একটি আবাসিক হোটেল
১
শহরে বিরাট একটা হট্টগোল লেগে গেছে। সেটা কী নিয়ে, তা বোঝা যাচ্ছে না। সব কটা দোকানের শাটার লাগানো। আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। থমথমে অবস্থা।
এর ভেতরে একটি আবাসিক হোটেলের সামনে ছোটখাটো একটি জটলা তৈরি হয়। রাত তখন বারোটার কাছাকাছি। হোটেলের কলাপসিবল গেট লাগানো। ভেতর থেকে সিকিউরিটি গার্ড নির্বিকার ভঙ্গিতে জানাল, গেট খোলা যাবে না।’
বাইরে অপেক্ষমাণ কয়েকজন; তারা থাকার জন্য রুম খুঁজছে। ভীষণ জরুরি সবার। আশেপাশে যে কয়টা হোটেল ছিল, রুম খালি নেই।
তাদের একজন সিকিউরিটি গার্ডকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘গেট খোলা যাবে না কেন? কোথাও লেখা আছে?’
‘বাইরে ধরপাকড় চলতেছে। গেট খুলতে নিষেধ আছে।’
তারপর এই কথা থেকে সেই কথায়, একটা বিচ্ছিরি গোলমাল বাঁধে। সেটার পক্ষে-বিপক্ষে মত দেবার এবং সেই মতকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে মানসিক স্ট্রেস থাকতে হয়, সেটা কারো ভেতরে নেই। প্রত্যেকে যে যার কথা বলছে এবং কেউই কারো কথা শুনছে না।
অবস্থা যখন বেগতিক তখন সিকিউরিটি গার্ড গেট খুলতে সম্মতি জানায়। তবে মুশকিল হলো, একটি মাত্র রুম খালি আছে। তারা নিজেরা ফয়সালা করুক, রুমটিতে কে থাকবে।
এরপর আবার হইচই। প্রত্যেকেই বোঝাতে চাইছে রুমটি তার দরকার। যে আগে এসেছে, রুম সে পাবে। এক্ষেত্রে তারা কোনো সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারেনি।
তাদের ভেতর একজন রবিন। বয়স উনিশ। আগামীকাল তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা। সে এসেছে রংপুর থেকে। পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো। এখন শুধু রুমে গিয়ে জেনারেল নলেজে চোখ বুলিয়ে শুয়ে পড়া।
তার পাশে যে ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে, তার নাম সাব্বির। সে বেশ বিমর্ষ। শরীরে কোনো শক্তি নেই, কিন্তু কথা বলছে সব শক্তি খরচ করে। পাশেই একটি হসপিটাল। সেখানে আইসিইউতে তার বাবা। সকালে অনেক কাজ। কিছু টাকাপয়সাও জোগাড় করতে হবে। বাড়িতে ইতোমধ্যে খবর দেয়া হয়েছে।
রুমের জোর দাবিদার আরও দুজন। তারা দুজন অবশ্য একসাথে এসেছে। গত সপ্তাহ থেকেই প্ল্যান চলছিল, একটু ফরেন মদ খাবে। তাদের মধ্যে একজনের নাম মোবারক। সে একটা পাথর নিয়ে রীতিমতো তালা ভাঙার চেষ্টা করছে। মোবারকের বন্ধু মিঠু। সে কুঁজো হয়ে পাথর খুঁজছে। আরও বড় পাথর লাগবে।
পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তখন রিসিপশন থেকে একজন এগিয়ে আসে। তিনি একটি অদ্ভুত সমাধান দিলেন। বললেন, ‘উপরে-নিচে করে চারটা বেড রেডি করা যাবে।’
কিন্তু তার এই কথায় পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে ওঠে। কারো সাথে কারো পরিচয় নেই। একসাথে থাকার প্রশ্নই আসে না। মোবারক ফ্যাসফেসে গলায় বলল, ‘ঘুমের মধ্যে কেউ টাকা নিয়ে গায়েব হলে দায়ভার কে নেবে?
মিঠু এক ধাপ এগিয়ে কোনো এক পলিটিকাল ভাইকে ফোন করেছে। পোলাপান লাগবে।
রিসিপশনিস্ট শুকনো গলায় বললেন, আপনাদের ভেতরে সবার আগে কে এসেছেন?’
প্রত্যেকে এক সাথে কথা বলতে শুরু করে। কেউ কারো কথা শুনছে না। এবং কারো কথা কেউ বুঝতে চাইছে না।
রাত একটার কিছু পর তারা চারজন হোটেলের একটি রুমে প্রবেশ করে। দুটি সিঙ্গেল বেড আর ফ্লোরে দুটি মাদুর দিয়ে বিছানা করা। এসি রুম, অ্যাটাচ বাথরুম। বেড দুটিতে মোবারক আর মিঠু পা এলিয়ে বসে পড়েছে। মিঠুর হাতে টিভির রিমোট। সে বিটের গান শুনবে।
এর ভেতরে একটা ফোন বেজে ওঠে। রবিনের আম্মু ফোন করেছে। প্রবেশপত্র নিয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করছে। রবিন হাত দিয়ে টিভির ভলিউম কমাতে ইশারা করে। মিঠুর সেদিকে খেয়াল নেই। সে নিজেও মুখ নাড়ছে ‘সাইয়া দিলমে আনারে, আখে ফিরনা জানারে…ছম ছমাছম ছম।’
‘গান কোটে বাজতোছে?’
‘তেমন কিছু নোয়ায়।’
‘তেমনুকছু নোয়ায় ফির কি?’ তুই কোটে? রবিনের আম্মুর গলায় উৎকণ্ঠা।
মিঠু উঠে গিয়ে হোটেলের করিডোরে গেল। আলামিন নামে এক ছেলে আছে, হোটেল বয়। সে মশারি টানিয়ে শুয়ে পড়েছে।
‘আইস হবে?’
আলামিন ঘুমে তলিয়ে গেছে। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। ‘আইস হবে আইস?’
‘আইস কী?’
আলামিনের বয়স সতেরো। দেখতে গোবেচারা কিন্তু হোটেলের নানান কুকর্মের সাথে জড়িত। এই যে তাদের বলা হয়েছে, আর কোনো রুম খালি নেই, আসলে আরও একটি রুম খালি আছে। বিশেষ প্রয়োজনে দরকার হয়।
‘কয়েকটা বরফের টুকরো লাগবে।’
আলামিন মাথা নেড়ে বলল, ‘বরফ নাই।’
‘ঠান্ডা পানি এনেছিলে কোথা থেকে?’
‘ফ্রিজ থেকে। ফ্রিজে বরফ নাই।’
‘চল দেখে আসি।’
আলামিন চুপ করে আছে। মিঠু তাকে জোর করে স্টোর রুমে নিয়ে যায়। ফ্রিজে বরফ পাওয়া গেছে। আলামিন ঘুম ঘুম চোখে একটা বাটিতে বরফ রাখছে। মিঠু পকেট থেকে একশ টাকা বের করে বলল, ‘জলদি একটা ঠান্ডা কোক নিয়ে আসো।’
‘এত রাতে কিছু খোলা নেই।’
‘তোমার তো বরফও ছিল না। পরে পাওয়া গেছে।’
আলামিন টাকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না কী করবে।
২
রবিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আলোতে তার ঘুমাতে অসুবিধা। রুমে অন্য যারা আছে, তাদের কাউকে দেখে মনে হচ্ছে না, ঘুমানোর চিন্তাভাবনা আছে। সে মনে মনে একশ ভেড়া উল্টো দিক থেকে গুনতে শুরু করে।
‘মোবাইল হবে?’
রবিন আপ্রাণ চেষ্টা করছে না শোনার। জবাব দিলেই তার ভেড়ার হিসেব ছুটে যাবে। আবার শুরু করতে হবে প্রথম থেকে।
‘ঘুমিয়ে গেছেন?’
রবিন চোখ মেলে তাকায়। ‘প্লিজ, বিরক্ত করবেন না।’
‘মোবাইল হবে?’
‘মোবাইল কেন?’
‘আমার নাম্বারে একটা ফোন দিব।’
‘কেন?’
‘ফোন খুঁজে পাচ্ছি না। ‘
মুশকিল হলো মিঠুর নিজের নাম্বার মনে পড়ছে না। তার নাম্বার পাওয়া যাবে মোবারকের কাছে। মোবারকের ফোন চার্জে দেয়া। সে গোসলে গেছে।
রবিন চোখ বন্ধ করে ভেড়া গুনতে শুরু করে। মাঠ ভর্তি ভেড়া। আগে বাউন্ডারি লাইনের ভেড়াগুলো গুনবে, তারপর মাঝখানে। হঠাৎ একটি ফোন বাজে। সাব্বিরের মা ফোন করেছে ফেরিঘাট থেকে। তিনি আসতে চাইছেন কিন্তু ঘাটে ফেরি নেই।
‘তোর বাবার শরীর কেমন?’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘এখন কী করে?’
‘ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে।’
ফোনের ওপাশ থেকে তিশার কথা শোনা যায়। সে কথা বলতে চায়।
‘আব্বুর কী হয়েছে ভাইয়া?’
‘অসুখ হয়েছে।’
অসুখ হলে কি মানুষ মারা যায়?’
‘কে বলেছে? তোমার জ্বর হয়নি?’
‘আব্বুর কি জ্বর হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। জ্বর হয়েছে।’
‘জ্বর হলে বেশি করে পানি দিতে হয়।’
‘আচ্ছা দিব।’
‘আমাদের স্কুলে বলেছে, বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হয়। আব্বু কি বৃষ্টিতে ভিজেছে?’
‘হ্যাঁ একটু ভিজেছিল।’
‘কিন্তু এখন বৃষ্টি আসল কোথা থেকে?’
‘অনেকদিন আগের বৃষ্টি। ‘
‘অনেকদিন আগে বৃষ্টিতে ভিজলে অনেকদিন পর জ্বর হয়?’
সাব্বির মাথা নাড়ে
‘তাহলে আম্মু কাঁদছে কেন?’
‘আম্মু তো এমনিতেই কাঁদে।’
তিশা ভেবে পায় না, বড়রা এমনিতে কেন কাঁদে! তার যখন খারাপ লাগে তখন সে কাঁদে। এমনি এমনি কাঁদে না।
‘তুমি?’
‘আমি কি কাঁদছি নাকি?’
‘হ্যাঁ কাঁদছ। আমি তোমার গলা শুনে বুঝতে পারি।’
সাব্বির নিঃশব্দে চোখ মোছে।‘
‘এখানে এত শব্দ কেন?’
‘রুমে আরও কয়েকজন আছে।’
‘এনারা কারা?’
‘একেকজন একেক জায়গা থেকে এসেছে।‘
তুমুল আকারে হইচই শুরু হলো। ঘটনার সূত্রপাত আলামিনকে দিয়ে। সে জানায়, কোক পাওয়া যায়নি। তাকে যে একশ টাকা দেয়া হয়েছে, সেখান থেকে পঞ্চাশ টাকা খরচ হয়েছে রিকশা ভাড়ায়।
মিঠু চোখ কপালে তুলে বলল, ‘রিকশা করে গেছো কোক আনতে?’
‘আশেপাশে দোকান সব বন্ধ।’
বাথরুম থেকে মোবারকের শব্দ শোনা যায়। তাওয়েল নেই।
আলামিন নরম গলায় বলল, ‘ধুইতে দিছে।’
‘তোমরা একটা রুম ভাড়া দিছ আর বলতেছ তাওয়েল ধুইতে দিছে!’
আলামিন মাথা চুলকায়। যা সত্য সে তাই বলেছে।
মোবারক ভেজা শরীরে সারা ঘর মাড়িয়ে রিসিপশনে ফোন করে। রিং
বেজে চলেছে।
‘ফোন ধরছে না কেন?’
‘ঘুম।’
‘মালিকের নাম্বার দাও!’
‘আমার কাছে নাই।’
এই পর্যায় মিঠু উঠে গিয়ে একটা চড় মারে। চড় মারার শব্দে রবিনের ঘুম ভেঙে যায়। কাঁথা থেকে মুখ সরিয়ে সে দেখছে, তার সামনে এক বালক স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে গালের ক্ষতস্থানে হাত বোলাচ্ছে। তার হাতে সময় নেই। সে আবার ভেড়া গুনতে শুরু করে।
৩
রাত তিনটা দশ মিনিট। রবিন ঘুমে তলিয়ে গেছে। ঘুমের ভেতরে স্বপ্ন দেখছে, সে পরীক্ষার হলে বসে আছে। সব প্রশ্নের উত্তর তার জানা কিন্তু লিখতে পারছে না। সে কলম নিয়ে আসতে ভুলে গেছে।
ক্লাসের কারো কাছ থেকে একটি কলম পাওয়া গেল না। তারপর অন্য
ক্লাসে যাবার পথে ভয়ংকর এক কান্নার শব্দ ভেসে আসে। জোয়ারের শব্দের মতো। ধীরে ধীরে শরীর হিম হয়ে ওঠে।
প্রথমে মনে হয়েছিল একটা সমুদ্র মানুষের মতো করে কাঁদছে, তারপর বোঝা গেল, একটা মানুষ সমুদ্রের মতো করে কাঁদছে। তুলার মতো একটা শব্দ কানের পাশে এসে বসে। কিছু কিছু সময় শব্দ থেমে যায়। তারপর আবার যখন শুরু হয়, শব্দের আওয়াজ পরিবর্তন হয়।
রবিন চোখ মেলে তাকায়। ‘কাঁদছেন কেন?’
সাব্বির কথার জবাব দেয় না।
রুমে বাতি জ্বলছে। টিভি চলছে। দুজন বসেছে ফরেন মদ নিয়ে। একজন চেষ্টা করছে ঘুমাবার। আর একজন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কেউ কাউকে বুঝতে পারে না কিন্তু সবাই চাইছে অন্যরা তাকে বুঝুক।
হঠাৎ একটা ফোন পেয়ে জিজ্ঞাসা করে সাব্বির, ‘আপনাদের কারো রক্তের গ্রুপ এবি নেগেটিভ?’
মিঠু আর মোবারক একসাথে মাথা নাড়ে—’না’।
তাদের উত্তেজনায় রবিন ঘুম থেকে উঠে বসে। তাকেও জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। সে না সূচক জবাব দিয়ে কাঁথা মুড়ি দেয়। চেষ্টা করছে অর্ধেক স্বপ্ন জোড়া লাগাবার। কয়েক ঘণ্টা পর তার পরীক্ষা। সে আবার ভেড়া গুনতে শুরু করে। মাঠে এবার অল্প কয়টা ভেড়া-হাতে সময় নেই।
পরদিন সকালে রবিন পরীক্ষা দিতে পারেনি। সে অ্যাডমিট কার্ড ফেলে এসেছে। কোথায় রেখে এসেছে, সেটাও তার মনে আছে। অস্থির চিত্তে দিগ্বিদিক ভুলে ছুটে চলেছে হোটলের দিকে। সিএনজি রাস্তায় সিগন্যালে দাঁড়ালে সেখান থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করে।
পথিমধ্যে দেখা হয় সাব্বিরের সাথে! অ্যাম্বুলেন্স, লাশ আর কান্নার শব্দে ফোকাস ডিফোকাসে কোথায় একটা সমস্যা হয়।
জিজ্ঞাসা করে রবিন ‘কী হয়েছে?’
‘মারা গেছে।’
‘কে?’
‘বাবা।‘
‘কীভাবে?’
‘খুব রেয়ার ব্লাড। এবি নেগেটিভ।’
‘পাওয়া যায়নি?’ প্রশ্নটি করতে গিয়ে আর করা হয়নি। কেমন করে করবে? তার রক্তের গ্রুপ এবি নেগেটিভ। এই সত্য জানলে নির্ঘাত আরেকবার মৃত্যু হবে।