এই দাহ – ৫

আজকাল এমনিই হচ্ছে গোলোকের। যে নির্লিপ্তির মধ্যে সে হাসপাতালের দেড়টা বছর কাটিয়েছে, এই ঘরে একটা বছর কাটিয়েছে, সেই ভাবটা তার নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও সে মনকে শান্ত সুস্থির রাখতে পারছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, তার উপর যেন অবিচার করা হয়েছে। 

কে অবিচার করল, সেটা স্পষ্ট নয়। হয়তো সবাই, হয়তো একজন কেউ। কাকে সে দোষ দেবে? 

হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সত্যব্রতের মুখেই সে খবরটা পেয়েছে, ঝর্না বিয়ে করেছে। করুক বিয়ে। অন্যায় দাবি কেন করবে গোলোক। সেদিক থেকে ঝর্না অন্যায় কিছু করেনি। গোলোক নিজেই বরং সরে এসেছে। আজও ঝর্না গোলোকের ঠিকানা জানে না। যেদিন সে জানতে পেরেছিল, সাংঘাতিক ব্যাধি তাকে আক্রমণ করেছে, সেইদিনই গোলোক সরিয়ে ফেলেছে নিজেকে। সকলের আগে ঝর্নাকেই জানিয়েছিল গোলোক। তারপর দাদাকে। 

হাসপাতালে চিঠি লিখত ঝর্না। প্রথম দিকে গোলক পড়ত। বড় যন্ত্রণা পেত সে। তারপর থেকে ঝর্নার চিঠি রাখাই বন্ধ করে দিল। ঠিকানা কেটে ফেরত পাঠিয়ে দিত। কী লাভ শুধু শুধু হৃদয় খুঁড়ে বেদনা বাড়িয়ে। একদিন ঝর্নার চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল। গোলোক দুঃখ পেয়েছিল বই কী? কিন্তু তা অসহনীয় নয়। 

সেই ঝর্না বিয়ে করেছে। বলবার কিছু নেই। কিন্তু ঝর্না সত্যিই কি ভালবেসে বিয়ে করেছে? গোলোকের খচখচানি এইখানে। যে ওকে পড়াত, তাকেই বিয়ে করেছে ঝর্না। 

তুমিও ওকে পড়াতে গোলোক। তোমাকেও ঝর্না বিয়ে করতে চেয়েছিল। 

না, না, অত সোজা নয়। ঝর্নাকে যা ভাবছ, অত লঘু মেয়ে সে নয়। আমি জানি ওকে। আমি ওকে ভাল করে চিনি। 

ঝর্না তখন স্কুলের ছাত্রী। গোলোক বি. এ. পাস করে আর্ট কলেজে গিয়ে ঢুকেছে। গোলোকের দাদা তখনও এমন ফেঁপে ওঠেন নি। চাকরি-বাকরির চেষ্টা না করে আর্ট কলেজে ভর্তি হতে গোলোকেরও ওপর তিনি একটু অসন্তুষ্টই হয়েছিলেন। যাহোক একটা চাকরি-বাকরি জুটিয়ে নিতে পরামর্শও দিয়েছিলেন। ছবি আঁকলে পেট চলবে না, এ কথা বার বার জানিয়েছিলেন। গোলোক গ্রাহ্য করে নি। সে তখন একটা টিউশানি খুঁজে বেড়াতে লাগল। 

ঝর্নার বাবা গোলোককে দেখেই পছন্দ করে ফেললেন। এক কথায় গোলোক পড়াতে লেগে গেল ঝর্নাকে। ঝর্না তখন ক্লাস এইটের ছাত্রী। ফ্রক পরত, পিগটেল বিনুনি বাঁধত আর আইসক্রিম চুষতে ভালবাসত। আর গোলোক তখন বি. এ. পাস করেছে। ভ্যান গগ পিকাসো হবার স্বপ্নে মজে আছে। 

ঝর্নার বুদ্ধিশুদ্ধি খারাপ ছিল না। তবে পড়াশুনায় মন দিত না। গোলোকের বড় বিরক্তি লাগত। তার মনে হত, কটা টাকা পাবার জন্য অমূল্য সন্ধেগুলো নষ্ট করে ফেলছে গোলোক। প্রথম বছরটায় কতবার সে বিরক্ত হয়েছে, ঝর্নার অমনোযোগিতায় খেপে উঠেছে। কতবার তার ইচ্ছে হয়েছে, এ-টিউশানি ছেড়ে দেবার। দু-একদিন এমন সঙ্কল্পও করেছে, এই শেষ, আজই শেষ করে দিয়ে আসবে। বলবে ঝর্নার বাবাকে, অন্য লোক দেখুন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বলেনি গোলোক। রোজকার মতো হোম টাস্ক দিয়ে উপদেশ দিয়ে এসেছে—ভাল করে পড়ো ঝর্না, নইলে পাস করতে পারবে না। ঝর্না জবাব দিত, তাতে আপনারই নাম খারাপ হবে মাস্টারমশাই। গোলোকের ইচ্ছে হত, ঠাস করে একটি চড় মারবার। কিন্তু কোনওদিন সে এসব ভাব প্রকাশ করেনি। 

ক্লাস টেনে উঠেও ঝর্না ফ্রক পরছিল, পিগটেল বাঁধছিল। সে-সময়কার ঝর্নার চেহারা কেমন ছিল গোলোক বলতে পারে না। মনে কোনও ছাপ নেই তার। 

সেই ঝনাই গোলোকের মনে স্থায়ী ছাপ রাখল সেইদিন, যেদিন গোলোক ওকে প্রথম শাড়ি-পরা অবস্থায় দেখল। সেদিন বিকাল থেকে কালবৈশাখী ভেঙে পড়েছিল কলকাতায়। ছুটির পর কলেজেই ওরা আটকে গেল। তারপর ঝড়ের মাতামাতি শেষ হল, বৃষ্টির তেজ কমল। আর গোলোক যাবে না যাবে না করেও ভিজতে ভিজতে যখন ঝর্নাদের বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ল, তখন একটু রাতই হয়েছে। 

তবু কড়া নাড়ল গোলোক। এসেছে যখন তখন হাজরেটা অন্তত দিয়ে যাক। খুট করে ভিতরে আলো জ্বলল, মুহূর্তে দরজা খুলল। গোলোকের চোখ ধাঁধিয়ে একটা বিদ্যুৎ যেন স্থির হয়ে দরজার ফ্রেমে আটকে গেল। 

ঝর্নাও একটু অবাক হয়েছিল। পরক্ষণেই খুশিতে ফেটে পড়ল। 

“ওমা, মাস্টারমশাই! ভিজে নেয়ে উঠেছেন যে, বেশ হয়েছে। উঠে আসুন, উঠে আসুন। এই বৃষ্টিতে কে আসতে বলেছে। এখন যদি অসুখ করে!” 

এ কার সামনে দাঁড়িয়ে আছে গোলোক? কে তাকে ভিতরে যেতে ডাকছে? ঝর্না? এ কোন ঝর্না? 

শাড়ি-জড়ানো যে-মেয়েটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সে তো ফ্রকের খোলসে ঢাকা গুটিপোকা নয়, এ যে পাখা-মেলা প্রজাপতি। গত দু বছর ধরে সে একেই পড়িয়েছে নাকি? গোলোকের রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। 

ধীরে ধীরে ভিতরে উঠে এল। বিস্ময়ে একেবারে অবাক হয়ে গেল। অবাক চোখে দেখতে লাগল ঝর্নাকে। ঝর্না গোলোকের ঐ তীব্র মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে প্রথমটা বিব্রত হয়ে পড়েছিল। পরমুহূর্তেই তার চোখে খুশির ঝিলিক খেলে গেল। পুরুষকে বেকায়দায় ফেললে মেয়েদের চোখে হামেশা যে ঝিলিক খেলে। শুধু চোখে নয়, মুখের ডৌলে, ঠোঁটে, দেহের প্রতিটি রেখায় স্পষ্ট এক স্পর্ধিত অস্বীকার ফুটে উঠল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঝর্না যেন এতদিনকার অসাম্যের ব্যবধানকে কমিয়ে ফেলল। 

ঝর্নার চোখ, ঠোঁট, দেহের প্রতিটি অংশই যেন হেসে উঠতে লাগল। পুরুষ-খেলানো হাসি। ঝর্না আঁচল দিয়ে আঙুল জড়াতে লাগল। ঠোঁট কামড়াল বার দুয়েক। কটাক্ষ করল। কিন্তু ঝর্নাকে কিছুই করতে হল না। সব এক এক করে আপনা থেকেই ঘটতে লাগল। গোলোকের প্রতি রক্তকণিকার কোষে কোষে প্রবল তীব্র আনকোরা এক নতুন অনুভূতির স্রোত শিরশির করে বইতে লাগল। 

“আমাকে কেমন দেখতে লাগছে মাস্টারমশাই?” 

ঝর্নার আচমকা প্রশ্নে চমকে উঠল গোলোক। সে দেখল তার এই ভাবান্তরে একটা দ্যুতি খেলে গেল ঝর্নার চোখে। 

গোলোক বলল, “খুব সুন্দর।”

ওর গলার স্বর কেঁপে গেল। আওয়াজটা ভাল করে বের হল না। 

গলাটা সাফ করে গোলোক বলে উঠল, “তোমাকে চেনাই যাচ্ছে না। যেন অন্য কেউ।”

ঝর্না সঙ্গে সঙ্গে—যাঃ বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠল। 

বলল, “দাঁড়ান, বাবাকে বলে দিচ্ছি।”

ভয় পেয়ে গোলোকের মুখ শুকিয়ে গেল। ঝর্না আবার খিলখিল করে হেসে উঠল। 

বলল, “কী ভীতু, কী ভীতু! বাবা নেই, মা নেই। মামাবাড়িতে গিয়ে সব আটকা পড়েছে। বাড়িতে আমি একা।”

বলেই ভিতরের দিকে ছুট দিল। আচমকা এক উত্তেজনার দমকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল গোলোক। একটি কথায় এত বিপর্যয়। একা! সে আর ঝর্না এতবড় বাড়িটার ছাদের নীচে একা! পড়ার ঘরে এগিয়ে যাবে গোলোক, পারল না। বাড়ির বাইরে চলে যাবে, পারল না। গোলোকের রক্তে আজ প্রথম ঝড় তুলল ঝর্না। পড়ার ঘর থেকে ঝর্না খানিক পরে ডাক দিল। গোলোক অতি কষ্টে এগিয়ে গেল। দেখল পড়ার টেবিলে হেলান দিয়ে ঝর্না দাঁড়িয়ে আছে। আর তার মুখে চোখে সেই খেলা শুরু হয়েছে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে উঠেছিল গোলোকের। 

কর্কশ, চেষ্টা-করে-আনা স্বরে গোলোক কোনমতে বলল, “এক গ্লাস জল খাওয়াতে পারো?” 

অমনি ঝর্নার ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। যেন, এখন গোলোক যে জল চাইবে ঝর্না জানত। 

‘আনছি’ বলে কটাক্ষ হেনে ঝর্না ভিতরে চলে গেল। 

একটু পরেই কাচের গেলাসে জল নিয়ে এল। হাত বাড়িয়ে জল নিতে গিয়ে ঝর্নার আঙুলে ওর আঙুল ঠেকে গেল। ঝর্নার চোখ দুটো চিকচিক করে হেসে উঠল। যেন বলল, এই ভাবেই শুরু হয়। গোলোকের দেহ বিদ্যুৎশক্তির ঘা খেয়ে চমকে উঠল। গোলোকের হাত থেকে গেলাসটা ফস্কে মাটিতে পড়ে খানখান হয়ে ভেঙে গেল। গোলোকের বুকটা কেঁপে উঠল ভয়ে। 

ঝর্না গোলোকের দিকে তিরস্কার করা দৃষ্টিতে একবার চাইল। পরক্ষণেই হাসতে হাসতে বলল, “বেশ হয়েছে! যেমন অন্যমনস্ক! মা-রা এসেছে, দাঁড়ান সব বলে দিচ্ছি।”

ঝর্না দরজা খুলেই, “ওমা, নতুনদি তুমিও এসেছ, বাঃ, বাঃ। বেশ হয়েছে। রাত্তিরে থাকবে তো?” 

নতুনদি বলল, “আর কি পিসিমা, তোমার মেয়ে তো দিব্যি বিয়ের জুগ্যি হয়ে উঠেছে।”

“যা অসভ্য!” বলে ঝর্ণা নতুনদির পিঠে এক কিল মারতেই সবাই জোরে হেসে উঠলেন। 

নতুনদি বলল, “আয়না দিয়ে দ্যাখ না বাঁদর। সত্যি তোকে যে আমার চাইতেও বড় দেখাচ্ছে রে।”

ঝর্না খিলখিল করে হাসতে হাসতে নতুনদির হাত ধরে পড়ার ঘরে ঢুকে পড়ল। বলল, “সাবধানে পা ফেলিস নতুনদি, মাস্টারমশাই গেলাস ভেঙে ফেলেছেন। মাস্টারমশাই, আজ আমার কিন্তু ছুটি।”

গোলোক আবার অবাক হয়ে গেল! দেখল এ একেবারে সেই আগের ঝর্না—চেনা ঝর্না, ছাত্রী ঝর্না। চোখের চাউনি আগের মতই সরল, তাতে লুকোনো কোনও অর্থ নেই। তাতে অস্বস্তির কোনও উপাদান নেই। 

সত্য বলতে কি, গোলোক যেন দোটানায় পড়ে গেল। ঝর্না আসে, পড়ে, চলে যায়। তার চোখে, ঠোঁটে, মুখে সেই ঝিলিক আর দেখতে পায় না গোলোক। যে-মায়ার খেলা সেই সন্ধ্যায় ঝর্নাকে নাবালিকা-জীবনের সীমান্ত থেকে এক টানে নারীত্বের দরজায় পৌঁছে দিয়েছিল, ঝর্নার মধ্যে সেই মায়ার ছিটেফোঁটাও নেই এখন। এতে সুবিধে হয়েছে এই, ঝর্নার সামনে সে আগের মতোই সহজে, কর্তৃত্বের গদিতে এঁটে বসতে পারে। সেই রাত্রে লহমায় লহমায় ঝর্না যেমন দুজনের মধ্যেকার ব্যবধান কমিয়ে এনেছিল, এখন আবার সে ব্যবধান আগের মতোই বেড়ে গেছে। এতে এক পরম স্বস্তি এই যে, গোলোক আবার তার মাস্টারির মুখোস অনায়াসে এঁটে নিতে পেরেছে। 

কিন্তু গোলোক এতে যে খুশি হয়েছে, একথা বললে মিথ্যে বলা হবে। এই নিস্তরঙ্গ ঝর্নার সামনে এলে সে একটুও বিচলিত হয় না বটে, কিন্তু প্রতিদিন, দরজার কড়া নাড়বার পর কী এক প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে থাকে। আবার সেই চমকটা দেবে না কি ঝর্না! না, প্রত্যহ যে দরজা খুলে দেয়, সে সাধারণ ঝর্না। তার চোখে কোনও এক স্কুলের মেয়ে। 

রোজ এমনিভাবে গোলোকের আশাভঙ্গ হত। একটু বুঝি হতাশার কামড়ও খেত। তারপর আবার সে মনকে গুছিয়ে নিয়ে পড়াতে বসত। পড়িয়ে চলে যেত। 

গোলোকের মন অস্থির হয়ে উঠত রাত্রির নিভৃতে। সেই ঝিলিক-মারা ঝর্নার দেখা পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ত। তার কল্পনায়, স্বপ্নে সেই ঝর্নার মূর্তিখানি একটু একটু করে তৈরি হয়ে উঠত। তখন গোলোক অপূর্ব এক সুখানুভূতির জোয়ারে ভাসত। এই সুখ পাওয়া ভাবটা কয়েকদিন ধরে আচ্ছন্ন করে রাখত গোলোককে। গোলোক রঙ তুলি নিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করল। অনেক এঁকে, অনেক ছিঁড়ে, অনেক যন্ত্রণায় ভুগে অনেকদিন পরে ছবিখানা শেষ পর্যন্ত শেষ করতে পেরেছিল। একখানা ছবিতেই গোলোক আর্টিস্ট মহলে বিখ্যাত হয়ে গেল। গোলোক তার নাম দিয়েছিল ‘কুঁড়ি থেকে ফুল’। 

অনেকদিন ছবিখানা সে কাউকে দেখায়নি। শুধু নিজেই দেখত। বলতে গেলে সত্যব্রতই ওটাকে বের করে এনেছিল সকলের সামনে। ওদের কলেজের বার্ষিক প্রদর্শনীতে। অমন যে খুঁতখুঁতে প্রিন্সিপ্যাল, তাঁকেও প্রশংসাপত্র দিতে হয়েছিল। অবশ্য একথাও বলেছিলেন, সেন্টিমেন্ট একটু বেশি আছে, তা থাক, এ-বয়সে ওটা একটু থাকা ভাল। 

প্রদর্শনীতে ছবিখানা দেবার পর গোলোকের মন অনেকটা শান্ত হয়ে গেল। শুধু বার কয়েক ইচ্ছে হয়েছিল, ঝর্নাকে একবার প্রদর্শনীতে নিয়ে যায়। কিন্তু বলতে ভরসা পায়নি। ছবি-টবি ঝর্নার মাথায় ঢুকবে না। 

সহপাঠীদের অনেকে অনেক আজেবাজে ইঙ্গিতও করত। জানতে চাইত, এই ফুলটি কে? রক্তমাংসের কেউ, না কল্পনা? গোলোক সে-সবে কান দিত না। এই সময় সে ছবি আঁকায় মন ডুবিয়ে দিয়েছিল। 

সেই ছবিখানা এখন কোথায় আছে গোলোক? ঐ কালো ট্রাঙ্কে না? 

হ্যাঁ। ঐ কালো ট্রাঙ্কেই সব ঠাসা আছে। দাদার গাড়ি এসে একদিন সব পৌঁছে দিয়ে গেছে। কিন্তু আমি খুলিনি। কিছুই বের করিনি। কী লাভ? 

গোলোক দেখল, খোলা জানালা দিয়ে জলের ছিটে আসছে। কখন বৃষ্টি শুরু হল? সে জানালাটা বন্ধ করে দিতে উঠল। কেন, কে জানে দৃষ্টি পড়ল দোতলায়।  সেই বাহারি বারান্দায় আলো জ্বলছে। কেউ নেই। পাশের জানালা দিয়ে ঘরের ভিতরটা দেখা যাচ্ছে। একটি পুরুষ খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা গায়ের চাদর। মেয়েটি খাটের ধারিতে বসে পা নাচাচ্ছে। আর হাতের ভঙ্গিতে আপত্তি জানাচ্ছে। পুরুষটি সস্নেহে এগিয়ে এল। আদর করে মেয়েটির গায়ে চাদরটি জড়িয়ে দিল। মেয়েটি খুব বাধ্য। চাদরটি গায়ে জড়িয়ে চুপ করে বসে রইল। তাকে একটু ক্লান্ত, একটু বিষণ্ণ দেখাচ্ছে; সেই পুরুষটিকে আবার দেখা গেল। এবার দু’হাতে দুটো গেলাস। গেলাসে দুধ না কী, ভাল বুঝতে পারল না গোলোক। শুধু দেখল, দুজনে আবার কথা কাটাকাটি হচ্ছে। পুরুষটি একটি গেলাস মেয়েটিকে দিতে চাইছে। মেয়েটি কিছুতেই নেবে না। খুকিদের মতো ঠেলে ঠেলে পুরুষের হাতটা সরিয়ে দিচ্ছে। পুরুষটা একটুও রাগছে না, একটুও বিরক্ত হচ্ছে না। বারবার সে স্নেহভরে অনুরোধ করছে বলে মনে হল। হঠাৎ পুরুষটা কী যেন বলল, মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর গেলাসটা হাতে নিল। পুরুষটি তার পাশে এসে বসল। তারও হাতে একটা গেলাস। দুজনে পাশাপাশি বসে চুমুক দিতে লাগল গেলাসে। 

ওরা খুব সুখী। গোলোক মনে মনে বলল। তারপরই দেখে, সর্বনাশ, বৃষ্টির একটু-একটু ছাঁটে তার জামাটা বুকের কাছে ভিজে গেছে! জানলা বন্ধ করেই সে তাড়াতাড়ি করে জামা ছাড়তে গেল। 

ওরা কত সুখী! বিছানায় শুয়ে রাত্রির গভীর অন্ধকারে সারা দেহ ডুবিয়ে গোলোক মনে মনে বলে উঠল : সুখী পরিবার। 

পারিবারিক স্বপ্নের ছবি আঁকা গোলোক ছেড়ে দিয়েছে। অসম্ভবের পিছনে ছুটে লাভ নেই, সে-জ্ঞানটা তার আছে। নিজের সীমারেখা কোথায়, তার চেয়ে ভাল আর সে জানে? না, পরিবারের স্বপ্ন দেখার বৃথা চেষ্টা সে করে না। 

কিন্তু দোতলা ফ্ল্যাটের যে মেয়েটিকে বিকেলে তার যক্ষ্মা হাসপাতালের রোগী বলে মনে হয়েছিল, সন্ধ্যায় দেখল সেও পারিবারিক জীব! স্বামীর (নিশ্চয়ই ও-লোকটা তার স্বামী) সান্নিধ্যে আসামাত্র কী অদ্ভুত পরিবর্তন হয়ে গেল মেয়েটার। কেমন আশ্চর্যভাবে সজীব হয়ে উঠল। তবে কি গোলোকেরও এমন পরিবর্তন হত, যদি সেও পরিবারভুক্ত হত? তার দাদা, ঝর্না, সবাই পরিবারের সামিল হয়ে গেছে। ঝর্নাকে নিয়ে সেও তো এতদিন পরিবার বাঁধতে পারত! 

ঝর্না না তোমাকে ভালবাসত গোলোক? 

বাসত বৈ কি? সে-কথা আমি এখনও বিশ্বাস করি। সত্যব্রত বলল বটে ঝর্না বঙ্কিমকে ভালবেসে বিয়ে করেছে। এটা একেবারে বাজে কথা। বাজে কথা। বঙ্কিমকে বিয়ে করার অনেক কারণ থাকতে পারে। তার পিছনে ভালবাসার তাগিদ নেই, এ আমি এখনও বিশ্বাস করি। 

এই বিশ্বাসের জন্যই তুমি হাসপাতাল ছাড়ার সময় ডাক্তারবাবুকে আচমকা প্রশ্ন করেছিলে—বিয়ে করতে পারব?—তাই না? তোমার অবচেতন মনে ঝর্নার কথাই কি মনে পড়েছিল, গোলোক? 

অ্যাঁ? হ্যাঁ, তা হতে পারে। ঠিক জানিনে। তবে এটা জানি, ঝর্নাকে আমি নিজে থেকে বিয়ে করতাম না। সে চাইলেও, না। আমি জানি, অসম্ভবের পিছনে ছুটে লাভ নেই। 

এটা নিতান্ত বাজে কথা হল না কি, গোলোক? কোনটা অসম্ভব ছিল তোমার কাছে? ঝর্নাকে বিয়ে করা, না বিয়ে না-করা? বিয়ে করাই যদি অসম্ভব বলে ভেবেছিলে, তবে সেই চারুলতাকেই বা বিয়ে করতে গিয়েছিলে কেন? মনোরমাকে আর তোমাকে, চারুলতা যদি এক বিছানায় শুয়ে থাকতে না দেখত, তবে কি বিয়েটা হত না বলতে চাও? তবে? 

সে তো অনেক পরের কথা। তখন আমার পরিবর্তন ঘটে গেছে। মনোরমার দেহের আস্বাদ পেয়েছি তখন। এটাও ধরে ফেলেছি মনোরমা শুধু তার দেহটাই বিলিয়ে গেছে এতদিন। মন দেয়নি, ভালবাসা দেয়নি। সেটা সঞ্চয় করে রেখেছিল তার স্বামীর জন্য। সে জানায় যে কত যন্ত্রণা, এক আমিই টের পেয়েছি। মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম, সে ক্ষতের উপশম করতে। চারুলতা হাতের কাছে ছিল, সম্ভবত সে আমাকে ভালও বেসেছিল, তাই চারুলতাকে অবলম্বন করে তাকে ভালবেসে সে-জ্বালা জুড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনোরমা তাতেও বাদ সাধল। এখন রাত কত? 

বেশি নেই গোলোক, বেশি নেই। বেশি সময় তোমার হাতে নেই। শিশি শুঁকেও লাভ নেই এখন। আগে লেখাটা শেষ করো, তারপরে ওটাকে কাজে লাগিয়ো। এলোমেলো ভাবে এগিয়ো না। ধাপে ধাপে এগোও। 

হ্যাঁ, সেই ভাল। আগে তবে ঝর্নার কথাই বলে নিই। 

ঝর্না স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হল। গোলোকেরও প্রায় কলেজ ছাড়বার সময় হল। এর মধ্যে, এই দীর্ঘ দুটো বছরের মধ্যে, ঝর্নাকে নিয়ে তেমন কোন অস্বস্তিতে আর পড়তে হয়নি গোলোকের। সেই একদিন, কিছু সময়ের জন্য, ঝর্নার নারীত্ব তার নাবালক অবয়বে ভর করে আবার তা মিলিয়ে গিয়েছিল। এই দু’বছরে আর একদিনও তা ফুটে ওঠেনি। অন্তত গোলোকের চোখে। মাঝে মাঝে গোলোকের মনে হয়, সে ‘বুঝি ভুলই দেখেছে। কিন্তু ছবিখানা? সেখানা তো ভুল নয়। তা যে জলজ্যান্ত এখনও আছে গোলোকের কাছে। তবে কি সবটাই গোলোকের কল্পনা? কুঁড়ি কুঁড়িই ছিল, কখনও ফুল হয়ে ফোটেনি। গোলোক কুঁড়িকেই ফুল বলে ভুল করেছে। 

ছবিখানা আঁকার পর থেকেই গোলোকের অস্বস্তির অনেক উপশম হয়েছিল। তবে তার মন আগে ঝর্না সম্পর্কে যত উদাসীন ছিল, এখন তার কিছু পরিবর্তন লক্ষ করল। ঝর্নার সান্নিধ্যে এলে সে যেন আনন্দ পায়। যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ ভালই লাগে গোলোকের। 

সেদিন সন্ধ্যায় যেতেই ঝর্না বলল, “মাস্টারমশাই, কাল আমার ছুটি কিন্তু। কাল আমরা থাকব না।”

কথাটা শুনে গোলোক চমকে উঠল।”কেন? কী করবে কাল?” 

“পিকনিক করব আমরা। দক্ষিণেশ্বরে যাব। সারাদিন থাকব তো। কখন ফিরব ঠিক নেই। বাবা তাই বলছিলেন, মাস্টারমশাইকে বলে দিস। 

তাও ভাল। আশ্বস্ত হল গোলোক। 

“আর কে থাকবে?” 

“অনেক অনেক। নতুনদিরা আসবে। আমার বন্ধুরা আসবে। বাবা যেন আরও কাকে কাক বলেছেন।”

“শুধু আমিই বুঝি বাদ।” ফস্ করে গোলোকের মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গেল।

“বাঃ, তা কেন?” লজ্জায় ঝর্নার মুখ লাল হয়ে উঠল। বোকা-বোকা মুখ করে বলল, “আপনি বাদ যাবেন কেন, আপনিও যাবেন।”

একটু থেমে ঝর্না বলল, “সত্যি আপনি যাবেন, মাস্টারমশাই?”

“তোমার বাবা আমাকে নেমন্তন্নই করলেন না, যাই কী করে?”

“এই তো আমি নেমন্তন্ন করছি।”

“তুমি নেমন্তন্ন করার কে?” 

“বা রে!” মাথাটা ঝাঁকিয়ে ঝর্না বলল, “আমারই তো ব্যাপার।

এবার গোলোক আশ্চর্য হল। 

“আমার জন্মদিন যে। সেইজন্যই তো পিকনিক। আমি বলছি, আপনাকে যেতে হবে!”

গোলোক এবার একটু দুঃখ পেল। এত ব্যাপার, আর সে কিছুই জানে না। গোলোকের মুখে বোধহয় এই দুঃখটার ছায়া ভেসে উঠেছিল। ঝর্না একটু অপ্রস্তুতই হল। 

খপ্ করে গোলোকের হাতখানা চেপে ধরে বলল, “সত্যিই অন্যায় হয়ে গেছে মাস্টারমশাই, আমি মাপ চাইছি।”

ঝর্নার অন্তরঙ্গতায় গোলোকের অভিমান বেড়ে গেল! বলল, “অন্যায় আর কী হয়েছে। আমি তোমাদের নিজের লোক তো নই যে-” 

গোলোকের কথা শেষ না হতেই ঝর্না ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। 

“আরে আরে ছি ছি। কাঁদছ কেন? কী হয়েছে?” 

ঝর্না টেবিলে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। পিঠের উপর মস্ত একটা বেণী লুটিয়ে পড়েছে। ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে পিঠের খানিকটা নরম ত্বক দেখা যাচ্ছে। দুটো হাতের উপর টেবিলের ল্যাম্পের উজ্জ্বলতা ঝরে পড়ছে। গোলোকের রক্তে কেমন একটা শিরশিরানি শুরু হল। বুকটা দুরদুর করতে লাগল। সেই দুবছর আগে একদিন যে প্রগল্ভ ফুলের সামনেটা দেখেছিল, এখন তারই ওপিঠটা যেন গোলোকের নজরে পড়ল। সেই অস্বস্তি আবার আক্রমণ করল গোলোককে। সে কী করছে বোঝবার আগেই ঝর্নার মাথাটা তুলে ধরল। আশ্চর্য, ঝর্নার চোখ দিয়ে জলের রেখা গড়িয়ে পড়া সত্ত্বেও গোলোকের মনে হল সে চোখের কটাক্ষে হাসি যেন ঝিলিক মেরে উঠল। চোখের ভাষায় স্পষ্ট হয়ে যেন ফুটল : এবার? কেমন জব্দ! 

ঝর্না বলল, “যাবেন তো, মাস্টারমশাই?” 

কান্নার লেশমাত্র পরিচয় ঝর্নার স্বরে নেই। 

গোলোকের হাসি পেল। বলল, “আচ্ছা যাব।” 

অমনি ঝর্নার চোখ মুখ হাসিতে ভরে উঠল। মুহূর্তে গোলোক দেখল ফুল আবার ফুটে উঠেছে। চোখের হাসি, ঠোঁটের হাসি বলছে : আমি জানতাম। 

গোলোক সেদিন আর বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারল না। ঠিকানা নিয়ে সোজা সে বেরিয়ে গিয়েছিল। 

সেদিনের সব কথা গোলোকের মনে আছে। কিছুই সে ভোলেনি। দরজার কাছে ঝর্না এসে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, “মাস্টারমশাই, যাবেন তো কাল?” 

গোলোক বলেছিল, “যাব।”

ঝর্না এই সংক্ষিপ্ত জবাব বিশ্বাস করেনি। বলেছিল, “না আমার গা ছুঁয়ে বলুন।”

গোলোক হেসে ফেলেছিল। বলেছিল, “মুখের কথায় বিশ্বাস হচ্ছে না। তোমার গা ছুঁয়ে কথা দিলে সে-কথা রাখব, তাই বা বিশ্বাস করবে কেন?” 

“হ্যাঁ করব। আমার গা ছুঁয়ে কথা দিলে সে-কথা আপনি ফেলতে পারবেন না।”

ঝর্নার চোখ-মুখ সাপুড়ের কৌতুকে হেসে উঠেছিল। গোলোকের মনে হল, এ-ঝর্না নিতান্ত সরল ঝর্না নয়। তার চোখে, তার মুখে যে-হাসি ফুটে উঠেছে, সে যেন বলতে চায়, বলছে, আমি জানি, তোমার দুর্বলতা কোথায়, অনেকদিন আগেই জেনেছি। 

গোলোকের প্রবল ইচ্ছে হয়েছিল, ঝর্নার হাত দুটো চেপে ধরে। কিন্তু কিছুতেই পারল না। 

মাথায় হাত রেখে বলল, “যাব। সত্যি যাব।” 

তারপর সে আর ঝর্নার দিকে চাইতে পারেনি। সোজা বেরিয়ে পড়েছিল রাস্তায়।

অদ্ভুত ভাল লাগছিল গোলোকের পথে পথে ঘুরতে। রাত বাড়তে লাগল। ট্রাম-বাসের সংখ্যা কমে এল। গোলোক একটুও ভূক্ষেপ করেনি। নিঃসঙ্গ হয়ে নির্জন পথে সে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে কিসের নেশায় এমন বুঁদ হয়ে গেছে, সেদিন বুঝতে পারেনি। এই আকাশ, আকাশে অজস্র তারা, রাস্তার সারি দেওয়া আলো, ছায়া-ছায়া বাড়িগুলো সব তার ভাল লেগেছিল। বেলফুলওয়ালার চিৎকার থেমে গেল। কুলপি বরফ বাড়ি ফিরে গেল। গাড়ির ভিড় কমে এল। এলোমেলো হাওয়া রাস্তার ধুলো, ছেঁড়া কাগজ, শালপাতার ঠোঙা নিয়ে লোফালুফি খেলল। সবই দেখল গোলোক। তারপর অনেক রাতে বাসায় ফিরল। ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিল বিছানায়। আনন্দের নেশা তাকে ঘুমুতে দিল না। 

গোলোকের মনে আছে সে রাতে তার এক বিন্দুও ঘুম হয়নি। 

আর মনে আছে পরের দিনের কথাও। খুঁজে পেতে বাগানবাড়িটা বের করতে তার সময় লেগেছিল। একে সে বেশ দেরি করেই রওনা দিয়েছিল, তার উপর বাড়ি খুঁজতে আরও দেরি। 

গোলোককে দেখামাত্র ছুটে এসেছিল ঝর্নাও। পরেছে। যৌবনের অস্তিত্ব ফুটে বেরুচ্ছে। গোড়ালি ঝর্না। পরিশ্রমে লাল হয়ে গেছে। ঘাম জমেছে। 

“এত দেরি করলেন যে!” 

গাছ-কোমর বেঁধে শাড়িটা বেরিয়ে পড়েছে। হাঁফাচ্ছে 

ঝর্নার চকচকে চোখদুটো কপট অভিমানে ভারী হয়ে এসেছিল। গোলোক হাসল। 

বলল, “ভুল ঠিকানা বলে দিয়েছিলে—” 

মুখের কথা শেষ হতে দিল না ঝর্না। 

ঠোঁটটা বেঁকিয়ে বলে উঠল, “ইস, আমার অমন ভুল হয় না মশাই, নিজেই ভুলে গিয়েছিলেন। সত্যি মাস্টারমশাই, আপনি খুব ভাল। না এলে যে কী কষ্ট হত আমার!”

“এই ঝর্না!” 

দূর থেকে কে একটা মেয়ে ওকে ডাকল। গোলোক বিরক্ত হয়েছিল মেয়েটার ওপর। 

“এই ঝর্না! খেলা ফেলে কতক্ষণ বসে থাকব?”

আবার ওর ডাক এল। ঝর্না নিরুপায় হয়ে গোলোকের দিকে চাইল। 

গোলোক হাসতে হাসতে বলল, “যাও ঝর্না, তোমার জন্য খেলা আটকে আছে।”

ঝর্নার মুখেও হাসি ফুটে উঠল। 

“খেলা দেখবেন, মাস্টারমশাই?” 

গোলোকের ইচ্ছে হল, বলে হ্যাঁ। কিন্তু বলল, “না, তোমাদের দঙ্গলে গিয়ে আমি কী করব?” 

“তবে ভেতরে যান।” —ব্যস্ত ঝর্ণা তাড়াতাড়ি জবাব দিল, “ঘরে বাবারা আছেন।”

বলেই ঝর্না ছুট দিয়েছিল। গোলোকের এটা খুব ভাল লাগল না। সে চায়নি ঝা এত শীঘ্র চলে যাক। সে ভেবেছিল, ঝর্না তার জবাব শুনে খেলতে আর যাবে না। তার কাছেই থাকবে। তাই সে খেলা দেখতে চায়নি। ঝর্না চলে যেতেই গোলোকের মনটা যেন ফাঁকা হয়ে উঠেছিল। গোলোক একটা অন্য প্রত্যাশা নিয়ে এসেছিল। সেটা পূরণ না হতে ও একটু দমে গেল। এখানে আসাটা তার কাছে নিরর্থক বলে মনে হল। বিরক্ত হল নিজের উপর। 

দূরে মেয়েরা কী খেলা করছে লাফিয়ে লাফিয়ে, কে জানে। ঝর্নাকে পেয়ে ওদের হল্লা বেড়ে উঠল। গোলোকের প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিল ওখানে যায়। কিন্তু কিছুতেই সে সেদিকে পা বাড়াতে পারল না। অনিচ্ছুকভাবে ঘরের দিকেই এগিয়ে গেল। 

সেখানে ঝর্নার বাবা বন্ধুবান্ধব পরিচিত লোক নিয়ে আড্ডা জমিয়েছিলেন। বিলাতি কায়দায় পোশাক পরা সমবয়সী গোটাকতক স্মার্ট যুবককেও দেখল গোলোক। বিশেষ পছন্দ করল না। 

ঝর্নার বাবা গোলোককে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন। 

“আরে, এসো এসো গোলোকবাবু। বেটার লেট দ্যান নেভার। আমরা ভাবছিলাম তুমি বুঝি আর এলে না। ঝর্নার সঙ্গে দেখা হয়েছে? ও তো অস্থির হয়ে উঠেছে।”

তিনি সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন গোলোককে। ঝর্নার টিউটর। আর্ট ইস্কুলের কৃতী ছাত্র। 

একটি যুবক বলে উঠল, “আই সি, ইউ আর গোলোক মজুমদার! দ্যাট আর্টিস্ট! নাউ আই আন্ডারস্ট্যান্ড!” 

গোলোক তার কথার ধরনে ঘাবড়ে গেল। অন্য সকলেও চোখে জিজ্ঞাসা ভরে তার দিকে চেয়ে রইল। 

যুবকটি এবার বাংলায় বলল, “গোলোকবাবু আমাদের ঝর্নার একটি চমৎকার পোরট্রেট এঁকেছেন মামা। বছর দুয়েক আগে ওঁদের কলেজের একজিবিশনে সেটা দেখানো হয়েছিল। দ্যাটস্ এ ওয়ান্ডারফুল পেন্টিং। অলমোস্ট এ মাস্টারপিস্! 

“সে কী! কই, আমরা তো কেউ জানিনে! কী হে গোলোকবাবু—” ঝর্নার বাবা বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন গোলোকের দিকে।, “সত্যি নাকি? তা, এত বড় খবরটা তুমি চেপে গেছ?” ভাগ্যিস মহেন্দ্ৰ বলল! 

মহেন্দ্ৰ বলল, “একজিবিশনে ছবিখানা দেখে তো আমি অবাক। ঝর্নার ছবি এখানে কোত্থেকে এল। কী যেন নামটা? হ্যাঁ, ‘কুঁড়ি থেকে ফুল’। আর্টিস্টের নাম দেখলাম গোলোক মজুমদার। চিনতে পারলাম না। তাই ভেবেছিলাম, তবে বোধহয় অন্য কারও পোরট্রেট হবে। এখন বুঝলাম সেটা আমাদের ঝর্নারই। 

ঝর্নাও খবর পেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসেছিল। 

“সত্যি মাস্টারমশাই? আমার ছবি এঁকে একজিবিশনে দিয়েছেন? সত্যি? কবে আঁকলেন? জানিনে তো। কখনও তো বলেননি?” 

দেখতে দেখতে অভিমানে মুখে অন্ধকার নেমে এল ঝর্নার।”যান আপনার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।”

তারপর ঝর্না আবার মিশে গেল তার বন্ধুদের ভিড়ে। 

কয়েকজনকে ডেকে শোনাল, “জানিস মাস্টারমশাই আমার ছবি এঁকেছেন। একজিবিশনে দিয়েছিলেন।”

কিন্তু ওই পর্যন্তই। তারপরই সে খেলায় মত্ত হয়ে গেল। দৌড় ঝাঁপ, হইহল্লা করল সারাদিন। আবার যেন সে স্কুলের মেয়েটি হয়ে গেল। একবার এলও না গোলোকের কাছে। খোঁজখবরও নিল না। 

সারাটা দিন খুব খারাপ কাটল গোলোকের। এই ভিড়ে সে বড় বেমানান হয়ে পড়েছে। আর যারা এসেছে সবাই সবার পরিচিত, আত্মীয়, বন্ধু। পরস্পর আলাপ করছে, গল্প করছে, তর্ক করছে। সে-ই শুধু আলাদা হয়ে পড়েছে। একেবারে একা। না এলেই পারত গেলোক। কেন যে মরতে এল এখানে। 

কিন্তু না আসার ক্ষমতা ছিল না বলেই তো সে এসেছে। কাল যে-ঋনা নিমন্ত্রণ করেছিল, আজকে এই চপল, খুকি খুকি ঝর্নার মধ্যে গোলোক তাকে খুঁজে পেল না। কালকের সেই ঝর্নার অনুরোধ না রাখা তার পক্ষে শক্ত ছিল। 

ঝর্নার সেই কী-রকম দাদা, মহেন্দ্ৰ, এক ফাঁকে তার সঙ্গে আর্টের কথা কপচে নিল। ফ্রান্স, গোগ্যাঁ, মাতিস, ইমপ্রেশানিজম, কিউবিজম্ কত কী যে বলে গেল গোলোকের কাছে, তার আর ইয়ত্তা নেই। বিরক্তি বোধ করছিল গোলোক। কোনও মতে তার হাত এড়িয়ে বাইরে চলে গেল। গাছের ছায়ায় গোল হয়ে বসে ঝর্নারা কী যেন খেলছে, দূরে দাঁড়িয়ে সে তাই দেখতে লাগল। একটা আশ্চর্য জিনিস গোলোক লক্ষ করল। অনেক মেয়েই তো খেলছে একসঙ্গে। ঘুরছে, ফিরছে, উঠছে, বসছে, কিন্তু গোলোকের দৃষ্টিতে তারা কেউ ফুটে উঠছে না। কিন্তু ঝর্না সামান্য একটু নড়ে বসামাত্র গোলোকের নজর ঝপ্ করে তার উপর পড়ছে। কখনও কখনও আশ্চর্য ভাল লাগছে তাকে। 

কিছুক্ষণ পরে গঙ্গার ধারে বাঁধানো ঘাটের ছায়ায় গিয়ে বসল গোলোক। ওপারে বেলুড় মঠ। চকচকে দিন, জোর হাওয়া, লোকজন, নৌকা, ব্রিজ, ট্রেন, সব মিলিয়ে গোলোকের মনে সুন্দর মনোরম ভাবের সৃষ্টি হল। তার যেন কারও ওপর আর অভিযোগ নেই। এক প্রশান্ত প্রসন্নতায় যেন সে ভরে গেছে। 

মেয়েরা হৈ হৈ করে ছুটে এল। মুহূর্তের মধ্যে গোলোকের প্রশান্তি বিদায় নিল। সব চান করতে এসেছে। জলে গিয়ে লাফ ঝাঁপ দিচ্ছে, কেউ কেউ সন্তর্পণে গিয়ে ডুব দিচ্ছে। জল ছিটোচ্ছে, খিলখিল করে হাসছে। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় ঝর্নার আঁচল উড়ে গেল। ভিজে ব্লাউজ ভেদ করে তার দেহ-রেখা ফুটে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে গোলোক অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। ঝর্নার দেহের গড়ন দেখে গোলোকের চোখে তৎক্ষণাৎ প্রতিমার বুক ভেসে উঠল। হঠাৎ ওর ইচ্ছে হল আরেকবার দেখে। এবার চাইতেই ঝর্নার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। জলকেলির উত্তেজনায়, খুশিতে স্ফটিকের মতো চকচক করছে ঝর্নার চোখদুটো। গোলোককে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল ঝর্না। 

একবার বলল, “কী সুন্দর জল মাস্টারমশাই, নামুন না।”

পরক্ষণেই বুঝি গোলোকের অস্তিত্বই ভুলে গেল। প্রবল উত্তেজনায় ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল জলে। 

.

ঝর্না গোলোককে চমকে দিল পরের পরের দিন। পিকনিকের পরদিন সে পড়াতে যায়নি। ভাল লাগছিল না তার। মনটা বেঁকে বসল। কিছুতেই ঝনাদের বাড়িতে যেতে রাজি হল না। সারাক্ষণ তার মনে হয়েছে, কী যেন সে পায়নি, কী যেন হারিয়েছে। মনে কোনও রকম জোর পাচ্ছিল না, তাই কোনও কাজে মন দিতে পারেনি সেদিন। 

পরদিন, ঝর্নাদের বাসায় ঢোকামাত্র, ঝর্না বেরিয়ে এল। 

উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞাসা করল, “শরীর খারাপ হয়নি তো মাস্টারমশাই?”

সংক্ষেপে জবাব দিয়ে পড়াতে বসল গোলোক। 

পড়ানো শেষ হলে সে উঠতে যাবে অমনি ঝর্না বলে বসল, “আপনি আমার উপর রাগ করেছেন মাস্টারমশাই, না?” 

প্রশ্নের ধরনেই গোলোক চমকে উঠেছিল। দেখল ঝর্না কেমন শান্ত সংযত হয়ে গেছে। 

গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে ঝর্না বলল, “আমি জানি, আপনি রাগ করেছেন। আমারই অন্যায় হয়েছে মাস্টারমশাই, সেদিন আপনাকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলেছি। বিশ্বাস করুন, আমারও খারাপ লেগেছে। আপনার কাছে যাওয়ার জন্য আমার খুবই ইচ্ছে হচ্ছিল।”

গোলোক বোকার মত চেয়ে রইল ঝর্নার দিকে। বলছে কী ঝর্না! 

“হ্যাঁ মাস্টারমশাই। কিন্তু পাছে ওরা ঠাট্টা করে, তাই যাইনি। আপনি আমাকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলেন, তাতেই নতুনদি কী সব বলছিল। 

“আমি তোমার দিকে চেয়ে ছিলাম, তোমাকে কে বললে?” 

ঝর্না বেশ জোর দিয়েই বলল, “আমি সব লক্ষ করেছি।” ঝর্নার স্বর সঙ্গে সঙ্গে খাদে নেমে এল। বলল, “অনেকদিন থেকেই লক্ষ করছি।”

এই একটিমাত্র কথায় গোলোকের মনে যেন তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। সে ধরা পড়ে গেছে ঝর্নার কাছে। ঝর্না দিনের পর দিন তাকে লক্ষ করে গেছে! একেবারে বোকা বনে গেল গোলোক। 

“নতুনদিও দেখেছে।” 

ঝর্নার কথায় চমকে উঠল গোলোক। দেখল ঝর্নার সংযত ভাব বদলাতে লেগেছে। চোখের কোণে দুষ্টু হাসি এসে উকি মারতে শুরু করেছে। 

“নতুনদি আমার খুব পিছনে লাগে জানেন। আচ্ছা মাস্টারমশাই, আমার যে-ছবিটা আপনি এঁকেছেন, সেটা কি মন থেকে এঁকেছেন?” 

গোলোক বলল, “কেন বলো তো?” 

“নতুনদি বলছিল, দেখিস্, তোর মাস্টারমশাই তোকে—” 

ঝর্না আর বলতে পারল না। ঝপ্ করে ওর মুখ রাঙা হয়ে গেল।

কী বলেছে ঝর্নার নতুনদি? গোলোকের বুক দুরদুর করতে লাগল। 

“কি বলেছে তোমার নতুনদি?” 

“যাঃ, নতুনদিটা বড় অসভ্য? 

হাসতে লাগল ঝর্না। ওর চোখে-মুখে অনেক কথা ফুটে উঠতে লাগল। 

গোলোক সেদিন আর ঝর্নার দিকে চাইতে পারেনি। তাড়াতাড়ি চলে এসেছিল বাসায়। সেই রাতটায় আবার একটা ঘোর এসেছিল গোলোকের। রেশটা অনেকদিন ছিল। স্মৃতিটা এখনও ঝাপসা হয়ে যায়নি। 

ঝর্না বলেছিল, “ছবিটা কবে দেখাবেন মাস্টারমশাই? 

ঝর্নার পীড়াপীড়িতে ছবিটা এনে দেখাল গোলোক। বাড়িসুদ্ধ লোকের সে কী হৈ চৈ সেদিন। ঝর্নার বাবা-মা-র মুখে গোলোকের প্রশংসা তো আর ধরে না। 

ঝর্নার বাবা বললেন, “গোলোকবাবু, তুমি একটি জিনিয়াস। ওয়ান্ডারফুল হয়েছে। বলছ বটে এটা দু’বছর আগের ঝর্না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, এটা আজকালের ঝর্না।”

ঝর্নারও খুশির অন্ত ছিল না। বলেছিল, “এটা আর দেব না কিন্তু।”

সেদিন থেকেই ঝর্নার একটা পরিবর্তন লক্ষ করল গোলোক। তার চপলতা একেবারে কমে গেল। এখনও হাসে ঝর্না। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ছোটে তার চোখ থেকে। কিন্তু তবুও সে-সবের চেহারা যেন অন্য রকম। মাঝে মাঝে কী হয় ঝর্নার, পড়তে পড়তে থেমে যায় হঠাৎ, গোলোকের দিকে কেমন অদ্ভুতভাবে চেয়ে থাকে। আবার কোনও কোনও দিন একবারও মুখ তুলে চায় না। ক্ষণে ক্ষণে তার গাল রক্তিম হয়ে ওঠে। গলার স্বর গাঢ় হয়, মৃদু স্বরে কথা বলতে থাকে ঝর্না। নখ খুঁটতে থাকে। এমনি মুহূর্তগুলোতে গোলোকের গা শিরশির করতে থাকে। খুব ভাল লাগে, মনে একটা নেশা নেশা ভাব জাগে। সেও চেয়ে থাকে ঝর্নার দিকে। ঝর্নার ঠোঁটে একফালি হাসি ফুটে ওঠে। রহস্যময় হাসি। 

হঠাৎ চট করে উঠে পড়ে ঝর্না। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, “এখন আমি যাই।”

ঝর্না তার সামনে থেকে উঠে যাওয়ামাত্র প্রবল এক সুখকর উত্তেজনার জোয়ার যেন গোলোককে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। ভাসতে ভাসতে কোথায় চলে যায়, তার ঠিক নেই। এই সময় ঝর্নার সঙ্গে ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছেটা তার প্রবল হয়ে উঠেছিল। নানা জায়গায় ঝর্নাকে নিয়ে যাচ্ছে গোলোক, বেড়াচ্ছে দুজনে—এমন স্বপ্ন সে হামেশাই দেখেছে। যে-রাতে সে ওই ধরনের স্বপ্ন দেখত, তার পরদিনটা অদ্ভুত ভাল মেজাজে থাকত। 

গোলোক স্বপ্নেও ভাবেনি, এমন একটা সুযোগ সে অযাচিতভাবে পাবে। 

পুজোর সময় ঝর্নারা দেশের বাড়িতে যায়। সেবার আর সবাই চলে গেলেও ঝর্না কলকাতায় থেকে গেল বাবার সঙ্গে যাবে বলে। একদিন গোলোককে ঝর্নার বাবাই বললেন, “আমি তো মোটে সময় পাচ্ছিনে গোলোকবাবু, ভাবলাম বাড়ি যাবার আগে মেয়েটাকে নিয়ে ঘুরব-ফিরব, তা এই সময় যত কাজ পড়ল। তুমি এক কাজ করো না, ওকে শহরটা একটু দেখাও না। মেয়েটা দিন দিন যত বড় হচ্ছে, ততই যেন মিইয়ে যাচ্ছে।”

সেইদিন বিকালেই ওরা বেরুল। ভেবেছিল সিনেমায় যাবে। কিন্তু গঙ্গার ধারে গিয়ে বেড়াতে বেড়াতে এত ভাল লাগল যে, সিনেমার বন্ধ ঘরে গিয়ে ঢুকতে চাইল না ওরা। স্ট্র্যান্ড রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল ওরা। গঙ্গার পাড়ে ধপ করে বসে পড়ল ঝর্না। গোলোককেও বসতে বলেছিল। সামনে একটা বিরাট জাহাজ। ঝর্নার কথার স্রোতোমুখ যেন খুলে গেল। অনর্গল বকতে থাকল। আহা, বলুক, বলুক। গোলোকের মন বলে উঠল। গোধূলির আলো ঝর্নার মুখখানাকে অনেক সজীব করে তুলেছে। অনেকটা আপন মনে কথা বলে চলেছে। –এই জাহাজ কোত্থেকে এল? কদিন এখানে থাকবে? এখান থেকে কোথায় যাবে? কত মাল ধরে? ভেতরে গিয়ে দেখতে দেবে কি না? 

গোলোক শুধু ‘হুঁ ‘হাঁ’ করে যাচ্ছিল। 

হঠাৎ ঝর্না প্রশ্ন করে বসল, “আচ্ছা মাস্টারমশাই, এই জাহাজটার ছবি, আপনি বাসায় গিয়ে আঁকতে পারবেন? অবিকল যেমন দেখছেন, তেমনি? 

গোলোক হাসল। ছেলেমানুষিতে পেয়েছে ঝর্নাকে। 

বলল, “অমন হুট করে কি আঁকা যায়। আগে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব লক্ষ করতে হবে, তবে তো!” 

“বেশ, ভাল করে লক্ষ করলেন, তারপর?” 

“তারপর ধ্যান করতে হবে। ধ্যানে এই জাহাজখানাকে অবিকল মনের মধ্যে এনে ফেলতে হবে। তারপর দেখবে ছবি আপনিই আঁকা হয়ে যাচ্ছে।”

ঝর্না এই জবাব শুনে অবাক হয়ে চেয়ে রইল গোলোকের মুখের দিকে।

বলল, “তবে তো নতুনদি বাজে কথা বলেনি।”

গোলোক ঝর্নার কথা ভালভাবে বুঝতে পারল না। 

ঝর্নার স্বর গাঢ় হয়ে এল। বলল, “নতুনদি বলেছিল, তোর চেহারাখানা মাস্টারমশাইয়ের মনে আঁকা হয়ে আছে।”

গোলোকের দেহে চাঞ্চল্য দেখা দিল। ঝর্নার মুখের দিকে চেয়ে সে বলল, “তোমার নতুনদি সত্যি কথাই বলেছেন।” 

গোলোকের স্বর ভাঙা-ভাঙা ঠেকল। ঝর্নার চোখে যেন স্বপ্ন নেমে এসেছে। মনে খুশি উপছে পড়ছে চোখ-মুখের ভিতর দিয়ে। 

মৃদু আধা-আধা নরম স্বরে ঝর্না বলল, “আমি তো ছবি আঁকতে জানিনে, তবে আমার মনে আপনার ছবি আঁকা আছে কেন মাস্টারমশাই! আপনার কথা মনে পড়লেই আপনার ছবিটা ভেসে ওঠে। 

ঝর্নার স্বরে সামান্য হয়তো উত্তেজনা আছে, কিন্তু ছলনা নেই। এক গভীর সত্য জেনে ফেলেছে যেন সে। তাই তার প্রকাশে কপটতা নেই। 

ঝর্না সরলভাবেই প্রশ্ন করল, “কেন মাস্টারমশাই?” 

গোলোক ঝর্নার হাত দুটো ধরে ফেলল। বলল, “আমি তোমাকে, তোমাকে ভালবাসি ঝর্না, তাই তোমার ছবি আমার মনে আঁকা আছে। তোমাকে আমি খুব ভালবাসি ঝর্না।”

গোলোক ঝর্নার হাতে মৃদু চাপ দিল। ঝর্নার হাত বুঝি ঘেমে উঠতে লাগল। অসহায়ভাবে কাঁপতে লাগল। চোখ দুটো অতলস্পর্শী হয়ে উঠল। 

ঝর্না ফিসফিস করে বলল, “বাড়ি চলুন, মাস্টারমশাই।”

গোলোক ফিসফিস করে মিনতি করল, “আর একটু বসো, আরেকটু বসো ঝর্না, এখনই উঠো না।”

ঝর্নার চোখ দুটো এই মিনতি শুনে হেসে উঠল। যেন অভয় দিল। যেন বলল, “না, উঠব না এখন। ভয় পেয়ো না।” 

সূর্য ডুবে গেছে। জাহাজগুলোর গায়ে, হাওড়ার পুলে, আলোর মালা জ্বলে উঠেছে। অন্ধকার নেমে পড়েছে পথে। হাওয়া উঠেছে। গোলোক ঝর্নার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বসে আছে। এক মধুর আবেশে তলিয়ে গেছে গোলোক। তাদের সামনে এখন জাহাজ নেই, গঙ্গা নেই, পিছনে কেল্লা নেই, কিছু নেই। ওরাই দুজন শুধু আছে। 

“গোলোক, এই গোলোক।”

অনেক দূর থেকে ডাকটা যেন ভেসে আসছে। কে গোলোক? আমি, আমাকে কেউ ডাকছে? 

“গোলোক, এই গোলোক। কী রে, বুঁদ হয়ে গেছিস যে!” 

গোলোক এতক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে পেল। দেখল সত্যব্রত। আঁকার সরঞ্জাম ঘাড়ে করে কোত্থেকে যেন ফিরছে। দেখল, ঝর্না অপ্রস্তুত হয়ে বসে আছে একটু দূরে। গোলোক নিজেও একটু বিব্রত হল। কিন্তু মুহূর্তেই সামলে নিল। 

বলল, “ঝর্না, এ হল, সত্যব্রত। আমার সহপাঠী। বন্ধু। নাম-করা আঁকিয়ে। আর এ হচ্ছে আমার ছাত্রী, ঝর্না—”  

“কুঁড়ি থেকে ফুল—” হাসতে হাসতে বলল সত্যব্রত।”এখন তো পুরোপুরি ফুল, মাফ করবেন ম্যাডাম, আপনি ঐ নামেই প্রকাশিত। আমাদের দোষ কী?” 

সত্যব্রতের কথার ধরনে ঝর্না খুব মজা পেল। ওর অপ্রস্তুতভাব কেটে গেল। হাসতে লাগল মুখে আঁচল চাপা দিয়ে। 

“তা বাবা, এত রাত্রে এখানে কী করছ দুজনে? পিছনে গুণ্ডা লেগে যেতে পারে। চলো, শহরের ভেতরে চলো।”

 সত্যব্রতের কথায় ঝর্না ভয় পেয়ে ফ্যাকাশে মেরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ল সে।

ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, “চলুন মাস্টারমশাই, চলুন।” 

গোলোক সত্যব্রতের এই পাকামিতে বিলক্ষণ চটে গেল। নিতান্ত অনিচ্ছাতে সে উঠল। ঝর্না এত ভয় পেয়েছে যে, কিছুক্ষণ গোলোকের গায়ের সঙ্গে প্রায় লেপ্টে-লেপ্টেই হাঁটতে থাকল। আর এই প্রথম গোলোক ঝর্নার নিকট সান্নিধ্যে এল। ঝর্নাকে জড়িয়ে ধরতে, কাছে টানতে প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিল গোলোকের। কিন্তু সঙ্গে যে সত্যব্রত রয়েছে। 

আউট্রাম ঘাট থেকে চৌরঙ্গীতে আসতে কতটুকু সময়ই বা লাগে। কিন্তু তার মধ্যেই গোলোক দেখল, সত্যব্রত দিব্যি ভাব জমিয়ে নিয়েছে ঝর্নার সঙ্গে। সত্যের সংস্পর্শে আসামাত্র ঝর্না যেন অনেক চোখা হয়ে উঠল। মুখর হয়ে উঠল। গোলোক যে পিছন পিছন আসছে, সে-কথা যেন ওরা ভুলেই গেছে। ঝর্নার হাত ধরে কেমন অনায়াসে চৌরঙ্গীটা পার করে দিল সত্য। চা খাওয়াতে গিয়ে ঢুকল মণিকোতে। ঢুকেই দেখে বঙ্কিম বসে আছে। সত্যব্রত বলল, “এই যে বঙ্কিম, আয় তোর সঙ্গে আলাপ করে দিই। এ হচ্ছে ঝর্না, আমার বন্ধু গোলোকের ছাত্রী।”

‘আমার বন্ধু’ কথাটা গোলোকের কানে লাগল। বঙ্কিমের মনে হল, ঝর্নাকে দেখে সে যেন একটু বিস্মিত হয়েছে। 

ফ্যাকাশে মুখখানা রুমাল দিয়ে মুছে বঙ্কিম বলল, “আপনাকে এর আগেও আমি দেখেছি।”

ঝর্না অবাক হয়ে গেল। বঙ্কিম সিগারেটে একটা টান মেরে বলল, “অবাক হবার কিছু নেই। আমার মতো অনেকেই দেখেছে আপনাকে। অবশ্যি গোলোকের ছবিতে। সে-ছবি যারা দেখেছে, কেউই আপনাকে ভুলবে না। ওয়ান্ডারফুল!” 

ঝর্না একটু লজ্জা পেয়েছিল। তা সত্ত্বেও সে চিকচিক করে উঠল খুশিতে। চকচকে চোখে একবার সত্যব্রত, একবার বঙ্কিমের মুখে চাইতে লাগল। গোলোকের মনে হল, সে আর পাত্তা পাচ্ছে না কারও কাছে। 

বঙ্কিম বলল, “দেখুন, আমি আঁকতে পারিনে। তার জন্য খেদ ছিল না মনে। আজ আফসোস হচ্ছে। ঈর্ষা হচ্ছে গোলোকের উপর। 

ঝর্নার যেন বাড়ি যাবার আর তাড়া নেই। গোলোক ভাবল, বাঃ বেশ। মশগুল হয়ে শুনছে ওদের কথা। এদিকে রাত হচ্ছে সে-খেয়াল নেই। 

গোলোক তাড়া দিল, “ঝর্না, আর না। আটটা বেজে গেল। তোমার বাবা হয়তো ভাববেন।”

এতক্ষণ পরে ঝর্না যেন বাস্তবে ফিরে এল।

“কী সর্বনাশ! তাই নাকি? চলুন, চলুন। 

ঝর্না এমন তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়ল যে, তার ধাক্কা লেগে জলের গেলাসটা বঙ্কিমের জামা-কাপড় খানিকটা ভিজিয়ে দিল। ঝর্না অপ্রস্তুত। বঙ্কিম হাসতে হাসতে জল ঝেড়ে ফেলল। 

বলল, “ভাল কথা, গোলোক, তারপরে তুমি এঁর কোনও ছবি আঁকোনি? 

গোলোক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “না। 

চ্চাক্ করে জিভের শব্দ করে বঙ্কিম বলল, “কী আপসোস! সে ছবিটা কোথায় রেখেছ?” 

গোলোক ঝর্নার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ওদের বাসায়।”

বঙ্কিম ঝর্নাকে বলল, “তাহলে আপনাদের বাসায় একদিন যাব, ছবিটা দেখতে। অবশ্য গোলোকের যদি আপত্তি না থাকে। 

ঝর্না বলল, “বা রে, এতে মাস্টারমশাইয়ের আপত্তি হবে কেন?” 

বঙ্কিম বলল, “সে আপনি বুঝবেন না।” বঙ্কিম সত্যব্রতের মুখের দিকে চাইল। তারপর দুজনে হেসে উঠল। ঝর্নার মুখও সঙ্গে সঙ্গে লাল হয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি রাস্তায় নেমে পড়ল। 

সত্যব্রত বলল, “আমি যদি তুই হতাম গোলোক, এ-সুযোগ ছাড়তাম না। এর মধ্যে অনেক ছবি এঁকে ফেলতাম ঝর্নার।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *