একটি গোলাপ
একটু আগে পড়ার টেবিল ছেড়ে বাবা রাগ করে উঠে গেছেন। সোনালি ফ্রেমের চশমাটা পড়ে আছে একপাশে। সাতটা অঙ্ক দিয়েছিলেন। একটাও আমি পারিনি। বারবার বুঝিয়ে দেবার পরও না। আমার মাথায় যে গোবর ভরা আছে তা আমি জানি। অফিস থেকে এসে এক কাপ চা খেয়েই পড়াতে বসেছিলেন। না পারলে বাবা আমাকে মারেন না। তিনবার, চারবার, পাঁচবার বুঝিয়ে দেন। জিজ্ঞেস করেন, ‘বুঝেছ? বুঝেছ? বুঝেছ?’ যদি বলি, ‘হ্যাঁ’, বলেও যদি না পারি, তা হলেই মুখটা থমথমে-মতো হয়ে যায়। ক্রমশ লাল হতে থাকে। একসময় বলেন, ‘না, ব্যর্থ চেষ্টা। যা হবার নয়, তা হবার নয়। সকলের সবকিছু হয় না, পড়াশোনা তোমার লাইন নয়। অকারণ সময় নষ্ট না করে, অন্য কিছু চেষ্টা করো।’
আমার সামনে খাতা খোলা। পেনসিল গড়াগড়ি। রাতের মৃদু বাতাসে বইয়ের পাতা ফিরফির করছে। বাইরের আকাশে বিশাল এক চাঁদ। চারপাশ যেন খলখল করে হাসছে। আর আমার চোখে জল। কেন আমার মাথায় কিছু ঢোকে না ভগবান! আমার বন্ধু বিশু প্রতিটি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। সাঙ্ঘাতিক ভালো ফুটবল খেলে। সুন্দর আবৃত্তি করে। প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের দিন স্কুলের নাটকে অভিনয় করে। ফটাফট হাততালি পায়। পদকের পর পদক। সুন্দর স্বাস্থ্য। সবসময় হাসছে। যখন হাঁটে মনে হয় সিনেমার হিরো হাঁটছে।
আমার এখন বিশুর কথা মনে পড়ছে। এই অঙ্ক সাতটা কষতে তার বড়োজোর পনেরো মিনিট সময় লাগত। মুক্তোর মতো হাতের লেখা। তেমনই তার জেনারেল নলেজ। ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে ওঠে। বিশু যখন ছোটো ছিল তখনই তার বাবা মারা গিয়েছিলেন। এখানে মামার বাড়িতে মানুষ হচ্ছে। মামারা ভীষণ ভালো। চারটেয় উঠে বিশু তার বড়োমামায় সঙ্গে ব্যায়াম করতে যায়। ফিরে এসে স্নান করে আদা-ছোলা খেয়ে পড়তে বসে। বিশু আমার খুব বন্ধু। ফার্স্ট হয় বলে এতটুকু অহঙ্কার নেই। বরং সেকেণ্ড বয় পার্থর সাঙ্ঘাতিক ডাঁট। কারো সঙ্গে বিশেষ কথা বলে না। এই বয়সেই চোখে চশমা। কথা যা বলে তাও ইংরেজিতে। একটা ইংরেজি প্রায়ই বলে, ‘প্রব্যাবলি’। সবেতেই প্রব্যাবলি। আমরা তাকে প্রব্যাবলি বলে ডাকি। আরও রেগে যায়। বলে, ‘আনকালচারড’। বিশুকে ধরার চেষ্টা করে। শুনেছি দিনে-রাতে বারো ঘণ্টা পড়ে। যতই চেষ্টা করুক বিশুকে মারতে পারে না। পার্থর বাবা বিলেতে থাকেন।
বিশু আমাকে বলে, ‘কী নিয়ে ডাঁট দেখাব বল? আমার কে আছে? কী আছে? মা প্রায় অন্ধ। মামার বাড়িতে পড়ে আছি। যেভাবেই হোক আমাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। কোনোরকমে পড়া শেষ করে একটা চাকরি জোগাড় করতে না পারলে আমার চলবে না। আমারা মাকে আমি যতদিন না সোনার সিংহাসনে বসাতে পারছি ততদিন আমার শান্তি নেই। মামার বাড়িতে মা যেন এক রাঁধুনি। আমার মায়ের যা কষ্ট! পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে আমি দেখিয়ে দিতে চাই, বিশু কী না করতে পারে তার মায়ের জন্যে।’
মায়ের কথা বলতে-বলতে বিশু যেন কীরকম হয়ে যেত। তাকে আরও বড়ো দেখাত। আরও যেন শক্তিমান। যেন একটা লোহার মূর্তি। দু-হাতে জাপটে ধরে পৃথিবীটাকে চুরমার করে দেবে। মাথাটা যেন আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। বিশু তো অনেক কিছু পড়ে। আমাকে একটা গল্প বলেছিল। শঙ্করাচার্য কী করেছিলেন মায়ের জন্য। শঙ্কর তো কেরলের কালাভিতে জন্মেছিলেন শিবঠাকুরের দয়ায়। আর যখন মাত্র তিন বছর বয়েস তখন মারা গেলেন তাঁর বাবা। কে আর রইল সংসারে! মা ছাড়া কেউ নেই। বাড়ি থেকে অনেক দূরে আলোয়াই নদী। সেই নদীতে রোজ তাঁর মা স্নান করতে যেতেন। হেঁটে হেঁটে। সে কী কম দূর। স্নান করে রোজ ফিরে আসতেন বারোটা-একটার মধ্যেই। একদিন হল কী, অনেক বেলা হয়ে গেল, তবু মা ফিরছেন না। মহা ভাবনা হল শঙ্করের। মায়ের খোঁজে চললেন, নদীর দিকে। প্রচন্ড রোদ চারপাশে যেন আগুন লেগে গেছে। কিছুটা দূর যাবার পর শঙ্কর দেখেন কি, রাস্তার একপাশে তাঁর মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। মায়ের অবস্থা দেখে শঙ্কর কেঁদে ফেললেন। ভগবানকে বললেন, ঈশ্বর, আপনি আমার মায়ের, আমার এই দুঃখিনী মায়ের কষ্ট দেখতে পান না! আপনার তো অসীম ক্ষমতা, দিন না মায়ের প্রিয় ওই আলোয়াই নদীকে আমাদের বাড়ির কাছাকাছি। তাহলে আর আমার মায়ের এত কষ্ট হয় না। ও মা! ঈশ্বরের কী অসীম করুণা! কয়েক দিনের মধ্যেই পালটে গেল নদীর গতিপথ। আলোয়াই নদী চলে এল শঙ্করের বাড়ির দোরগোড়ায়।
একটু আগে আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল। মাথাটা ঢুলেঢুলে সামনে পড়ে যাচ্ছিল। বাবা রাগ করে উঠে যাবার পর আমার চোখ বড়ো-বড়ো হয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছে আমি আর এ-বাড়ির কেউ নয়। আমার বাবা, আমার জ্যাঠামশাই, আমাদের বংশের সবাই ভীষণ শিক্ষিত। আমার বাবা তো সব পরীক্ষায় প্রথম হতে-হতে স্কলারশিপ পেতে-পেতে আজ এক মস্ত মানুষ। বিরাট চাকরি করেন। কত বড়ো একটা লাইব্রেরি করেছেন। সবসময় বই পড়েন। আমার বাবা খুব সুন্দর বেহালা বাজান। খাতা-পেনসিল ছাড়াই অঙ্ক কষেন মুখে-মুখে। লোকে কী বলবে, আমি তো নিজেই বুঝতে পারি, অমন বাবার এমন ছেলে হতেই পারে না। আমার মরে যাওয়াই উচিত। বাবার সঙ্গে যখন বেড়াতে বেরোই তখন আমি একটু দূরে দূরে হাঁটি। আমার মনে হয়, পাশে-পাশে হাঁটলে বাবার লজ্জা করবে। বাবার পাশে বিশুকেই মানায়।
আজ আমাদের বাড়িতে খুব ভালোমন্দ রান্না হয়েছে। এখনও হচ্ছে। ভারি সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে। অন্য দিন হলে রান্নাঘরে গিয়ে একটু চেখে আসতুম। আজ আমার রাতের খাবার খেতেও লজ্জা করবে। অপদার্থ আমি। কেউ না বললেও আমি শুনতে পাই, সবাই যেন মনে মনে বলছে, লেখাপড়ায় খাজা, আবার গন্ডেপিন্ডে গিলছে। গেলা ছাড়া আর কী জানে! যেদিন আমার জন্যে বাবা খুব কষ্ট পান, সেদিন আর তিনি কিছুই খান না। সোজা নিজের ঘরে গিয়ে নিজের লেখাপড়া শুরু করে দেন। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘কেউ তো কিছু করলে না, নিজেই করে যাই। কত কী পড়ার আছে, কত কী জানার আছে!’ টেবিল আলোর সামনে খোলা বই, দু-পাশে বইয়ের পাহাড়। ক্রমশই তিনি তলিয়ে যেতে লাগলেন অন্য জগতে। অঙ্ক, জ্যোতির্বিদ্যা, ইংরেজি সাহিত্য। রাত চলেছে। পড়া চলেছে। ওদিকে খাবার ঘরে সবাই নীরবে বসে থেকে থেকে, একসময় সব চাপাচুপি দিয়ে চলে আসে। রান্না হল, খাওয়া হল না। আমার জন্যে সকলের উপোস।
মাথা নীচু করে খাতায় পেনসিলের আঁকিবুকি কাটছি আর ভাবছি। সামনে তিন সার অঙ্ক। বাবার অনেক চেষ্টা আমাকে বোঝাবার। মাথার পেছনে একটা হাত এসে পড়ল। আলতো একটা হাত। মুখ তুলে তাকালুম। আমার জ্যাঠামশাই ভীষণ ভালোবাসেন আমাকে। আমার দুঃখ হলে তাঁরও দুঃখ হয়। আমার আনন্দে তাঁর আনন্দ। জ্যাঠামশাইয়ের দু-চোখে জল। ধরা-ধরা গলায় বললেন, ‘একটু মন দিয়ে পড়ো না বাপি। কেন পারবে না। নিশ্চয় পারবে। একটা রোখ করো।’
আমার চোখেও জল এসে গেল। টপটপ করে চাঁর-পাঁচ ফোঁটা জল পড়ল খাতার পাতায়। কোঁচার খোঁট দিয়ে চোখের জল মোছাতে-মোছাতে জ্যাঠামশাই বললেন, ‘আমাদের বংশ হল লেখাপড়ার বংশ। সেই বংশের ছেলে তুমি। কেন তোমার হবে না। তোমার মনে না-টা ঢুকে গেছে। তাড়াও ওটাকে। ভয় তাড়াও।’
যা ভেবেছিলুম তাই। রাতে কারো খাওয়া হল না। বাবা কথা বন্ধ করে দিয়েছেন। দেখি মা-ও কথা বলছেন না। বাবা কেবল বলেন, ‘তোমার ছেলে। তোমার ছেলে।’ বিশুর সঙ্গে তুলনা করেন। মায়ের তো অপমান হয়। আমার জন্যেই হয়। শুয়ে আছি, ঘুম আর আসেই না। চিন্তায়-চিন্তায় মাথার ভেতরটা জবরজং হয়ে আছে। কাউকে কিছু না বলে আমি নিরুদ্দেশে চলে যাব। কত ছেলেই তো যায়। আমি বোকা হতে পারি; কিন্তু বদমাশ তো নই। আমার কাছে কিছু জমানো টাকা আছে। সেই টাকায় এমন একটা জায়গায় চলে যাব, যেখানে নদী আছে, আশ্রম আছে। সেই আশ্রমে বড়ো একজন সাধু থাকবেন। মুখে মিষ্টি হাসি। চোখে জ্যোতি। আমি বলব, ‘সাধুজি, আমার কেউ নেই।’ না, মিথ্যা কথা বলব না। সব সত্যি কথা বলব। বলে বলব, ‘আমি সন্ন্যাসী হব। আমার ঠাকুর্দা সন্ন্যাসী ছিলেন, আমিও সন্ন্যাসী হব।’ খুব করে ধরলে আমাকে আর ‘না’ বলে তাড়াতে পারবেন না। কানে ভেসে এল বেহালার সুর। বাবা জেগে আছেন। বেহালার করুণ সুর শুনে বুঝতে পারছি বাবা কাঁদছেন। বেহালা দিয়েই বাবা তাঁর মনের অবস্থা সকলকে বুঝিয়ে দেন। নিশ্চয় আমার মা-ও এখনও জেগে আছেন। এখন দরজা খুলে বেরোনো যাবে না। বেহালা ভীষণ কাঁদছে।
সকাল হয়ে গেল। মশারির বাইরে এসে দাঁড়ালেন জ্যাঠামশাই। কত মিষ্টি গলা তাঁর। ‘পিন্টু, ওঠো। ভোর হল। কাল সারা রাত কিছু খাওনি তুমি। মুখ ধোও। আমি গরম জিলিপি আর কচুরি কিনে আনি।’
ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলুম। আজ তো আমার চিরকালের মতো চলে যাওয়ার দিন। আমার আর কোনো কষ্ট নেই, একটাই কষ্ট, আমার এমন সুন্দর জ্যাঠামশাইকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না। সেই কবে, আমি যখন খুব ছোটো, একদিন খবর এল জ্যাঠাইমা মারা গেছেন। জ্যাঠাইমার বাপের বাড়িতেই ঘটনাটা ঘটে গেছে হঠাৎ। সেই থেকে আমার জ্যাঠামশাই একা। ভীষণ একা। আমি মনে-মনে ভাবতুম, বড় হই, তারপর আমি জ্যাঠামশাই একা। ভীষণ একা। আমি মনে-মনে ভাবতুম, বড়ো হই, তারপর আমি জ্যাঠামশাইয়ের সমস্ত দুঃখ দূর করে দেব। জ্যাঠামশাইয়ের কেউ যখন নেই, ছেলে নেই, মেয়ে নেই, আমি তখন আছি। জ্যাঠামশাই সকলকে এখনও বলেন, ‘দেখবে তোমরা, পিন্টু কত বড়ো হবে! বিজ্ঞানী হবে। কত সম্মান পাবে দেশে-বিদেশে। পিন্টুর গাড়ি এসে দাঁড়াবে বাড়ির সামনে। ও অমনি হুশ করে চলে যাবে আমাদের দিকে হাত নাড়তে-নাড়তে। অফিসের গাড়ি নয়, নিজের গাড়ি। আমাদের সঙ্গে ভালো করে কথা বলার সময়ও তখন ওর থাকবে না। কাজ আর কাজ। মিটিং। আজ আমেরিকায় তো কাল লণ্ডনে। আজ ভিয়েনায় তো কাল জার্মানিতে।’
জ্যাঠামশাই যখন বলতেন, তখন একপাশে দাঁড়িয়ে আমি মিটিমিটি হাসতুম। শুনতে আমার ভীষণ ভালো লাগত। মনে হত, না-হয়েই আমি হয়ে গেছি। আমার ফ্রেঞ্চ-কাট একটা দাড়ি হয়েছে। চোখে গোলমতো সোনার ফ্রেমের জ্ঞানী চশমা। মুখটা গম্ভীর আর ভারী। প্রোফেসর পিন্টু। অনেকে আবার জ্যাঠামশাইয়ের সমালোচনা করতেন। বটঠাকুর একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন। বেশি আদরে ছেলেরা বাঁদর হয়ে যায়। জ্যাঠামশাই মাটির মানুষ। তিনি হাসতে-হাসতে বলতেন, ‘ছেলেদের মধ্যে এমনি করেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগাতে হয়।’
জ্যাঠামশাই মশারি তুলে ধরলেন। আমি নেমে পড়লুম ফাঁক দিয়ে। জ্যাঠামশাই আমার চুল ঘেঁটে দিয়ে বললেন, ‘চিয়ার-আপ’। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম তাঁর দিকে। রোজ যে সকাল হয় সেই সকাল। আকাশ-ভাঙা আলো। অজস্র পাখির প্রার্থনা; কিন্তু আমার কাছে একেবারে অন্যরকম মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কাল রাতে আমার ভীষণ জ্বর হয়েছিল। মনে হচ্ছে, কাল রাতে আমাদের বাড়িতে আগুন লেগেছিল। সব পুড়েঝুড়ে গেছে। আমি সেই ছাইয়ের ওপর জেগে উঠেছি। জ্যাঠামশাই আমার পিঠে দু’বার চাপড় মেরে বললেন, ‘হতাশ হবার কী আছে! মনটাকে শক্ত করে লেগে পড়ো, দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।’
ঘরের বাইরে এসেই বাবার মুখোমুখি। তিনি মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন। আমি জানি ঘেন্নায় বাবা আমার মুখের দিকে তাকালেন না। আমি কোনো অন্যায় করলে, কেউ কোনো অন্যায় করলে, বাবা একেবারে অন্যরকম হয়ে যান। তিনদিন, চারদিন একেবারে না খেয়ে থাকেন। যার জন্য তিনি এইরকম করেন, তাকে অন্য সকলে যা-তা বলতে থাকে। যেমন একটু পরেই মা আমাকে বলবেন, ‘একটু বুদ্ধি খাটিয়ে পড়লেই তো হয়। লেখাপড়া না করলে বড়ো হয়ে তো ভিক্ষে করতে হবে।’ আমার পিসিমা নাকের ডগায় চশমা নামিয়ে বলবেন, ‘তোর জন্যে এইবার মানুষটা না খেয়ে মরবে।’ এমনকী, আমাদের বাড়িতে যে কাজ করে, সেই মহিলাও বলবে, ‘রোজ-রোজ পড়া নিয়ে তোমার এই খ্যাচামেচি ভালোও লাগে বাপু! পড়বে তো পড়ো, না পড়বে তো ছেড়ে দিয়ে কলেকারখানায় কাজ শেখো না! বাড়িতে একটু শান্তি আসুক।’ যাঁরা বেড়াতে আসবেন তাঁরাও বলবেন, ‘পড়াশোনা কি সকলের হয়! বাপ শিক্ষিত হলেই কি আর ছেলে শিক্ষিত হয়।’ চিমটিকাটা কথা। কথার লঙ্কাবাটা। সব আমাকে সহ্য করতে হবে মুখে বুজে। কেউ আবার বলবেন, ‘এই বয়েসটা তো আবার ভালো নয়। গেঁজে যাবার বয়েস।’
বাথরুমের কল দিয়ে জল পড়ছে বালতিতে আর আমি শুনছি ঝরনার শব্দ। পাহাড় বেয়ে ঝরনা নেমে আসছে। অনেকটা উঁচুতে সাদা একটা মন্দির। আশ্রম। গেরুয়া-পরা এক সন্ন্যাসী। তিনি যেন আমাকে ডাকছেন, ‘আয়, আয়, চলে আয়। এখানে কত শান্তি! অঙ্ক নেই, ভূগোল নেই, ইতিহাস নেই, সমাজ-বিজ্ঞান, জীবন-বিজ্ঞান নেই। পরীক্ষা নেই। পাশ-ফেল নেই। কারো সঙ্গে কারও তুলনা নেই। এখানে পাহাড়ের মাথায় সাদা সাদা বরফ জমে। সেই বরফ গলে ঝরনা হয়। ঝরনা থেকে নদী। বসন্তে চারপাশে ফুলে-ফুলে ভরে যায়। তুই চলে যা।
দৃশ্যটা এত স্পষ্ট হল যে, আমার মনে হচ্ছে সত্যিই আমি চলে গেছি সেখানে। না, আমি যাব। আমি যাবই। আমাকে জ্যাঠামশাই ছাড়া কেউ ভালোবাসেন না। সবাই ঘেন্না করেন। এ-বাড়িতে আর সকলের ভালোবাসা পেতে হলে পরীক্ষায় ফার্স্ট সেকেন্ড হতে হবে। এক-শোর মধ্যে এক-শো পেলেই ভালো হয়। বড়োজোর নিরানব্বই। আমি পারব না। আমার মাথা ভালো নয়। কোথা দিয়ে কী হয় আমি বুঝতে পারি না। অঙ্ক ভীষণ প্যাঁচোয়া। আমার কিছুই তেমন মনে থাকে না। কে কবে রাজা হল, কোন দেশ কবে স্বাধীন হল, আমার জানার কোনো দরকার নেই। আমি জানি, আমাদের এই জায়গাটার নাম ষষ্ঠীতলা। পশ্চিম দিকে দু-মিনিট হাঁটলেই গঙ্গা। গঙ্গা আসছে সেই কোনো দূর গোমুখ থেকে। সেখানে পাহাড়ে আকাশে কোলাকুলি। ঋষির আশ্রম। নদীর শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আমাদের গঙ্গা সেই পাহাড়ের খবর নিয়েই বহে চলেছে সমুদ্রের দিকে। কত তীর্থের ফুল ভেসে আসতে চায়। কাশী, প্রয়োগ, হরিদ্বার। গঙ্গার ধারে-ধারে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই আমাদের মহাশ্মশান। যেখানে আমি মাঝে মাঝে যাই মানুষের চলে যাওয়া দেখতে। ছেলে-বুড়ো, স্ত্রী-পুরুষ কে যে কখন যাবে কোনোই ঠিক নেই। বলে, ‘ডাক এসেছে আমার সে-দেশ থেকে।’ সেই দেশের কথা আমার কোনো বইয়ে লেখা নেই। কিন্তু ডাক আসে। যে যায় তার জন্যে সবাই কাঁদে, কারণ এই যাওয়া একেবারেই যাওয়া, সে আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। যত, যতই কাঁদো, সে আর আসবে না। এই যে আমার বন্ধু সত্য চলে গেছে, এক বছর, দু-বছর, তিন বছর, আজ চার বছর হল। সত্য জন্মদিনে একটা বই আর একটা কলম দিয়েছিল আমাকে। আমি দেখি আর ভাবি, কোথায় সত্য আর কোথায় আমি! কিলোমিটারে এ-দূরত্ব মাপা যাবে না।
আমার এই জায়গাটাই আমার স্বর্গ। পুরোনো কালীবাড়িতে সন্ধ্যেবেলা আরতি হয়। কোথা থেকে ছুটে আসে কুচকুচে কালো রঙের দুটো কুকুর। কুকুর দুটো সমানে শাঁখের সুরে ডাকতে থাকে। পাগলা-ভোলা ডাইনে-বাঁয়ে দুলিয়ে-দুলিয়ে ঘড়ি বাজায়। বৃদ্ধ শ্যামবাবু নেচে-নেচে ঘণ্টার দড়ি টানতে থাকেন। শিববাবু টকটকে লালকাপড় পরে মায়ের সামনে থেবড়ে বসে উদাত্ত চিৎকার তোলেন, ‘মা, মা, জগদম্বা।’ জগদম্বা বলার সঙ্গেসঙ্গে থামের খাঁজে খাঁজে ঘুমিয়ে-থাকা পায়রারা চমকে উঠে ডানা ঝাপটাতে থাকে। দুঃখী-দুঃখী চেহারার সন্ধ্যার মা একপাশে বসে থাকেন মায়ের দিকে তাকিয়ে। দু-চোখে জলের ধারা। আমি একপাশে দাঁড়িয়ে এইসব দেখি। পাথরের দালান। প্রাচীন ঝাড়বাতি। শিবের ঘর। সামনের মাঠে হাড়িকাঠ। রাতের অন্ধকারে হাড়িকাঠাটাকে দেখলে ভয় করে। লোটা-লোটা কান কত কচি-ছাগলের জীবন নিয়েছে এই কাঠ। পঞ্চপ্রদীপের শিখা মায়ের কালো বুকের সামনে নেচে ওঠে। আরতি শেষ হবার পর যখন নিস্তব্ধতা নেমে আসে, ঠ্যাং করে ঘণ্টা বাজিয়ে শেষ ভক্তটি উঠে চলে যান, তখন আমার যেন আরও ভালো লাগে। ফুল, বেলপাতা, ধূপের গন্ধ। আতর-মেশানো চরণামৃত। মায়ের কালো মুখ। লাল লকলকে জিভ। হাসি-হাসি চোখ। কেউ নেই। আমি আর মা। ধপধপে, মোটাসোটা চেহারার পুজারী একপাশে বসে সব গোছগাছ করছেন। এ মা কোনোদিনও বলবেন না, ‘পিন্টু, তুই একটা কুলাঙ্গার। বসে বসে বাপের অন্ন ধ্বংস করছিস।’ কত দিন মনে হয়েছে, আমি যদি ওই পূজারী হতে পারতুম। ভারী গম্ভীর গলা। সংস্কৃতে যখন মন্ত্র বলেন তখন মনে হয়, পাথরে-পাথরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মন্দিরের লাগোয়া ছোট্ট একটা ঘরে থাকেন। নিজে রেঁধে খান। কারো সঙ্গে বেশি কথা বলেন না। নকশাল আমলে ছেলেরা মন্দির ভাঙতে এসেছিল। মায়ের হাতের খাঁড়াটা নিজের হাতে নিয়ে মন্দিরের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘ক্ষমতা থাকে আগে আমাকে মারো, তারপর মায়ের গায়ে হাত।’ খাঁড়া হাতে শুরু করলেন চন্ডীপাঠ। সবাই মাথা নীচু করে ফিরে গেল। অবিশ্বাসীরা বললেন, ‘আহা! এতে আর মায়ের মাহাত্ম্য কী হল! ছেলেরা দয়া করে ছেড়ে দিল।’
ছোট্ট একটা তেলেভাজার দোকান আছে আমাদের পাড়ায়। ভাই-বোনে দোকান চালায়। আমার মনে হয়, ঈশ্বর যদি আমার সব কেড়ে নেন নিন, আমাকে ওইরকম একটা বোন দিন। আমিও একটা তেলেভাজার দোকান দেব। বিরাট কড়ায় ফুটন্ত তেলে হাবুডুবু খাবে গোল-গোল ফুলুরি। আমার বোন গামলায় বেসন ফেটাবে। চুড়ির আওয়াজ উঠবে রিনঠিন, দোকানের সামনে লাইন পড়ে যাবে। আমি মাঝে মাঝে দোকানটায় যাই। চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকি একপাশে। মনে হয় যন্ত্রসংগীত হচ্ছে। সেতার আর তবলা! কী সুন্দর বোঝাপড়া দু-জনে। এখানে অঙ্ক যা আছে খুবই সহজ। লেখাপড়া নেই, আছে বোঝাপড়া।
গঙ্গার ধারে সার-সার বাগানবাড়ি। বিশাল-বিশাট গেট তালাবদ্ধ। কেউ কোথাও নেই। লম্বা-লম্বা দেবদারু গাছ। বাতাসের দীর্ঘশ্বাস পাতায় পাতায়। ওই বাড়িগুলো আমার ভীষণ প্রিয়। একা-একা ঘুরে বেড়াই। হাঁ করে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখি। ভাবি, কত কী হত এখানে! কত লোক, কত আলো, কত গান, কত কথা, কত খাওয়া! সব কোথায় গেল!
আমার এই সুন্দর জগৎ ছেড়ে আমি কোথায় যাব! তবু আমাকে যেতেই হবে। আর না! এদের আমি কেউ নই। আমি আই. এ. এস. হতে পারব না, কারণ আমার অঙ্কে মাথা নেই। আমি একটা গবেট। বাংলাটা মোটামুটি ভালোই লিখতে পারি। স্কুলে আমার বাংলার মাস্টারমশাইয়ের অন্তত সেইরকমই ধারণা। তা বাংলায় ভালো হয়ে আমার হবেটা কী? বাংলায় অধ্যাপক হব কোনো কলেজে! অত সোজা নয়! আমার বলতে গেলে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। বেকার হয়ে ঘরে বসে থাকা ছাড়া। ধুৎ, আমি চলেই যাই। কত ছেলেই তো হারিয়ে যায়!
জ্যাঠামশাই ছাদে ওঠার সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আমাকে ইশারায় ডাকলেন। ফিসফিস করে বললেন, ‘পিন্টু, সোজা ছাতে চলে যাও। ছাতের ঘরে তোমার জন্যে খাবার চাপা দিয়ে রেখে এসেছি। চট করে খেয়ে নেমে এসো। আজ আমি তোমাকে পড়াব।’
‘ছাতে গিয়ে খাব কেন জ্যাঠামশাই?’
‘আমরা তো কেউ খাচ্ছি না। তোমাকে খেতে দেখলে কেউ আবার যদি কিছু বলে বসে! বলা তো যায় না।’ আর ঠিক সেই সময় ওপাশের ঘরে বাবা মাকে বেশ জোরে জোরেই বলছেন, ‘পন্ডশ্রম করে লাভ নেই। ওকে দিয়ে যতটা পারো বাড়ির কাজকর্মই করাও। দোকান-বাজার, ঘর ঝাঁট, গম ভাঙানো, রেশন আনা, ইলেকট্রিক বিল জমা দেওয়া।’
মা বলছেন, ‘কী বলছ তুমি? রেগে গেলে তোমার যা মুখে আসে তাই বল। আমাদের ওই একটিমাত্র ছেলে, মানুষ হবে না?’
‘অনেক অনেক চেষ্টা হয়েছে। যা হবার নয়, তা হবার নয়। যতদিন না কোনো কলে-কারখানায় ঢোকাতে পারছি, ততদিন ওকে সংসারের কাজে লাগাও। গবেট, ডানস। গোঁফ দেখে যেমন শিকারি বেড়াল চেনা যায়, মুখ দেখে তেমনই ছেলে চেনা যায়। ওর মুখটা দেখছ, যেন হাবলা-গোবলা একটা শিশু। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। গাছের পাতা দেখছে, কাক দেখছে। আকাশের মেঘ দেখছে। চোখ দেখলেই বোঝা যায়, ভেতরে কিছু নেই। হস্তিমূর্খ।’
‘কী বলছ তুমি? ও এখনও শিশুর মতো সরল। ওর ভেতরে একটা কবি আছে।’
‘তা হলে সারাজীবন তোমার আঁচলের তলায় রেখে দাও। বড়দার কোনো ছেলে-মেয়ে নেই। বংশে ওই একটিমাত্র ছেলে। সে কী করবে? না কবিতা লিখবে! আহা! কী উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ!’
জ্যাঠামশাই আমাকে ঠেলে ছাতে পাঠিয়ে দিলেন। খোলা ছাতে এসে মনে হল, মানুষের পৃথিবীতে কেবল স্বার্থ। কিছু একটা কেউকেটা হতে পারলেই খাতির। হয় বিদ্যা, না হয় অর্থ! আমাদের পাড়ায় মিষ্টির দোকানের মালিকের কী খাতির! কারণ তাঁর সাতটা দোকান, দুটো বিশাল বাড়ি, তিনটে গাড়ি। তিনি তো কারও সঙ্গে ভালো করে কথাই বলতে চান না। আমার বাবার মতো পন্ডিত মানুষকেও নাম ধরে ডাকেন। তাঁর প্রাণের বন্ধু হলেন কন্ট্রাকটর যদু মল্লিক। তাঁরও সমান সমান পয়সা। তা এ-বাড়িও তো স্বার্থপর। অহঙ্কারী। অঙ্কে এক-শো পেলে খুব খাতির। তিরিশ পেলে অপদার্থ। চাকর-বাকর।
খাস্তা কচুরি আর জিলিপি দুটোই আমার খুব প্রিয়। প্রচন্ড খিদে। জিভে জল এসে গেছে। কিন্তু আমি খাব না। আমার খাবার অধিকার নেই। এসব বড়লোকের খাদ্য। এসব খেতে হলে মানুষকে অনেক টাকা রোজগার করতে হয়। অনেক টাকা রোজগার করতে হলে লেখাপড়ায় ভীষণ ভালো হতে হয়, বা বিশাল বড়ো ব্যবসায়ী হতে হয়। জ্যাঠামশাই কত ভালবেসে নিজে গিয়ে কিনে এনেছেন। ছুড়ে পাশের মাঠে ফেলে দিতেও প্রাণ চাইছে না। কী করা যায় ভাবছি, এমন সময় জ্যাঠামশাই ছাতে উঠে এলেন। পরিষ্কার শুভ্র এক মানুষ, পায়ে ভেলভেটের চটি। উলটে আঁচড়ানো কাঁচাপাকা চুল। ভগবানের মতো সুন্দর মুখ। জ্যাঠামশাই বললেন, ‘আমি জানতুম তুমি খাবে না। বাপ-মায়ের কথায় অভিমান করতে আছে?’
খাওয়া তুলে, শরীর তুলে, ঘুম কী চান তুলে কথা বললে আমার ভীষণ খারাপ লাগে। আমি তো লেখাপড়ায় ভালো হবার কত চেষ্টা করছি! প্রাণপণ চেষ্টা। রাতে সামান্য একটু ঘুমোই, তাও যদি সব বলে, খাচ্ছে-দাচ্ছে পড়ে-পড়ে ঘুমোচ্ছে আর মোষের মতো শরীর বাগাচ্ছে তা হলে কেমন লাগে!
জ্যাঠামশাই জোর করে আমার মুখে একটা কচুরি ঢুকিয়ে দিলেন। আমার চোখে জল এসে গেল। জ্যাঠামশাই বললেন, ‘আমার বাবা তো আমাকে উঠতে-বসতে গালাগাল দিতেন। ভাইটা তো লেখাপড়ায় ভীষণ ভালো ছিল। কোনো পরীক্ষায় সেকেন্ড হত না। তার ফলে আমার গঞ্জনা আরও বেড়ে যেত। আমি ছিলুম ঠিক তোমার মতো। অনেকটা বয়স পর্যন্ত শিশুর মতো। পেকে ঝানু হতে আমার যে কত বছর লেগেছিল! আজও ঠিক-ঠিক হতে পারিনি। আমার অত উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নেই। হেসেখেলে দিনগুলো কাটিয়ে দিতে পারলেই হল। এই একটু গান শুনলুম, আপন মনে বাথরুমে একটু নেচে নিলুম, যখন যা জুটল খেয়ে নিলুম। কী আছে বাবা! এ তো দো দিনকা মেলা! আজ হিঁয়া তো কাল হুঁয়া।’
জ্যাঠামশাই হাত তুললেন আকাশের দিকে।
আমি বললুম, ‘আপনি কিন্তু এম. এ.-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট পেয়েছিলেন।’
‘আহা, সে সাবজেক্টটা আবার কী দেখো। ফিলজফি। মেয়েদের সাবজেক্ট।’
‘আপনি ম্যাট্রিকে ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পেয়েছিলেন।’
‘সে পেতে পারি। তা বলে তো তোমার বাবার মতো ফার্স্ট হতে পারিনি। খবরের কাগজে ছবিও ছাপা হয়নি।’ জ্যাঠামশাই কোঁচার খুঁট দিয়ে আমার চোখের জল মুছিয়ে দিলেন। আমি তাঁকে প্রণাম করলুম।
‘হঠাৎ প্রণাম!’
‘এমনি, ইচ্ছে হল তাই।’
ছাতের আলসেতে গোটাকতক লোভী কাক এসে বসেছে। জ্যাঠামশাই একটা কচুরি ভেঙে ছড়িয়ে দিলেন চারপাশে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাক কি জিলিপি খায়?’ তারপর নিজেই বললেন, ‘খাবে না কেন? কাক হল সর্বভুক।’ একটা জিলিপি টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিলেন। কাকগুলোর কী আনন্দ! আমি কী যে খাচ্ছি বুঝতেই পারছি না। জ্যাঠামশাই পাছে কিছু মনে করেন তাই গিলে যাচ্ছি।
ঠোঙাটা জঞ্জালের গাদায় ফেলে দিয়ে জ্যাঠামশাই বললেন, ‘চলো, এবার আমরা দু-জনে কোমর বেঁধে লেগে যাই। তোমার বাবাকে বলে দেব, এবার থেকে আমি পড়াব। দেখি কিছু হয় কি না!’
জ্যাঠামশাই নীচে নেমে এসে সকলকে শুনিয়ে-শুনিয়ে বললেন, ‘আমরা পড়তে বসছি। আমাদের কেউ কোনো ডিস্টার্ব করবে না।’
সবাই এপাশ দিয়ে, ওপাশ দিয়ে যাওয়া-আসা করছে, আমাদের কথায় খুব একটা কান দিল বলে মনে হল না। জ্যাঠামশাই এত ভালো মানুষ যে, তাঁর থাকা, না-থাকা প্রায় একই কথা। কেউ সম্মান করে না, আবার অসম্মানও করে না। জ্যাঠামশাইয়ের জন্য আমার ভীষণ দুঃখ হয়। আমার জ্যাঠাইমা ছিলেন দেবীর মতো। মা-দুর্গার মতো। আমার জ্যাঠামশাইকে বাবা ভীষণ সম্মান করতেন। তিনি চলে গিয়ে আমার সব চলে গেছে। বাড়িটায় আর কোনো সুখ নেই।
পড়ার টেবিলে বসে জ্যাঠামশাই অঙ্কের ওপর একটা বক্তৃতা দিলেন। অঙ্ক কাকে বলে? ‘শোনো, অঙ্ককে আগে ভেঙে নিতে হয়। অঙ্ক হল শত্রু। একটু দূর থেকে দেখে নিতে হয় শত্রু-সমাবেশ। কে কোথায় কীভাবে আছে! তারপর আক্রমণ করো পেনসিল নিয়ে। কচ-কচ করে কেটে ফেলো যত রহস্য, যত ধাঁধাঁ। অঙ্ক এক ছদ্মবেশী শয়তান। গোঁফ, দাড়ি, ও পরচুল-পরা এক অভিনেতা। সব টেনে টেনে খুলে ফেলো দেখবে সহজ সরল, সেই দুই আর দুইয়ে চার। শত্রু না ভাবলে কাউকে আক্রমণ করা যায় না। বন্ধু ভেবেছ কি মরেছ। নাও, প্রথম অঙ্কটা শুরু করো।’
জ্যাঠামশাই দর্শনে সুপন্ডিত। কুটকচালে অঙ্ক তাঁর পক্ষে সামলানো কী সহজ! এদিক থেকে ওদিক থেকে নানা দিক থেকে তিনি অঙ্কটাকে আক্রমণ করলেন। তিনটে পাতা সংখ্যায় সংখ্যায় ভরে গেল। কিম্ভূতকিমাকার সব উত্তর বেরোলো। শেষে খুব করুণ মুখে বললেন, ‘অনেকদিন চর্চা নেই তো, সবই প্রায় ভুলে গেছি। তোমার জন্যে আবার সব ঝালাতে হবে। এসো, আমরা আর্টস সাবজেক্ট পড়ি।’
আমাদের ঘরের সামনে দিয়ে বাবা গটগট করে হেঁটে গেলেন। ফিরেও তাকালেন না। মনে-মনে বললুম, একবার দেখে গেলে পারতেন। আর হয়তো দেখা হবে না কোনোদিন। সঙ্গেসঙ্গে আমার চোখে জল এসে গেল। মন ধমকে উঠল। এত মন খারাপ হলে কেউ সন্ন্যাসী হতে পারে না। সন্ন্যাসীদের মন হওয়া উচিত ইস্পাতের মতো।
জ্যাঠামশাই দশটা নাগাদ বেরিয়ে গেলেন। এইবার আমার খেলা। আমার টিনের সুটকেসে পঞ্চাশটা টাকা জমেছে। অনেকদিন ধরে একটু একটু করে জমিয়েছি। আমি একটু কৃপণমতো আছি। সহজে খরচ করি না। টাকাটা আজ আমার কাজে লেগে যাবে। সঙ্গে আর-কিছু নেওয়া যাবে না। নিলেই সব সন্দেহ করবে। বড়ো-বড়ো সন্ন্যাসী যাঁরা সন্ন্যাসী হয়েছেন, তাঁরা সব একবস্ত্রেই গৃহত্যাগ করেছেন। এ তো আর চেঞ্জে যাওয়া নয়।
ভালো করে চান করলুম। বাথরুমটাকে ভালো করে দেখে নিলুম। আর তো দেখতে পাব না। এই জায়গাটা সারাবাড়ির মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয়। ঠাণ্ডা। শান্ত। বসে বসে অনেক কিছু ভাবা যায়। বাথরুম থেকে বেরিয়ে মোটামুটি পরিষ্কার একটা জামা আর ট্রাউজার পরলুম। বেশি সাজগোজ চলবে না। আমি তো আর বিয়ে-বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে যাচ্ছি না! আজ সবচেয়ে বড়ো সুবিধে আমাকে সবাই বয়কট করেছে। আরও সুবিধে আজকের কাগজে খবর আছে, বিশু নেহরু প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় সারা ভারতের মধ্যে প্রথম হয়ে রাশিয়া যাচ্ছে। সেই নিয়ে বিশুর গুণগানে বাড়ি একেবারে ফেটে যাচ্ছে। সব কথারই শেষ কথা বিশুকে দ্যাখো আর আমাদের অপদার্থটাকে দ্যাখো।
ঠাকুরের ছবিতে প্রণাম করলুম। আমার জ্যাঠাইমার বড়ো ছবিটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম অনেকক্ষণ। জ্যাঠাইমাই আমাকে পথ দেখাবেন। যেদিক দিয়েই হোক বড়ো আমাকে হতেই হবে। এমন বড়ো যে খবরের কাগজে ছবি বেরোবে। মানুষ আমাকে মনে রাখবে মৃত্যুর পরেও। জন্মদিন পালন করবে। আড়াল থেকে মাকে একবার দেখে নিলুম। আমার মা-টা মানুষ হিসেবে ভীষণ ভাল, তবে নিজের কোনও মত নেই। তার সবেতেই ভীষণ চিৎকার করেন। সারাটা দিন হইহই করছেন, করছেন তো করছেনই। আমার মা-টার মনে কোনো প্যাঁচ নেই। নাচালেই নাচেন। মুখ আলগা, দিল খোলা। সবাই তাই বলে। মা দেখি একপাশে বসে চুলের জট ছাড়াচ্ছেন আর আমাদের বাড়িতে যে কাজ করে তার সঙ্গে বকবক করছেন। আমি মনে মনে মাকে বললুম, মা, বিদায়। আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না মা। তোমার জন্যেই আমার মনটা খারাপ হবে। আমাকে যতই তুমি গালাগাল দাও, তুমি আমাকে ভালোবাসো। কাল অনেক রাতে তুমি যখন মশারি তুলে আমার মাথায় হাত রাখলে, তখন তুমি ভেবেছিলে আমি ঘুমোচ্ছি। আমি কিন্তু জেগেছিলুম। তুমি আঙুল দিয়ে আমার চোখের দুটো কোল দেখলে, আমি কেঁদেছি কি না! আমি আর বাইরে কাঁদি না, কাঁদি ভেতরে। আমি যে বড়ো হচ্ছি মা। ঠোঁটের ওপর গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে। আমি শুনছিলুম, তুমি বলছ, কেন বাবা, একটু ভাল করে লেখাপড়া করিস না। তুই যে আমাদের বংশের একমাত্র বাতি! জানি মা, কিন্তু কী করব বল? মানুষের মতো দেখতে হলেও আমি একটা গাধা। তবে তোমাকে আমি বলে যাচ্ছি, ভাল ইঞ্জিনিয়ার হতে না পারি, ভাল সন্ন্যাসী আমি হবই। আসি মা।
চোখ দুটো অল্প অল্প জ্বালা করছে। একটু, খুব একটু জল এসেছে। আসুকগে! মন দুর্বল হলে চলবে না। আমি পুরুষ, আমাকে লড়াই করে বাঁচতে হবে। কেমন? দরজার পাশে থুপ্পি মেরে বসে ছিল আমার গেরুয়া রঙের বেড়ালটা। এই বাড়িতে ওকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। পুষিও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। সে ভালোবাসার কোনও তুলনা হয় না। মনখারাপ করে বসে থাকলে ও এসে আমার গায়ে মোটা চামরের মতো লেজটা বোলাতে থাকে। ঘড়ঘড় করে। গায়ে গা ঘষে। শেষে কোলে উঠে শুয়ে পড়ে।
বেড়ালটাকে পাশ কাটিয়ে আমাদের লোহার গেটটা খুলে বেরিয়ে এলুম রাস্তায়। মনে মনে বললুম, বাড়ি, তুমি রইলে। তুমি থাকো। অনেক-অনেক দিন থাকো। আমি যখন বড়ো হব, আরও বড়ো, ধরো, আজ থেকে চোদ্দো বছর পরে, আমি এসে একবার দেখে যাব। জানি না তখন কে থাকবে আর না থাকবে! বাবা, মা, জ্যাঠামশাই। আমার পুষিটা তো থাকবেই না। ছাতের টবের গাছগুলো সব মরে যাবে। মেলা থেকে অনেক পুতুল কিনেছিলুম, সেগুলো ওরা সব অযত্ন করে ফেলে দেবে। আমার পড়ার বই, গল্পের বই, খাতা, কলম হয়তো কাউকে দিয়ে দেবে। থাকগে, সে যা হয় হবে। বাড়ি তুমি রইলে, আমি চললুম।
ভাই-বোনের তেলেভাজার দোকানের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ালুম। বোনকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। ছিপছিপে পাতলা চেহারা। চাঁপাফুলের মতো গায়ের রং। চোখ দুটো টানাটানা। এই অ্যাত বড়ো-বড়ো চোখের পাতা। মণি দুটো কুচকুচে কালো। হরিণের মতো। ঠোঁট দুটো পাতলা কাগজের মতো। লম্বা, লতানে হাত। মুখে সব সময় একটা হাসি লেগে আছে। হাসার সময় চোখ দুটো ছোটো-ছোটো হয়ে গিয়ে এত সুন্দর দেখায়! মিষ্টি কথা, যেন শিশির ঝরে পড়ছে। আমাকে ভগবান যদি অমন একটা বোন দিতেন আমার আর কোনো দুঃখ থাকত না। আমি সেতার বাজাতুম, সে নাচত। আমার জমানো পয়সায় তাকে আইসক্রিম খাওয়াতুম। ভোরে তার জন্যে তুলে আনতুম চাঁপা ফুল। চাঁদনি রাতে দু-জনে নৌকো করে গঙ্গায় বেড়াতুম। আজ সে একটা নীল ডুরে শাড়ি পরেছে। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে বললে, ‘স্কুলে যাবে না?’
‘যাচ্ছি তো।’
‘বই নিলে না?’
মিথ্যে-মিথ্যে বললুম, ‘আজ আমাদের পরীক্ষা।’
‘বিকেলে আসবে তো! আজ আমরা রোল তৈরি করব।’
‘আসব।’
কী জানি কেন, মনে হল ওকে একটা কিছু দিয়ে গেলে বেশ হয়, কোনো উপহার। আমার কাছে তো কিছু নেই। সামান্য কয়েকটা টাকা আছে। একটা জিনিস আছে, আমার আঙুলে আমার পইতের আংটিটা। যে সন্ন্যাসী হবে, তার আঙুলে আংটি থাকা উচিত নয়। মেয়েটির নাম তৃষা।
আমি এগিয়ে গিয়ে বললুম, খুব আস্তে, ‘তৃষা একবার আসবে। খুব-একটা কথা ছিল তোমার সঙ্গে। এক মিনিট।’
দোকানে তখন ভিড় নেই। তৃষা বেরিয়ে এল। একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললুম, ‘তুমি আমার একটা জিনিস তোমার কাছে রাখবে?’
‘কী জিনিস?’
‘আমার এই আংটিটা।’
‘আংটি? আংটি কেন রাখব! সোনার আংটির কত দাম?’
‘রাখো না তৃষা। আমি ভুলে পরে চলে এসেছি। আর ইচ্ছে করছে না বাড়ি যেতে। তোমার আঙুলে এখন রেখে দাও।’
তৃষা হ্যাঁ-না কিছু বলার আগেই আংটিটা তার সরু চাঁপার কলির মতো আঙুলে ঢুকিয়ে দিয়েই আমি হনহন করে হাঁটা দিলুম। আর কোনও দিকে তাকাতাকি নয়। একটা বাস আসছিল। উঠে পড়লুম। আমার ভেতর বেশ-একটা গতি এসে গেছে। আমি চলার আগেই ভেতরটা চলতে শুরু করেছে। বাসে এদিক-ওদিক কারও দিকে বেশি তাকালুম না। বলা যায় না, চেনাশোনা কারও সঙ্গে যদি হঠাৎ চোখাচোখি হয়ে যায়, অমনি চেপে ধরবেন, ‘তুই এখন কোথায় যাচ্ছিস পিন্টু? তোর স্কুল নেই?’ বাসে যা ভিড়। সবাই গুঁতোগুঁতিতেই ব্যতিব্যস্ত। আমার মতো পুঁচকেটার দিকে কে আর তাকায়! চেনা অনেকই, কিন্তু কে আর কাকে চিনছে এখন! লড়াই চলেছে, লড়াই চলেছে, লড়াই। জায়গার লড়াই। দমকে দমকে কাশির মতো, দমকে দমকে ঝগড়া। কী ঝগড়াই যে করতে পারে মানুষ, কতভাবে! কুকুরকেও হার মানায়! এক বৃদ্ধ আমার পিঠে মোক্ষম একটা গুঁতো মেরে বললেন, ‘এই ছোঁড়া, ভেতরে যা!’ ছোঁড়া বলা, তার সঙ্গে তুই-তোকারি, এমন রাগ হচ্ছিল! তারপরে ভাবলুম, পথে নেমেছি চিরকালের জন্যে, সেই গানটার মতো, পথেই জীবন, পথেই মরণ আমাদের, মাথা গরম করলে চলবে না। সত্যি কথা বলতে কী, নিজেকে এখন বেশ বড়ো-বড়ো লাগছে। বাস অনেকটা দূর চলে এসেছে। এতটা পথ কেবল তৃষার কথাই মনে পড়ছে। মা নয়, বাবা নয়, জ্যাঠামশাই নয়। তৃষা মনে হয় আগের জন্মে আমার কেউ ছিল! আর একটা কথা কি, যারা ঘৃণা করে তাদের দিকে ঘৃণাটাই তেড়ে যায় বাঘের মতো।
ভিড়-থিকথিকে স্টেশন। চারদিকে ঘ্যাচোরম্যাচোর। ফুটকড়াইয়ের মতো মানুষের ছড়াছড়ি। টিকিট কাটার সার সার খুপরি। বেশ চিন্তায় পড়ে গেলুম। কোন ট্রেন, কোথাকার টিকিট! পকেটে মাত্র পঞ্চাশটা টাকা। ঠিক করলুম, তিরিশ টাকার মধ্যে যতদূর যাওয়া যায়, ততদূর যাব। এখন যদি বলি, তিরিশ টাকার টিকিট দিন, সন্দেহ করবেন।
একটা জায়গার নাম লেখা রয়েছে, ‘ধানবাদ’। নামটা শোনা-শোনা। ধানবাদ মানে ধন্যবাদ। কিনে ফেললুম টিকিট। একটু পরেই ট্রেন ছাড়বে। অনেক আগে আমাদের স্কুল থেকে ট্রেনে চাপিয়ে একবার দার্জিলিং বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। তখন কোনও ভয় করেনি। গোটা কামরা জুড়ে আমরা সবাই ছিলুম। সারা রাত গান আর গল্প। এখন আমি একা। এত বড়ো একটা ট্রেন! কামরার পর কামরা। প্রচুর লোক। নানারকমের লোক। হঠাৎ দেখি, আমাদের বাড়ির উলটো দিকের বিধানবাবু হাতে একটা সুটকেস নিয়ে হনহন করে আমার পাশ দিয়ে চলে গেলেন, প্রায় আমাকে ঠেলা মেরে। বুকটা ধক করে উঠল। চিনে ফেললেই মুশকিল। পরে বুঝলুম, মানুষ যখন নিজের ধান্দায় থাকে, তখন কেউ আর কাউকে চিনতে পারে না। বিধানবাবু চলে গেলেন ট্রেনের শেষ কামরাটার দিকে।
আমি একটা আধখালি কামরায় উঠতেই বৃদ্ধমতো এক ভদ্রলোক কাজের লোককে যেভাবে বলে সেইভাবে বললেন, ‘আরে, আরে, এটা ফার্স্ট ক্লাস, এটা ফার্স্ট ক্লাস।’
আমার ভীষণ খারাপ লাগল, ভদ্রলোক জানেন না, আমি বড়ো না হতে পারি, আমার বাবা কত বড়ো। আমি আমার সেই বড়ো-বাবার একমাত্র ছেলে। আমাকে ফার্স্ট ক্লাস চেনাচ্ছেন ভদ্রলোক। বড়লোকরা ভীষণ ছোটোলোক হয়! ভালোভাবেই তো বলতে পারতেন! মানুষের একটু ক্ষমতা আর পয়সা হলেই বিশ্বের সব মানুষকে ভিখিরি মনে করেন। কে জানে কোথাকার কে? কামরায় যে ক-জন রয়েছেন সকলকেই কেমন যেন তে-এঁটের মতো দেখতে। অহঙ্কারে সব মটমট করছে। দাঁড়াও, আমারও দিন আসবে। আসবেই আসবে। তখন আমি গোটা একটা ট্রেন ভাড়া করে ভারত ঘুরতে বেরোব।
একটা দুই লেখা কামরায় উঠে একটু বসার জায়গা পেয়ে গেলুম। আমার পাশে হাসিখুশি চেহারার ভদ্রলোক। বেশ স্বাস্থ্যবান। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। ছোটো করে কাটা একমাথা কোঁকড়া-কোঁকড়া চুল। ঝকঝকে চোখ। ঝকঝকে দাঁত। এইমাত্র যেন ঈশ্বরের বাগান থেকে তুলে আনা হয়েছে। ভদ্রলোক নিজেই সরে গিয়ে আমার হাত টেনে বসালেন গুনগুন করে গান গাইছেন, ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণতলে।’ ভদ্রলোক কেমন যেন একটা আনন্দের মধ্যে রয়েছেন। আমি যতটা সম্ভব ছোটো হয়ে বসলুম।
ট্রেন দুলতে শুরু করেছে। ভদ্রলোকের কাঁধে আমার কাঁধ ঘষে যাচ্ছে। তিনি পকেট থেকে দুটো লজেন্স বের করে একটা আমার হাতে দিলেন, ‘নাও, লজ্জা কোরো না। ট্রেনে লজেন্স খেতে হয় তা না হলেই মন খারাপ লাগে। ট্রেন তো আমাদের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যায়, এই যে চলে যাওয়া এইটাই বুঝলে কিনা ভীষণ দুঃখের।’
তিনি নিজের লজেন্সের কাগজটা খুলছেন আর গুনগুন করছেন, ‘না, যেও না, রজনী এখনও বাকি, বলে রাতজাগা পাখি।’ বসে আছেন জানালার ধারে। পাতলা কাগজটা বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখতে লাগলেন যত দূর দেখা যায়। গলাটা টেনে নিয়ে বললেন, ‘প্রজাপতির মতো কেমন উড়ে গেল!’
আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘না, কাজটা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না।’
আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলুম, কী রে বাবা! ভদ্রলোক আমার ভেতরটা দেখতে পেয়ে গেছেন নাকি। আমি কে? যাচ্ছি কোথায়? দম বন্ধ করে বসে আছি। ট্রেনটা ঝাঁ-ঝাঁ করে ছুটছে।
ভদ্রলোক কথাটা এইবার শেষ করলেন, ‘ছোটোদেরই জানালার ধারে বসা উচিত। তুমি চলে এসো আমার জায়গায়। তুমি যাবে কোথায়?’
‘আজ্ঞে, ধানবাদ।’
‘বা: ভেরি ফাইন। অনেকটা পথ। চলে এসো।’
আমি জানালার ধারে চলে গেলুম, তিনি সরে এলেন আমার জায়গায়। ভদ্রলোক তখন গুনগুন করছেন আর একটা গানের লাইন, ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না।’ হঠাৎ গান থামিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি যাবে কোথায়?’
‘ধানবাদ?’
‘আঃ, ডবল ফাইন। আমারও ধানবাদ। তা তুমি ধানবাদের কোথায় যাবে?’
মহা সমস্যা। কী উত্তর দেব? ধানবাদের তো কিছুই আমি জানি না। হে ঈশ্বর রক্ষা করো। চোখ কান বুজিয়ে বলে দিলুম, ‘কালীবাড়ির কাছে।’ কালীবাড়ি একটা থাকবেই থাকবে।
ভদ্রলোক বললেন, ‘ট্রিবল ফাইন। সিদ্ধেশ্বরীতলাতেই তো আমার বাড়ি। একেবারে কালীবাড়ির গায়ে। তুমি কার বাড়িতে যাবে?’
এইবার আরও শক্ত প্রশ্ন। এ যেন না পড়ে পরীক্ষায় বসা। কী উত্তর দেব। যা থাকে বরাতে। দুম করে বলে দিলুম, ‘কে. সি. মিত্রের বাড়িতে।’
‘কে. সি. মিত্র? কোল করপোরেশনের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর! সেও তো আমার বাড়ির পেছনে। বলতে গেলে তুমি তা হলে আমার বাড়িতেই যাচ্ছ।’
কথা শেষ করেই ভদ্রলোক আবার গুনগুন শুরু করে দিলেন, ‘মায়াবন বিহারিণী হরিণী।’ আমি শুধু অবাক হয়ে গেলুম, না পড়েও তা হলে পরীক্ষায় পাশ করা যায়। ট্রেন চলেছে আর আমি ভাবছি, সেই কলটা তা হলে কী কল? মনের চোখে দেখতে পাওয়া ভীষণ একটা ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে মনকে দিয়ে দেখানো। ওই তো ধানবাদ স্টেশন। বেরিয়ে এলুম। সামনে একটা চত্বর মতো। আরও পরে রাস্তা। ডান দিকে রিকশা নিয়ে এগিয়ে চলেছি। না দেখা জায়গাটা ছবি হয়ে ফুটে উঠছে মনের চোখে।
আমাদের সামনের আসনে এক বৃদ্ধ। সমস্ত চুল একেবারে ধপধপে সাদা। পাঞ্জাবিটা একেবারে টাইট ফিটিং। তাঁর পাশে দুটি মেয়ে জানালার দিকে, তৃষার বয়সী। যে-তৃষা তেলেভাজার দোকানে, সেই তৃষাই যেন দু-খন্ড হয়ে আমার সামনে ট্রেনের আসনে। আমি ভদ্রলোককে দেখছি আর ভাবছি, কাচার পর পাঞ্জাবিটা ছোটো হয়ে গেল, না মানুষটা মোটা হয়ে গেল। একেই কী গবেষণা বলে! এই গবেষণা করেই কি ডি. ফিল পায়। মেয়ে দুটি মাঝে-মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছে। চুল সব পেকে গেলেও মানুষটি জোয়ান। হাঁটুর ওপর সেদিনের কাগজ। অবাক হয়ে গেলুম ভদ্রলোক দুইয়ের পাতাটা খুলে নিরুদ্দিষ্টদের ছবি দেখছেন আর আমার দিকে আড়-চোখে চাইছেন। ভারী সন্দেহবাতিক তো ভদ্রলোকের। তেমনই বোকা, আমার চেয়েও বোকা। আজ যে নিরুদ্দেশ হল, আজই তার ছবি কাগজে বেরোয় কী করে! ভদ্রলোক তাঁর পাশের মেয়েটিকে একটা ছবি দেখালেন। দু-জনে ফিসফিস করে কথা হল। মেয়েটি ঝলকে আমাকে একবার দেখে নিল। আবার ফিসফিস। ভদ্রলোক কাগজ মুড়ে রাখলেন।
আমার পাশের ভদ্রলোক আবার দুটো লজেন্স বের করলেন, ‘বুঝলে, নিয়মটা হল, একটা লজেন্স শেষ হয়ে যাবার পর দশ মিনিট গ্যাপ, তারপর আবার একটা। তোমার কতক্ষণ আগে শেষ হয়েছে?’
‘অনেকক্ষণ।’
‘সে কী, অনেকক্ষণ মানে? তুমি চিবিয়ে ফেলেছ নাকি?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘ঠিক জানি, তুমিও ওই শতকরা নিরানব্বইয়ের দলে। শেষ পর্যন্ত চুষে খাবার ধৈর্য্য নেই। কিছুক্ষণ চুষেই কড়রমড়র। নাও ধরো। এটা আর চিবোবে না।’
তিনটে খুব বাজে ধরনের ছেলে ভীষণ অসভ্যতা করছিল বেশ কিছুক্ষণ ধরে। তাদের লক্ষ্য যতদূর মনে হল আমাদের সামনে বসে থাকা ওই মেয়ে দুটি। যা-তা গান গাইছে। সিটি দিচ্ছে। বাজে-বাজে কথা বলছে, সকলেই বেশ ভদ্রলোকের মতো জামাকাপড় পরেছে। পরলে কী হবে! খোলশটা ভদ্র আর পুরটা অভদ্র। নালা-নর্দমার মতো। কামরায় অত যাত্রী কেউ কিন্তু কিছু বলছেন না। সব মুখ বুজে সহ্য করে নিচ্ছেন।
আমার পাশের ভদ্রলোক বললেন, ‘তোমার নামটা কী?’
‘পিন্টু।’
‘তাই নাকি? আমার ভাইয়ের নামও পিন্টু ছিল। কী আশ্চর্য! আমার ডাকনাম কী বলো তো? বিল্টু। তুমি আমাকে বিল্টুদা বোলো। তার মানে কী বলো তো? আমি যেন আমার ভাইকে ফিরে পেলুম। তোমাকে প্রায় পিন্টুর মতোই দেখতে। সেই পিন্টুর মতো। আসলে কী জানো, নামের সঙ্গে চেহারা মিলে যায়। যেমন ধরো, এক শোটা বিল্টুকে পাশাপাশি দাঁড় করাও, দেখবে চেহারা আর স্বভাবে অনেক মিল। কেন হয়, কীভাবে হয় তা আমি বলতে পারব না, আমি সেরকম পন্ডিত নই।’
ওই ছেলে তিনটে হঠাৎ খুবই একটা যাচ্ছেতাই কথা বললে। আমার উলটো দিকের মেয়ে দুটি ফিসফিস করে বললে, ‘বাবা, শুনছ?’
‘কান দিসনি। বাজে ছেলে।’
বিল্টুদা ধীরে-ধীরে উঠলেন, ‘আমি একটু হালকা হয়ে আসি।’
তিনি উঠে যাওয়া মাত্রই ওই তিনটে ছেলের মধ্যে যেটা পালের গোদা সেইটা এসে বসে পড়ল। আমি বললুম, ‘এ কী। আমার দাদার জায়গা।’
ছেলেটা কনুইয়ের গুঁতো মেরে বললে, ‘জায়গা তোর বাপের।’
আমার মনে হচ্ছিল, ঝেড়ে দি স্ট্রেট একটা ঘুসি, তারপর যা হয় হবে। মানুষ তো নেই। সব ভেড়া। বিল্টুদা ফিরে এলেন সাদা রুমালে হাত মুছতে-মুছতে। ট্রেন ছুটছে দুলে-দুলে। রুমালটা পকেটে পুরে ছেলেটাকে বললেন, ‘ওঠো, ওঠো, উঠে পড়ো।’
ছেলেটা বললে, ‘ওঠো কী! আপনি বলুন।’
বিল্টুদা বললেন, ‘তুমি এখন ওঠো তো।’
দাঁড়িয়ে থাক, দাঁড়িয়ে থাক। অনেকক্ষণ বসেছিস।’
বিল্টুদার ডান হাতটা বিদ্যুতের মতো ছুটে এল ছেলেটার চোয়ালের দিকে। নিমেষে ঘটে গেল ঘটনাটা। ক্র্যাক করে একটা শব্দ হল। ছেলেটার নীচের চোয়ালটা ঝুলে পড়ল। বিল্টুদা তার চুলের মুঠিটা ধরে সিট থেকে টেনে তুলে প্যাসেজের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, যা:, গুরুকে এখন তিনমাস শুইয়ে রাখ। তিন মাসের আগে ও চোয়াল আর মেরামত হবে না।’
ছেলে দুটোর একটা তেড়ে আসছিল। বিল্টুদা ডান পা দিয়ে কী একটা করলেন, ছেলেটা কাটা কলাগাছের মতো উলটে পড়ে গেল তো গেলই। আর ওঠে না। তিন নম্বর ছেলেটাকে বললেন, ‘এসো ওস্তাদ, প্রসাদ নিয়ে যাও।’
ছেলেটা বললে, ‘পরের স্টেশনে মজা দেখাব।’
বিল্টুদা বললেন, ‘মজা তো আমি দেখাব। জি. আর. পি’র হাতে তুলে দেব ডাকাত বলে। তার আগে তোমার হাতের খিল দুটো খুলে দেব। এক সেকেণ্ডের ব্যাপার। গুরুর চোয়াল খুলেছি, চ্যালার হাঁটু খুলেছি, আর এক চ্যালার কাঁধ খুলে দেব। সামান্য কাজ তার জন্যে এত ঝামেলা।’
ছেলেটা ঘাবড়ে গেল। ট্রেনের গতি কমছে। স্টেশন আসছে। বিল্টুদা উঠে দাঁড়ালেন, ‘পিন্টু, তুমি বোসো, আবর্জনা তিনটেকে ফেলে দিয়ে আসি স্লো মোশনেই ফেলব। লাইনের খোয়ার ওপর একটু বিশ্রাম নিক, আহা অনেক খিস্তি করেছে।’
বিল্টুদা তৃতীয় ছেলেটার কাঁধে হাত রেখেই হাত তুলে নিলেন। ছেলেটা ‘বাবা রে’ করে উঠল। দুটো হাত লটপট। বিল্টুদা বললেন, ‘কিছুই হয়নি ভাই। সঙ্গদোষ বড়ো দোষ। এর পর আরও ভয়ঙ্কর কিছু হবে। চলো, এইবার তোমাদের একে-একে ফেলি।’
দ্বিতীয় ছেলেটা হাত জোড় করে বললে, ‘এবারকার মতো ক্ষমা করে দিন সার।’
‘ক্ষমা তো করেইছি ভাই। একবারে তো ঝলঝলে করে দিইনি। এইবার তোমাদের নামিয়ে দিই। মানুষকে সাহায্য করাই মানুষের ধর্ম।’
‘আমরা যে আরও অনেক দূরে যাব স্যার?’
‘না:, আর যায় না। আগে নিজেদের একটু মেরামত করে নাও।’
ট্রেনের গতি প্রায় কমে এসেছে। জামার পেছন দিকের কলার ধরে এক-একটাকে তুললেন, বেড়াল ছানার মতো ঝুলছে। দরজা খুলে ফেলে দিলেন বাইরে, যেন বসিয়ে দিলেন আলতো করে।
বৃদ্ধ ভদ্রলোক বললেন, ‘কাজটা ঠিক হল না, যদি দল বেঁধে আক্রমণ করে?’
বিল্টুদা বললেন, ‘আপনাকে আমার অনুরোধ, মেয়েদের নিয়ে ভবিষ্যতে বেরোবার আগে নিজে মানুষ হবেন। গোরু, ভেড়া, ছাগলও প্রতিবাদ করে। শিং দিয়ে ঢুঁ মারে, কেবল মানুষই মুখ বুজে সহ্য করে। কাওয়ার্ড কোথাকার। এতগুলো লোক একবারও প্রতিবাদ করলেন না। সব মজা দেখছিলেন, মজা।’
কিছুই হল না, ট্রেন আবার চলতে শুরু করল। বিল্টুদা লজেন্স বের করলেন। বললেন, ‘খামোখা খানিকটা সময় নষ্ট হল। কোনও মানে হয়। শোনো পিন্টু, দিনকাল খুব বাজে পড়েছে। শুধু লেখাপড়া শিখলেই হবে না, মার্শাল আর্টও শিখতে হবে। তিনটে জিনিস কী কী ছাড়লুম বলো তো—ক্র্যাক জ্যাক, লেগ ব্রেক আর প্লেকসি ফ্লেকস। তুমিও এসব শিখবে, তা না হলে কেঁচোর মতো বাঁচতে হবে।’
বিল্টুদা গুনগুন গান ধরলেন, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা।’
ধানবাদ স্টেশন এসে গেল। আমরা দুজনে নেমে পড়লুম। এইবার আমার সমস্যা। সব মিথ্যে ধরা পড়ে যাবে রে ভাই। বিল্টুদা বললেন, ‘এ কী, তোমার সঙ্গে কোনও মালপত্র নেই, না ভুলে ট্রেনে ফেলে এলে?’
বিল্টুদার একটা হাত আমার কাঁধে, আর-এক হাতে সুটকেস।
‘আমার সঙ্গে কিছু নেই।’
‘কে. সি. মিত্র তোমার কে হন? মামা? আমার সঙ্গে ভীষণ আলাপ। জানো তো ওঁর তিনটে অ্যালসেশিয়ানকে আমিই ট্রেনিং দিয়েছি। আচ্ছা, একটা কথা মনে হচ্ছে, এতদিন ওই বাড়ির সঙ্গে আমার যোগাযোগ, তোমাকে তো এর আগে কোনোদিন দেখিনি। কেন বলো তো?
আর আমার মিথ্যে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বিল্টুদাকে আমার ভীষণ, ভীষণ ভাল লেগে গেছে। এখন মনে হচ্ছে, সন্ন্যাসী না হয়ে বিল্টুদা হওয়াই ভাল। যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনই সুন্দর ব্যবহার, তেমনই সাহস আর আত্মবিশ্বাস!
আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লুম। বিল্টুদা বললেন, ‘কী হল? জল খাবে? জলখাবার?’
‘বিল্টুদা, আপনার সঙ্গে আমার খুব একটা প্রাইভেট কথা আছে। যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করেন তা হলে বলব। কোথাও একটু বসবেন?’
বিল্টুদা কেমন যেন একটু ঘাবড়ে গেলেন, বললেন, ‘চলো তা হলে, মূলচাঁদের দোকানে বসি। হ্যাঁ গো, তুমি পালিয়ে-টালিয়ে আসনি তো, বাপ-মায়ের বুক খালি করে! তাহলে কিন্তু খুব অন্যায় করেছ।’
মূলচাঁদ কচৌরিঅলার দোকানে আমরা বসলুম পাশাপাশি। বিল্টুদার দেখি ভীষণ খাতির। ইয়া বড়ো-বড়ো গেলাসে এসে গেল দু-গেলাস জল। কিছু বলতেই হচ্ছে না, এসে গেল দু-প্লেট গরমাগরম কচুরি।
‘নাও, খাও। উঃ, সেই কোন সকালে খেয়ে বেরিয়েছি। পেটে যেন ডাকাত পড়েছে। হ্যাঁ বলো, তোমার কথা বলো।’
‘দেখুন, আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। আমার দাদা নেই, মনে হচ্ছে, সত্যিই আপনি আমার দাদা। আপনাকে আমি যা বলব, তা শুনে আমাকে আপনি পুলিশের হাতে তুলে দেবেন না বলুন? প্রমিস।’
‘প্রমিস।’
আমি তখন সব খুলে বললুম। একেবারে গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত। বললুম, ‘আমি আপনাকে মিথ্যে কথা বলেছি। কে. সি. মিত্র আমার কেউ নন। তিনি কে তাও আমি জানি না। মিছিমিছি বলেছি আর মিলে গেছে। মিথ্যে কথা বলার জন্যে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আপনার কাছে। আপনি আমাকে সাহায্য করুন, প্লিজ। আমি একবার যখন বেরিয়ে এসেছি, আর আমি ফিরব না, কিছুতেই না। হয় আমি সন্ন্যাসী হব, নাহয় আমি আপনি হব।’
‘আচ্ছা, তুমি আগে কচুরি খাও, তারপর একটা হিসেব করতে হবে। বিচার করতে হবে। কোনও কিছু দুম করে করতে নেই। জীবনটা বোমা নয়। প্রথমে তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব। ধানবাদ জায়গাটা বাজে জায়গা। একা তোমাকে আমি ছেড়ে দিতে পারি না পিন্টু।’
আজকাল আর আমার সেই ছেলেবেলার মতো টাঙা দেখা যায় না। সবই সাইকেল রিকশা। একজন রিকশাঅলা খুব খাতির করে এগিয়ে এল। বিল্টুদার এখানে খুব খাতির। পুরো পরিচয় এখনও আমার জানা হয়নি। জানার সময় পাইনি। রিকশা আমাদের দু-জনকে নিয়ে এগিয়ে চলল। কীরকম একটা শুকনো সাঙ্ঘাতিক জায়গা! তেমনই গরম। বিশাল-বিশাল মাঠ অকারণে ছুটে চলে গেছে, টিলা পেরিয়ে, পাথর ভেঙে, কোথায় কে জানে। আকাশটা ধূসর। অনেক অনেক দূরে অস্পষ্ট পাহাড় আর জঙ্গল। মাঠ রয়েছে, গাছ নেই। জমি ফেটে চৌচির।
বিল্টুদা বললেন, ‘ধানবাদ পুরোটাই প্রায় ফাঁপা। তলায় কয়লাখনি। আমরা ওপর থেকে কিছুই বুঝতে পারছি না, তলায় আগুন জ্বলছে। খনিতে একবার আগুন লেগে গেলে সে-আগুন আর সহজে নেবানো যায় না। যুগ যুগ ধরে জ্বলে।
‘কী নিয়ম জানো, কয়লা কেটে নেবার পর গাড়ি-গাড়ি বালি ঢেলে গর্তটা ভরাট করার যাকে বলে স্যাণ্ড ফিলিং, সেসব আর ঠিকমতো করা হয় না। কয়লা দাহ্যপদার্থ। একস্তরে আগুন ধরে গেলে আর রক্ষে নেই, সেই আগুন মাটির তলা ধরে হাঁটতে থাকে। তাকে আর বাধা দেবার উপায় থাকে না। কী মজা বলো তো! একদিন হয়তো পুরো ধানবাদ শহরটা ভুস করে নেমে যাবে নীচে। গভীর রাতে অনেক সময় আমরা একটা অদ্ভুত গুমগুম শব্দ শুনতে পাই। মাটির তলা দিয়ে যেন রেলগাড়ি যাচ্ছে। একবার একজন মাটি খুঁড়ছিল। যেই গাঁইতি মেরেছে মাটি ঢুকে গেল নীচে। বেরিয়ে এল আগুনের জিভ আর ধোঁয়া। লোকটা অমনি গাঁইতিটাইতি ফেলে দে ছুট।’
আমরা একটা বনমতো জায়গা পেরিয়ে ডান দিকে বাঁক নিলুম। বিল্টুদা বললেন, ‘এই জায়গাটা বহুত খতরনক। প্রায়ই ডাকাতি হয়। এখানে ডাকাত আসে ঘোড়ায় চেপে। কী মজা! একটু বেশি রাতে এই জায়গা দিয়ে যাও না, তোমার বুক গুড়গুড় করবে ভয়ে। আমাকে মাঝে-মাঝে যেতে হয় স্কুটারে চেপে। আমি তখন যা স্পিড মারি না, একেবারে ঝড়।’
বিল্টুদার কথা শুনতে-শুনতে মনে হল, পৃথিবীটা যেমন সুন্দর তেমন ভয়ের। একজনের ভাগ্যে যখন যা-খুশি তাই ঘটতে পারে। কিছু করার নেই। সোজা পথ চলে গেছে বহুদূর। আমাদের ডানপাশে সুন্দর একটা কলেজ পড়ল। সুন্দর-সুন্দর সব বাড়ি। একটু-একটু বাগান। বোগেনভেলিয়ার বাহার।
বিল্টুদা বললেন, ‘এইটা হল ধানবাদের পশ এলাকা। ধনকুবেরদের বসবাস। এখানে লোকের পয়সা কী। বাপস। টাকার বস্তা নিয়ে বাজার করতে বেরোয়। কী আর বলব তোমাকে! টাকায় অরুচি।’
‘বিল্টুদা, আপনিও খুব বড়োলোক?’
‘ধুস। আমার দিন কোনোরকমে চলে যায়। সৎপথে কেউ বড়োলোক হয় রে ভাই?’ বিশাল জায়গা-ঘেরা একটা বাড়ির সামনে বিল্টুদা রিকশাকে বললেন ‘রোকো।’
আমার তো ভয় লেগে গেল, ওরেব্বাস, এ যেন লাটভবন! আবার খুব আনন্দও হল, এত বড়ো একটা বাড়িতে থাকতে পাব। আমাদের বাড়িটা এর কাছে যেন বৈঠকখানা। জেলখানার মতো উঁচু পাঁচিল। লোহার চাদরের বিশাল গেট। এর নাম কোনোরকমে দিন চলা!
গেটের পাশে দাঁড়িয়ে বিল্টুদা একটা বোতাম টিপলেন। দূরে একটা ঘণ্টা বাজল। কিছুক্ষণ পরে গেটের পেটে বসানো ফালি অংশটা খুলে গেল। একটা মুখ উঁকি মারল। একেবারে হিরোর মতো চেহারার এক যুবক। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। নীল জিনস। টি শার্ট। যুবকটি একপাশে সরে দাঁড়াল, আমরা নীচু হয়ে ঢুকে পড়লুম। যেন তেপান্তরের মাঠ। দূরে একটা ঝলমলে সুন্দর বাড়ি। পাঁচিলের ধারে-ধারে বড়ো-বড়ো গাছ। আমরা দু-পা এগোতেই নানা সুরে একপাল কুকুর ডেকে উঠল কোথা থেকে। আমি আমনি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লুম। বেড়াল আমি ভীষণ ভালোবাসি। কুকুর দেখলেই আমার ভয় করে।
বিল্টুদা আমার কাঁধে হাত রেখে বলেলেন, ‘নো ফিয়ার! সব বাঁধা আছে। তা ছাড়া তুমি তো বললে সন্ন্যাসী হবে। জঙ্গলে যে বাঘও থাকে ভাই।’
‘এত কুকুর আপনি পুষেছেন?’
‘ওইটাই তো আমার ব্যবসা গো। আমি ডগ ব্রিডার অ্যাণ্ড ট্রেনার। দেখবে কী মজা! কুকুর কীরকম ট্রেনিং নেয় তোমার ধারণা নেই।’
‘ওরা হঠাৎ এমন ডাকছে কেন? আমাদের চোর ভেবেছে বুঝি?’
‘ধুর পাগল! দেখছ না কেমন আদুরে গলায় ডাকছে! তিনদিন পরে আমি এলুম তো!’
‘কী করে বুঝল আপনি এসেছেন?’
‘খুব সহজ! বাতাস বইছে আমাদের দিক থেকে ওদের দিকে। সেই সঙ্গে আমাদের পায়ের শব্দ। কুকুরের দুটো সম্পদ, নাক আর কান। কানে ওরা মানুষের চেয়ে হাজার গুণ বেশি জোরে শব্দ শোনে। গন্ধ যত ফিকেই হোক ওদের নাকে লাগবেই। সঙ্গেসঙ্গে ধরে ফেলবে কার গন্ধ, কীসের গন্ধ! তা ছাড়া ওদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ভীষণ প্রবল। ওরা বুঝতে পারে, কে চোর, কে সাধু! বুঝলে, কুকুর এক আজব জীব। আমি যত মিশছি ততই অবাক হচ্ছি। মানুষ-ফানুস আমার আর ভাল লাগে না। সবেতেই বড়ো আশান্তি করে!’
বিল্টুদার বাড়িটা অতি সুন্দর। নীচের তলাটা একেবারে ফাঁকা। চার চৌকো বিশাল একটা হলঘরই বলা চলে। ছাইরঙের পাথরের মেঝে। একপাশ দিয়ে উঠে গেছে ঝুলন্ত সিঁড়ি দোতলায়। এমন কায়দার সিঁড়ি কলকাতায় বড়োলোকদের বাড়িতেই থাকে। লম্বা-লম্বা তিন-চার ধাপ সিঁড়ি ভেঙে আমরা সেই গ্রেট হলে ঢুকলুম। সামনের দেওয়ালে বিশাল এক অয়েল-পেন্টিং। সুন্দরী এক মহিলার। বিদেশিনী। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে বিল্টুদা বললেন, ‘আমার স্ত্রীর ছবি। গত বছর মারা গেছেন কার অ্যাকসিডেন্টে।’
আমার মুখ দিয়ে আচমকা বেরিয়ে গেল ‘ইস।’
‘ইস বললে?’
‘এত সুন্দর একজন মানুষ মারা গেলেন!’
আমার তো কেউ নয়, তবু জল এসে গেল আমার চোখে। বিল্টুদা বললেন, ‘সে কী, তুমি কাঁদছ! না সত্যিই তুমি সন্ন্যাসী হবে। সন্ন্যাসীদের ভেতরে খুব জল থাকে। হিমালয়ে গেলে সেই জল জমে বরফ হয়। আর বরফ মানেই ভগবান। আমার হল এই থিয়োরি।’
বাকি তিনটে দেওয়ালে পৃথিবীর যাবতীয় কুকুরের ছবি। তলায়-তলায় সব নাম লেখা। ধূসর পাথরের মেঝে, সাদা দেওয়াল। দেওয়ালে সব রঙিন ছবি। কোণে কোণে পেতলের টবে ইনডোর প্ল্যান্ট। দেওয়াল ঘেঁষে ঝকঝকে বসার আসন। আমার মনে হল আমি স্বর্গে এসে গেছি। এইরকম একটা জায়গার স্বপ্ন আমি মাঝে মাঝেই দেখতুম। আজ ভাগবান আমাকে টেনে নিয়ে এলেন। কী মজা! বাড়ির কথা আর মনেই পড়ছে না। আমি আর আমার মনের ভাব চাপতে পারলুম না। বলেই ফেললুম, ‘কী সুন্দর।’
‘আর সুন্দর, যার চেষ্টায়, পরিকল্পনায় এই সুন্দর সেই চলে গেল তো আর কী হবে! আমি সেই থেকে ভাবছি, তোমার সঙ্গেসঙ্গে আমিও সাধু হয়ে যাব। আমার জীবনের গল্প শুনলে মনে হবে তোমার গল্পটা কিছুই নয়। তুমি তো আদুরে ছেলে। অতিরিক্ত ভালোবাসাও এক অত্যাচার। তুমি সেই অত্যাচারে অতিষ্ঠ হযে বেরিয়ে এসেছ। না:, বড়ো বেশি কথা হয়ে যাচ্ছে।’
ঝোলানো সিঁড়ির মাথার ওপর ফ্রক-পরা একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল। আমি তো ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছি। ভেবেছি, অয়েল পেন্টিংটাই বুঝি জীবন্ত হয়ে এসেছে। বিল্টুদা বললেন, ‘আমার মেয়ে। নাম এলা। নামটা আমি রবীন্দ্রনাথ থেকে পেয়েছি।’ বিল্টুদা এলাকে বললেন, ‘মিট পিন্টু। কলকাতা থেকে আসছে। তোমারই ক্লাসে পড়ে। ভেরি গুড বয়।’
এলা বললে, ‘তোমরা ওপরে এসো। কী করছ ওখানে অতক্ষণ? তোমরা আসছ দেখে চা বসিয়েছি। টি ইজ রেডি।’
ওপরটা আরও সাঙ্ঘাতিক সুন্দর। মেমসাহেবের বাড়ি একেই বলে। মনে হচ্ছিল আমার মাকে ডেকে এনে একবার দেখাই, সুন্দর বাড়ি কীভাবে ছবির মতো সাজাতে হয়। এলাকে দেখে আমার ভীষণ লজ্জা করছিল। তৃষার সঙ্গে আমার খুব ভাব। তৃষা আমাদের ঘরের মেয়ে। তাকে আবার লজ্জা কীসের। কিন্তু এলা? বাবা রে! তার জামা, তার চুল, নীল চোখ, স্লিপার, তার হাঁটা-চলা, তাকাবার ভঙ্গি, কথাবলার ধরন, সবই অসাধারণ। আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে একেপাশে দাঁড়িয়েছিলুম। মেঝেতে এত পালিশ যে বলতে গেলে পা স্লিপ করছে।
হঠাৎ এলা এগিয়ে এসে আমার হাত ধরল। মনে হল, আমি শামুকের মতো গুটিয়ে খোলে ঢুকে যাই। এলার গা থেকে সুন্দর একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। জানি বিলিতি সেন্টের গন্ধ। কলকাতার নিউমার্কেটে গেলে এইরকম গন্ধ পাওয়া যায়। এলার হাত ফরসা। আমারটা তেমন ফরসা নয়। আমি মাটির দিকে চেয়ে আছি।
হঠাৎ বিল্টুদা হইহই করে উঠলেন, ‘এলা, এলা, করিস কী? গায়ে হাত দিসনি। ও যে একটু পরেই সন্ন্যাসী হয়ে যাবে।’
এলা ভয়ে হাত ছেড়ে দিল। বিল্টুদা হা, হা করে হাসতে লাগলেন।
এলা বললে, ‘সন্ন্যাসী মানে?’
‘সে স্টোরি পরে হবে। তুই ওকে কী করতে চাস?’
‘হাত-মুখ ধোবে তো?’
‘যা, নিয়ে যা।’
এলা বললে, ‘শোনো, তোমাকে আমি বাথরুম ব্যবহারের নিয়মটা শিখিয়ে দিই।’
আমি এইবার অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকালুম। নীল পদ্মফুলের মতো দুটো চোখ। দুধের মতো গায়ের রং। মুখের চামড়া একেবারে টানটান, পাতলা। তলা থেকে একটা গোপাপি আভা ফুটছে। বাথরুম ব্যবহারের আবার নিয়ম আছে নাকি?
এলা হেসে ফেলেছে। ঠিক মুক্তোর মতো এক সার দাঁত। ‘অবাক হলে তো! আচ্ছা, আগে এই চটিটা পায়ে গলাও, তারপর এই নাও।’
দরজাটা খুলে দিল এলা। আমি তো অবাক। এর নাম বাথরুম। আয়নার মতো মেঝে। দেওয়ালে-দেওয়ালে আয়না। কত কী জিনিস! আবার মাথার ওপর পাখা। একপাশে একটা বিশাল সাদা নৌকো। তাইতে সব কল লাগানো। ওটাকে নাকি বলে বাথটব! শুয়ে শুয়ে চান করতে হয়। হাত ধোয়ার বেসিন। এসব বাবা জীবনে দেখিনি। না আছে টিনের বালতি, না আছে মগ। না আছে শ্যাওলা-ধরা মেঝে। নিয়মটা হল মেঝেতে যেন একফোঁটাও জল না পড়ে। ভিজে পায়ের ছাপ না পড়ে। বেসিনে যেন সাবানের ফেনার বুজকুড়ি না থাকে।
আমি বললুম, ‘এলাদিদি, আপনাদের আর কোনো বাথরুম নেই চাকর-বাকরদের জন্যে!’
‘দিদি নয়, আপনি নয়। এলা আর তুমি। অন্য বাথরুম থাকলেও, এটাতেই তোমাকে যেতে হবে আর যা বললুম, তা শিখতে হবে। জানো তো মা বলতেন, বাথরুমই মানুষের চরিত্র তৈরি করে। যা-ও।’
এলা আঙুল উঁচিয়ে আমাকে আদেশ করল। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে, আগে ঘুরে-ঘুরে সব দেখলুম। আহা, আমার মাকে যদি দেখাতে পারতুম! যেদিকে তাকাই সেদিকেই আমি। কত আয়না! পিন্টুর দিকে পিন্টু তাকিয়ে আছে বোকার মতো। পা ধোব কোথায়। পা দুটোর যা ছিরি। মা আমাকে, মাঝে-মাঝে এই নিয়ে বলেন। না বাবা, কাল সকালেই এ-বাড়ি থেকে আমাকে পালাতে হবে। আামি একটা অসভ্য।
কনুই বেয়ে এক ফোঁটা জল মেঝেতে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি তোয়ালে দিয়ে মুছলুম। হাঁসের পালকের মতো সাদা তোয়ালে। কোনোরকমে বেরিয়ে এসে বাঁচি। ফিনফিনে কমলালেবু রঙের চায়ের কাপে চা, প্লেটে নানারকমের কেক। এমন কেক আমি জীবনে খাইনি। কোথায় আমার রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁট। এক ডেলা আখের গুড়।
বিল্টুদা বললেন, ‘তুমি তো একবস্ত্রে গৃহত্যাগ করেছ। এইবার তোমার জামা, কাপড়ের কী ব্যবস্থা হবে!’
আমার মনে তখন অন্য প্রশ্ন। করেই বসলুম, ‘আপনি এত বড়োলোক, তা হলে সেকেণ্ড ক্লাসে এলেন কেন?’
‘এ একটা তুমি প্রশ্নের মতো প্রশ্ন করেছ? সন্ন্যাসী তো হবে, মায়া কাকে বলে জান? ভোজবাজি? এইসব তোমার আজ আছে কাল নাও থাকতে পারে। সেই শেয়ালের গল্পটা তোমাকে শোনাতে ইচ্ছে করছে।’
এলা এসে আমার পাশে বসে পড়ল, ‘আমিও শুনব বাবা।’ এমন স্বাভাবিকভাবে বসল, যেন কোনো অহঙ্কারই নেই। আমার হাতটা ধরে বললে, ‘তুমি কিছু খাচ্ছ না কেন? মন খারাপ। তোমার কথা তো কিছু শোনাই হল না।’
বিল্টুদা বেশ জাঁকিয়ে বসলেন। মুখটা যেন ভগবান হাসি দিয়ে তৈরি করে দিয়েছেন। এলাকে বললেন, ‘পিন্টুর গল্প তুই পরে শুনবি। আগে ওর প্রশ্নের উত্তরটা গল্পে দিই। এক গ্রামে, ধরো, আমারই মতো এক মানুষ থাকত। ধরো সে ছিল চাষা। যেমন আমি ছিলুম আমার অতীতে। তার চালাবাড়ির উঠোনে ছিল বিশাল, বিশাল, বিশাল এক খড়ের গাদা। পাহাড়ের মতো। রোজ তার মুনিশরা সেই গাদা থেকে খাবলা খাবলা খড় নিত।’
এলা বললে, ‘মুনিশ কী বাবা?’
‘ও হ্যাঁ, তোমার তো আবার বাংলা জ্ঞান আমাদের মতো নয়। মুনিশ হল যারা চাষবাসে সাহায্য করে। ফার্ম-লেবারার। তা ওই খড় নিতে নিতে একটা বেশ বড়ো গর্ত তৈরি হল। সেই গর্তে এসে আশ্রয় নিল এক শেয়াল। কীরকম শেয়াল? না যে জাদু জানত। ম্যাজিশিয়ান। শেয়ালটা করত কী, না এক বৃদ্ধের রূপ ধরে সেই বাড়ির মালিককে দর্শন দিত। মালিকের নাম, ধরো, বিল্টুবাবু। একদিন ওই বৃদ্ধরূপী শেয়াল বিল্টুকে বললে, চলো, আজ আমার সঙ্গে একটা জায়গায় বেড়াতে চলো। বিল্টু প্রথমে একটু ভয় পেয়ে বললে, না, আমি যাব না। কে না, কে এক বুড়ো! চিনি না, শুনি না। তা সেই বুড়োর চাপাচাপিতে বিল্টু শেষে রাজি হয়ে গেল। বৃদ্ধ বললে, বেশি দূরে তোমাকে যেতে হবে না, তুমি আমার এই গর্তে চলে এসো। বিল্টু ভয়ে ভয়ে সেই খড়ের গর্তে গিয়ে ঢুকল। একটু এগিয়েই বিল্টু ‘থ’ মেরে গেল।
এলা বললে, ‘থ’ মারাটা কী বাবা? তুমি আমার মতো বাংলায় বলো।’
‘থ’ মারা হল, থমকে যাওয়া। ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে না, টি এইচ এ ডব্লু, থ, মানে জমে গেল। ফ্রিজড। বিল্টু দেখে কী সেই গর্তের ভেতর, বড়ো-বড়ো, সুন্দর সুন্দর ঘর। সাজানো-গোছানো, টেরিফিক। সাজানো একটা ঘরে দু-জনে মুখোমুখি বসল। ভুরভুর সুগন্ধি চা এল, খাবারদাবারও এসে গেল। বিল্টু মনে মনে ভাবছে, কী কান্ড, তারই উঠোনে, তারই খড়ের গাদার ভেতর এ কী ম্যাজিক! সে এতদিন কিছুই জানত না। তবে জায়গাটা ভারি বিষণ্ণ। দিন কি রাত বোঝার উপায় নেই। আলোটা কেমন যেন! তা যাকগে, এখন তো খাওয়া যাক। অনেকক্ষণ ধরে খাওয়া-দাওয়া চলল, শেষে বিল্টু বললে, এবার তা হলে ওঠা যাক। উঠে ফেরার জন্যে দু’পা গিয়ে যেই সে পেছন ফিরে তাকাল, দেখে কী, সব অদৃশ্য। কিছুই নেই, কেউ কোথাও নেই। বিল্টু হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল সেই খড়ের গাদা থেকে।
‘সেই বৃদ্ধের রোজকার রুটিন ছিল, সন্ধ্যে হলেই বেরিয়ে যেত আর ফিরে আসত ভোরের আলো ফোটার সঙ্গেসঙ্গেই। কোথায় যে যেত তাকে অনুসরণ করেও ধরা যেত না, যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল। তখন বিল্টু একদিন কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেসই করে ফেলল, রোজ আপনি যান কোথায়? বৃদ্ধ বললে, আমার এক বন্ধুর বাড়িতে। সেখানে জোর খানাপিনা হয়। বিল্টু বললে, আমাকেও একদিন নিয়ে চলুন না। খুব ইচ্ছে করছে যেতে। বৃদ্ধ প্রথমে রাজি হল না, শেষে বললে আচ্ছা চলো। চলো বলেই সে বিল্টুর হাত চেপে ধরলে। সঙ্গেসঙ্গে তাদের দু-জনের যেন ডানা গজিয়ে গেল। এক কেটলি চায়ের জল গরম হতে যতটুকু সময় লাগে সেইটুকু সময়ের মধ্যে তারা এক বিশাল শহরে পৌঁছে গেল। লোকজন, গাড়ি-ঘোড়া, আলোর মালা। চারধার একেবারে ঝলমল করছে। তারা দু-জনে গিয়ে ঢুকল বেশ বড়ো এক রেস্তরাঁয়। একগাদা লোক বসে গেছে টেবিলে-টেবিলে। খুব খানাপিনা চলেছে। হইহট্টগোল। তারা দু-জনে গিয়ে বসল রেস্তরাঁর দোতলায়। সেখানে বসল সেখান থেকে নীচের সব টেবিল দেখা যাচ্ছে। ভালো-ভালো সব খাবার প্লেটে-প্লেটে। বৃদ্ধ বলা নেই কওয়া নেই নীচে নেমে গেল। সেখানে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে এর তার টেবিল থেকে ভালো-ভালো খাবারের প্লেট নিয়ে ওপরে চলে এসে বিল্টুকে বললে, এই নাও, খাও। বিল্টু তো অবাক। আচ্ছা জাদুকরের পাল্লায় তো পড়েছে! বিল্টু খাচ্ছে, আর তাকিয়ে আছে নীচের দিকে। এমন সময় সুন্দর লাল পোশাক পরা রেস্তরংর ওয়েটার বড়ো এক প্লেট চিকেনতন্দুর এক ভদ্রলোকের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল। বিল্টুর নাকে এসে লাগল সেই সুগন্ধ। বিল্টু বৃদ্ধকে বললে, ওই প্লেটটা তুলে আনুন না। আমার জিভে জল এসে গেছে।
‘বৃদ্ধ বললে, ওখানে আমি সুবিধে করতে পারব না ভাই। ওই লোকটি ভীষণ সৎ আর একরোখা। আমি ধরা পড়ে যাব।’
‘বিল্টুর মনে একটা আকাঙ্ক্ষা জন্মাল। আচ্ছা, তা হলে এই সৎ আর একরোখা হলে, কেউ তার কিছু নিয়ে নিতে পারে না। বেশ, তা হলে আমিও ওইরকম হব। যাঁহাতক ভাবা, বিল্টু অমনি টাল খেয়ে পড়ে গেল একেবারে ওপর থেকে নীচে। যারা খানাপিনা করছিল একেবারে তাদের ঘাড়ের ওপর। তারা তো অবাক, এ-লোকটা পড়ল কোথা থেকে? আকাশ থেকে নাকি! বিল্টুও মহা অপ্রস্তুত। সে ওপর দিকে তাকাল। ও মা, এ কী? রেস্তরাঁর দোতলাটা গেল কোথায়! নেই তো! মোটা একটা বিম চলে গেছে, এপাশ থেকে ওপাশে। এতক্ষণ সে ওই বিমটার ওপর বসে ছিল নাকি?’
‘বিল্টু তখন যাদের ঘাড়ের ওপর পড়েছিল তাদের সব খুলে বলল। তারা বললে, সে কী রে ভাই, তুমি যে জায়গা থেকে এসেছ বলছ, সে জায়গা তো এখান থেকে হাজার মাইল দূরে। বিল্টুর পকেট তো গড়ের মাঠ। তারা তখন চাঁদা তুলে বিল্টুর ট্রেন-ভাড়ার ব্যবস্থা করে দিলে।’
‘কী বুঝলে বলো?’
এলা বললে, ‘সৎ, চরিত্রবান, আপরাইট না হলে এক অবস্থা থেকে আর-এক অবস্থায় পড়ে যেতে বেশিক্ষণ লাগে না।’
বিল্টু বললেন, ‘আর-একভাবে বলা যায়, সৎলোকের জায়গা নীচের দিকে। তারা বাতাসে ভেসে থাকে না। তারা থাকে মাটিতে। পিন্টু, তুমি আমার এই অবস্থাটা চিরকালের ভেবো না। এটা তৈরি করে গেছেন এলার মা, তাঁর নিজের দেশের মান অনুসারে। এটা আমাদের দেশের মান অনুযায়ী হয়নি। এ আজ আছে কাল নেই। এ-দেশে ফার্স্টক্লাসে উঠতে হলে শেয়ালকে সঙ্গী করতে হবে। যত রকমের চুরি, জোচ্চুরি, ভেলকি দেখাতে হবে। আমাদের ক্লাস হল সেকেণ্ড ক্লাস।’
বিল্টুদা উঠে গেলেন। এলা বললে, ‘জান, আমার বাবা এক অদ্ভুত মানুষ। সিগারেট খায় না, মদ খায় না। মাছ-মাংস খায় না। নরম বিছানায় শোয় না। আমাদের বাগানের ও মাথায় বিশাল এক ইঁদারা আছে সেই ইঁদারায় কী শীত, কী গ্রীষ্ম, দু-বেলা হুড়হুড় করে চান করে। কখনো মিথ্যে কথা বলে না। কাউকে খাতির করে না। আমার ইচ্ছে করে, আমিও বাবার মতো হই।’
‘আমারও সেই ইচ্ছে, আমার বাবার মতো হই।’
‘হচ্ছ না কেন?’
‘অনেক চেষ্টা করেও পারলুম না বলে আজ বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। ট্রেনে তোমার বাবার সঙ্গে দেখা। এখন ভাবছি তোমার বাবার মতোই হব। ভেবেছিলুম সন্ন্যাসী হয়ে যাব। এখান থেকে যাব, পরেশনাথ। পরেশনাথ পাহাড়ে শুনেছি অনেক সন্ন্যাসী থাকেন।’
‘তুমি তো হিমালয়ে যেতে পারতে?’
‘সে তো পারতুম, কিন্তু আমার যে মাত্র পঞ্চাশটা টাকা ছিল।’
‘তুমি টাকা নেবে? আমার কাছে অনেক টাকা আছে।’
‘আমি কারও টাকায় সন্ন্যাসী হব না। নিজে নিজে হব।’
‘তা তুমি সন্ন্যাসী হয়ে সোধ করে দিও। কী আছে? কোনও প্রবলেম নেই।’
‘ও মা, সন্ন্যাসী হয়ে শোধ করব কী? তখন তো আমার কিছুই থাকবে না। শুধু একটা কৌপীন।’
‘কৌপীন কী জিনিস?’
‘সে তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না। একটু অসভ্যমতো একটা ব্যাপার। মেয়েদের সামনে পরতেও নেই, বলতেও নেই।’
‘ও বুঝেছি, বুঝেছি, লয়েনস ক্লথ। তা হলে তখন তুমি মেয়েদের সামনে বেরোবে কীকরে?’
‘বেরোবই না। সন্ন্যাসীদের মেয়েদের মুখ দেখতেই নেই।’
‘ও মা, সে কী! আমার বাবার গুরু তো সন্ন্যাসী। তিনি তো আমাদের বাড়িতে আসেন।’
‘সে তোমার গুরু হলে আসা যায়। সন্ন্যাসী থেকে গুরু হতে অনেক সময় লাগে।’
‘আমার মত নেই।’
‘মত নেই মানে?’
‘লেখাপড়া না করে সন্ন্যাসী হওয়াটা আমি সমর্থন করি না। কোনও-কিছুর ভয়ে সন্ন্যাসী হওয়াটা ঠিক নয়। ভেরি ব্যাড। ওতে ঠিক-ঠিক সন্ন্যাসী হওয়া যায় না।’
‘আমি তো আর সন্ন্যাসী হব না ভাবছি। তোমার বাবার মতো হব।’
‘যা:, তা কেন, তুমি তোমার বাবার মতো হও। বলে না? বাপকা বেটা। তোমার বাবা কীরকম?’
‘উরে ব্বাবা, আগুনের গোলার মতো। ভীষণ পন্ডিত। সব পরীক্ষায় ফার্স্ট।’
‘আর তুমি?’
‘আমি লাস্টের আগে। মানে লিস্টটাকে উলটে নিলে আমি সেকেণ্ড।’
এলা হাসতে-হাসতে আমার গায়ে লুটিয়ে পড়ল। হাসি চেপে বললে, ‘লেখাপড়া করো না বুঝি?’
‘কেন করব না? সারা দিনরাত পড়ি।’
‘তাও হচ্ছে না?’
‘না।’
‘কেন বলো তো?’
‘সেইটাই তো কেউ বুঝতে পারছে না। মাথায় কিছু নেই, নাকি কে জানে? তাই তাড়িয়ে দেবার আগে নিজেই নিজেকে তাড়িয়ে দিয়েছি।’
‘আর ফিরবে না?’
‘কভি নেহি!’
‘তোমার মা-বাবা কাঁদবেন।’
‘বাবা কাঁদবেন না। আর মাকে বাবা কাঁদতে দেবেন না। ধমকে ঠাণ্ডা করে দেবেন।’
‘কিন্তু আমার বাবার মতো হতে গেলে যে তোমাকে অনেক-কিছু শিখতে হবে। অনেক লেখাপড়া করতে হবে। সারা পৃথিবী ঘুরতে হবে। ঘোড়ায় চাপা শিখতে হবে। শিখতে হবে বন্দুক ছোঁড়া। সাত-আটটা ভাষা শিখতে হবে। শিখতে হবে কুংফু, জুজুৎসু, মোটর চালানো, প্লেন চালানো।’
‘অঙ্ক?’
‘অফকোর্স।’
‘অঙ্ক ছাড়া কি পৃথিবীতে কিছুই হয় না?’
‘কী করে হবে? পৃথিবীটাই তো অঙ্কের পৃথিবী। হিসেবের পৃথিবী।’
এলা উঠে গিয়ে পিয়ানো বাজাতে বসল। পিয়ানো বাজানো আমি সিনেমায় দেখেছি। এই প্রথম আমি সামনাসামনি দেখলুম। বাজনাটার পিড়িং পিড়িং আমি তেমন বুঝি না, তবে যন্ত্রটা দেখতে বেশ বড়োলোকের মতো। মহা বিপদে পড়ে গেলুম। আমি যে এখন চান করব। এলা বাজাচ্ছে। বলতে গেলে যদি বিরক্ত হয়। এমন সময় বিল্টুদা এলেন। হাতে প্যান্ট, জামা, গেঞ্জি, ডোরাকাটা পাজামা। কোথা থেকে নিয়ে এলেন কে জানে। আমি বললুম, ‘বিল্টুদা, আমি যে এইবার চান করব।’
‘করবেই তো। সেই ব্যবস্থাই তো হচ্ছে। আমিও করব। তুমি কোথায় করবে? বাথরুমে না ওপেন এয়ার?’
‘ওপেন এয়ার।’
‘ঠাণ্ডা লাগবে না? সর্দিজ্বর হবে না?’
‘আজ্ঞে না।’
‘তা হলে চলো।’
এইবার আমরা বাড়ির পেছন দিক দিয়ে বেরোলুম। পেছন দিকটা আরও সুন্দর। একেবারে ফাঁকা। অনেক দূরে কয়লাখনির গর্তে নামার সেই লিফটগুলো দেখা যাচ্ছে। দেহাতি গ্রামের ছোটো-ছোটো চালা। হিন্দিতে মা তার ছেলেকে ডাকছে। বিশাল এক পাখির মতো রাত্রি নামছে ডানা মুড়ে। টিপ-টিপ আলো জ্বলে উঠছে। লাটাখাম্বায় বাঁধা লোহার বালতি নামছে ইঁদারায়। তার শব্দ। যেমন ভালো লাগছে। খারাপও লাগছে তেমনই। বাড়ির কথা ভেবে। এতক্ষণে সেখানে হইহই পড়ে গেছে। থানা-পুলিশ হচ্ছে। হাসপাতালে-হাসপাতালে খবর নেওয়া আরম্ভ হয়েছে। মনে-মনে খুব ভয় পেয়ে গেলুম। এর পর যদি আমি ফিরি, আমার বাবা বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না। সত্যি-সত্যিই বের করে দেবেন। জ্যাঠামশাইও বাঁচাতে পারবেন না। বাবা ভীষণ কড়া মানুষ। আমার সামনে এখন দুটো রাস্তা। হয় মরে যাওয়া, নয় তো একেবারে চিরকালের মতো হারিয়ে যাওয়া।
একসঙ্গে অনেক কুকুর ডাকছে। বিল্টুদা বললেন, ‘আর একটু পরেই ফেরোসাস কুকুরগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তখন আর এখান থেকে কেউ বেরোতেও পারবে না, ঢুকতেও পারবে না, আমার সাহায্য ছাড়া।’
‘এই ব্যবস্থা কেন করেছেন বিল্টুদা?’
‘প্রাণে বাঁচার জন্যে ভাই। এই জায়গাটার নাম ধানবাদ। এখানে যদি তুমি কোনো মানুষকে মারো, তা হলে মরার সময় তাকে বলতে হবে ধন্যবাদ। আর যে মারবে সে বলবে সরি। ভারতবর্ষের টেকসাস।’
‘কী কী কুকুর ছাড়বেন?’
‘ডোবারম্যান, অ্যালসেশিয়ান, বুলডগ, সেন্ট বারনারড। যে যার এলাকায় ঘুরবে, পাহারা দেবে। রাত হোক না, দেখবে মজা।’
ইঁদারার ঠাণ্ডা জলে এমনিই শীত করছিল। কুকুরের ভয়ে শীত আরও বেড়ে গেল। আসার পথে দেখলুম আস্তাবলে দুটো তাগড়া ঘোড়া রয়েছে। আসতে-আসতে কেন জানি না বিল্টুদা হঠাৎ বললেন, ‘মন থেকে ভয় তাড়াও পিন্টু। ভিতুদের জীবনে কিছু হয় না। জীবনকে পিঠ দেখিও না, মুখ দেখাও।’
এলা পড়তে বসেছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি জানালার ধারে। হঠাৎ একটা হুইসল বাজল, আর কোথা থেকে ছুটে এল একপাল কুকুর। কয়েকটা কুকুর ঠিক বাছুরের মতো বড়ো। একটু আগে ভেবেছিলুম, আমি বিল্টুদা হব। এখন মনে হচ্ছে, দরকার নেই। একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। হঠাৎ বাড়ি ফিরে যাবার জন্যে মনটা ভীষণ কেঁদে উঠল। আমার বাবা, আমার মা, আমার জ্যাঠামশাই, আমার সেই বেড়ালটা, আমাদের ছাদ। আমার ডানা থাকলে এখনই উড়ে চলে যেতুম; কিংবা বিল্টুদার গল্পের ওই শেয়াল বুড়োটা যদি আসত। কুকুরদের সঙ্গে আরও তিন-চারজন রয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন বিল্টুদা। সবাই মিলে কুকুরগুলোকে নানারকম উপদেশ দিচ্ছেন। কী কান্ড রে বাবা!
ছবির মতো একটা ঘরে আমাকে শোয়ানো হল। আমি একা একটা ঘরে। বিরাট এক বিছানা। চারপাশে বড়ো-বড়ো জানলা। এলা, বিল্টুদা, দু-জনেই আমাকে গুডনাইট করে গেছেন। সুইচ টিপে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়লুম। ভাবছি, বিল্টুদা কেন আমাকে বাড়ি ফিরে যাবার জন্য চাপ দিচ্ছেন না। বিল্টুদা কি ছেলেধরা? ডাকাত নাকি? শেয়ালবুড়োর গল্পটার মধ্যে কোনো রহস্য নেই তো! এলা তো মেমসাহেব তাই মনে হয় একটু অহঙ্কারী। একটা গুমগুম শব্দ হচ্ছে কোথায়! এই সেই। ধানবাদের মাটির তলায় আগুন জ্বলছে। অনেক দূরে পর-পর কয়েকটি বোমার শব্দ হল। কে জানে কী? ডিনামাইট দিয়ে কয়লা ফাটাচ্ছে নাকি!
কিছুতেই আর ঘুম আসে না। বাড়ির চিন্তা। হঠাৎ মনে হল, অপঘাতে মানুষ মারা গেলে ভূত হয়। হঠাৎ যদি এলার মায়ের ভূত এই বাড়িতে আসেন। এত প্রিয় বাড়ি তাঁর। যদি এই ঘরে এসে জানালার ধারের ওই চেয়ারটায় বসেন। ‘ভয় তাড়াও পিন্টু’—এ কথা কেন বললেন বিল্টুদা! এ-বাড়িতে তা হলে নিশ্চয় ভয়ের কিছু আছে। বিছানা থেকে উঠে ঘরের বন্ধ দরজাটার সামনে দাঁড়ালুম। ভাবছি খুলে বাইরে গিয়ে দেখব কে কোথায় আছে। গিয়ে বলব, আমি তো কোনওদিন একা শুইনি, আমার ভীষণ ভয় করছে বিল্টুদা। ভয়ে মরে যাওয়ার চেয়ে বলে ফেলাই ভাল। রাত ভোর হতে এখনও অনেক বাকি। দরজাটায় যেই হাত রেখেছি, বাইরে একটা গরর করে চাপা গর্জন হল। বা: বেশ মজা, বিল্টুদা এখানেও কুকুর ছেড়ে রেখেছেন। আমাকে একবারও বলেননি। আমার হঠাৎ বেরোবার প্রয়োজন হলে আমি কী করব! সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। সেই গুমগুম শব্দটা এখনও হচ্ছে। সারা রাতই হবে মনে হয়।
আমি জানলার ধারে সরে এলুম। চারপাশ ধু-ধু ফাঁকা। চাঁদটা বেশ বড়ো হয়েছে। নীচের জমিতে অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় কুকুরগুলো ঘুরছে। হঠাৎ দেখি এক অশ্বারোহী। খুব ধীরে ঘোড়া চালিয়ে ওপাশ থেকে এপাশে আসছে। চিনতে অসুবিধে হল না। বিল্টুদা এ কী, ঘুমোননি! আমি তাড়াতাড়ি জানলার নীচে বসে পড়লুম। যদি আমাকে দেখে ফেলেন, ভাববেন আমি বিল্টুদাকে দেখছি। এত রাতে কেউ ঘোড়ায় চাপে? কী জানি বাবা! এ আমি কোথায় এলুম! ঘোড়াটা এদিক থেকে চলে গেল ওদিকে। আমি বিছানায় ফিরে এসে চাদরে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লুম। মনে মনে প্রার্থনা করলুম, ঈশ্বর তাড়াতাড়ি রাত ভোর করে দাও। আমি আর থাকতে চাই না, আমার বাড়ি ছেড়ে। সন্ন্যাসী হবার মতো সাহস আমার নেই ভগবান। ভগবানের কথা, মায়ের কথা ভাবতে-ভাবতে আমি বোধ হয় একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, বিশ্রী একটা স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ঝাঁ করে ভেঙে গেল। আমার সামনে একটা বন্ধ দরজা। দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার একটা হলঘর। আমি হাতড়াতে হাতড়াতে সামনে এগোচ্ছি। হঠাৎ আমার মাথায় কী একটা এসে লাগল। জিনিসটা দুলে উঠল। দুলতে দুলতে দু-তিনবার আমার মাথা ছুঁয়ে গেল। আমি অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে ধরলুম। দুটো পা। ওপর দিকে তাকালুম। একটা দেহ। কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে। একজন মানুষ। আমি ভয়ে চিৎকার করে পড়ে গেলুম। স্বপ্নে পড়ে গেলে ঘুম ভাঙবেই। চিৎকারটা মনে হয় বেশ জোরেই করেছি। আমার ঘরের দরজা খুলে বিল্টুদা ঢুকলেন। দরজাটা কাল রাতে বাইরে থেকেই বন্ধ ছিল। এখন বুঝলুম। টানলেও খুলত না। তার মানে ডোবারম্যান আমার কিছু করতে পারত না। বিল্টুদার পরনে ঘোড়ায় চড়ার সাদা পোশাক। হাতে একটা হান্টার। দেবদূতের মতো দেখাচ্ছে। দু’হাতে হান্টারটা ধরে আছেন। মুখে সেই অপূর্ব হাসি, ‘কী হল পিন্টু? স্বপ্ন?’
‘হ্যাঁ, বিল্টুদা। আমি এক্ষুনি বাড়ি যাব।’
‘গুড। গুড বয়। আমি জানতুম। উঠে পড়ো। এক ঘণ্টার মধ্যে একটা ট্রেন আছে।’
সবে ভোর হচ্ছে। পুবের আকাশ আগুনের মতো লাল। কত পাখি যে ডাকছে একসঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি তৈরি হয়ে গেলুম। এলা বললে, ‘সে কী, তুমি চলে যাবে। আমি ভেবেছিলুম, তুমি বেশ থাকবে। আমরা দু-জনে মিলে লেখাপড়া করব। গান শিখব। পিয়ানো বাজাব। বেড়াতে যাব। রিভলবার ছোঁড়া শিখব। ঘোড়ায় চড়া শিখব, আর তুমি কিনা চলে যাচ্ছ?’
এলার চোখ ছলছল করছে। এলাকে আমি অহঙ্কারী, অমিশুক ভেবেছিলুম। তা তো নয়।
বিল্টুদা বললেন, ‘ও তো একা থাকে, ভেবেছিল তোমাকে সঙ্গী পাবে? তুমি ছেলেটা কিন্তু খুব ভালো, অনেকটা স্বপ্নের মতো। তুমি এখানে থাকলে তোমাকে আমি তৈরি করে দিতুম। আমার মনে হয়, তুমি খুব বড়ো একজন আটিস্ট হবে।’
‘আমি আবার ফিরে আসতে পারি?’
‘অফকোর্স। মা, বাবা, গুরুজনদের অনুমতি নিয়ে আসবে। এই বাড়িতে আমার পরে আর কেউ নেই।’ এলা আমাকে একটা সুন্দর কলম উপহার দিল। আমি কী দেব? আমার তো কিছু নেই দেবার মতো। নীচের মাঠে একটো কুকুরের ট্রেনিং হচ্ছে। আগুনে রিং, কুকুরটাকে তার ভেতর দিয়ে লাফিয়ে যেতে হবে। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়লুম। দেখার মতো দৃশ্য। আগুনের রিংটা দু-জনে দু-পাশ থেকে ধরে আছে। আর একজন কুকুরটাকে বোঝাচ্ছে, যদি ওর ভিতর দিয়ে এপাশে আসতে পার, তা হলে এই বড়ো মাংসের টুকরোটা পাবে।
বিল্টুদা বললেন, ‘কুকুরটাকে তিন দিন না খাইয়ে রাখা হয়েছে। ওই মাংসের টুকরোটার জন্যে ও এখন জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারে।’
‘ওর মুখ-চোখ দেখে আমার ভীষণ দুঃখ হচ্ছে। কী করুণ!’
‘দুঃখ এলে কোনো-কিছু শেখানো যায় না। শিক্ষককে কঠোর হতে হবেই, ছাত্রের কল্যাণের জন্যে। দয়ামায়া করলেই ভবিষ্যৎ গেল। কুকুরটা যখন সব শিখে যাবে তখন এর কী খাতির হবে জান! কত টাকা রোজগার করবে জান? সাধারণ একজন মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। এ কী হবে জান তো, গুরু মারা চেলা!’
স্টেশনে এসে, ট্রেনের কামরায় বসে বিল্টুদা আমার ঠিকানাটা লিখে নিলেন, আর তাঁর একটা কার্ড আমাকে দিলেন। কার্ডটা হাতে নিয়ে চমকে গেলুম। আসল নাম বিরাজ বসু, এক্স আই. পি. এস.। আই. পি. এস. তো পুলিশের বড়ো অফিসার হন। আবার এম. এসসি-(ক্যান্টাব)। মানে বিদেশে লেখাপড়া শিখেছেন। নিজেকে ভীষণ ছোটো মনে হচ্ছে। বটগাছের পাশে, চারাগাছ।
ট্রেন ছাড়ার সময় হল। বিল্টুদা বললেন, ‘ওই কুকুরটা, আর গল্পের শেয়ালটাকে সারাজীবন মনে রেখো। কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। জীবন থেকে পালাবে না, জীবনের ভেতর ঢুকে যাবে সাহস করে। জীবন হল জ্বলন্ত একটা রিং, তার ভেতর দিয়ে অক্লেশে চলে যাওয়াটাই হল শিক্ষা। আর এইটা যিনি শেখাতে পারেন তিনিই শিক্ষক। আবার এসো। এলাকে নিয়ে একদিন তোমাদের বাড়িতে আমি যাব।’
ট্রেনটা যখন ধীরে-ধীরে চলতে শুরু করেছে তখন বিল্টুদা শেষ কথা বললেন, ‘কারো মতো হবার চেষ্টা করবে না, নিজের মতো হবে। সন্ধ্যের ঝোঁকে বাড়ির কাছাকাছি এসে নিজের থেকেই পা দুটো যেন অচল হয়ে গেল। একটা বাঁক ঘুরলেই বাড়ি। তৃষার তেলেভাজার দোকানের সামনে দাঁড়াতেই সে ছুটে এল, ‘কোথায় ছিলে তুমি? ছিছি।’
‘কেন তৃষা?’
‘সে আমি বলতে পারব না। তুমি আগে বাড়ি যাও।’
আমি টলতে-টলতে বাড়ির দিকে এগোতে লাগলুম। আমার পা আর চলছে না। কী হয়েছে, কী হতে পারে! আমি শামুকাকার রকে বসে পড়লুম। বসেই মনে হল, বিল্টুদা বলেছেন, ‘জীবনকে পিঠ দেখাবে না, মুখ দেখাবে।’ আবার উঠে পড়লুম। বাড়ির বাইরেটা থমথম করছে। দরজাটা হাটখোলা। উঠোনের রকে মা বসে আছেন। তাঁকে ঘিরে আছেন পাড়ার মহিলারা।
হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে কে একজন বললেন, ‘দিদি ওই যে এসেছে।’
আমি মা বলে যেই দু’ পা এগিয়েছি, মা অমনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘তাড়া, তাড়া, শয়তানটাকে মেরে তাড়া।’
মায়ের হাতের কাছে স্টেনলেস স্টিলের একটা গেলাস ছিল সেইটা সজোরে ছুঁড়ে মারলেন। আমার কপালের একপাশে সজোরে লেগে গেলাসটা পড়ে গেল পায়ের কাছে। ভীষণ লেগেছে। আমি সেইখানেই বসে পড়লুম। মা কেঁদে উঠলেন। একজন এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘তুমি শিগগির শ্মশানে যাও। তোমাকে খুঁজতে গিয়ে তোমার জ্যাঠামশাই গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছেন কাল রাতে মেডিকেল কলেজের সামনে।’
তীরবেগে দৌড়োতে লাগলুম শ্মশানের দিকে। কোথা থেকে ভীষণ বল এসে গেছে শরীরে। আমার কপালের পাশ দিয়ে কী-একটা গড়াচ্ছে। হোঁচট খেয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলের নখটা উড়ে গেল। হোক, যত কিছু আছে সব আমার হোক। আমিও কেন গাড়ি চাপা পড়ি না, তা হলে আমার জ্যাঠামশাইয়ের কাছে এক্ষুনি চলে যেতে পারি।
শ্মশানে জ্যাঠামশাইকে তখন চিতায় তোলা হবে। ফুলের বিছানায় তিনি শুয়ে আছেন। মুখটা যেন ফুটে আছে পদ্মের মতো। জানি কীসের আনন্দ! আমাদের ফেলে জ্যাঠাইমার কাছে যাবার আনন্দ।
বাবা আমাকে কিচ্ছু বললেন না, একটাও কথা নয়। শুধু আর-একজনকে বললেন মুখাগ্নিটা ওই করুক।’ আমাদের সেই ছাত। সেই ছাতের ঘর। সবই আছে, তিনি নেই। কে ভেঙে-ভেঙে আমার মুখে একটু-একটু করে কচুরি আর জিলিপি ঢুকিয়ে দেবেন। কে আমার মাথা বুকে চেপে ধরে বললেন, ‘কিচ্ছু ভেবো না, তুমি অনেক অনেক বড়ো হবে।’ ওই সিঁড়িতে একজোড়া চটির শব্দ আর উঠবে না।
একঝাঁক কাক, কা-কা করে শুধুই খুঁজে যাবে একজন প্রিয় মানুষকে। রথের মেলা থেকে যে গোলাপের চারাটা এনে জ্যাঠামশাই পুঁতেছিলেন, সেই গাছটায় একটামাত্র সাদা গোলাপ ফুটেছে। ওইটাই আমার জ্যাঠামশাইয়ের মুখ। আমি ওই কুকুরটাকে মনে রেখেছি—জীবন এক আগুনের রিং, তার ভেতের দিয়ে গলে যেতে হবে অক্লেশে।