একটি উপকথা

একটি উপকথা
A Fable

কোন এক সময়ে একজন শিল্পী একটি খুব সুন্দর ছোট ছবি এঁকে সেটাকে এমনভাবে রাখল যাতে আয়নায় ছবিটি পুরে ছায়াটা দেখতে পাওয়া যায়। এতে দূরত্বটা দ্বিগুণ হওয়ায় ছবির রেখাগুলো নরম হয়ে ওঠে এবং ছবিটা আগের চাইতে দ্বিগুণ মনোরম

শিল্পীর বাড়ির পোষা বিড়ালটির মুখে এই কথা শুনল বনের সব পশু রা; তারা ঐ বিড়ালটি কে খুব প্রশংসার চোখে দেখত, কারণ বিড়ালটি ছিল শিক্ষিত, মার্জিত রুচি ও সভ্য; সে এমন অনেক কিছু তাদের বলত যা তারা আগে জানত না বা জানলেও সে সম্পর্কে নিশিচত ছিল না। এবার তারা বিড়ালের মুখে আয়নার ছবিটির ছায়া সম্পর্কে এই নতুন কথা শুনে খুব উৎসুক হয়ে উঠল। ব্যাপারটা ভাল ভাবে বুঝবার জন্য এ সম্পর্কে নানারকম প্রশ্ন করতে আরম্ভ করল। তারা যখন জিজ্ঞাসা করল ছবিটা কি জিনিস তখন বিড়াল ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল। সে বলল, এটা একটা সমতল জিনিস। খুব সুন্দরভাবে সমতল, আশচর্য রকমের সমতল, এর সমতলত্ব দেখে মুগ্ধ হতে হয়; আর কী সুন্দর!

এই কথা শুনে বনের পশু দের উত্তেজনা মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। তারা বলল, পৃথিবীর বিনিময়েও তারা ছবিটা দেখবে। তখন ভলুক জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, কিসের জন্য ছবিটাকে এত সুন্দর মনে হয়?

ছবিটা দেখতেই সুন্দর বলে বিড়াল বলল।

এই উত্তর শুনে পশু দের মনের আকর্ষণ ও অনিশ্চয়তা আরও বেড়ে গেল। তারা আগের চাইতেও বেশী উত্তেজিত হয়ে পড়ল। তখন গরু জিজ্ঞাসা করল;

আয়না কাকে বলে?

বিড়াল বলল, আয়না হল দেয়ালের মধ্যে একটা গর্ত। তুমি যদি তার দিকে তাকাও তাহলেই ছবিটা দেখতে পাবে আর সে ছবি এত সুন্দর, এত সূক্ষ্ম, এত স্বর্গীয় যে তার অকল্পনীয় সৌন্দর্য তোমাকে এতই অনুপ্রাণিত করবে যে তোমার মাথা ঘুরতে থাকবে, অতি-আনন্দে তুমি মুছিত হয়ে পড়বে।

গাধা এতক্ষণ একটি কথাও বলে নি; এবার সে এ ব্যাপারে একটু সন্দেহ প্রকাশ করতে আরম্ভ করল। সে বলল, এত সুন্দর কোন জিনিস এর আগেও ছিল না এবং আজ নেই। তার মতে যখন কোন জিনিসের সৌন্দর্য বিরাট বিশেষণ যোগ করে গলাবাজি করা হয় তখন সে সৌন্দর্য সন্দেহের অবকাশ রাখে।

স্বাভাবিকভাবে এই সন্দেহ পশু দের মধ্যে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। আর তাতে বিড়ালটি অসন্তুষ্ট হয়ে চলে গেল। দিন। দুয়েকের মধ্যে এ ব্যাপারে আর কেউ কোন উচচ বাচ্য করল না; কিন্তু পরে আবার নতুন করে উৎসাহ দেখা দিল এবং সকলের আগ্রহ স্পষ্ট চোখে পড়ল। তারা তখন গাধাটাকে খুব বকাবকি করল, কারণ সে বিনা প্রমাণেই ছবিটা সুন্দর নয় বলে সন্দেহ প্রকাশ করায় তাদের এত বড় একটা সম্ভাবিত আনন্দকে নষ্ট করে দিয়েছে।

এত বকুনি খেয়েও গাধাটা কিন্তু বিচলিত হল না। সে খুব ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে বলল, তার আর বিড়ালের মধ্যে কে ঠিক বলেছে সেটা স্থির করবার একটাই উপায় আছে: সে নিজেই সেখানে গিয়ে গর্তটা দেখে এসে বলবে সে কি দেখল। পশু রা এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল আর খুসি হয়ে গাধাকে সেখানে যেতে বলল–গাধাও তাদের কথামত কাজ করল।

কিন্তু সে জানত না ঠিক কোথায় দাঁড়াতে হবে, তার জন্য সে ভুল করে আয়না আর ছবিটার মাঝ খানে দাঁড়াল। তাতে ফল হল-আয়নার ছবিটাকে দেখাই গেল না। গাধাটা ফিরে এসে বলল:

বিড়াল মিথ্যে কথা বলেছে। ঐ গর্তে একটা গাধা ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। কোন সমতল জিনিসের চিহ্নমাত্রও সেখানে চোখে পড়ল না। যদিও সেটা খুব সুন্দর আর ভাল একটা গাধা, তবুও সেটা শুধু একটা গাধা ছাড়া আর কিছুই নয়।

হাতি জিজ্ঞাসা করল, তুমি কাছের থেকে খুব পরিষ্কারভাবে দেখেছিলে তো?

ওহে পশু রাজ হাতি, আমি খুব কাছ থেকে পরিষ্কার দেখছি। আমি এত কাছে থেকে দেখছি যে আমার নাক আয়নাটাতে লেগে গিয়েছিল।

হাতি বলল, এতো বড় তাজ্জব ব্যাপার। যতদূর জানি বিড়ালটা তো সব সময়ই আমাদের সত্যি কথাই বলে। তার চেয়ে বরং আর একজন সাক্ষী পাঠিয়ে দেখা যাক। ভালুক, তুমি বরং যাও, গর্তটা দেখ, তারপর ফিরে এসে বল কি দেখলে।

ভালুক তখন সেখানে গেল। ফিরে এসে বলল: বিড়াল আর গাধা দুজনেই মিথ্যে কথা বলেছে। গর্তে একটা ভালুক ছাড়া আর কিছুই নেই।

পশু রা তো এবার অবাক হয়ে মহা ধাঁধায় পড়ে গেল। প্রত্যেকেই তখন নিজে গিয়ে দেখতে চাইল আসলে ব্যাপারটা কি। হাতিও তাদের এক এক করে পাঠাতে লাগল।

প্রথমে গেল গরু। গর্তে একটি গরু ছাড়া আর কিছুই সে দেখতে পেল না।

বাঘ একটা বাঘ ছাড়া আর কিছুই দেখল না। সিংহ, সিংহ ছাড়া আর কিছুই দেখল না।

চিতা দেখল শুধুই একটা চিতাবাঘ। উট ও দেখল একটা উট, আর কিছু নয়।

হাতি তখন ভীষণ রেগে গিয়ে ঠিক করল, সে নিজেই গিয়ে আসল সত্যটা জেনে আসবে। ফিরে এসে সে সমস্ত প্রজাদের মিথ্যে কথা। বলবার জন্য খুব বকুনি দিল এবং বিড়ালের নৈতিক ও মানসিক অন্ধত্বের জন্য এমন রেগে গেল যে, তাকে আর শান্ত করা গেল না। সে বলল, একটা আধকানা মূর্খ ছাড়া সকলেই ঐ গর্তে একটা হাতি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না।

বিড়ালের শিক্ষা

তুমি যদি তোমার কল্পনার আয়না এবং বাস্তবের মধ্যে দাঁড়াও তাহলে তুমি যা কিছু সঙ্গে নেবে তাই সেখানে দেখতে পাবে। তোমার কান দুটো যদি সেখানে নাও দেখতে পাও, তবু জানবে কান দুটো সেখানেই আছে।

[১৯০৯]

অনুবাদ: ঈশিতা দত্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *