একটা অন্যরকম দিন
বর্ধমান স্টেশনে দুটো বেশ বড়ো ট্রেন এখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। যদিও দুটো ট্রেন যাবে উলটোদিকে, কিন্তু ইঞ্জিন দুটো কাছাকাছি দুটো লাইনে। এক্ষুনি ছাড়বে তাই ফোঁস ফোঁস করছে।
এরই মধ্যে একটা ইঞ্জিন অন্য ইঞ্জিনটাকে জিজ্ঞেস করল, তুই কোথায় যাচ্ছিস রে?
সেই ইঞ্জিনটা বলল, আমি তো আসছি দিল্লি থেকে, যাব কলকাতায়। তুই কোথায় যাচ্ছিস?
এই ইঞ্জিনটা বলল, আমি কলকাতা থেকে আসছি। যাব মুম্বাই।
ট্রেনের ড্রাইভাররা তো একজন আর একজনের সঙ্গে কথা বলেই। ইঞ্জিনরাও কথা বলে। তা অন্য কেউ বুঝতে পারে না।
একটা ট্রেনের নাম গীতাঞ্জলি আর একটা ট্রেনের নাম রাজধানী।
গীতাঞ্জলি আবার জিগ্যেস করল রাজধানীকে, কলকাতায় পৌঁছে তারপর তুই কী করবি?
রাজধানী বলল, কী আবার করব? আবার রওনা দেব দিল্লির দিকে। সেখান থেকে আবার পরের দিন কলকাতায়। আবার দিল্লি। এরকমই তো চলবে।
গীতাঞ্জলি বলল, দিনের পর দিন একই পথে যাওয়া-আসা করতে তোর একঘেয়ে লাগে না?
রাজধানী হেসে উঠে বলল, তুই কী পাগল হয়েছিস নাকি? হে-হে-হে-হে…
এই সময় গার্ডের হুইসল বেজে উঠল। দুটো ট্রেনই স্টার্ট দিয়ে চলতে লাগল দু-দিকে।
বিকেল সবে শেষ হয়ে আসছে। আকাশ এখনও অনেকটা লাল। খুব সুন্দর হাওয়া বইছে। লাইনের ধারে ধারে তারের উপর বসে থাকা নানারকম পাখি। তারা শিস দিয়ে ডাকছে একজন আর একজনকে।
খুব জোরে ছুটতে ছুটতে গীতাঞ্জলি ট্রেনটা হঠাৎ এক জায়গায় থেমে গেল। সেখানে লাইনের ধারে-কাছে কোনো বাড়িঘর নেই। দু-পাশেই ধু-ধু করা মাঠ। ফসল কাটা হয়ে গেছে, তাই মাঠ একবারে খালি।
একটুখানি থেমে থাকার পর গীতাঞ্জলি ট্রেনটা লাইন ছেড়ে নেমে পড়ল মাঠের মধ্যে।
ইঞ্জিনের ড্রাইভারের একটু ঝিমুনি এসেছিল। চমকে জেগে উঠে সে চেঁচিয়ে বলল, আরে, আরে, এ কী হচ্ছে! অ্যাকসিডেন্ট নাকি?
সে প্রাণপণে ব্রেক কষে ইঞ্জিনটা থামাবার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুতেই সেটা থামল না।
সে আবার ভয়ে বলে উঠল, এ কী ভূতুড়ে ব্যাপার হচ্ছে!
তখন গীতাঞ্জলির ইঞ্জিন বলল, ভয় পাবার কিছু নেই। আজ আমরা একটু বেড়াতে যাচ্ছি।
ড্রাইভার বলল, বেড়াতে যাচ্ছি মানে? ট্রেন আবার লাইন ছাড়া চলতে পারে নাকি? অসম্ভব!
ইঞ্জিন বলল, কিছুই অসম্ভব নয়। খুব জোর ইচ্ছে থাকলে সবই পারা যায়। আজ একটা অন্যরকম দিন।
ট্রেন সত্যিই আস্তে আস্তে মাঠের মধ্যিখান দিয়ে চলেছে এঁকেবেঁকে।
ট্রেনের সব যাত্রীরা এর মধ্যে ভয়ে চ্যাঁচামেচি শুরু করেছে। কাঁদতেও শুরু করেছে কেউ কেউ। সবাই ভাবছে, যেকোনো মুহূর্তে নিশ্চয়ই ধপাস করে একপাশে পড়ে যাবে!
কয়েকজন টপাটপ লাফিয়ে নেমে পড়তে লাগল। অন্যরাও নামতে শুরু করল সেইভাবে! বাচ্চা আর বুড়ো-বুড়িদের ধরে ধরে নামানো হল।
একটুক্ষণের মধ্যেই একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল ট্রেন।
শুধু ড্রাইভার তখনও চেষ্টা করে যাচ্ছে ইঞ্জিনটা থামাতে। পারছে না কিছুতেই। তখন সে কাঁদো-কাঁদো গলায় ইঞ্জিনকে বলল, এখনও সময় থাকতে লাইনে ফিরে চলো। নইলে, তুমিও বাঁচবে না, আমিও মরব!
ইঞ্জিন বলল, ওসব কিছু হবে না! তুমি চুপ করে বসে থাকো।
কিন্তু ড্রাইভার কী চুপ করে বসে থাকতে পারে? তারও তো প্রাণের ভয় আছে! সে-ও আবার লাফিয়ে পড়ল বাইরে।
এর মধ্যে অন্ধকার হয়ে এসেছে। ট্রেনটা যাচ্ছে একটা নদীর পাশ দিয়ে। ড্রাইভার লাফ দিয়ে পড়ল সেই নদীর জলে। ভাগ্যিস সে সাঁতার জানে! তাই ডুবল না। সাঁতরে নদী পার হয়ে ওপারে উঠে আবার সে ছুটতে লাগল।
আরও খানিকটা যাবার পর গীতাঞ্জলি এসে থামল একটা বনের ধারে।
এর মধ্যে চাঁদ উঠে গেছে, জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছে বড়ো বড়ো গাছের মাথায়।
বনে যেসব জন্তুজানোয়ার আছে, তারা খুব অবাক! বনের ধারে এত বড়ো একটা ট্রেন এসে দাঁড়িয়ে আছে! এরকম তো আগে কোনোদিন হয়নি। পাখিদের এখন ঘুমোবার সময়, তারাও জেগে উঠে ডাকাডাকি শুরু করেছে। গাছেরাও নিজেদের মধ্যে কথা বলছে ফিসফিসিয়ে।
একটু বাদে একটা আট-ন’ বছরের বাচ্চা ছেলে এসে দাঁড়াল ট্রেনটার কাছে। সে ফিচিং ফিচিং করে একটু-একটু কাঁদছে।
গীতাঞ্জলি ট্রেন তাকে জিজ্ঞেস করল, এই খোকা, তুমি কাঁদছ কেন?
ট্রেন কথা বললে বড়ো বয়েসের মানুষরা ভয় পায় কিন্তু অবিশ্বাস করে। বাচ্চারা কিন্তু ভয়ও পায় না, অবিশ্বাসও করে না।
সে কান্না থামিয়ে বলল, আমি বাবার সঙ্গে মামাবাড়ি যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কোথায় বাবা হারিয়ে গেল!
ট্রেন বলল, বাবা হারিয়ে যায়নি। তুমি হারিয়ে গেছ। তাতে কী হয়েছে, তুমি বাবাকে আবার খুঁজে পাবে ঠিক।
বাচ্চা ছেলেটি ট্রেনের গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, ওগো ট্রেন, বাবাকে যদি খুঁজে না-পাই, তুমি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে?
ট্রেন বলল, তা তো দিতেই পারি। তোমার বাড়ি কোথায়? তোমার নাম কী?
ছেলেটি বলল, আমার নাম সুগন্ধকুমার কর্মকার। আমাদের বাড়ি মণিকোঠা গ্রামে, সেখানে অনেক বাতাবি লেবুর গাছ আছে।
ট্রেন বলল, বা:, গ্রামের নাম জান, আর সেখানে অনেক বাতাবিলেবুর গাছ, তবে তো খুঁজে পাওয়ার কোনো অসুবিধেই নেই। ঠিক পৌঁছে দেব। এখন একটু বোসো। দেখো না, আকাশে আজ কত তারা দেখা যাচ্ছে। আর চাঁদটা যেন ফিক ফিক করে হাসছে। আর অনেকগুলো জোনাকি এমনভাবে উড়ছে, যেন হাওয়াতে তারা কিছু একটা লিখছে। কী লিখছে, তুমি পড়তে পার?
সুগন্ধ বলল, না। আমি শুধু বাংলা পড়তে পারি। আর একটু-একটু ইংরেজি। জোনাকিরা কী কথা বলে, এখনও শেখা হয়নি।
ট্রেন জিজ্ঞেস করল, তুমি গান গাইতে পার? একটা গান শোনাও না।
সুগন্ধ বলল, আমি তো গান জানি না।
ট্রেন বলল, তুমি নাচতে পার? একটু নাচো।
ইঞ্জিন বলল, ভাল্লুক দাদা আর ভাল্লুক বউদি, একটু নাচ দেখাও না…
সুগন্ধ লজ্জা পেয়ে বলল, ভ্যাট। আমি নাচতেও জানি না।
ট্রেন জিজ্ঞেস করল, তাহলে তুমি কী জান?
সুগন্ধ বলল, আমি একটু মাউথ অর্গান বাজাতে পারি। কিন্তু সেটা তো সঙ্গে আনিনি। আমার দাদা মাঝে মাঝেই সেটা আমার কাছ থেকে নিয়ে নেয়।
ট্রেন বলল, তাহলে তুমি চুপটি করে বোসো আমার কাছে। হাওয়া খাও। আমি ঠিক তোমাদের গ্রামে পৌঁছে দেব। তোমাকে টিকিট কাটতেও হবে না!
এই সময় দুটো গাছ থেকে দুটো কোকিল ডেকে উঠল। আর একটা কী পাখিও ডাকল, সেটা ঠিক চেনা গেল না।
এই জঙ্গলে থাকে দুটো খুব বড়ো ভাল্লুক। তারা এমনই হিংস্র আর এত বড়ো চেহারা যে বাঘও তাদের ভয় পায়। শেয়াল-টেয়াল তো কাছেই ঘেঁষে না।
একটা ঝোপের আড়ালে বসে তারা বাচ্চা ছেলেটিকে আগে থেকেই তাক করছিল। এখন ভাল্লুকটা তার বউকে বলল, এই, যা তো, ওই বাচ্চা ছেলেটার ঘাড় কামড়ে টেনে নিয়ে আয়। অনেকদিন বাচ্চা মানুষের রক্ত খাইনি।
ভাল্লুকিটা বলল, বাচ্চা ছেলের রক্ত, গরম গরম, কী ভালো খেতে! চলো, একসঙ্গেই যাই।
খানিকটা এগিয়েই ভাল্লুকিটা হঠাৎ থেমে গেল।
ভাল্লুক জিজ্ঞেস করল, কী হল, থামলি কেন?
ভাল্লুকি বলল, কেমন কেমন যেন লাগছে। আর সব দিন তো মানুষ দেখলেই তেড়ে যাই। আজ একটা অত বড়ো ট্রেন এসেছে আমাদের বাড়ির কাছে। রাত্তিরবেলা কোকিল ডাকছে। হাওয়াতেও কেমন ফিসফিসানি। আজকের দিনটা অন্যরকম। আজ আর ওকে মারতে ইচ্ছে করছে না।
ভাল্লুক ধমক দিয়ে বলল, তাহলে কি আজ খালি পেটে থাকব নাকি? আর তো খাওয়ার মতন কিছু দেখছি না।
তারপরই সে গলার আওয়াজ নরম করে বলল, তুই ঠিকই বলেছিস। গা-টা কেমন যেন শিরশির করছে। এমনি এমনিই ভালো লাগছে। আজ সত্যিই অন্যরকম দিন।
থপথপিয়ে তারা দু-জন চলে এল সুগন্ধের কাছে।
সুগন্ধ কিন্তু ভাল্লুকদের দেখে একটুও ভয় পেল না।
সে ইঞ্জিনকে বলল, এই তো ওরা এসে গেছে। ওরা নাচ দেখাবে। ভাল্লুকরা খুব ভালো নাচ জানে।
ইঞ্জিন বলল, ভাল্লুক দাদা আর ভাল্লুক বউদি, একটু নাচ দেখাও না। আমি কোনোদিন দেখিনি।
ভাল্লুকি বলল, এমন সুন্দর রাত, নাচতে তো ইচ্ছে করছেই। কিন্তু কোন নাচটা দেখাব বলো তো? কথাকলি না-মণিপুরি?
ইঞ্জিন বলল, আমি তো অতশত বুঝি না। তোমাদের যেটা ইচ্ছে হয়, সেটাই দেখাও!
এর মধ্যে হয়েছে কী, ইঞ্জিনের অন্য দিক দিয়ে একটা লম্বা সাপ উঠে এসেছে।
কিছু কিছু সাপ আছে, বেশ ভদ্র। তারা মানুষকে কামড়ায় না। এই সাপটা কেউটে, বড্ড বদরাগী, মানুষ দেখলেই কামড়াতে যায়। সে সুগন্ধকে ছোবল মারার জন্য ফণা তুলল।
সুগন্ধ ভাল্লুক দেখে ভয় না-পেলেও সাপকে খুব ভয় পায়। সে ভয়ে কেঁপে উঠল।
তখন পাশের একটা বটগাছ গম্ভীরভাবে ধমক দিয়ে বলল, এই কেউটে, তোর লজ্জা করে না? আজ এমন একটা অন্যরকম রাত, আজকেও তোর হিংসে না-করলে চলে না? একটা থাপ্পড় খাবি?
কেউটে সাপটা তখন আর ছোবল মারল না বটে, কিন্তু ফণাটা দোলাতে লাগল।
সুগন্ধ দৌড়ে নেমে গিয়ে ভাল্লুকিকে জড়িয়ে ধরল।
ভাল্লুকি বলল, ভয় নেই, ভয় নেই, আমরা তো আছি। তুমি আমাদের পেছনে দাঁড়াও, আমরা এবার নাচ শুরু করি। প্রথমে মণিপুরি ড্যান্স!
কিন্তু নাচ শুরু করা গেল না।
একটু দূরে শোনা গেল একটা গাড়ির শব্দ।
এখানে জঙ্গলে ঢোকার কোনো রাস্তা নেই, বড়ো বড়ো গাছ আর ঝোপঝাড়। জঙ্গলে ঢোকার রাস্তা আছে দু-কিলোমিটার দূরে, ভাগ্যবান গেটে। তাই এদিকে কখনো গাড়ি আসে না।
একটু পরেই জোরালো সার্চলাইট জ্বেলে সেখানে এসে গেল জিপ গাড়ি। সেটা থেকে টপাটপ নেমে পড়ল ছ-জন পুলিশ। তাদের হাতে রাইফেল আর রিভলবার।
তাদের একজন চেঁচিয়ে হুকুম দিল, গো, গো। সার্চ, সার্চ!
সঙ্গেসঙ্গে তারা অস্ত্র বাগিয়ে ছুটে ছুটে ট্রেনের প্রত্যেকটা কামরায় কী যেন খুঁজতে লাগল।
পুলিশ দেখে ভাল্লুক দুটো আর সুগন্ধ চট করে লুকিয়ে পড়েছে একটা বড়ো ঝোপের আড়ালে। সাপটা কিন্তু এখনও ইঞ্জিনের মধ্যে একইরকমভাবে ফণা তুলে আছে।
পুলিশরা ট্রেনটির সব কামরায় উঠে ভালো করে তল্লাশি করল। তারপর সবাই নেমে পড়ে বলল, না:, কিছু নেই। কেউ নেই।
পুলিশের মধ্যে যে হেড সে বলল, খবর পেয়েছিলাম, ক-জন লোক মিলে ট্রেনটাকে হাইজ্যাক করে এখানে নিয়ে এসেছে। তারা এর মধ্যে কোথায় পালাল? জঙ্গলের ভেতরটাও খুঁজে দেখতে হবে।
এবার সে জিপ থেকে আর একজন লোককে টেনে নামাল। এই লোকটির দু-হাত দড়ি দিয়ে বাঁধা। তার জামা-প্যান্ট জবজবে ভেজা। চাঁদের আলোতে চেনা যায়, এ সেই ইঞ্জিনের ড্রাইভার, যে ইঞ্জিন থেকে লাফ দিয়ে পালাতে গিয়ে নদীতে পড়েছিল।
পুলিশের হেড তাকে জিজ্ঞেস করল, পঞ্চু, যারা এই ট্রেনটা হাইজ্যাক করেছিল, তাদের দলে ক-জন ছিল?
ড্রাইভার বলল, স্যার, আমার নাম পঞ্চু নয়, আমার নাম ভোম্বল…
হেড তাকে ধমক দিয়ে বলল, তোর নাম যাই-ই হোক…
অন্য একজন পুলিশ টিপ্পনী কাটল, পঞ্চুর থেকে ভোম্বল বুঝি বেশি ভালো?
হেড আবার বলল, তোর নাম যাই-ই হোক, আমি তোকে পঞ্চু বলেই ডাকব। যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দে। ক-জন ছিল?
ভোম্বল বলল, একজনও ছিল না স্যার। ট্রেন কেউ হাইজ্যাক করেনি।
হেড বলল, কেউ হাইজ্যাক করেনি? তাহলে ট্রেনটা লাইন ছেড়ে এখানে এল কী করে? তুই এনেছিস? সত্যি কথা বল, নইলে, নইলে, এক্ষুনি গুলি করে তোকে শেষ করে দেব!
ভোম্বল কাঁচুমাচুভাবে বলল, একদম তিন সত্যি করে বলছি স্যার, আমি তো অনেক আগেই নেমে পড়েছি!
হেড বলল, আবার মিথ্যে কথা? তুই আনিসনি, তাহলে ট্রেনটা এখানে এল কী করে?
ভোম্বল বলল, ইঞ্জিনটা নিজে নিজে এসেছে!
তা শুনে সব ক-টা পুলিশ হো হো করে হেসে উঠল। এমন মজার কথা তারা জীবনে শোনেনি। ইঞ্জিনটা নিজে নিজে এসেছে! হা-হা-হি-হি-হো-হো। তাদের হাসি থামতেই চায় না।
হেড হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে ভোম্বলকে জিজ্ঞেস করল, ইঞ্জিনটা নিজে নিজে লাইন ছেড়ে এখানে এল কেন?
ভোম্বল এবার সরলভাবে বলল, আজ যে একটা অন্যরকম দিন!
হেড আরও রেগে গিয়ে বলল, অন্যরকম দিন? কেন অন্যরকম দিন? কীসের অন্যরকম দিন? যত্ত সব বাজে কথা! এবার দেখাচ্ছি মজা! পঞ্চু, ওঠ, ইঞ্জিনের ওপরে ওঠ!
ভোম্বলের হাতের দড়ি খুলে দেওয়া হল। তাকে ঠেলতে ঠেলতে তোলা হল ইঞ্জিনে। অন্য সব পুলিশও ওপরে উঠে এল।
হেড ভোম্বলকে হুকুম দিল, এবার চালাও ইঞ্জিন। আগে ব্যাক করো।
ভোম্বল খুব ভয় পাওয়া গলায় বলল, আমি পারব না স্যার।
হেড বলল, কেন পারবি না? আমার হুকুম না-শুনলে শাস্তি হবে জানিস না?
সে তার রিভলবারটা ভোম্বলের মাথার পেছনে ঠেকাল।
ভোম্বল তবু বলল, ইঞ্জিন আমার কথা শুনছে না।
আবার অন্য পুলিশরা হেসে উঠল।
হেড কড়া গলায় বলল, ইঞ্জিন তোর কথা শুনছে না? ইঞ্জিন কি মানুষ নাকি? ইঞ্জিন তো একটা যন্ত্র। মানুষ যেমনভাবে চালাবে, যন্ত্র সেইভাবে চলবে।
ভোম্বল বলল, না, স্যার। এক-একদিন যন্ত্ররাও মানুষের কথা শোনে না। নিজেদের ইচ্ছে মতন চলে। আমি নিজের চক্ষে দেখেছি।
হেড বলল, তুই চালা বলছি। কেমন না-চলে আমি দেখছি। চালা, চালা!
ভোম্বল অনেকগুলো প্লাগ টেপাটেপি করল। কিছুই হল না। তারপর পেছন ফিরে বলল, দেখলেন তো স্যার, এখন আমাকে মারতে চান তো মারুন। তাতে কোনো লাভ হবে না। ইঞ্জিনকে তো আর আপনি গুলি করে মারার ভয় দেখাতে পারবেন না?
এই সময় হঠাৎ খুব জোরে ট্রেনের সিটি বেজে উঠল। যেন রাত্তিরের অন্ধকারের কালো পর্দাটা ছিন্নভিন্ন করে দিল সেই তীক্ষ্ণ আওয়াজ।
সবাই চমকে গেল একেবারে।
সিটি কে বাজাল? যে বোতামটা টিপলে বাজানো যায়, সেটায় তো কেউ হাত দেয়নি। তাহলে?
এই রহস্যের সমাধান করার আগেই একজন পুলিশ চেঁচিয়ে উঠল, সাপ! সাপ!
সেই কেউটে সাপটা পুলিশের হেডের একেবারে পায়ের কাছে ফণা তুলে আছে। যেকোনো মুহূর্তে ছোবল মারতে পারত, কিন্তু এখনও মারেনি।
হেড এক লাফে পিছিয়ে গেল খানিকটা। তারপর সাপটাকে মারবার জন্য রিভলবারটা সেটার দিকে তাক করে টিপ করতে লাগল।
কিন্তু হেডের গুলি করা আর হল না। তার চোখ বুজে এল, হাত থেকে রিভলবারটা খসে পড়ে গেল নীচে।
অন্য পুলিশরা ভাবল, কী হল? কী হল?
একজন বুড়ো মতন পুলিশ বলল, এই রে। সাপের চোখের দিকে সোজাসুজি তাকাতে নেই। সাপ হিপনোটাইজ করতে পারে। আমি আমার রাইফেলটা দিয়ে ওটাকে পিটিয়ে মারতে পারি। তাতে অবশ্য আমাকে চোখ বুজে থাকতে হবে। ওকে যদি দেখতে না-পাই, মারব কী করে?
এই সময় দু-বার কোকিল ডেকে উঠল। আর সেই অন্য পাখিটা…
হেড চোখ খুলে বলল, কোকিল ডাকল? রাত্তিরবেলা কোকিলের ডাক তো আগে কখনো শুনিনি। অন্য পাখিটাই বা কী?
ভোম্বল বলল, আজ স্যার সত্যিই একটা অন্যরকম দিন। অন্যরকম রাত।
সাপের কথাটা আর মনেই রইল না। হেড বলল, একটা সরসর শব্দ শুনতে পাচ্ছ?
বুড়ো মতন পুলিশটি বলল, হ্যাঁ, স্যার, গাছের পাতায় হাওয়ার শব্দ। গাছেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।
হেড বলল, গাছ বুঝি কথা বলতে পারে? ধ্যাৎ!
বুড়ো মতন পুলিশটি বলল, মাঝে মাঝে বলে স্যার। আমি ওদের কথা একটু একটু বুঝতেও পারি।
হেড বলল, তুমি গাছের কথা বুঝতে পার? চালাকি হচ্ছে আমার সঙ্গে? কী কথা বলছে ওরা?
বুড়ো মতন পুলিশটি বলল, ওরা স্যার গান গাইছে। সেই গানটা হচ্ছে, আজ একটা অন্যরকম দিন। আজ একটা অন্যরকম রাত। আপনি কান পেতে শুনুন, আপনিও বুঝতে পারবেন।
হেড কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল।
তখনই বাইরে থেকে একটা ছোটো ছেলের গলা শোনা গেল, আমার যে খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার যে খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে।
বুড়ো মতন পুলিশটি বাইরে উঁকি দিয়ে দেখল, একটি ছোটো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছলছল করছে তার চোখ।
সেই পুলিশটি জিজ্ঞেস করল, অ্যাই, তুই কে? তোর কীসের দেরি হয়ে যাবে?
ছেলেটি বলল, আমার নাম সুগন্ধ। আমার বাবা হারিয়ে গেছে। না, না, আমিই হারিয়ে গেছি। এই ট্রেন দাদা বলেছে, আমাকে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেবে।
হেডপুলিশ বলল, ট্রেন তোকে বাড়ি পৌঁছে দেবে? তোকে নিজের মুখে বলেছে?
সুগন্ধ বলল, হ্যাঁ, বলেছে তো। কখন যাব?
ট্রেন আবার একবার জোরে সিটি বাজাল।
এদিকে ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে ভাল্লুক আর ভাল্লুকি এতক্ষণে বিরক্ত হয়ে উঠেছে। ভাল্লুকি বলল, তখন থেকে আমার নাচতে ইচ্ছে করছে, কিছুতেই আর হচ্ছে না। যত সব ঝামেলা! এখন আমি নাচবই নাচব!
ভাল্লুক বলল, ঠিক আছে, নাচ শুরু কর না। আমিও আছি তোর সঙ্গে।
তখন তারা নাচতে নাচতে বেরিয়ে এল ঝোপের আড়াল থেকে।
ভাল্লুকের ঘোঁৎঘোঁৎ আওয়াজ শুনে পুলিশরা সব সেদিকে তাকাল। দু-দুটো অত বড়ো বড়ো ভাল্লুককে দেখে তারা রাইফেল আর রিভলবার বাগিয়ে ধরল।
বুড়ো পুলিশটি হেড পুলিশকে বলল, স্যার, স্যার, গুলি ছুড়বেন না। যে ভাল্লুক নাচে, তারা কি কামড়ায়?
হেড বলল, তাও তো বটে। না:, এরা কামড়াবার পার্টি নয়। চলো, তাহলে আমরা ওদের নাচ দেখি।
ভাল্লুক আর ভাল্লুকি বেশ নাচতে নাচতে এগিয়ে এল অনেক কাছে। তবে তারা মণিপুরী না কথাকলি নাচছে, তা অবশ্য ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
সুগন্ধও নাচতে লাগল ওদের সঙ্গে। কোথা থেকে কয়েকটা খরগোশ আর কাঠবিড়ালি এসে নাচ জুড়ে দিল। কোকিল দুটো আর সেই অজানা পাখিটা ডাকতে লাগল। নাচতে লাগল সব গাছের পাতা। দোল খেতে লাগল আকাশের চাঁদ। বেশি ঝিকঝিক করতে লাগল অনেক তারা।
পুলিশটিও ওদের সবার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে নাচতে নাচতে গাইতে লাগল। আজ একটা অন্যরকম দিন/আজ আমরা নাচব সবাই তা ধিন, তা ধিন, তা ধিন।
গীতাঞ্জলি ট্রেনটারও একটু একটু নাচতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু এত বড়ো দেহটা নিয়ে সে নাচলে অন্যরা কী ভাববে! তাই সে লজ্জা পাচ্ছিল। একটু বাদে সে আর থাকতে পারল না। সেও নেচে নেচে গাইতে লাগল, তা ধিন, তা ধিন, তা ধিন!