একটি আষাঢ়ে গল্প

একটি আষাঢ়ে গল্প

‘‘There are more things in heaven and earth Horatio, than are dreamt of in your philosophy.’’

বাংলা করলে দাঁড়ায়—হোরেসিও কত্তা, স্বর্গে আর নরকে এ্যয়সা কিছু চিজ আছে, যার কথা তোমাদের দাড়িওয়ালা আঁতেল দার্শনিকরা প্রাণীকুলের রোলকলের খাতায় লিখে উঠতে পারেননি৷

স্বর্গের প্রাণীদের নিয়ে আমাদের তেমন আগ্রহ নেই; আমরা উঁকি দেব, নরকে৷ আজকের গল্পে, কিছু নরকের প্রাণীকে হাজির করব আমরা৷ তবে তাঁরা তো আর এমনি-এমনি আসতে চান না! আসুন একটা কাজ করা যাক৷ আমরা সবাই গোল হয়ে বসে চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকি—আমাদের ছোটবেলায় পড়া কোনও গল্পের কথা৷ এমন কোনও গল্প, যা আস্তে-আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছে আমাদের স্মৃতিতে, অথচ, সেই বইটা গেছে হারিয়ে৷

আপনি তো ভুলে চলেছেন; কিন্তু গল্পের চরিত্ররা কি ভুলতে পেরেছে আপনাকে? নাকি এখনও, আপনার চোখ চেয়ে অপেক্ষা করছে তারা? কে বলতে পারে?!

নদীর ধারে এসে দাঁড়ালাম আমরা৷ এতক্ষণে আকাশের চাঁদ কালো মেঘে ঢাকা পড়ে গেছে; সুতোর মতো ফিনফিনে আলো তার ফাঁক গলে এসে পড়ছে নদীর জলে৷ সেই সঙ্গে একটা মিহি হাওয়া৷ নিশার মনে হয় মনটা ফুরফুরে হয়ে এসেছে এতক্ষণে৷ সে গুনগুনিয়ে কী একটা যেন গান ধরেছে৷ গানের সুরটা চেনা-চেনা লাগল আমার৷

কাল রাতে যে লোকটাকে মেরে খেয়েছিলাম সেই লোকটা বোধহয় সুরকার ছিল৷ নিশা আবার পুরুষ মানুষের মাথা খেতেই ভালোবাসে৷ সেই সুরকারের মাথা কড়মড়িয়ে খাওয়ার পর থেকেই সুরটা ভাঁজার চেষ্টা করছে৷

‘এ কী গো? নদী আছে, নৌকা বাঁধা আছে, মাঝি কই?’

আমিও চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, সত্যি, পাড়ে নৌকা বেঁধে রেখে মাঝি গায়েব৷ বিড়বিড় করে বললাম, ‘ভূতেদের নিয়ে এই এক সমস্যা, ব্যাটারা কখন যে দেখা দেয় আর কখন ধোঁয়া হয়ে যায় বোঝা মুশকিল৷’

‘ওই যে, ওই যে, ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে৷’

আমি আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম, খানিক দূরে সত্যি বাদার বনের উপরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকাচ্ছে, ল্যাং বাড়িয়ে একটু দেখে নিয়ে বললাম, ‘ধুর, ওটা ভূত নয়, কে একটা যেন কচুবনে লুকিয়ে গাঁজা টানছে, তার ধোঁয়া৷ তোমারও আক্কেল বলে নেই…’

কথাটা শুনেই নিশা গদগদ মুখে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘এই শোনো না, আমার গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে এসেছে…’

‘তো আমি কী করব? ফ্লাস্কে রক্ত আছে, বের করে খেয়ে নাও৷’

আদুরে গলা ভেসে এল, ‘ধুর, ও রক্তটা ভালো না, কেমন যেন সর পড়ে গেছে৷’

‘ইয়ার্কি? রক্ত কি দুধ যে সর পড়বে? ওটা খেলে খাও না হলে শুকিয়ে থাকো, আমি এখন অকারণে মানুষ খুন করতে পারব না৷ তাছাড়া দেখছ লোকটা কচুবনে গাঁজা টানছে৷’

‘তাতে কী হয়েছে?’

‘মশারা এমনিতেই ওর রক্ত স্পঞ্জের মতো চুষে নিয়েছে৷ পারলে ক-টা পুরুষ্টু মশা-টশা মেরে চিবিয়ে নাও৷’

নিশা রাগী-রাগী মুখ করে কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় পিছন থেকে হিমের মতো ঠান্ডা গলা ভেসে এল, ‘আপনারা কি আমাকে খুঁজছেন?’

আমরা পিছন ফিরে দেখলাম, অন্ধকার মেখে একটা তালঢ্যাঙা লোক বৈঠা হাতে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার গা থেকে টপটপ করে জল পড়ছে৷ মাথার চুল সব ভিজে, পরনে একটা খাটো করে পরা ছেঁড়া লুঙ্গি আর নোংরা গোলগলা কুড়িয়ে পাওয়া টি-শার্ট৷ টি-শার্টের উপরে কী যেন একটা লেখা আছে, ভালো করে খেয়াল করলাম—নট এফ্রেইড অফ ডেথ৷ বুঝলাম এই সেই ভূতুড়ে মাঝি৷

আমি নিজেই এগিয়ে গিয়ে মাথা নেড়ে বললাম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনার সঙ্গেই তো কথা হয়েছিল৷’

লোকটা মুখ দিয়ে একটা ঘোঁত-ঘোঁত আওয়াজ করে পাড়ে বাঁধা নৌকার দিকে এগিয়ে গেল৷ নিশা ফ্লাস্ক থেকে একটু রক্ত গলায় ঢেলে মুখ মুছতে- মুছতে বলল, ‘আচ্ছা যদি কিছু মনে না করেন, আপনার গা থেকে কি সারাক্ষণই জল পড়ে?’

নৌকা বাঁধার দড়িটা খুলতে-খুলতে লোকটা ঘাড় নাড়ে৷

‘মনে হয় জলে-টলে ডুবে মরেছিল…’ ভাবুক গলায় বলে নিশা৷

আমি বললাম, ‘এই ভালো৷ বাথরুম-টাথরুম করে আর জল দেবার দরকার পড়ে না, একটু দাঁড়িয়ে থাকলেই সব পরিষ্কার৷’

নাক সিঁটকানো স্বরে নিশা উত্তর দিল, ‘উঁহু, আমার তো মনে হয় আলাদা করে বাথরুম করারও দরকার পড়ে না৷ কোনটা কিসের জল সেটা লোকে তো বোঝে না, করে দিলেই হল৷ ছ্যাঃ ছ্যাঃ! এতটা রাস্তা এর সঙ্গে যেতে হবে? আর অন্য মাঝি পেলে না?’

‘আর বলো না, মাঝিরা সব এখন বাংলা গানে চলে যাচ্ছে৷ গল্পে ভূতুড়ে মাঝি পাওয়া মুশকিল৷ বাংলা গীতিকারদের…’

হঠাৎ করে আমাদের কথার মাঝেই খনখনে গলায় মাঝি বলে উঠল, ‘একশো আট৷’

‘অ্যাঁ?’

‘আমার ভাড়া, ওটা আগে দিয়ে দিতে হবে৷’

‘শালা, মরেও টাকার খাই যায়নি৷’ নিশা বিড়বিড় করে বলে৷

‘আপনি অ্যাডভান্স নেন নাকি?’ জিজ্ঞেস করলাম৷

‘নেওয়া ছাড়া উপায় কী বলুন? শেষবার মদ খেয়ে নৌকা চালাতে গিয়ে মাঝগঙ্গায় জলে ডুবে মরলাম, টাকাটা উসুল করা হল না, তারপর থেকেই…’

আমি পকেট থেকে একটা একশো টাকা আর চারটে দু-টাকা বের করে তাকে দিতে গেলাম, সে মাথা নেড়ে বলল, ‘সারা গা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে বাবু, টাকা রাখব যে ভিজে যাবে তো…’

‘তাহলে উপায়?’

‘পে টি এম করে দিন৷’

‘অ্যাঁ!’

‘কিউ আর কোড এই বৈঠার হাতলে পাবেন… এই নিন৷’

এতক্ষণে চাঁদের গা থেকে মেঘ সরে গেছে৷ হালকা রূপালি আলোয় আমাদের তিনটে অ-মানুষের শরীর ভেসে যাচ্ছে৷ নিশা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখে বলে, ‘দাড়িটা কতদিন কাটোনি, মুখের কী অবস্থা হয়েছে দেখেছ?’

‘কালকেই কেটেছি৷ ওটা দাড়ি নয়, লোম৷’

‘ওঃ! আজ তো পূর্ণিমা৷ নেল কাটার আর ট্রিমার এনেছি, চিন্তা কোরো না৷’

আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনছিল বোধহয় মাঝিটা, সেরকম হিলহিলে গলায় বলে, ‘আচ্ছা দাদা, আপনি কি তার মানে…’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি ওয়ারউলফ!’

‘সেকি!’

‘সেকির কী আছে?’ আমি খেঁকিয়ে উঠলাম, ‘বিদ্যাসাগর পুরুষসিংহ ছিল, তখন কোনও আপত্তি করেননি৷ আমি পুরুষ নেকড়ে হয়ে গেলেই যত সমস্যা?’

মাঝি একটু মুষড়ে পড়ল৷ দাঁড় টানতে-টানতে নিশার দিকে দেখিয়ে বলল, ‘আর উনি?’

‘উনি আমার স্ত্রী, ডাইনি৷’

‘ছি ছি, আপনি একটি মেয়েকে ডাইনি বললেন, ফেমিনিস্টরা জানতে পারলে…’

‘আরে ধ্যার মশাই, সত্যিকারের ডাইনি৷ ঝাঁটা নিয়ে আকাশে উড়ে বেড়ায়৷ মানুষ-টানুষ মেরে রক্ত খায়৷ একটু কালো বিড়াল হয়ে দেখিয়ে দাও তো গো…’

‘না, না৷ থাক থাক…’ লোকটা আর কথা না বাড়িয়ে দাঁড় টানতে লাগল৷ আমরা দু-জনে ছইয়ের ভিতরে এসে ঢুকে বসলাম৷ নিশা কাঁধের ঝোলাটাকে একদিকে নামিয়ে রেখে বসে পড়ল৷

‘আউউউউ…’ চিৎকার করে উঠলাম৷

‘কী হল তোমার? এখনও তো নেকড়ে হওয়ার সময় হয়নি৷’

‘ধ্যাত্তেরি, নেকড়ে নয়৷ হাতের উপরে বসে পড়েছ!’

‘ওঃ…’ জিভ কেটে একটু সরে বসল নিশা৷ ফ্লাস্ক থেকে বের করে আরেক ঢোঁক রক্ত খেয়ে নিল৷ সত্যি জোলো হাওয়ায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি৷

নৌকার তলা থেকে দাঁড়ের ছলাত-ছলাত আওয়াজ ভেসে আসছে৷ সেই সঙ্গে মাঝির গা বেয়ে টুপটুপ জলের শব্দ৷ লোকটার এতক্ষণে কৌতূহল জেগে উঠেছে, সে বাইরে থেকে প্রশ্ন করল, ‘তা আপনারা যাবেন কোথায়?’

‘নদীর ওপারে একটা ছোট মফসসল আছে, হানাপাড়া, চেনেন?’

‘আমি ভূত বাবু, হানাবাড়ি চিনি, হানাপাড়া চিনব কী করে?’

‘পান করতে গিয়েই তো জলে ডুবে মরেছ, তাও পান (pun) করার স্বভাব গেল না? তা আগে নিয়ে যাওনি কাউকে?’

‘পঞ্চাশ বছর কেটে গেল, কেউ ওঠেনি আমার নৌকায়৷’

‘নৌকার যা কন্ডিশন দেখছি, পরের পঞ্চাশ বছরেও কেউ উঠবে না৷ হ্যাঁ গো, গুগল ম্যাপেও কিছু দেখাচ্ছে না?’

‘উঁহু, তোমার ডাইনিবিদ্যায় কোনও উপায় নেই?’

‘আছে… কিন্তু… কিন্তু একটু নোংরা উপায়৷’

‘কী রকম?’

ঝোলার ভিতর থেকে একটা খিলি পান বের করে আমার দিকে এগিয়ে দেয় নিশা, তারপর গলা নামিয়ে বলে, ‘এই পান খেয়ে একবার জোর গলায় হানাপাড়া বলে জলে পিক ফেলতে হবে, তারপর সেই লাল পিক নিজে থেকেই সেদিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে৷’

‘বেশ তো আমাকে দাও৷ পিক ফেলছি৷’

‘আহা, তুমি বুঝতে পারছ না৷’

‘কী বুঝব?’

নিশা আরও গলা নামিয়ে বলে, ‘ধরো আমরা ভুল দিকে এগোচ্ছি৷ অর্থাৎ আমাদের যেতে হবে পিছনে৷ পান খেয়ে পিক ফেললে পিকটা তাহলে পিছনে, মানে আমাদের মুখে এসেই লাগবে৷’

ব্যাপারটা বুঝতে আমার মিনিট খানেক সময় লাগল৷ তারপর নিশার হাত থেকে পানটা নিয়ে বাইরে মুখ বাড়িয়ে বললাম, ‘দাদা, আপনি পান খান তো?’

‘বেঁচে থাকতে খেতাম… তারপর পঞ্চাশ বছর…’

‘এই নিন, খাঁটি বেনারসি পান৷’

গদগদ হয়ে আমার হাত থেকে পান নিয়ে মুখে পুড়ে দিল লোকটা৷ আমি ছইয়ের তলায় ঢুকে এসে গলা তুলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যেতে হবে মনে আছে তো?’

‘হানাপাড়া৷’

জলের দিকে দেখে নিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হলাম, ‘বাঃ, ঠিক দিকেই যাচ্ছি৷’

ঢিমে তালে এগিয়ে চলেছে নৌকাটা৷ ছইয়ের দু-দিকে যেটুকু দেখা যাচ্ছে সেখানেই ঝিকমিকে চাদের আলো এসে খেলা করে যাচ্ছে৷ সামনে তাকিয়ে দেখলাম জলের উপরে মাঝির ছায়া পড়েনি৷ মাঝে-মাঝে দু-একটা মাছ মাথা তুলে আমাদের দিকে তাকিয়েই আবার হারিয়ে যাচ্ছে অতল জলের তলায়৷ নৌকার দুলুনিতে বেশ আরাম লাগে আমার৷ ঘুম পায়৷ আমার ঠিক পাশেই আমার কাঁধের উপরে মাথা রেখে এলিয়ে পড়েছে নিশা৷ মেয়েটাকে দেখলে বোঝা যায় না, প্রায় আড়াইশো বছর বয়স তার৷ এখনো মুখের চামড়া টানটান৷ ডাগর ডাগর চোখ দুটো এখন বন্ধ৷ সামনে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে আমার দিকে যখন চায় আমার ভিতরের লড়াকু নেকড়েটা মেনি বিড়ালের মতো মিউ মিউ করতে থাকে৷ তবে তাকানোর সময় চোখে মণি না থাকলে ভারি ভয় লাগে মশাই৷

‘একটা ব্যাপার জিজ্ঞেস করছি কিছু মনে করবেন না প্লিজ৷’ দাঁড় বাইতে-বাইতে আবার প্রশ্ন করেছে মাঝি৷

‘হ্যাঁ, করুন না৷’

‘আপনি বললেন আপনার স্ত্রী ঝাঁটা নিয়ে উড়ে বেড়াতে পারে, তো আপনারা তো উড়ে-উড়েই নদী পার হতে পারতেন৷’

একটু ক্ষণ চুপ করে থাকলাম আমি, নিশাই উত্তর দিল, ‘গোটা নদী আমি আগে পার হতে পারতাম, এখন আর পারি না৷’

‘কেন?’

লোকটাকে কথাগুলো খুলে বলার তেমন কোনও দরকার ছিল না৷ তাও এ লোকটা যখন ভূত তখন কথাগুলো কিছুটা হলেও সে বুঝতে পারবে৷ নিশাকে আমি চোখের ইশারা করতে সে তার ঝোলার ভিতর থেকে বইটা বের করে আনল৷ সেটা হাতে নিয়ে আমি বললাম, ‘শুধু ওর নয়, আমাদের দু-জনের শক্তিই কমে আসছে দিন-দিন৷ আজ রাতটা পোহালেই হয়তো আমরা মুছে যাব৷’

‘কেন?’ দাঁড়টা পাটাতনের উপরে রেখে আমাদের সামনে নেমে এল মাঝি৷ বেশ কিছুটা দূরে বসে পড়ল পা ছড়িয়ে৷

হাতে ধরা বইটা আমি তার দিকে এগিয়ে দিলাম৷ বইয়ের প্রায় উঠে যাওয়া কভারে নামটা পড়ল লোকটা, ‘যে গল্প সত্যি হবে না’—এতো একটা বাচ্চাদের গল্পের বই!

‘আজ থেকে বছর ষাটেক আগে এই বইটা লেখা হয়৷ এতে আমাদের দু-জনকে নিয়ে একটা ছোটগল্প আছে, ডাইনিবুড়ি আর নেকড়ে মানুষ৷ আঠারো পাতা খুলুন… হ্যাঁ… এই যে…’

লোকটা পাতাটা খুলে প্রথম পাতার হেডপিসে একবার চোখ বুলিয়ে নিল, আমাদের দুজনের মুখের সঙ্গে মিলিয়ে দেখল একবার৷ তারপর রেখে দিল৷

‘পঞ্চাশ বছর আগে একটি বাচ্চা মেয়েকে তার জেঠু উপহার দিয়েছিল বইটা৷ কিছু একটা ম্যাজিক ছিল গল্পটার মধ্যে৷ মেয়েটা গল্পটা পড়া মাত্র আমরা জীবন্ত হয়ে উঠি৷’

‘সে আবার কী! জীবন্ত হয়ে গেলেন কী করে?’

‘সে আমরা কী করে জানব?’

‘বাবা! তারপর?’

‘তারপর আর কী? চলছিল বেশ আনন্দে ৷ দিনের বেলা পোড়ো বাড়ি- টাড়ি পেলে সেখানে কাটাই, রাতে খিদে পেলে বাইরে বেরিয়ে মানুষ মেরে পেট ভরে রক্ত খাই… তবে সেটা খুব বেশি করতে হয় না৷ দুটো মানুষের সংসার কতই বা আর রক্ত লাগে… ’

পাশ থেকে নিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল, ‘কিন্তু আমাদের সুখের দিন আর রইল না৷’

‘কেন? কী হল হঠাৎ?’

‘আমরাও প্রথমে বুঝতে পারিনি৷ পরে ও কীসব ডাকিনী বিদ্যা করে বলল যে মেয়েটা গল্পটা পড়ায় আমরা জেগে উঠেছিলাম সে গল্পটা ধীরে- ধীরে ভুলে যাচ্ছে এবার৷ আর যত ভুলে যাচ্ছে তত আমাদের শক্তিও কমে আসছে৷ শুধু তাই নয়, বইটাও আর মেয়েটার কাছে নেই৷ ফলে সেটা আবার পড়বে সে আশাও নেই৷’

‘এ তো ভয়ানক কাণ্ড! তারপর?’

‘আমরা বুঝলাম যদি বাঁচতে চাই তাহলে যেভাবেই হোক মেয়েটাকে বইটা পড়াতে হবে৷ ব্যস, আমরা খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম৷ সারারাত পুরনো বইয়ের দোকান ভাঙচুর করে বই খুঁজি, ঝাঁটায় চড়ে উড়ে বেড়াই৷ শেষে একদিন খুঁজে পেয়ে গেলাম৷’

‘পেলেন কী করে?’

‘একদম প্রথম পাতাটা খুলুন৷’

মাঝির মাথা থেকে চুইয়ে পড়া জলে ভিজতে শুরু করেছে বইটা৷ সেটা তার হাত থেকে নিয়ে আমিই পাতা উলটে দেখালাম৷ পেনের কালিতে গোটা-গোটা অক্ষরে লেখা আছে, ‘স্নেহের পলিকে পনেরো বছরের জন্মদিনে, ছোট জেঠু৷ উনিশে এপ্রিল, উনিশশো সত্তর৷’

‘এই ডেট আর নাম দেখেই আবার ডাকিনীবিদ্যা করলেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, লোকেশনটা মোটামুটি ট্রেস করা গেছে৷ কিন্তু বাড়িটা খুঁজে পাওয়া মুশকিল৷’

‘একটা জিনিস নিয়ে কিন্তু চিন্তা হচ্ছে আমার, বুঝলে? আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে মেয়েটার পনেরো বছর বয়স ছিল৷ এখন তার মানে পঁয়ষট্টি, যদি চোখের গোলমাল হয়? তাহলে তো পড়তেই পারবে না৷’ নিশির উদ্বিগ্ন গলা৷

‘পড়ে শোনালে কাজ দেবে না বলছ?’

‘উঁহু৷ আগের বার নিজে পড়েছিল বলেই কাজ হয়েছিল৷’

দাড়িতে থুড়ি গালের লোমে হাত বুলাতে-বুলাতে বললাম, ‘চিন্তায় ফেললে৷’

নৌকা এতক্ষণ নিজের মতো দাঁড়িয়ে ছিল৷ মাঝি উঠে গিয়ে আবার দাঁড় টানতে লাগল৷ সে উঠে যেতে নিশা আরেকটু আমার দিকে সরে এসে বলল, ‘আচ্ছা, যদি আজ সত্যি আমরা মরে যাই, তাহলে কী হবে?’

ঠাট্টার সুরে বললাম, ‘মরে যাওয়ার ওইটাই ভালো দিক৷ কী হবে ভাবার দরকার পড়ে না৷ ওটা বেঁচে থাকার টেনশন৷’

‘ধুর, তা বলছি না৷ আমাদের তো স্বর্গ-নরক নেই৷ আমরা যাব কোথায়?’

‘কেন? তুমি কোথায় যেতে চাইছ?’

‘যেখানে তুমি যাবে৷’

এইসব শুনে মনটা গদগদ হয়ে গেল৷ শরীরের ভিতরে নেকড়েটা মনে হল মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেয়ে নিল কয়েকবার৷ গলা তুলে মাঝিকে বললাম, ‘তোমার নৌকায় গান বাজনার কোনও ব্যবস্থা নেই?’

‘আছে তো, এই যে… নদী পারাপারে একশো আর গান শোনানোর জন্য আট টাকা!’

পাটাতনের তলা থেকে একটা মিউজিক প্লেয়ার বের করে মাঝি গান চালিয়ে দিল৷

‘আরে এ কী! এ কী!’

‘গেল গেল নৌকা উলটে গেল…’

চিৎকার চেঁচামিচিতে দুমদাড়াক্কা সেই গান থামিয়ে দিল মাঝি৷ আমি হাঁপাতে-হাঁপাতে বললাম, ‘এ কী রে বাবা! মাঝি কোথায় ভাটিয়ালি গাইবে, দিলদরিয়া থাকবে, একূল-ওকূল থাকবে, তা না, ঝিনচ্যাক-ঝিনচ্যাক!’

ব্যাজার হয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম নদীর উলটোদিকের পাড়টা দেখা যাচ্ছে এখন৷ এটাই মনে হয় হানাপাড়া, মানে কাছাকাছিই এসে গেছি৷ নিশাকে একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় বাইরে থেকে মাঝির হিমহিমে গলা ভেসে এল, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন৷’

‘এ যা গান শোনালে তাতে ইতিহাস তোমায় ক্ষমা করবে না৷’

‘আমার নৌকা এবার ডুবে যাবে৷’

আমি চমকে উঠলাম, ‘অ্যাঁ!’

নিশার রাগত স্বর বলে উঠল, ‘অ্যাই! ডুবে যাবে মানেটা কী? বললেই হল?’

‘আসলে ঠিক এইখানেই আমার নৌকাডুবি হয়েছিল৷ এর বেশি আমি আর যেতে পারি না৷’

নৌকাটা এবার ভয়ানক ভাবে দুলে উঠল, আমার লম্বা হয়ে যাওয়া কানটা নিশার মাথায় ঠুকে গেল৷

নৌকার ভিতরে জল ঢুকতে শুরু করেছে৷ মাঝি ব্যাটা দেখলাম এতক্ষণে কঙ্কালরূপ ধারণ করেছে৷ দেঁতো হাসি হাসতে-হাসতে বলল, ‘আসলে কঙ্কাল হয়ে সাঁতার কাটা সহজ, আপনারাও হয়ে যান৷’

এবার রেগে উঠলাম আমিও৷ ‘চোপ! ব্যাটা জোচেচার ভূত কোথাকার! দে আমার টাকা ফেরত দে৷’

লোকটা দাঁড়ের হ্যান্ডেলটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘নিয়ে নিন পারলে৷’

ইচ্ছা করল দাঁড়ের বাড়ি ঠেঙিয়ে সবক-টা হাড় ভেঙে দিই৷ নিশার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেও ঝাঁটা বের করেছে৷ বললাম, ‘হ্যাঁ, ঝ্যাঁটাপেটা করো শালাকে, সব ভূত নেমে যাবে মাথা থেকে৷’

সে ঝাঁটাটা সোজা করে ধরে মাথা নেড়ে বলল, ‘কাউকে পেটাতে হবে না৷ এর উপর উঠে বসো৷’

বাক্যব্যয় না করে উঠে বসলাম৷ নৌকা এতক্ষণে জলের তলায় ডুবতে শুরু করেছে৷ কঙ্কালটা গিয়ে পড়েছে জলের উপরে৷ খটখট হাড়ের ভিতর থেকে কয়েকটা শব্দ শোনা গেল, ‘আপনাদের যাত্রা শুভ হোক, এই নাদের আলিকে ভুলে যাবেন না৷’

‘ওরে হারামজাদা! এই সেই নাদের আলি, সুনীল গাঙ্গুলিকে তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবে বলে মুর্গি বানিয়েছিল৷ আর আমাদের মাঝ নদীতে ডুবিয়ে দিয়ে গেল, আবার কথা রাখেনি হতভাগা৷’

‘ওর কথা ছাড় এখন৷’ আমার সামনে থেকে ঝাঁটা ওড়াতে-ওড়াতে বলল নিশা, ‘হানাপাড়াতে পলিকে খুঁজে বের করবে কী করে সেটা ভাব৷’

‘তুমি তো বললে বাড়িটা চেনো৷’

‘তা চিনি, কিন্তু বাড়িটা তো বৃদ্ধাশ্রমও হতে পারে৷ অনেকগুলো বুড়ি থাকলে তাকে চিনব কী করে? মুখ তো চিনি না৷’

‘তাহলে চিনব কী করে? হাউ? হাউউউউউউউউ৷’

‘ধ্যাত৷ অত চিন্তার কিছু নেই৷ জন্মের উপর যখন নিজেদের হাত ছিল না, মরার হলেও নিজেরা কিছু করতে পারব না৷ আজ রাতটা কী সুন্দর, তাই না?’

চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, সত্যি, মরার ভয়টা না থাকলে আজ একটা রাতের মতো রাত বটে৷ ঝোড়ো হাওয়ার ধাক্কা পায়ে এসে লাগছে, নিশার মাথার লম্বা-লম্বা চুলগুলো আকাশের দিকে উড়ে যেতে চাইছে; সেই চুলের ফাঁক দিয়ে গোল চাঁদটা দেখা যাচ্ছে মাঝে-মধ্যে৷ জলের ভিতর থেকে কয়েকটা মাছ লাফিয়ে আমাদের উড়ন্ত ঝাঁটাটা ধরার চেষ্টা করছে৷ পায়ের কাছ অবধি লাফিয়ে এসে আবার ফিরে যাচ্ছে তারা৷

‘হয়তো আমাদের শেষ রাত৷’

নিশা কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় কোথা থেকে একটা বেয়াড়া বাদুড় এসে মারল ঝাঁটায় ধাক্কা; ধাক্কাটা এত জোরে মারল যে আমি ঝাঁটা থেকে ছিটকে গেলাম৷ নিশা উপর থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘তুমি সাঁতরে ওপারে ওঠ, আমি যাচ্ছি৷ নেকড়েরা সাঁতার কাটতে পারে তো?’

‘আমি কী জানি? ওয়্যারউলফ হওয়ার সময় কেউ ম্যানুয়াল দেয়নি৷’

জলে পড়তেই কিন্তু বুঝতে পারলাম সাঁতার আমার রক্তে৷ আমার পায়ের আঙুলের ফাঁকে মাকড়সার জালের মতো একরকম ছোট পর্দা জাতীয় গজিয়েছে৷ সেটাই দেখলাম সাঁতরাতে সাহায্য করছে৷

নাদের আলিটা কী ভোগান্তিই না ভোগাল! ব্যাটাচ্ছেলেকে একবার হাতের সামনে পেলে শুধু তিন প্রহরের বিল না, বৃন্দাবনটাও দেখিয়ে দিতাম৷ জল মুখে লেগে সমস্ত লোম ভিজে গেল৷ কোনওরকমে সাঁতরে-সাঁতরে পাড়ে উঠে দেখলাম নিশা আগে থেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে আছে৷

ঢোলা জামার খানিকটা অংশ দিয়ে আমার মুখ মোছাতে-মোছাতে সে বলল, ‘মেয়েটার বাড়ি খুঁজে পাওয়ার একটা উপায় পেয়েছি জানো?’

‘কী উপায়?’

‘একটা দাঁড়কাক এসে খবর দিয়ে গেল মেয়েটা যেখানে আছে তার ঠিক আশপাশেই একটা সুগন্ধী সাদা ফুলের গাছ আছে৷’

‘বাঃ, তো সেই কাকটার পিছন-পিছন গেলেই তো হয়৷’

‘উঁহু, ওর থেকে ভালো একটা উপায় আছে৷ নেকড়েদের শুনেছি ভয়ানক শক্তিশালী ঘ্রাণশক্তি হয়…’

‘তাই নাকি!’ আমি বাতাসে ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করি, ‘হ্যাঁ… পাচ্ছি, সুগন্ধ হুহু… আহাহাহা…’

‘পাচ্ছ! কিসের গন্ধ?’

‘আহা… হিংয়ের কচুরি আর কষা মাংস…’

‘ধ্যাত… প্রাণে বাঁচলে তারপর খাইখাই করবে, কোনও ফুলের গন্ধ পাচ্ছ কিনা বলো৷’

‘হিংয়ের ফাঁকে একটা রজনীগন্ধাও আছে মনে হচ্ছে…’

‘ব্যস… ওইটাকে বেস করে এগিয়ে যাও৷’

সেই গন্ধের সূত্র ধরে এগোতে লাগলাম আমরা৷ রাত প্রায় আড়াইটের কাছাকাছি৷ আমার কনুইয়ের কাছটা ধরে আছে নিশা৷ মাঝে-মধ্যে চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবার চেষ্টা করছে৷ মেয়েটা ভারী অদ্ভুত৷ এই অলৌকিক জগতে আমার চেয়ে ওর অভিজ্ঞতা ঢের বেশি৷ আড়াইশো বছর ধরে বেঁচে আছে, পলাশির যুদ্ধ দেখেছে, দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে, স্বাধীনতার সূর্য দেখেছে, অথচ এখনও আমার ল্যাজে-ল্যাজে ঘুরে না বেড়ালে সে নাকি ভরসা পায় না৷

দুদিকে একতলা-দোতলা বাড়ি সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার মধ্যে-মধ্যে সরু গলি এদিক-ওদিক চলে গেছে৷ অন্ধকারের ভিতরে ভালো করে তাকিয়ে কয়েকটা ভূত-প্রেতের দেখা পেলাম৷ আমাদের দেখে একগাল হেসে তারা লোকের জানলায় আঙুল দিয়ে কটকট আওয়াজ করতে লাগল৷ ভূতগুলো চিরকালই এরকম৷ রাতবিরেতে লোকের জানলায় উঠে এ কী বেলেল্লাপনা!

সেদিকে খেয়াল করতে-করতে বুঝতে পারিনি পায়ের কাছে একটা ইট পড়েছে, তাতে হোঁচট খেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিলাম৷ নিশা ধরে নিল আমাকে, ‘আঃ, চোখ তো জ্বলছে, একটু সতর্ক হয়ে চলতে পার না৷’

‘হেঁ হেঁ…’

‘একি! হাসছ কেন?’

না, বলছিলাম, ওয়্যারউলফ যখন অসতর্ক থাকে তখন তাকে কী বলে জানো?’

‘না, কী বলে?’

‘আন-এও্যার উলফ৷’

ফুলের গন্ধটা ভয়ানক বেড়ে উঠতে আমরা একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম৷ বাড়িটা একতলা, চারপাশে একটা মোটামুটি এক-নেকড়ে সমান উঁচু পাঁচিল৷ উপরে তাকিয়ে ছাদের কিনারে একগাদা রজনীগন্ধার টব চোখে পড়ল৷ ওখান থেকেই আসছিল মনে হয় গন্ধটা৷

একটা ছোট লাফে পাঁচিলের উপরে উঠে পড়লাম আমি, তারপর হাতটা নীচে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘উঠে এসো৷’

‘পাঁচিল টপকে ঢুকব?’

‘উঁহু৷ ছাদ দিয়ে৷’

হাতে করে তাকে তুলে নিয়ে পাঁচিলের উপরে দাঁড় করিয়ে দিলাম আমি৷ মুখের দিকে ভালো করে তাকাতে দেখলাম হাওয়ায় ওড়ার সময় প্রচুর বালি এসে জমা হয়েছে তার মুখে আর চুলে৷ সেগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে-দিতে বললাম, ‘এ্যাঃ! উইচ থেকে একেবারে স্যান্ড-উইচ হয়ে গেছো৷’

সে আমার দুটো কাঁধ চেপে ধরে পিঠে ঝুলে পড়ল৷ আমি পাঁচিল থেকে কার্নিসের মাথায় লাফ দিলাম৷ সেখান থেকে লাফিয়ে ছাদের রেলিংয়ে চড়ে ছাদে নেমে এলাম৷

‘আমি তোমাকে হারাতে চাই না৷’ কানের পাশ থেকে নিশার গলা শুনতে পেলাম৷ মনে হল তার চোখ দুটোও ভিজে গেছে৷

ছাদে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম দু-জনে৷ শরীর এতক্ষণে বেশ ক্লান্ত লাগছে আমার৷ নিশার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানেও ছায়া নেমেছে৷ এক ধাক্কায় তার বয়স যেন অনেকটা বেড়ে গেছে৷ মেয়েটার স্মৃতি আরও আবছা হয়ে আসছে হয়তো৷

‘চলো, নীচে নামতে হবে, কুইক৷’

ছাদের দরজায় তালা লাগানো ছিল৷ কবজির কাছ থেকে পিন জাতীয় কিছু একটা বের করে তালার ভিতরে ঢোকাল নিশা, খুট শব্দ করে সেটা খুলে গেল৷

একতলায় নামার সিঁড়ি ফাঁকা পড়ে আছে৷

আমরা দু-জনে সেইদিকে পা বাড়ালাম৷ কেন জানি না আমার বুকের ভিতরটা থেকে-থেকে শুকিয়ে যাচ্ছে৷ নীচে নেমে কী দেখব জানি না৷ পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধা হয়তো আমাদের দেখে ভয় পেয়ে যাবেন৷ এতদিন আগে পড়া একটা বইয়ের চরিত্রের কথা মনে থাকার আশা নেই৷

সিঁড়ি দিয়ে নামলে একতলায় মাত্র তিনটে ঘর৷ তিনটেরই দরজা বন্ধ৷ আমরা চুপিসারে তিনটে ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম৷

‘কোন ঘরে আছে বুঝব কী করে?’

‘মহিলার বয়স হয়েছে৷ বয়স্ক লোকের ঘরে ওষুধের গন্ধ বেশি পাবে৷’

অসন্তাোষ জানালাম, ‘উফফ! এই গন্ধ শুঁকে-শুঁকে আমার নাকটা ব্যথা হয়ে গেল৷’

পাত্তা না দিয়ে ও জিজ্ঞেস করল, ‘ওষুধের গন্ধ পাচ্ছ?’

মাঝখানেরটা থেকে সরে ডানপাশের দরজাটার সামনে দাঁড়ালাম আমি, ‘হ্যাঁ, এইটা থেকে পাচ্ছি৷’

‘তার মানে ওর ভিতরেই আছেন বৃদ্ধা৷’

‘তুমি ভূতের গল্পের চরিত্র না গোয়েন্দা গল্পের?’

‘সরো দেখি, একটু কাজ করতে দাও৷’

নিশা আবার দরজার লকে কাঠি করতে খুট করে একটা শব্দ হয়ে খুলে গেল দরজাটা৷ আমরা কয়েক পলক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ হাত দিয়ে ঠেলে আরও খানিকটা খুলে দিল নিশা৷ দু-জনে ভিতরে ঢুকে এলাম৷

বিছানার উপরে সত্যি এক বয়স্ক মহিলা শুয়ে আছেন৷ তার মাথার কাছে ছোট একটা খোলা জানলা৷ সেই জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার মুখে৷ বিছানার উপরে ধবধবে সাদা চাদর পাতা৷ গোটা ঘরটা রজনীগন্ধার গন্ধে ম-ম করছে৷ বাইরের ঘাসের জমি থেকে পোকামাকড় ডেকে চলেছে একটানা৷ আর কোনও শব্দ নেই৷

‘আমি জাগাচ্ছি, তুমি বইটা রেডি রাখো৷’

কথাটা বলে মহিলার দিকে এগিয়ে গেল নিশা৷ আমি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বইটা বের করে হাতে ধরে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলাম বৃদ্ধার মুখ৷ বয়সের তুলনায় কিছুটা বেশিই বয়স্ক দেখাচ্ছে তাকে৷ চামড়ার উপর অসংখ্য বলিরেখার দাগ৷ চোখ দুটো এখন নিপুণ করে বন্ধ৷ এই তবে সেই পলি?

‘পলি, পলি শুনছ?’

নিশার গলাটা কেঁপে যাচ্ছে৷ মহিলার মুখে কিন্তু কোনও ভাবান্তর লক্ষ করলাম না৷ নিশা আবার ডাকল, ‘একবার চোখ খোলো পলি, দেখ আমাদের চিনতে পারো কি না৷’

এবার আমি এগিয়ে গিয়ে বইটা বিছানার উপরে রেখে একটা হাত পলির মুখের উপরে রাখলাম৷ নিশা চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে, আমি মাথা নাড়লাম, ‘বেঁচে নেই৷’

‘মানে?’

‘মনে হচ্ছে আজ রাতে… একটু আগেই৷’

‘তাহলে? কী হবে?’

‘কিচ্ছু হবে না৷’

পলির বিছানার দু-পাশে কিছুটা জায়গা খালি ছিল৷ আমার শরীর ক্লান্ত হয়ে এসেছে এতক্ষণে৷ বিছানার উপরে উঠে একপাশের ফাঁকা জায়গাটায় শুয়ে পড়লাম৷ পলির শরীরে স্পন্দন নেই৷ তার পেটের উপরে একটা হাত রাখলাম আমি৷ ঠান্ডা হয়ে আছে সব৷

পলির অন্যপাশে নিশাও শুয়ে পড়ল৷ মাথার চুলের উপরে চাঁদের আলো এসে রুপোলি সুতোয় ঢেকে রেখেছে মুখটা, কোথা থেকে একটা জোনাকি ঘরে ঢুকে ছোটাছুটি করতে শুরু করেছে৷ নিশার চোখ দুটো এখন আমার দিকে স্থির, কিছু যেন সে বলতে চায় আমাকে, কিন্তু মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে তার৷

খেয়াল করলাম, এইবার আমাদের শরীর দুটো হালকা হয়ে আসছে৷ হাওয়ার সঙ্গেই যেন মিশে যাচ্ছে একটু-একটু করে৷ নিশার হাতটা আমার হাতের ফাঁকে আশ্রয় নিল৷ দু-জনে একসঙ্গে চোখ বুজলাম৷

ভোররাতে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে এল একটা বছর পনেরোর মেয়ে৷ দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ থাকার কথা, সেটা এখন খোলা রয়েছে কী করে? সে একটু অবাক হল৷ একটু আগেই রাতের সফর সেরে সে বাড়ি ফিরেছে, চোর-টোর ঢুকেছে নাকি? আর মিলি?

সে ঘরের আরও ভিতরে ঢুকে এল৷ বিছানার উপরে এক বৃদ্ধার শরীর পড়ে আছে৷ বাকি বিছানা খালি৷ বৃদ্ধার মাথার ঠিক পাশে চোখ আটকে যায় মেয়েটির৷ সে চমকে ওঠে—একটা বই৷ বইটা তার চেনা৷

দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে বইটা হাতে তুলে নেয় সে৷ প্রথম পাতাটা উলটেই দ্বিতীয়বার অবাক হয়ে যায়৷ আরে! এটা তো তার নিজের বই! নিজের পনেরো বছরের জন্মদিনে পাওয়া, তার নামটা পর্যন্ত লেখা আছে৷ মিলির কাছে এই বইটা কী করে এল?

অন্য কেউ কি রেখে গেছে? কিন্তু তাই বা কী করে হয়? ওরা দুই বোন ছাড়া তো আর কেউ এখানে থাকে না৷ তবে কি অন্য কেউ ঘরে ঢুকেছে? পলি সতর্ক হয়ে ওঠে৷ একটু পিছিয়ে এসে চারিদিকে তাকায়৷ তার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে হিংস্র শ্বদন্ত বের হয়ে আসে৷ আজ রাতে আর শিকার ধরতে বেরোয়নি পলি৷ খিদে নেই তেমন৷ তাও কেউ আক্রমণ করলে তাকে ছিঁড়ে খাওয়ার মতো পিপাসা আছে তার৷

পনেরো বছরের পরে আর বয়স বাড়েনি পলির৷ সে রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার৷

ঘরের চারদিকটা একটু খতিয়ে দেখে নিশ্চিত হয় পলি৷ নাঃ, অন্য কোনওভাবে এসেছে বইটা৷ নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়৷ বইয়ের একটা বিশেষ গল্প ভীষণ প্রিয় ছিল৷ কী যেন—ডাইনিবুড়ি আর নেকড়েমানব৷

নিজের ঘরে ফিরে এসে আলো জ্বালিয়ে সেই গল্পটাই পড়তে শুরু করে পলি৷ হ্যাঁ, একটু-একটু করে পুরো গল্পটাই মনে পড়ে যাচ্ছে৷ তার লাল ঠোঁটের কোণে একটা চওড়া হাসি খেলে যাচ্ছে৷

পড়তে-পড়তে একবার চমকে ওঠে সে৷ কিছুর একটা আওয়াজ ভেসে এসেছে এক্ষুনি, অনেকটা দূর থেকে ভেসে আসা নেকড়ের চিৎকারের মতো৷ কিন্তু এখানে নেকড়ে আসবে কোথা থেকে? নাঃ, গল্পটাই চেপে বসেছে তার মনের মধ্যে৷ মাথা নেড়ে আবার পড়তে থাকে সে৷

আর ঠিক সেই সময়ে একটা কালো মোটা বিড়াল গদগদ স্বরে ডাকতে- ডাকতে পলির জানলা ডিঙিয়ে অন্ধকারে গায়েব হয়ে যায়৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *