একটি আশ্চর্য স্বপ্ন

একটি আশ্চর্য স্বপ্ন
A Curious Dream

[একটি নীতি-বাক্য সহ]

গত রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। মনে হল, আমি যেন দরজার সিঁড়িতে [কোন বিশেষ শহরে হয় তো নয়] বসে স্মৃতিচারণা করছি; তখন রাত প্রায় বারোটা কি একটা। আবহাওয়া স্বাস্থ্যপ্রদ ও সুন্দর। বাতাসে কোন মানুষের শব্দ শোনা যাচ্ছে না, এমন কি পায়ের শব্দও নয়। মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসা কোন কুকুরের ফাঁকা ঘেউ ঘেউ ডাক এবং ততোধিক দূর থেকে আসা তার। অস্পষ্টতর জবাব ছাড়া আর কোন শব্দই সেই মৃত্যুব্ধ তাকে বিঘ্নিত করছে না। এমন সময় শুনতে পেলাম পথ দিয়ে যেন একটা কংকালের খট খট আওয়াজ এগিয়ে আসছে; ভাবলাম, কোন নৈশ গায়ক দলের কাঠের খঞ্জ নির শব্দ। এক মিনিট পরেই টুপি-পরা এবং শতছিন্ন ছাতাপরা শবাবরণে অর্ধেক শরীর ঢাকা একটা লম্বা কঙ্কাল বড় বড় পা ফেলে আমার পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে তারার অস্পষ্ট ধূসর আলোয় অদৃশ্য হয়ে গেল। তার ঘাড়ে একটা কীটে কাটা শবাধার ও হাতে একটা বাণ্ডিল। খট খট শব্দটা যে কিসের সেটা বুঝতে পারলাম; হাঁট বার সময় হাড়ের জোড়গুলিতে ঠোকাঠুকি লেগে এবং দুপাশের পাঁজরের উপর কনুই ঠুকে যাওয়ায়ই শব্দটা হচ্ছিল। বলতে পারি, বিস্ময় বোধ করেছিলাম। চিন্তা-ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নিয়ে এই অশরীরী আবির্ভাব কিসের হতে পারে সেটা বুঝে উঠবার আগেই আরও একজনের আসার শব্দ পেলাম-কারণ সেই খট খট শব্দটা আমার চেনা হয়ে গেছে। একটা। শবাধারের দুই-তৃতীয়াংশ তাঁর কাঁধে, আর পায়ের ও মাথায় দিককার কিছু তক্তা তার বগলে। খুবই ইচ্ছা হল তার মাথার ঢাকনার নীচ দিয়ে তাকিয়ে তার সঙ্গে কথা বলি, কিন্তু যেতে যেতে চোখের গর্তের ভিতর থেকে যে ভাবে সে তাকাল এবং বেরিয়ে-আসা দাঁতের পাটি যে ভাবে দেখাল তাতে মনে হল তাকে না আটকানোই ভাল। সে চলে যেতে না যেতেই আবার সেই শব্দ কানে এল এবং আবছা আলোর ভিতর থেকে আর একটি কঙ্কাল বেরিয়ে এল। মাথায় একটা ভারী কবরের পাথর বয়ে আনতে সে একেবারে কুঁজো হয়ে পড়েছে: দড়িতে বাঁধা একটা নোংরা শবাধারকে সে টেনে নিয়ে চলেছে। আমার কাছে পৌঁছে সে দু এক মুহূর্তের জন্য স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল; তারপর ঘুরে আমার কাছে এসে বলল:

এটাকে একটু নামিয়ে দেবে কি?

কবরের পাথরটাকে নামিয়ে মাটিতে রাখতে গিয়ে দেখলাম তার উপরে নাম লেখা রয়েছে জন বাক্সটার কপম্যান্ হাস্ট, আর মৃত্যুর তারিখ লেখা রয়েছে মে, ১৮৩৯। মৃত লোকটি শান্তভাবে আমার পাশে বসে পড়ল এবং হাত তুলে করোটি টা মুছল-পূর্বেকার অভ্যাসবশতই কাজটা সে করল, কারণ তার হাত থেকে কোন ঘাম ঝরতে দেখলাম না।

বাকি শবাবরণটুকু টেনে নিয়ে চিন্তিতভাবে চোয়ালটা হাতের উপর রেখে সে বলল, খুব খারাপ। তারপর বাঁ পা-টা হাঁটুর উপর তুলে শবাধারের ভিতর থেকে একটা মরচে-পড়া নখ বের করে গোড়ালির হাড়টাকে অন্যমনস্কভাবে চুলকোতে লাগল।

কি খুব খারাপ বন্ধু?

ওঃ, সব কিছু সব কিছু। মনে হয় না মরাই ছিল ভাল।

আমাকে অবাক করলে তো। এ কথা বলছ কেন? কোন ভুল-ভ্রান্তি ঘটেছে কি? ব্যাপার কি?

ব্যাপার? এই শবাবরণ-এই ছেঁড়া কম্বলের দিকে তাকিয়ে দেখ। কবরের পাথরটাকেও দেখ। সব ভেঙে–চুরে গেছে। এই লজ্জাজনক পুরনো শবাধারটা দেখ। চোখের সামনে একটা লোকের সব সম্পত্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আর জিজ্ঞাসা করছ, ভুল-ভ্রান্তি ঘটেছে কিনা? আগুন আর গন্ধক!

আমি বললাম, শান্তি হও, শান্ত হও। এটা খুবই খারাপ-নিশ্চয় খুব খারাপ। তবে এ পরিস্থিতিতে এ সব জিনিস নিয়ে তুমি যে মাথা ঘামাবে তা ভাবতে পারি নি। দেখ প্রিয় মহাশয়, মাথা আমি সত্যি ঘামাচ্ছি। আমার গর্বে আঘাত লেগেছে-বলতে পারি, আমার আরাম বিঘ্নিত হয়েছে-ধ্বংস হয়েছে। যদি অনুমতি কর তো আমার ইতিহাস তোমাকে বলব-এমনভাবে বলব যাতে তুমি বুঝতে পার, মাথার আবরণটাকে ঠেলে তুলে দিয়ে বেচারি কংকাল কথাগুলো বলল।

বলে যাও, আমি বললাম।

এখান থেকে একটা কি দুটো ব্লক আগে এই রাস্তারই একটা পুরনো লজ্জাজনক কবরখানায় আমি থাকি-এই যা, ঠিক ভেবেছিলাম উপস্থিতিটা সরে যাবে! নীচের দিক থেকে তিন নম্বর পাঁজরটা বন্ধু তোমার কাছে যদি থাকে তাহলে একটা দড়ি দিয়ে যদি আমার শিরদাঁড়ার সঙ্গে ওটা বেঁধে দাও, অবশ্য রূপোর তার হলেই ভাল হয়, কারণ ঘসে-মেজে রাখলে সেটা অনেকদিন টেকে আর দেখতেও ভাল হয়-ভাব তো, শুধুমাত্র উত্তরপুরুষের উদাসীনতা ও অবহেলার ফলে এই ভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া, ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে যাওয়া! আর বেচারি ভূতটা এমনভাবে দাঁত কড়মড় করে উঠল যে আমার গা গুলিয়ে উঠল, আমি কাঁপতে লাগলাম-কারণ কংকালের গায়ে মাংস বা চামড়া না থাকায় ব্যাপারটা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ঐ পুরনো কবরখানায় আমি থাকি; তিরিশ বছর ধরে আছি। আমি বলছি, আজ সব কিছুই বদলে গেছে। প্রথম যেদিন আমার এই পুরনো শ্রান্ত দেহটাকে ওখানে রেখেছিলাম, সেদিন দুশ্চিন্তা, দুঃখ, উদ্বেগ, সন্দেহ ও ভয়ের হাত থেকে চিরদিনের মত মুক্তি পেয়ে গেলাম এই মধুর চিন্তায় উজ্জীবিত হয়ে একটা লম্বা ঘুমের আশায় শরীরটাকে টানটান করে দিয়েছিলাম, আর শুয়ে শুয়ে কান পেতে পরম সন্তোষের সঙ্গে শুনছিলাম। সমাধি-খননকারীর কাজের শব্দ, শবাধারের উপর প্রথম এক কোদাল মাটি ফেলা থেকে শুরু করে ক্রমেই অস্পষ্ট হতে অস্পষ্টভাবে আমার নতুন বাসভবনের ছাদটাকে পিটিয়ে সমান করে দেওয়ার শব্দ পর্যন্ত-আঃ! সে কী আরাম! হায়রে! আজ রাতে যদি সে রকমটা আর একবার ঘট ত! আমার স্বপ্নাচ্ছন্ন অবস্থায়ই একটা হাড়-সর্বস্ব হাত সশব্দে আমাকে একটা থাপ্পড় মেরে বসল।

হ্যাঁ মশাই, তিরিশ বছর আগে আমি ওখানে শুয়েছিলাম, আর বেশ সুখেই ছিলাম। কারণ তখন এটা ছিল গ্রামাঞ্চ ল-বড় বড় গাছপালা ছিল, ফুল ছিল, বাতাস ছিল; অলস বাতাসে পাতায় পাতায় মর্মর ধ্বনি উঠল; কাঠবিড়ালিরা আমাদের উপরে ও চারপাশে ঘুরে বেড়াত; কীট পতঙ্গরা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসত; আর সেই স্তব্ধ নৈঃশব্দ্যকে পাখিরা গানে গানে ভরে দিত। আহা, মৃত্যুর পরে দশটি বছর তখন কী আমারেই কাট ত! সব কিছুই মনোরম। প্রতিবেশীরাও ছিল ভাল; যে সব মৃত ব্যক্তিরা আমার কাছাকাছি থাকত তারা সকলেই ছিল শহরের সেরা পরিবারের লোক। উত্তরপুরুষরা তখন আমাদের জগতের কথা ভাবত। তারা আমাদের কবর গুলোকে খুব ভাল অবস্থায় রাখত; বেড়াগুলোকে নিখুঁতভাবে মেরামত করত, উপরকার বোর্ডটাকে রং করে বা চুণকাম করে রাখত, আর মরচে ধরতে বা নষ্ট হতে শুরু করলেই সেটা বদলে নতুন বোর্ড লাগিয়ে দিত; স্মৃতিফলকগুলোকে সোজা অবস্থায় রাখত, রেলিংগুলোকে ঝকঝকে করে রাখত, গোলাপের ঝড় ও অন্যান্য ঝোঁপ-ঝাড়কে কেটে হেঁটে সুন্দর করে রাখত; আ রাস্তাগুলোকে সব সময়ই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পাথর দিয়ে বেঁধে দিত। কিন্তু সেদিন আর নেই। বংশধররা আমাদের ভুলে গেছে। আমার এই বুড়ো হাতে উপার্জন করা টাকায় তৈরি মস্ত বড় বাড়িতে বাস করে আমার নাতি, আর আমি ঘুনোই এমন একটা অবহেলিত কবরে যেখানে আক্রমণকারী কীট রা আমার শবাবরণকে কেটে কেটে সেখানে বাসা তৈরি করে! আমি এবং আমার যে বন্ধুরা এখানে শায়িত রয়েছে তারাই এই সুন্দর শহরের পত্তন ও সমৃদ্ধি সাধন করেছি, আর আমাদের সেই সব বড়লোক সন্তানরা আজ আমাদের এমন একটা বিধ্বস্ত কবরখানায় ফেলে রেখেছে যাকে দেখে প্রতিবেশীরা অভিশাপ দেয় আর অপরিচিতরা নাক সিঁট কোয়। সেকাল আর একালের তফাৎটা দেখ-যেমন ধর: আমাদের সব গুলি কবরই গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে; মাথার উপরকার বোর্ড গুলো পুরনো হয়ে ভেঙে পড়েছে; রেলিংগুলো যেন এক পা আকাশে তুলে এদিক-ওদিক দুলছে; আমাদের স্মৃতিফলক গুলি ক্লান্তিতে হেলে পড়েছে; কবরের পাথরগুলো নৈরাশ্যে মাথা নীচু করে আছে; কোন রকম সাজ-সজ্জাই আর এখন নেই-গোলাপ নেই, ফুলের কেয়ারি নেই, পাথরে বাঁধানো পথ নেই; নয়নসুখকর কোন কিছুই নেই; এমন কি যে রং-হীন কাঠের বেড়াটা একদিন অন্য জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গ থেকে ও অসতর্ক পদক্ষেপের হাত থেকে আমাদের পবিত্রতাকে রক্ষা করত, সেটা ভেঙে পড়ে রাস্তার উপর ঝুলছে, আর তার ফলে আমাদের এই অকিঞ্চিৎকর বিশ্রাম স্থানের উপর সকলের ঘৃণার দৃষ্টি আরও বেশী করে পড়েছে। তাছাড়া আমাদের এই দারিদ্র্য ও দুরবস্থাকে এখন আমরা অরণ্যের আড়ালেও ঢেকে রাখতে পারি না, কারণ শহর তার শীর্ণ হাত আমাদের বাসস্থানের দিকেও বাড়িয়ে দিয়েছে।

এবার তাহলে বুঝতে পারছ-দেখতে পারছ ব্যাপারটা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের বংশধররা যখন আমাদেরই টাকায় প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করছে আমাদের চারপাশে, তখন মাথার খুলি ও হাড়কে একত্রে রাখতে আমাদের করতে হচ্ছে কাঠের সংগ্রাম। শুনলে অবাক হবে, আমাদের কবরখানায় এমন একটা কবরও নেই যেটা দিয়ে জল না পড়ে। রাতের বেলা বৃষ্টি হলেই আমাদের বেরিয়ে এসে গাছে উঠতে হয়-কখনও বা গলার নীচে ঠাণ্ডা জলের ফোঁটা পড়লে হঠাৎ আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। যে কোন বৃষ্টি-ঝরা রাতে। বারোটার পরে যদি সেখানে যাও তাহলে দেখতে পাবে, আমাদের মধ্যে অন্তত পনেরো জন একহাতে গাছের ডাল ধরে ঝুলে আছি, হাড়ের জোড়গুলি ভীষণভাবে শব্দ করছে, আর আমাদের পাঁজরের ভিতর দিয়ে বাতাস শোঁ-শোঁ করে বয়ে চলেছে। অনেক দিনই তিন-চার ঘণ্টা আমাদের এই ভাবে কাটাতে হয়, আর তারপরে ঠাণ্ডায় জমে কাঠ হয়ে নীচে নেমে আসি এবং পরস্পরের মাথার খুলি ধার করে নিয়ে যার যার কবর খুঁড়ে বের করে নেই-আমি মাথাটা পিছনে হেলিয়ে ধরছি, তাহলেই তুমি দেখতে পাবে খুলির মধ্যে কত পুরনো শুকনো মাটি জমে আছে-এর ফলে অনেক সময়ই মাথাটা কত যে ভারী লাগে! হ্যাঁ মশাই, অনেক দিনই ভোর হবার ঠিক আগে যদি তুমি সেখানে হাজির হও তাহলে দেখতে পাবে যে আমরা কবরের মাটি খুঁড়ছি, আর আমাদের শবাবরণগুলোকে বেড়ার উপর শু কোবার জন্য মেলে রেখেছি। আরে, একদিন আমার একটা চমৎকার শবাবরণ সেখান থেকে চুরিই হয়ে গেল-স্মিথ নামে। এক মক্কে ল সেটা নিয়ে গেল। ওই দূরের একটা গরীব মানুষদের কবরখানায় সে থাকে। আমার এ কথা মনে করবার কারণ কি জান? যেদিন আমি প্রথম তাকে দেখি সেদিন তার গায়ে একটা চৌখুপি শার্ট ছাড়া আর কিছুই ছিল না; কিন্তু নতুন কবরখানার একটা। সামাজিক মিলন-অনুষ্ঠানে যখন তাকে শেষ বারের মত দেখলাম তখন সেই ছিল সমবেত সকলের মধ্যে সবচাইতে সেরা পোশাকে সজ্জিত মৃতদেহ-আর এটাও খুবই অর্থপূর্ণ যে আমাকে দেখেই সে সেখান থেকে চলে গেল; আবার সম্প্রতি এখানকার একটি বুড়ি তার শবধারটি ই খুইয়েছে-সাধারণত কোথাও গেলে সেটাকে সে সঙ্গে করেই নিয়ে যায়, কারণ তার শ্লেষ্মর ধাত, আর রাতের বাতাস বেশী গায়ে লাগলেই তার সেই বাতের ব্যথাটা চাড়া দেয় যার প্রকোপেই তার মৃত্যুটা ঘটে ছিল। তার নাম হচকিস্-আন্না মাটি ডা। হকিস্-তুমি হয় তো তাকে চিনতেও পার। সামনের দুটো দাঁত এখনও আছে; বেশ লম্বা, কিন্তু এখন অনেকটা ঝুঁকে পড়েছে, বাঁ দিকে পাঁজরের একটা হাড় নেই; মাথার বাঁ দিক থেকে এক গুছি বিবর্ণ চুল ঝুলে আছে, এক গু ছি আছে মাথার ঠিক উপরে ডান কানের দিকটা ঘেঁসে; নীচের চোয়ালটী তার দিয়ে বাঁধা, আর বাঁ হাতের একটা ছোট হাড় কখন লড়াই করতে উড়ে গেছে; হাত দুটো বুকের উপর আড়াআড়িভাবে ভেঙে নাকের ছিদ্র দুটো আকাশের দিকে তুলে এক ধরনের ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁঠে-হয় তো কোথাও না। কোথাও তাকে দেখেছ?

ঈশ্বর না করুন! অনিচ্ছাকৃতভাবে কথাটা বলেই অপ্রস্তুত বোধ করলাম। তাড়াতাড়ি নিজের এই কঠোরতাকে শু ধরে নিয়ে বললাম, মানে আমি শুধু বলতে চাই যে সে সৌভাগ্য আমার হয় নি; ইচ্ছা করে তোমার বন্ধুর সম্পর্কে কোন রকম অসৌজন্যমূলক কথা আমি বলতে পারি না। তুমি বলছিলে যে তোমার শবাবরণটি চুরি হয়ে গেছে, কিন্তু এখন যেটা তোমার গায়ে রয়েছে তার ছিন্ন দশা দেখেও তো মনে হয় যে একসময় এটা খুব দামীই ছিল। তাহলে-

আমার অতিথির মুখমণ্ডলের শুকনো হাড় ও কুঁচকানো চামড়ার একটা ভৌতিক পরিবর্তন দেখা দিল; মুচকি হেসে বেশ চতুর ভঙ্গীতে সে জানাল যে বর্তমান পোশাকটি যখন তার গায়ে উঠেছে ততক্ষণে পার্শ্ববর্তী কবরখানার জনৈক ভূতের একটি পোশাক খোয়া গিয়েছে। ব্যাপারটা বোধগম্য হল। তবু তার মুখভঙ্গী-বিশেষ করে তার হাসি আমার ভাল লাগছিল না। তাই তাকে কথা চালিয়ে যেতেই বললাম।

কংকাল বলতে লাগল, হ্যাঁ বন্ধু যা বললাম সেটাই প্রকৃত অবস্থা। দুটি পুরনো কবর-একটি তে আমি থাকতাম, আর একটি খানিকটা দূরে-আমাদের বর্তমান বংশধরদের দ্বারা এতদূর অবহেলিত হয়েছে যে তাতে আর বাস করা যায় না। কংকালের নিজস্ব অসুবিধা তো আছেই-আর এই বর্ষায় সেটা কম কথা নয়-বর্তমান অবস্থায় সম্পত্তিরও বিস্তর ক্ষতি হচ্ছে। হয় আমাদের অন্যত্র চলে যেতে হবে, আর না হয় চোখের সামনে সব কিছু নষ্ট হয়ে যাওয়া দেখতে হবে। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, তবু এ কথা সত্য যে আমার পরিচিত কারও শবাধারই এখন ভাল অবস্থায় নেই। পাইন কাঠের বাক্সে বোঝাই হয়ে ভাড়াটে গাড়িতে চড়ে যারা এখানে আসে সেই নীচু শ্রেণীর লোকেদের কথা আমি বলছি না; আমি বলছি তোমাদের সেই সব উঁচু মাপের রূপোর কারুকার্য করা শবাধারের কথা যেগুলো কালো পালক মাথায় পরা শোভাযাত্রার আগে আগে আসে, আর যারা ইচ্ছামত কবরের জায়গা বেছে নিতে পারে-অর্থাৎ জার্ভিস, ব্লেড় সু ও বালিংদের কথাই আমি বলছি। সেই সবই আজ ধ্বংসের মুখে। তারাই ছিল আমাদের মধ্যে সব চাইতে শাঁসালো লোক। অথচ এখন তাদের দিকে তাকাও-একেবারেই রসহীন আর দারিদ্র্যপীড়িত। একজন ব্লেড সু তো জনৈক পরলোকগত নাপিতের কাছে দাড়ি। কামাবার সরঞ্জামের বদলে তার স্মৃতিফলকটাই বেচে দিল। অথচ একটি মৃতদেহের কাছে তার স্মৃতিফলকটি ই সব চাইতে গর্বের বস্তু। তার উপর খোদাই করা কথা গুলি পড়তে সে ভালবাসে। কোন রকম অভিযোগ না করেই বলছি, আমার বংশধররা এই পুরনো। পাথরটা ছাড়া আমার কবরে যে আর কিছুই দেয় নি তাতে আমার প্রতি খুবই খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে-তার উপরে আবার এই পাথরে কোন রকম গুণকীর্তনই লেখা নেই। একসময় এই পাথরটার গায়ে লেখা ছিল–

‘উপযুক্ত পুরস্করই সে পেয়েছে’

লেখাটা দেখে প্রথমে খুবই গর্ববোধ হয়েছিল, কিন্তু যত দিন যেতে লাগল ততই দেখতাম আমার কোন পুরনো বন্ধু এখানে এলেই রেলিং-এর ভিতরে থুতনিটা গলিয়ে মুখ বাড়িয়ে এটা পড়ত আর তারপরে মুচকি হেসে খুসি মনে ফিরে যেত। কাজেই ঐ বোকাদের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যই লেখাটা আমি মুছে ফেলে দিলাম। কিন্তু একটি মৃত মানুষ তার স্মৃতিফলক নিয়ে খুবই গর্ববোধ করে। ঐ তো দূরে আধা ডু জন জার্ভিস তাদের পারিবারিক স্মৃতিফলকটি সঙ্গে নিয়েই চলে যাচ্ছে। একটু আগে স্মিথরাও চলে গেল তাদের স্মৃতিফলক নিয়ে। আরে, হিগিন্স যে, বিদায় পুরনো বন্ধু। উনি হলেন মেরিডিথ হিগিন্স-৪৪ সালে মারা গিয়েছিলেন-কবরখানায় আমাদের দলেই ছিলেন-খুব পুরনো পরিবার-ওর সঙ্গে আমার খুব ভাব-আমার কথা শুনতে পায় নি বলেই জবাব দিল না। আর তাই তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলাম না বলে আমি দুঃখিত। ওকে দেখলে তোমারও ভাল লাগত। ও রকম বিকৃত, গাঁট–খোলা কংকাল তুমি কখনও দেখ নি। সে যখন হাসে, মনে হয় দুটো পাথরে ঘসাঘসি হচ্ছে, কিন্তু লোকটি খুব আমুদে। সে এমনভাবে কথা বলে যেন কেউ জানালার কাঁচের উপর নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে। হেই জোন্স! উনি হলেন বুড়ো কলম্বাস। জোন্স-তার শবাচ্ছাদন তৈরি করতেই ব্যয় হয়েছিল চারশ ডলার-স্মৃতি-ফলকটার জন্য ব্যয় হয়েছিল সাতাশ শ। 2৬ সালের বসন্তকালের কথা। তখনকার দিনের পক্ষে সে এক এলাহি ব্যাপার। সব জায়গা থেকে মৃতরা এসে ভিড় করেছিল তার তৈজসপত্রাদি দেখতে। ঐ যে একটি কংকাল একা একা চলেছে, বগলে একটু করো বোর্ড, হাঁটুর নীচে কার পায়ের একটা হাড় নেই, সঙ্গেও কিছু নেই-দেখতে পাচ্ছ? উনি হলেন বাফ্টো ডালহৌসি-যত লোক আমাদের কবরখানায় ঢুকেছে তাদের মধ্যে কলম্বাস জোন্সের পরে। তিনিই ছিলেন সব চাইতে পরিপাটি সাজে সজ্জিত। আমরা সবাই চলে যাচ্ছি। আমাদের বংশধরদের কাছে যে ব্যবহার পাচ্ছি তা আর আমরা সইতে পারছি না। তারা নতুন নতুন কবরখানা খুলছে, কিন্তু আমাদের ফেলে রেখেছে অনাদৃত অবস্থায়। কিছু রাস্তা তারা। মেরামত করে, কিন্তু আমাদের রাস্তায়, বা আমাদের জিনিসপত্রে কখনও হাত দেয় না। আমার শবাধারটি ই দেখ-অথচ আমি বলছি এক সময়ে এটা একটা দেখবার মত আসবাব ছিল-শহরের যোন কোন বসবার ঘরে রাখলে এটা লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। যদি চাও তো এটা তোমাকে দিতে পারি-এটাকে মেরামত করার সামর্থ্য আমার নেই। তলাকার কাঠ টা নতুন লাগিয়ে নিও, উপরের কাঠটাও কিছুটা পাল্টাতে হবে, বাঁ দিকে একটা নতুন পটি বসিয়ে দিও, তাহলেই দেখতে একেবারে খাসা হবে। ধন্যবাদ দিতে হবে না-ওকথা বলো না-তুমি আমার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করেছ, তাই আমাকে অকৃতজ্ঞ মনে করবার আগেই আমার যা কিছু আছে সব তোমাকে দিয়ে যাব। এই চাদরটা আমার বড়ই প্রিয়, তুমি যদি চাও-চাও না? বেশ, তোমার যেমন মর্জি, আমি শুধু ন্যায়পরায়ণ ও উদার হতে চেয়েছিলাম-আমার মধ্যো নীচ তা পাবে না। বিদায় বন্ধু এবার আমাকে যেতে হবে। জানি না-হয়তো অত রাতে আমাকে অনেকটা পথ চলতে হবে। শুধু একটি কথা নিশ্চিত জানি, আমি এবার যাত্রীদলে ভিড়েছি, ঐ পুরনো কবরে আর আমাকে ঘুমুতে হবে না একটা সম্মানজনক বাসস্থান না পাওয়া পর্যন্ত আমি চলতেই থাকব, তাতে যদি নিউ জার্সি পর্যন্ত পা চালাতে হয় তাও সই। সকলেই চলেছে। গত রাতের জমায়েতেই স্থির হয়েছে চলে যেতে হবে; তাই সূর্য উঠবার সময় হলে দেখা যাবে পুরনো গোরস্থানে একটা হাড়ও পড়ে নেই। হেলো, ঐ যে জনাকয় ব্লেড় সু যাচ্ছে; তুমি যদি পাথরটা তুলে নিতে একটু সাহায্য কর তাহলে আমিও ওদের দলে যোগ দিতে পারি। ওরা খুব বড় বংশের লোক। বিদায় বন্ধু।

কবরের পাথটাকে ঘাড়ে নিয়ে ভাঙা শবাধারটাকে টানতে টানতে সে শোভাযাত্রার সঙ্গে যোগ দিল; বেশ আন্তরিক পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও তার দানকে আমি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। যতদূর মনে হয় দুঘণ্টা ধরে এই বিষণ্ণ সমাজপরিত্যক্তের দল তাদের জিনিসপত্র নিয়ে সেখান দিয়ে যেতে লাগল, আর আমি বসে বসে করুণার চোখে তাদের দেখতে লাগলাম। তাদের মধ্যে যে দুএকজন অপেক্ষাকৃত যুবক এবং যাদের চেহারা ও অতটা বিধ্বস্ত নয় তারা রেলপথের মাঝ রাতে চলাচলকারী ট্রেনের খোঁজ-খবর করল; মনে হল বাকিরা রেলপথের কোন খবরই রাখে না; তারা বিভিন্ন শহরে ও নগরে যাবার রাস্তাঘাটের হদিস জানতে চাইল; তার মধ্যে অনেক শহর-নগরের নামই এখন আর মানচিত্রে পাওয়া যাবে না, দীর্ঘ ত্রিশ বছর আগেই সেগুলি মানচিত্র থেকে এবং পৃথিবী থেকেও উধাও হয়ে গেছে। ঐ সব শহর-নগরের কবরখানার বর্তমান অবস্থা কেমন, আর মৃতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সুনাম তাদের আছে কিনা-সে সম্পর্কেও তারা খোঁজ-খবর নিল।

সমস্ত ব্যাপারটাই আমাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করল; এই সব গৃহহারাদের জন্য আমার মনে সহানুভূতিও জাগল। যেন এ সবই বাস্তব ঘট না, যেন আমি মোটেই স্বপ্ন দেখছি না এমনিভাবে জনৈক মৃত যাত্রীকে আমার মনোভাব জানিয়ে বললাম, এই বিচিত্র ও একান্ত দুঃখদায়ক অভিযানের একটি বিবরণ প্রকাশ করবার ইচ্ছা আমার মাথায় ঢুকেছে; আরও বললাম, যদিও এর যথাযথ বর্ণনা আমি করতে পারব না, তবু মৃতদের প্রতি যাতে এতটুকু অশ্রদ্ধা প্রকাশ না পায় সে বিষয়ে আমি সতর্ক থাকব। কিন্তু একজন প্রাক্তন নাগরিকের রাজকীয় ধ্বংসাবশেষ আমার ফ টুকের উপর অনেকখানি ঝুঁকে পড়ে কানে কানে বলল;

ও নিয়ে আপনি মাথা ঘামাবেন না। যে কবরখানা ছেড়ে আমরা চলে যাচ্ছি তাকে যারা এতদিন সহ্য করেছে, আজ সেই সব কবরখানায় যারা অবহেলিত ও পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রইল তাদের সম্পর্কে যে যাই বলুক তাও তারা অবশ্য সহ্য করতে পারবে।

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা মোরগ ডেকে উঠল, আর সেই ভৌতিক শোভাযাত্রা অদৃশ্য হয়ে গেল, একটু করো ন্যাকড়া বা একখানি হাড়ও সেখানে পড়ে রইল না। আমার ঘুম ভেঙে গেল; দেখলাম, বিছানার বাইরে মাথাটা বেশ খানিকটা ঝুলিয়ে আমি শুয়ে আছি-এ অবস্থাটা হয় তো নীতি-বাক্য সমন্বিত স্বপ্ন দেখার পক্ষে উপযুক্ত, কিন্তু কাব্যের পক্ষে অনুকূল নয়।

মন্তব্য: পাঠক নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে, তার নিজের শহরের কবরখানার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা যদি ভাল থাকে, তাহলে এই স্বপ্ন তার শহরের বিরুদ্ধে মোটেই দেখা হয় নি; এ স্বপ্ন-বিবরণ বিশেষভাবে এবং একান্ত তিক্ততার সঙ্গে তার পাশ্ববর্তী শহরের বিরুদ্ধেই লিপিবদ্ধ করা হল।

[১৮৭০]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *