একটি অলৌকিক দ্বীপ
মূল গল্প A Haunted Island (Algernon Henry Blackwood)
যে ঘটনাটার কথা বলতে চলেছি সেটা আসলে মন্ট্রেল থেকে টরোন্টো যাওয়ার পথে কানাডিয়ান লেকের উপরে অবস্থিত একটি বদ্ধ দ্বীপে আমার দু-সপ্তাহ কাটানোর অভিজ্ঞতা৷ সে দ্বীপটা লেকের ঠিক কোথায় খুঁজলে পাওয়া যাবে তা আমি আর বলতে চাই না, সে ঘটনার যে স্মৃতিটুকু আমার মনে জেগে আছে সেটাই শুধু আপনাদের শোনাতে চাই৷ প্রায় পনেরো বছর আগের কথা৷ তখনও আমি কলেজের পড়াশোনা শেষ করিনি৷ পড়াশোনার সঙ্গে-সঙ্গে ছিল দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর শখ৷
সে সময়েও তেমনই এক অভিযাত্রী দলের সঙ্গে ভিড়ে কানাডা পাড়ি দিয়েছিলাম৷ আমাদের দলটা কানাডিয়ান লেকের উপরে দিয়ে যেতে-যেতে একটা ছোট দ্বীপের উপরে আশ্রয় নিয়েছিল৷ কথা ছিল একটা রাত সেখানে কাটিয়েই ভোর-ভোর নাগাদ আবার যাত্রা শুরু করব আমরা৷ আমি কিন্তু আর যেতে রাজি হলাম না৷ কারণটা আর কিছুই নয়৷ গোটা গ্রীষ্মকালটা এই ট্রাভেল পার্টির সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে গায়ে হাওয়া লাগিয়েই কাটিয়ে দিয়েছি৷ পড়াশোনা প্রায় কিছুই করিনি৷ ফলে যা হওয়ার—সিলেবাস জমতে-জমতে একেবারে গলা অবধি বুজে এসে খোঁচা দিয়ে চলেছে ক্রমাগত৷ এখন কিছুদিন বইখাতা মেলে পড়াশোনা না করলেই নয়৷
এই আইল্যান্ডে এসে থেকেই খেয়াল করেছি আমাদের দলটাকে বাদ দিয়ে জায়গাটা বেশ নির্জন৷ চারদিক জল দিয়ে ঘেরা৷ লোকজন খুব একটা যায় না ওদিকে৷ তাছাড়া আইল্যান্ডের একেবারে মাঝ বরাবর একটা বেশ বড়সড় কাঠের কটেজ আছে৷ ব্যস! সোনায় সোহাগা৷ আমি ঠিক করে নিলাম আগামী এক সপ্তাহ ট্রাভেল পার্টির সঙ্গ ছেড়ে ওই কটেজে বসেই লেখাপড়ায় মন দেব৷
সেপ্টেম্বর প্রায় শেষ হয়ে শরৎ আসতে চলেছে৷ লেকের জলের দিকে তাকালে এখন ঝাঁক-ঝাঁক ট্রাউট মাছ চোখে পড়ছে৷ লেকের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা মেপল গাছের পাতায় ঘন লাল আর সোনালি রং লাগতে শুরু করেছে৷
এই গোটা আইল্যান্ডের বুকে আছে বলতে একটা সার-সার মেপল গাছের জঙ্গল, তার মাঝে একটা দোতলা কটেজ, একটা ডিঙি নৌকা, আর গোটাকতক কাঠবেড়ালি৷ স্থানীয় এক চাষি সপ্তায় একবার করে আসে এখানে, খাবার-দাবার বিক্রি করে ফিরে যায়৷
আমার দলে যারা ছিল তারা যাবার আগে একগাদা উপদেশ দিয়ে গেল আমাকে৷ এখানে রাতের দিকে উষ্ণতা নাকি শূন্যের নীচে নেমে যায়, ফলে সে সময়ে বাইরে বেরলে ঠান্ডায় জমে যাওয়ায় সম্ভবনা আছে৷ তাছাড়া এখানে একদল স্থানীয় উপজাতি লোক নাকি বেশ বুনো জীবনযাপন করে৷ বিদেশি মানুষ দেখলে মাঝে-মাঝে আক্রমণ করে বসে৷ তাদের থেকে যতটা সম্ভব দূরে-দূরে থাকাই ভালো৷
ওরা সবাই চলে যাওয়ার পরেই চারপাশ থেকে একটা অদ্ভুত একাকীত্ব চেপে ধরল আমাকে৷ এই আইল্যান্ডের চারিদিকে ছ-সাত মাইল জুড়ে অন্য আইল্যান্ড নেই৷ কটেজের পিছন দিকে কয়েক কিলোমিটার সাঁতরে গেলে একটা জঙ্গল পড়ে বটে কিন্তু সেই জঙ্গলের সীমারেখা যতদূর দেখা যায় তাতে জনবসতি চোখে পড়ে না৷ এত নির্জনতার মাঝেও আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই দ্বীপের পাথর আর গাছপালাদেরকে ভীষণ জীবন্ত মনে হয়৷ দ্বীপটা একবার ঘুরে দেখতে গিয়ে মাঝে-মাঝেই মনে হল যেন সে পাথরগুলো আমার নাম ধরে ডেকে উঠছে৷ ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিলাম অবশ্য৷
কটেজের ভিতরে মোট ছ-টা ছোট-ছোট বেডরুম আছে৷ যেন একটা বড় ঘরকেই পাইন গাছের কাঠ দিয়ে আলাদা-আলাদা করে রাখা হয়েছে৷ সবক-টা ঘরেই একটা কাঠের খাট, একটা ম্যাট্রেস আর একটা করে চেয়ার দেখতে পেলাম৷ অথচ সব মিলিয়ে আয়না আছে দুটো, তার একটা আবার কোনও কারণে ভেঙে গিয়েছে৷
কটেজের মেঝে যেহেতু কাঠের তৈরি তাই হাঁটাহাঁটি করতে গেলে মচমচ করে শব্দ হয়৷ তার উপরে এখানে আগে যারা থাকত তাদের এত চিহ্ন ছড়িয়ে আছে যে-কোনও ঘরে ঢোকার আগে মনে হয় ঘরে ঢুকলেই হয়তো কাউকে চোখে পড়বে৷ এই ছ-টা ঘরের মধ্যে দোতলার একটা ঘরের দরজা কিন্তু অনেক টানাটানি করেও খুলল না৷ কোনও কারণে কব্জায় জং ধরে হয়তো আটকে গেছে সেটা৷ মনে হয় যেন ভিতর থেকে কেউ টেনে ধরে রেখেছে দরজাটাকে৷
অনেক বাছাবাছি করে শেষে দোতলার একটা ঘরেই ঠাঁই নিলাম৷ এ ঘরটা বারান্দার একেবারে পাশে, অন্যগুলোর তুলনায় অনেকটাই ছোট, তবে বিছানাটা বেশ বড়সড়৷ একতলার সিটিং রুমের একেবারে মাথার উপরেই এই ঘরটা৷ জানলা দিয়ে তাকালেই সকালের সূর্যটা চোখে পড়বে৷
কটেজের সামনের লম্বা রাস্তাটা জলরেখার একেবারে প্রান্ত বরাবর শেষ হয়েছে৷ বোটে করে কেউ আইল্যান্ডে এলে সেখান দিয়েই উঠতে হয়৷ রাস্তা ছাড়া আইল্যান্ডের বেশিরভাগটাই মেপল গাছে ঢাকা৷ কটেজের একেবারে গা ঘেঁষে এমনভাবে গাছগুলো উঠে এসেছে যে হালকা হাওয়া দিলেও মনে হয়, ঘরের ভিতরে তাদের পাতা ঢুকে আসবে৷
দিনের বাকিটা সময় তাঁবু থেকে জিনিসপত্র এনে এখানে গোছাতে-গোছাতেই কেটে গেল৷ যেটুকু দিনের আলো পড়েছিল তাতে ছোট বোটটা নিয়ে দ্বীপের চারদিক একবার প্রদক্ষিণ করে এলাম৷
মাটিতে পা রাখতে আগের থেকে আরও নির্জন মনে হল আইল্যান্ডটাকে৷ এতক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে৷ কানাডার এই অঞ্চলে গোধূলি বলে কিছু হয় না৷ আকাশের বুক থেকে হঠাৎ করেই উবে যায় সূর্যটা৷
বোটটা জলের উপরেই বেঁধে রেখে কটেজের সামনের রাস্তাটা ধরে এগিয়ে আসতে লাগলাম আমি৷ উপরে চোখ তুলে তাকিয়ে শোবার ঘরের বারান্দাটা চোখে পড়ল৷ যে ছ-টা ল্যাম্প বারান্দার উপরে জ্বালিয়ে গেছিলাম সেগুলো আগের মতোই জ্বলছে৷ তাদের খয়েরি উজ্জ্বল আলো একতলার কাচের জানলায় ক্ষীণ হয়ে এসে পড়েছে৷ সেই মৃদু আলো-ছায়ার আঁকি- বুঁকিতে মনে হল একতলার বেডরুমের জানলায় যেন দাঁড়িয়ে আছে কেউ৷
সে রাতে একটু তাড়াতাড়িই শুতে চলে গেছিলাম৷ মাথার কাছের জানলাটা খোলা রেখে শুয়েছিলাম বলে বাইরে গাছের পাতায় হাওয়ার শব্দ কানে আসছিল ক্রমাগত৷ সেই সঙ্গে দূরে বাঁধা বোটের গায়ে লেগে জল তরঙ্গের ছপছপ আর মচমচে কাঠের শব্দ৷ আরেকটা আওয়াজ, সম্ভবত এই অলৌকিক নিঃসঙ্গ পরিবেশে আমার মনের ভুল, তাও… মনে হল কটেজের ফাঁকা বিস্তীর্ণ করিডোরে যেন ফিসফিস করে কথা বলে চলেছে কেউ৷ খুব চাপা পায়ের শব্দ… কারা যেন লুকিয়ে-চুরিয়ে ঘোরাঘুরি করে চলেছে গোটা কটেজ জুড়ে… একসময় গিয়ে সেই সমস্ত শব্দ আমার স্বপ্নের সঙ্গে মিশে গেল…
একটা সপ্তাহ এমন করেই কেটে গেল৷ ঠিক যেমন চেয়েছিলাম পড়াশোনা তেমন করেই এগিয়ে নিয়েছি কিছুটা৷ তবে দশ দিনের মাথায় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল৷ মাঝরাতে হঠাৎ করেই ভেঙে গেল ঘুমটা৷ ঘুম থেকে উঠেই কেমন বিশ্রী একটা অনুভূতি হল৷ ঘরের চারদিকের বাতাস যেন আমার উপরে ভিড় করে রয়েছে৷
অকারণেই কীরকম একটা ভয় এসে চেপে ধরেছে আমাকে৷ ঘরটার ভিতরে কিছু একটা যেন আছে৷ দেখতে পাচ্ছি না, অথচ আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে আমাকে৷ অস্বস্তিটা এত বেড়ে উঠল যে আমি শেষপর্যন্ত ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে নেমে রান্নাঘরে চলে এলাম৷ এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘরটা ছেড়ে আসতেই ভয়টাও কমে গেল৷ সেদিন রাতটা একতলাতেই ঘুমিয়ে পড়লাম৷
পরদিন সকালে জলখাবার বানাতে-বানাতে এই কটেজে কাটানো সমস্ত রাতগুলোর কথা মনে করলাম৷ ঠিক কিসের জন্যে কাল রাতে অতটা ভয় পেলাম সেটা কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারলাম না৷ মনে পড়ল একদিন রাতে এত জোরে হাওয়া দিচ্ছিল যে তাতে একতলার জানলার পাল্লাগুলো বেশ জোরে ধাক্কা খাচ্ছিল বারবার৷ আমি একতলায় নেমে এসে জানলা বন্ধ করতে গিয়ে দেখি জানলা বন্ধই আছে৷ আওয়াজটা কোথা থেকে আসছিল সেটা বুঝতে পারিনি অবশ্য৷ কিন্তু এর বাইরে তেমন কিছু তো ঘটেনি৷ তাহলে কাল রাতে অমন করছিল কেন মনটা?
খেয়ে-দেয়ে লেকের জলে একটু সাঁতার কেটে বই হাতে দোতলার ঘরটায় যেতে গিয়েই দরজার বাইরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ কেন জানি না কিছুতেই ঢুকতে ইচ্ছা করছে না ঘরটায়৷ মনে হচ্ছে ঘরের ভিতরে ঢুকলেই খারাপ কিছু একটা ঘটবে৷ এত ভারী বিপদে পড়া গেল! আমার মনের ভিতরে কেউ একটা বসে আগাম নির্দেশ দিয়ে চলেছে আমাকে৷ নির্দেশটা এতই প্রবল যে বই হাতে নীচে নেমে এলাম আমি৷ নামার আগে সেই বন্ধ দরজাটাও চোখে পড়ল৷ এই ক-দিনে ওটা কয়েকবার খোলার চেষ্টা করছি৷ কিন্তু কোনও লাভ হয়নি তাতে৷
সেদিন সন্ধেয় আর উপরের ঘরে শুতে গেলাম না৷ বসার ঘরের মেঝেতেই একটা ম্যাট্রেস টেনে এনে শুয়ে পড়লাম৷ জানি ব্যাপারটা অকারণ ভয়ের কাছে নতিস্বীকার কিন্তু তাও ঘুম না হলে পড়াশোনা এগোবে না আমার৷
রাত ঠিক আটটা নাগাদ খাওয়া-দাওয়া সেরে বসার ঘরের চেয়ারে বসে বইতে মুখ দিলাম৷ খোলা জানলার বাইরে একবার চোখ মেলে তাকালাম৷ বাইরের গোটা আইল্যান্ডের উপরে শান্ত একটা রাত নেমে এসেছে৷ জমাট বাঁধা হাওয়া একটুও নড়ছে না৷ এমনকী লেকের জলে ঢেউয়ের শব্দ অবধি আসছে না৷ আকাশের বুক কালো পর্দার মতো মেঘের দল ঢেকে রেখেছে৷ ঠিক একটা ঝড়ের পূর্বাভাসের মতো নিস্তব্ধ হয়ে আছে সব কিছু৷
এত কিছুর মধ্যেও মাথাটা আশ্চর্য রকম পরিষ্কার লাগল আমার৷ বেশ একটানা মন দিয়ে পড়তে লাগলাম৷ রাত যত বেড়ে চলেছে নিস্তব্ধতা তত গাঢ় হচ্ছে যেন৷ কাঠবিড়ালিগুলোর আওয়াজ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না৷ কাঠের পাটাতনগুলোও মচমচ আওয়াজ থামিয়ে চুপ করে আছে৷ ঘড়িতে শব্দ করে ন-টা বাজল৷
হঠাৎ আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম বইয়ের পাতায় একটাই প্যারাগ্রাফ যেন বারবার পড়ে চলেছি আমি৷ অথচ প্যারাগ্রাফগুলো এতই সরল যে দ্বিতীয়বার পড়ার দরকারই হয় না৷ মনে হল শত চেষ্টা করেও আমি মনোযোগ ধরে রাখতে পারছি না৷ খেয়াল করলাম কয়েকবার আমি একসঙ্গে দুটো পাতা উল্টে ফেলেছি৷ অথচ পাতার শেষ অবধি পড়ার আগে খেয়ালও হয়নি গন্ডগোলটা৷ হচ্ছেটা কী?
আমার শরীর তেমন ক্লান্ত নয়, মনও বেশ সজাগ হয়ে আছে৷ তাহলে? আমি আবার মনটাকে এক জায়গায় জড়ো করে বইতে এনে ফেললাম৷ কিছুক্ষণ এগোল পড়াটা৷ কিন্তু একটু পরেই আমার মাথা এলিয়ে পড়ল চেয়ারের পিছনে৷ চোখ খুলে দেখলাম কী কারণে যেন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি৷ সেখানে এখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে৷
কিছু তো একটা গন্ডগোল হচ্ছে৷ মনে হল ঘরের কোথাও কিছু একটা কাজ করতে আমি ভুলে গেছি৷ কোথাও একটা জানলা খোলা আছে হয়তো, চেয়ার ছেড়ে উঠে উপরে গিয়ে ঘরগুলো দেখে এলাম৷ শোবার ঘরের ফায়ারপ্লেসের আগুন নিভে এসেছে৷ ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির চারপাশটা একবার ঘুরে দেখে এলাম৷ নাহ, সবই ঠিক আছে৷ তাহলে বারবার কেন মনে হচ্ছে কোথাও কিছু একটা গোলমাল হয়ে আছে? আমার মাথাটাই কি খারাপ হয়ে গেল তাহলে?
ব্যাপারটা জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে ফেলে ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বুলাতে গিয়ে মনে হল ঘরটা হঠাৎ যেন বেশ কিছুটা পুরনো হয়ে গেছে৷ ঘরের দেওয়ালে আগের থেকে হলুদের পরিমাণটা বেড়ে উঠেছে৷ জানলা দিয়ে কি নতুন কোনও আলো আসছে তাহলে? ব্যাপারটা এত বেশি করে মনে হতে লাগল যে আমি উঠে দাঁড়িয়ে জানলার কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে বাইরে তাকালাম৷ নাহ, কেউ তো নেই৷ উপরের শোবার ঘরের বারান্দা থেকে ল্যাম্পের আলো বাইরে এসে পড়েছে৷ একইরকম একটা মানুষের ছায়া পড়ে আছে জানলার বাইরে৷ আর কোথাও কিচ্ছু নেই৷
রাস্তাটা পেরিয়ে বোটটা যেখানে বাঁধা আছে তার কাছাকাছি একটা সাদা বাতিস্তম্ভ আছে৷ লেকের জলের কিছুটা সেই আলোয় চোখে পড়ে৷ সেদিকে একটানা তাকিয়ে থাকতে-থাকতে আচমকাই চমকে উঠলাম আমি৷ লেকের যে অংশটায় আলো গিয়ে পড়েছে সেটার উপর দিয়ে একটা বোট যেন দ্রুত একদিক থেকে আরেকদিকে চলে গেল৷
এত রাতে এই সময়ে লেকের উপরে কে ডিঙি বাইবে? বিশেষ করে এখানে চারিদিকে তেমন কোনও জনবসতি নেই যখন! খানিকটা ভয়ই লাগল আমার৷ বোটটার উপরে কেউ বসেছিল কি না দেখতে পাইনি৷ আপাতত সেটা অন্ধকারে হারিয়ে গেছে৷
চেয়ারে বসে পড়ে আবার পড়ায় মনোযোগ দিলাম৷ মনটা কিন্তু উসখুস করতেই লাগল৷ কী যেন একটা গন্ডগোল লাগছে৷ কিছু যেন একটা গন্ডগোল হয়ে আছে কোথাও৷ কোথাও একটা জানলা কিংবা…
ঠিক এমন সময় জলের উপর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসতে চোখ তুলে দেখলাম আবার একটা ডিঙি জলের উপর দিয়ে সরে যাচ্ছে৷ এবার মনে হল দুটো লোক বসে আছে ডিঙিটার উপরে৷ এক ঝলকে তাদের চেহারা দেখে স্থানীয় আদিবাসী বলেই মনে হল৷ আগের মতোই আলোর একদিক থেকে আরেকদিকে সরে গেল ডিঙিটা৷
অস্থির পায়ে উঠে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ কিছুক্ষণ সেইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তৃতীয়বার ডিঙিটা দেখতে পেতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে৷ একটাই ডিঙি নৌকা বারবার দেখছি আমি৷ আইল্যান্ডটাকে ঘিরে পাক খাচ্ছে লোকদুটো৷ কিন্তু কেন? এত রাতে দুটো আদিবাসীলোক এই নির্জন আইল্যান্ডের চারপাশে করছেটা কী?
জানলার কাছটায় কিছুটা আলো আছে৷ সেখান থেকে আমি অন্ধকারে সরে এলাম৷ লোকগুলোর উদ্দেশ্য খারাপ হতে পারে৷ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে জানলার দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম ডিঙিটাকে আবার দেখা যায় কি না৷
তৃতীয়বার ডিঙিটা কিন্তু একপাশ থেকে অন্য পাশে সরে গেল না৷ বরঞ্চ আলোটার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ আমার বোটের ঠিক পাশেই ডিঙিটাকে বেঁধে লোকদুটো আইল্যান্ডের ভিতরে উঠে এল৷ রাস্তাটা ধরে এগিয়ে আসতে লাগল কটেজটার দিকে৷
এতক্ষণে তাদের উদ্দেশ্যটা বুঝতে পেরেছি আমি৷ বসার ঘরের পিছনে রাখা ব্যাগের ভিতর থেকে মার্টিন রাইফেলটা বের করে নিলাম৷ দ্রুত নিভিয়ে ফেললাম টেবিল ল্যাম্পটা৷ ঘরের ভিতরটা যতটা সম্ভব অন্ধকার করে রাখা দরকার৷ একেবারে কোণের দিকে ঘেঁষে দেওয়ালে পিঠে রেখে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি৷ দরজা এবং আমার মধ্যে আছে শুধু টেবিলটা৷ তার উপরে এখনও আমার বইখাতা ছড়িয়ে আছে৷
একটু-একটু করে অন্ধকারটা চোখ সয়ে গেল আমার৷ জানলার বাইরেটা আবার দেখতে পেলাম৷ এতক্ষণে লোকদুটো সেখান থেকে অন্তর্হিত হয়েছে৷ তারা জানলা বা সামনের দরজা যা দিয়েই ভিতরে আসুক না কেন আমার চোখে পড়তে বাধ্য৷
শিরায় রক্ত চলাচলের শব্দ শুনতে পাচ্ছি যেন৷ নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাইফেল উঁচিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম৷
বাইরের দরজার কাছে তাদের পায়ের আওয়াজ পেলাম৷ বুঝলাম দরজা দিয়েই ভিতরে ঢুকবে তারা৷ তাই যদি ঢোকে আমার ঘরের সামনে দিয়ে যেতেই হবে৷
কিছুক্ষণ সেইভাবে অপেক্ষা করতেই কাচের দরজার ওপাশে একটা দীর্ঘ ছায়ামূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল৷ আন্দাজে বুঝতে পারলাম লোকটার উচ্চতা প্রায় সাড়ে ছ-ফুট৷ চওড়া কাঁধ৷ দেহের ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত৷ তার ঠিক পিছনেই এ লোকটার চেয়ে কিছুটা বেঁটে আরেকটা লোক৷ আমার হাত একবারের জন্যে কেঁপে উঠল৷ বুঝতে পারলাম এদের একজনকে লক্ষ করে গুলি চালালে অন্যজন আক্রমণ করবে আমাকে৷ নার্ভের চাপ কোনওরকমে সামলে আমি সেইভাবে অপেক্ষা করতে লাগলাম৷ একবার চিৎকার করতে ইচ্ছা করল, কিন্তু জানি কোনও লাভ হবে না তাতে৷ রাইফেলের নলের উপরে আঙুলটা আর অনুভব করতে পারছি না৷ উত্তেজনায় আমার স্নায়ু অবশ হয়ে আসছে৷
দরজার কাছে হ্যান্ডেলটা মোচড়ানোর শব্দ পেলাম৷ তারপর ধীরে-ধীরে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে এল তারা৷ পিছনের বেঁটে লোকটা বন্ধ করে দিল দরজাটা৷ এখন ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আমরা তিনজন৷ বহু চেষ্টা করেও নিঃশ্বাস ধরে রাখতে পারলাম না আমি৷
ঘরের চারিদিকে কিছু যেন খুঁজে চলেছে লোকগুলো৷ টেবিলের নীচে, দেওয়ালের গায়ে ঝুঁকে বারবার কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে৷ আমি কিছুক্ষণের জন্যে বিপদের গন্ধ ভুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তাদের দিকে৷ এত আঁতিপাঁতি করে খুঁজছেটা কী? ঘরের জিনিসপত্র চুরি বা লুট করার কোনও ইচ্ছা তো দেখছি না৷
বেশ কিছুক্ষণ সেইভাবে খোঁজাখুঁজির পর দু-জনেই সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল৷ কী যেন ভেবে বেঁটে লোকটা আচমকাই আঙুল তুলে উপরের দিকে কিছু একটা দেখাল৷ লম্বা লোকটা সেই আঙুলের দিকে তাকিয়ে একবার ঘাড় নেড়ে কিছু বুঝে নিয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে৷
এই ঘরটার ছাদের দিকে দেখিয়ে কী বোঝাল লোকটা? মুহূর্তে মনে পড়ে গেল, উপরের শোবার ঘরটা৷ যে ঘরটায় থাকতে গেলেই একটা অস্বস্তি চেপে ধরছিল আমাকে৷ আমি অবাক হয়ে দেখলাম ঘরের ভিতর থেকে দু-জন লোক একসঙ্গে বেরিয়ে উপরের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল৷
লোকগুলো যা খুঁজছে সেটা সম্ভবত ওই ঘরেই আছে৷ কী এমন জিনিস আছে ওখানে? আমার তো তেমন কিছুই চোখে পড়েনি৷
নিস্পন্দ কয়েকটা মুহূর্ত কাটল৷ আমি দেওয়ালের কাছ থেকে সরলাম না৷ লোকগুলো ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে আমার হাতের স্নায়ুগুলো আবার সচল হয়ে উঠল৷ উপর থেকে একটা আওয়াজ শুনে বুঝলাম উপরের শোবার ঘরে কিছু একটা সরাচ্ছে তারা৷ কিন্তু বিছানা ছাড়া তেমন কোনও আসবাব তো নেই সেখানে৷ বিছানা সরালে আরও জোরে আওয়াজ হবার কথা৷ কী সরাচ্ছে তাহলে?
কিছুক্ষণ পরে আবার সিঁড়ির উপরে পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম৷ এবার শুধু পায়ের আওয়াজ নয়, কিছু একটা যেন টেনে সিঁড়ির উপর ঘষটে-ঘষটে নীচে নামিয়ে আনছে তারা৷
বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে এইবার৷ আকাশের কোণে যে কালো মেঘটা ছিল সেটা এতক্ষণে ঝরে পড়তে শুরু করেছে৷ সেই সঙ্গে ভেসে আসছে মৃদু বাজ পড়ার শব্দ৷ ক্রমশ বেড়ে উঠছে বাজের দাপট৷ সাদা আলোর ঝলকে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে সমস্ত ঘরটা৷ আমি মনে-মনে প্রমাদ গুনলাম৷ সিঁড়ির কাছের ল্যান্ডিংয়ের কাছে এসে ঘরের ভিতরে তাকিয়ে বিদ্যুতের আলোয় যদি আমাকে দেখতে পায় তারা তাহলে…
ল্যান্ডিংয়ের একেবারে কাছে এগিয়ে এসেছে এখন পায়ের আওয়াজ৷ ঘরের ঠিক বাইরে দু-জন লোককে আবার চোখে পড়ল আমার৷ হ্যাঁ… আগের মতোই কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে এল তারা৷
পিছনের বেঁটে লোকটার হাতে যে জিনিসটার একটা প্রান্ত ধরা আছে সেটা যে ঠিক কী তা আন্দাজ করা সহজ না৷ একবার দেখে মনে হল একটা বড় সিডার কাঠের লগকে ঘরের ভিতরে টেনে এনেছে, কিংবা একটা অতিকায় ডানার মৃত পাখি৷ জিনিসটার আউটলাইনটা কিছুতেই বুঝতে পারলাম না৷
জিনিসটাকে সেইভাবে মাটিতে ঘষটে-ঘষটেই আমার দিকে এগিয়ে এল তারা৷ মনে হল আমাকে যেন আগেই দেখতে পেয়েছে দু-জন৷ এক পা- এক পা করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে৷ বাইরে ভীষণ জোরে একটা বাজ পড়ল, বুঝতে পারলাম এবার আবার ঘরটা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে, আমার আর লুকানোর জায়গা নেই৷ সমস্ত শব্দ এখন এমন ভাবে থেমে গেছে যেন পৃথিবী ফিরে গেছে সেই আদিম সময়ে যখন সময়ের জন্মই হয়নি৷ আমি আন্দাজে লম্বা লোকটার কপাল লক্ষ করে বন্দুক তুলে ধরে সেকেন্ড গুনতে লাগলাম… এক… দুই… তিন…
বীভৎস সাদা আলো ঝলকে উঠল ঘরের ভিতরে৷ আর তাতেই এক পলকের জন্যে আমার দৃষ্টি লোকটার কপাল থেকে সরে তাদের হাতে ধরা জিনিসটার উপরে গিয়ে পড়ল৷ পাখি নয়, কাঠের লগ নয়, একটা বিদেশির মৃতদেহ… আমার হাত থেকে রাইফেল খসে পড়ল…
আলোটা নিভে যাওয়ার ঠিক আগে লম্বা লোকটা আমার দিকে এগিয়ে এল, আমি তার দিকে আঘাত করতে যেতেই একটা হাত দিয়ে আমাকে ধরে ফেলল সে৷ সঙ্গের বেঁটে লোকটা একটা আঙুল মুখের কাছে তুলে ইশারায় চুপ করতে বলল আমাকে… আমাকে শব্দ করতে বারণ করছে তারা… জ্ঞান হারানোর ঠিক আগে আবার মেঝেতে পড়ে থাকা সেই মৃতদেহটার উপরে চোখ পড়ল আমার৷ মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ে থাকা মৃতদেহটা অন্য কারও নয়… আমার নিজের…
পরদিন সকালে একটা মানুষের গলার আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙে আমার৷ চোখ খুলে দেখি সেই চাষিটা এসে ডাকাডাকি করছে আমাকে৷ সকালে খাবার বেচতে এসে বাইরের দরজাটা খোলা দেখে ভিতরে ঢুকে আমার খোঁজ করে সে দেখে আমি মেঝের উপরে পড়ে আছি৷ একটু দূরেই মার্টিন রাইফেলটা পড়ে ছিল৷
আমি উঠে বসতে চাষিটা অবাক মুখে পরপর প্রশ্ন করতে থাকে আমাকে, তার কোনওটার উত্তরই দিতে পারিনি আমি৷ উঠে দাঁড়িয়ে চাষির সঙ্গেই সমস্ত কটেজটা ঘুরে দেখে আর কিছুই খুঁজে পাইনি৷
সেই কটেজে আর থাকার সাহস হয়নি আমার৷ পরের একসপ্তাহ চাষিকে কিছুটা টাকাপয়সা দিয়ে তার বাড়িতেই কাটিয়ে দিয়েছিলাম৷
সেখান থেকে চলে আসার বছর দশেক পর আরেকবার সেই আইল্যান্ডে ফিরে গেছিলাম আমি৷ তখনও একইরকম ভাবে দাঁড়িয়েছিল কটেজটা৷ তার ভিতরে আর একবার ঢুকে দেখার সাহস হয়নি আমার৷
সেদিন রাতে ঠিক কী ঘটেছিল তা আমি এখনও জানি না৷ দোতলার যে ঘরটা বন্ধ অবস্থায় ছিল সেটার ভিতরে ঠিক কী ছিল তাও আমার জানা নেই৷ তবে ইদানীং যখনই চুপ করে বসে সে রাতের কথা ভাবি একটা মাত্র সম্ভাবনা আমার মাথায় উঁকি দেয়৷ সেই বন্ধ ঘরের ভিতরে যেই থাকুক না কেন, একটা গোটা আইল্যান্ডে বছরের পর বছর একাই কাটাতে হয় তাকে৷ তাই কেউ কটেজে থাকতে এলে সে একটা সঙ্গী খুঁজে পায়৷ আমাদের স্থূল ইন্দ্রিয়ের পক্ষে তার অস্তিত্ব অনুভব করা সম্ভব নয়৷ তাই আমাদের শরীর থেকে আত্মাকে আলাদা করে যোগাযোগ করতে চায় সে৷ এই কারণেই প্রথম দিন ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই তার অস্তিত্ব অনুভব করা শুরু করি আমি৷ এরপর থেকে শেষদিন ঘুম ভাঙা অবধি গোটা সময়টা কেবল আমার আত্মাই জাগ্রত ছিল৷ শরীর পড়েছিল শোবার ঘরেই৷
ওই দু-জন স্থানীয় আদিবাসী তাদের তন্ত্রমন্ত্র প্রয়োগ করে আমার আত্মাকে আবার আমার শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে গেছিল৷ মাঝে-মাঝে ভাবি সেদিন সেই কালো চামড়ার স্থানীয় লোকগুলো যদি না থাকত! তাহলে আজ আমি আর আপনাদের সামনে বসে এই গল্প বলতে পারতাম না৷ হয়তো সেই কানাডিয়ান লেকের উপর সেই নির্জন কটেজে ওই বন্ধ ঘরের দরজাটা খোলা থাকত আমার জন্য…
অনূদিত