একটি আজগুবি অথবা সত্যি বিকেল

একটি আজগুবি অথবা সত্যি বিকেল

রিকশাওয়ালা বলল, এই গলি দিয়ে সোজা গেলেই সাঁপুইপাড়া।

ভাড়া মিটিয়ে আবেশ বলল, আর যেতে হবে না, এখানেই নেমে যাচ্ছি।

রিকশা থামিয়ে লোকটা জিজ্ঞাসা করল, কী নামটা যেন?

অধিরাজ কংসবণিক, ছেলের নাম সোমরাজ।

অ। নাহ চিনি না। অবশ্য এখন তো ওই পাড়ায় অনেক নতুন লোক এসেছে। সকলকে চিনি না। আর রিকশাও তো আজকাল তেমন…বলতে বলতে গিয়ে থেমে গেল লোকটা।

আবেশ তাকাল রিকশাচালকটির দিকে। শুকনো চেহারা। একটা নস্যি রঙের ফুলপ্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গোটানো আর মা তারা বাসনালয়ের বিজ্ঞাপন লেখা ময়লা হয়ে যাওয়া হলদে গেঞ্জি। গা থেকে ঘামের গন্ধ বেরোচ্ছে। গেঞ্জিটা ঘামে ভেজা। ভাঙাচোরা মুখ। তোবড়ানো গালে কাঁচা-পাকা বিজবিজে দাড়ি।

আবেশ গলিটা ধরে হাঁটতে থাকল। হ্যাঁ, এই তো এবার মনে পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু বাড়িগুলো আর চেনার উপায় নেই। গলির দুইপাশে যে বাড়িগুলো ছিল সেগুলো সব ম্যাজিকের মতো ভ্যানিশ। দুই-তিনটে ফ্ল্যাট-বিল্ডিং হয়েছে। পুরোনো বাড়িগুলোও পুরো ভোল পালটে ফেলেছে। সোমরাজের বাড়িটা চেনা যাবে তো? ওরা রয়েছে তো আদৌ? এই দোলাচলে পা ফেলতে থাকল আবেশ। কতকাল পরে আবার এই পাড়ায় আসা। কতদিন? আর মনে পড়ে না। তবে থাকবে নিশ্চয়ই, সোমরাজ বলেছিল যেদিনই আসবি এখানে চলে আসিস, আমরা এই সাঁপুইপাড়া ছেড়ে কোথাও নড়ছি না, নড়ব না। শিকড় গেঁথে গিয়েছে পুরো এখানকার মাটিতে।

একটা মুদিখানার দোকান নজরে এল। এই দোকানটা আগে ছিল কি? নাহ, মনে পড়ছে না। স্মৃতি কি এতটাই ঝাপসা হয়ে গেল! কোনটা নতুন আর কোনটা পুরোনো মনে পড়ছে না! গলিতে অনেকগুলো টিউবলাইট জ্বলছে। আবেশ মনে মনে বিড়বিড় করছিল—একটা টিউবওয়েল ছিল, তার পাশেই একটা নারকেলগাছ। ওই গাছটার ঠিক পিছনেই ছিল সোমরাজদের বাড়ি।

আরও কিছুটা যাওয়ার পরেই…ওই তো, হ্যাঁ, ঠিক এইবার চিনেছে। উফফ, স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল আবেশ। স্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা অবাকও হল। এটা কেমন হল? সোমরাজদের বাড়িটা এত বছর পরেও ঠিক একই রকম দেখতে রয়েছে! বাড়ির চারপাশের বাড়িগুলো বিলকুল বদলে গিয়েছে। এমনকী ওদের বাড়ির পিছনে দুটো বিশাল ফ্ল্যাটবাড়িও কিংকং-এর মতো দাঁড়িয়ে, কিন্তু সেই চৌকো উঠোন, উঠোনে সোমরাজের বাবার নিজের হাতে তৈরি ফুলের বাগান, পাঁচিল, কালো রং করা গ্রিলের গেট। একতলা ছোট বাড়িটা এখনও সেই সাদা রঙ। পাঁচিলেও সাদা চুনকাম। সোমরাজদের বাড়ির এই একটাই বৈশিষ্ট ছিল, সাদা রঙ। সোমরাজের বাবা ও মা দুজনেরই প্রিয় রং ছিল সাদা এবং হয়তো মা-বাবার কারণেই সেই সাদা রঙের প্রতি ঝোঁকটা সেমরাজের প্রতিও বর্তেছিল। তবে সাদার প্রতি ভালোবাসাটা ওদের তিনজনেরই একটা অবসেশনের পর্যায়ে ছিল। কিছুটা বাড়াবাড়িই মনে হত পরিচিতদের। ওদের প্রতিটি ঘর ছিল সাদা রং, বিছানার চাদর, বালিশ সাদা। সোমরাজ বেশিরভাগ সময়েই সাদা শার্ট বা গেঞ্জি পরত। ওর বাবাও তাই। এই নিয়ে বন্ধুদের মধ্যেও ইয়ার্কি ফাজলামো চলত।

মন খুশি হয়ে গেল আবেশের। একহাতে প্লাস্টিকের প্যাকেটে ঝোলানো তালশাঁস সন্দেশের প্যাকেট, অন্য হাত দিয়ে গ্রিলের গেটটা খুলল আবেশ। গেটের ঠিক ডানপাশে পাঁচিলের গায়ে শ্বেত পাথরের ফলকে কালো অক্ষরে লেখা ‘আশালতা’। এই বাড়ির নাম। সোমরাজের ঠাকুমার নামে বাড়ি। বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেটটা বন্ধ করতে করতে আবেশ আবার ভাবল আদৌ ওরা রয়েছে তো বাড়িতে? যদিও আজ রবিবার। মার্চ মাসের শেষ রবিবারের বিকেল। থাকারই কথা। দেখা যাক।

লনটায় পা রেখেই আবেশের মনে পড়ল এই বাড়িতে আগে বন্ধুরা দল বেঁধে ঢুকলে শুরুতেই যে খেলাটা হতো তা হল কে ক’টা লাফে এই গ্রিলের গেট থেকে বাড়ির দরজায় পৌঁছতে পারে। কেউ চারটে কেউ বা পাঁচটা লাফে টপকে যেত। আবেশের হতো ঠিক পাঁচটা। কিছুতেই ওটাকে কমিয়ে চারটেতে আনতে পারত না। একমাত্র সবথেকে লম্বা সুশান্ত সাড়ে তিন লাফেই পৌঁছে যেত একেবারে দরজার মুখে।

এখনও কি আবেশের পাঁচটা লাফই প্রয়োজন হবে? নাকি…একবার দেখলে…থাক, পরে দেখা যাবে। পায়ে হেঁটে ঠিক দশ পা যাওয়ার পর পালিশ করা কাঠের দরজায় কড়া নাড়ল আবেশ।

প্রথমে কোনও সাড়া নেই। আবার খটখট। সাড়া নেই।

কেউ নেই! কিন্তু দরজায় বাইরে থেকে তো তালা নেই। তাহলে… শেষবার দরজার কড়া নাড়তে যাবে তখনই ভেতর থেকে সাড়া এল—যাচ্ছি। কাকিমার গলা। মিনিট খানেকের মধ্যেই এসে দরজা খুলল কাকিমা।

সেই আটপৌরে ঢঙে পরা শাড়ি। শাড়ি থেকে মা-মা গন্ধ বেরোচ্ছে। কপালে এতবড় সিঁদুরের টিপ। একমাথা কোঁচকানো কাঁচা-পাকা চুল।

ও আবু তুই? আয়।

আবেশ খুব অবাক হল। একবার দেখেই চিনে ফেলল ওকে। ‘আমাকে চিনতে পারছ কাকিমা’ প্রশ্নটা করা হল না।

সমু আছে কাকিমা?

হুঁ আছে তো। যা ঘরে যা।

কাকিমার পাশ দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল।

সোমরাজের ঘরটা ড্রয়িংরুমের ঠিক ডানদিকে। আবেশ সেই ঘরে ঢোকার আগে দেখতে পেল ড্রয়িংরুমের এক কোণে সাদা লেসের কভার ঢাকা দেওয়া কাঠের টুলের ওপর ফ্লাওয়ার ভাসে রজনীগন্ধার স্টিক রাখা রয়েছে। এই ফুল রাখার ব্যাপারটা এই বাড়ির অভ্যাস! এইটা কাকুর শখ। ফুলের বাগান এবং ঘরে ফুলদানিতে রজনীগন্ধার স্টিক। এত ভালো লাগে!

সোজা সোমরাজের ঘরে ঢুকে পড়ল আবেশ। ঘরে খাটের ওপর বসেছিল সোমরাজ। আবেশকে দেখে বলল, এসে গেছিস, এখুনি ভাবছিলাম তোর কথা।

শুনে থমকানোর কথা ছিল আবেশের, কিন্তু সেসব কিছুই হল না। একগাল হেসে বলল, অমনি দিলি একটা!

মাইরি বলছি, ভাবছিলাম কখন আসবি আর এসে ক্যারমের বোর্ডটা একটু কষ্ট করে খাটে তুলবি।

তুই শালা…পর্যন্ত বলেই ব্রেক কষে গলা নামিয়ে আবেশ বলল, মহা খচ্চর।

সোমরাজ ওর স্বভাবসুলভ ফিক করে হাসিটা ছাড়ল। তারপর বলল, একটু হেল্প করে দে গুরু। মাকে আজ সন্ধেবেলায় ওটা বানাতে বলেছি, তোর স্পেশাল আইটেমটা।

সত্যি?

মাক্কালি। মাকে জিজ্ঞাসা কর।

ঠিক আছে। বলে খাটের একপাশে খাড়া করে রাখা ভারি ম্যাচবোর্ডটা দুহাতে শক্ত করে ধরে খাটের ওপর ধপাস করে ফেলল আবেশ। সমুর বোর্ডটা বেজায় ভারি। তবে খেলে খুব মজা। গত বছর কাকু সমুর জন্মদিনে ওকে গিফট করেছিল। তারপর থেকে এটা বন্ধুদের সমান অধিকার। এমনকী অনেক সময় সমু বাড়িতে না থাকলেও বন্ধুরা এসে নিজেদের মতো খেলে যায়। ক্যারাম খেলায় সমুর বাবা হলেন পুরো চ্যাম্পিয়ন। একসময় পাড়া, বেপাড়া ক্লাব, অফিসে প্রচুর কম্পিটিশনে নাম দিতেন, অনেক প্রাইজও পেয়েছেন। আবেশরা সুযোগ পেলেই কাকুর কাছ থেকে ক্যারমের স্ট্রোক শেখে। বাবার কাছ থেকে সমুও শিখে দিনে দিনে তুখোড় হয়ে উঠেছে।

বোর্ড থেকে সবুজ কভারের দড়িগুলো খুলে ফেলল দুই বন্ধু মিলে। তারপর চকচকে বোর্ডটা শুকনো ন্যাকড়া দিয়ে মুছে তার ওপর সাদা কৌটো থেকে পাউডার ঢালা হল। শেষে ঘুঁটি সাজিয়ে শুরু হয়ে গেল খেলা। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দুই বন্ধু আত্মমগ্ন। এবারেও যথারীতি সমু এগিয়ে যাচ্ছে। টপাটপ নিজের সাদা ঘুঁটিগুলো ফেলে যাচ্ছে পকেটে। খুব রাগ হচ্ছে আবেশের। কাকু কেন সমুকেই সব টেকনিক শেখাচ্ছে। এমন করলে তো আর ওর সঙ্গে এক দানও খেলা যাবে না। ধুর…।

ভাবতে ভাবতেই ঘরে ঢুকলেন অধিরাজ। আবেশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন—কী রে হারছিস না জিতছিস?

আবেশ বেশ রাগত গলাতেই বলল, তোমার জন্য জেতার উপায় রয়েছে নাকি? সব টেকনিক ছেলেকে শিখিয়ে দিয়েছ। আমাদের জন্য কিছুই রাখোনি। আর খেলব না।

আবেশের কথা শুনে বাপ-ব্যাটা দুজনেই হেসে উঠল। অধিরাজ বললেন, তা তুই ব্যাটা মন দিয়ে খেলবি না আর অন্যদের দোষ দিলে হবে? ক্যারাম খেলায় সবার আগে দরকার মনোযোগে। নিজের কনসেন্ট্রেশন আঙুলের ডগায় না এলে কিস্যু হবে না।

অধিরাজের সঙ্গে সমুর বন্ধুদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতোই। ছেলেগুলোর সঙ্গে তিনি সহজভাবে মেশেন। সেই কারণে এক এক সময় পারস্পারিক কথোপকথনও বন্ধুর মতোই হয়ে যায়।

আবেশ বলল, ওসব বলে আর কী হবে? হেরেই তো গেলাম প্রায়।

কেন এখনও তো সমুর চারটে ঘুঁটি রয়েছে, লড়ে যা।

আর আমার সবক’টাই।

তাতে কী? বলতে বলতেই বসে পড়লেন অধিরাজ। আবেশকে বললেন সরে বোস। দেখ, কীভাবে খেলা ঘোরাতে হয়।

সমু বিপদ বুঝে হাউমাউ করে উঠল—এটা ঠিক নয়, তুমি কেন আমাদের খেলায় ঢুকছ!

তাতে কী? একজন প্লেয়ারের স্পিরিটটাই আসল, সে সকলের সঙ্গেই খেলার সাহস রাখবে তবে না…

বাবার কথায় চুপ না করে সমু আরও কিছু বলে উঠতে যাচ্ছিল, তার আগেই অধিরাজ আবার বলে উঠলেন—এই আবুর কথাই ধর, ও তো এবার ক্লাস নাইনের অ্যানুয়ালেও থার্ড হয়েছে? কী, হয়েছে তো? এবার ওর ক্লাসের সকলের সঙ্গেই কিন্তু ওকে কমপিট করতে হয়েছে। যে এবার ফার্স্ট হয়েছে তার সঙ্গেও আবার যে ফেল করেছে তার সঙ্গেও, তোর সঙ্গেও।

বা রে, এটা কোনও যুক্তি হল? এটা তো পরীক্ষার নিয়ম।

ঠিক, একজন পরীক্ষার্থীও কিন্তু আসলে একজন প্লেয়ার। তাই নিয়মটা একই। নে আবু, জানলার পর্দাটা তুলে দে তো। আলো কম লাগছে।

আবেশ উঠে গিয়ে ঘরের পশ্চিমমুখো জানলার পর্দাটা সরিয়ে দিতেই অস্তগামী সূর্যের লাল আলো এসে পড়ল সমুর ঘরের বিছানায়, ক্যারম বোর্ডের ওপরে, ওদের চোখে মুখে গায়ে। আরেকটু পরেই সন্ধে নামবে।

খেলা জমে উঠল এক মিনিটের মধ্যেই। এবং যথারীতি হারা গেম জিতিয়ে দিলেন অধিরাজ। সমু স্ট্রাইকার ধরার আর সুযোগই পেল না, একে একে সব ঘুঁটি পকেটে ফেলে শেষে রেডটাও ফেলে দিলেন এক স্ট্রোকে।

সমু যথারীতি খুবই রেগে গিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে আর খেলব না। খেলা বন্ধ। বলে ঘুঁটিগুলো সবে পকেট থেকে বার করতে যাবে, কাকিমা ঘরে ঢুকল। দুই হাতে ধরা ট্রে।

খেয়ে নে আগে তারপর ঝগড়া করবি। ট্রে নামানোর সঙ্গে সঙ্গে আহ করে উঠল আবেশ। সদ্য তৈরি ধোঁয়া উঠতে থাকা চিঁড়ের পোলাও। আহা, কী সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে! ঘি, তেজপাতা, গরমমশলা মেশানো এক গন্ধ! ঈষৎ হলুদ আর বাদাম দেওয়া এই পোলাওটা কাকিমা এত সুন্দর বানায়! আবেশের সবথেকে ফেবারিট। ঝপ করে একটা প্লেট তুলে নিয়েই চামচে করে কিছুটা মুখে দিয়ে বুঝল আগুন গরম। হাঁ করে হু হা করতে শুরু করল।

কাকিমা বলল, ওরে আস্তে খা, মুখ জ্বলে মরবি তো।

আবেশের কাণ্ড দেখে তিনজনেই হাসছে।

খেতে খেতে অনেক গল্প হল। আবার দুই দান ক্যারামে কলাগাছ খেলা হল। ততক্ষণে বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। আশপাশের দুই একটা বাড়ি থেকে ছেলে-মেয়েদের সান্ধকালীন গলা সাধা শুরু হচ্ছে।

পাশের ঘর থেকে ক্রিরিং ক্রিরিং করে টেলিফোন বেজে উঠল। তিন-চারবার বেজে ওঠার পর কাকিমা তুললেন, হ্যালো…হ্যাঁ বলছি… সুমিত্রাকে…ডাকব?…আচ্ছা ধরুন একটু। বলে কাকিমা রিসিভারটা ক্রেডলের পাশে রেখে অন্য একটি ঘরের জানলা দিয়ে ডাকতে থাকলেন—সুমী…এই সুমী…তোর সেজোমাসি ফোন করেছে।

ওদিক থেকে শোনা গেল—আসছি।

এই পাড়ায় মাত্র দুটি বাড়িতেই টেলিফোন রয়েছে, একটা সোমরাজদের বাড়ি, আরেকটা বেশ কিছু দূরে রাকেশ গুপ্তদের বাড়ি। তবে ওই বাড়িতে বিশাল বাঘা একটা কুকুর রয়েছে আর বাড়ির সবাই খুব অহংকারি বলে পাড়ায় যাবতীয় লোকের ফোন নম্বর এই বাড়িরই দেওয়া। ২৬৭৩-৯৩৫৬ সোমরাজদের টেলিফোনের এই নাম্বারটা আবেশের বাড়িতেও নিজেদের ফোন নাম্বার হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। তবে কোথাও ফোন করার দরকার হলে এসটিডি বুথ।

সমু আবেশকে জিজ্ঞাসা করল, কেবল টিভির লাইন নিচ্ছিস নাকি?

নাহ রে…বাবা বলল মাধ্যমিকের আগে কোনও লাইন নয়।

আবেশের এই মনখারাপ করা উত্তরে অধিরাজ বললেন, ঠিক কথাই তো বলেছে বাবা। আমিও এখন নেব না। বলে সমুকে বললেন আর একটা বছর, স্কুল ফাইনালটা দিয়ে নে, তারপর যত খুশি ইএসপিএন দেখিস।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল চিঁড়ের পোলাও। তারপর চা, আবার একপ্রস্থ ক্যারাম। ততক্ষণে ঘরে টিউবলাইট জ্বলে উঠেছে। গল্পে গল্পে মনেই নেই বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে।

কাকিমা এসে বললেন, হ্যাঁ রে এবার খেলা গোটা। এই আবু ওঠ, এবার বাড়ি গিয়ে পড়তে বোস।

আবেশ মুখ তুলে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল পৌঁনে সাতটা। ইসস দেরি হয়ে গেল এত। এই সমু যাচ্ছি রে বলতে বলতেই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল আবেশ। অনেক দেরি করে ফেলেছে। আজ মনে হয় মায়ের কাছে ঝাড় রয়েছে।

কাল আসিস।

হ্যাঁ বলে চটি পায়ে দিয়ে বেরোতে গিয়েই ঝুপ করে লোডশেডিং হয়ে গেল। গোটা পাড়াটা নিমেষে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গানও থেমে গেল।

ওই অন্ধকার গলি বেয়ে ধীরে ধীরে এগোতে থাকল আবেশ। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে সব। আসতে আসতে এগোতে থাকল। কীসের যেন একটা অস্বস্তি শরীর জুড়ে। খুব জল তেষ্টা পাচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। একটু জল খেলে ভালো হত। গলির মুখে পৌঁছতেই দেখল ঝলমলে আলো। মানে কারেন্ট চলে এসেছে। একটা চায়ের দোকান। দুটো টিউবলাইট জ্বলছে। সামনে বেঞ্চে একটা জলের জগ। আবেশ গিয়ে জগটা তুলল। গলায় দুই ঢোক জল ঢেলে কিছুটা আরাম পেল। জগটা নামিয়ে যথাস্থানে রেখে দিতে গিয়ে দেখল একজন মাঝবয়েসি লোক ওই বেঞ্চে বসে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। লোকটার একহাতে চায়ের ভাঁড় ধরা, গালে কাঁচাপাকা দাড়ি, পরনে হাফশার্ট আর লুঙ্গি। কাছেই বাড়ি হবে বোধ হয়। কিন্তু আবেশকে লোকটা এমন অবাক হয়ে দেখছে কেন?

আবেশ সবে জিজ্ঞাসা করতে যাবে, কাকু আমাকে কিছু বলবেন? তার আগেই লোকটা ওকে জিজ্ঞাসা করে উঠল দাদা, কিছু মনে করবেন না একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

দাদা…আপনি…এসব কী? এত বড় লোকটা আবেশকে আপনি করে বলছে কেন? ইয়ার্কি করছে নাকি?

লোকটা আবার জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আপনি কি সীতারাম বয়েজ স্কুলে পড়তেন কোনও সময়ে?

সীতারাম বয়েজ…কোনও সময়ে…শব্দদুটো যেন কানের ভেতরে আচমকাই প্রচণ্ড ধাক্কা দিল। কেমন যেন ওলোটপালট হয়ে গেল ভেতরে।

নিজের অজান্তেই অস্ফুটে হ্যাঁ শব্দটা বেরিয়ে এল আবেশের।

লোকটা ততক্ষণে চায়ের ভাঁড়টা হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়িয়েছে। আপনি কি নাইটি টু মাধ্যমিক ব্যাচ?

নাইনটি টু…আবার একটা প্রবল ঝাঁকুনি…মুখ থেকে কথা সরল না আবেশের। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে। লোকটা ততক্ষণে হাতের ভাঁড় ফেলে দিয়ে খুব উচ্ছসিত হয়ে বলে উঠল আমি ঠিক আন্দাজ করেছি, তুমি আবু তো? আবেশ চক্রবর্তী? আমাদের ব্যাচের সেকেন্ড বয়…ওরে আমি শিবু, শিবকুমার সাউ, চিনতে পারছিস না…আরে সেই…

লোকটার কথাগুলো যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছিল আবেশের কানে। যেন দীর্ঘদিনের একটা গভীর ঘুম থেকে ওকে কেউ আপ্রাণ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। তার কণ্ঠস্বর আধো ঘুম আর আধো চেতনায় কানে এসে বাজছে।

কী চেহারা বানিয়েছিস রে! মাথায় অত চুল ছিল তোর, পুরো টাক ফেলে দিয়েছিস…আর এত বড় ভুঁড়ি কী করে বাগালি? কতবছর পর তোর সঙ্গে দেখা হল…সেই এই পাড়া ছেড়ে তোরা দিল্লি চলে গেলি মাধ্যমিকের পর, তারপর আর কোনও যোগাযোগই নেই। একটানা একাই কথা বলছিল শিবকুমার।

আর আবেশ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল চায়ের দোকানের ভেতরের একটা আয়নার দিকে। হ্যাঁ, শিবুর বর্ণনার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিচ্ছিল।

দুনিয়ানাটা গোল বুঝলি…আর ছোটবেলার বন্ধু তো, ঠিক দেখা হবেই। কী ভালো যে লাগছে তোর সঙ্গে দেখা হয়ে। কেমন একবার দেখেই চিনলাম বল। তুই কিন্তু আমাকে চিনতে পারিসনি। তা এতদিন পর এখানে কোথায় এসেছিলি বল তো?

শিবুকে এবার মনে পড়তে শুরু করেছিল আবেশের। ফরোয়ার্ড খেলত। বাঁ-পায়ে সাংঘাতিক শট করতে পারত। স্কুলের হয়ে বেশ কয়েকবার প্রাইজও এনেছিল। হাট্টাকাট্টা সেই ছেলেটা কবে এমন বুড়ো হয়ে গেল!

কী রে, এখানে কোথায় এসেছিলি বললি না?

সমুদের বাড়িতে। নীচু গলায় বলল আবেশ।

পেলি না তো? কী দেখলি, বিশাল ফ্ল্যাট? ওরাও অনেকদিন আগে এখান থেকে চলে গিয়েছে রে। সল্টলেকে ফ্ল্যাট নিয়েছে। তাও কম করে পনেরো বছর হয়ে গেল। বাড়িটা অনেকদিন ফাঁকা পড়েছিল, তারপর এই বছর আষ্টেক আগে ভেঙে ফ্ল্যাট হল। পুরোনো বাসিন্দা অনেকেই ছেড়ে চলে গিয়েছে…এই আমরাই কয়েকজন আঁকড়ে পড়ে রয়েছি। তোদের পাড়াতেও আর অনেকদিন যাওয়া হয় না, তবে শুনেছি তোদের বাড়িটাও তো…এখানে কোথায় উঠেছিস?

আরও অনেক অনেক কথা ক্রমাগত বলে যাচ্ছিল শিবু। তার কিছুই আর কানে ঢুকছিল না আবেশের। কারণ ও জানে…আবার যদি এই গলি পেরিয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় তবে কোনও ফ্ল্যাট নয়, সেখানে ও দেখতে পাবে সাদা রঙের একতলা বাড়ি, কালো গ্রিলের গেট। ভেতরে ছোট একটা ফুলের বাগান। আর সেই বাড়ির বাইরে থেকেও ক্যারাম বোর্ড খেলার খটাস খট শব্দ হচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *