়ে থাকুক, তার সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনই সম্পর্ক নেই, আর সেটা কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারও নয়।

ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ করুন আর্চি, তুমিই সত্যিকারের বন্ধু

হুররে আর্চি! যাও তো বাবা, ওদের থ্যাতা নাক ভোতা করে দাও।

সকলে একবাক্যে গর্জে উঠল। একদিকে বন্ধুর জন্য গর্ববোধ, আর অন্যদিকে তার প্রতি আনুগত্যবোধ-এই দুয়ে মিলে সমস্ত পরিস্থিতির রংটাই বদলে দিল।

একটু চুপ করে থেকে গোলমাল থামলে স্টিলম্যান বলল: টু ম জেফরিসকে আমি বলব ওদিকের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে, আর কনস্টেবল হ্যারিসকে বলব অন্য দরজায় দাঁড়াতে। দেখবেন, কেউ যেন এ ঘর থেকে বেরিয়ে না যায়।

যেমন বলা তেমনই কাজ। তুমি চালিয়ে যাও!

আমার বিশ্বাস, অপরাধী এখানেই আছে। আমার অনুমান যদি ঠিক হয়ে থাকে অচিরেই তাকে আপনারা দেখতে পাবেন। এবার আসুন। শোচনীয় দুর্ঘটনার আগাগোড়া সব কথাই আপনাদের বলব। খুনের উদ্দেশ্য ডাকাতি নয়, উদ্দেশ্য প্রতিহিংসা। খুনী, স্বল্পবুদ্ধি নয়। দু শ বাইশ ফুট দূরে সে দাঁড়িয়ে ছিল না। কাঠের টুকরো ছিটকে এসে তার গায়ে লাগে নি। ঘরের গায়ে সে বিস্ফোরক দ্রব্য রাখে নি। সে শিকারের থলে সঙ্গে নিয়ে আসে নি এবং ন্যাটও নয়। এই সব ভুল গুলি বাদ দিলে মাননীয় অতিথির বক্তব্য মোটামুটি ঠিক।

ঘরের মধ্যে একটা হাসির ঢেউ খেলে গেল; বন্ধু বন্ধুর দিকে মাথা নেড়ে যেন বলল, তলে তলে এইটে ই তো আসল কথা। বাহাদুর ছেলে বটে। কিছুতেই হার মানবে না!

অতিথির প্রশান্তি তবু অবিচলিত। স্টিলম্যান বলতে লাগল:

আমারও কিছু সাক্ষীসাবুদ আছে; সেগুলি কোথায় পাওয়া যাবে তাও আপনাদের বলছি। একটু রো মোটা তার তুলে ধরল। সেটা দেখবার জন্য জনতা ঘাড় খাড়া করল। এটার গায়ে গলানো চর্বির একটা প্রলেপ দেওয়া আছে। আর আছে এই আধ-পোড়া মোমবাতিটা। বাকি অংশটায় এক ইঞ্চি পর পর দাগ কাটা আছে। এই জিনিসগুলি কোথায় পেলাম তাও বলছি। যুক্তি-বিচার, অনুমান, সূত্রগুলোকে নানা ভাবে সাজানো এবং পেশাদার গোয়েন্দারা অন্য যে সব নাটকীয় ভাবভঙ্গী দেখিয়ে তাকে সে সব তুলে রেখে সহজ সরলভাবে আমি আপনাদের বুঝিয়ে বলব কেমন করে এই শোচনীয় ঘটনাটি ঘটেছে।

সে একমুহূর্ত থামল; নীরবতা ও উৎকণ্ঠার সাহায্যে সমবেত জনতার আগ্রহকে বাড়িয়ে তুলতে কিছুটা সময় নিল; তারপর আবার বলতে লাগল:

অনেক কষ্ট করেই খুনী তার পরিকল্পনার ছকটা এঁকেছিল। ছকটা খুবই ভাল, কৌশলপূর্ণ; এতে তার বুদ্ধিদীপ্ত মনেরই পরিচয় পাওয়া যায়, স্বল্পবুদ্ধির নয়। যাতে উদ্ভাবনকারীর উপর কোন রকম সন্দেহ না পড়ে সে দিকে দৃষ্টি রেখেই পরিকল্পনাটা করা হয়েছিল। প্রথমেই মোমবাতিটার গায়ে এক ইঞ্চি ফাঁকে ফাঁকে দাগ কেটে এমন ভাবে সেটাতে আগুন ধরিয়েছিল যাতে নির্দিষ্ট সময়ে সেটা কার্যকরী হতে পারে। সে পরীক্ষা করে দেখেছিল যে মোমবাতিটার চার ইঞ্চি পুড়তে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। যতক্ষণ ধরে এই ঘরে ফ্লিন্ট বাক্‌নারের চরিত্র ও গতিবিধি সম্পর্কে তদন্তের কাজ চলছিল ততক্ষণে উপরের ঘরে বসে আধ ঘণ্টা যাবৎ এটাই আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখছিলাম। আর তা থেকেই বুঝতে পেরেছি, হাওয়া থেকে নিরাপদে রাখলে মোমবাতিটা পুড়তে কি রকম সময় লাগে। মোমবাতিটা কি হারে পোড়ে সেটা দেখে নিয়ে অপরাধী মোমবাতিটা নিভিয়ে দিয়েছিল-সেটাই এতক্ষণ আপনাদের দেখালাম-আর তারপরে আর একটা মোমবাতিতে দাগ কেটে নিয়েছিল।

নতুন মোমবাতিটাকে সে একটা টিনের মোমবাতি-দানের মধ্যে বসিয়ে দেয়। তারপর ঠিক পাঁচ ঘণ্টার দাগের কাছে গরম তার দিয়ে মোমবাতিটার ভিতরে একটা গর্ত করে নেয়। সে তারটা আপনাদের আগেই দেখিয়েছি-তারটার গায়ে চর্বি গলিয়ে ঠাণ্ডা করে। প্রলেপের মত করে মাখিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ফ্লিণ্ট বাকনারের ঘরের পিছন দিককার খাড়া পাহাড়ের গায়ে যে ঘন ঝোপ-জঙ্গল আছে, কষ্ট করে-বলা উচিত কঠোর পরিশ্রম করে একটা খালি ময়দার পিপে টানতে টানতে সে জঙ্গল বেয়ে সে উঠে আসে। সেই নিরাপদ ও প্রস্থানে সেটাকে রেখে তার নীচে মোমবাতিদানটাকে বসিয়ে দেয়। তারপর প্রায় পঁয়ত্রিশ ফুট পলতে মেপে নেয়-ঘর থেকে পিপেটা ততটা দূরেই ছিল। পিপের পাশে একটা গর্ত করে-এই সেই বড় ভ্রমর যেটা দিয়ে এ কাজটা সে করেছিল। সব কিছু ঠিকঠাক করে পলতের একটা দিক রাখে। বাকনারের ঘরের সঙ্গে, আর অপর দিকে একটা খাঁজ কেটে মোমবাতির গর্তের মধ্যে সেটাকে ঢুকিয়ে দেয়-এমন ভাবে সময় বেঁধে দেয় যাতে গতকাল সন্ধ্যা আট টা নাগাদ মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দিলে আজ সকাল একটার সময় বিস্ফোরণটা ঘটে। আমি বাজি রেখে বলতে পারি এই ভাবেই কাজটা করা হয়েছিল। পিপেটা জঙ্গলের মধ্যেই আছে, বাকি মোমবাতিটাও আছে টিনের মোমবাতিদানের ভিতরে, পোড়া পতেটা আছে সেই ভ্রমর দিয়ে করা গর্তের মধ্যে আর অপর অংশটা নেমে গেছে ঠিক সেখানে যেখানে উড়ে-যাওয়া ঘরটা ছিল। অধ্যাপক যখন এখানে বসে অবান্তর ঘটনাকে বাতিল করছিলেন আর এই ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কহীন সব খুঁটিনাটি জিনিস সংগ্রহ করছিলেন, সেই ফাঁকে ঘণ্টাখানেক বা দু ঘণ্টা ধরে আমি এই সব কিছু নিজের চোখে দেখে এসেছি।

সে থামল। ঘরের মানুষগুলো একটা লম্বা শ্বাস টেনে হাত-পাগুলোকে টান করে খুসির মেজাজে হাসিতে ফেটে পড়ল। হ্যাম স্যাণ্ডুইচ বলল, বাহাদূর বটে! তাই তো অধ্যাপকের পিছনে ঘুরঘুর না করে সে বনে জঙ্গলে ঢু মেরে বেড়াচ্ছিল। তবেই বোঝ– ছেলেটা বোকা নয়।

সিলম্যান আবার কথা বলতে শুরু করল;

এক বা দু ঘণ্টা আগে আমরা যখন বাইরে গিয়েছিলাম তখনই ঐ ভ্রমর ও মোমবাতির মালিক ঐ জিনিস দুটোকে লুকনো স্থান থেকে নিয়ে পাইনের জঙ্গলের মধ্যে আরও একটা ভাল জায়গায় গিয়ে পাইনের কাঁটা দিয়ে ঢেকে লুকিয়ে রাখে। সেখানেই আমি সেগুলিকে দেখতে পেয়েছিলাম। ভ্রমরটা পিপের ছিদ্রের সঙ্গে ঠিক মিলেও গেছে। আর এখন-

মহাপুরুষটি বাধা দিল। ব্যঙ্গের সুরে বলল:

ভদ্রজনরা, একটা সুন্দর রূপকথা তো শোনা গেল-সত্যি খুব সুন্দর। এবার আমি এই যুবককে দু একটা প্রশ্ন করতে চাই।

উপস্থিত কেউ কেউ ঠোঁট বাঁকাল। ফার্গুসন বলল:

এবার বুঝি আর্চির সঙ্গে লেগে গেল।

অন্য অনেকের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তারা গম্ভীর হয়ে গেল। মিঃ হোমস বলল:

পর পর সাজিয়ে বেশ সুশৃংখলভাবে এই রূপকথাটি কে পরীক্ষা করে দেখা যাক। পরীক্ষাটা হবে যাকে বলে জ্যামিতিক ক্রম অনুসারে-বিবরণগুলিক পরষ্পর সন্নিবদ্ধ করে ক্ষমাহীন শৃংখলা ও অভ্রান্ত পদক্ষেপে ধীরে ধীরে অভিযান চালানো হবে এই টিনের তৈরি ভুলের খেলনা দুর্গের দিকে, অনভিজ্ঞ কল্পনার এই স্বপ্ন-মিনারের দিকে। হে তরুণ যুবক, শুরুতে আমি আপাতত আপনাকে মাত্র তিনটি প্রশ্ন করতে চাই-হ্যাঁ, আপাতত। আমি কি ধরে নিতে পারি যে আপনার মতে উল্লেখিত মোমবাতিটা জ্বালানো হয়েছিল গতকাল রাত আটটা নাগাদ?

হ্যাঁ স্যার, আট টা নাগাদ।

ঠিক আট টায় কি?

না, অতটা সঠিক করে বলতে পারব না।

হুম। আপনি কি মনে করেন, ঠিক ঐ সময়ে কোন লোক সেখান দিয়ে গেলে তার সঙ্গে খুনীর দেখা হয়ে যেতে পারত?

হ্যাঁ, তাই মনে হয়।

ধন্যবাদ। কথা শেষ। তবে আবার বলছি, আপাতত-সবই আপাতত।

অতিথির দিকে তাকিয়ে স্টিলম্যান বলল, আমি স্বয়ং সেখানে হাজির ছিলাম সাড়ে আট–না, নটা নাগাদ।

বটে! চমৎকার-খুবই চমৎকার। তাহলে হয়তো খুনীর সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?

না। কারও সঙ্গে আমার দেখা হয় নি।

ওঃ। তাহলে-মাফ করবেন-আপনার তথ্যের কোন প্রাসঙ্গিকতা আমি দেখতে পাচ্ছি না।

প্রাসঙ্গিকতা নেইও। আপাতত। আমি বলছি নেই-আপাতত।

একটু থেমে আবার বলল: খুনীর সঙ্গে আমার দেখা হয় নি, কিন্তু তার খোঁজ যে পেয়েছি সেটা নিশ্চিত, কারণ আমি বিশ্বাস করি যে সে এই ঘরেই আছে। আমি চাই, আপনারা সকলেই একে একে আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যাবেন-ঠিক এইখান দিয়ে যেখানে ভাল আলো আছে-যাতে আপনাদের পা দুটি আমি দেখতে পাই!

ঘরময় উত্তেজনার গুঞ্জন উঠল। শুরু হল যাত্রা। অতিথিটি আপ্রাণ চেষ্টায় গম্ভীর হয়ে রইল, আর স্টিলম্যান চোখের উপর হাত রেখে প্রতি জোড়া পায়ের উপর কড়া নজর রাখল। একে একে পঞ্চাশজন চলে গেল,-কোন ফল হল না। ষাট, সত্তর। সমস্ত ব্যাপারটাই যেন উদ্ভট মনে হতে লাগল। প্রচ্ছন্ন বিদ্রপের স্বরে মন্তব্য করল:

মনে হচ্ছে আজ রাতে খুনীরা বড়ই দুর্লভ!

উপস্থিত সকলেই বিদ্রূপটা উপভোগ করে হেসে উঠল। আরও দশ বারো জন প্রার্থী হেঁটে গেল-বরং বলা যায় ঠাট্টায় ভঙ্গীতে দুলে দুলে নেচে চলে গেল-আর তখনই হঠাৎ স্টিলম্যান হাত বাড়িয়ে বলল:

এই সেই খুনী!

ফেটলক জোন্স! জনতা গর্জন করে উঠল। সকলে হৈ-হৈ করে উঠল। নানা রকম মন্তব্য শোনা গেল।

গণ্ডগোল যখন চরমে উঠল তখন অতিথিটি হাত বাড়িয়ে সকলকে শান্ত হতে বলল। একটি বিখ্যাত নাম ও প্রবল ব্যক্তিত্বের রহস্যময় প্রভাব সকলকেই শান্ত হতে যেন বাধ্য করল। মর্যাদা ও আবেগের সঙ্গে অতিথি বলল:

ব্যাপার গুরুতর। একটি নির্দোষ জীবনের উপর উদ্যত হয়ে আঘাত। অথচ সে সন্দেহাতীতভাবে নির্দোষ! সংশয়াতীতভাবে নির্দোষ। সেটাই আমি প্রমাণ করছি; সকলে শুনুন; দেখুন, একটি মাত্র সরল ঘটনা কেমন করে এই নির্বোধ মিথ্যাকে অনায়াসে মুছে দেয়। মন। দিয়ে শুনুন। বন্ধুরাণ, এই ছেলেটি গতকাল সন্ধায় একবারও আমার দৃষ্টির বাইরে যায় নি!

কথাগুলি সকলকেই প্রভাবিত করল। সকলেই জিজ্ঞাসায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে স্টিলম্যানের দিকে তাকাল। তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। স্টিলম্যান বলে উঠল:

আমি জানতাম সেখানে আরও একজন ছিল। দ্রুত টেবিলের কাছে এগিয়ে গিয়ে সে প্রথমে অতিথির পায়ের দিকে, তারপর তার। মুখের দিকে তাকিয়ে বলল আপনি ছিলেন তার সঙ্গে! সে যখন মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দিল যার ফলে পরে এক সময় গুঁড়ো পদার্থটা জ্বলে উঠেছিল তখন আপনি তার কাছ থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে ছিলেন না। [উত্তেজনা] আরও বড় কথা, দেশলাইটাও আপনি দিয়েছিলেন!

স্পষ্টতই অতিথিটি আহত হল; অন্তত সকলের তাই মনে হল। কথা বলবার জন্য সে মুখ খুলল; কিন্তু কথাগুলি সহজ ভাবে মুখ থেকে বের হল না।

 এটা-মানে-এটা তো-পাগলামি-এটা-

স্টিলম্যান এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভুলল না। একটা পোড়া দেশলাইয়ের কাঠি তুলে দেখাল।

এই দেখুন একটা কাঠি। এটা পেয়েছি পিপেটার মধ্যে-এই যে আরও একটা।

অতিথি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল:

হ্যাঁ-আপনি নিজেই এগুলো সেখানে রেখে দিয়েছিলেন!

কথাটা সকলেরই মনে ধরল। স্টিলম্যান পাল্টা জবাবে বলল:

এটা মোমের তৈরি-এ জিনিস এ শিবিরের কেউ দেখে নি। এর বাক্সটার খানাতল্লাসীর ব্যাপারে আমি প্রস্তুত আছি। আপনিও প্রস্তুত কি?

এবার অতিথি বিচলিত হয়ে উঠল-অতি বড় নির্বোধের চোখেও সেটা ধরা পড়ল। সে হাত দুটি নাড়ল, বার দুই ঠোঁট ও নাড়ল, কিন্তু কথা বের হল না। সকলে সাগ্রহ উৎকণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষা করতে লাগল। চারদিক নিস্তব্ধ। ইতিমধ্যে স্টিলম্যান শান্তভাবে বলল:

আপনার সিদ্ধান্তের জন্য আমরা অপেক্ষা করে আছি।

কয়েক মুহূর্ত আবার চুপচাপ; তারপর নীচু গলায় অতিথি বলল:

তল্লাসীতে আমার আপত্তি আছে।

কেউ হৈ-হল্লা করল না বটে, কিন্তু একের পর এক একই কথা অস্পষ্ট গলায় উচ্চারিত হল:

তাহলে তো বোঝাই গেল! ইনি এখন আর্চির হাতের মুঠোয়!

এখন কি করা হবে? কেউ তা জানে না। সেই মুহূর্তে ব্যাপারটা বড়ই বিভ্রান্তিকর বলে মনে হল-কারণ সমস্ত ব্যাপারটা এমন একটা আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত মোড় নিয়েছে যার জন্য এই সরল মানুষগুলি মোটেই প্রস্তুত ছিল না; তাই হঠাৎ আঘাত লেগে থেমে যাওয়া ঘড়ির মত তারাও কেমন যেন বিমূঢ় হয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই যন্ত্রটা আবার চলতে শুরু করল, দুয়ে-দুয়ে, তিনে-তিনে। আলোচনা শুরু হল, নানা প্রস্তাব নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি করবার পরে একটা প্রস্তাব মোটামুটি ভাবে সমর্থিত হল: ফ্লিন্ট বাকনারকে সরিয়ে দেবার জন্য খুনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হোক। কিন্তু অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা মাথার লোকরা এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করল; তারা বলল, পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্রসমূহের পচা মাথাওয়ালা লোকগুলো এটাকে একটা কেলেংকারি বলে রট না করে বোকার মত হৈ-চৈ শুরু করে দেবে। শেষ পর্যন্ত ঠাণ্ডা মাথারই জয় হল; তাদের প্রস্তাবেই সকলে সম্মতি দিল; তাদের দলপতি সকলকে শান্ত হতে বলে তাদের প্রস্তাবটি ঘোষণা করল: ফেটু লক জোন্সকে কারাগারে পাঠিয়ে তার বিচারের ব্যবস্থা করা হোক।

প্রস্তাব পাস হয়ে গেল। আপাতত আর কিছু করারও নেই। এই ব্যবস্থায় সকলে মোটামুটি খুসিই হল, কারণ ভিতরে ভিতরে সকলেই অধৈর্য হয়ে উঠে ছিল, কতক্ষণে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পারবে পিপে ও অন্যান্য জিনিসগুলি সেখানে সত্যি আছে কি না।

কিন্তু না-যাত্রায় বাধা পড়ল। বিস্ময়ের তখনও শেষ হয় নি। প্রথমটায় ফে টুলক জোন্স সকলের অলক্ষ্যেই নীরবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল; কিন্তু যখন তার গ্রেপ্তার ও বিচারের কথা ঘোষণা করা হল তখন সে হতাশ হয়ে বলে উঠল:

না! কোন লাভ নেই। আমি জেলে যেতে চাই না; বিচারও চাই না। আমার দুর্ভগ্যের অন্ত নেই, দুঃখ-দুর্দশারও শেষ নেই। আমাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দাও; সব শেষ করে দাও। সবই প্রকাস পাবে-কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। সে এমনভাবে সব কথা বলে দিল যেন সে আমার সঙ্গে সঙ্গেই ছিল-জানি না এ সব কথা সে জানল কেমন করে। সেখানে গিয়ে আপনারাও পিপে ও অন্য জিনিসগুলি দেখতে পাবেন; তখন আর আমার কোন আশাই থাকবে না। আমি তাকে খুন করেছি; আপনারা হলেও তাই করতেন; সে যদি আপনাদের সঙ্গে কুকুরের মত ব্যবহার করত। আর আপনারা আমার মতই ছেলেমানুষ হতেন,-দুর্বল, গরিব, সাহায্য করবার মত একটি বন্ধুও নেই-

হ্যাম স্যাণ্ডুইচ চেঁচিয়ে বলল, তাকে ঠাণ্ডা করেছ বেশ করেছ! তোমরা সকলেও দেখ বাছারা-

কনস্টেবলদের মধ্যে থেকে: গোলমাল নয়! গোলমাল নয়!

একটি কণ্ঠ স্বর: তুমি যা করতে যাচ্ছিলে তা কি তোমার খুড়ো জানতেন?

না, জানতেন না।

তিনি কি সত্যি সত্যি দেশলাইয়ের কাঠি তোমাকে দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা কি জন্য আমি চাইছি তভা তিনি জানতেন না।

তুমি যখন এমন একটা কাজে বেরিয়ে গেলে তখন গোয়েন্দা জেনেও তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার ঝুঁকি তুমি নিলে কেন? ব্যাপার কি বল তো?

ছেলেটি ইতস্তুত করতে লাগল; বোতাম নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে সলজ্জভাবে বলল:

গোয়েন্দাদের আমি চিনি, কারণ তারা তো আমার পরিবারেরই মানুষ; তাই কোন কাজ যদি তাদের না জানাতে চান তো তার সব চাইতে ভাল উপায় হচ্ছে কাজটা করবার সময় তাদের কাছাকাছি রেখে দেওয়া।

হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে সকলে তার এই সরল জ্ঞানের বাণীকে সম্বর্ধনা জানাল; কিন্তু তাতে বেচারির বিভ্রান্তি কিছুমাত্র কমল না।

.

০৯.

মিসেস স্টিলম্যানকে লেখা চিঠি থেকে; তারিখের ঘরে লেখা শুধু মঙ্গলবার।

একটা অব্যবহৃত কাঠের ঘরে ফেটু লক জোন্সকে তালা-চাবি বন্ধ করে বিচারের অপেক্ষায় রেখে দেওয়া হল। কনস্টেবল হ্যারিস তার দু দিনের খাবার ব্যবস্থা করে দিল, নিজের উপর ভালভাবে নজর রাখতে বলল, এবং কথা দিল যে আবার খাবারের প্রয়োজন হলেই সে তার সঙ্গে দেখা করবে।

পরদিন সকালে আমরা জন কুড়ি লোক বন্ধুত্বের খাতিরে হিলেয়ালের সঙ্গে গিয়ে তার স্বৰ্গত আত্মীয় বারের সৎকারের কাজে সাহায্য করলাম। হিলেয়ার হল প্রধান শবাধারবাহী, আর আমি হলাম তার প্রথম সহকারী। সবে কাজকর্ম সব শেষ করেছি এমন সময় ছেঁড়া পোশাক পরা একটি বিষণ্ণ অপরিচিত লোক খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাথা নীচু করে আমাদের পাশে এল। সঙ্গে সঙ্গে নাকে লাগল সেই গন্ধ যাকে আমি সারা পৃথিবী খুঁজে বেড়াচ্ছি! আমার নিঃশেষিতপ্রায় আমার রাজ্য সে গন্ধ যেন স্বর্গের সুবাস বয়ে আনল।

মুহূর্তের মধ্যে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে আস্তে তার কাঁধে হাত রাখলাম। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত সে ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল। সকলেই ছুটে এল। কোন রকমে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে সে হাত জোড় করে কাঁপা গলায় অনুরোধ জানাল, আমি যেন তাকে আর যন্ত্রণা না দেই। বলল:

শার্লক হোমস, তুমি আমাকে সারা পৃথিবী তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছ, অথচ ঈশ্বর সাক্ষী, কোন মানুষের কোন ক্ষতি আমি করি নি।

তার অর্থহীন চোখের দিকে একবার তাকিয়েই বুঝতে পারলাম, লোকটা পাগল। মাগো, এটা আমারই কৃতকর্মের ফল। সেই মুহূর্তে মনে হল, কোন দিন হয় তো তোমার মৃত্যু-সংবাদে এই দুঃখেরই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। সকলে এসে তাকে তুলে ধরল, তার চারদিকে ভিড় দাঁড়াল, করুণাপরবশ হয়ে অনেক আশা ও আশ্বাসের কথা তাকে শোনাল-সে এখন বন্ধুজনের মধ্যেই আছে, তারাই তার যত্ন নেবে, তাকে আশ্রয় দেবে, যে কেউ তার গায়ে হাত তুলবে তাকেই শেষ করে ফেলবে। খনি-শিবিরের কাঠ-খোট্টা লোকগুলোর স্বভাবই এই: তাদের অন্তরের দক্ষিণ দিকটায় যদি সাড়া জাগাতে পার তো তারা তোমার মায়ার মত; আর যদি জেগে ওঠে অন্তরের বিপরীৎ দিকটা তো তারাই হয়ে ওঠে দুরন্ত, যুক্তিহীন। তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য সকলে সাধ্যমত অনেক কিছুই করল, কিন্তু কোন ফল হল না। শেষটায় সুকৌশলী ওয়েলস ফার্গুসন বলল:

একমাত্র শার্লক হোমসই যদি তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকে, তাহলে তোমার আর কোন ভয়ের কারণ নেই।

বন্ধুহীন পাগল সাগ্রহে প্রশ্ন করল, কেন?

কারণ সে আবার মরেছে।

মরেছে! মরেছে! আঃ, আমার মত একটা হতভাগার সঙ্গে তোমরা মস্করা করো না। সে মারা গেছে? সত্যি-সে কি সত্যি কথা বলছে বাছারা?

ঠিক যেমন তুমি দাঁড়িয়ে আছ তেমনিই সত্যি! হ্যাম স্যাণ্ডুইচ বলল। অন্য সবাই সমস্বরে তাকে সমর্থন করল।

ফার্গুসন বলল, গত সপ্তাহে সে যখন তোমাকে খুঁজে ফিরছিল তখন সান বার্নার্ড নোতে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। তাকে অন্য লোক বলে ভুল করেছিল। সে জন্য তারা দুঃখিত, কিন্তু এখন তো আর কিছু করার নেই।

সবজান্তার মত হ্যাম স্যাণ্ডুইচ বলল, তাকে স্মরণ করে তারা একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করছে।

জেমস ওয়াকার একটা দীর্ঘশ্বাস টানল-স্বস্তির শ্বাস-কিন্তু মুখে কিছু বলল না; তার চোখের উদাস ভাব কিছুটা কমল, মুখটাও বেশ

পরিস্কার হল, দৃষ্টির বিষণ্ণতাও কিছুটা হ্রাস পেল। সকলে বাড়ি ফিরে গেলাম। ছেলেরা মিলে যথাসম্ভব ভাল রান্নাবান্না করে তাকে খাওয়াল; এদিকে হিলেয়ার ও আমি নিজেদের নতুন পোশাক দিয়ে তাকে টুপি থেকে জুতোর ফি তে পর্যন্ত সব কিছু দিয়ে সাজালাম; একজন শান্তশিষ্ট বৃদ্ধ ভদ্রলোকের মত করে তুললাম। বৃদ্ধ কথাটাই ঠিক, যদিও কিছুটা দুঃখজনক বটে। নুয়ে-পড়া দেহ, চুলে বরফের কুঁচি, আর মুখের উপর দুঃখ-দুর্দশার অনিবার্য ছাপ-এ সব মিলিয়ে তাকে বুড়ো করেই তুলেছে, যদিও বয়সের হিসাবে এখনও সে যুবক। সে খেতে লাগল, আর আমরা ধূমপান করতে করতে গল্প করতে লাগলাম। খাওয়া শেষ হলে তবে তার কথা বলার মত শক্তি ফিরে এল। স্বেচ্ছায় সে তখন তার অতীত ইতিহাস আমাদের শোনাল। ঠিক ঠিক তার কথার পুনরাবৃত্তি করতে পারব না; তবে যথাসম্ভব চেষ্টা করব।

ভুল লোক–এর কাহিনী

ঘটনাটা এই রকম: আমি তখন ডেনভার-এ। সেখানে আমি অনেক দিন ছিলাম; ঠিক কতদিন ছিলাম সেটা কখনও মনে করতে পারি, আবার কখনও পারি না-অবশ্য তাতে কিছু আসে-যায় না। হঠাৎ সে স্থান ছেড়ে যাবার একটা নির্দেশ পেলাম, অন্যথায় অনেক অনেক বছর আগে পূর্বাঞ্চলে একটি ভয়ংকর অপরাধের দায়ে আমাকে ধরিয়ে দেওয়া হবে।

সে অপরাধের কথা আমি জানতাম, কিন্তু আমি সে অপরাধী নই, সে একই নামের আমার এক জ্ঞাতি ভাই। সে অবস্থায় কি করব? ভয়ে আমার মাথা গুলিয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারলাম না। সময়ও দেওয়া হল অত্যন্ত অল্প-মনে হয় মাত্র একটি দিন। সব কথা ফাঁস হলে আমার সর্বনাশ হবে; বিনা বিচারে তারা আমাকে শাস্তি দেবে, আমার কোন কথাই বিশ্বাস করবে না। জনতার বিচারই এই রকম; পরে যখন বুঝতে পারে তাদের ভুল হয়েছে, তখন দুঃখ প্রকাশ করে; কিন্তু তখন তো অনেক দেরি হয়ে যায়-ঠিক যেমনটি হয়েছে মিঃ হোমসের বেলায়। তাই স্থির করলাম, সব কিছু বিক্রি করে নগদ টাকা নিয়ে চলে যাব এবং হাওয়া থেমে গেলে প্রয়োজনীয় প্রমাণ-পত্র নিয়ে ফিরে আসব। রাতের অন্ধকারে পালিয়ে চলে গেলাম পাহাড়ের ওপারে অনেক দূরে। ছদ্মনাম নিয়ে ছদ্মবেশে সেখানেই বাস করতে লাগলাম।

ক্রমেই নানা গোলমালে জড়িয়ে পড়লাম; দুশ্চিন্তা বেড়ে চলল; এমন কি এক সময় নানা রকম ভূত দেখতে লাগলাম, তাদের কথা শুনতে লাগলাম। কোন বিষয় নিয়ে পরিষ্কারভাবে ভাবনাচিন্তা করবার শক্তিও হারিয়ে ফেললাম। সব কিছু কেমন যেন গুলিয়ে যেতে লাগল। মাথায় যন্ত্রণা হত। অবস্থা খারাপ হয়েই চলল; আরও অনেক ভূত, অনেক কথা তারা যেন সারাক্ষণই আমাকে ঘিরে থাকত; প্রথমে রাতের বেলায়, তারপরে তারা দিনেও হানা দিতে লাগল। তারা সর্বদাই আমার বিছানার চারদিকে ফি সৃফিস্ করে কথা বলত, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করত। ঘুম চলে গেল। বিশ্রামের অভাবে শরীরও ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে লাগল।

তারপরেই অবস্থা সঙীন হয়ে উঠল। একদিন রাতে তারা ফি ফি সিয়ে বলল, আমার তো কিছু করতে পারব না, কারণ আমরা তাকে দেখতে পাই না, কাজেই লোকদের কাছে তাকে ধরিয়ে দিতে পারি না।

তারা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। একজন বলল: শার্লক হোমসকে এখানে নিয়ে আসতে হবে। বারো দিনের মধ্যে সে এখানে এসে পড়বে।

তারা একমত হল, ফিসফিস্ করে কথা বলল, আনন্দে হি-হি করে হেসে উঠল। আমার বুক ভেঙে গেল, কারণ সে লোকটির কথা আমি পড়েছি; সুতরাং তার অতিমানবিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও শ্রান্তিহীন প্রচেষ্টার ফলে আমার যে কি অবস্থা হবে তা ভালই বুঝতে পারলাম।

ভূতরা তাকে আনতে চলে গেল, আর মাঝে রাতে বিছানা থেকে উঠে আমিও পালালাম। সঙ্গে শুধু একটা ছোট থলে। তার মধ্যেই আমার যথাসর্বস্ব-ত্রিশ হাজার ডলার; তার দুই-তৃতীয়াংশ এখনও থলের মধ্যেই আছে। চল্লিশ দিন পরে সেই লোকটি আমার খোঁজ পেয়ে গেল। কোন রকমে আবার পালিয়ে গেলাম। অভ্যাসবশত সরাইখানার খাতায় তার আসল নামটাই সে লিখে ফেলেছিল; অবশ্য পরে সেটা কেটে ডাগেট বার্কলে নামটা বসিয়ে দেয়। কিন্তু ভয় মানুষকে সজাগ ও সতর্ক করে তোলে; আমিও কাটাকুটির ভিতর থেকে আসল নামটা পড়তে পেরে হরিণের মত পালিয়ে গেলাম।

সাড়ে তিন বছর ধরে সে আমাকে পৃথিবীর সর্বত্র-প্রশান্ত মহাসাগরীয় রাষ্ট্রসমূহ, অস্ট্রেলেসিয়া, ভারতবর্ষ-যত দেশের কথা তোমাদের মনে আসে সর্বত্র সে আমাকে তাড়া করে ফিরতে লাগল। তারপর ফিরে এসে মেক্সিকো হয়ে কালিফোর্নিয়া পর্যন্ত; একদণ্ড বিশ্রামও আমার কপালে জোটে নি। আজ আমি বড় ক্লান্ত! সে আমার প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছে, কিন্তু আমি কখনও তার বা অন্য কারও ক্ষতি করি নি।

তার কাহিনী এখানেই শেষ। বুঝতেই পারছ, সব কিছু শু নে এখানকার সকলেরই মন গলে গেল। আর আমি-তার প্রতিটি কথা আমার মনের যেখানে এসে লাগল সেখানেই যেন একটা ফুটো হয়ে বসে গেল।

স্থির হল, বৃদ্ধ লোকটি আমাদের সঙ্গেই থাকবে এবং আমার ও হিলেয়ার এর অতিথি হবে। ঠিক করলাম, খেয়ে দেয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেই

তাকে নিয়ে ডেভার-এ ফিরে যাব এবং তার বিষয়-সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করে দেব।

খনির লোকদের স্বভাব মতই হাড়-কাঁপানো করমর্দন করে সকলে বুড়ো লোকটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

পরদিন ভোরে ওয়েলস ফার্গো ফার্গুসন ও হাম স্যান্ডুইচ আস্তে আমাদের বাইরে ডেকে নিয়ে গোপনে বলল:

অপরিচিত বুড়োটির প্রতি খারাপ ব্যবহারের কথা সকলেই জেনে গেছে। সারা খনি-অঞ্চলটা তেতে উঠেছে। চারদিকে থেকে এসে। তারা জড়ো হচ্ছ-অধ্যাপককে শাস্তি দিতে তারা বদ্ধপরিকর। কনস্টেবল হ্যারিস ফ্যাসাদে পড়ে গেছে। টেলিফোনে শেরিফ কে খবর দিয়েছে। চলে এস!

ছুটে গেলাম। অন্যের কথা জানি না কিন্তু আমি মনে মনে চাইছিলাম যে শেরিফ এসে পড়ুক; কারণ বুঝতেই তো পারছ, আমার কাজের জন্য শার্লক হোমসের ফাঁসি হোক এটা আমি চাইতে পারি না। শেরিফের কথা আমি অনেক শুনেছি; তবু নিশ্চিত হবার জন্য বললাম:

তিনি কি উত্তেজিত জনতাকে ঠেকাতে পারবেন?

উত্তেজিত জনতাকে ঠেকাবেন! জ্যাক ফেয়ারফ্যাক্সও তা পারেন কি! আমার হাসি পাচ্ছে! পারবেন কি! আমার জানতে ইচ্ছা করছে!

পাহাড়ী পথ ধরে ছুটে চললাম। দূরাগত চিৎকার ও চেঁচামেচি তে শান্ত বাতাস ভরে উঠেছে; আমরা যত এগোচ্ছি, সে শব্দ ততই বাড়ছে। গর্জনের পর গর্জন, ক্রমেই জোরে, আরও জোরে, কাছে, আরও কাছে। অবশেষে সরাইখানার সামনেকার খোলা জায়গায় সমবেত জনতার কাছে যখন পৌঁছে গেলাম তখন তাদের চিৎকারে কানে তালা লাগবার মত অবস্থা। ডালি-র খাদ থেকে আগত কিছু ষণ্ডাগোছের লোক হোমসকে চেপে ধরেছে, সে কিন্তু সম্পূর্ণ শান্ত; ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি; তার বৃটি শ হৃদয়ে মৃত্যুর ভয় যদি বা থেকে থাকে তবু তার লৌহ-কঠিন ব্যক্তিত্ব সে ভয়কে সংযত করে রেখেছে, বাইরে তার তিলমাত্র প্রকাশ নেই।

ড্যালি-র দলের শ্যাড়বেলি হিগিন্স বলল, সকলে ভোট দাও! তাড়াতাড়ি! ফাঁসি হবে, না গুলি?

তার এক সঙ্গী চেঁচিয়ে বলল, কোনটাই না। এক সপ্তাহের মধ্যে সে আবার বেঁচে উঠবে; একমাত্র পুড়িয়ে ফেললেই তবে তার স্থায়ী অবসান ঘটবে।

আশপাশের শিবির থেকে সমাগত সব দলই বজ্র-গর্জনে তার কথা সমর্থন করে ধাক্কাধাক্কি করতে করতে বন্দীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল; চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরে চেঁচাতে লাগল: আগুন! ভোটের ফল। আগুন! টানতে টানতে তাকে ঘোড়ার খুঁটির কাছে নিয়ে গেল, তার দিকে পিঠ দিয়ে তাকে শিকল দিয়ে বাঁধল, গাছগাছালি এনে তার কোমর পর্যন্ত জমা করল। তার কঠিন মুখ কিন্তু এতটুকু কাপল না; পাতলা ঠোঁটে তখনও সেই ঘৃণার হাসি।

দেশলাই! একটা দেশলাই আন!

শ্যাডবেলি দেশলাইর কাঠি জ্বালাল, হাত দিয়ে বাতাস থেকে আড়াল করে ধরল, মাথা নীচু করল, তারপর পাইনের ডালের নীচে সেটাকে ধরল। জনতা নিশ্চপ। ডালে আগুন ধরল; দুএক মিনিটের মধ্যেই একটা ক্ষীণ শিখা জ্বলে উঠল। দূরাগত অশ্ব-ক্ষুরের শব্দ যেন শুনতে পেলাম-ক্রমে সেটা স্পষ্ট হল-আরও আরও স্পষ্ট, আরও; কিন্তু নিজেদের কাজে ব্যস্ত জনতা সেটা খেয়ালই করল না। দেশলাই কাঠি টা নিভে গেল। আর একটা কাঠি ধরিয়ে লোকটি নীচু হল; আবার আগুনের শিখা দেখা গেল। এবার আগুনটা ছড়িয়ে পড়ল। কিছু কিছু লোক মুখ ফিরিয়ে নিল। জল্লাদ লোকটি পোড়া কাঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের কীর্তি দেখতে লাগল। একটা পাহাড়ের মোড় ঘুরে ক্ষুরের শব্দ বজ্রগর্জনে দ্রুত আমাদের দিকে নেমে আসতে লাগল। পর মুহূর্তেই ধ্বনি উঠল:

শেরিফ!

জনতাকে সরিয়ে সে সোজা ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গেল; ঘোড়াট। পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল; সে হাঁক দিল;

হাই ভবঘুরের দল। সরে যাও!

সকলেই কথামত কাজ করল। শুধু দলপতি ছাড়া। সে দাঁড়িয়েই রইল। হাত বাড়াল রিভলবার বের করতে। শেরিফ তৎক্ষণাৎ বাধা দিয়ে বলল:

হাত নামা ব্যাটা পাষণ্ড। লাথি মেরে আগুন নিভিয়ে ফে। এবার অপিরিচিতের বাঁধন খুলে দে।

লোকটা তার কথামতই কাজ করল। শেরিফ তখন একটা বক্তৃতা দিল। ঘোড়াটাকে সামরিক ভঙ্গীতে দাঁড় করিয়ে সে কথা বলতে লাগল। কথায় কোন উত্তাপ সঞ্চার না করে মাপমত সুচিন্তিত ভাষায় এমনভাবে তার বক্তব্য উপস্থাপিত করল যেটা তার চরিত্র ও পদমর্যাদারই অনুকুল।

তারপর বন্দীর দিকে তাকিয়ে বলল, আগন্তুক, আপনি কে আর এখানে কি করছিলেন?

আমার নাম শার্লক হোম! আমি কিছুই করি নি।

নামের শব্দটাই শেরিফের উপর আশ্চর্য প্রভাব বিস্তার করল। আবেগের সঙ্গে সে বলল, যে মানুষের অদ্ভুত সব কার্যকলাপের ফলে তাঁর যশ ও কৃতিত্বের কথা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং অপূর্ব সাহিত্যিক প্রেক্ষাপটের গুণে সেই সব কার্যকলাপের ইতিহাস প্রতিটি পাঠকের হৃদয় জয় করেছে, আমাদের নক্ষত্র ও রেখালাঞ্ছিত পতাকার তলে এসে সেই মানুষের উপরেই নেমে এসেছে এমন অন্যায় উৎপীড়ণ-এটা আমাদের দেশের পক্ষে এক মহা কলঙ্ক। সমস্ত জাতির হয়ে শেরিফ তার কাছে ক্ষমা চাইল, আনত হয়ে হোমসকে অভিবাদন জানাল, কনস্টেবল হ্যারিসকে নির্দেশ দিল হোমসকে যেন তার বাসায় পৌঁছে দেয় এবং তার উপর যেন আর কোন রকম নির্যাতন না হয়। তারপর জনতার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল: যার যার গর্তে পালাও, নীচাশয়ের দল! সকলে চলে গেল। তখন সে

আবার বলল: শ্যাড় বেলি আমার সঙ্গে চল; তোমার ব্যবস্থা আমি নিজের হাতে করব। না-পিস্তলটা রাখ; ওটার জন্য যেদিন আমি তোমাকে ভয় করব সেদিন গত বছরের একশ বিরাশি জনের দলে যোগ দেবার সময় আমার হবে। সে ধীরগতিতে ঘোড়া চালাল; শ্যাড বেলি চলল তার পিছনে পিছনে।

প্রাতরাশের সময় হলে আমরা যখন বাসার দিকে এগিয়ে চলেছি এমন সময় খবর এল, ফে টুলক জোন্স গত রাতেই হাজত থেকে পালিয়েছে; সে উধাও! সে জন্য কেউ দুঃখিত হল না। খুড়োর যদি ইচ্ছা হয় তো তার খোঁজ করুক; তার তো সেটাই কাজ; শিবিরের লোকদের তাতে কোনও আগ্রহ নেই।

.

১০.

দশ দিন পরে।

জেমস ওয়াকার এখন শারীরিক সুস্থতা ফিরে পেয়েছে। তার মনের উন্নতি দেখা যাচ্ছে। আগামী কাল সকালে তাকে নিয়ে ডেনভার যাচ্ছি।

পরদিন রাত। ছোট স্টেশন থেকে ডাকে দেওয়া সংক্ষিপ্ত চিঠি।

আজ সকালে যাত্রা মুহূর্তে হিলেয়ার আমার কানে কানে বলল: যখন তুমি নিরাপদ মনে করবে, যখন বুঝবে যে এতে তার মনটা বিচলিত হয়ে তার আরোগ্যের পথে বিঘ্ন ঘটাবে না, তখন ওয়াকারকে খবরটা দিও পুরনো দিনের যে অপরাধের কথা সে বলেছে সেটা করেছিল তারই এক জ্ঞাতি ভাই, সেও তাই বলেছে। আসল অপরাধীকে আমরা কাল কবর দিয়েছি-এ শতাব্দীর সেই সব চাইতে অসুখী মানুষটি ফ্লিণ্ট বাকনার। তার আসল নাম ছিল জ্যাকব ফুলার! মাগো, না জেনেই আমি তার শোকযাত্রায় যোগ দিয়েছিলাম, আর আমার সহায়তায়ই তোমার স্বামী ও আমার বাবা আজ কবরে শায়িত। তার বিশ্রাম নির্বিঘ্ন হোক।

[১৯০২]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *