একটি কাঁঠালগাছ ও ঠাকুরদার শেষ স্মৃতি
সকালের ব্যস্ত মুহূর্তে হিমশিম খাচ্ছি হাতের কাজটা শেষ করতে, হঠাৎই ফোন এল ফুলকাকার, শুনেছিস, ওরা কাঁঠালগাছটা বিক্রি করে দিতে চাইছে।
কার কাঁঠালগাছ, কোথাকার কাঁঠালগাছ, ফুলকাকা তার কিছুই না বললেও আমি তাঁর কণ্ঠের উৎকণ্ঠা লক্ষ করে বুঝে গেলাম কথাটার অর্থ।
বহুকাল হল দেশের বাড়ির সঙ্গে আমার বা ফুলকাকার কারও কোনও সম্পর্ক নেই। প্রায় চল্লিশ বছর আগে দুজনে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে পড়তে দেশের বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম কলকাতায়। চলে এসেছিলাম ঠিকই, কিন্তু তখনও স্থির ধারণা, যে-মাটিতে আমাদের শিকড় সেখানে ফিরে আসতে হবে কোনও একদিন। কলকাতায় এসে প্রায় প্রতিদিনই ফুলকাকা আর আমি আলোচনা করতাম দেশের বাড়ি নিয়ে, রোমন্থন করতাম ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতি। মনে মনে দিন গুনতাম আবার কবে যাব সেই ফেলে আসা মাটিতে।
সেই শিকড় তখনও পর্যন্ত বেশ শক্তপোক্ত ছিল কেন না জন্ম থেকেই সেই বাড়িতে আমাদের বসবাস, সেখানেই কাটিয়েছি জীবনের প্রথম পনেরোটা বছর, সেই পনেরো বছর মানে জীবনের গড়ে ওঠার সময়, আর কে না জানে প্রত্যেক মানুষের জীবনে শৈশব-কৈশোরই প্রকৃত ঐশ্বয, সেই ঐশ্বর্য কোনও মানুষ ভুলতে পারে না আমৃত্যু।
সেই যে চল্লিশ বছর আগে চলে এসেছিলাম, তার পরে কোনও বছর একবার, কোনও বছর দু-বার দেশের বাড়িতে যেতে হয়েছে নানা কারণে। কখনও আত্মীয়স্বজনের ছেলে বা মেয়ের বিয়েতে, বা তাদের বাচ্চাদের মুখেভাতে। কখনও যে-স্কুলে পড়েছিলাম সেখানকার কোনও উৎসবের আমন্ত্রণে। কলকাতা থেকে দুটো বা তিনটে বাস বদলে প্রায় ঘণ্টাচারেকের পথ হলেও নিজের বাড়িতে যাওয়ার আনন্দই ছিল আলাদা, সেই কারণেই জার্নিটা তেমন কষ্টকর মনে হত না কখনও। বরং কোনও একটা উপলক্ষ্য থাকলে নাচতে নাচতে যেতাম সবাই মিলে। ভিটেবাড়ির গন্ধে যেমন ফিরে পেতাম শৈশব-কৈশোরের দিনগুলি, তেমনই দেখা হত ছোটোবেলার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, সারাদিন তাদের সঙ্গে কাটিয়ে সন্ধের বাস ধরে আবার ফিরে আসতাম কলকাতায়। তবে বিয়েটিয়ের অনুষ্ঠান থাকলে রাত্রিটা কাটাতে হত।
কলকাতায় তখনও নিজেদের কোনও বাড়ি ছিল না, থাকতে হত ভাড়াবাড়িতে। ফলে কলেজের ভর্তির ফর্মে হোক, চাকরির কোনও পরীক্ষার ফর্মে হোক, কিংবা সরকারি কোনও রেকর্ডের প্রয়োজনে হোক, অস্থায়ী ঠিকানা হিসেবে লিখতাম কলকাতার ভাড়াবাড়িটার ঠিকানা, কিন্তু স্থায়ী ঠিকানা লিখতাম দেশের বাড়ির ঠিকানা।
দেশের বাড়ির ঠিকানা কতদিন যে আমাদের ‘পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস’ ছিল তা এখন আর মনে নেই, তবে সম্ভবত কলকাতায় ভাড়াবাড়িতে বহুদিন একটানা থাকার ফলে ও দেশের বাড়িতে যাতায়াত কমে আসার কারণে সেই অস্থায়ী ঠিকানাটিও কোনও একদিন লেখা হয়েছিল স্থায়ী ঠিকানার ঘরে।
তবু সত্যি বলতে কি দেশের বাড়ির স্মৃতি ও গন্ধ দীর্ঘকাল পরেও ম্লান হয়নি একরত্তিও। পরবর্তীকালে এমন হয়েছে দেশের বাড়িতে যেতে হয়তো পার হয়ে গেল তিন বা চার বছর, কিন্তু সেই বাড়ির অস্তিত্ব গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে মনের ভিতর।
তবে দীর্ঘদিন পরে কখনও যেই না পৌঁছেছি দেশের বাড়ি, অমনি সেখানকার আত্মীয়স্বজনরা মুহূর্তে হিসেব করে বলে দেয়, এবার তুমি চার বছর পরে এলে!
চমকে উঠে বলেছি, সে কী! এই তো সেদিন ঘুরে গেলাম, বিয়েবাড়িতে কত হইচই হল!
যার বিয়েতে এসেছিলাম তার কোলে তখন আড়াই বছরের বাচ্চা, সে হেসে তার বাচ্চাটাকে মেলে ধরল আমাদের সামনে!
মনে মনে দমে গেলেও হিসেব যেন মেলাতে পারি না কিছুতেই। মনে হত এই তো সেদিন!
আসলে দেশের বাড়ির সঙ্গে ছোটোবেলার অনেকগুলো বছর লেপ্টে থাকার ফলে এখানকার প্রতিটি ধুলোর কণাও যেন আমাদের পরিচিত। বাস থেকে নামতেই পরের পর মিলে যায় সেই অশ্বত্থ গাছ, সেই নদীর বাঁক, সেই রথতলা, সেই কালীবাড়ি, সেই মুচকন্দ ফুলের গাছ।
ইছামতী নদীর ধারে আমাদের সেই বাড়ির বৃত্তান্তটা একটু বলে নেওয়া যাক। ওপার বাংলা থেকে আমার ঠাকুর্দা সপরিবারে এসে বিখ্যাত নদীটির তীরে একখণ্ড পতিত জমি পরিষ্কার করে প্রথমে একটি খড়ের ঘর, তার কয়েক বছর পর টালির বাড়ি, আরও ক-বছর পর শুরু করেছিলেন পাকাবাড়ির গাঁথনি। পাশাপাশি চারখানা ঘর ছিল, তার মাঝের ঘরটিতে ছিল আমার আর ফুলকাকার শোয়া-বসা-পড়া। আমি কখনও পড়ার বই চাপা দিয়ে চুপিচুপি পড়ে ফেলতাম শিশু ও কিশোর সাহিত্যের মন-ভালো-করে দেওয়া বইগুলি। কখনও কবিতা লেখার খাতা খুলে লিখতাম ছন্দ আর মিল দিয়ে লেখা এক-একটি ছড়া। নিজের কৃতিত্বে মশগুল হয়ে থাকতাম কিছুক্ষণ। হঠাৎ ঘোর কেটে গিয়ে মনে হত, এই রে, সামনেই তো পরীক্ষা, এত ফাঁকি দেওয়া মোটেই ভালো কাজ নয়!
ঠাকুর্দার সামনে তখন এক ভয়ংকর লড়াই তাঁর পরিবারের ভরণপোষণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে। নির্দিষ্ট কোনও চাকরি ছিল না তাঁর। রুজিরোজগারের জন্য ছুটে বেড়াতে হত সারাদিন।
সতেরো কাঠা জমিটির সদ্ব্যবহার করতে পোঁতা হয়েছিল দুটো নারকেল ও কিছু সুপারির চারা। নানা জাতের আমগাছ বসানো হয়েছিল, তাতে যেমন ফল ধরত, তেমনি দিত ছায়াও। ছিল একটি তেঁতুল গাছ, মাত্র কয়েক বছরে কীরকম বড়ো হয়ে গিয়েছিল ধাঁ ধাঁ করে। যত দূর মনে পড়ে তেঁতুল গাছটা কেউ পোঁতেনি! হয়তো ফেলে দেওয়া কোনও বিচি থেকে হঠাৎই একদিন জন্মেছিল ছোট্ট একটি চারা, তারপর দিনে দিনে ধারণ করেছিল একটি মহিরুহের আদল।
বাড়ির পিছনদিকে প্রায় সাত-আট কাঠা জমি ছিল যেখানে পোঁতা হয়েছিল নানা ফলফলারির গাছ। বহুবছর ধরে ছিল একটা কলাবাগান, অন্তত পনেরো-কুড়িটা ঝাড় হয়েছিল যাতে সারা বছর বড়ো বড়ো কলার কাঁদিতে ভরে থাকত। পেকে হলুদ হয়ে উঠলে সেই কাঁদি পাড়া হত একটার পর একটা। সে ছিল ভারী উল্লাসের দিন। সেই কলাবাগান একসময় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভারী আপশোস করেছিল বাড়ির সবাই। পরবর্তীকালে সেই জমিতে কখনও আদা, কখনও হলুদ ইত্যাদির চাষ করে আমার ঠাকুর্দা বেশ জমিদারি-জমিদারি অভিব্যক্তি ফোটাতেন মুখে।
বসানো হয়েছিল একটি জাম ও খুদে জাম গাছ। এক কোণে একটি লিচু গাছ। ছিল একটি ফলসা, গোটা তিনেক পেয়ারা গাছ। তার মধ্যে একটি কাশির পেয়ারা যার ভিতরের শাঁস ছিল চমৎকার লালচে। একটির নাম দিয়েছিলাম বোম্বাই পেয়ারা, তার এক-একটি পেয়ারা এত বড়ো হত যে, ধরত না আমাদের ছোটো ছোটো দুই হাতের মুঠোয়। এক কোণে লতিয়ে বেড়াত একটি করমচা গাছ, সেই করমচা গোটা বিশেক খেলে সকালের বা বিকেলের রুটি খাওয়া থেকে রেহাই নিতাম। একটি সবেদা গাছও একবার পোঁতা হয়েছিল যা বেশিদিন বাঁচেনি।
বসতবাড়ির সেই জমিতে এরকম একটি ছোটোখাটো ফলবাগিচা ছিল আমাদের ছোট্ট অহংকার।
ঠাকুর্দা তখন একটু একটু অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, সেসময় হঠাৎ একদিন সস্তায় পেয়ে নিয়ে এসেছিলেন অনেকগুলো নারকেল গাছ। তারপর একটা পুরো দিন ধরে বাড়ির চারপাশে গর্ত খোঁড়া হল, ঠাকুর্দা একটার পর একটা গর্তের ভিতর নিজের হাতে পুঁতলেন নারকেল গাছগুলো। বিকেলের দিকে তাঁকে খুব শ্রান্ত দেখাচ্ছিল, কিন্তু মুখে জ্বলজ্বল করছিল একঝাঁক তৃপ্তির হাসি।
পরে শুনেছি এতগুলি গাছ তিনি নিজের হাতে পুঁতেছিলেন তার কারণ গ্রামদেশে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, নিজের হাতে গাছ পুঁতলে সেই গাছের ফল না খেয়ে কেউ মরে না।
নারকেল গাছগুলোর অনেকগুলোই চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ফল দিয়েছিল, সেদিন ঠাকুর্দার কী আনন্দ!
আরও একটি গাছ ঠাকুর্দা বসিয়েছিলেন বসতবাড়িটার দক্ষিণদিকে। সেটি একটি কাঁঠাল গাছ। ঠাকুর্দার অসুখ তখন বেশ বাড়াবাড়ির পর্যায়ে। প্রায়ই ডেকে আনতে হচ্ছে সরকারি ডাক্তারকে। এলএমএফ হলেও তিনিই এই এলাকার সবচেয়ে নামী ও দামি ডাক্তার। তিনি প্রেসক্রিপশন করছেন আর মৃদু স্বরে বলছেন, ‘কলকাতায় নিয়ে গেলেই ভালো হত।’ কিন্তু তখন আমাদের যা অবস্থা তাতে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার জন্য যে-টাকার প্রয়োজন তা ছিল না।
সেই সময় পাড়ার এক শুভানুধ্যায়ী মাসিমা বলেছিলেন, ওঁকে দিয়ে আবার একটা গাছ পোঁতাও। তা হলে যদি—
কথাটা বাড়ির সবাইকার মনে ধরতে কাকাদের কেউ নিয়ে এসেছিলেন কাঁঠাল গাছের একটি চারা। ঠাকুর্দা তখন প্রায় চলচ্ছত্তিহীন। বিছানাতেই শুয়ে থাকেন বেশিরভাগ সময়। তবু সবাই তাঁকে কথাটা বলতে রাজি হয়েছিলেন চারাটা পুঁততে। বুঝতে পেরেছিলাম সংস্কারটা তাঁর মনেও ছিল প্রবলভাবে। সবাই তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে বসতে দিয়েছিলেন একটি মোড়ার উপর, সেখানে বসে কাঁপা কাঁপা হাতে ধরেছিলেন কাঁঠাল চারাটা, তারপর আগে থেকে কেটে রাখা একটি গর্তের মধ্যে চারাটিকে বসিয়ে দিতে আবার তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে আসা হয়েছিল ঘরের ভিতর বিছানায়।
কিন্তু এবারের উদ্যোগটা আর কাজে লাগেনি। ঠাকুরর্দার অসুখ এমন বাড়াবাড়ি হয়ে গেল যে, আর বেশিদিন ধরে রাখা যায়নি তাঁকে।
বাবারা পাঁচ ভাই, একে একে চার ভাই রুজিরোজগারের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলেন চারদিকে। পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেয়ে ডেরা বেঁধেছিলেন কেউ কলকাতায়, কেউ শহরতলিতে, কেউ পাশ্ববর্তী জেলায়। ততদিনে সবাই প্রায় সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেছেন দেশের বাড়ির সঙ্গে।
একমাত্র রাজুকাকা চাকরি না-জোটাতে পেরে রয়ে গিয়েছিলেন সেই ভিটেবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করতে। তাঁর সংসার ভালোমতো চলে না, এ-বাড়ির যা কিছু ফলফসল তাঁরই প্রাপ্য। ফলে গাছের ফল ধরলে তিনি সেগুলি বিক্রিবাঁটা করে মেটাতেন তাঁর অভাবের সংসারের চাহিদা।
আমরা তখন কলকাতায় থাকি বলে এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্যও হত না নিজেদের মধ্যে। আমাদের এজমালি সম্পত্তি সামান্য হলেও তিনি আগলাচ্ছেন এটাই ঢের!
সেই নারকেল গাছগুলো তখন বিশাল বিশাল আকার ধারণ করেছে, তার ডগায় ঝুলতে থাকে কখনও ডাব, কখনও দুম্বো, কখনও ঝুনো। আমরা বহুদিন পর পর দেশের বাড়িতে গেলে রাজুকাকা ব্যস্ত হয়ে বলতেন, ‘দাঁড়া, ক-টা ডাব পাড়াই।’ সেই ডাব লোক দিয়ে পাড়িয়ে কেটে আমাদের সামনে ধরতেন, স্টর ছাড়াই মুখ লাগিয়ে সেই জল ঢক ঢক করে খেলে খুব খুশি হতেন রাজুকাকা। যেন এ-বাড়ির সব কিছুরই উপর আমাদেরও তো সমান অধিকার।
হঠাৎ একদিন শুনেছিলাম বিশাল জামগাছটা নাকি কাকা ফড়ে ডেকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন নামমাত্র দামে। জামগাছটার উপর ছিল আমার আশৈশব দুর্বলতা। তখন নিতান্তই শিশু ছিল জামগাছটা, বৈশাখ মাস আসতে না আসতে তার কচি ডালগুলো ভরে উঠত টোপা টোপা জামে। কুচকুচে কালো সেই জামের খোসা সরাতেই নধর আর ঘন বেগুনি রঙের মিষ্টি শাঁস। আমি অনায়াসে তার নীচের ডালটা ধরে ঝুলে পড়ে এক হেঁচকায় উঠে পড়তাম উপরে, ডাল বেয়ে বেয়ে অনেকখানি উপরে উঠে বেশ জমিয়ে বসে একটার পর একটা জাম পাড়তাম, আর মুখে ফেলতাম টকাটক। ঘণ্টাখানেক ধরে চলত এই অসাধারণ অ্যাডভেঞ্চার। যখন নীচে নামতাম, আমার জিব ততক্ষণে ধারণ করেছে বেগুনিবর্ণ, আর গাছের নীচে ছড়িয়ে আছে বৃষ্টির ফোঁটার মতো অজস্র জামবিচি।
সেই জামগাছটা খুবই ঝাঁকড়া আর বড়ো হয়ে গিয়েছিল, তার ডালে চড়ার কোনও প্রশ্নই নেই, তবু সেটির বিক্রি খবর পেয়ে কেউই খুশি হতে পারিনি।
কিন্তু রাজুকাকাই বা করবেন কী! তাঁর কোনও নির্দিষ্ট রোজগার না-থাকায় হঠাৎ কিছু টাকার দরকার হলে এরকম করে মেটাতেন সেই অভাব।
এমনি করে একদিন কাটা পড়ল খুদে জাম গাছ।
বিশাল একটা তেঁতুলগাছ ছিল সেটাও হঠাৎ বিক্রি করে দিয়ে রাজুকাকা বলেছিলেন, তেঁতুল তো কোনও কাজেই লাগে না আমাদের!
সেবার আমি আর ফুলকাকা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম বিষয়টা আর বলতাম, যেমন একটা গাছ কাটা হয়ে গেল, তার পরিবর্তে আরও ক-টা নতুন গাছ তো পুঁততে পারে রাজুকাকা! তা হলে কালে কালে সেগুলো আবার বড়ো হতে পারে, ফল ধরতে পারে!
অত বড়ো তেঁতুলগাছটা কেটে ফেলা মানে পিছনদিকের বাগানটা আর চেনাই যাবে না! তেঁতুল গাছটা তার বিশাল ঝাঁকড়া চুল নিয়ে আজ কত্ত বছর দাঁড়িয়ে ছিল বাগানে! আমাদের সেই ছোটোবেলার কত দৌরাত্মেরর সাক্ষী ছিল সে।
আমি আর ফুলকাকা বলাবলি করতে থাকি, এভাবে একটি-একটি করে সব ক-টা বড়ো গাছ কাটা হয়ে গেলে আমাদের বাড়ির সেই ছায়াসুনিবিড় চেহারাটাই যাবে বদলে।
কিন্তু কলকাতায় বসে তো কোনও সুরাহাও করতে পারব না এই বৃক্ষনিধনপর্বের।
ইতিমধ্যে রাজুকাকা গত হয়েছেন, সেখানে বসবাস করছে তাঁর দুই পুত্র রিভু আর বিভু। তারা ইতিমধ্যে বিয়ে-থা করে সংসারও করছে স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে। সমস্যা হচ্ছে তাদের দুজনের রোজগারও তেমন আহামরি নয়, ফলে বাড়িটি মেরামত করার মতো অবস্থাও তাদের নেই, তেমনই রক্ষণাবেক্ষণ করে না সেই ফলবাগিচার।
আমরা কলকাতায় বসে মাঝেমধ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করি রিভু-বিভুর উদ্দেশে, বলাবলি করি, এতটা জমি শুধু-শুধু পড়ে আছে, কিছু নতুন গাছগাছালি তো লাগাতে পারে। তাতে তাদেরই তো সুসার হয়! আমরা তো আর কেউ ও-বাড়িতে যাচ্ছি না ভাগ নিতে।
এরকম আলোচনার দিনে একদিন রিভু-বিভু কলকাতায় চলে এল আমার ফুলকাকার সঙ্গে কী জরুরি কথা বলতে। এ-কথা সে-কথার পর বলল, তোমরা তো কেউ আর দেশের বাড়িতে যাও-টাও না, এখন তো আমরা দুই ভাই থাকি। শুনছি নাকি সেটেলমেন্ট থেকে নতুন রেকর্ড হবে আমাদের গাঁয়ের জমি, তা—
বলে কথায় একটু যতি দিয়ে বলল, আমাদের বাড়ির জমিটা যদি আমাদের দু-ভায়ের নামে না-দাবি লিখে দাও, তাহলে বাড়িটা আমাদের নামে রেকর্ড হয়।
প্রস্তাবটা এমনই অপ্রত্যাশিত যে, আমি আর ফুলকাকা দুজনেই কিছুক্ষণ বুঝে উঠতে পারলাম না বিষয়টা। পরক্ষণে বললাম, তা কী করে হবে!
আমাদের চোখে অপার বিস্ময় দেখে হয়তো রিভু-বিভুর চোখেও বিস্ময়ের সরোবর। একটু থেমে বলল, তোমাদের তো এদিকে বাড়িঘর হয়ে গেছে, কেউ আর দেশের বাড়ি থাকতে যাবে না কখনও, তা হলে না-দাবি লিখে দিতে আপত্তি কেন?
ফুলকাকাই বলল, শুধু তোদের দুজনের নামে বাড়ি হলে বাড়তি কী সুবিধে হবে তোদের? বরং যেরকম আছে সেরকমই থাকুক না! পাঁচ ভাইয়ের এজমালি সম্পত্তি। শুধু তোরা থাকিস ওখানে। তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না! চার ভাইয়ের এখন অনেক উত্তরাধিকারী। তাদের কার কী মত তা তো বলতে পারব না! এখন সবাইকার মতামত জোগাড় করাই হবে কঠিন। সবাই এক জায়গায় বসে আলোচনা না করলে এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত শুধু আমরা দুজন নিতে পারব না। বরং যেমন আছে তেমনই থাকুক।
রিভু-বিভু মুখ কালো করে ফিরে গেল দেশের বাড়িতে। আমি আর ফুলকাকা বুঝে উঠতে পারলাম না রিভু-বিভুকে এভাবে ফিরিয়ে দেওয়া ঠিক হল কি না!
কিন্তু যে-কথাটা আমরা উচ্চারণ করতে পারলাম না তা হল দেশের বাড়ির ভিটেমাটিতে আমরা কখনও ফিরে যাব না, তার মালিকানাও দাবি করব না কখনও, কিন্তু সেই ভিটেবাড়ি থেকে এত দূরে বসবাস করেও প্রতি মুহূর্তে সেই বাড়িটার উপর কী অপরিসীম মমত্ব অনুভব করি। সেই সতেরো কাঠা জমির মধ্যে আজও রয়ে গেছে আমাদের শৈশব-কৈশোর। এখনও যত বছর পরেই সেখানে যাই না কেন, সেই জমিটার ভিতর এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে পা দিই, ঘুরে ঘুরে দেখি কোথায় সেই লতার আমগাছটা, এখনও তাতে প্রতি বছর আম হচ্ছে কি না! কোথায় সেই বিশাল গাম্বুল গাছটা! সেই ইছামতীতে আজও জোয়ার-ভাটা খেলে কি না! স্নান করার জন্য যে চৌবাচ্চাটা করা হয়েছিল, তার চাতালটা আরও কতখানি ভেঙে গেছে!
যে-ঘরগুলোয় আমরা থাকতাম, যে-ঘরের মধ্যে জড়িয়ে আছে আমাদের প্রতিদিনকার স্মৃতি, সেই ঘরগুলি আর সেভাবে মেরামত না হওয়ায়, একটু একটু করে ধসে পড়েছে তার কয়েকটা দেওয়াল। চারখানা ঘর ভেঙেটেঙে এখন সেখানে অস্তিত্ব আড়াইখানা ঘরের। বাড়িটা পুরনো আর ঝরঝরে হয়ে গেলেও সতেরো কাঠার উপর অতি যত্নে তৈরি করার বাগানটার কিছুটা তো আছে! আজও বাড়ির চারদিকে প্রহরীর মতো রয়ে গেছে নারকেল গাছগুলি। আর ঠাকুর্দার পুঁতে যাওয়া সেই কাঁঠালগাছটাও।
সেই কাঁঠালগাছটা বিক্রি করতে চাইছে শুনে ভিতরে ভিতরে বেশ বিদ্রোহ হয় আমার মনে। কাঁঠালগাছটা যেদিন পোঁতা হয়েছিল সেই দিনটা আজও স্পষ্ট মনে আছে আমার। গাছটা বসানোর মুহূর্তে ঠাকুর্দার অভিব্যক্তিতে দেখেছিলাম এক অদ্ভুত আলো। ডাক্তার তখন প্রায় ‘জবাব’ দিয়ে গেছেন, কিন্তু সে-কথা তাঁকে বলা হয়নি, তাই মৃত্যুপথযাত্রীরও যেমন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশা থাকে হয়তো কোনও অলৌকিক শক্তিতে বেঁচে উঠবেন, শুরু করবেন নতুন জীবন, তেমনই ঠাকুর্দার বলিরেখাময় মুখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছিল এক আশ্চর্য আলোর রশিম, তাঁতে প্রতিফলিত নতুন করে বাঁচার প্রেরণা।
আজ এতদিন পরে সেই কাঁঠালগাছ কেটে ফেলার পরিকল্পনা করেছে রিভু-বিভু, তাতে কি কখনও সায় দিতে পারি আমরা!
আমাদের আপত্তি জানানোর আগেই খবর পেয়ে যাই কাঁঠালগাছটা বিক্রি হয়ে গেছে। একজন ফড়ে তার শিকড়সুদ্ধ কেটে নিয়ে গেছে ভ্যানবোঝাই করে।
এক মুহূর্তে বাড়ির সামনে, দক্ষিণ দিকের সেই কাঁঠালগাছটার বিশাল শূন্যতা বিশালতর হয়ে ওঠে আমার চোখের সামনে। যেন বাড়িটার একটা আব্রু ছিল, হঠাৎ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে সেই আব্রু। সেই সঙ্গে বিপন্ন হয়ে গেল আমাদের শৈশব-কৈশোরের অস্তিত্বও। লোপ পেয়ে গেল ঠাকুর্দার জীবনের শেষ দিনগুলোর স্মৃতিও।