একজন গণেশের গল্প

একজন গণেশের গল্প

গণেশের আবার কাজ চলে গেছে।

আবার সে বেকার। বারো বছরের জীবনে এই নিয়ে তার সাতবার কাজ গেল। হায়ার অ্যান্ড ফায়ার।

গণেশ বড়দের মতো কর্মজীবন শুরু করেছিল সামান্য ‘কম বয়েসে’। তবে সেটা বুক ফুলিয়ে বলবার মতো কোনও কথা নয়। অনেকেই ‘কম বয়েসে’ বড়দের মতো কর্মকাণ্ড করে ফেলে। কেউ স্কুল পাশ করে, কেউ এরোপ্লেন বানায়, কেউ ছবি আঁকে, কেউ গান গায়। গণেশও তেমন। আট বছর বয়সেই ‘নিজের ভাত নিজে জোটাও’ কর্মকাণ্ডে যোগ দিয়েছে। একটাই ফারাক, ‘কম বয়েসে’ মায়ের কোলে বসে বড়দের মতো গান গাইলে বা বাবার কাঁধে চেপে অঙ্ক পারলে টিভিতে লাফালাফি হয়, খবরের কাগজে ছবি বেরোয়। নিচে লেখা হয়, ‘খুদে প্রতিভা’। কিন্তু আট বছর বয়েসে নিজের পেট নিজে ভরাতে শিখলে কেউ পাত্তা দেয় না। মুখ ফিরিয়ে নেয়। ভাবটা এমন যেন, এ আর এমন কী! কুকুর বিড়ালের ছানা নিজে খুঁটে খায় না? তাদের বাপ মা কখনও মুখে দুধ-ভাত তুলে দেয়? তারা যদি পারে, মানুষের ছানা কেন পারবে না? মানুষ কি কুকুর বিড়ালের থেকে কম? কথা সত্যি।

গণেশ এখন চৌমাথায়। শিবমন্দিরের পাশে যে সিমেন্ট বাঁধানো গাছতলা আছে সেখানে বসে পা দোলাচ্ছে। চৈত্রের গনগনা দুপুর। এই ছোট্ট মফস্সল শহর রোদে ফাটছে। মানুষজন তেতেপুড়ে খাক। তারমধ্যে গাছতলার বাতাস কিছুটা ঠান্ডা। গণেশের পরনে হাফ প্যান্ট, স্যান্ডো গেঞ্জি। গেঞ্জির অবস্থা করুণ। কাঁধ ছেঁড়া, বুকে পিঠে ডাল, তরকারির ফ্যাসফ্যাসে হলুদ দাগ। তবে প্যান্টের অবস্থা ভালো। চকচকে, হাঁটু পর্যন্ত ঝোলা। প্লাস্টিকের সরু বেল্টও রয়েছে। গণেশের রোগা ভোগা, ছোটখাটো চেহারায় মানিয়েছে মন্দ নয়। যদিও এখন তার প্যান্ট পরে থাকার কথা ছিল না। মিনিট চল্লিশ হল, তিনটে কাচের ডিশ একসঙ্গে হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাওয়ার অপরাধে ভাত-ডালের হোটেল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। জীবনের সাত নম্বর চাকরি। বহিষ্কারের আগে মালিক শ্যামাচরণ মাইতি আর্তনাদ করে ওঠে।

‘এই হারামজাদাকে কদিন আগেই নতুন জামা প্যান্ট কিনে দিয়েছি। আর সেই শয়তান কিনা তিন—তিনটে প্লেট একসঙ্গে ভেঙে ফেলল! অ্যাই কে আছিস? আছিসটা কে? জামাপ্যান্ট খুলে এটাকে এখনই বের করে দে। ন্যাংটো হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াক। ডিশ ভাঙার মজা বুঝুক।’

শ্যামাচরণ মিথ্যে বলেনি। খাবারের হোটেলে বেশি নোংরা জামাপ্যান্ট চলে না। তারওপর আবার পার্টিবাবুদের ভিড় হচ্ছে। সেই কারণে কিছুদিন হল নতুন এক সেট জামাপ্যান্ট পেয়েছে গণেশ। মালিকের নির্দেশ মতো নতুন জামা খুলে নেওয়া হল। টান পড়ল প্যান্টে। সেই সময় ‘ডালপঞ্চ’ এগিয়ে আসে। তার হস্তক্ষেপে গণেশ শেষ পর্যন্ত প্যান্ট সহযোগে বেরোতে পেরেছে। নইলে একটা চিন্তার বিষয় হত। পঞ্চুদা হোটেলের রাঁধুনি। ডাল ভালো বানায় বলে নাম হয়েছে ‘ডালপঞ্চু’।

তবে এসব হল কঠিন বিষয়। গণেশ খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে না। কঠিন বিষয়কে সহজ ভাবে নেওয়ার শিক্ষা তাকে দিয়েছে শটারদা।

‘বুঝলি গণশা, জীবন হল একটা সহজ নদীর মতো। খুশি মতো চলে। চলার সময়ে পুজোর ফুল মালা পড়ল না পচা লাশ ভাসল, গায়ে মাখে না। মাথা ব্যথাও নেই। তোকেও তেমন হতে হবে। কঠিন জিনিস ঝেড়ে ফেলে, সহজ হতে হবে।’

শটারদার তার থেকে তেরো-চোদ্দো বছরের বড়। কীভাবে জানি স্কুলের শেষ ক্লাস পর্যন্ত গিয়েছিল। পেট টানতে গিয়ে লেখাপড়া টানতে পারেনি। ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়া হল না। কাজকম্মও জুটল না। জুটলেও মতামত হল না। পরের হুমকি ধামকি মোটে পছন্দ নয় এই লোকের। স্বাধীন ভাবে নিজে কিছু করতে চায়। গণেশকেও বারবার বলে।

‘গণশা, অন্যের চাকর হয়ে থাকার থেকে নিজের মাকর হয়ে থাকা ঢের ভালো। মাকর কী জানিস? মাকর হল, মানসম্মান। জানবি, মানসম্মান হল সবার আগে।’

‘নিজের মাকর’ হতে গিয়ে নানা কাজ করেছে শটারদা। ছোটখাটো বিজনেস। জমেনি কোনোটাই। উলটে লোকে ঠকিয়েছে। ধার দেনা হয়েছে রিস্তর। শেষপর্যন্ত ওয়াগন ভাঙায় থিতু হয়েছে। কখনও কর্ড লাইন, কখনও মেন লাইনে কাজ। সাইডিং-এ দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়ির দরজা খোলে গাঁইতি মেরে। এক শটে তালা উপড়োয়। হিন্দি সিনেমার কায়দায় চলন্ত মালগাড়িতে উঠে বস্তাও ফেলতে পারে। জায়গা ভুল হবে না। সেখানেও শট পাকা। তাই লাইনে নাম হয়েছে ‘শটার’। এখানে কাজের সম্মান আছে। তবে একজায়গায় বেশিদিন থাকবার উপায় নেই শটারদার। রেল পুলিশে দু—দু’বার ধরে হাজতে চালান করেছিল। বলে দিয়েছে, এরপর দেখতেই পেলেই গুলি। রেল লাইন বছরে একটা—দুটো না মারলে নাকি তাদের চাকরিতে প্রোমোশন নেই। প্রোমোশন না পেলে হবে কী করে? তাদের তো ঘরে বউ-ছেলে আছে। শটারদার সঙ্গে গণেশের দেখা হয় কদাচিৎ। মানুষটা তাকে পছন্দ করে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের যেখানে শেষ হয় সেখানে বসে গাঁজা টানতে টানতে বকবক করে। গণেশ হাঁ হয়ে শোনে।

‘তোর জন্য কেন কিছু করি না জানিস গনশা?’

গণেশ অস্ফুটে বলে, ‘না, জানি না।’

শটারদা বলে, ‘তোর আর আমার দু’জনেরই কেস এক। জন্মানোর পর বা-মা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল। জঞ্জালের মধ্যে কুঁইকুঁই করছিলাম, লোকে কুড়িয়েছে। কেন কুড়িয়েছে জানিস?’

গণেশ বলে, ‘না, জানি না।’

শটারদা নাক মুখ থেকে সাদা ঘন ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, তুই যদি ভাবিস ভালোবেসে কুড়িয়েছে মস্ত ভুল করবি। কুড়িয়েছে ভয়ে। ভেবেছে, আমি যদি এমন করে এঁটোকাটার মধ্যে পড়ে থাকতাম কেউ কি তুলত? এইটা ভয়। বেশিরভাগ করুণার পিছনে জানবি ভয় থাকে। একই ভয়ে লোকে ভিখিরিকে পয়সা দেয়। ভাবে আমি যদি ভিখিরি হতাম। তাহলে কি কেউ পয়সা দিত? না দিলে আমি কী খেতাম? ভিক্ষে আসলে নিজেকেই দেয়। বুঝলি?’

গণেশ বুঝল না। বোঝবার কথাও নয়। শটারদা কত লেখাপড়া! আর সে তো কোনওদিন স্কুলেই যায়নি। তারপরেও ঘাড় কাত করে।

শটারদা বলে, ‘হিসেব করলে আমরা হলাম ডাস্টবিনতুতো ভাই। দুজনেরই ফাদার মাদার হল ডাস্টবিন। দেখলেই পেন্নাম ঠুকবি।’

কথা শেষ করে মেটে রঙের দাঁত বের করে শটারদা ‘খ্যাঁক খ্যাঁক’ আওয়াজ করে হাসে। এক পায়ের ওপর অন্য পা তুলে নাচাতে নাচাতে বলে, ভাই হয়েও আমি তোর জন্য কিছু করি না।’

গণেশ অবাক হয়ে বলে, ‘তুমি আবার কী করবে!’

শটারদা উদাসীন গলায় বলে, ‘তোর জন্য একটা পাকা কাজকম্ম কি জুটিয়ে দিতে পারি না? ইচ্ছে করলেই পারি। আমার কারবারেই নিয়ে নিতে পারি। ওয়াগন ভাঙার লাইনে তোর বয়েসের ছেলেপিলেও লাগে। হাত-পা নরম বলে মালগাড়ির ভাঙা দরজার অল্প ফাঁক দিয়ে টক করে ভিতরে গলে যেতে পারে। ছোট ছেলেপিলেদের দিকে রেল পুলিশ চট করে বন্দুকও তুলতে পারে না। তারপর ধর, খিদের সময় তোকে এক পেট ভাত খাইয়ে দিতে কী আর এমন খরচা? রোজাগারপাতি ভালো থাকলে, সঙ্গে ডিমের ঝোলও পেতিস। ঝড়জলের টাইমে মাথা গোঁজবার একটা ঠাঁই দরকার। সে জোগাড় করে দেওয়াও কঠিন নয়। মান্তুকে বললেই হবে। এদিকার গোডাউন, কারসেডে সব ওর কন্ট্রোলে। একটায় ঢুকিয়ে দিত। কত লোকেই তো থাকে। মান্তু ভাড়া খাটায়। আমি বললে তোর জন্য হাফ ভাড়া। তারপরেও কিছু করি না। কেন জানিস?’ গণেশ জানতে চায় না। কী হবে জেনে। এই যে মানুষটার পাশে মাঝেমধ্যে দু’দণ্ড বসতে পারে, এই তো যথেষ্ট। নিজের লোক বলে তো দুনিয়ায় আর কেউ নেই।

শটারদা বলে, ‘কীরে চুপ মেরে গেলি কেন? বল, কেন করি না।’ গণেশ বলে, ‘জানি না।’

শটারদা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওসব করে মাসতুতো, পিসতুতো, খুড়তুতো ভাইয়েরা। ডাস্টবিনতুতো ভাইদের একে অপরের জন্য কিছু করবার নিয়ম নেই। তাদের নিজের জোরে বাঁচতে হয়। নিজের জোরে আবর্জনা খুঁটে খেতে হয়। তবে চিন্তার কিছু নেই। খাবারের অভাব হবে না। গোটা দুনিয়া জুড়ে থরে থরে ডাস্টবিন সাজানো। একটা থেকে বেরিয়ে আর একটায় টুক করে ঢুকে পড়বি। কোনো শালার হেল্প লাগবে না। শুধু একটা কথা মনে রাখবি গণশা, ওনলি কথা, যতক্ষণ পারবি ফাইট চালাবি। বেদম ফাইট। ডাস্টবিনের বাচ্চারা কখনও হারে না। ফাইট কী জানিস? ফাইট হল লড়াই। এই হল তরবারি যুদ্ধ।’ ডান হাত ঘুরিয়ে শূন্য তরবারি হাতে যুদ্ধ দেখায় শটারদা। বলে,’বুঝলি?’

গণেশ আবার কিছু না বুঝে ঘাড় কাত করে। শটারদা বলে, ভেরি গুড। এসব হল হাই থট। হাই থট কাকে বলে জানিস? হাই থট হল বড় বড় চিন্তা ভাবনা। এই চিন্তা করে কত মানুষের যে নামডাক হয়েছে! হাই থট করবার জন্য ভগবান দু’ধরনের মানুষকে বেচেছেন। বড়লোক আর ছোটোলোক। প্র্যাকটিস কর তুইও পারবি। ছোটলোকদের কোটায় ঢুকে যাবি ‘

কথা শেষ করে আবার ‘খ্যাঁক খ্যাঁক’ আওয়াজে হাসি।

মজার কথা, ইদানীং গণেশের মধ্যে অল্পস্বল্প ‘হাই থট’এর উদয় হচ্ছে। সে লক্ষ করে দেখেছে, পেটে খিদে থাকলে বেশি করে ‘হাই থট’ আসছে। সে অবাক হচ্ছে। খিদের সঙ্গে বড় চিন্তার সম্পর্ক কী? এই দুনিয়ায় যারা বড় চিন্তাভাবনা করেছেন, নামডাক করছেন, তারা কি সব খিদের সময় করেছেন? তাই হবে। ইদানীং কাজকম্ম চলে গেলে তার মনে হয়, জীবনটাই এরকম। কোনও কিছুই পাকা নয়। কখন চলে যায়, কখন আসে তার ঠিক নেই। আবার রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শুয়ে যখন রাত কাটায়, মাথার পাশ দিয়ে ঝমঝম করে রেলগাড়ি যায়, মনে হয়, মানুষ নিজেই একটা রেলগাড়ি। একটার পর একটা স্টেশন পেরিয়ে চলেছে। আবার কখনও মনে হয়, তার যে কেউ নেই একথা ভেবে মনখারাপ করা বোকামি। আসলে এই দুনিয়ায় কারোরই কেউ নেই। সবাই মিথ্যে করে ভাবে, আমার এ আছে, আমার সে আছে। কচু আছে। এই যে সেদিন বাজারের হরিনাথকাকা হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে একা একা মরে গেল, ওর কি ছেলেমেয়ে নেই? আছে তো। কেউ কি এল? কেউ এল না। তাহলে থেকে কী হল?

তবে এই সব ভেবে গণেশের মাঝেমধ্যে ভয়ও লাগে। পাগলটাগল হয়ে যাচ্ছে না তো? হাবিজাবি চিন্তা হলে নাকি মানুষ পাগল হয়। কী সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে কল থেকে পেট ভরে জল খেয়ে নেয় গণেশ। খিদে মরলে যদি হাই থট পালায়।

এখন দুপুর দুটো। গণেশের খিদে পাচ্ছে। এই খিদে বিকেল পর্যন্ত টানা গেলেও রাতের দিকে একটা কিছু ব্যবস্থা করা দরকার। তবে শুধু খিদে নয়, ঘুমও পাচ্ছে। কাল রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি। পার্টিবাবুরা অনেক রাত করে হোটেলে খেতে এলো। তাদের খাবার দিয়ে, থালা বাসন ধুয়ে, নিজে কোনোরকমে দুটো রুটি-ছেঁচকি মুখে গুঁজে শুতে শুতে সেই রাত দেড়টা। কদিন এরকমই চলছে। সামনে ভোট। পার্টিবাবুরা অনেক রাত পর্যন্ত শহরে ঘুরে ঘুরে মিটিং মিছিল করছে। পোস্টার সাঁটছে। স্টেশনের পাশের মাঠে স্টেজ বেঁধে, লোক জড়ো করে ভাষণ দিচ্ছে। দড়ির গায়ে, কঞ্চির মাথায়, লাঠির ডগায় পতাকা বেঁধে সাজাচ্ছে। ‘ভোট দিন ভোট দিন’ বলে খুব খানিকটা চেঁচিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লে রাতে দলবেঁধে খেতে আসছে। এই সময়টা শ্যামাচরণের ব্যবসা ভালো। সব পার্টির লোকই কমবেশি তার হোটেলে খায়। কেউ ভাত-ডালে খুশি, কারও কষা মাংস লাগে। দু-একজন সাইডের টেবিলে বসে লুকিয়ে বোতল বের করে। ঘন বাদামি রঙের বোতল। গণেশকে বলে, ‘অ্যাই একটা প্লেটে খানিকটা পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা নিয়ে আয় দেখি। দুটো গ্লাস দিবি। গা ব্যথার ওষুধটা খেয়ে নিই। কাল আবার শালার ভোর থেকে খাটনি।’

গণেশ বড় করে হাই তুলল। এখানেই ঘুমোবে, এই গাছতলাতেই। আগেও ঘুমিয়েছে। একটা গামছা থাকলে হত। পাতলেই বিছানা। গামছার মতো নরম গদি হয় না। হাটে, ঘাটে, মাঠে যেখানে খুশি পেতে নাও। না, গামছা একটা কিনতে হবে কিন্তু উপায় নেই। হাতে পয়সা কই? শ্যামাচরণ মাইতির কাছে তিনমাসের মাইনে জমা রয়েছে। দেবে বলে মনে হয় না। আগেও এমন হয়েছে। গাড়ি মেরামতির গ্যারাজ থেকে তাড়াবার সময় তো পুরোটাই মেরে দিয়েছিল। বাজারে হরিনাথ বুড়োর হয়ে ফুলের দোকানে যখন বসল তখনও এক ঘটনা। দু’মাস খাটাল, টাকা দিল এক মাসের। এরা তো ছেঁচড়া, সুযোগ পেলেই লোক ঠকায়, সবাই জানে। ভদ্রলোকের বাড়িতেও এক কাণ্ড। এই তো বছরখানেক আগের কথা। রাতদিনের ফাইফরমাস খাটতে লোকের বাড়িতে কাজ নিয়েছিল। কর্তা গিন্নি দুজনেই কলেজে পড়ায়। পাড়ার লোকে খাতির করে। কিছু হলে ডেকে নিয়ে যায়। মালা পড়ায়। ওরাও নরম নরম কথা বলে। কাজটা দিয়েছিল কনকমাসি একরকম জোর করেই নিয়ে গিয়েছিল।

‘ছোটনোকদের মতো কাজ না করে একটা ভদ্রনোকের বাড়িতে ঢুকে যা দিকিনি গণশা। খাওয়া, পরা, থাকা, মাইনে সব পাবি। তারপর কদিন বাদে নিজেই ভদ্দরনোক হয়ে যাবি। মাস্টারের বাড়ি বলে কতা ‘

গণেশ কাজে ঢুকে একমাসের মধ্যেই বুঝতে পারল ‘ভদ্দরনোক’ না ছাই। কর্তা গিন্নি দুটোই বিরাট বজ্জাত। পচা বাসি খেতে দেয়। একদিন সে বলল, ‘খাব না। পেট ব্যথা করে।’ ব্যস্, চুরির অভিযোগ তুলে কদিন পরেই দিল তাড়িয়ে। পরে গণেশ খবর পেয়েছিল, ওরা নাকি এমনই করে। কাজ করিয়ে মাইনে না দিয়ে লোক তাড়ায়।

শটারদাকে কখনও এসব কথা বলেনি গণেশ। রেগে গেলে মুশকিল। কী করতে কী করে বসবে তার ঠিক আছে।

গণেশ মন্দিরের পাশের টিউবয়েল গিয়ে ভরপেট জল খেল গণেশ। ঘাড়ে মাথায় জলের চাপড় দিয়ে আধখানা ভিজেও নিল। গাছতলায় ফিরে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। দুপুর ঢলে পড়ছে বলে রোদের তেজ যেন কমছে। নাকি কমেনি? যা খুশি হোক। রোদ জলে ঘাবড়ানোর ছেলে সে নয়। কাল থেকে আবার কাজ খুঁজতে হবে। কাজ পেতে অসুবিধে হবে না। গণেশ এই বয়েসেই বুঝে গেছে, যতদিন বয়স কম, ততদিন কাজের অভাব নেই। এ দেশে কাজ চাইলে বড়দের যেমন লাথি ঝাঁটা, শিশু আর বালকদের তেমন কদর। চায়ের দোকান, খাবার হোটেল, ইটের ভাটা, গাড়ির গ্যারাজ, বাবুর বাড়ি, দোকান-বাজারে সবাই নেবার জন্য ছোঁক ছোঁক করছে। বয়স যত কম, তত সুবিধে। টাকা পয়সার বালাই নেই। থাকলেও নামমাত্র, তাও জমা থাকবে। পুরোটা ফেরত না দিলেও চলবে। এদের ঝগড়াঝাঁটি করবার মুরোদ নেই। পেট বাড়েনি, তাই খাওয়াও বাড়েনি। সেখানেও খরচা কম। ছোটদের দিয়ে যেহেতু কাজ করানোর নিয়ম নেই, ডিউটি টাইমেরও নিয়ম নেই। যত খুশি খাটাও। কাক ডাকা ভোর টু প্যাঁচা ডাকা রাত। এই সুযোগ কে ছাড়বে? সুতরাং এই বয়েসে কাজ পেতে সমস্যা নেই।

গণেশ পাশ ফিরল। অনেকদিন শটারদার সঙ্গে দেখা নেই। সেও স্টেশনের দিকে যাওয়ার সময় পায় না। আজ সন্ধের দিকে একবার গেলে হয়। তবে শটারদা কি আসবে? কোনও ঠিক নেই। মাস তিনেক আগে শেষ দেখা হয়েছিল।

‘বুঝলি গণেশ, খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। হেভি বিজি।’

গণেশ বলল, ‘সে তো তুমি সব সময় ব্যস্ত। হয় কাজ, নয় পুলিশের তাড়া।’

শটারদা গাঁজা ভরা সিগারেটে টান দিয়ে বলল, ‘আরে বাবা, সে বিজি নয় রে, আরও বিজি আছে। যাক, তুই ছেলেমানুষ তোকে বলাটা ঠিক হবে না।’

গণেশ বলল, ‘আচ্ছা বল না।’

শটারদা বলল, ‘রাগ করলি?’

গণেশ বলল, ‘ওমা! রাগ করব কেন?’

শটারদা গলা নামিয়ে লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, ‘প্রেম বুঝিস গণশা? মহব্বত, লাভ?’

গণেশ বলল, ‘এমনি বুঝি না, গানে বলে। হোটেলে রেডিও চলে।’

শটারদা ভাসা ভাসা গলায় বলল, ‘আমার মনে হয়, বড় বিপদ হয়েছে। প্রেম হয়েছে গণশা।’

একথায় গণেশের কিছু এসে যায় না। প্রেম হলেই বা কী, না হলেই বা কী। সে বলল, ‘ও।’

শটারদা আরও উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মেয়েটার নাম রানি। দেখতে মোটে ভালো না। গায়ের রং ময়লা। নাক থেবড়া। চোখ কুতকুতে। তারপরেও একবার না দেখলে মনটা খচখচ করে।’

গণেশ বলল, ‘ও, আচ্ছা।’

শটারদা ফস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘একবার যেতেই হয়। খুচখাচ কথা হয়। তোর কথাও বলেছি। তবে সমস্যা কী জানিস গণশা? সমস্যা হল, রানি আসল কথাটা কিছু বলে না। সেও কি আমাকে ভালোবাসে? এটাও একটা হাই থটের ব্যাপার। প্রেম হল দুজনের জিনিস। একজন চুপ মেরে গেলে ঝামেলা। না যায় ধরা, না ছাড়া যায়। বাদ দে এসব। তুই ছেলেমানুষ বুঝবি না।’

খালি পেটের ঘুমে স্বপ্ন থাকে না। আজ দুপুরে গণেশের ঘুমে স্বপ্ন এল। মজার স্বপ্ন। শটারদা শ্যামাচরণের হোটেলে বসে খাচ্ছে। সঙ্গে একটা মেয়ে। গায়ের রং ময়লা, নাক থ্যাবড়া, চোখ কুতকুতে। তারপরেও তাকে দেখাচ্ছে অতি সুন্দর। গণেশে ছুটোছুটি করে দুজনের জন্য খাবার আনছে। একসময়ে মেয়েটি ধমক দেওয়া গলায় বলল, ‘অ্যাই ছেলে, তুমি আর কোথাও যাবে না। আমাদের সঙ্গে বসে খাবে। আর এই দেখ, তোমার জন্য আমি একটা খুব সুন্দর জামা এনেছি। আমাদের সঙ্গে খেতে বসবার আগে পরে নাও।’

গণেশ কী করবে বুঝতে পারছিল না। শটারদার বলল, ‘জামাটা নে গণশা রাণী যখন বলছে কোনও চিন্তা করিস না। ও খুব হাই থটের মেয়ে। তার ওপর তুই একটা ভালো ছেলে। আমার মতো নোস। সৎ পথে খেটে খাস। রানি তোকে পছন্দ করে।’

গণেশের ঘুম ভাঙল ‘ভোট দিন, ভোট দিন’ শ্লোগানে। রাস্তা দিয়ে মিছিল চলেছে। সন্ধে নেমেছে। চোখ খুলতে দেখল, দাঁড়িয়ে আছে ডালপঞ্চু।

‘চল। মালিক ডাকছে।’

গাছতলা থেকে নামতে নামতে গণেশ সিদ্ধান্ত নিল, অনেক হয়েছে। আর পরের কাছে কাজ নয়। নিজেই কিছু করবে।

‘না, যাব না। মালিককে বলে দাও। জমা টাকাও দিতে হবে না। যা ভেঙেছি দাম দিয়ে দিলাম।’

পার্টিবাবুরাও হল্লা করতে করতে রেল স্টেশনের মাঠের দিকে চলেছে। নিশ্চয় সভা হবে। গণেশও স্টেশনের পথে হাঁটা দিল। হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, আচ্ছা, সভার পর ফেলে দেওয়া বাঁশ, কঞ্চি, লাঠি, পতাকা, ফেস্টুন কুড়িয়েবাড়িয়ে, জড়ো করে বিক্রি করলে কেমন হয়? খারাপ হবে কেন? দেখাই যাক না। এত হট্টগোলের সভা থেকে রাতের রুটি ডালের দামটুকু তো উঠবে না?

মাঠে একা দাঁড়িয়ে আছে গণেশ।

এখন কত রাত? বারোটা? একটা? নাকি দুটো? যা কিছু হোক। গণেশের কিছু এসে যায় না। সভা শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। চারধার শুনশান। জনমনিষ্যি নেই। শুধু মাঠের এককোণে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে মঞ্চের কঙ্কাল।

প্ল্যান মতো কাজ হয়নি গণেশের। ফেলে দেওয়া বাঁশ, কঞ্চি, লাঠি, পতাকা, ফেস্টুন কিছুই জড়ো করতে পারেনি। পারবে কী করে? সন্ধেবেলা স্টেশনে পৌঁছে খবর পেল, শটারদার ডেডবডি নিয়ে আসছে পুলিশ। কালরাতে রেললাইলের ওপরই গুলি খেয়েছে। সেই বডি এসে পৌঁছোল অনেক রাত করে। বস্তায় মোড়া। এমন হতচ্ছেদ্দা করে নিয়ে যাচ্ছে, যেন ডাস্টবিনে ফেলে দেবে। গণেশ কাছে গেলে পুলিশ বলল, ‘ভাগ শালা।’ গণেশ অন্ধকার প্ল্যাটফর্মে গায়ের রং ময়লা, নাক থেবড়া, চোখ কুতকুতে একটা মেয়েকে খুঁজতে লাগল।

রাত আরও বাড়লে, নিশ্চুপ, নিষ্ঠুর শহর মাড়িয়ে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে মাঠে চলে এসেছে গণেশ। তার কোনও দুঃখ নেই। থাকবে কেন? কঠিন জিনিস সহজভাবে নিতে শিখে গেছে না? নিচু হয়ে একটা কঞ্চি হাতে তুলে নিল। মাঠে পড়ে থাকা, পতাকা খোলা একটা ভাঙা কঞ্চি

এই মুহূর্তে গণেশ হাতে কঞ্চির তরবারি নিয়ে স্টেজে লাফিয়ে লাফিয়ে, নেচে নেচে যুদ্ধ করছে। কার সঙ্গে? কে জানে। নিশ্চয় খিদের চোটে মাথা খারাপ হয়ে গেছে বেচারির। ছোট মানু তো। কতক্ষণ আর খিদে সহ্য করবে। তবে লাগছে বেশ। নাটকের রাজার মতো। আর তো কেউ আলো জ্বালাবার নেই, তাই আকাশের একপাশে হেলে পড়া চাঁদ তার ওপর নরম আলো ফেলছে। যেন বলছে, ‘দেখ, দেখ সবাই একবার একজন গণেশকে দেখ।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *