একজন বিচ্ছিন্নবাদী
“একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি…….. একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি……গতকাল জামিল আলী নামে এক অটোচালক হারাইয়া গিয়াছে। লোকটির পরনে ছিল চেক শার্ট আর লুঙ্গি। যদি কোন সহৃদয়বান ব্যক্তি লোকটির সন্ধান পেয়ে থাকেন …… তবে অতি সত্ত্বর বহরমপুর কাদেরের মোড়ের করিম স্টোরে যোগাযোগ করতে বলা হইল। মোবাইল নম্বর শূন্য এক তিন এক চার…… দুই পাঁচ…… সাত চার পাঁচ। সন্ধানকারীকে পুরস্কৃত করা হইবে। একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি……….”
মাইকিং করতে করতে রিক্সাটা থানার পাশের গলিতে ঢুকে পড়ল।
সকাল সাতটা। বহরমপুর থানা।
ওসি সাহেবের রুমটা গুমোট। তার ওপর ইলেক্ট্রিসিটি নেই। উত্তর দিকে জানালা খোলা। কিন্তু বাতাস নেই। ওসি সাহেবের বসার তেল চিটচিটে চেয়ারটা চকচকে একটা টাওয়েল দিয়ে মোড়ানো। খাইরুল সেই চেয়ারটাতে পাথরের মত বসে আছেন। মাঝখানে টেবিল। টেবিলের ওপাশের চেয়ারে বসে আছে মেরিলিনা নামের এক অস্থিরমতি যুবতী। নাম মেরিলিনা জামান। বয়স আনুমানিক বিশ কি বাইশ হবে। আবার তার কমও হতে পারে। সম্প্রতি সে ইতালি থেকে এই দেশে এসেছে। তার ব্যাগ হারিয়ে গিয়েছে। বিকালবেলা সে ভুল করে একটা অটোতে তার ব্যাগটা ফেলে যায়। হোটেলে চেক ইন করার সময় তার ব্যাগের কথা মনে পড়ে। কিন্তু ততক্ষনে অটোওয়ালা চলে গিয়েছে। সে বহরমপুরের কিছুই চেনে না। তার মহাবিপদ। ধারণা করেছিল থানায় এসে বিদেশী পাসপোর্টধারী হিসেবে একটু বেশি গুরুত্ব পাবে, কিন্তু তার প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি মিলছে না।
মেরিলিনা বলল, “আমার পাসপোর্ট, আমার কাগজপত্র, আমার সব কিছু ছিল ঐ ব্যাগটার ভেতরে। দ্য ব্যাগ ওয়াজ এভ্রিথিং টু মি। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, স্যার। হোটেলের ম্যানেজার আমাকে মাইকিং করাতে বলল। করিয়েছি। এখন পর্যন্ত ব্যাগের খোঁজ নিয়ে কেউ আসেনি।”
মেরিলিনার কথায় ইতালিয় টান। খাইরুল প্রায় দশবার হল মেয়েটাকে বুঝিয়েছেন যে একটা সাধারন ডায়েরি করা ছাড়া এখন তার কিছুই করার নেই। মানুষই হারিয়ে যাচ্ছে তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না আর ব্যাগ তো ব্যাগ। সময় হলে তার ব্যাগের সন্ধান করা হবে। নিয়মের বাইরে এখানে কিছু করা সম্ভব না। এমনিতেও এই থানায় অনিয়মটাই নিয়ম। পলিটিকাল লোকজন যখন খুশি তখন থানায় ঢুকে পড়ে। খাইরুল সাহেবের সামনে বসে বগল চুলকায়। পারিবারিক ঝামেলা মিটাতেও মাঝে মাঝে তাকে মানুষের বাড়ি বাড়ি যেতে হয় যেটা নিয়মের বাইরে। কিন্তু, খাইরুল যতটা পেরেছেন, থানাটাকে নিয়মের ভেতরে আনার চেষ্টা করেছেন। সামনে বসে থাকা এই যুবতীকেও তিনি নানা ভাবে নিয়ম বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, এবং মোটামুটি ব্যর্থ হয়েছেন। মেয়েটা অসহায়ের মত তার হারানো ব্যাগটার জন্য হাহুতাশ করছে আর গ্লাসের পর গ্লাস পানি খাচ্ছে।
খাইরুল গলা খাঁকারি দিয়ে একাদশতম চেষ্টা শুরু করলেন। বয়সে মেয়েটা খাইরুল সাহেবের থেকে যথেষ্ট ছোট। তাও খাইরুল মেয়েটাকে তুমি সম্বোধন করতে চাইলেও পারলেন না।
“দেখেন। হুট করে একটা সমস্যার সমাধান করা যায় না। এখানে আমরা ডায়েরির সিরিয়াল ধরে কাজ করি। আপনি একটা মিসিং ডায়েরি করে যান। আমরা কাল পরশুর ভেতরেই আপনার ব্যাগটার খোঁজ করব। চিন্তা করার কারণ নেই। বাইরে শিউলি ম্যাডাম আছেন। উনার কাছে যান। গেলেই উনি আপনার ডায়েরি করে দেবেন। একটা এপ্লিকেশান লিখতে হবে। উনি সব বুঝিয়ে দেবেন।”
মেরিলিনা আর কিছু বলল না। গত পঁয়ত্রিশ মিনিট সে ওসিকে তার বিপদের ‘গুরুত্ব’ বোঝানোর চেষ্টা করেছে। পারেনি। এখন সে ইচ্ছা করলে ইতালির এম্ব্যাসিতে যোগাযোগ করতে পারে। অ্যাম্ব্যাসি থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসপির মাধ্যমে এই ভদ্রলোককে কড়া কিছু কথা শোনানো হবে। এই লোক হাত ধরে মাফ টাফ চেয়ে তার ব্যাগ খুঁজতে বের হবে।
মেরিলিনা সেটা চাচ্ছে না।
মেরিলিনা চেয়ারটা সামনে টেনে নিয়ে বসল। বলল, “স্যার, আমি ইতালিতে থাকি। আমার বাবা ছিলেন ইতালির পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির অধ্যাপক। নাম ডাঃ বশির জামান। বাবা ছিলেন সংসারি এবং খুব গোছানো ধরণের মানুষ। কিন্তু হঠাৎ করেই বাবা কাউকে কিছু না বলে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। বাবার তেমন কোন বন্ধু ছিল না। তার কলিগরাও তার ব্যাপারে কিছুই বলতে পারেননি। বাবার ইন্সটিটিউটেও কেউ কিছু বলতে পারেনি। আমি ভীষণ ভেঙে পড়ি। প্রায় পাঁচ বছর অপেক্ষার পরে জানতে পারি বাবা বাংলাদেশে আছেন। বাবাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া আমার উদ্দেশ্য না। বাবা কেন কিছু না বলে দেশে ফিরে আসলেন এটাই বাবার মুখ থেকে শুনব। তাই বাবাকে খুঁজতেই আমি এত দূর এসেছি। ব্যাগে আমার প্রয়োজনীয় সব কিছু ছিল। প্লিজ স্যার। এখনও যদি একটু দেখেন, আমার ব্যাগটা হয়ত পাওয়া যেতে পারে। ওটার ভেতরে আমার মায়ের দেওয়া একটা চাবি ছিল স্যার। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা চাবি।”
“গুরুত্বপূর্ণ চাবি বলতে?”
“জানি না। আসলে, আমার মা আমাকে চাবিটা দিয়েছিলেন। কিন্তু কিসের চাবি জানি না। আমার মনে হয় চাবিটা আমাকে বাবা পর্যন্ত নিয়ে যাবে। চাবিটার সাথে একটা ঠিকানাও লেখা ছিল। ব্যাগটা হারিয়ে গেলে চাবিটাও আর পাব না। আমার বাবার শেষ স্মৃতি ওটা।”
“চাবিটা কিরকম দেখতে?”
“অনেকগুলো চাবি ছিল, আর চাবিটার সাথে পিতলের ফলকে একটা ঠিকানা লেখা ছিল। ঠিকানাটাও আমার মনে নেই।”
“কিভাবে জানলেন যে আপনার বাবা এদেশেই আছে?”
“উনার এক ছাত্র আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছিল।”
“সেই ছাত্রের সাথে যোগাযোগ হয়েছে?”
“না। তার ফোন নাম্বার নেই আমার কাছে। নামটাও ভুলে গিয়েছি।” এই মেয়ে তো পুরাই দায়িত্বজ্ঞানহীন। খাইরুল কিছুটা বিরক্ত হলেন। তার সময় নষ্ট হচ্ছে। খাইরুল শেষবারের মত কড়া গলায় মেয়েটাকে নিয়ম বোঝাতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ করে সামনে বসে থাকা মেয়েটার জন্য তিনি মায়া অনুভব করলেন। কিন্তু প্রকাশ করলেন না। এই দেশে প্রশাসনের চেয়ারে বসে মায়া দেখালে লোকে পেয়ে বসে। পরীক্ষিত সত্য।
মায়ার উদ্রেক হওয়ার কারণ জুঁই। জিনাতুল তাসমিয়া জুঁই। আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগের কথা। খাইরুল তার ছোট বোন জুঁইকে খুব আশা নিয়ে এক বড় ব্যবসায়ীর ছেলে কায়সার হামিদের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। পিতৃহীন খাইরুল মায়ের অমতেই এই বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় কায়সার খুন হয়। কায়সারের ছোট ভাইয়ের নামে কায়সারের দুইজন বিজনেস পার্টনার মামলা করে। তাদের অভিযোগ, চাঁদাবাজির জের ধরে কায়সারের নেশাখোর ছোট ভাই কায়সারকে নিজ হাতে খুন করেছে। আর কায়সারের পরিবার থেকে মামলা করা হয় জুঁইয়ের নামে। কায়সারের পরিবার থেকে বলা হয় পরকীয়া প্রেমের জের ধরে জুঁই কায়সারেরই কয়েকজন বন্ধুর সাথে হাত মিলিয়ে কায়সারকে খুন করিয়েছে। জুঁইকে জেল হাজতেও পাঠানো হয়।
জুঁই খাইরুল সাহেবের হাত ধরে বলেছিল, “কোথায় এনে ফেললে আমাকে মিয়া ভাই? বিয়ে না দিয়ে যদি বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে তাহলেও শাস্তি ছিলো। দেড় বছরে মানুষটা তো আমাকে সুখ দিলই না, মরে গিয়ে আরও দোযখের ভেতর ফেলে গেল।” খাইরুল তখন মাত্র সিভিল সার্ভিসে ঢুকেছেন। কি করবেন না করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সত্য উদ্ঘাটনের থেকে তিনি নিজের বোনের জামিনকে বেশি গুরুত্ব দিলেন। কায়সারের পরিবার প্রভাব খাটিয়ে তাদের ছোট ছেলেকে বের করে নিয়ে গেল। খাইরুলও একে ওকে ধরে জুঁইয়ের জামিনের ব্যবস্থা করে ফেললেন। জামিনের আগের দিন জুঁই খাইরুলকে বলেছিল, “চিন্তা করো না মিয়া ভাই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি যদি কখনও মারা যাই, মনে রাখবা আমি সবসময় তোমার সাথে থাকব।”
খাইরুল সেদিন জুঁইকে জামিনের কথা বলেননি। বোনকে পরদিন সারপ্রাইজ দেবেন ভেবেছিলেন।
সারপ্রাইজ দেওয়া হল না। পরদিন জেলে গিয়ে জানা গেল, জুঁই গায়ে কেরোসিন ঢেলে নিজেকে জ্বালিয়ে দিয়েছে।
জুঁই বেঁচে থাকলে কি তাকে সাহায্য করতেন না খাইরুল?
তিনি মেরিলিনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “অটোর ড্রাইভারের চেহারা মনে আছে?”
“না। আমি আসলে খুব আপসেট ছিলাম। ড্রাইভারের মুখের দিকে সেভাবে খেয়াল করা হয়নি।”
“সময় নেন। ভেবে দেখেন কিছু মনে পড়ে কিনা। মনে করেন।”
“গোলগাল মুখ ছিল, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল।”
“পরনে কি ছিল মনে পড়ে?”
“একটা সাদা শার্ট আর লুঙ্গি।”
“অটোটা দেখতে কেমন ছিল?”
“সামনের অংশটা লাল ছিল। শুধু এইটুকুই মনে আছে।”
“কোথা থেকে অটোতে উঠেছিলেন?”
“বাসট্যান্ড থেকে। বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে।”
“অটোর কোন নম্বর প্লেট ছিল। মনে আছে?”
“না সেটা মনে নেই। কিন্তু অটোটার সিট ছিল খয়েরি রঙের। আর, অটোটার ব্যাক ভিউ মিরর ছিল না।”
“আপনার কন্টাক্ট নম্বরটা দিয়ে যান। যদি ব্যাগ পাওয়া যায়। আমি জানাবো।”
“আপাতত আমার কন্টাক্ট নম্বর নেই। হোটেল সুকর্ণে উঠেছি। ওখানকার রিসেপশনে ফোন করলেই ওরা আমাকে ডেকে দেবে।”
খাইরুলকে আরও কিছু ছোটখাট তথ্য দিয়ে মেরিলিনা বিদায় নিল।
মেরিলিনা বের হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে খাইরুল সাহেবের মনে হল, মেয়েটার হাতে টাকা পয়সা আছে তো? কিছু টাকা দিয়ে দিলেও তো হত।
খাইরুল থানার সেকেন্ড অফিসার সাজ্জাদকে ডেকে শহরের ভেতরের সবগুলো অটো গ্যারেজের খোঁজ করতে বললেন। ড্রাইভারের আনুমানিক বিবরণটাও বলে দিলেন। ব্যাগটা কেউ পেয়েছে কিনা সেটাও দেখতে বললেন।
পরদিন দুপুর পর্যন্ত ব্যাগের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। খাইরুল তাই নিজেই বের হলেন। তার মোটর সাইকেল থানার গেট থেকে বের হওয়ার সময় পর্যন্তও কেউ জানত না, সামান্য একটা হারিয়ে যাওয়া ব্যাগ খুঁজতে গিয়ে কত গভীর লুকানো ক্ষত বেরিয়ে আসবে।