এই দিন তো দিন নয়
প্রাথমিক শিক্ষার উপর আমি কয়েকটা টিভি স্পট তৈরি করে দিয়েছি। ইদানীং এগুলি দেখানো হচ্ছে। আপনাদের চোখে পড়েছে কি? ঐ যে একটিতে লম্বা চুলওয়ালা এক বয়াতীকে দেখা যায়, সে এক দল বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে গান গাইতে গাইতে এগুতে থাকে—
এই দিন তো দিন নয় আরো দিন আছে
এই দিনেরে নিবে তোমরা সেই দিনেরো কাছে…
এক পর্যায়ে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মত সে সবাইকে নিয়ে যায় স্কুলের। দিকে। এখন কথা হল, যাদের জন্যে এই জিনিসটা তৈরি করা, তারা কি এটা দেখছে? এর কোন প্রভাব কি পড়ছে? না-কি অর্থ, শ্রম ও মেধাই সবাই মিলে নষ্ট করছি?
স্কুলের সময় চোখ খুলে তাকালে অস্বস্তিকর একটা দৃশ্য দেখা যায়। হাসিখুশি। ছোট ছোট বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে। তাদের ভারী স্কুলব্যাগ যারা টানছে তাদের অনেকের বয়সই স্কুলযাত্রীদের কাছাকাছি। এদের দায়িত্ব আপামণিদের বইয়ের ব্যাগ। স্কুলে পৌঁছে দেয়া।
আমাদের অনেকের বাড়িতেই অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েরা কাজ করে। তাদের কাজ শুরু হয় সূর্য ওঠার আগে, শেষ হয় গভীর রাতে। তাদের কাছে লেখাপড়া অনেক দূরের ব্যাপার। টিভিতে বিজ্ঞাপন প্রচারের আগে লেখাপড়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ওদের শিক্ষিত করার আগে শিক্ষিত করতে হবে তাদের, যারা শিক্ষিত হয়েই আছেন। মোটিভেশনাল ছবি এদের জন্যেই আগে করা দরকার।
আমার সঙ্গে এক ভদ্রলোক খুব তর্ক করলেন–সবাই শিক্ষিত হলে দেশ চলবে? একটা এম, এ. পাস ছেলে হাল চালাবে? শিক্ষিত বেকার দিয়ে হবে কি? এতগুলি বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েই বা হবেটা কি? বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আমাদের কি শেখাচ্ছে? সন্ত্রাস ছাড়া আর কি?
।এদের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। এরা সবকিছুই উল্টো দিক থেকে দেখেন। গোলাপ ফুল এনে দিলে প্রথমে খোঁজেন কাঁটা। তারপর ফুল। ফুল দেখে মুগ্ধ হয়ে কাঁটা অগ্রাহ্য। করার ক্ষমতা আমাদের দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা কেন জানি ছায়াটা আগে দেখতে শুরু করেছি।
আমি এক ডাক্তার সাহেবকে চিনি, যিনি তার সারাজীবনের সঞ্চয়ের একটা বড় অংশ দিয়ে তার নিজ গ্রামে স্কুল এবং কলেজ করে দিলেন। গ্রামে রটে গেল, ডাক্তার সাহেব ইলেকশন করবেন। এসব তারই প্রস্তুতি। কেউ কেউ বললেন, বহু রোগী মেরে পাপ কামিয়েছে। এখন পাপ কাটানোর চেষ্টা।
মানুষের মুখের এসব কথায় কিছুই আসে যায় না। যা সত্য তা-ই টিকে থাকে। অসত্য স্থায়ী হয় না। সৌভাগ্যক্রমে সত্যকে ভালবাসেন, এমন মানুষের সংখ্যাই এই সমাজে শুধু যে বেশি তাই না, অনেক। এইসব মানুষ সমাজে প্রভাবকের মত কাজ করেন। একজন মন্দ মানুষকে দেখে আমাদের মন্দ হবার ইচ্ছা জাগে না। কিন্তু একজন ভালমানুষকে দেখে ভালমানুষ হতে ইচ্ছা করে।
আমার ছোটবেলায় সিলেটের মীরাবাজারে আমাদের বাসার পাশে একজন। ওভারশীয়ার থাকতেন। তিনি রোজ সন্ধ্যাবেলা তার ছেলে-মেয়েদের পড়াতে বসতেন। কাজের ছেলে ছিল, তাকেও পড়তে বসতে হত। এই ছিল কঠিন নিয়ম। পুরনো। ছেলেটি চলে যাবার পর নতুন কেউ এলে তার জন্যেও এই ব্যবস্থা। এ বাড়িতে কাজ নিলে পড়াশোনা করতে হবে এই ভয়ে কেউ তার বাসায় কাজ নিত না।
ভদ্রলোকের এই সৎগুণটি আমার মাকে প্রভাবিত করে। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখি, আমার মাও বাসায় এই নিয়ম চালু করেছেন। মার বাসায় যেই কাজ করবে। তাকেই পড়তে হবে। মা নিজেই পড়ান। আমার মার বেলায় সবই পণ্ডশ্রম হয়েছে। তিনি কাউকেই পড়ালেখা শেখাতে পারেননি। জানি না এর কারণ কি।
মার ব্যর্থতা পুষিয়ে দিয়েছে আমার মেজো মেয়ে শীলা। তার কাণ্ডকারখানা বেশ। মজার। সে তখন পড়ে ক্লাস ফাইভে। প্রায়ই দেখা যায়, সন্ধ্যাবেলা সে কাজের মেয়েদের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমরা খুবই বিরক্ত হই। দরজা বন্ধ করে। সে করে কি? জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। মাথা নিচু করে থাকে।
আমার স্ত্রীর ধারণা হল, সে নিশ্চয়ই দরজা বন্ধ করে কাজের মেয়েগুলির সঙ্গে। গল্পগুজব করে। এটা ভাল লক্ষণ না। এদের কাছ থেকে সে আজেবাজে গল্প : শুনবে। শীলাকে একদিন প্রচণ্ড বকা দেয়া হল। তারপর রহস্য ভেদ হল। হেলেনা। নামে আমাদের ১২/১৩ বছর বয়েসী একটি কাজের মেয়ে আছে, তার লেখাপড়া। শেখার খুব শখ। সে শীলাকে ধরেছে। শীলা তাকে লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব। নিয়েছে। অনেকদূর না-কি শিখিয়েও ফেলেছে।
আমি পরীক্ষা নিতে গিয়ে চমৎকৃত হলাম। সত্যি সত্যি হেলেনা মেয়েটি পড়তে শিখেছে। বানান করে করে সুন্দর পড়তে পারে। আমি আমার মেয়েকে বললাম, মা, তুমি যে এই কাজটা করছ–গোপনে করছ কেন?
তোমরা যদি বকা দাও, এই জন্যে গোপনে করছি।
আমার এত ভাল লাগল যে বলার নয়।
আমার জীবনে অনেক আনন্দময় ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু এত আনন্দময় ঘটেনি। আমি আমার মেয়েকে পুরস্কার দিলাম।
আমার মেয়েটা জানে না সে কত বড় একটা কাজ করেছে। আমি জানি। পড়তে পারার মত আনন্দ আর কিসে আছে? মনের ভাবকে চিরস্থায়ী করে রাখার ক্ষমতা পরম করুণাময় মানুষকে দিয়েছেন। সে লিখতে পারছে। পশুদের সেই ক্ষমতা দেয়া হয়নি।
তারপরেও দেখি, মানুষ হয়েও একদল পড়তে পারছে না। লিখতে পারছে না। তারা থেকে যাচ্ছে পশুর স্তরে। ওদেরকে টেনে তুলে আনার দায়িত্বও আমরা অস্বীকার। করছি। আমাদের বাংলা ভাষায় খারাপ গালাগালির একটি হচ্ছে মুর্খ। অন্য ভাষায় সে রকম নেই। একজন ইংরেজ অন্য একজনকে gnorant বলে গালি দেয় না। এটা। প্রমাণ করে–জাতিগতভাবে শিক্ষাকে আমরা কত উচুতে স্থান দেই। শিক্ষার প্রতি যে জাতির এত মমতা সেই জাতি কেন সর্বসাধারণকে শিক্ষার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করবে না?
ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এ কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। এই টাকার একটি অংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করলেও কিন্তু ঈপ্সিত ফল পাওয়া যেত। একজন শিক্ষিত মানুষকে। বোঝানো অনেক সহজ।
আমার ভাবতে ভাল লাগে, এমন একদিন আসবে যেদিন আমাদের দেশের সব মানুষ লিখতে জানবে, পড়তে জানবে। এটা তেমন কোন কঠিন ব্যাপারও নয়। যদি আইন করে দেয়া যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা উচ্চশিক্ষা নিতে আসবে তারা অতি অবশ্যই দুজনকে লিখতে এবং পড়তে শিখিয়ে তারপর আসবে।
সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়তে আসার জন্যে এটা হবে অবশ্যপালনীয় শর্ত।
অনেক কঠিন কঠিন কথা বলে ফেললাম–একটা গল্প বলে শেষ করি। আমরা। তখন বগুড়ায় থাকি। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে দিয়েছি। হাতে প্রচুর অবসর। দিনরাত। গল্পের বই পড়ি। একদিন সতীনাথ ভাদুড়ির অচিন রাগিণী পড়ছি। পড়তে পড়তে চোখে পানি এসে গেল। লজ্জিত হয়ে চোখ মুছছি। তখন দেখি, আমাদের বাসার ঠিকা কি অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। সে বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলে–এমন কি আছে এখানে যা পড়ে একজন কাঁদতে থাকে? বইয়ের ভেতর কোন দুঃখ ভরে দেয়া হয়েছে?
আমি তাকে বোঝাতে পারলাম না। সে বইটা হাতে নিয়ে দেখতে চাইল। আমি বইটা তার হাতে দিলাম। সে নেড়ে চেড়ে দেখল। গন্ধ শুকল। আমার মাকে গিয়ে বলল, দাদা যখন বই পড়তে পড়তে কান্দে তখন যে কি সুন্দর লাগে!
পাঠকের এই সৌন্দর্য আমরা অবশ্যই সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেব। এই দিন তো দিন নয় আরো দিন আছে। এই দিনেরে নেব আমরা সেই দিনেরো কাছে।
অসাধারণ চিন্তাধারা।