একটা তবু রইল বাকি

একটা তবু রইল বাকি

‘ভূত কখনো দেখলাম না বোন!’— আপশোস করলেন মার্থা পিম, ‘বড়োদিনের সময়! জমত ভালো, একটা ভূত পেলে।’

জ্যাঠতুতো বোন ম্যাবেল আর ক্লারা থাকে এ-বাড়িতে, তাদেরই পৈতৃক বাড়ি এটা। মাঝবয়সি দু-টি নিরীহ মহিলা, সন্ধ্যার আঁধারে ভূতের প্রসঙ্গ উঠতেই জড়সড় একেবারে। ম্যাবেল বলল, ‘যা এতকাল দেখনি, এখনও না-হয় নাই দেখলে তা। বড়োদিন যা জমবার, ঠিকই জমবে দিদি, ভূতের অভাবে আটকে যাবে না দেখো।’

ক্লারা কাঁচুমাচু হয়ে অনুরোগ করল, ‘তোমাদের কি আর কথা নেই? ভর সন্ধ্যে বেলা কী ভূত-ভূত করছ বলো তো!’

মার্থা এ বাড়ির অতিথি। লন্ডনে থাকেন, ফি-বছরই বড়োদিনটা এখানে কাটান। পাকাপোক্ত নেমন্তন্ন হয়ে আছে তাঁর, চিরদিনের জন্য। আসেন মার্থা, ভালোই লাগে বছরের শেষে এই ঠাঁইবদলটা। লন্ডনে তাঁর দোকান আছে, চীনেমাটির বাসনের দোকান। বেশ অভিজাত পর্যায়েরই দোকান, এমন এমন উঁচুদরের সব বাসন মার্থা পিম-এর সংগ্রহের ভিতর আছে, যা বাজারে কুত্রাপি পাওয়া যাবে না আর।

আসেন তিনি, বছরের শেষ হপ্তাটা ফি বছরটি কাটিয়ে যান এসেক্স কাউন্টির এই দিগন্তছোঁয়া প্রান্তরের মাঝখানে, কয়েকটা দিন ভালোই কেটে যায় নিরিবিলিতে লুকোনো চমৎকার এই পল্লিভবনটিতে। আছে, উইনটনদের এই বাড়ি ছাড়া আরও বাড়ি আছে বই কী এ-তল্লাটে, তবে এক মাইলের ভিতরে কেউ নেই। আর, যারা আছে, সবাই তারা থাকে পুব দিকটাতে, পশ্চিমে এন্তার মাঠ আর জলা, জলা আর মাঠ, মাইল দশেক দূরে একটামাত্র বাড়ি ‘হার্টলি হাউস’, তারপর মাইল দশেক ওইরকমই মাঠ-জলা পেরুলে একেবারে সমুদ্র।

‘উঠেই যখন পড়েছে ভূতের কথা’— বলল ম্যাবেল, ‘হার্টলি হাউসে বুড়ি লেফেইন কীভাবে দিন কাটাচ্ছে, কে জানে! অনেক দিনই খোঁজখবর পাইনি তার। আছে কী নেই, তাও জানি নে। বাড়িটি আবার নাকি হানাবাড়ি—’

‘হানাবাড়ি না-হাতি!’— বললেন মার্থা, ‘আমি তো সে-বাড়িতে গিয়েছিলাম একবার, মনে নেই? হানাবাড়ির কোনো চিহ্ন তো দেখিনি বাপু!’

‘তুমি গিয়েছিলে?’— সংশয়ের সুরে প্রশ্ন আসে ক্লারার দিক থেকে।

সংশয়ের নিরসন করে দেয় ম্যাবেল, ‘তোর কিছুই মনে থাকে না দেখছি। অবশ্য হয়েছে অনেক দিন। তা বছর কুড়ি— না, আরও বেশি। পঁচিশ বছর, না, তারও চেয়ে বেশি হবে, ত্রিশ বছরেরই কাছাকাছি হবে বলে মনে হয়, সেই যে স্যার জেমস সিওয়েল মারা গেলেন যে বার—’

কথাটা ম্যাবেলের মুখ থেকে শুনে নিলেন মার্থা, ‘ঠিক বলেছ বোন, আমারও অত সব খুঁটিনাটি মনে ছিল না, কেবল ওই একটা কথাই পাক খাচ্ছিল মাথায়, আমার দোকানের ক্রাউন ডার্বি চীনেগুলো ওখান থেকেই নিলামে কেনা। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, আমি সেবার যখন এ বাড়িতে বেড়াতে এসেছি, তখনই নিলামটা হল হার্টলি-হাউসে। সবে স্যার জেমস মারা গিয়েছেন তখন, মিস লেফেইন কোথা থেকে কে জানে এসে দখল নিয়েছেন বাড়ির, শুনেছিলাম ভাগনি না কি হন—’

‘সেই থেকে মিস লেফেইন রয়েই গিয়েছেন ওই তেপান্তর মাঠের বাড়িটাতে নিছক একা। কী করে আছেন কে জানে!’ বলছে ম্যাবেল— ‘আমাদের এই বাড়ি ধর, এর তো তবু এক মাইলের মধ্যে দেদার পড়শি আছে, নিত্যি নৈমিত্তিক গয়লা আসছে, মাংসওয়ালা, রুটিওয়ালা, কয়লাওয়ালা— রোজকার রোজ জোগান দিচ্ছে সব মাল। তা ছাড়া আমরা নিজেরাও আছি দুই বোন। তবু ধর আমরা হাঁপিয়ে উঠি এক এক সময়। আর ওই হার্টলিতে, মিস লেফেইন, এখান থেকেও দশ মাইল দূরে, জনপ্রাণী নেই যেখানে, কী করে যে— বিশেষ বাড়িটারও রয়েছে ভূতুড়ে অপবাদ, স্যার জেমস সিওয়েল নাকি মরেও বাড়ির মায়া ছাড়তে পারেননি।’

মার্থা হেসে ফেললেন, ‘বাড়ির মায়া, না বাসনগুলির মায়া? আমার কাছে পয়সা সেদিন বেশি ছিল না, এক সেট ক্রাউন ডার্বির বেশি আর কিছু কিনতে পারিনি। তখনও বিস্তর জিনিস রয়ে গিয়েছিল, কিনতে পারিনি বলে আপশোস যা হয়েছিল আমার! সেগুলি হয়তো এখনও হয়নি বিক্রি, পড়েই আছে সেই অসাধারণ সংগ্রহ ওই জলশূন্য জলার ভিতর। তাই বলছিলাম, বাসনগুলোর মায়া কাটানো স্যার জেমসের পক্ষে সহজ যদি না-হয়ে থাকে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।’

ম্যাবেল বলল, ‘তুমিও তো ক্রাউন ডার্বির পুরো সেটটা কিনতে পারনি। সব কথাই মনে পড়ছে এখন। ফিরে এসে তুমি যেন বলছিলে, ‘একখানা প্লেট কোথায় যে হারিয়ে গেছে, কিছুতেই খুঁজে পেলেন না মিস লেফেইন। এগারোখানাই নিয়ে আসতে হল।’

‘হ্যাঁ, আমার সেটটাতে খুঁত হয়ে রয়েছে। আর জানো, ওই খুঁতের জন্যই সেটটা এতদিনেও বিক্রি হয়নি। অনেক পয়সা আটকে আছে সেই থেকে।’

ম্যাবেল হাসতে হাসতে বলল, ‘তাহলে তুমি এক কাজ করো মার্থা! চলে যাও একদিন হার্টলি হাউসে, গাড়িখানা নিয়ে। বহুদিন তো হয়ে গেল, এর মধ্যে মিস লেফেইন হয়তো হারানো ক্রাউন ডার্বিখানা খুঁজে পেয়ে থাকতেও পারেন। একখানা প্লেট রেখে তাঁর লাভ নেই, পেয়ে থাকলে অবশ্যই তোমায় বেচে দেবেন। আর চাই কী, ভূতের অভাবে বড়োদিনটাই জোলো লাগছে তোমরা কাছে, হার্টলিতে গেলে স্যার জেমসের দেখাও পেয়ে যেতে পারো।’

ক্লারার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, ‘দোহাই তোমাদের, থামো এখন। ওই জোলো বড়োদিন নিয়েই বুড়ো হয়ে গেলাম, ঝাঁঝালো বড়োদিন আর বরদাস্ত হবে না এ বয়সে।’

সে-সন্ধ্যায় কথাটা সেইখানেই থেমে গেল, তা ঠিক, উইন্টন বোনেরা সে-কথা মনেও রাখেনি তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু মার্থা পিম কিছুতেই ভুলতে পারছেন না ওটা। সত্যিই তো! মাঝে ত্রিশটা বছর কেটেছে। ইতিমধ্যে মিস লেফেইন অবশ্যই হয়তো পেয়ে থাকতে পারেন হারানো ক্রাউন ডার্বিখানা। অর্থাৎ পাওয়া যদি গিয়ে থাকে, আর মিস লেফেইন যদি বেচতেই রাজি হন, তাহলে কী মজাই যে হয়!

বারোখানা ক্রাউন ডার্বির একটা পুরো সেট চীনেমাটির প্লেট— এটা অনেক রাজাগজার ঘরেও নেই। বিক্রি যদি হয়ে যায়, কল্পনাতীত দামে বিক্রি হতে পারে। একদিনে তাহলে অবস্থা ফিরে যায় মার্থার। আর না-ও যদি হয় বিক্রি, পাশাপাশি বারোখানা প্লেট সাজিয়ে রেখে ঘণ্টার পরে ঘণ্টা তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতেই পারেন যদি মার্থা, সেটাও কম সৌভাগ্য নয়।

আর ভূত! হেসে ফেললেন মার্থা। যদি স্যার জেমসই ভূত হয়ে থাকেন, যদি বাদবাকি চায়নাগুলোর মায়া কাটাতে না পেরে থাকেন বুড়ো নাইট, মার্থা পিম তাঁর সঙ্গে দরদস্তুর করতে ভয় পাবেন না। ব্যাবসা করতে বসে এ জীবনে এমন অনেক মানুষের সংস্রবে তিনি এসেছেন, চরিত্রের দিক দিয়ে ভূতের চেয়ে যারা কম ভয়াবহ নয়।

একটু একটু করে সংকল্পটা দানা বাঁধতে লাগল মার্থার মনে। যাবেন তিনি, এই বারই হার্টলি হাউসে যাবেন একদিন। বরাতটা পরখ করেই আসবেন। পাওয়া যাবে কী যাবে না হারানো প্লেটখানা, নিশ্চিন্দি হয়ে আসবেন সেদিক দিয়ে। যাবেন, প্রথম সুযোগেই যাবেন।

কিন্তু বড়োদিনের ভিতরে সে সুযোগ হল না কোনোমতেই। উৎসবের ঢেউ এই জনমনিষ্যিহীন ধূ-ধূ প্রান্তরকেও প্লাবিত করতে ছাড়ে না বড়োদিনের সময়। দূরে দূরে থাকলেও, আছে দুই-চার ঘর প্রতিবেশী। কোনোদিন তারা আসছে উইন্টন হাউসে, কোনোদিন তাদের বাড়িতে যেতে হচ্ছে দুই মিস উইন্টনকে। আর যেহেতু মিস পিম হচ্ছেন ম্যাবেল-ক্লারার সম্মানিত অতিথি, তাঁর নেমন্তন্ন হচ্ছে বিশেষভাবে, অতিরিক্ত সমাদরের সঙ্গে। ছুটি আর মার্থার জোটে না।

বড়োদিনের হপ্তাটাই কেটে গেল এইভাবে। আর দুটো দিন মেয়াদ মার্থার অবস্থিতির। এরই মধ্যে মতলব যদি হাসিল হয় তো হল, নইলে এবারকার মতো রইল মুলতুবি।

যাহোক, প্রায় শেষ মুহূর্তে হয়ে গেল সুযোগ। সেদিন লাঞ্চের পরেই ম্যাবেল বলল, রাতে ঘুম হয়নি, আজ একটু দিবানিদ্রার সাধনা করবে সে। আর ক্লারা একখানা নতুন উপন্যাস দিয়েছে কেলভিনদের মেরায়ন, সে আবার লন্ডন ফিরে যাচ্ছে কালই, পড়ে শেষ করে আজ সন্ধ্যার মধ্যেই ফেরত দিতে হবে বই। না-পড়ে ফেরত দেওয়া? উঁহু, একেবারেই সম্ভব নয়! উপন্যাসখানা গরম কেকের মতোই চটকদার।

ওরা নিজের নিজের ঘরে উঠে গেল, মনে মনে জানে, মার্থা দিদিও চলে যাবে নিজের আস্তানায়। তার আবার সময় কাটাবার ভাবনা? চীনেমাটির বাসন নিয়ে যে দেশে যে ক্যাটালগখানা ছাপা হয়, তার একখণ্ড এসে পৌঁছোবেই মার্থা পিম-এর টেবিলে। গাদাপ্রমাণ সচিত্র মূল্যতালিকা সে সঙ্গেই এনেছে। এ-কয়দিন বেশি ফুরসুত মেলেনি তাদের ওলটাবার। আজ আশা মিটিয়ে ওলটাক।

কিন্তু মার্থা পিম সেদিক দিয়েও গেলেন না। উপরে উঠলেন সশব্দে, নামলেন নিঃশব্দে। গিয়েছিলেন শুধু একটা গরম জামা আর গলাবন্ধ আনতে। কারণ শেষ ডিসেম্বরে, এই বিশ মাইল পরিমাণ বাধাবন্ধহীন উদোম মাঠ আর জলাতে ঝোড়ো হাওয়া কী পরিমাণ কষ্ট দিতে পারে মানুষকে, তা কল্পনা করবার মতো শক্তি মার্থার আছে।

নিঃশব্দে আস্তাবলে গিয়ে ঘোড়াটাকে বার করলেন, হাটুরে গাড়িখানাও টেনে নিয়ে গেলেন রাস্তায়। এ-গাড়িতে গদি পাতলেই মানুষের গাড়ি, গদি বাদ দিলেই মালের গাড়ি। জোনাস মালি এই গাড়িতে বোঝাই দিয়েই বাঁধাকপি নিয়ে যায় মার্শ-টাউনের হাটে, প্রতি মঙ্গলবার আর শনিবার।

গদি চাপাতে অবশ্যই ভোলেননি মার্থা। ঘোড়াকে গাড়িতে জুতে ধীরে ধীরেই তা চালাতে লাগলেন কিছুক্ষণ। বাড়ির হাতা থেকে যতক্ষণ না বেরুচ্ছেন, ম্যাবেল-ক্লারা না-ই বা জানল, তাঁর অভিযানের কথা। জানলে বাধা দেবে নিয্যস। সেদিন গালগল্পের ভিতর ঠাট্টার ছলে যা-খুশি বলুক। সত্যি সত্যি ডিসেম্বরের এই মেঘলা অপরাহ্নে মার্থাকে জলার দিকে যাত্রা করতে দেখলে ওরা দুই বোন যে মাথা-ভাঙাভাঙি করবে একেবারে, তাতে সন্দেহমাত্র নেই মার্থার।

অবশেষে গাড়ি বেরুল রাস্তায়। আস্তে করে ঘোড়ার গায়ে এক ঘা লাঠি ছুঁইয়ে দিতেই জন্তুটা হেলে-দুলে যথাসাধ্য বেগে ছুটে চলল।

নানা কথার ছলে পথের নিশানা ঠিকই জেনে নিয়েছিলেন ম্যাবেলের কাছ থেকে, তবু পথ হারাতে বেশিক্ষণ লাগল না মার্থার। যেদিকে চোখ ফেরান, দৃশ্য হুবহু একরকম। শীতের ঘোলাটে আকাশ, পুরোনো টিনের মতোই ছাই রং তার, তারই মতো শক্ত নিরেট মনে হয় মাঠের মাটিতে দাঁড়িয়ে। দিগন্ত পর্যন্ত অঙ্গ এলিয়ে মুষড়ে পড়ে আছে ঊষর প্রান্তর, জাফরান-রঙা জলার ভিতরে জলপাই বাদামি মাথাভাঙা নলখাগড়াগুলোকে দেখাচ্ছে সদ্য শুকনো ক্ষতচিহ্নের মতো। জলের উপরে হালকা বরফের সর পড়েছে একটা, হাওয়াটা কনকনে নয় বটে, কিন্তু ডিসেম্বরের শীতকে যেন তা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছে হাড়ের ভিতরে।

ভিজে, স্যাঁৎসেঁতে মাটি, ন্যাড়া ন্যাড়া গাছগুলোর মাথায় মাথায় কুয়াশার টুপি। খালে খালে পচা জল, পাড়ে পাড়ে উলঙ্গ ঢিবি। জলের উপরে মাছরাঙা, ঘাসের উপরে কাক, দূর শূন্যে দুই-একটা শঙ্খচিল উড়ছে।

ছোটো টাট্টুটাকে থামিয়ে এই ভূতুড়ে পরিবেশের দিকে খানিকটা তাকিয়ে রইলেন মার্থা। একটু বাদেই তিনি বোনের বাড়ির বৈঠকখানায় আগুনের ধারে পা মেলে দিয়ে খোশ গল্প করতে পারবেন, এটা চিন্তা করতেই বেশ ভালো লাগছিল ওই দিকে তাকিয়ে।

ঘণ্টাখানিক গাড়ি হাঁকাবার পরে এই এতক্ষণে একটা মানুষের মুখ দেখতে পেলেন মার্থা। উলটো দিক থেকে আসছে এক বুড়ো, নলখাগড়াগুলোর মতোই তারও মুখের রং বাদামি। তাকে পথ জিজ্ঞাসা করতেই সে অবাক হয়ে খানিকটা সময় তাকিয়ে রইল মার্থার দিকে, তারপরে বলল, ‘কী? হার্টলি? হার্টলি? তা সোজা চলে গেলেই হার্টলি। সোজা চলে গেলেই—’

চলে যাচ্ছে বুড়ো, আর পিছন ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে বারে বারে। মার্থা মনে মনে হেসে সমুখপানে গাড়ি চালিয়ে দিলেন। হাসিটা কেন? বুড়োটাকে অবাক করে দিতে পেরেছেন বলে। এই আবহাওয়ায় কেউ সজ্ঞানে হার্টলির হানাবাড়িতে যেতে পারে— এটা দেখে ওর মতো মানুষ অবাক হবে বই কী!

জলার ধার দিয়ে দিয়ে পথের রেখা পড়ে আছে এঁকেবেঁকে, মাইলের পরে মাইল একই একঘেয়ে দৃশ্য, জলের বুকে বাদামি নলখাগড়া, ঢিবির উপরে ন্যাড়া গাছ। ‘এমন জায়গায় বাস করতে হলে মানুষকে ঝোপেঝাড়ে ভূত দেখতেই হয়।’— ভাবলেন মার্থা।

হঠাৎই হার্টলি হাউস চোখের সামনে ভেসে উঠল। একটা গোল মতো ঢিবি, তাকে ঘিরে রেখেছে মরা, শুকনো গাছের সারি। সেই ঢিবি বেষ্টন করে প্রাচীন একটা ইটের দেয়াল। জোলো আবহাওয়ার দরুন সে দেয়াল শ্যাওলা আর আগাছায় আচ্ছন্ন একেবারে।

হার্টলি ছাড়া এ-তল্লাটে বড়ো বাড়ি আর নেই, এটা শোনা আছে। সুতরাং, এইটিই যে সেই হার্টলি, তা স্বভাবতই অনুমান করে নিলেন মার্থা। তা ছাড়া, ত্রিশ বছর আগে হলেও, আগে একবার এখানে এসেও ছিলেন যখন, স্বভাবতই একটু একটু করে এখন মনে পড়ছে স্থানটা। মনে পড়ছে, কিন্তু মনে যেরকমটা পড়ছে, চোখ চেয়ে সেরকমটা দেখছেন না। জলার ভিতর থেকে খাড়া-উঠে-যাওয়া ওই টিলাটা ঠিকই আছে, কিন্তু ওই লম্বা গাছগুলো তখন জ্যান্ত ছিল, এখন নেই। মাঠ ছিল তখন সবুজ, জলার নোংরা জল তখন মাঠে ঢেউ খেলত না, এমন স্যাঁৎসেঁতে ছিল না মাটি।

‘মিস লেফেইন আলবাত পাগল।’ ভাবলেন মার্থা, ‘পাগল না-হলে কেউ এমন জায়গায় বাস করতে পারে না।’

বাগানের দরজায় ঘোড়ার লাগাম লটকে দিলেন মার্থা। গেটটাকে বন্ধ রাখার কথা মনে হয়নি কারও। বন্ধ করবেই বা কী জন্য? বাগান তো অরণ্য বললেই হয়, তার ভিতরে ঢুকবার লোভ মানুষ বা ছাগল-গোরু কারও হবার কথা নয়।

কিন্তু অবাক কাণ্ড! বাগানটা যতই অনাদরে থাকুক, বাড়িটার উপরে যত্ন নেবার লোক আছে। দেখা যাচ্ছে, দেখতে ছিমছাম, জানলায় পর্দা, দরজার কড়াতে নতুন পালিশ। পালিশ যে একান্তই হালের, তাতে সন্দেহ থাকতে পারে না, কারণ সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় দু-দিনেই এখানে সব ধাতুর রং চটে মরচে ধরে যায়, এটার এখনও যায়নি।

আড়ে-দিঘে সমান, মজবুত বাড়িটা। এমন অদ্ভুত জায়গায় তৈরি না-হলে এর দাম হত বিলক্ষণ। জায়গা অদ্ভুত, তা ছাড়া ওই দিকের ওই ঝাড়ালো সাইপ্রেস গাছটা বাগানকে তো আঁধার করেইছে, বাড়ির দুটো ধারেই সৃষ্টি করেছে খানিকটা আলো-আঁধারি। মিস লেফেইনের উচিত গাছটা কেটে ফেলা।

বাগানে ফুল গাছের কেয়ারি তো কয়েক যুগের ভিতরই হয়নি, একটা কপি শালগ্রাম তৈরি করে যে উদরে দেবেন, সেটুকু উৎসাহ পর্যন্ত লেফেইন-মহিলার নেই। আগাছা! আগাছা! দুনিয়ায় যতরকম আগাছা আছে, এখানে তাদের প্রতিনিধি পাঠাতে ভুল হয়নি কারও। কোনোটা সগৌরবে মাথা তুলেছে দেয়াল ছাপিয়ে, কেউ লতিয়ে গিয়ে সৃষ্টি করেছে জটিল ঝোপ। গোটাকতক ফলের গাছ, মান্ধাতার আমলে সেগুলি পুঁতেছিলেন সম্ভবত স্যার জেমস সিওয়েল নিজেই, তারা এখন হরেকরকম লতার বেষ্টনে দম বন্ধ হয়ে মরতে বসেছে।

দরজার কড়া জোরে জোরে নাড়তে নাড়তে মার্থা এই সবই লক্ষ করছেন ক্রমাগত। লক্ষ করছেন আর তাঁর দুঃখ হচ্ছে সেই ভাগ্যহীনা মহিলার জন্য, যাঁকে জীবন কাটাতে হচ্ছে এই লক্ষ্মীছাড়া জায়গায়।

বাগানের এদিকে-ওদিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করতে করতে একটা জিনিস বিশেষ করেই চোখে পড়ল মার্থার। সে একটা সমাধিস্তম্ভ। গাছগাছালির আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে সে যেন মার্থাকে বলতে চাইছে, ‘আমি আছি এখানে, বাড়ির মালিক আমি এখানেই আছি।’ কথাটা ভুলেই যাওয়া গিয়েছিল, এই স্তম্ভ দেখে ম্যাবেলের উক্তি মনে পড়ে গেল মার্থার, ‘বর্ষার দিনে মারা গেলেন স্যার জেমস, চারিধার জলে জলাকার। বহুদূরের গির্জা থেকে শববহনের গাড়ি আনাই সম্ভব হল না হার্টলিতে। অগত্যা তাঁরই বাগানের কোণে কবর দিতে হল ভদ্রলোককে।’

কড়া যতই নাড়ুন, সাড়া কেউ দেয় না ভিতর থেকে। ব্যাপার কী, বুঝবার জন্য দরজা ছেড়ে পিছিয়ে এসে দাঁড়ালেন। ঘাড় উঁচু করে উপরপানে তাকালেন বাড়িটা লক্ষ করবার জন্য। মানুষ তো নিশচয় আছে! এমন পরিচ্ছন্ন চেহারা বাড়ির। এমন সযত্নে পর্দা ঝোলানো!

এইবার কিন্তু উপর থেকে মাটির দিকে চোখ নামাতেই মার্থা দেখতে পেলেন, দরজা ইতিমধ্যে ঈষৎ খুলে তার ভিতর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একটি মানুষ, বেশ মনোযোগ দিয়েই লক্ষ করছে মার্থাকে। এইবার বেশ উৎফুল্লভাবে এগিয়ে গেলেন মার্থা, ‘ভাবলাম একবার মিস লেফেইনের সঙ্গে দেখা করে আসি। উইন্টন হাউস থেকে আসছি। আপনিই তো মিস লেফেইন?’

‘আমারই বাড়ি’— অবান্তর উত্তরটাতে একটু যেন কলহের সুর।

এ বাড়িতে চাকর আছে, এমনটা ধারণা অবশ্য মার্থা করেননি, কিন্তু বাড়িটাকে এত সাফ করতে হলে যে-পরিমাণ মেহনত দরকার, তা কি এই মহিলাটিই করেন? করতে পারেন?

‘নিশ্চয়! নিশ্চয়! আপনারই বাড়ি বই কী!’ তাড়াতাড়ি জবাব দিলেন মার্থা, ‘ভিতরে আসতে পারি কি আমি? উইন্টনদের বাড়িতে আছি আমি। মার্থা পিম, অনেক দিন আগে একবার এসেছিলাম এ বাড়িতে।’

খুব ক্ষীণকণ্ঠে জবাব এল, ‘আসুন ভিতরে, আসুন। মানুষ এখানে কদাচিৎ আসে। এমন একা মনে হয়—’

ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে মার্থা ভাবছেন, একা মনে না-হলেই সেটা আশ্চর্য হত।

প্রবেশপথ কেমন অন্ধকার যেন। তবু মিস লেফেইনের চেহারা মোটামুটি দেখতে পাচ্ছেন বই কী মার্থা! প্রথমেই তাঁর মনে হল ওই বেচারি মহিলা অসম্ভব রকমের বুড়ো। এমন শুকনো, দুর্বল, বিবর্ণ মানুষ বেঁচে থাকে কী করে? মার্থার নিজের বয়স কম হল না, তবু ওই লেফেইন-মহিলার তুলনায় নিজেকে যেন আনকোরা তরুণ বলে মনে হচ্ছে তাঁর।

শুকনো, দুর্বল— সন্দেহ নেই, কিন্তু কী দারুণ মোটা মহিলাটি! অস্বাভাবিক মোটা। পোশাকটা পরেছেন, তাও কী ঢলঢলে বেঢপ! আর কোন রঙের কাপড় যে সেটা, তাও তো ছাই বোঝা যাচ্ছে না! বোঝা যাচ্ছে শুধু এইটুকু যে, সে পোশাকে এখানে-ওখানে লেগে আছে মাটি, আর জায়গায় জায়গায় দেখা যাচ্ছে জলের ছোপ। এই ঠান্ডার দিনে ভদ্রমহিলা কি বাগানে কাজ করছিলেন নাকি? আর কাজ? এই বাগানে করবার মতো কাজ কী আছে?

মহিলার চেহারাটা আরও বিদঘুটে হয়েছে তার চুলের দরুন, একেবারে চামড়া ঘেঁষে ছাঁটা সে চুল। এখানে চুল কাটবার লোকই বা উনি পেলেন কোথায়?

মহিলা বলছেন কাঁপা-কাঁপা ক্ষীণ কণ্ঠে, ‘এত কষ্ট করে এখানে আসা ভারি দয়া আপনার। ভারি দয়া। কোথায় বসবেন? বৈঠকখানাতেই বোধ হয়? আমি নিজে তো বাগানেই বসি!’

‘বাগান? এই আবহাওয়ায় বাগান?’— অবাক হয়ে যান মার্থা।

‘আবহাওয়া, ওটা সয়ে যায়।’— উত্তর এল তেমনি ক্ষীণকণ্ঠে, ‘কতখানি যে সয়ে যায়, আগে থাকতে ধারণা করতে পারবে না কেউ—’

সন্দিগ্ধসুরে জবাব দিলেন মার্থা, ‘যায় নাকি? তা হবে! কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই একা থাকেন না এ বাড়িতে?’

‘ইদানীং নিছক একাই। সঙ্গী না-ছিল একেবারে, তা নয়। কিন্তু কোথায় যে চলে গেল, ঠাহর পেলাম না।’ বিরক্তভাবে বললেন মহিলা, ‘তার আর টিকিটিও দেখতে পাই না।’

মার্থা আস্তে আস্তে মাথা নাড়ছেন। কোনো সঙ্গী যে এই পরিবেশে বেশি দিন টিকতে পারে না, এটা বোঝা সোজা। কিন্তু তা হলেও, এই বুড়ির দেখাশোনার জন্য একজন কেউ না থাকলেও তো চলে না।

বৈঠকখানায় ঢুকলেন দু-জনে। বেশ পরিচ্ছন্ন, কিন্তু কী মুশকিল, এত শীতেও আগুনের কোনো বন্দোবস্তই নেই এখানে।

কিন্তু মরুক গে আগুন। দেয়ালের গায়ে গায়ে তাকে তাকে কী চমৎকার সব চীনেমাটির বাসন, কী যত্নে সাজানো! মার্থা পিম চীনেমাটির জহুরি নজরে আসতেই বুঝলেন, ক্রাউন ডার্বির সঙ্গে তুলনা না-চললেও এর কোনো বাসনখানাই তুচ্ছ করবার নয়, লন্ডনের দোকানে নিয়ে তুলতে পারলে এদের দাম অনেক।

বুড়ি কি মনের কথা বুঝতে পেরেছে মার্থার? তা নইলে ফোকলা মুখে হাসতে হাসতে বলবে কেন, ‘চোখে পড়েছে তো? আমার কত যত্নের জিনিস যে ওগুলি! পেলে ভারি খুশি হও, না?’

মার্থা মনে মনে স্বীকার করলেন যে, খুশি তিনি নিশ্চয়ই হন। একবার দেয়ালের গায়ে, একবার টেবিলের উপর, একবার-বা ডালা-খোলা সিন্দুকের মধ্যে, থাকে থাকে সাজানো বাসনগুলির কাছে ঘুরতে থাকলেন মার্থা, আগুনের চারপাশে পতঙ্গের মতো। বুড়িও সঙ্গে সঙ্গে আছে, আর মার্থার আগ্রহ দেখে খক খক করে হেসে উঠছে থেকে থেকে।

‘এর ভিতরে একখানা ক্রাউন ডার্বি প্লেট কোথাও লুকোনো নেই তো?’— বলছেন মার্থা, ‘জানেন, অনেক দিন আগে এখানে একাট নিলাম হয়েছিল।’

‘তা হয়েছিল।’— বুড়ির কথায় অপরিসীম বিরক্তি মাখানো, ‘সেই নিলামে আমার এগারোখানা ক্রাউন ডার্বি বিক্রি হয়ে গেল, কোনোরকমে একখানা আমি লুকোতে পেরেছিলাম।’

‘আপনি? লুকোতে গেলেন কেন?’

‘আমার জিনিস, আমার সামনে ওরা বেচে দিচ্ছে, আমি লুকোব না?’— ত্রু«দ্ধ কণ্ঠে জবাব দিল বুড়ি, ‘সেই মেয়েমানুষটার ডম্ফাই যদি দেখতে! বলে কিনা, সব বাসন তার! আমার মুখের উপরই বলে একরকম। তাইতেই তো তাকে তাড়ালাম আমি—’

‘ওরা বেচে দিচ্ছে মানে?’ মার্থার সব যেন তালগোল পাকিয়ে যেতে চায়, ‘ওরা কারা? আপনি ছাড়া আপনার জিনিস কে বেচবে আর? আমি তো নিজেই আপনার কাছ থেকে—’

হঠাৎ কেমন ধোঁকা লাগে মার্থার। ত্রিশ বছর আগের কথা। তখন মিস লেফেইনকে কীরকম দেখেছিলেন তিনি, তা কিছুমাত্র মনে নেই এখন। এমন মোটা নিশ্চয়ই দেখেননি। তবে মাঝবয়স পেরুলে অনেক মহিলা অস্বাভাবিকরকম মুটিয়ে যান, এটা অবশ্য সত্য। ইনিও হয়তো সেইরকমই গিয়েছেন।

বৃদ্ধা নিজের মনে বলে যাচ্ছে, ‘কোনো কিছুই লুকোতে পারিনি, কেবল ওই ডার্বি একখানা ছাড়া। গেল, গালে চড় মেরে নিয়ে গেল এগারোখানা ডার্বি।’

মার্থা ভাবেন, বদ্ধ পাগল বুড়িটা। হবে না? একা একা এই তেপান্তর মাঠে—

উঃ, একটু আগুনও যদি থাকত এ ঘরে! মার্থার হঠাৎ চোখে পড়ল, বুড়ির পায়ে জুতো পর্যন্ত নেই, স্রেফ একজোড়া সাদা মোজা পায়ে দিয়ে এই প্রচণ্ড শীতে অক্লেশে বসে আছে। যা বলেছে বুড়ি, ঠিক কথাই। অভ্যাসে ঠান্ডা সহ্য হয়ে যায়। কিন্তু মার্থার সে-অভ্যাস নেই। কষ্ট হচ্ছে, আগুনের অভাবে, একটু গরম চায়ের অভাবে অসহ্য কষ্ট হচ্ছে মার্থার। ডার্বিখানা নিয়ে বা না-নিয়ে এখান থেকে বেরুতে পারলে হয়—

‘একখানা ক্রাউন ডার্বি লুকিয়ে রেখেছিলেন, বললেন’,— মার্থা নিজের মনের কথা প্রকাশ করেই দিলেন, ‘ওখানা আমায় দিয়ে দিন না। আমার সেটটা পুরো হয়, আমি ভালো দাম দেব।—’

‘দাম নিয়ে আমি কী করব?’— বলে বুড়ি, ‘পয়সার কোনো দরকার তো হয় না আমার!’

‘কেন, খাওয়া-দাওয়ারও তো একটা খরচ আছে, কিন্তু ডার্বিখানা কি দেবেন?’

‘চলো, দিই। অনেক দিন কাউকে কাছে পাইনি। তুমি কষ্ট করে কতদূর থেকে বললে, চলো দিই।’— বলে বুড়ি সেই ঢাউস-মোটা শরীর নিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে এল। পিছনে আছেন মার্থা। একটা পচা গন্ধ নাকে আসছে। যত উপরে উঠছেন, তত বেশি গন্ধ। ‘হবে না? কতদিনের বন্ধ দরজা—’ ভাবেন মার্থা।

অনেক ঘর উপরে, কিন্তু কোনোটা দেখেই এমন মনে হয় না যে, মানুষ এখানে বাস করে। বিছানা আয়না আলমারি ছবি সোফা টেবিল— সবেতেই ঢাকনা চাপা দেওয়া। ‘আপনি থাকেন কোন ঘরে?’— জিজ্ঞাসা করে ফেললেন মার্থা এক সময়।

‘বাগানেই থাকি বেশিরভাগ।’— উত্তর এল বুড়ির কাছ থেকে।

শেষঘরের একটা দেরাজ থেকে বুড়ি টেনে বার করল একখানা ক্রাউন ডার্বি। পেয়েই ধন্যবাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এলেন মার্থা সিঁড়ি বেয়ে, ‘কিছু মনে যদি না-করেন, অনেক দূর যেতে হবে, সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আর এই একটা বিশ্রি গন্ধ—’

‘উঃ, কী এত তাড়াতাড়ি বাপু, বুঝি না’— সিঁড়ির মাথা থেকেই বলল বুড়ি, ‘গন্ধ? সেই মেয়েটাও গন্ধের কথা বলত প্রায়ই।’

‘ধন্যবাদ, আবার সুযোগ পেলে আসব।’— বলে মার্থা এসে গাড়িতে উঠলেন।

বুড়ির কথায় তন্ময় হয়ে ভাবছেন মার্থা, গাড়ি যে ভুল পথে চলে এসেছে, তা লক্ষ করেননি। হঠাৎ সেটা খেয়াল হল, অদূরে একখানা কুঁড়ে ঘর দেখে। এখানে অন্য মানুষও আছে তাহলে। ভালো, বুড়িটাকে যত পরিত্যক্ত, একা মনে করা গিয়েছিল, তা তাহলে নয় সে। ভালো।

গাড়ির শব্দ পেয়ে একটি যুবতী বেরিয়ে এল কুঁড়ে থেকে, ‘হার্টলির চাবি চান? এনে দিচ্ছি।’

‘চাবি? না তো, চাবি কেন?’

‘বাড়িটা বিক্রি হবে কিনা! কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। মিস লেফেইন বিজ্ঞাপন পাঠিয়েছেন ফ্রান্স থেকে।’

‘ফ্রান্স থেকে? আমি যে এইমাত্র হার্টলি থেকে আসছি, এতক্ষণ কথা কয়ে এলাম মিস লেফেইনের সঙ্গে!’

‘মিস লেফেইনের সঙ্গে? অসম্ভব, আজ সকালেও আমি দেখে এসেছি, বাড়ি খালি! আমি রোজই একবার যাই কিনা। গিয়ে বাড়িটা ঝাঁট-পাট দিয়ে আসি। একা কিন্তু যাই না কখনো! ভয় করে। মিস লেফেইনও ভয় পেয়েই পালিয়েছেন। ইদানীং স্যার জেমস বড়ো বেশি উৎপাত করছিলেন কিনা!’

‘স্যার জেমস উৎপাত করছিলেন?’ একটা আলো যেন ঝলক দিয়ে উঠল মার্থার সমুখে। ভূত আছে হার্টলিতে, বলেছিল ম্যাবেল-ক্লারা। ক্ষীণকণ্ঠে মার্থা যুবতীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খুব বড়ো, খুব মোটা, পায়ে শুধু সাদা মোজা, গায়ে পচা গন্ধ— কেউ আছে নাকি ও-বাড়িতে?’

যুবতীর চোখ যেন ঠিকরে পড়ে, ‘দেখেছেন তা হলে? আমি দেখিনি, কিন্তু মিস লেফেইনের কাছে শুনেছি। আমি দেখিনি, কারণ একা কখনো যাই না ও-বাড়িতে। ওই স্যার জেমস, তাঁর চীনেবাসনের মায়া কাটাতে পারেননি এখনও।’

মার্থা ঝিম ধরে বসে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর ডার্বি প্লেটখানা ব্যাগ থেকে বার করে গুঁজে দিলেন জোর করে যুবতীর হাতে, ‘কাল যখন যাবে, এই প্লেটটা ও-বাড়িতে রেখে এসো। আমার দরকার নেই।’

এই বলে জোরসে গাড়ি হাঁকিয়ে দিলেন। সন্ধ্যার আগে বাড়ি পৌঁছোনো তা সম্ভব হবে হয়তো। কিন্তু নাক থেকে এই পচাগন্ধটা ঝেড়ে ফেলা যাবে কিনা কোনোদিনই, খুব সন্দেহ হচ্ছে মার্থার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *