একটি চলে যাওয়া দিনের গুরুতর কাহিনী – সুকুমার দে সরকার
নিজের নাম নিয়ে শেষে এমন মুস্কিলে পড়ব কে জানত? শেক্সপিয়র বলে গেছেন নামেতে কি আসে যায়। আমার মামা আমার বেলায় মহাপুরুষের সেই মহাবাক্য প্রয়োগ করেছেন অর্থাৎ যে কোন বিশেষ্য বা বিশেষণ যা তাঁর বেশ লাগসই মনে হয় তা তিনি আমার ওপর লাগিয়ে বসেন। তাই তাঁর কাছে কখনও আমি পেঁচা কখনও গরু কখনও ভাল্লুক আবার কখনও দোল-গোবিন্দ বলেও আখ্যাত হই। আমার মেসোমশায়ের কিন্তু অন্য মত—তিনি আবার মস্ত মনস্তত্ত্ববিদ! তিনি বলেন নামের ওপরেই এক এক জনের মনস্তত্ত্ব ফুটে ওঠে—নামই সব। বাপ মা যা নাম দেয় সে সব ভুল, তার ভেতর থেকে চরিত্রের কোন আভাস পাওয়া যায় না, তাই যে সব লোকের সংস্পর্শে তিনি আসেন, তাদের সকলকে তিনি নিজে এক একটা নাম দেন। আমার কপালে জুটেছিল—হরির লুঠ।
তারপরে আমার পিসেমশাই। তিনি অত যুক্তি তর্কের ধার ধারেন না। তাঁর পরিচয় তোমরা শিগগিরই পাবে, তবু আগে থাকতে এটুকু জেনে রাখো যে তিনি রসগোল্লা খেতে অত্যন্ত ভালবাসেন আর রসগোল্লা কথাটা সব সময় তাঁর মুখে লেগে আছে। আমার পিসেমশাই পয়সাওয়ালা লোক, কিন্তু তেজারতি ব্যবসা করে তাঁর প্রকৃতিটা বেশ কৃপণ হয়ে উঠেছিল। সদানন্দ রোডে প্রকাণ্ড এক পাঁচতলা বাড়ির ফ্ল্যাটে তিনি থাকতেন। মোটের ওপর চলছিল ভাল, কিন্তু গোলমাল বাঁধালে একছড়া প্রকাণ্ড মোটা সেকেলে সোনার বিছে হার।
সেদিন সকালে তখন সবে বিছানায় উঠে বসেছি, হঠাৎ মামা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকেই বললেন, এই দেখ, ঠিক যা ভেবেছি পেঁচাটা ঘুমোচ্ছ।
কই মামা, ঘুমোচ্ছি কোথায়, এই তো উঠে বসে আছি।
তবে তো খুব কাজ করেছ। নে নে চল।
কোথায়?
শুনিসনি তোর পিসেমশায়ের বাড়ি যে ভীষণ চুরি হয়ে গেছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ রে ভাল্লুক। চল শিগগির চল।
একবার মামার দোকানের একটা মুক্তোর মালা চুরির চোর ধরার সাহায্য করেছিলাম বলে মামার কাছে আজও আমার খুব খাতির। আমার মামা জুয়েলার আর পিসেমশাই তেজারতি করেন, তাই ওঁদের দুজনের মধ্যেও খুব খাতির।
মামার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। পথে যেতে যেতে মামা আমাকে চুরির সমস্ত ব্যাপার খুলে বললেন।
পিসেমশায়ের বাড়ির ওপরের ফ্ল্যাটে তেতলায় সম্প্রতি এক বেহারী ভদ্রলোক ভাড়াটে এসেছেন। কালরাত্রে সেই ভদ্রলোক পিসেমশায়ের কাছে এসে বলেন—বাবুজি আমি নূতন কলকাতায় এসে টাকার অভাবে বড় বিপদে পড়ে গেছি। শুনলাম আপনি টাকা ধার দেন, তা আমার এই হারটা বাঁধা রেখে যদি আপনি পাঁচশো টাকা ধার দেন তো বড় উপকার হয়।
অবশ্য কথাগুলো সব হিন্দিতেই হয়েছিল। পিসেমশাই হারটা পরীক্ষা করে দেখলেন একেবারে পাকা সোনার দামী হার। তবু বললেন, ‘আপনি কাল আমার দোকানে আসবেন—দিয়ে দেব।
তখন সে ভদ্রলোক বললেন, বাবুজি আমার হাতে একটাও পয়সা নেই। আজই যদি আপনি দেন তো বিশেষ উপকার হয়।
এখন, সেদিন কি কারণে পিসেমশায়ের হাতে টাকা ছিল, তিনি হারটা নিয়ে টাকাটা দিয়ে দেন। তারপরে হারটা তাঁর সেকেলে লোহার সিন্দুকে তুলে রেখে যথারীতি কাজটাজ সেরে তিনি শুয়ে পড়েন। লোহার সিন্দুকটা থাকত পিসিমার ঘরে, পিসিমা কিছুদিন আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। পিসেমশায়ের শোবার ঘর তার পাশে। সকালবেলা তিনি উঠে দেখেন পিসিমার ঘরের বারান্দার দিকে দরজা খোলা। তাঁর কি রকম সন্দেহ হয়। উঠে এসে দেখেন সেকেলে লোহার সিন্দুকের ডালা ভাঙা পড়ে আছে, ভেতরে কিছু নেই। আর বারান্দা থেকে বাঁধা একটা লম্বা দড়ি নিচে মাটিতে ঝুলছে। সিন্দুকে আর কিছু বিশেষ ছিল না, কিছু টাকা আর সেই হারটা। সব উধাও। পিসেমশাই প্রথমে টেলিফোন করে মামাকে আনান, তারপরে পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ এসে সব লিখে টিখে নিয়ে বলে যে এই রকম সিন্দুক ভাঙা চুরি কয়েকদিন ধরে অনেকগুলো হয়েছে, কিন্তু চোরকে তারা কিছুতেই ধরতে পারছে না।
এই তো গেল সংক্ষেপে ব্যাপার, তারপরেই মামা আমার কাছে আসেন। পিসেমশায়ের ওখানে যখন পৌঁছলাম, তখন বেলা প্রায় ন’টা হবে। বাড়িতে ঢোকবার প্যাসেজের সামনেই রামসিং দারোয়ানের ঘর। ফ্ল্যাট হিসেবে ভাড়া দেওয়া কিনা, তাই রামসিং বাড়ির তাঁবেদরি করে, আমাদের দেখে রামসিং বেরিয়ে এল। ইয়া তাগ্ড়া লম্বা চেহারা, বুক পেট সব সমান গোল আর মুখে বিশাল এক ঝাড়ুদারি গোঁফ।
মামাকে দেখে রামসিং বলল, কি বাবুজি, ডাকু পাকড়াবার জন্যে কি এই খোঁকাবাবুকে নিয়ে এলেন নাকি?
মামা বললেন, হ্যাঁ।
রামসিং হো হো করে হেসে উঠল। তারপরে আমার কাঁধে তার বিশাল হাতটা বেড়াল যেমন করে ইঁদুরকে ধরে, তেমনি করে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, খোঁকাবাবু পালোয়ান, ডাকু পাকড়াকে লিয়ে আসবে।
রামসিং আবার হো হো করে হেসে উঠল। আমার ভয়ানক রাগ হচ্ছিল, তবু রামসিং-এর চোখে একটা অদ্ভুত লোভ আলো দেখে চুপ করে গেলাম। এরকম ব্যাপারে যত চুপ করে দেখা যায় ততই ভাল।
ওপরে গিয়ে দেখি পিসেমশাই একটা ইজিচেয়ারে উদাস হয়ে পড়ে আছেন। আমাকে দেখেই হাঁউমাউ করে উঠলেন, এই দেখ রসগোল্লাটা এই সময় জ্বালাতে এসেছে, আমি মরছি আর এখন হল ওর মজা দেখবার সময়! ওরে, উঃ! আমার বুক কেমন করছে!
মামা বললেন, ওরকম করছ কেন? চুপ কর।
চুপ করব? আমার মান সম্মান সব গেল। দেওনারায়ণের কাছে মুখ দেখাব কি করে!
দেওনারায়ণ সেই বেহারী ভদ্রলোকের নাম।
মামা বললেন, কি আর হয়েছে, না হয় টাকাটা তুমি দিয়ে দেবে—
‘অ্যাঁ, ওরে বাবা, হা—জা—র টাকা!’ পিসেমশাই প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওরে আমার বুক কেমন করছে, বুকের ব্যথাটা আবার বেড়ে উঠেছে। ওরে রসগোল্লা ডাক্তার ডাক।’
আমি মামার মুখের দিকে তাকালাম। মামা বললেন, যা রে শুঁট্কি মাছ, তোর মেসোমশাইকে একবার খবর দে।
মেসোমশাই আত্মীয়দের সকলেরই ফ্যামিলি ফিজিসিয়ন—ভিজিটটা বেঁচে যায় কি না!
একটু পরে দুমদাম করে এসে মেসোমশাই ঘরে ঢুকলেন। কাঁধে এক প্রকাণ্ড ঝুড়ি। আমরা তো অবাক! জিগ্যেস করলাম, ওতে কি মেসোমশাই?
কমলা লেবু।
কমলা লেবু কি হবে?
উঃ উঃ কি বোকা! নে! কমলা লেবু কি হয়? নে, নে, একটা খেয়ে দেখ কি হয়।
তা তো জানি, কিন্তু নিজে কাঁধে করে নিয়ে এলেন, এর মানে কি? ওগুলো পিসেমশায়ের জন্য বুঝি?
অ্যাাঁ? না, না, বুকের ব্যামো, ও লেবু খাবে কি? আর নিচে গাড়িতে রেখে আসার কি জো আছে? ড্রাইভারটা যদি খেয়ে নেয়?
ভেবে দেখ, তোমরা, প্রকাণ্ড মাস্টার বুইকে যিনি ঘুরে বেড়ান তাঁর ভয় একটা লেবু যদি ড্রাইভার খেয়ে নেয়। আবার জিগ্যেস করলাম, তা লেবু খেলে তো শুনেছি হার্ট শক্ত হয়, পিসেমশায়ের বেলা কি সে নিয়ম খাটে না?
অ্যাাঁ? আচ্ছা দে আধখানা।
তারপরে পিসেমশায়ের দিকে ফিরে বললেন; এইবার বল তো টেঁশুরাম কেমন আছ?
পিসেমশাই লাফিয়ে উঠলেন, টেঁশুরাম কাকে বলছ?
কেন, তোমাকে! আমি ভেবে দেখলাম ওই নামটাই তোমার মনস্তত্ত্বের সঙ্গে চমৎকার মানায়। একেবারে খাপে খাপ বসে যায়, কি বলিস রে হরির লুঠ?—আমার দিকে ফিরে মেসোমশাই বললেন।
আমাকে আর উত্তর দিতে হল না। পিসেমশাই তখন উঠে বসেছেন, তাঁর.বুকের ব্যথা কখন ভাল হয়ে গেছে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে তিনি বললেন, আমি টেঁশুরাম? তাহলে তুমি—তুমি একটা (পিসেমশাই খুঁজতে লাগলেন)⋯তুমি একটা রসগোল্লা!
খামোখা কেন রাগ করছ?—মেসোমশাই বললেন। তারপরে মামার দিকে ফিরে জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা, তুমি বল গদাধর?
গদাধর কাকে বলছ?—বাজখাঁই গলায় উত্তর এল।
কেন, তোমাকে! ওটা তোমার নাদা পেটের সঙ্গে যা মানায়—চমৎকার!
কি? কি বললেন? আমার নাদা পেট?
তারপরে যা কাণ্ড শুরু হল ঘরের ভেতর সে আর বলবার নয়। কাকে রেখে কাকে সামলাই? ঘরের ভেতর যেন কথার কুরুক্ষেত্র বেধে গেল। আমি শেষে চটে মটে বললাম, তোমরা তাহলে এই করতে থাকো, আমি চললাম।
রাগ করে পথে নেমে এলাম। তিনজন বয়স্ক লোক—তাঁদের একি কাণ্ড? সকাল বেলাটাই আমার নষ্ট হল দেখছি। হঠাৎ পেছন থেকে পিসেমশায়ের চিৎকার শুনলাম—এই রসগোল্লা!
সঙ্গে সঙ্গেই মেসোমশায়ের ডাক—হরির লুঠ! দেখি সামনের বারান্দায় পিসেমশাই আর মেসোমশাই দুজনেই বেরিয়ে এসে আমাকে ডাকছেন।
রসগোল্লা!
হরির লুঠ!
রসগোল্লা!
হরির লুঠ!
কি আর করি—ফিরলাম। কিন্তু একি বিপদ! আমার পেছু পেছু এত লোক আসে কেন? দেখতে দেখতে পথটা লোকে ভরে গেল আর সবাই পিসেমশায়ের বাড়ির সামনে এসে জড়ো হল। একজন হেঁকে বলল, কই মশাই, রসগোল্লা হরির লুঠ কোথায়?
পিসেমশাই আমাকে দেখিয়ে বললেন, না, সে আপনাদের নয় মশাই, ওই ওকে!
কেন, আমরা বুঝি খেতে জানি না? হরির লুঠ দেবেন তার আবার একে ওকে কি?
মেসোমশাই আমাকে ডাকলেন, এই হরির লুঠ।
কই মশাই, কই? শুধু শুধু লোককে মিথ্যে কথা বলেন কেন?
আপনাদের বলছি না মশাই।
বলছেন না কিরকম, হরির লুঠ বলে আকাশ ফাটিয়ে ফেলছেন আর আসলে শূন্যি?
কতক্ষণ এরকম চলত বলা যায় না, কিন্তু সব থেকে বাঁচালেন মামা, আমার ওপর মামার জীব জগতের জ্ঞান প্রয়োগ এতদিনে দেখলাম সার্থক হল। মামা হঠাৎ বারান্দায় বেরিয়ে এসে আমাকে হেঁকে বললেন, এই ডালকুত্তা, তেড়ে যা না, হাঁ করে দেখছিস কি?
ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন বলল, ‘অ্যাাঁ! ডালকুত্তা? তারপরেই সব হাওয়া।
ওপরে এসে বললাম, তোমরা কি সারাদিন আজ এই করবে না চুরির ব্যাপার কিছু বলবে?
মামা বলল, ব্যাপার আর কি বলবার আছে? একটা চোর দড়ি বেয়ে এই বারান্দায় উঠেছে, কোন যন্ত্র দিয়ে দরজা খুলেছে, তারপরে সিন্দুক ভেঙে লোপাট।
পিসেমশাই শুধু একবার হাঁউ-মাঁউ করে উঠল।
আমি বললাম, যন্ত্র দিয়ে দরজা খুলেছে কি করে জানলেন?
প্রথম, যে চোর সিন্দুক ভাঙতে পারে, সে দরজাও ভাঙতে পারে; দ্বিতীয়, দরজায় একটা নূতন বড় করে ছেঁদা করা হয়েছে।
আচ্ছা পিসেমশাই, আপনার সেই ভদ্রলোক সেই হারটার কথা বা টাকার কথা ওই রামসিং দারোয়ানকে বলেছিল কিনা জানেন?
না, তা তো জানি না, তবে ডেকে জিগ্যেস করতে পারি।
হ্যাঁ, করুন না একবার।
দেওনারায়ণবাবুকে ডেকে আনা হল।
মামা বলল, এই প্যাঁচা, কি জিগ্যেস করবি তুই কর।
আমি জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা, আপনি আপনার হারটা কি রামসিংকে দেখিয়েছিলেন বা বন্ধকের কথা বলেছিলেন?
ভদ্রলোক ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। পিসেমশাই বললেন, ও উনি আবার ভালো বোঝেন না সব। আচ্ছা, আমি জিগ্যেস করছি।
অনেকক্ষণ ইকড়ি মিকড়ি করার পর জানা গেল হারটার কথা। দেওনারায়ণবাবু রামসিংকে বলেও ছিলেন দেখিয়েও ছিলেন এবং বন্ধক দিয়ে যে টাকা নিয়েছিলেন সে কথাও বলেছিলেন। এক দেশের আর এক ভাষার লোকের কাছে অত লুকোচুরি করবার দরকার মনে করেননি।
দেওনারায়ণবাবু চলে গেলে মামা বলল, কেন, রামসিংয়ের কথা জিগ্যেস করছিস কেন?
আমি বললাম, হারটার কথা দুজন লোকের মোটে জানবার কথা। এক দেওনারায়ণের, দুই পিসেমশাই। তৃতীয় যদি কেউ জানে তাহলে সন্দেহটা তার ওপর পড়ে। এখন এটা সাধারণ চোরের কাজ নয়, কারণ ঠিক হারটা যেদিন রাখা হল চুরিও সেদিনই হোল। এর মধ্যে একটা যোগাযোগ রয়েছে। এ কোন জানা চোরের কাজ।
পিসেমশাই লাফিয়ে উঠলেন, ঠিক হয়েছে। নিশ্চয় এই ব্যাটা রামসিং নিয়েছে। আমার এখানে যে। আর কিছু থাকে না, সব দোকানে থাকে, ও জানে। কাল শুনেছে হারটা ওখানে রেখেছি, ব্যাটা দড়ি বেঁধে ওপরে উঠেছে, তারপর দরজা কেটে সিন্দুক ভেঙে চুরি করেছে। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি ব্যাটাকে!
দাঁড়ান, দাঁড়ান পিসেমশাই—এখন নয়।
কেন?
আগে ভাল করে দেখা যাক। চলুন তো, বারান্দাটা একবার দেখা যাক।
বারান্দায় এসে আমি বললাম, দড়িটা কোথায় গেল?
পুলিশে নিয়ে গেছে।
দড়িটা কোথায় বাঁধা ছিল?
মামা আর পিসেমশাই দেখিয়ে দিলেন, মেসোমশাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লেবু খেতে লাগলেন।
বাড়িটা প্রকাণ্ড লম্বা, সামনে দু সার ছোট ছোট ব্যালকনি ওপরে উঠে গিয়েছে, আমাদের মাথার ওপর আমাদের মতই ব্যালকনি আরও চারটে ওপরে উঠে গেছে। ব্যালকনিগুলো ঢালাই করা, তার ওপর বালির কাজ! দেখলাম, যেখানে দড়িটা বাঁধা ছিল বলে ওঁরা দেখিয়ে দিলেন, সেখানে কোন দাগ নেই—চুন বালির ওপরে কোন রকম দাগ পড়েনি। একটু আশ্চর্য হয়ে গেলাম।
সেদিন আর কিছু হল না, চলে এলাম। মনটা চিন্তিত হয়ে রইল। পথে যেতে যেতে ভাবলাম একটা লোক দড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল অথচ রেলিংয়ের চুন বালিতে কোন দাগ পড়ল না? লোকটা কি পাখির মত হালকা নাকি? লোকটা দড়ি বেঁধে তো উঠে এসেছে, তাতে চুনের ওপর অনেক ঘস! লাগবার কথা। হঠাৎ বিদ্যুতের মত একটা কথা মনে চমকে গেল। আমরা ধরে নিয়েছিলাম চোর দড়ি বেঁধে ওপরে উঠে চুরি করেছে। বারান্দায় দড়িটা বাঁধা ছিল। কিন্তু চোর নিচে থেকে ওপরের বারান্দায় দড়ি বাঁধল কি করে? চোরের তো আর পাখা থাকতে পারে না। আর থাকলে সে দড়ি ব্যবহার করবে কেন? হতভম্ব হয়ে গেলাম। এ কি অদ্ভুত ব্যাপার?
সন্ধ্যেবেলা আবার পিসেমশায়ের ওখানে গেলাম, গিয়ে দেখি বাড়ি অন্ধকার কুপ কুপ করছে। সিঁড়ির মুখে রামসিংকে কারণ জিগ্যেস করলাম, এত অন্ধকার কেন?
ডাকু পকড়নেকা সুবিস্তা হোগা আপকা খোঁখাবাবু। রাম সিং হো হো করে হেসে উঠল, তারপরে বলল, নেই খোঁখাবাবু, বিজলি লাইন ফিউজ হো গিয়া, মিস্ত্ৰি আতা হ্যায়।
আর কিছু না বলে ওপরে উঠতে লাগলাম। হঠাৎ সিঁড়ির বাঁকে লাগল ঠোক্কর কার সঙ্গে। আর সঙ্গে সঙ্গে কে যেন বলে উঠল, কি মশাই, দেখতে পান না? অন্ধ নাকি?
একটা কড়া জবাব দিতে যাব, হঠাৎ লোকটা প্রায় ছুটে নেমে গেল। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কে লোকটা? অমন করে পালাল কেন? তাড়াতাড়ি পিসেমশায়ের ঘরে ঢুকতেই পিসেমশাই বলে উঠলেন, কি রে রসগোল্লা কি মনে করে?
দাঁড়ান, বলে বারান্দায় গিয়ে দেখি বাড়ি থেকে দেওনারায়ণ বেরিয়ে যাচ্ছে। লোকটা একবার সন্দিগ্ধভাবে উপরে তাকাল, তারপরে হনহন করে পা চালিয়ে দিল।
বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়। ওর সঙ্গেই যে আমার ধাক্কা লেগেছিল এ বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল না, কিন্তু ও নাকি বাংলা জানে না? এ লুকোচুরির মানে কি? প্রথমত ও মিথ্যে কথা বলেছে বাংলা জানে না বলে, দ্বিতীয় বাংলা বলে ফেলে ও ওরকম লুকিয়ে পালাতে চাচ্ছে—এর মানে কি? আর হঠাৎ সত্যিটা মনে চমক দিয়ে গেল।
হারটার কথা তিনজন জানত। পিসেমশাই, দেওনারায়ণ আর রামসিং। এখন, রামসিং নিচে থেকে ওপরের বারান্দায় দড়ি বাঁধতে পারে না। পিসেমশায়কে বাদ দেওয়া যেতে পারে। তাহলে থাকে দেওনারায়ণ। সে তার বারান্দা থেকে দড়ি বেঁধে নেমে এসে হারটা চুরি করেছে, তারপরে ওঠবার সময় দড়ির নিচের দিকটা পিসেমশায়ের বারান্দায় বেঁধে আবার ওপরে উঠে গেছে। তারপর নিজের বারান্দা থেকে দড়িটা খুলে একেবারে নিচে ফেলে দিয়েছে। কেউ তাকে সন্দেহ করতে পারেনি। তার দু রকম লাভ—টাকাটাও, হারটাও। আর তাই আমরা নিচের বারান্দায় কোনরকম দড়ির দাগ দেখতে পাইনি। আমি ছুটে ভেতরে এলাম—পিসেমশাই,আপনার থানার ইন্সপেক্টরের সঙ্গে ভাব আছে?
কোন ইন্সপেক্টর?
যে এই চুরির ভার নিয়েছে?
না, তবে তোর মামার সঙ্গে তার ভাব আছে।
তবে ডাকুন মামাকে।
আধঘণ্টা পরে মামা এসে বলল, কিরে গরু, আবার কি খেয়াল?
মামা, ইন্সপেক্টরকে একটা খবর দিতে হবে। খবরটা ঠিক কি না জানি না, তবে মনে হয় আমার সন্দেহ ঠিক।
খবরটা কি?
পিসেমশাই বললেন, রসগোল্লা।
অ্যাঁ, রসগোল্লা? সে আবার কি?
আঃ, তোমরা আবার শুরু করো না, আমি বললাম, দাঁড়াও সব বলছি।
সেই রাতেই ইন্সপেক্টর বিজয়লালবাবু এসে দেওনারায়ণকে বললেন, বাবুজি, আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে, একবার আসতে পারি?
জরুর—দেওনারায়ণ জবাব দেয়।
আমরা বিজয়লালবাবুর পেছনে ভেতরে যাই এবং কোন কথা না বলে একেবারে বারান্দায় গিয়ে হাজির হই। বেশি খুঁজতে হয় না, বারান্দার চুনবালির রেলিংয়ের হাতলে গোল করে কাট দাগ।
বিজয়লালবাবু হেসে ওঠেন, তারপরে আমাকে বলেন, সাবাস ভায়া! ওই দড়ির দাগ, ওইখানে দিয়ে ও নিচে নেমেছিল।
পিসেমশায় লাফিয়ে ওঠেন, উঃ! সাহস দেখেছ! হতভাগাকে জেলে দেব, হতভাগা একটা⋯একটা⋯রসগোল্লা।
আমরা ভেতরে আসি আর আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠি—দেওনারায়ণ কোথায়?
অ্যাঁ?—পিসেমশাই বলেন।
পালিয়েছে। বললে মামা।
বিজয়লালবাবু হাসেন, এইটাই হল বোঝার উপর শাকের আঁটি। লোকটা চালাক হয়েও বোকা, ভেবেছে পালিয়ে রেহাই পাবে। ওর ওই পালানটাই ওর বিরুদ্ধে শেষ প্রমাণ। তবে বাছাধনকে যেতে হবে না বেশি দূর। নিচে আমার লোক এমনি সাধারণ পোশাকে খাড়া আছে, যতক্ষণ আমি ওপরে থাকব ততক্ষণ কেউ পালাতে পারবে না।
তারপরে? আরও শুনতে চাও? দেওনারায়ণ ধরা পড়ল, বমাল পাওয়া গেল। শুধু পিসেমশায়েরটা নয়, আরও অনেকের। লোকটা বেহারী মোটেই নয়, একটা পাকা বাঙালী চোর। নানা জায়গায় নানারকম সেজে চুরি করেছে। সিন্দুক ভাঙায় লোকটা একেবারে পাকা। তারপর তার দুঃখের কাহিনী আর নাই বা শুনলে।
এসবের পর অনেকদিন কেটে গেছে। সে সব দিনগুলো আজকাল একেবারে স্বপ্নের মত মনে ভেসে আসে, আবার স্বপ্নের মতই মিলিয়ে যায়। স্মৃতির ওপর কিন্তু তাদের দাগ থেকে যায়, তাই স্মৃতির পাতা থেকে এক একটা কাহিনী তোমাদের উপহার দিই। কি অদ্ভুত আমাদের এই চলে যাওয়া দিনগুলো!