এই দুনিয়ার এমন মজা
এই দুনিয়ার মজাই হলো ওই! এখানে সব কিছুই বদলে যায়। তার মানে, আগে যে-রকম ছিল সেই রকমটি আর থাকে না। অন্য রকম হয়ে যায়। এই বদলের একটুও বিরাম নেই।
এই তো সে বছর কিনে আনলুম একটা ছাতা। কুচকুচে কালো রঙ। টাকের ওপর সেই ছাতা বাগিয়ে যখন রাস্তায় ঘুরে বেড়াই তখন মনটা গর্বে যেন নেচে ওঠে—আড় চোখে চেয়ে। দেখি আর পাঁচ জন চেয়ে দেখছে কি না। কিন্তু ও হরি! বছর তিনেক ঘুরতে না ঘুরতে দেখি আমার সেই নতুন ছাতাটা বদলে গিয়ে অন্য একটা ছাতা হয়ে গিয়েছে। কোথায় গেল সেই কুচকুচে কালো রঙ, ঝলমলে সেই নতুন ছাতাটা! তার বদলে দেখি ছাতাটার রঙ হয়েছে ফ্যাকাশে হলদে মতো, চেহারাটা হয়েছে ধ্যাড়ধ্যাড়ে, নড়বড়ে-পুরনো ছাতার চেহারা যে-রকম হয়। হাতে নিতে ব্যাজার লাগে। রাস্তায় বেরিয়ে ভাবি, কেউ চেয়ে দেখছে না তো! না দেখলেই ভালো। নেহাত টাক-ফাটা রোদ, নইলে, ওটাকে বয়ে বেড়াতে বয়ে যেতো।
ছিল নতুন চটকদার ছাতা। সেটা বদলে অন্য ছাতা হয়ে গেল। লক্কড় এক ছাতা।
কিন্তু কবে বদলালে? কখন বদলালো?—এই কথা ভেবে দেখতে গেলে একটু থতমত খেয়ে যাই। তাই তো! ছাতা-ছাড়া আমি এক পা-ও বেরোই না। তার মানে, রোজই ওই ছাতা হাতে বেরোচ্ছি। বেরোতে বেরোতে একদিন দেখি নতুন ছাতাটি আর নেই। অথচ, রোজই মনে হয়েছে সেই ছাতাটাই। এমন তো নয়, যে একদিন ভোর বেলা উঠে দেখলাম সেই নতুন ছাতাটা রাতারাতি বদলে গিয়ে একটা পুরনো ছাতা হয়ে গিয়েছে। তাহলে? তাহলে মানতেই হবে ছাতাটা রোজই বদলেছে। কিন্তু এমনভাবে বদলেছে যে চোখে পড়ে নি। তার মানে, বদলটা বড় মিহি। এমন মিহি যে চোখে পড়ে না। কিন্তু চোখে ধরা পড়ুক আর নাই পড়ুক বদলটা পুরোদমেই চলেছে। তার বিরাম নেই।
দুনিয়ায় বদলের শেষ নেই। বদলের বিরাম নেই। কিন্তু তার মধ্যে কতকগুলো বদল আছে যা আমাদের চোখে ধরা পড়ে, কতকগুলো বদল আছে যা আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। হয়তো একদিন শুরু হলো ভূমিকম্প ঃ পাহাড়ের চূড়ো দিয়ে ঠিকরে বেরোতে লাগলো আগুনের হলকা, কাঁপতে শুরু করলো পৃথিবীর বুক, আর সেই কাঁপুনীতে চিড় খেয়ে দুফাঁক হয়ে গেল একটা পাহাড়, ফেটে চৌচির হয়ে গেল একটা বিরাট মাঠ। সকাল বেলায় উঠে দেখি পাহাড়টা যে-রকম ছিল সে-রকম আর নেই, মাঠটা যে-রকম ছিল সে-রকম আর নেই! বদলে গিয়েছে। অন্য রকম হয়ে গিয়েছে। এই যে বদল, এ-বদলকে চোখে দেখতে পাওয়া গেল। কিন্তু সব রকমের বদল এই রকমের নয়। কতকগুলো বদল এমন মিহি আর এমন আস্তে আস্তে হয় যে সেগুলোকে চোখে দেখতে পাওয়া যায় না। আজকে দেখলাম। একটা ছেলে রাস্তায় ডাং-গুলি পিটছে; কিন্তু বছর কতক পরে দেখবো সেই ছেলেটা আর সেই ছেলেটা নেই। ফিটফাট এক ভদ্রলোক হয়ে গিয়েছে, গটগট করে আপিস চলেছে। তারপর, আরো কিছু বছর পরে যদি তাকে দেখি তাহলে দেখবো সেই মাঝবয়সী আপিসের বাবুও আর নেই। তার বদলে একটি বুড়ো থুত্থুড়ে লোক রোয়াকে বসে নাতিদের রূপকথা শোনাচ্ছে।
কিন্তু সেই ডাং-গুলি খেলোয়াড় বদলে গিয়ে কবে এই দাদু হয়ে গেল? নিশ্চয় রোজই বদলেছে, সব সময় ধরে বদলেছে, প্রতি মুহুর্তে বদলেছে। কেবল বদলটা এমন মিহি যে চোখে ধরা পড়ে না।
পৃথিবীতে যতো সব গাছ-পালা, জীব-জন্তু, সব কিছুর বেলাতেই এই কথা। সব কিছুই বদলে যাচ্ছে। অবিরাম বদলে যাচ্ছে। কেবল, সেই বদল এমন মিহি যে আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। তবে এই বদলটা শুধু কচি বয়েস বদলে বুড়ে বয়েস হয়ে যাবার মতো বদল নয়। কচি-বয়েস বদলে বুড়ো-বয়েস হবার কথা তো আছেই। তাছাড়াও আরো একরকম বদল আছে। সেইটাই দারুণ মজার। সেটা হলো, এক রকম জানোয়ার বদলে বেবাক আর এক রকম জানোয়ার হয়ে যাবার ব্যাপার। যেমন ধরো, অনেকদিন আগে এক রকমের জানোয়ার ছিল, সেগুলোকে যেন শেয়ালের মতো দেখতে। তাদের নাম দেওয়া হয় ইয়োহিপাস। অনেক হাজার বছর ধরে সেই জানোয়ারগুলোর বংশ বেড়ে চলেছেঃ বাচ্চার পর বাচ্চা, আবার তার বাচ্চা, আবার তার বাচ্চা, তাদের বাচ্চা-এই রকম অনেক অনেক দিন ধরে। আর শেষ পর্যন্ত সেই অদল বদলের ফলে ওই জানোয়ারদের চেহারা বদলে গিয়ে একেধারে অন্য-রকম হয়ে গেল। কী-রকম হয়ে গেল তা শুনলে অবাক হয়ে যাবে। কেননা, আজকের দিনে যে-সব ঘোড়া চিঁহি চিঁহি করছে আর ঘাস খেয়ে ঘুরছে সেই ঘোড়াগুলোই হলো ওই অনেক হাজার বছর আগেকার শেয়ালের মতো দেখতে ছোটো ছোটো ইয়োহিপাসদের বংশধর।
দুনিয়ায় ক্রমাগতই এই রকম ব্যাপার চলেছে! এক রকমের জানোয়ার বদলাতে বদলাতে শেষ পর্যন্ত অনেক হাজার বছর পরে এক্কেবারে অন্য রকমের জানোয়ার হয়ে যায়। তবে জানোয়ারগুলোর দিকে তুমি-আমি এমনি যদি চেয়ে দেখি তাহলে এই বদলটা আমাদের চোখে পড়বে না। বড় মিহি এই বদল। কিন্তু, তুমি-আমি যদি চোখে দেখতে না পাই তাহলে এই বদলের খবরটা জোগাড় করলে কে? ওঃ, সে এক ভারি মজার ছেলে। তার নাম চার্লস ডারউইন।