একটা ফালটুস চুরি

একটা ফালটুস চুরি

সকালবেলায় টেনিস খেলার জন্য সাউথ ক্লাবের দিকে রওনা হচ্ছি, এমন সময় ফোন।

”কালকেতু নন্দী আছে?”

গলার স্বরটা বেশ ঘড়ঘড়ে। ঠিক বুঝতে পারলাম না কার ফোন। বিরক্তির সঙ্গেই বললাম, ”কে বলছেন?”

”আমি পঙ্কজদা, পঙ্কজ রায়।”

মুহূর্তের মধ্যেই বিরক্তি উধাও। পঙ্কজদা, মানে টেস্ট ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়! দু’দিন আগে সি এ বি—র ক্লাব হাউসে দেখা হয়েছিল পঙ্কজদার সঙ্গে। সল্ট লেকে ছোটদের জন্য উনি একটা কোচিং ক্যাম্প চালান। সেখানে কী যেন একটা সমস্যা হয়েছে। আমাকে সেদিন বলতেও শুরু করেছিলেন। বাংলা—বিহার রঞ্জি ম্যাচ কভার করে তখন অফিসে ফিরছি। তাড়া ছিল বলে ঘটনাটা ভাল করে শুনিনি। সাত সকালে পঙ্কজদার ফোন পেয়ে ভাবলাম, উনি হয়তো কোচিং ক্যাম্পের ব্যাপারেই কথা বলতে চাইছেন।

আন্তরিকভাবেই বললাম, ”গুড মর্নিং পঙ্কজদা, কালকেতু বলছি।”

ও—প্রান্তে হতাশ গলা পঙ্কজদার, ”গুড মর্নিং নয় রে ভাই। আমার ব্যাড মর্নিং। সক্কালবেলায় ফালটুস ব্যাপার। আমার সেই ব্যাটটা চুরি গেছে।”

”ব্যাট চুরি গেছে?” ঠিক বুঝতে পারলাম না। পালটা প্রশ্ন করতেই পঙ্কজদা বললেন, ”যত সব ফালটুস ব্যাপার। সেই ব্যাটটা পাচ্ছি না রে ভাই, যেটা দিয়ে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করেছিলাম। তিনতলার বসার ঘরে, তুমি তো একবার দেখেও গেছো, শো—কেসে সাজিয়ে রেখেছিলাম। আজ সকালে বের করতে গিয়ে দেখি, নেই।”

পঙ্কজদা ‘ফালতু’ কথাটা কখনও বলেন না। বলেন, ‘ফালটুস’। উত্তর কলকাতার লোকেরা এরকম আরও অনেক কথা বলেন, যা কোনও অভিধানে পাওয়া যাবে না। প্রথম—প্রথম পঙ্কজদার মুখে ফালটুস কথাটা শুনে বেশ মজা লাগত। এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। পঙ্কজদার মতো নিপাট ভদ্রলোক খেলার জগতে পাওয়া খুব মুশকিল।

যাই হোক, পঙ্কজদার ব্যাট চুরির কথাটা শুনে বেশ অবাক লাগল। কিছুদিন আগে ডি সি এম ফুটবল কভার করতে দিল্লি গিয়েছিলাম। ওখানকার এক ‘ইভনিং ডেইলি’তে সেই সময় একটা ছোট্ট খবর চোখে পড়েছিল। দিল্লিতে কপিলদেব যেখানে থাকেন, সেই সুন্দরনগরের বাড়িতে চুরি হয়েছে। চোর আর কিছু নেয়নি। চুরি করেছে একটা ক্রিকেট বল, যা দিয়ে কপিল তাঁর ৪৩২তম উইকেটটা নিয়ে বিশ্বরেকর্ড করেন। সেদিনই কপিলের বাড়িতে ফোন করেছিলাম। শুনলাম, বাড়িতে কেউ নেই। কপিল আর তাঁর স্ত্রী রোমি সিঙ্গাপুরে বেড়াতে গেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, পরদিন কোনও ‘মর্নিং ডেইলি’তে ওই খবরটা আর দেখতে পাইনি। তাই ঠিক বুঝতে পারিনি, বল চুরির ঘটনা সত্যি কি না।

কপিলদেবের পর পঙ্কজ রায়। দু’টো ঘটনার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও যোগসূত্র আছে। সেটা কী, পরেও ভাবা যেতে পারে। ফোনে জানতে চাইলাম, ”পঙ্কজদা, বাড়ির লোকজনদের সবাইকে জিজ্ঞেস করেছেন?”

”করেছি রে ভাই। ফুচা বলল, ‘দু’দিন আগেও শো—কেসে ব্যাটটা দেখেছে।’ ও—ই বলল, ‘কালকেতুকে আগে খবরটা দাও। ও ঠিক সলভ করে দেবে।’

ফুচা হল, পঙ্কজদার ছেলে প্রণব রায়। সেও টেস্ট ক্রিকেটার। আমারই সমবয়সী। আমি যে—সময় ক্রীড়া—সাংবাদিকতা শুরু করি, সেই সময় ফুচাও ওর ক্রিকেটার—জীবন শুরু করেছে। ফলে আমাদের মধ্যে বিশেষ বন্ধুত্ব সেই সময় থেকে। বছর পনেরো আগে ওই ফুচাই আমাকে প্রথম ওদের কুমোরটুলির বাড়িতে নিয়ে যায়। সেদিনই প্রথম দেখি, পঙ্কজদার বিশ্বরেকর্ডের ব্যাটটা। এখন অবশ্য ফুচা থাকে সল্ট লেকে।

কে চুরি করতে পারে পঙ্কজদার ব্যাট? ভাবছি। আমাকে নিরুত্তর দেখে পঙ্কজদা অনুরোধ করার ভঙ্গিতে বললেন, ”একবার আমার বাড়িতে আসবে। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমাদের আমলে তো এত লেখালেখি হত না। নিউজ পেপার কাটিং রেখে দেওয়ার চলও ছিল না। আমার কাছে কোনও কিছু নেই। এক ওই ক্রিকেট ব্যাটটা রেখে দিয়েছিলাম। সেটাও গায়েব।”

সাউথ ক্লাবে গিয়ে টেনিস খেলা ঘুচে গেল। বললাম, ”আপনি ভেঙে পড়বেন না। আমি মিনিট কুড়ির মধ্যেই আসছি।”

আমার সিঁথির বাড়ি থেকে কুমোরটুলি, গাড়িতে বড় জোর পনেরো মিনিট। মারুতিটা নিয়ে বেরোলাম। আমার সাংবাদিক জীবনে গোয়েন্দাগিরির কাজটা এই প্রথম নয়। এর আগেও, খেলার জগতে বেশ কিছু অপরাধের কিনারা করেছি। সবচেয়ে সাড়া জাগিয়েছিল, ব্রায়ান লারার গ্লাভস চুরির ঘটনাটা। এই তো মাসকয়েক আগে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভারত—সফরের সময়কার কথা। বোম্বাই টেস্টের সময় একদিন ড্রেসিংরুম থেকে লারার গ্লাভস চুরি হয়ে যায়। ওয়াংখেড়ের প্রেস বক্সে বসে লাঞ্চের সময় আমি গল্প করছিলাম ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র রিপোর্টার আশিস শুক্লার সঙ্গে। হঠাৎ দেখি পলি উমরিগড় আমাকে খুঁজতে ওপরে উঠে এসেছেন। সাংবাদিক বন্ধুরা অনেকেই জানে, আমার শখের গোয়েন্দাগিরির কথা। তাদেরই কেউ হয়তো পলি—কে কথায়—কথায় বলেছিল। সব শুনে হঠাৎ আশিস ঠাট্টা করে বলল, ”পলি সাহাব, এই সামান্য ব্যাপারের জন্য আপনি আমার বন্ধুর কাছে এসেছেন। যান, টি—ব্রেকের মধ্যেই লারার গ্লাভস ফিরে পাবেন।” পলি উমরিগড় একটু অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সেদিন প্রেস বক্স থেকে নেমে যান। সত্যি বলতে কী, ওই চাউনিটাই আমাকে চাগিয়ে তুলেছিল। আশিস শুক্লার সম্মান রাখার জন্য সেদিন টি—ব্রেকের আগেই গ্লাভস—চোরকে ধরে ফেলেছিলাম। লারার গ্লাভস চুরির ঘটনাটা পরদিন ভারতের সব কাগজে বেশ বড়—বড় করে বেরিয়েছিল। শুধু আমার নামটা ছাপতে বারণ করেছিলাম।

ব্যস, সেই ঘটনার পর খেলা আর খেলোয়াড়—মহলে গোয়েন্দা হিসেবে আমার নামটা ছড়িয়ে গিয়েছে। এমনিতে সাংবাদিকতার কাজটা এক ধরনের গোয়েন্দাগিরিই। আমারও বেশ মজা লাগে জটিল কোনও সমস্যার সমাধান করতে। স্কুলে আমার একবন্ধু ছিল সুদীশ নাগ। দু’জনে একসময় ব্যোমকেশ থেকে শার্লক হোমস খুব পড়তাম। ওর জীবনের স্বপ্ন ছিল, বড় ‘ক্রাইম—রিপোর্টার’ হবে। আর আমার লক্ষ্য ছিল, নামী গোয়েন্দা হওয়া। ভাগ্যের কী পরিহাস, আমি হলাম গিয়ে রিপোর্টার। আর সুদীশ এখন ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট অর্থাৎ ডি ডি—র অফিসার। কোনও—কোনও সময় জট ছাড়াতে ও আমাকে সাহায্যও করে। বছরকয়েক আগে প্রায় তিন লাখ টাকার কারচুপি ধরেছিলাম একটা অ্যাসোসিয়েশনে। সুদীশও অবাক হয়েছিল আমার কাজ দেখে।

পঙ্কজদার বাড়ির দিকে আসতে—আসতে সুদীশের কথাও ভাবছিলাম। এটা সাধারণ ঘটনা নয়। লালবাজারে গিয়ে একবার সুদীশের সঙ্গে দেখা করা দরকার। সেইসঙ্গে বীভৎস মোদকের কাছেও ঢুঁ মেরে আসতে হবে। এই লোকটা অপরাধ জগৎ সম্পর্কে প্রচুর খবর রাখে। বিশ্বের কোথায় কী ধরনের অপরাধ হচ্ছে, চট করে বলে দিতে পারে। নামী খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত জিনিস হাতিয়ে স্মারক হিসেবে রাখার প্রবণতা নতুন নয়। খেলোয়াড়রা হলেন তারকা। তাঁদের ভক্তরাই এই অপরাধগুলো করে। প্রিয় খেলোয়াড়দের অটোগ্রাফ নেওয়া, তাদের কাছ থেকে সামান্য উপহার পাওয়ার প্রত্যাশা অল্পবিস্তর সবার মধ্যেই থাকে। কেউ প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে, কেউ পারে না। আর না পারলেই তখন…চুরি। এরকম বেশ কয়েকটা চুরির তদন্ত করতে গিয়ে দেখেছি, পেছনে অদ্ভুত সব কারণ। বোম্বাইয়ে যে—ছেলেটি লারার গ্লাভস চুরি করেছিল, ধরা পড়ার পর কাঁদতে—কাঁদতে সে আমাকে বলেছিল, লারার মতো ব্যাটসম্যান হতে চায়। ওই গ্লাভস দুটোই নাকি ওকে অনুপ্রাণিত করত। এইসব পাগলকে শাস্তি দেওয়ার কথা কখনও ভাবা যায়?

অবশ্য এর উলটো দিকটাও আছে। খেলা এখন পুরোপুরি বাণিজ্য হয়ে গিয়েছে। খেলোয়াড়, খেলার সরঞ্জাম তো পণ্য। পৃথিবীতে হুজুগে লোকের অভাব নেই। খেলোয়াড়দের সামান্য সরঞ্জাম, ব্যক্তিগত জিনিসও এখন কেনার জন্য লোকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আমেরিকার বিশ্বকাপের সময় নিজের চোখে দেখেছি, নিউ ইয়র্কের এক হোটেলের বেয়ারাকে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যেতে। ইতালি দলটা ওই হোটেলে দেড় মাস ছিল। বেয়ারাটির কাজে সন্তুষ্ট হয়ে রবার্তো বাজ্জো একদিন তাকে একটা জার্সি উপহার দেন। ওই জার্সির দাম তখন বেয়ারাটি বুঝতে পারেনি। ইতালি টিম ফাইনালে চলে যাওয়ার পর বাজ্জোর জার্সিটার দাম ওঠে আমাদের টাকায় কুড়ি লাখ। ইতালির এক ধনী মহিলা জার্সির কথা জানতে পেরে, তা কিনে নেন বেয়ারাটির কাছ থেকে।

এসব কথা ভাবতে—ভাবতেই পৌঁছে গেলাম পঙ্কজদার বাড়ি। একেবারে কুমোরটুলি পার্কের গায়েই। পুরনো আমলের বাড়ি। উত্তর কলকাতায় এরকম প্রচুর বাড়ি আছে। ফুচার সঙ্গে আগে বহুবার এ—বাড়িতে এসেছি। মোটামুটি সবাই আমাকে চেনেন। তিনতলায় পঙ্কজদার বসার ঘরে পৌঁছতেই দেখি, সোফায় অপরিচিত এক ভদ্রলোকও বসে। সল্ট লেক থেকে সাত সকালে ফুচা হাজির। টেলিফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন পঙ্কজদা। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার আমাকে দেখে ইশারায় বসতে বললেন উনি।

সোফায় বসা ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল ফুচা। ”কালকেতু, ইনি সুরজিৎ খুরানা। দিল্লি থেকে এসেছেন। ‘স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া’র অফিসার। আর মিঃ খুরানা, ইনি কালকেতু নন্দী। দৈনিক বাংলা কাগজের স্পোর্টস এডিটর।”

খুরানা সৌজন্য প্রকাশ করেই বললেন, ”হ্যালো, মিঃ নান্ডি।”

ফুচা বলল, ”মিঃ খুরানা বাবার ওই ক্রিকেট ব্যাটটা নেওয়ার জন্যই এসেছিলেন।”

একটু অবাক হয়েই আমি জানতে চাইলাম, ”কেন?”

”স্পোর্টস অথরিটি দিল্লির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে একটা মিউজিয়মের মতো করছে। প্রাক্তন আর বর্তমান খেলোয়াড়দের কাছ থেকে স্মারক চেয়ে নিয়ে ওখানে রাখবে। মিঃ খুরানা বলছেন, ভারতের খেলাধুলোর ইতিহাস সেখানে তুলে ধরা হবে।”

ফুচার মুখে এটুকু শুনে আমি বেশ আগ্রহ বোধ করতে লাগলাম। লন্ডনে এরকম একটা সংগ্রহশালা দেখেছিলাম বছরদুয়েক আগে। হবু খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করার জন্য এরকম স্পোর্টস মিউজিয়ম আমাদের দেশেও হচ্ছে শুনে ভাল লাগল।

খুরানাকে জিজ্ঞেস করলাম, ”কী—কী থাকবে মিউজিয়মে, ডিটেলে বলবেন?”

উনি একটু ইতস্তত করে বললেন, ”আমার পক্ষে বলা ঠিক হবে না। দিল্লিতে আমাদের ডিরেক্টর জেনারেল সাংবাদিক সম্মেলন করে ওসব জানাবেন।”

হেসে বললাম, ”কলকাতায় আর কার বাড়িতে গেছেন?”

”এখনও যাইনি। সবে কাল বিকেলের ফ্লাইটে এসেছি।”

”আপনাকে একটা ভাল ইনফরমেশন দিতে পারি মিঃ খুরানা। নর্মান প্রিচার্ডের ওলিম্পিক মেডেল দু’টো এখন কলকাতায় একজনের কাছে আছে।”

খুরানা এতক্ষণ আমাকে একটু এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন। বুঝতে পারছিলাম। খবরের কাগজের লোক শুনলে অনেক সরকারি অফিসার এরকম আজব ব্যবহার করেন। নর্মান প্রিচার্ড আর অলিম্পিক মেডেল, কথাগুলো শুনে হঠাৎ আগ্রহ নিয়ে উনি ঘুরে বসলেন। চোখ দুটো চকচক করে উঠল। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, অপ্রত্যাশিত একটা খবর পেয়ে খুরানা বেশ উল্লসিত। দিল্লিতে ফিরে গিয়ে নিশ্চয়ই সাই কর্তাদের কাছে ফলাও করে বলবেন, কত কষ্ট আর দৌড়োদৌড়ি করে তিনি দুটো দুষ্প্রাপ্য জিনিস জোগাড় করেছেন। খুরানা জিজ্ঞেস করলেন, ”নর্মান প্রিচার্ড কে?”

বললাম, ”আপনি কি ঠাট্টা করছেন মিঃ খুরানা? আপনি আমাকে নর্মান প্রিচার্ড কে, সেটা জিজ্ঞেস করছেন! উনিশশো সালে প্রিচার্ড ভারতের হয়ে ওলিম্পিকে নেমেছিলেন। দুটো রুপোর মেডেলও তিনি জেতেন। আসলে উনি ছিলেন একজন ফুটবলার। আমাদের এই কলকাতা শহরেই থাকতেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ফুটবল টিমের হয়ে ট্রেডস কাপে একবার হ্যাটট্রিকও করেন। এখানে ফুটবল খেলার প্রসারের জন্য প্রিচার্ড অনেক কিছু করেছেন। পরে লন্ডনে ফিরে যান। উনিশশো সালে প্যারিসে ওলিম্পিক হচ্ছে শুনে তিনি সেখানে যান। ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে রুপো জেতেন দু’শো কুড়ি গজ দৌড় আর দু’শো কুড়ি গজ হার্ডলসে।”

খুরানা মন দিয়ে শুনছিলেন আমার কথা। এরই মধ্যে লক্ষ করিনি কখন পঙ্কজদা সোফায় এসে বসেছেন। ভ্রূ কুঁচকে রয়েছে। দেখেই মনে হচ্ছে, উনি বিরক্ত। চোখে চোখ পড়তে বললেন, ”কী ফালটুস ঝামেলা। কাল বিকেল থেকে আমার কাজের ছেলেটাও হাসপাতালে। বনগাঁয় ওর বাড়িতে যাচ্ছিল রামু। একদিনের ছুটি নিয়ে। এই এখনই খবর পেলাম, ন্যাশনাল হাইওয়েতে বাস অ্যাক্সিডেন্ট করে বেটাচ্ছেলে মারাত্মক চোট পেয়েছে।”

ফুচা জিজ্ঞেস করল, ”খবরটা তোমাকে কে দিল?”

”বুঝলাম না!”

”সে কী! জিজ্ঞেস করলে না?”

”জিজ্ঞেস করব কী, তার আগেই তো ফোন ছেড়ে দিল।”

ফুচা উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়াল সোফা ছেড়ে। বলল, ”বাবা, এ নির্ঘাত রামুর কাজ। অ্যাক্সিডেন্ট না ছাই। আমার মনে হচ্ছে, ব্যাট চুরি করে ও ব্যাটাই পালিয়েছে। আর এখন গপ্প ছড়াচ্ছে, যাতে সন্দেহটা ওর ওপর না পড়ে।”

পঙ্কজদা যেন একটু মুষড়ে পড়লেন। তারপর আমতা—আমতা করে বললেন, ”না, না। রামু ওই ব্যাট নিয়ে কী করবে! এ তোর বাড়াবাড়ি।”

ফুচা আমাকেই জিজ্ঞেস করে বসল, ”তোমার কী মনে হচ্ছে, অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা ঠিক?”

পঙ্কজদার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ”রামুর যদি সত্যিই অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে থাকে, তা হলে সেটা বের করতে সময় লাগবে না। আমি অফিসে গেলেই খোঁজ নিতে পারব।”

শুনে পঙ্কজদা বললেন, ”আরে ভাই, রামু সেরকম ছেলেই না। সাত—আট বছর আমার বাড়িতে আছে। যতসব ফালটুস কথাবার্তা।”

পঙ্কজদা খুব অস্থির হয়ে উঠেছেন। বোঝাই যাচ্ছে। দীর্ঘ আটত্রিশটা বছর এই ক্রিকেট ব্যাটটা সযত্নে রেখেছেন। মাদ্রাজে নিউজিল্যান্ড টিমের বিরুদ্ধে প্রথম উইকেটে তিনি আর ভিনু মানকড় ৪১৩ রানের একটা ইনিংস খেলেন। সেই বিশ্বরেকর্ড আজ পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেননি। ওই ব্যাটটা দিয়েই পঙ্কজদা ১৭৩ রান করেন। বাড়তি মমতা তো থাকবেই।

ডান দিকে দেওয়ালের ভেতর শো—কেসের দিকে একবার তাকালাম। আগেকার দিনের তৈরি বাড়ি। দেওয়ালের ভেতর তাক। তাতে নানা ট্রোফি, মেডেল, মানপত্র। শুধু ব্যাটটাই নেই।

কীভাবে চুরি হতে পারে সেটা আন্দাজ করার জন্য শো—কেসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটা ক্রিকেট—ব্যাট কারও পক্ষে পকেটে করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এমনকী সাধারণ ব্যাগে করেও অসম্ভব! বিশেষ করে তিনতলার ঘর থেকে। নীচে নামার সময় কারও না কারও চোখে পড়বেই। আর একটা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার, ঘর থেকে আর কিছু চুরি হয়নি। তার মানে, চোরের ‘টার্গেট’ই ছিল ওই ব্যাগটা। স্রেফ একটা ক্রিকেট—ব্যাট। শো—কেসে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখার ফাঁকে ঠিক করে নিলাম, একটু ফাঁকা পেলে পঙ্কজদাকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে, গত দু’—তিনদিন বাড়ির লোক ছাড়া আর কেউ এই ঘরে এসেছিল কি না।

পঙ্কজদা খুব আপসোসের সুরে কথা বলছেন খুরানার সঙ্গে। আমি খুব ভাল করে দেখছি শো—কেসের সেই তাক, যেখানে ক্রিকেট—ব্যাটটা রাখা ছিল। হঠাৎ চোখ গেল, ছোট্ট একটুকরো তুলোর দিকে। সাদা তুলো, তবে কিছু পরিষ্কার করা হয়েছে সেটা দিয়ে। কাচের পাল্লাটা খুলে আলতো করে তুলোর টুকরোটা তুলে নিয়ে এলাম। পারফিউমের গন্ধ বেরোচ্ছে তুলো থেকে। পরে কাজে লাগতে পারে ভেবে সেটা পকেটে রেখে দিলাম। শো—কেসের পাশেই শ্বেত পাথরের র‌্যাকে লাল রঙের টেলিফোন। তার এক হাতের মধ্যে পশ্চিম দিকের জানলা। আগেকার দিনের খড়খড়ি দেওয়া কাঠের পাল্লা। একেবারে মেঝে থেকে আমার মাথা সমান উঁচু। ভেতরের দিকে লোহার লম্বা—লম্বা শিক। কাঠের পাল্লাটা খুলে নীচের দিকে তাকাতেই দেখি ছোট্ট একটা প্যাসেজ এবং খিড়কির দরজা। ওই প্যাসেজে বসে কলের পাশে বাসন মাজছে কাজের মেয়ে। আগেকার দিনে বাড়িতে ঝাড়ুদারদের যাতায়াতের জন্য এইরকম প্যাসেজ রাখা হত।

ঘরের চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে ফের সোফায় এসে বসলাম। পঙ্কজদা জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই বললাম, ”শো—কেসের পাল্লা দুটো খোলা থাকত, না তালা—চাবি দিয়ে রাখতেন?”

পঙ্কজদা বললেন, ”না, তালা—চাবি দেওয়া থাকত না। কে জানে, তিনতলার ঘর থেকে চুরি হবে?”

এই সময় ফুচা বলল, ”পুলিশকে জানানো দরকার।”

পঙ্কজদা রেগে উঠলেন, ”না, না, পুলিশ—ফুলিশ ডাকতে হবে না। ফালটুস ব্যাপার। জামনগরের মহারানি আমাকে একবার একটা সোনার মেডেল প্রেজেন্ট করেছিলেন। ওই তো শো—কেসেই রয়েছে। সেটা চুরি গেলেও আমার এত আপসোস হত না। নিয়ে গেল আসল জিনিসটা!”

আমি বললাম, ”পঙ্কজদা ঠিকই বলেছেন। পুলিশকে খবর দিয়ে কোনও লাভ নেই। এই তো কিছুদিন আগে কাঁকুড়গাছিতে প্রসূন ব্যানার্জির বাড়িতে চুরি হয়ে গেল। পুলিশ কিছুই করতে পারল না।”

আমরা কথা বলছি। খুরানা চুপচাপ বসে। খুব হতাশ মনে হচ্ছিল ওঁকে। ভদ্রতা করে জানতে চাইলাম, ”আপনি ক’দিন কলকাতায় থাকবেন?”

খুরানা বললেন, ”ঠিক বুঝতে পারছি না। আমাকে যে লিস্ট দেওয়া হয়েছে, তাতে মনোজ কোঠারি, গুরবক্স সিংহ, চুনী গোস্বামী, শৈলেন মান্না আর দিব্যেন্দু বড়ুুয়ার নাম আছে। এঁরা কোথায় থাকেন বলতে পারেন? এঁদের কাছ থেকেও স্মারক নিতে হবে।”

”কোঠারির বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। এখান থেকে কাছে, বিবেকানন্দ রোডে। চুনী গোস্বামী থাকেন সাউথ ক্যালকাটায়। সকালের দিকে ওঁকে বাড়িতে পাবেন। সবচেয়ে ভাল যদি দুপুরের দিকে ওঁকে ধরতে পারেন আমাদের স্পোর্টস কাউন্সিলে।”

”আর শৈলেন মান্না?”

”উনি থাকেন ইস্ট ক্যালকাটায়। ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি। একটু কথা বলে তবে ওঁর বাড়িতে যাবেন। লোকে এত টানাটানি করে মান্নাদাকে নিয়ে যে, ওঁকে বাড়িতে পাওয়া খুব মুশকিল। দিব্যেন্দু বড়ুয়া থাকেন সল্ট লেকে। এই ফুচার বাড়ির কাছাকাছি।”

খুরানা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ”মিঃ নান্ডি, আপনি নর্মান প্রিচার্ড সম্পর্কে কী যেন বলছিলেন তখন?”

বললাম, ”প্রিচার্ড ওলিম্পিকের কয়েক বছর পর ফের ভারতে আসেন। আই এফ এ—র সেক্রেটারিও হন। ওই সময় তিনি থাকতেন পার্ক স্ট্রিটে ম্যাকলিয়ড হাউসে। এখন যেটা ২৪৩ নম্বর পার্ক স্ট্রিট। ওঁর নাতির ছেলের নামও নর্মান প্রিচার্ড। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আমার সঙ্গে পড়ত। ছেলেটা দারুণ ফুটবল খেলত। সেই সূত্রে আমার সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বও হয়েছিল। কাছেই বাড়ি, ওর বাড়িতে তখন প্রায়ই যেতাম। একদিন হঠাৎ ও ওলিম্পিক পদক দুটো দেখায়। আর সেদিনই প্রথম বলে ওর ঠাকুরদার বাবার কথা। নর্মান অবশ্য এখন কলকাতায় থাকে না। প্রচুর ব্রিটিশ আর অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার একটা সময় অস্ট্রেলিয়ায় চলে যায়। সেই সময় নর্মানও কলকাতা ছাড়ে। তবে ওর বাবা চার্লস প্রিচার্ড এখনও এখানে আছেন। এই তো মাসছয়েক আগে ‘স্টেটসম্যান ভিনটেজ কার র‌্যালি’তে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।”

খুরানা বললেন, ”মেডেল দুটো চাইলে ওঁরা কি দেবেন?”

আমি বললাম, ”একবার চেয়ে দেখতে পারেন। খাঁটি ব্রিটিশ রক্ত, প্রিচার্ড একটু মেজাজি লোক। সাবধানে কথা বলবেন। ইচ্ছে হলে উনি দিতেও পারেন।”

পকেট থেকে নোটবই বের করে খুরানা নাম—ধাম লিখে নিলেন মনোজ কোঠারির আর চার্লস প্রিচার্ডের। ভদ্রলোক বেশ লম্বা। ছিপছিপে শরীর, বয়স বোঝা যায় না। তবে ষাটের কাছাকাছি তো বটেই। দেখে মনে হয়, এখনও শরীরচর্চা করেন। সাংবাদিক মহলে একটা কথা চালু আছে, দিল্লির সাই হল বৃদ্ধাশ্রম। ওখানে যত অবসর নেওয়া লোকেদের ভিড়। খুরানাকে অবশ্য এখনও কর্মক্ষম বলেই মনে হল।

নোটবই বুক পকেটে চালান করে দিয়ে খুরানা এবার উঠে দাঁড়ালেন। পঙ্কজদার হাত ধরে আন্তরিকভাবেই বললেন, ”যদি ব্যাটটা ফিরে পান, তা হলে আমাদের দেবেন। আমি যোগাযোগ রাখব। এখন চলি। মনোজ কোঠারির বাড়ি যেতে হবে।” খুরানা ঘর থেকে বেরোলেন ফুচার সঙ্গে।

ঘরে আমি আর পঙ্কজদা। দেওয়ালঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম প্রায় ন’টা বাজে। বেলা সাড়ে বারোটার মধ্যে আমাকে অফিস যেতেই হবে। বোম্বাইয়ের সুরেশ ওয়েগাংকর বলে এক ভদ্রলোক একটা ক্রিকেট টিম নিয়ে হংকংয়ে সেভেন—আ—সাইড ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলতে যাচ্ছেন। কলকাতা থেকে দু’জন ক্রিকেটারকে ওই দলে নিয়ে যাবেন। তিনি প্রেস কনফারেন্স ডেকেছেন তাজ বেঙ্গল হোটেলে। সঙ্গে লাঞ্চ। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আগে কখনও আলাপ হয়নি। শুনেছি, ক্রিকেটপ্রেমী। প্রচুর টাকাও খরচ করেন। প্রতি বছর সারা ভারত থেকে খেলোয়াড় বাছাই করে টিম নিয়ে বিদেশে যান। কলকাতার যে দু’জন ক্রিকেটারকে নিয়ে যাবেন, তাঁদের নাম ওই প্রেস কনফারেন্সে জানাতে চান। মনে—মনে হিসেব করে নিলাম, পঙ্কজদার বাড়ি থেকে বেলা দশটার সময় বেরোলেও, বাড়িতে ফিরে চান—টান করে তাজ বেঙ্গলে বারোটার মধ্যে পৌঁছতে অসুবিধে হবে না।

পঙ্কজদা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ”কী মনে হচ্ছে কালকেতু, আমার ব্যাটটা কি ফেরত পাওয়া যাবে?”

বললাম,”চেষ্টা তো করবই পঙ্কজদা!”

”জানো, ওই ব্যাটটা আমার খুব পয়া ছিল। পঞ্চান্ন সালে ইংল্যান্ড থেকে কেনা। তখন আমরা বিলেতের ব্যাট নিয়ে খেলতাম। নটিংহামশায়ারে ‘গান অ্যান্ড মুর’ বলে একটা কোম্পানি ছিল। ওদেরই ‘স্টার কোয়ালিটির অটোগ্রাফ’ নামে ওই ব্যাট তখন খুব চলত। কত দিয়ে কিনেছিলাম জানো? মাত্র তিন পাউন্ড, তখনকার দিনে ৪৫ টাকার মতো।”

পঙ্কজদা স্মৃতি রোমন্থনে ডুবে গেলেন, ”পঞ্চান্ন সালের একেবারে শেষ দিকে নিউজিল্যান্ড টিম ভারত সফরে এল। আমি ওই অটোগ্রাফ ব্যাটটা তার কিছুদিন আগে কিনেছি। আমাদের এই কুমোরটুলি পার্কটা দেখছ। এখানে নেট প্র্যাকটিস করতাম। এই পার্কের ‘হিস্ট্রি’ শুনলে অবাক হয়ে যাবে। এখান থেকেই ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম। আমার জ্যাঠামশাই রায়বাহাদুর তড়িৎভূষণ রায় ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আমার আর—এক জ্যাঠামশাই ছিলেন মোহনবাগান ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। ঠিক উমাপতি কুমারের আগে। আমাদের এই বাড়িটা ১০০ বছরের পুরনো।”

ব্যাট প্রসঙ্গে কথা বলতে—বলতে পঙ্কজদা অন্যদিকে চলে যাচ্ছেন দেখে বললাম, ”ওই নিউজিল্যান্ড টিমটা কেমন ছিল পঙ্কজদা?”

”ভাল, বেশ ভাল। মাদ্রাজ টেস্টে…ওটাই ওদের সঙ্গে প্রথম টেস্ট। আমি আর ভিনু…ভিনু মানকড় দু’জনে ওপেন করেছিলাম। ওই সময় আমি বেশ ভাল ফর্মে। বুঝলে, প্রথম দিনই সেঞ্চুরি করে ফেললাম। আমার যখন ১০০, ভিনুর তখন ৮০ বা তার একটু কম—বেশি। ও আমার কাছে এসে বলল, ‘পঙ্কজ, এবার একটু ধরে খেলো। আমি চালাই। দু’জনে মিলে চালালে ভাল হবে না।’ ওর কথা শুনে আমি ধরে খেলতে শুরু করলাম। ভিনুও প্রথম দিন ওর সেঞ্চুরিটা পেয়ে গেল। সে—সময় টেস্ট ম্যাচ প্রতি দিন পাঁচ ঘণ্টা করে হত। এখনকার মতো ছয় ঘণ্টা করে নয়। সারাদিন ব্যাট করে আমরা দু’জনই নট আউট। স্বভাবতই, দু’জনে বেশ খুশি।”

৩৮ বছর আগেকার ঘটনা পঙ্কজদার মুখে শুনছি।

চোখ—মুখ দিয়ে চাপা গর্ব ফুটে বেরোচ্ছে পঙ্কজদার। ওঁর মতো ‘পারফরম্যান্স’ কোনও খেলায় কোনও বাঙালির নেই। তা সত্ত্বেও পঙ্কজদাকে আজ পর্যন্ত কোনওদিন হামবড়াই করতে শুনিনি।

”সেকেন্ড ডে—তে লাঞ্চ পর্যন্ত আমরা দু’জন টিকে গেলাম, বুঝলে! মাদ্রাজের লোকেরা ক্রিকেটের রেকর্ড মনে রাখে। লাঞ্চের সময়ই ওদের দু’—একজন আমাকে বলল, আপনারা ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। এখন সেটা ভাঙার চেষ্টা করুন। ওপেনিং পার্টনারশিপে সেই সময় রেকর্ড ছিল ইংল্যান্ডের লেন হাটন আর সিরিল ওয়াসব্রুকের। ওরা এগারো বছর আগে জোহানেসবার্গে ৩৫৯ রান করেছিল সাউথ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। সেই সময় কোনও ভারতীয়ের কোনও রেকর্ড ছিল না টেস্ট ক্রিকেটে। এখন যেমন সুনীল আর কপিল রেকর্ড করে রেখেছে, সে সময় আমরা ভাবতেও পারতাম না। যাই হোক, ভিনু আর আমি লাঞ্চের পর ঠিক করেই নামলাম ওয়ার্ল্ড রেকর্ড গড়তে হবে। শেষ পর্যন্ত করেও ফেললাম।”

এ—পর্যন্ত বলেই পঙ্কজদা থামলেন। এই সময় ফুচা ঘরে ঢুকে বলল, ”খুরানাকে পৌঁছে দিয়ে এলাম। লোকটা খুব আপসোস করতে—করতে গেল। এত ভদ্রলোক, ভাবা যায় না!”

পঙ্কজদা বললেন, ”আমার দুর্ভাগ্য, আর কী।”

খুরানার কথা শোনার ইচ্ছে তখন আমার নেই। মাদ্রাজে সেই ওয়ার্ল্ড রেকর্ড হওয়ার পর কী হল, জানার জন্য পঙ্কজদাকে বললাম, ”সেই দিনটা কীভাবে ‘সেলিব্রেট’ করেছিলেন আপনারা?”

”সেলিব্রেশনের কী আছে? তখন তো আর টিভি—তে এত মাতামাতি ছিল না। লাঞ্চের পর ওয়ার্ল্ড রেকর্ডটা হয়ে গেল। আর তখনই পলি আমাকে একটা চিরকুট পাঠাল—’হিট এভরি বল অ্যান্ড গেট আউট’। প্রতিটা বল মারো, আর আউট হয়ে চলে এসো। সেবার পলি উমরিগড় আমাদের টিমের ক্যাপ্টেন। আমি ভাবলাম, প্রচুর রান হয়ে গেছে। ও বোধ হয় ইনিংস ডিক্লেয়ার করতে চায়। তাই মারতে গিয়ে আউট হয়ে গেলাম। আমার রান তখন ১৭৩।”

”তারপর কী হল পঙ্কজদা?”

”বোকামি করেছিলাম। টেস্ট ম্যাচে একটা ডাবল সেঞ্চুরির কী মূল্য, সে—সময় জানতাম না। পলির চিরকুট পেয়ে আমি বাজে বলে মারতে গিয়ে আউট হয়েছি শুনে, পরে ভিনু খুব রাগারাগি করেছিল। পলি কিন্তু, আমি আউট হওয়ার পরই ইনিংস ডিক্লেয়ার করেনি। নিজে খেলতে নেমেছিল। ভিনু বলেছিল, ‘আমাকে জিজ্ঞেস করলে না কেন? ডাবল সেঞ্চুরির সুযোগ আর কখনও তুমি পাবে?’ ভিনু নিজে সেই ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরি করে। এখনও আমি আপসোস করি, ওই ম্যাচে কেন পলি—র কথা শুনলাম?”

কথা বলতে—বলতেই হঠাৎ দরজার দিকে চোখ পড়ল পঙ্কজদার। কুড়ি—বাইশ বছরের একটা ছেলেকে ঢুকতে দেখে বললেন, ”সব শুনেছিস তো?”

সেই ছেলেটি বলল, ”একটু আগেই ফুচাদা বলল। রামু ব্যাটা এই কাজ করতে পারে, ভাবতেও পারছি না। ওকে ছাড়বেন না।”

পঙ্কজদার দিকে আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই উনি বললেন, ”এ হচ্ছে কালী, কালীকিঙ্কর, হাটখোলার ওদিকে থাকে। আগে আমার কাছে ট্রেনিং নিত। সল্ট লেকে আমার একটা দোকান আছে। সেখানে কাজ করে।”

কালী নামের ছেলেটি পঙ্কজদাকে বলল, ”আপনি যদি বলেন তো, আমি রামুর বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে আসি।”

শুনে ফুচা বলল, ”এখনই রওনা হলে তুই বিকেলের মধ্যে ফিরে আসতে পারবি। এগারোটা—সাড়ে এগারোটার সময় একটা বনগাঁ লোকাল আছে।”

অনিচ্ছা দেখিয়ে পঙ্কজদা বললেন, ”থাক, থাক। যত সব ফালটুস সন্দেহ। তাড়াহুড়ো করিস না। কালী, তুই বরং সল্ট লেকে চলে যা। দোকানে এখন লোক নেই।”

ঘাড় নেড়ে কালীকিঙ্কর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ”এই ছেলেটা কতদিন আছে আপনার দোকানে?”

পঙ্কজদা বললেন, ”বছরখানেক। ফ্যামিলির অবস্থা খুবই খারাপ। আমার এখানে রোজ এই সময় আসে। আমার সঙ্গে রোজ সল্ট লেক যায়।”

”আপনার এই ঘরে, বাড়ির লোক ছাড়া আর কে—কে আসে?”

”মাঝে—মাঝে আমি তাস—টাস খেলি। আশপাশেই আমার সমবয়সী কিছু বন্ধু আছে। মোটামুটি ওরাই আসে। সারাদিন তো আমি, বলতে গেলে বাড়িতেই থাকি না। দোকান আর কোচিং ক্যাম্প নিয়ে ব্যস্ত।”

”ভাল করে ভাবুন। আর কেউই এ—ঘরে আসেন না?”

”মনে পড়ছে না।” অসহায়ভাবে ফুচার দিকে তাকালেন পঙ্কজদা। ”না, না, আর কেউ আসে না।”

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে।

এবার ওঠা দরকার। না—হলে তাজ বেঙ্গলে প্রেস কনফারেন্সে পৌঁছতে পারব না। আমাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে পঙ্কজদা বললেন, ”কালকেতু, একটা রিকোয়েস্ট, এই খবরটা ছেপো না। লোকে ফালটুস বিরক্ত করবে।”

হেসে ঘাড় নাড়লাম। তারপর ফুচার সঙ্গে নীচে নেমে এলাম। বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে ও বলল, ”কী বুঝলে কালকেতু? ব্যাট উদ্ধার করা যাবে?”

”মনে হচ্ছে। তবে তোমার সন্দেহটা ঠিক নয়। রামু চুরি করেনি। লোক পাঠিয়ে খবর নাও। ওর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।”

… বাড়ি ফিরে আসতে না আসতেই ফুচার ফোন, ”অদ্ভুত ব্যাপার। খুরানা একটা সানগ্লাস ফেলে গিয়েছেন। উনি কোথায় আছেন, জিজ্ঞেস করিনি। সানগ্লাসটা ফেরত দেওয়ার জন্য সল্ট লেকের সাই সেন্টারে ফোন করেছিলাম। ওদের ডিরেক্টর হাকিম বললেন, সুরজিৎ খুরানা নামে কেউ দিল্লি থেকে আসেনি। দিল্লি সেন্টারে ওই নামে কোনও অফিসারই নেই।”

শুনে আমি মুচকি হাসলাম।

সুরেশ ওয়েগাংকরের প্রেস কনফারেন্সেই দেখা হয়ে গেল তথাগতর সঙ্গে। এই ছেলেটা ক্রীড়া সাংবাদিকতায় নতুন এসেছে। আমার সঙ্গে খুব হৃদ্যতা। মাঝে—মধ্যে গোয়েন্দাগিরিতে সাহায্যও করে। ওকে আড়ালে টেনে নিয়ে পঙ্কজদার ব্যাট চুরির কথা সংক্ষেপে বললাম। তথাগত বলল, ”আমাকে কী করতে হবে শুধু বলো। আজ আমার নাইট ডিউটি। রাত্তির ন’টা অবধি ফাঁকা আছি।”

তথাগতকে দু’টো তথ্য জোগাড় করার ভার দিলাম। ওর নিজের গাড়ি আছে। এটা খুব সুবিধার। সব শুনে ও বলল, ”অফিসে ফিরেই তোমাকে ফোন করব। তার আগে বেরিয়ে যেয়ো না অফিস থেকে।”

ওয়েগাংকরের প্রেস কনফারেন্স শেষ হয়ে গেল ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই। শুনেছি লোকটা ইমপোর্ট—এক্সপোর্টের ব্যবসা করে। প্রায়ই বিদেশে যায়। তার মধ্যে বছরে একবার ক্রিকেট টিম নিয়ে। কখনও ইংল্যান্ড, কখনও ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কখনও আবার আফ্রিকার কোনও দেশে। এই সফরগুলো অবশ্য কোনওটাই সরকারি নয়। অর্থাৎ, ক্রিকেট বোর্ডের অনুমতি নিয়ে নয়। পুরোটাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে আর যোগাযোগে। ক্রিকেট কর্তারাও কিছু বলেন না। তরুণ ক্রিকেটাররা, বিদেশে খেলার অভিজ্ঞতা পায় বলে। ওয়েগাংকরের টিমটা হংকং যাচ্ছে কাল সকাল ন’টার ফ্লাইটে। প্রেস কনফারেন্সে ভদ্রলোক মজা করে একবার বললেনও, ”সাংবাদিকদের কেউ যদি আমাদের সঙ্গে যেতে চান, তা হলে পুরো দায়িত্ব আমার।”

বলা বাহুল্য, কেউই উৎসাহ দেখালেন না।

তাজ হোটেল থেকে বেরিয়ে একবার লালবাজারে গেলাম। সুদীশের সঙ্গে দেখা করার জন্য। তিনতলায় ওঁর দফতরে গিয়ে শুনলাম, নেই। বাইরে বেরিয়েছেন, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরবেন। এই সময়টা কী করব ভেবে ঢুকলাম ক্রাইম সেকশনে বীভৎস মোদকের ঘরে।

”আরে আসুন কালকেতুবাবু। অনেকদিন পর। সুদীশ ঘরে নেই বুঝি?”

হেসে বললাম, ”ঠিকই ধরেছেন।”

”ডি সি এমে মোহনবাগান টিমটাকে হারিয়ে দিয়ে এলেন? ইরানি টিমটা কি খুব ভাল ছিল?”

বীভৎস মোদক পাঁড় মোহনবাগান সাপোর্টার। খেলার খুব খবর রাখেন। বেশ কয়েক বছর লালবাজারে যাতায়াত করছি। এখানকার অর্ধেক লোক ইস্টবেঙ্গল, অর্ধেক মোহনবাগান।

বললাম, ”পুরো টিম থাকলে ইরানি টিমটাকে হারিয়ে দিতে পারত মোহনবাগান। ব্যাডলাক বলতে পারেন।”

”আরে মশাই, আপনি টুর্নামেন্ট কভার করতে গেলেই দেখেছি, মোহনবাগান জেতে। এবারই পারল না। তা হঠাৎ কী মনে করে লালবাজারে?”

”একটা ইন্টারেস্টিং কেস পেয়েছি। আপনার একটু সাহায্য চাই।”

সংক্ষেপে গুছিয়ে বললাম বীভৎস মোদককে। সব শুনে উনি বললেন, ”মনে হচ্ছে, এটা চ্যাং মিনের কোনও এজেন্টের কাজ।”

”চ্যাং মিন? সে আবার কে?”

”লোকটা থাকে হংকংয়ে। বিরাট সুপার মার্কেটের মালিক। তবে ওর আসল রোজগারটা অদ্ভুত। রিসেন্টলি একটা আর্টিকেল বেরিয়েছে পুলিশদের ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে। ওই লোকটাকে নিয়ে। চ্যাং মিনের ব্যবসা, বিশ্বের বিখ্যাত লোকদের ব্যক্তিগত জিনিস কেনা—বেচা নিয়ে।”

”সেটা কীরকম?”

”ধরুন, আইনস্টাইনের ব্যবহার করা একটা কলম। বা চার্লি চ্যাপলিনের টুপি। এগুলো কেনার জন্য বহু লোক মুখিয়ে আছেন। লক্ষ—লক্ষ ডলার খরচ করতেও তাঁরা রাজি। চ্যাং মিন সস্তায় এইসব জিনিস জোগাড় করে। কোনও—কোনও সময় চোরাই পথেও জিনিস ওর কাছে আসে। এই তো কিছুদিন আগে আন্দ্রে আগাসি সোনালি চুল কেটে ফেলল। সেই চুল চ্যাং মিনের কাছে চোরাই পথে আসে। সিঙ্গাপুরের এক ধনী মহিলা সেই চুল কিনেছেন এক লাখ ডলার দিয়ে।”

”চ্যাং মিন কি খেলার সরঞ্জামও কেনা—বেচা করে?”

”করে। কার্ল লুইসের একটা ওলিম্পিক গোল্ড মেডেল ও বিক্রি করেছিল পাঁচ লাখ ডলারে। ওই পদকটা, লুইস ওর বাবা মারা যাওয়ার পর, মৃতদেহের সঙ্গে সমাধিতে দিয়েছিল।”

পু”লিশ এসব জানতে পারে না?”

”পারে। তবে অনেক পরে। বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর। আর হংকংয়ে পুলিশের পক্ষে চ্যাং মিনকে কিছু করা সম্ভব না। যাক গে, ছাড়ুুন এসব কথাবার্তা। সামনের বছর মোহনবাগান নাকি বেলজিয়ামের একজন নামী ফুটবলারকে আনছে?”

বীভৎস মোদকের প্রশ্নটা শুনে আমি হেসে ফেললাম। লালবাজারে সারাদিন অপরাধীদের মাঝে কাটাতে হয় ভদ্রলোককে। তা সত্ত্বেও মোহনবাগানকে ভুলতে পারেন না। মোহনবাগান নিয়ে টুকটাক কথা বলে আমি উঠে পড়লাম। সুদীশের জন্য আর বসে থাকা যাবে না। অফিসে অনেক কাজ পড়ে আছে।

খবরের কাগজের অফিস। দিন—রাত্তির কাজ। ওখানে ঢুকলে বাইরের জগতের কথা আর মনে থাকে না। এক—একদিন দুপুরবেলায় ঢুকতে হয়। যখন বেরোই, মাঝ রাত্তির। আমরা মজা করে বলি, বাইরে ভূমিকম্প হলেও টের পাওয়ার উপায় নেই। পরদিন কাগজ পড়ে জানতে হয়, ঝড়ঝঞ্ঝা হয়েছিল। ওয়েগাংকরের প্রেস কনফারেন্স নিয়ে কয়েক প্যারাগ্রাফ লিখে ফেললাম। তারপরেই তথাগতের ফোন। খুব উত্তেজিত, ”কালকেতুদা, প্রচুর খবর আছে।”

”বল।”

”কালীকিঙ্কর ছেলেটার খোঁজ নিয়েছি। হাটখোলায় থাকে। বাবার মুদির দোকান। মা স্রেফ হাপিশ। এক বোন আছে। বয়স সতেরো—আঠারো। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কাজ করে।”

”কী কাজ?”

”কাঁকুড়গাছিতে ‘টেলি ওয়াশ’ বলে একটা কোম্পানি আছে। ওদের কাজ টেলিফোন পরিষ্কার করে দেওয়া। বিভিন্ন অফিসে, লোকের বাড়িতে গিয়ে এদের লোকেরা সপ্তাহে একদিন টেলিফোন পরিষ্কার করে দেয়। মেয়েটা সেই কাজ করে। ওর এরিয়া কুমোরটুলি—হাটখোলা—শোভাবাজার অঞ্চলে। টেলি ওয়াশে ফোন করেছিলাম। ওর মালিক আবার সল্ট লেকে আমাদের ব্লকেই থাকে। কথায়—কথায় বেরিয়ে গেল সেটা।”

”বাঃ, চমৎকার! আর কী তথ্য পেয়েছিস তুই?”

”খুরানা। লোকটা কি লম্বা, ছিপছিপে, ওভার সিক্সটি? যদি তা হয়, ধুরন্ধর লোক।”

”ঠিক তাই। লোকটাকে কোথায় দেখলি?”

”তোমার আন্দাজমতো জায়গাতেই। ঘণ্টাখানেক আগে সেখানে গিয়েছিল। নাম বলেছে প্রকাশ মেহেরা। লোকটাকে ফলো করে অনেক তথ্য পেলাম। সেন্ট্রাল ক্যালকাটায় একটা হোটেলে গিয়ে উঠেছে। তুমি তো জানোই, বড়—বড় সব হোটেলে আমার একজন করে সোর্স আছে। রতন সাহা বলে একটা ছেলে ক্যারাটে করে। সে ওই হোটেলের সিকিউরিটি চিফ। তুমি তাকে চেনো।”

”হ্যাঁ চিনি। ব্যারাকপুরে থাকে। মাঝে—মাঝে ক্যারাটের খবর ছাপাতে আমার কাছেও আসে।”

”হ্যাঁ সেই ছেলেটাই। ও বলল, খুরানা ওরফে মেহেরা লোকটা গতকাল হোটেলে এসেছে। হোটেল রেজিস্টারে অবশ্য খুরানা নামটাই রেখেছে। স্পোর্টসের দু’—চারজন লোক ওর সঙ্গে দেখা করেছে এর মধ্যে। একজনের গায়ে ইন্ডিয়া ইলেভেন লেখা ট্র্যাকসুটও নাকি ছিল। লোকটা দু’দিনে দু’বার টেলিফোন করেছে হংকংয়ে। কথা বলেছে ক্যান্টনিজ ভাষায়। হোটেলের পি বি এক্সে রেকর্ড করা আছে কথাবার্তা।”

”তুই কোত্থেকে কথা বলছিস?”

”হোটেলের লবি থেকে। আমার হাতে এখনও সময় আছে ঘণ্টাচারেক। কী করব বলো।”

”তুই ওখানেই থেকে যা। রাতে অফিস থেকে একবার ফোন করে সব জানাবি।”

”ঠিক আছে।” তথাগত ফোন ছেড়ে দিল।

আমি কাগজ—কলম নিয়ে বসলাম। জট ছাড়াবার সময় এটা করি। সন্দেহের তালিকায় এক নম্বর সুরজিৎ খুরানা ওরফে প্রকাশ মেহেরা। দু’ নম্বরে কেউ আছে? আপাতত কেউ নেই। আচ্ছা, খুরানা বা মেহেরা লোকটার উদ্দেশ্য কী? বীভৎস মোদকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হংকংয়ে চ্যাং মিন নামে একটা লোক নামী খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত জিনিস চড়া দামে বিক্রি করে। মেহেরা লোকটা হংকংয়ে দু’বার ফোন করেছে। তা হলে কি ওই লোকটা চ্যাং মিনের এজেন্ট? লোকটা দিল্লি থেকে এসেছে। কপিলদেবের সেই বল—টা চুরি গিয়েছে দিল্লির সুন্দরনগর থেকেই। মেহেরাই কি সেটা হাতিয়েছে? হোটেলের পি বি এক্সে রেকর্ড করা ওর কথাবার্তা শুনলে ভাল হত। কিন্তু ক্যান্টনিজ ভাষা জানা লোক না হলে সেটা বোঝা সম্ভব নয়।

চিন্তা করতে লাগলাম কলকাতায় এরকম লোক কেউ আছেন কী না। ট্যাংরা অঞ্চলে বেশ কয়েকজন চিনা চামড়ার ব্যবসা করেন। তাঁরা পায়রা রেসে খুব উৎসাহী। তাঁদেরই একজন ওয়াই টং মাঝেমধ্যে আমার কাছে আসেন পায়রা রেসের খবর দেওয়ার জন্য। তাঁর সাহায্য নিলে কেমন হয়? এটা ভেবেই ফোন করলাম ওয়াই টংকে। আমারই সমবয়সী। জন্ম কলকাতায় বলে হিন্দি—বাংলা কিছু—কিছু বলতেও পারেন। টং—কে অফিসে আসতে বললাম।

হাতের কাজকর্ম সেরে উঠতে না উঠতেই টং এসে হাজির।

”কী সমাচার নান্দীদা?”

বললাম, ”আপনাকে একবার আমার সঙ্গে বেরোতে হবে।”

”কোথায়?”

”এই সেন্ট্রাল ক্যালকাটাতেই, একটা হোটেলে।”

”চলিয়ে।”

টং নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছেন। গাড়িতে উঠেই হিন্দি—বাংলা মিশিয়ে বললেন, ”আজ আমাদের ট্যাংরায় আপনাকে চাইনিজ ডিশ খাওয়াব। পেয়েছি যখন, আপনাকে আর ছাড়ছি না।”

বললাম, ”ওসব পরে হবে। একটা ইনভেস্টিগেশন করছি। সেজন্য ব্যস্ত। আপনাকে একটু সাহায্য করতে হবে।” সংক্ষেপে বললামও ঘটনাটা। শুনে টং ঝকমক করে উঠলেন। তারপর বললেন, ”আরে, আমার ফোরফাদাররা সব ক্যান্টনের লোক। ওই ভাষাটা আমি জানি। কলকাতায় যত চিনা দেখবেন, কেউই মেন—ল্যান্ড চায়নার লোক না।”

দু’জনে গল্প করতে—করতেই পৌঁছলাম হোটেলে। দেখি লবিতে তখনও বসে রয়েছে তথাগত। আমাদের দেখে ও লাফিয়ে উঠল। বলল, ”এইমাত্র মেহেরার সঙ্গে একটা মেয়ে দেখা করতে গেল। সতেরো—আঠারো বছর বয়স।”

ওকে বললাম, ”তুই এখানে বসে ‘ওয়াচ’ কর। রতনকে ডাক। আমরা পি বি এক্সে গিয়ে টেপ করা কথাবার্তাগুলো বরং শুনে আসি।”

তথাগতই উঠে গিয়ে রতন সাহাকে ডেকে আনল। ও বলল, ”ভাল সময়ে এসেছেন কালকেতুদা। সাতটার সময় ডিউটি বদল হয়। মিস নিনা এখন থাকায় সুবিধা হবে।”

তিনজনে মিলে পি বি এক্স রুমে গেলাম। বিরাট হোটেল। তার সব ব্যবস্থাই আলাদা। রতন সাহা বোধ হয় আগেই মিস নিনাকে সব বলে রেখেছিল। টংকে একটা হেডফোন দিয়ে মিস নিনা টেপ চালিয়ে দিল। কাচের ঘেরাটোপের ওপাশে ভদ্রমহিলা বসে। টং পকেট থেকে একটা নোটবই আর কলম বের করেছেন। কানে শুনছেন, আর চটপট কাগজে লিখে নিচ্ছেন। মিনিট দশেক ধরে এসব চলছে। লেখার জন্য টং মাঝে মাঝে ইশারা করে মিস নিনাকে টেপ বন্ধ করতে বলছেন। আবার লেখা শেষ হলেই চালাতে বলছেন। আমি আর রতন সাহা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছি সোফায় বসে।

এক সময় মাথা থেকে হেডফোনটা খুলে টং আমাকে বললেন, ”এই সুরজিৎ নামের লোকটা কে মিঃ নান্দী?”

”সুরজিৎ! ও…সুরজিৎ খুরানা। এই লোকটার কথা শোনার জন্য আমরা এসেছি।”

”টেপ রেকর্ডারে যা শুনলাম, তাতে ওই ভদ্রলোকের কোনও আত্মীয়া হংকংয়ে থাকেন। তিনি গুরুতর অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।”

”সে কী!”

”হ্যাঁ। ভদ্রলোক কোনও সময়, দীর্ঘ কয়েক বছর নিশ্চয় হংকংয়ে ছিলেন। ক্যান্টনিজ—চিনায় যেভাবে তড়তড়িয়ে কথা বলছেন, তাতে এই কথাটাই মনে হচ্ছে।”

”সুরজিৎ খুরানা ওদিকে কার সঙ্গে কথা বলেছেন?”

”এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে। তিনিই অসুস্থতার খবর দিচ্ছেন। যে আত্মীয়া অসুস্থ, তাঁর ইলেকট্রনিকসের দোকান আছে চুনকিং ম্যানসন নামে এক সুপার মার্কেটে। সেটা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। শুনে সুরজিৎ খুব ‘আপসেট’। ওপাশের ভদ্রমহিলা বারবার অনুরোধ করছেন, একবার সপ্তাহখানেকের জন্য হলেও হংকংয়ে যেতে। এই হল, আপনার প্রথম দিনকার কথাবার্তা।”

জিজ্ঞেস করলাম, ”পরের দিন?”

”পরের দিন অর্থাৎ আজ খুব সামান্যই কথা বলেছেন। সুরজিৎ জানতে চাইছেন, ভদ্রমহিলা কেমন আছেন। এইসব টুকরো কথা।”

পি বি এক্স রুম থেকে, সত্যি বলতে কী একটু হতাশ হয়েই বেরিয়ে এলাম। লবিতে পৌঁছতেই তথাগত চোখের ইশারায় দেখাল, খুরানা হোটেলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন একটা মেয়ের সঙ্গে। মঙ্গোলিয়ান মুখ। মেয়েটার পরনে স্ল্যাকস আর লাল রঙের একটা গেঞ্জি। দু’একটা কথা বলেই মেয়েটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। পনেরো—কুড়ি গজ দূর থেকে খুরানাকে দেখছি। সকালে পরনে ছিল সাফারি স্যুট। এখন চোস্ত আর কুর্তা। সত্যিই খুব ‘হ্যান্ডসাম’। আপাতদৃষ্টিতে এখন আর সন্দেহ করার কোনও কারণ নেই লোকটাকে। একটাই প্রশ্ন, ভদ্রলোক চার্লস প্রিচার্ডের বাড়িতে গিয়ে নিজের নামটা কেন ভাঁড়ালেন? কেন নিজেকে প্রকাশ মেহেরা বলে পরিচয় দিলেন?

মুহূর্তের মধ্যেই মন ঠিক করে নিলাম। তারপর সরাসরি গিয়ে দাঁড়ালাম খুরানার সামনে।

”কেমন আছেন মিঃ খুরানা?”

”ভাল। আপনি এখানে?”

”এই, একজনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আপনার কাজ এগোল?”

”কিছুটা। কোঠারির সঙ্গে কথা বলেছি। বড়ুুয়া বিদেশে খেলতে গিয়েছে। মিঃ মান্নার সঙ্গে কাল দেখা করব। হ্যাঁ, আপনি যে ভদ্রলোকের নাম—ঠিকানা দিয়েছিলেন, পার্ক স্ট্রিটে…চার্লস প্রিচার্ড…তাঁর কাছেও গিয়েছিলাম। প্রথমে টেলিফোন করি। উনি সরাসরি বলে দেন, কারও সঙ্গে দেখা করবেন না। টেলিফোনে নিজের নামটা বলে ফেলেছিলাম। পরে ঠিক করলাম, সরাসরি গিয়ে নিজেই দেখা করব। আজ দুপুরে ম্যাকলিয়ড ম্যানসনে ওঁর ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা করার সময় আর নিজের নামটা বলিনি। আমাদের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর আছেন…প্রকাশ মেহেরা। তাঁর নাম—ঠিকানা দিয়ে এসেছি। চার্লস বললেন, চিঠি দিয়ে উনি জানিয়ে দেবেন ওলিম্পিক মেডেলগুলো মিউজিয়মে দেবেন কী না। আপনিও যদি একটু চেষ্টা করেন, তা হলে ভাল হয়।”

জিজ্ঞেস করলাম, ”মিঃ খুরানা, আপনি কি কখনও হংকংয়ে ছিলেন?”

ভয়ানক চমকে উঠলেন খুরানা। তারপর বললেন, ”হ্যাঁ, ওখানে ভারত সরকারের চাকরি করতাম। বছর পাঁচেক হল দেশে ফিরেছি। অবসর নিয়ে বসেই ছিলাম। সাই কর্তারা অল্প কয়েকদিন হল আমাকে এই দায়িত্বটা দিয়েছেন।”

খুরানাকে ‘গুড নাইট’ জানিয়ে হোটেল থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম। টং খুব পীড়াপীড়ি করলেন ট্যাংরায় চাইনিজ খেতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। ওঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফের অফিসেই ফিরে এলাম।

ব্যাট চুরির কেসটা একটু জটিল হয়ে উঠছে। খুরানা লোকটা যা বলছেন, তাতে সন্দেহের বাইরে। ওঁর সঙ্গে হোটেলের লবিতে কথা বলার সময় সেই সানগ্লাস ফেলে আসার কথাটা বলা হল না। সকালে পঙ্কজদার বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে যা—যা হয়েছিল, পুরো ঘটনাটা আবার ভাবতে শুরু করলাম। কোনও অপরাধমূলক কাজই নিখুঁত হতে পারে না। নিশ্চয়ই কোনও না কোনও ভুল তাতে থাকবেই। বারবার ভাবতে লাগলাম। আর কাগজে তা লিখে রাখতে আরম্ভ করলাম। এরই মাঝে হঠাৎই মনে পড়ল মিরজা—র কথা। দিল্লি সাই—তে পাবলিক রিলেশনস অফিসার হল মিরজা। সেন্ট জেভিয়ার্সে আমার সঙ্গে পড়ত। কী ভেবে দিল্লিতে মিরজা—কে একবার ফোন করলাম। এ—কথা সে—কথার পর জিজ্ঞেস করলাম, ”তোদের সাই—তে সুরজিৎ খুরানা বলে কোনও অফিসার জয়েন করেছে?”

বললাম, ”হ্যাঁ। সাত—আটদিন আগে। লোকটার ওপর একটা বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। খুরানা তো এখন তোদের ওখানে। দেখা হয়েছিল বুঝি?”

বললাম, ”হ্যাঁ। কিন্তু কলকাতায় সাই সেন্টার থাকা সত্ত্বেও দিল্লি থেকে লোক পাঠানোর কী দরকার ছিল? ভদ্রলোক যা করতে এসেছেন, সেটা তো এখানকার লোকেরাও করতে পারতেন।”

মিরজা হেসে বলল, ”সাইয়ের হাতে প্রচুর টাকা। খরচ তো করতে হবে।”

বললাম, ”মজার ব্যাপার হল, ভদ্রলোক কলকাতায় এসে এখনও সাই সেন্টারে যোগাযোগ করেননি। এখানে ওঁর নাম কেউ জানেনও না।”

”হতে পারে। আশ্চর্যের কিছু নেই। স্পোর্টস মিউজিয়মের কথা আমাদের ডিরেক্টর জেনারেল আগে থেকে জানাতে চান না। আমি পাবলিক রিলেশনসে আছি। আমিও ভাল জানি না।”

আরও দু’—চারটে কথার পর ফোন ছেড়ে দিলাম। ব্যাট চুরির কেস আরও জট পাকাল। খুরানা ভদ্রলোককে অযথা সন্দেহ করছিলাম। ঠিক এইরকম পরিস্থিতিতে বরাবর দেখেছি, ভাগ্য আমাকে অদ্ভুতভাবে সাহায্য করে। সামান্য একটা সূত্র পাইয়ে দেয়, যা জট খুলে দেয়। কোনও রহস্য উন্মোচনের জন্য মনঃসংযোগ করাটাই আসল। আরও…আরও গভীরে গিয়ে না ভাবলে পঙ্কজদার ব্যাট চুরির রহস্যভেদ সম্ভব হবে না। অফিসে বসে মনঃসংযোগ করা সম্ভব নয়।

রাতে বাড়িতে ফিরতেই মা বললেন, ”তথাগত ফোন করেছিল। তোকে ‘রিং ব্যাক’ করতে বলেছে।”

ইচ্ছা করছিল না। তবুও ফোনটা করলাম। জানি, কেন ও আমাকে ফোন করেছে। ইদানীং ওরও আমার মতো টেনিস খেলার শখ বেড়েছে। হংকং থেকে একটা ভাল র‌্যাকেট আনাতে চায়। ওয়েগাংকরের টিম হংকং যাচ্ছে শুনে তাজ বেঙ্গলে আমাকে বলেছিল, কারও হাত দিয়ে একটা র‌্যাকেট আনিয়ে দিতে। একদম ভুলে গেছি সে—কথা। তথাগতর অফিসে ফোন করতেই টেলিফোন অপারেটর বললেন, ”উনি পেজ মেকাপ রুমে আছেন। একটু ধরুন।” রিসিভার কানে লাগিয়ে ভাবতে লাগলাম, তথাগত আজ সারাটা দিন আমার জন্য নষ্ট করেছে। ওর র‌্যাকেটের ব্যবস্থা করে দেওয়া দরকার। কাল সকালের দিকে এয়ারপোর্টে গিয়ে কলকাতার ছেলে দুটোকে ধরতে হবে। পাঁচ মিনিট ধরে ফোন ধরেই আছি। তথাগতর পাত্তা নেই। খবরের কাগজে এই এক অসুবিধা। চট করে লাইন পাওয়া যায় না। আর পেলেও লোকটাকে ধরা যায় না। আমাদের অফিস সম্পর্কেও এরকম প্রচুর অভিযোগ শুনেছি। বিরক্ত হয়েই একসময় লাইনটা ছেড়ে দিলাম।

আর কী আশ্চর্য! রিসিভারটা ‘ক্রেডল’—এ রাখতেই হঠাৎ চোখে পড়ল সেই জিনিসটা। ছোট্ট এক টুকরো তুলো, সুগন্ধি মাখানো। টেলিফোনের পাশে পড়ে থাকা। মুহূর্তেই পকেটে হাত চলে গেল। সকালে পঙ্কজদার শো—কেসেও এরকম একটা তুলোর টুকরো পেয়েছিলাম। রিসিভারটা তুলে ফের একটা নাম্বারে ডায়াল করলাম। ব্যাট চুরির সূত্র হাতের কাছেই পেয়ে গেছি।

…আমার সামনের সোফায় পঙ্কজদা, পাশে ফুচা, সুরজিৎ খুরানা। উলটো দিকে কোনাকুনি বসে তথাগত আর কালীকিঙ্কর। দরজার কাছে ভিড় করে দাঁড়িয়ে কয়েকজন। বাড়িরই লোকজন। সবাইকে ডেকে এনেছি ম্যাজিক দেখাব বলে। সল্ট লেকের দোকান বন্ধ করে এসেছেন পঙ্কজদা। সন্ধেবেলায় ফের খুলতে হবে বলে তাড়া লাগালেন উনি, ”সাসপেন্স না রেখে এবার শুরু করে দাও কালকেতু।”

চারপাশে সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে শুরু করলাম, ”পঙ্কজদা, আপনার ব্যাট চুরির রহস্য উদ্ধারের জন্যই আজ সবাইকে ডেকেছি। আপনি যখন এই দায়িত্বটা আমাকে দেন, সেই সময় আমিও খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ৩৮ বছরের পুরনো একটা ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে চোর কী করবে? এটা সাধারণ চোরের কাজ নয়। ওই ব্যাটটার একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে। কেননা ওই ব্যাট দিয়ে একটা বিশ্বরেকর্ড করা হয়েছিল। ক্রিকেট সম্পর্কে আগ্রহ আছে, এরকম লোকের পক্ষেই ওই ব্যাটটা নিয়ে কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক। অর্থাৎ, চোর ক্রিকেট জগতের লোক অথবা এমন লোক, যার সঙ্গে ক্রিকেট মহলের যোগাযোগ আছে।

”পঙ্কজদা, গতকাল আপনার বাড়িতে আসার পর আলাপ হয়েছিল সুরজিৎ খুরানার সঙ্গে। প্রাথমিকভাবে সন্দেহটা ওর ওঁপর পড়েছিল। পরে খতিয়ে দেখলাম, সন্দেহটা অমূলক। তা হলে আর কে আছেন, যিনি ক্রিকেট ব্যাটটা হাতিয়ে নিতে পারেন! সেই লোকটির উদ্দেশ্যই বা কী থাকতে পারে? কেউ—কেউ বিখ্যাত লোকের ব্যবহার্য জিনিস হাতিয়ে ব্যক্তিগত সংগ্রহে রেখে দেন। এটা এক ধরনের ‘হবি’। এক্ষেত্রেও কি সেরকম কিছু ঘটেছে?

”সত্যি বলতে কী, আমিও শুরুর দিকে এ—ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না। গতকাল লালবাজারে আমার এক বন্ধুর কাছে নতুন কিছু তথ্য পেয়ে চিন্তাধারাটা বদলালাম। হংকংয়ে এইসব দুষ্প্রাপ্য জিনিসের একটা চোরাবাজার আছে। সারা বিশ্বে তাদের এক ধরনের এজেন্ট ছড়িয়ে আছেন। যাঁরা ছলে—বলে—কৌশলে জিনিস সংগ্রহ করে ওই বাজারে পাঠান। এর বিনিময়ে বেশ ভাল টাকা তাঁরা রোজগার করেন। জানতাম না, আজ সকালেই জানতে পারলাম, আমাদের দেশেও তাদের একজন এজেন্ট আছেন। তিনি বোম্বাইয়ের লোক। নাম সুরেশ ওয়েগাংকর। তিনি এখন কলকাতায়।”

ঘরের সবাই চমকে উঠলেন। পঙ্কজদা বলেই ফেললেন, ”সে কী? ওই ছেলেটা তো প্রতি বছর টিম নিয়ে এদিক—সেদিক খেলতে যায়।”

বললাম, ”হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। গত বছরও যখন টিম নিয়ে লন্ডনে গিয়েছিল, আপনার কাছেও একবার এসেছিল। ওই দলটার কোচ হয়ে লন্ডনে যাওয়ার কথাও আপনাকে বলেছিল। আপনি রাজি হননি। এ বছর এসে ওয়েগাংকর ফুচার ‘স্পোর্টস শপ’ থেকে ক্রিকেটের প্রচুর সরঞ্জামও কিনেছে।”

পঙ্কজদা ঘাড় নাড়লেন। তা দেখে আমি বললাম, ”আসলে ওয়েগাংকর আপনার সঙ্গে হৃদ্যতা বাড়াতে চেয়েছে, ওই ক্রিকেট ব্যাটটার কথা মাথায় রেখেই। বছর তিনেক আগে হংকংয়ে টিম নিয়ে গিয়ে ওয়েগাংকর পরিচিত হয় চ্যাং মিনের সঙ্গে। যে চোরাবাজারের কথা আগে বললাম, তার মালিক ওই চ্যাং মিন। গত তিন বছরে ওয়েগাংকর শচীন তেন্ডুলকরের দুটো গ্লাভস, হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদের একটা হকি স্টিক…এরকম আরও কিছু জিনিস হাতিয়ে চ্যাং মিনের কাছে বিক্রি করেছে। এবার হংকংয়ে নতুন ধরনের সেল দিচ্ছে চ্যাং মিন। ‘বিশ্ব রেকর্ডের সরঞ্জাম’ নাম দিয়ে। প্রকাশ্যে নয়, অল্প কয়েকজন ক্রেতার মধ্যে। ওয়েগাংকরের কাছে দুটো জিনিস চেয়েছিল চ্যাং মিন। এক, পঙ্কজদার এই ব্যাট। দুই, কপিলের সেই বল, যা দিয়ে ৪৩২ তম উইকেট পেয়েছে। ওয়েগাংকর কপিলের বলটা আগেই হাতিয়ে নিয়েছিল। মাসকয়েক আগে। তারপর এই পঙ্কজদার ব্যাট, যা নিয়ে ও আজই চলে যাচ্ছিল হংকংয়ে।”

পঙ্কজদা অবাক হয়ে তাকিয়ে আমার দিকে। বললেন, ”চলে যাচ্ছিল… মানে নিয়ে যেতে পারেনি?”

”না পঙ্কজদা, মাত্র আধঘণ্টার জন্য আপনার ব্যাটটা চালান করতে পারেনি। ঠিক সময়ে আমি এয়ারপোর্টে না পৌঁছলে ওই ব্যাটটা আপনি আর ফেরত পেতেন না। ব্যাটটা আমার হেফাজতে রয়েছে। নীচে আমার গাড়ির ডিকি—তে।”

পঙ্কজদা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, ”মাই গড! আমার ব্যাটটা ওয়েগাংকরের কাছে গেল কী করে?”

”সেটাই প্রশ্ন। গেল কী করে? নিশ্চয়ই সে এমন লোক, যার সঙ্গে ওয়েগাংকর আর আপনার—দু’জনেরই সম্পর্ক আছে। এই উত্তরটা পরে দিচ্ছি। আগে শুনুন, ব্যাটটা আপনার এই শো—কেস থেকে পাচার হল কী করে? মনে আছে পঙ্কজদা, কাল আপনাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই তিনতলার ঘরে, বাড়ির লোকজন ছাড়া আর কে—কে আসেন? আপনি একজনের কথা বলেননি। এই ঘরের টেলিফোন পরিষ্কার করার জন্য একটি মেয়ে প্রতি বুধবার আসে। তার নাম দুর্গা। মাসছয়েক হল, সে এই কাজটি করছে। সে—ই ব্যাটটা সরিয়ে ফেলে গত বুধবার।”

পঙ্কজদা বললেন, ”কিন্তু কীভাবে?”

সোফা ছেড়ে এবার আমি উঠে পড়লাম। তারপর শো—কেসের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, ”মেয়েটা ছোট্ট একটা ব্যাগ নিয়ে আসত। যার মধ্যে থাকত পারফিউমের শিশি। টেলিফোন পরিষ্কার করার জন্য এক ধরনের কেমিক্যাল থাকে। যেদিন ও ব্যাটটা সরায়, সেইদিন ওই ব্যাগের ভেতর বড় একটা কালো নাইলনের দড়ি নিয়ে এসেছিল। ব্যাটটা শো—কেস থেকে বের করে দড়ি দিয়ে বেঁধে, এই জানলা দিয়ে নীচে নামিয়ে দেয়। সেইসময় ঘরে কেউ ছিল না।”

দু’ পা এগিয়ে আমি জানলার কাছে গেলাম। কাঠের পাল্লা সরিয়ে নীচের দিকে একবার তাকিয়ে বললাম, ”নীচের ওই প্যাসেজের শেষে আপনাদের খিড়কির দরজা। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল দুর্গার পরিচিত একজন। সে দড়ি থেকে ব্যাটটা খুলে নিয়ে বেরিয়ে যায়। সেটা দেখার পর নিশ্চিন্ত হয়ে দুর্গা দড়িটা ওপরে তুলে নিয়ে ব্যাগে ভরে রাখে।”

ফুচা জিজ্ঞেস করল, ”পরিচিত সেই লোকটা কে?”

”বলছি। তার আগে বলি, দুর্গার ওপর সন্দেহটা হল কী করে? কোনও অপরাধই নিখুঁত হয় না। এই দুর্গা বলে মেয়েটা ব্যাট সরাবার সময় ভুল করে এক টুকরো তুলো ফেলে গিয়েছিল শো—কেসের মধ্যে। আসলে তুলোর টুকরো দিয়ে টেলিফোন পরিষ্কার করার ফাঁকে ও হঠাৎ ঘরটা ফাঁকা পেয়ে যায়। ফলে তুলোর টুকরোটা আমি পেয়ে যাই শো—কেসে। এখন প্রশ্ন হল, দুর্গার সঙ্গে ওয়েগাংকরের যোগাযোগ হল কী করে? আসলে এরা দু’জন কেউ কাউকে কোনওভাবেই চেনে না। এখনও চেনে না। দু’জনে দু’জনের কথা জানেও না। দুর্গাকে দিয়ে এই অপরাধটা করিয়েছে একজন। এর জন্য মাত্র ৫০০ টাকা দিয়েছে। আর সে নিজে ওয়েগাংকরের কাছ থেকে পেয়েছে পাঁচ হাজার টাকা।”

পঙ্কজদা অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ”কে এই ফালটুস লোকটা?” অনেকক্ষণ পর এহ প্রথম ওঁর মুখে ফালটুস কথাটা শুনলাম।

হেসে বললাম, ”একটু অপেক্ষা করুন, বলছি।” গাড়ির চাবিটা তথাগতর দিকে এগিয়ে ধরে বললাম, ”ডিকি খুলে আগে পঙ্কজদার ব্যাটটা নিয়ে আয়।”

তথাগত বেরিয়ে যেতেই বললাম, ”আগে বলি, ব্যাটটা উদ্ধার করলাম কী করে? সকালে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম। ওয়েগাংকরের টিমটা যাচ্ছিল ন’টার ফ্লাইটে। আমার আগেই ওরা পৌঁছে গিয়েছিল এয়ারপোর্টে। কাস্টমস—এ আমার এক বন্ধু আছে শ্রীধর মল্লিক। সকালবেলায় আগেই ওকে ফোন করে সব জানিয়ে রেখেছিলাম। টিমের জিনিসপত্র কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য যেতেই শ্রীধর আমাকে ভেতরে ডেকে নেয়। সব প্লেয়ারের জিনিসপত্র তন্নতন্ন করে খোঁজা শুরু করে শ্রীধর। শেষে ওয়েগাংকরের সুটকেসে আপনার ব্যাটটা পাওয়া যায়। আমি চিনতে পারতাম না। কেননা প্রত্যেক প্লেয়ারের কাছে দু—তিনটে করে ব্যাট। আপনার ব্যাটের ব্লেডে ভিনু মানকড়ের সই আছে। অস্পষ্ট হয়ে গেছে, তবুও বোঝা যাচ্ছে। তা ছাড়া ব্লেডের তুলনায় হ্যান্ডেলটা নতুন। বোধ হয় হ্যান্ডেলটা এক বা দু’বার আপনি বদলেছেন।”

পঙ্কজদা ঘড়ঘড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ”ওয়েগাংকরের কী হল?”

”শ্রীধর ওকে যেতে দিচ্ছিল না। এটা শুনে কুড়ি—বাইশটা ছেলের মুখ শুকিয়ে যায়। টিমের পক্ষে আর হংকং যাওয়া সম্ভব হত না। ওই অল্পবয়সী ছেলেগুলোর কথা ভেবেই আমি শ্রীধরকে বলি, ছেড়ে দিতে। তবে একটা কথা, ওয়েগাংকরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বটে, ওকে কিন্তু ফিরতে হবে কলকাতা এয়ারপোর্ট দিয়েই। তখন শ্রীধর ওর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। অবশ্য আপনি যদি চান, তবেই।”

এইসব কথাবার্তার মধ্যেই ব্যাট নিয়ে তথাগত ওপরে উঠে এল। পঙ্কজদা সেটা নিয়ে পরম আবেগে হাত বোলালেন। তারপর বললেন, ”জানো কালকেতু, এই ব্যাটটা আমি আমার নাতিকে উপহার দেওয়ার জন্য রেখে দিয়েছিলাম। আমার বড় নাতি… প্রদীপের বড় ছেলের জন্ম হয়েছিল সাত জানুয়ারি। যে তারিখে আমি ওই বিশ্বরেকর্ডটা করি। ওর জন্মদিনে আমার তাই রেকর্ডের দিনটার কথা মনে পড়ে। বড় নাতির বয়স এখন ১০ বছর। আমি চাই ও আমার মতো ক্রিকেটার হোক।”

ঘরের সবাই চুপ করে বসে। এরই মধ্যে টেলিফোনটা বেজে উঠল। ফুচা উঠে ধরতে যাচ্ছিল। আমি বারণ করলাম। কয়েক পা এগিয়ে ফোনটা ধরে বললাম, ”কপিলদেবকে দিন।”

ও—প্রান্তে কপিল। জিজ্ঞেস করল, ”বলটা কি পেয়েছ কালকেতু?”

”হ্যাঁ। আমার কাছেই আছে।”

”ঠিক আছে। আমার লোক কাল তোমার কাছ থেকে নিয়ে নেবে। অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমার জন্য কী করতে পারি, বলো।”

”কিচ্ছু না। পঙ্কজদার একটা কোচিং ক্যাম্প আছে। কলকাতায় এলে সেখানে গিয়ে যদি একদিন ছেলেদের টিপস দাও। খুশি হব।”

”অবশ্যই যাব। এক সপ্তাহের মধ্যেই কলকাতায় যাচ্ছি ব্যবসার কাজে। সেই সময় যোগাযোগ করব। আবার বলছি, অসংখ্য ধন্যবাদ, জাসুসি কে লিয়ে। কালকেতু নান্দি কা জবাব নেহি।”

কপিল ফোন ছেড়ে দেওয়ার পর সবার উৎসুক মুখে একবার চোখ বুলিয়ে বললাম, ”এয়ারপোর্ট থেকেই কপিলকে ফোন করেছিলাম। ও বাড়িতে ছিল না। ওর পি এ—কে এখানকার টেলিফোন নম্বরটা দিয়ে রেখেছিলাম। যাক সেসব কথা। এবার আসল প্রশ্নটার উত্তর দিই। কে সেই মাধ্যম যে দুর্গাকে দিয়ে কাজটা করিয়ে ক্রিকেট ব্যাটটা পৌঁছে দিয়েছিল ওয়েগাংকরের কাছে?”

ঘরের ভেতর আলপিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে, এমন নীরবতা। আমি পঙ্কজদার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর বললাম, ”নামটা জানাচ্ছি। তবে আমাকে কথা দিন, পুলিশে দেবেন না।”

ভ্রূ কুঁচকে পঙ্কজদা বললেন, ”কে এই ফালটুস লোকটা? তাকে চিনি?”

”ভালমতোই চেনেন। সে এখন এই ঘরেই। আপনাদের কালীকিঙ্কর।”

ভয়ানক চমকে উঠলেন পঙ্কজদা। সবার চোখ এখন কালীকিঙ্করের দিকে। একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে ওর মুখ। তথাগতর পাশে সিঁটিয়ে বসে আছে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই পঙ্কজদা এক চড় কষালেন কালীকিঙ্করের মুখে, ”তুই! তুই এটা করেছিস?” রাগে কাঁপছেন পঙ্কজদা। ওঁকে দু’ হাতে ধরে জোর করেই বসিয়ে দিলাম সোফায়। তারপর বললাম, ”কালীকিঙ্করের ওপর সন্দেহ হওয়ার কোনও কারণই ছিল না। ওকে ধরিয়ে দিল ওই এক টুকরো তুলো। ফুচা, মনে আছে, কাল বেশ রাতে তোমাকে ফোন করে এই কালীকিঙ্কর সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম, সুরেশ ওয়েগাংকরের সঙ্গে কালীকিঙ্করের কোনওভাবে পরিচয় থাকা সম্ভব কি না। তুমি বলেছিলে, দু’জন দু’জনকে চেনে। আসলে ওয়েগাংকরের সঙ্গে কালীকিঙ্করের আলাপ গত বছর থেকে। বোম্বাই থেকে গত বছর এসে ও একবার আপনার সল্ট লেকের দোকানে গিয়েছিল। তারপর থেকে প্রায়ই ও কালীকিঙ্করের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত ফোন মারফত। বেশ কিছুদিন ধরেই ওয়েগাংকর আপনার ওই ব্যাটটা চাইছিল। শেষ পর্যন্ত টাকার লোভে কালীকিঙ্কর রাজি হয়ে যায়। একটা তথ্য আপনারা কেউ এখনও জানেন না। এই যে দুর্গা বলে মেয়েটার কথা আপনাদের বললাম, সে আর কেউ নয় কালীকিঙ্করের নিজের বোন। আপনার এখানে আসার আগে আমি নিজে গিয়েছিলাম হাটখোলায় ওদের বাড়িতে। একটু চাপ দিতেই দুর্গা পুরো ঘটনাটা আমাকে বলে দিয়েছে। ব্যাট চুরিতে প্রথমে ও রাজি হয়নি। মাধ্যমিক পাশ করার পর টাকার অভাবে ও কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। কালীকিঙ্কর ওকে বলে, ভর্তির টাকা জোগাড় করে দেবে। আপনার দোকানে কাজ করার ফাঁকে—ফাঁকে কালীকিঙ্কর একটা বদভ্যাস ধরেছিল। সেটা হল সাট্টা। এতে হাজার পাঁচেক টাকা ওর ধার হয়ে যায়। সব মিলিয়ে যা পরিস্থিতি হয়েছিল, ওয়েগাংকরের ফাঁদে পা না দিয়ে ওর উপায় ছিল না।”

কালীকিঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে এবার আমি বললাম, ”পঙ্কজদা আমাকে কিন্তু আপনি কথা দিয়েছেন, ওকে কোনও শাস্তি দেবেন না।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *