এই দাহ – ২০

২০

চারুলতার আবির্ভাবও যেমন অদ্ভুত, তেমনি তার ধরন-ধারণও। প্রথম দিনই গোলোকের চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। দু’দিন ধরে সমানে বৃষ্টি ঝরছিল। একমুহূর্তও ছেদ পড়ে নি। ঝিটাও কামাই করেছে। বৃষ্টিতে গোলোকের বড় ভয়। ঘরে যা ছিল, তা দিয়ে গোলোক দু’দিন চালিয়েছে। চালিয়েছে মানে, প্রায় না খেয়েই আছে। ক্ষিধের চোটে খুব ভোরেই ঘুম ভেঙেছে তার। চা করতে গিয়ে দেখে এক দানাও চিনি নেই। বেজায় বিরক্ত হল গোলোক। শব্দ শুনে বুঝতে পারল, গবগব করে বৃষ্টি পড়ছে। গোলোকের দুশ্চিন্তা বাড়ল। সর্বনাশ, আজও যদি না আসে বুড়ি? তা হলে তো নিরম্বু উপোস। কারণ, গোলোক না খেয়ে মরে গেলেও এই বৃষ্টিতে বাজার করতে বেরোবে না। রাস্তায় নামলেই কোমর পর্যন্ত ডুবে যাবে। না, তার বেরুবার প্রশ্নই ওঠে না। এক্সপোজারটি লাগলে আর দেখতে হবে না। তা হলে কী করবে সে? কী আর করবে, বিরক্ত হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। চাদরটা টেনে দিল গায়ে। তারপর খিদের কামড়ে অস্থির হয়ে বুড়ি-ঝির মুণ্ডপাত করতে লাগল। 

একটু পরেই কড়া নড়ল দরজার। যাক, নিশ্চিত্ত হল গোলোক, এল তা হলে। বেশ করে ধমকাবে আজ ওকে। গোলোক উঠল না। শুয়ে শুয়েই বলল, “খোলাই আছে।”

দরজা খুলতেই গোলোক অবাক হয়ে গেল। বুড়ি তো নয়। এ আবার কে? গোলোক উঠে বসল। একটি যুবতী মেয়ে আপাদমস্তক ভিজে ঘরের ভিতর ঢুকল। 

বলল, “আপনি গোলোকবাবু তো?”

গোলোক বিস্মিত হয়ে বলল, “হ্যাঁ।”

মেয়েটি হাসল ঠোঁট-টেপা হাসি। বলল, “যাক বাবা, ঠিকানাটাও ভাল করে বলতে পারেনি। খুঁজে খুঁজে হয়রান। আমি চারু। চারুলতা। আপনার যে ঝি, সে তো পড়ে পা ভেঙেছে। আমায় বললে, চারি, কদিন কাজ করবি বাবুর বাড়ি? বললাম, করব। বললে, তা হলে যা। বাবু রোগা মানুষ, ঘরে বোধহয় কিছু নেই, হয়তো না খেয়ে আছে।”

আবার হাসল। “কোথায় কী আছে দেখিয়ে দিন।” 

গোলোক টাকা বের করে দিয়ে বলল, “আগে বাজারে যাও, কিচ্ছু নেই। খুব খিদে পেয়েছে আমার। কাল থেকে প্রায় কিছুই খাইনি। সকালে চা খেতে গিয়ে দেখি, চিনি নেই।” গোলোক আবার বিরক্ত হল।”কী যে করে বুড়ি। ওকে দিয়ে আর চলবে না দেখছি। 

চারুলতা ঠোঁট টিপে হাসল। চোখের দৃষ্টিতে তার এমন একটা প্রত্যয়, যেন গোলোক যে একথা বলবেই, সে তা জানত। গোলোকের মনে হল, নিজের সম্পর্কে সে যেন অতিমাত্রায় সচেতন। হাত পেতে টাকা নিয়ে গিয়ে গোলোকের আঙুলে চারুলতার আঙুল ঠেকে গেল। কী কাণ্ড! গোলোকের শরীরটা শিরশির করে উঠল। গোলোকের মনে হল ইচ্ছে করেই এ কাজ করল চারুলতা। 

চারুলতা বলল, “কী কিনব বলুন?” 

গোলোক বিরক্ত হয়ে বলল, “তার আমি কী জানি? সংসারে কী লাগে জানো না?” 

চারুলতা হাসতে হাসতে বলল, “সংসারে কী লাগে তা আমার জানা আছে। কিন্তু আমি তো আপনার ঘরের লোক নই বাবু, যে আপনার সংসারে কী লাগবে তাও জানব।” 

গোলোক ভাবল এক্ষুনি ওকে বিদেয় করে দেয়। পরক্ষণেই ভাবল, তা হলে সে-ই বিপদে পড়ে যাবে। তার চাইতে বেশি বেশি করে জিনিস-পত্র আনিয়ে নিক ওকে দিয়ে, তারপর বিদেয় করে দেবে।

গোলোক রাগটা মনে মনে চেপে রেখে ওকে একটা বিরাট ফর্দ করে দিল। চারুলতা বাজার আনতে গেল। 

চারুলতা জিনিসপত্রের বোঝা নিয়ে যখন ফিরে এল তখন গোলোক দেখল, তার সর্বদেহেই যেন বন্যা বইছে। আগেকার বিরক্তি দূর হয়ে গেল। করুণা হল গোলোকের। নিজেকে খুব স্বার্থপর বলে মনে হতে লাগল। সে জোয়ান-মদ্দ পুরুষ হয়ে ঘরে বসে আছে, আর তারই ভোগের সামগ্রী সংগ্রহ করতে একটা মেয়েলোককে সে দুর্যোগের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। 

গোলোক বলল, “দ্যাখো, চারুলতা, ওই ট্রাঙ্কে আমার কাপড় আছে, একটা বের করে নিয়ে পরো।”

চারুলতা গোলোকের দিকে চেয়ে হাসল। ওর সতর্ক হাসি যেন বলল, ঠিক হিসেব মতোই এগোচ্ছে কাজ। রান্নাঘরে গিয়ে চারুলতা নিজের ময়লা কাপড় ছেড়ে যখন গোলোকের ধোপভাঙা কাপড় পরে এ-ঘরে এসে হাজির হল তখন তাকে ঝি বলে, বুড়ি-ঝিদের সগোত্র বলে যেন মনেই হল না। বরং তাকে এই পরিবেশের মানুষ বলেই গোলোকের মনে হতে লাগল। পোশাকের পরিবর্তনে কি এত পরিবর্তন হয়? চারুলতা নিমেষেরে মধ্যেই যেন চা বানিয়ে এনে দিল। গোলোকের মনে হল, যেন কতকাল পরে সে চা খাচ্ছে। চা খাবার পর তার জড়তা কাটল। আজ তার আর কিছু করবার নেই। তাই বিছানা ছেড়ে উঠল না। 

চারুলতা নিঃশব্দে তার কাজ করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে গোলোকের খাবার বানিয়ে দিয়েছে। ঘর মুছে, বাসন মেজে রান্না চাপিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে গোলোক চারুলতার নিপুণ হাতের কারিকুরি চেয়ে চেয়ে দেখছিল। একটা জিনিস অবাক হয়ে লক্ষ করল গোলোক, শরীর সম্পর্কে মেয়েদের যে অতিরিক্ত সচেতনতা থাকে, লজ্জাবোধ থাকে, চারুলতার তা একেবারে নেই। উবু হয়ে যখন মেঝে ঘষছিল, তখন চারুলতার গা থেকে কয়েকবার কাপড় খসে পড়েছিল, কিন্তু চারুলতা তাতে কিছুমাত্র বিব্রত বোধ করেনি। গায়ে কাপড় তুলে দিতে তার যেন কিছুমাত্র তাড়া ছিল না। কাপড়ের আলগা আচ্ছাদনের মধ্য থেকে চারুলতার দেহের অনেক গোপনীয়তাই গোলোকের চোখে অনাবৃত হয়ে উঠেছিল। চারুলতার শরীরের আদলটা নিখুঁত। নিটোল গড়ন। এমন সুগঠিত দেহ খুব কম মেয়েরই দেখা যায়। মুখ এমনিতে হয়তো সাধারণই, কিন্তু কথায় কথায় চারুলতা হাসে আর অমনি তার ঠোঁটে একটা চাপা ব্যঙ্গের হাসির ঢেউ খেলে যায়, চোখ দুটো দেখলে তখন মনে হয়, যেন পৃথিবীর যাবতীয় রহস্য তার বোঝা হয়ে গিয়েছে; আর তাইতে চারুলতার স্বতন্ত্র এক ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়। 

গোলোক এক সময় আশ্চর্য হয়ে দেখল, চারুলতার এই প্রায় অনাবৃত দেহটি ওর নিকট সান্নিধ্যে আসা সত্ত্বেও গোলোক কোনও চাঞ্চল্য, কোনও অস্থিরতা বোধ করছে না। সে দেখল তার নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা অনেকটা উপশম হয়ে এসেছে। তার ভাল লাগছে। এতদিন এ-ঘরে যেন অনেক ফাঁক ছিল। চারুলতা তার প্রথম দিনের উপস্থিতি দিয়ে তা যেন অনেকটা ভরে দিয়েছে। আর কোনও অনুভূতির খোঁজ পাওয়া গেল না ওর মনে। শুধু একটা ভাল লাগার অনুভব তার চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল। অনেকদিন পরে শান্তি পেল গোলোক। তার চোখ ভরে ঘুম আসছিল। চারুলতার হাতে পরম বিশ্বাসভরে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল গোলোক। 

.

“উঠুন, উঠুন!” গোলোক চোখ মেলে দেখল, চারুলতা ডাকছে।”খাওয়া দাওয়া করবেন না? বাব্বা, কী ঘুম আপনার?” সে হাসল। 

গোলোক কেমন যেন লজ্জা পেল। তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়ল। বলল, “খেতে দাও, আমি মাথাটা ধুয়ে এখনই আসছি।”

“সে কী, চান করবেন না?” 

“নাঃ,” গোলোক জবাব দিল, “আজ বেশ ঠাণ্ডা আছে। সর্দি লাগে যদি।”

“গরম জল করে দিই তা হলে,” চারুলতা বলল, “একটু বসুন তবে, এক্ষুনি করে দিচ্ছি।”

“না না, তুমি আবার কষ্ট করবে কেন?” 

চারুলতা বলল, “এ-কাজ তো আমার মাইনের মধ্যেই পড়ে। তা ছাড়া এসব অভ্যাসও আছে। নার্সের কাজ শিখেছিলাম তো কিছুদিন।”

“তাই নাকি?” গোলোক অবাক হল। একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখতে চেষ্টা করল চারুলতাকে। চারুলতা ততক্ষণে হিটারে জল চাপিয়ে দিয়েছে। 

“হ্যাঁ।” চারুলতা একটু হাসল। “কিন্তু শেখাটা শেষ করতে পারিনি।”

“কেন?” প্রশ্নটা গোলোকের মুখ দিয়ে হঠাৎ বের হল। 

চারুলতা হাসল। বলল, “দুটি ছোকরা ডাক্তারের জন্য। দুজনে মিলে আমাকে নিয়ে লোফালুফি করল। তাই রোগীর সেবা করার বদলে তাদেরই সেবাদাসী বনে গেলাম। তাদের দাবি মিটিয়ে আর নিজের কাজ করার সময় থাকত না। শিখব কখন!” 

চারুলতা ঠোঁট টিপে হাসল। চারুলতার কথাবার্তা শুনে গোলোক থ মেরে গেল। এ-রকম করে কোনও মেয়ে যে কথা বলতে পারে সে-ধারণা গোলোকের ছিল না। মুখের আগল নেই যেন চারুলতার। গম্ভীর হয়ে গেল সে। একেবারেই বস্তির মেয়ে। ওর প্রগল্ভতার প্রশ্রয় দেবে না গোলোক। কথাবার্তা কমই বলবে, ওর সঙ্গে। 

খেতে খেতে গোলোক কিন্তু সব ভুলে গেল। কী চমৎকার রাঁধে চারুলতা। খেয়ে যে এমন তৃপ্তি হয়, এর আগে গোলোকের সে অভিজ্ঞতা হয়নি। গোলোক খুব খুশি হল। 

গদ্‌গদ হয়ে বলল, “তোমার রান্নার হাত খুব ভাল চারুলতা। 

চারুলতা শান্তভাবে হাসল। যেন বলতে চায়, এ আর নতুন কথা কী? এ তো আমি জানিই। 

বলল, “অনেক কষ্ট করে শিখেছি এটা।”

“কোথায় শিখলে চারু?” ইচ্ছে ছিল না কথা বাড়ায়, তবু ফস করে বলে ফেলল গোলোক। 

চারুলতা বলল, “বাগবাজারের এক বনেদি বাড়িতে। বাবুর বাড়িতে আয়ার কাজ করতাম। সেই বাড়িতে এক ঠাকুর ছিল, সেই আমাকে এমন রান্না শিখিয়েছে। কত রকম রান্না যে সে জানত, তার যেন সীমা নেই। দু-তিন মাসেই আমি অনেক রান্না শিখেছিলাম। আরও কিছুদিন থাকতে পারলে আরও নানা রকম শিখে নিতুম। কিন্তু কপালে সইল না।” চারুলতা হাসল। 

“কেন?” গোলোক আবার জিজ্ঞাসা করে বসল। চারুলতার প্রতি তার মন ক্রমশ প্রসন্ন হয়ে উঠছে। 

চারুলতা একটুও ইতস্তত না করে বলতে লাগল, “কেন আবার?” তার কণ্ঠে ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠল, “বাবু যেদিন টের পেলেন, তাঁর ভোগে তাঁরই মাইনে-করা ঠাকুর ভাগ বসাচ্ছে, সেদিন অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। আমার গালে ঠাস করে এক চড় মেরে বললেন, “হারামজাদি কুত্তি, তোর প্রবৃত্তিরও বলিহারি যাই, তুই ভদ্দরলোকের বাড়ি থাকার উপযুক্ত নোস। রাস্তার কুকুর রাস্তায় যা। বেরো বাড়ি থেকে। আমাকে তক্ষুনি, সেই রাত্তিরেই বের করে দিলেন। ভেবেও দেখলেন না, এত রাত্তিরে যাই কোথায়। আরও মজা কী জানেন, গিন্নি মা বাপের বাড়ি গেলে বাবু আমাকে পালঙ্কে তুলে, তোকে গয়না দেব, বাড়ি করে দেব, মাথায় করে রাখব চারু—বলে রাতের পর রাত কত সোহাগ করতেন, সে-সব সোহাগের কথা সেই সময় দেখলাম বেমালুম উপে গেল। এমন কি, আমার চার-পাঁচ মাসের মাইনে বাকি ছিল, তাও দিলেন না। ভদ্দরলোকের আঁতে ঘা লাগলে তারা কিন্তু ছোটলোকেরও অধম হয়ে যায়। ওঁর চাইতে ঠাকুরটা অনেক ভাল। সে শুধু নেয়নি, কিছু দিয়েও তো গেছে। নয় কি?” 

চারুলতা নিরুত্তেজ শান্ত গলায় সরলভাবে প্রশ্ন করে বসল। গোলোকের কানমাথা ঝিম ঝিম করে উঠল। রাগে শরীরটা রি রি করতে লাগল। ধমক দিল, “চুপ করো! তোমার আস্পদ্দা তো কম নয়।” 

গোলোকের রাগ দেখে চারুলতা অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল। গোলোকের মনে হল, ধমক খেয়ে, একটা শিশুই যেন পরিণত মেয়ের দেহ ধারণ করে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। গোলোক তাড়াতাড়ি সামলে নেবার চেষ্টা করল। অবশ্য বিরক্তিটা চাপতে পারল না। বলল, “তোমার কথাবার্তা বড় বিশ্রী চারুলতা। 

এতক্ষণে চারুলতার ঠোঁট চিরে আবার তার স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা ফুটে উঠল। 

তেমনি শান্তভাবে বলল, “বাবুরা কথকতা শোনবার জন্যে তো আমাকে রাখেন না, যে-জন্যে রাখেন সে-সব আমার খারাপ নেই। আপনি নিজেও তো প্রমাণ পেলেন।” 

“কিসের প্রমাণ?” গোলোক শঙ্কিত হল। এই ঠোঁটকাটা মেয়েটা আবার কী বলবে তাকে। মনে মনে একটু ঘাবড়েই গেল গোলোক। 

চারুলতা বলল, “বাঃ! এই তো আপনি আমার রান্নার প্রশংসা করছিলেন!”

“ও হ্যাঁ।” গোলোক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। 

চারুলতা বলল, “ঘরখানার দিকে একবার চেয়ে দেখুন না। কেমন আগোছালো, নোংরা করে রেখেছিল বুড়ি, আর এখন দেখুন আমিই বা কী করেছি। মিলিয়ে দেখে নিজেই বুঝবেন, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছিনে।”

না, তা বলছে না চারুলতা। গোলোক ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়েই তা দেখে নিল। ঘরের শ্রী ফিরে গেছে। তকতক করছে ঘরখানা। গোলোকের চোখে মুখে একটু হয়তো খুশির আভাসই ফুটে উঠল। চারুলতার সতর্ক চোখ সেটা তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলল। বলল, “আপনি আমাকে কাজে লাগাবেন, মাইনে দেবেন তার জন্য। তার বদলে আমি অপনাকে পুরোপুরি খুশি করব। এই আমার দস্তুর। পছন্দ না হয়, কাজে গাফিলাতি ঘটে, তাড়িয়ে দেবেন। কী, উঠছেন কেন? হয়ে গেল খাওয়া?” 

গোলোক বলতে বাধ্য হল, খুব তৃপ্তি করেই সে খেয়েছে। বলতে বাধ্য হল, এমন তৃপ্তি সে এর আগে আর কোনওদিন পায়নি। 

চারুলতা প্রশংসা যেন গায়েই মাখল না। এ-যেন তার জানাই। গোলোক মুখ ধুয়ে ফিরে এসে দেখে, মশলার বাটি আর সাজা পান নিয়ে চারুলতা দাঁড়িয়ে আছে। এ অভিজ্ঞতাও গোলোকের জীবনে আনকোরা নতুন। চারুলতা পণ করেছে, নতুন নতুন অভিজ্ঞতার আঘাতে গোলোককে ঘায়েল করে ছাড়বে। 

বলল, “এ আবার কী? আমি তো পান খাইনে।”

“তা হলে মশলা খান। ওইজন্যেই তো দুরকম রেখেছি। সকালে সেজন্যই তো জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তা আপনি তো চটেই উঠলেন। আপনার অভ্যেস কী, তা তো জানিনে। আপনার যা দরকার খোলাখুলি আমাকে বলে দেবেন 

গোলোক মশলা নিয়ে চিবোতে চিবোতে তক্তপোশের উপর বসল। চারুলতা এঁটো বাসন তুলে নিয়ে গেল। একটু পরে এসে চারুলতা বলল, “দেখুন, একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি। তখন ঘুমিয়ে পড়লেন তাই। আমার ভাতও কিন্তু রেঁধে নিয়েছি। একে তো ঘরে গিয়ে খাবার সংস্থান আমার নেই, তার ওপর এই বৃষ্টি। ভিজে ভিজে এখন যাব, আবার বিকেলে আসব আর সেই রাত্তিরে ফিরব। কতবার আর ভিজব। তার চাইতে এখানে খাওয়া-দাওয়া করে ওবেলার কাজ সেরে দিয়েই চলে যাব। কী, আপত্তি নেই তো?” 

গোলোক বলতে যাচ্ছিল, ও-বেলার কাজ সে নিজেই করে নিতে পারত, তার জন্য চারুলতার থাকার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বলতে গিয়েই ভাবল, চারুলতা যদি ভাবে খেতে দেওয়ার ভয়েই গোলোক তাকে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দিচ্ছে, তাই সে আর ওর প্রস্তাবে আপত্তি করল না। 

চারুলতা খাওয়া-দাওয়া সারল। সারা দুপুর ধরে নানান কাজ করল। এক ফাঁকে গোলোক দেখল, চারুলতা তার শাড়িটা পরে ফেলেছে। পান খেয়ে ঠোঁট দুটো লাল করেছে। গোলোকের মনে হল, চারুলতা এরই মধ্যে এখানে চমৎকার এক গার্হস্থ্য পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেছে। যার আস্বাদ গোলোকের অভিজ্ঞতায় এ-যাবৎ অনুপস্থিত ছিল। চারুলতাকে এই পরিবেশে মানাচ্ছেও বেশ। 

এক নতুন ধরনের আনন্দের সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচয় ঘটছে গোলোকের এ-আনন্দে উত্তেজনা নেই, জ্বালা নেই, যন্ত্রণা নেই। এর প্রভাব মৃদু, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী। 

গোলোকের মনের কোণে একটা আকাঙ্ক্ষা উকিঝুঁকি দিতে লাগল। আহা, এ কি অসম্ভব? একেবারেই অসম্ভব? এমন একটা গার্হস্থ্য জীবন কি প্রতিষ্ঠা করা যায় না? 

২১ 

যে-আকাঙ্ক্ষার অঙ্কুর সেই প্রথম দিনটিতেই গোলোকের মনের গভীর গোপনে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল, চারুলতার প্রাত্যহিক সাহচর্যে এক মাসের মধ্যেই সেটা দ্রুত ডালপালা বিস্তার করে গোলোকের সমস্ত মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। এখন তার অনেক সাধ। আর সে নিজেকে বঞ্চিত করে রাখতে চায় না। গোলোক আর ছন্নছাড়ার মতো থাকতে চায় না। সংসারী হতে চায় সে। সব সময় নিজের বোঝা বয়ে বেড়াতে আর ভাল লাগে না। ক্লান্তি এসেছে তার। অন্য কারও হাতে নিজেকে নিঃশেষে সঁপে দিয়ে মুক্ত হতে হতে চায় গোলোক। 

ঝর্না তার মনে যে ফিকে দাগ (গোলোকের তখন কিন্তু এটাকে গভীর বলেই মনে হয়েছিল) রেখেছিল, মনোরমা এসে তা মুছে দিয়েছিল। শুধু মুছেই দেয়নি, সে নিজেও গভীরতর এক ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। এখন চারুলতার প্রবেশে, তার দৈনন্দিন সাহচর্যে সেই অতীত ক্ষতের আর চিহ্নমাত্রও রইল না। অথচ ঝর্না আর মনোরমার সঙ্গে যে অন্তরঙ্গতা (ঝর্নার সঙ্গে আবেগের এবং মনোরমার সঙ্গে দেহের) গড়ে উঠেছিল গোলোকের, চারুলতার সঙ্গে তার শতাংশের এক অংশও গড়ে উঠল না। চারুলতা প্রথম দিন যত দূরে ছিল, এই একমাস পরেও সেই ততখানিই দূরে রয়ে গেছে। এ-একটা আশ্চর্য রহস্য বলে মনে হয় গোলোকের। চারুলতা এত নিঃসংকোচ, এত মুখফোঁড়, দেহ সম্পর্কে এত বিকারহীন (ইচ্ছে করলে যে-কোনও মুহূর্তে চারুলতাকে খাটে এনে শোয়াতে পারে গোলোক। একবার মুখ ফুটে বললেই হল। সে জানে চারুলতা একটুও আপত্তি করবে না। শুধু ঠোঁট টিপে হাসবে। আর সেই হাসিটা বলতে থাকবে : হ্যাঁ, এইবার পথে এসেছ, তবে এতদিন সাধুপুরুষটি সেজে ছিলে কেন?) তবু চারুলতার কোথায় যেন একটা প্রতিরোধের শক্ত গণ্ডী আছে। সেটা পার হওয়া অসাধ্য। 

গোলোক আর কোনও মেয়ের ভগ্নাংশ চায় না। এবার ষোলো আনাই চাই তার। সে কাউকে উজাড় করে দেবার জন্য যেমন প্রস্তুত, তেমনি তৈরি কাউকে উজাড় করে গ্রহণ করতে। সে যা যা চায়, গোলোকের স্থির বিশ্বাস তা চারুলতা, একমাত্র চারুলতাই দিতে পারে। এ-বিশ্বাস কী করে তার হল, সে জানে না। তবে এটা জানে, গার্হস্থ্য সুখ অন্তরে অন্তরে সে যা কামনা করছে, মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখছে, তা তাকে চারুলতাই দিতে পারে। 

চারুলতার সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব সহজ হয়ে উঠেছে। আগে চারুলতার কথাবার্তা তার কেমন স্থূল, কেমন উদ্দেশ্য-প্রণোদিত, কেমন অশ্লীল ইঙ্গিতময় বলে মনে হত। এখন গোলোক দেখল, তার প্রতিটি কথা সত্য। জীবনে অনেক ভুগেছে চারুলতা। বাপমায়ের স্মৃতিটুকুও তার মনে নেই। অনাথ আশ্রমে পালিত হয়েছে। ব্রহ্মচারী বাবার আশ্রম। একটু বড় হতেই চারুলতা দেখেছে, কিছু না দিয়ে এ জগতে কিছু পাবার উপায় নেই। ব্রহ্মচারী বাবা যেদিন চারুলতাকে প্রথম শাড়ি দিলেন, সেদিন তিনি শুধু শাড়িই দেননি, বৈজ্ঞানিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করলে গর্ভসঞ্চারের দায় কীভাবে এড়ানো যায় হাতে-কলমে চারুলতাকে সে শিক্ষাও দিয়েছিলেন। শিক্ষাটা যে কত মূল্যবান, পরবর্তী জীবনে পদে পদে টের পেয়েছে চারুলতা। যা-কিছু পেয়েছে চারুলতা, বিভিন্ন স্তরের লোকেদের কাছ থেকে, তা দু’দিনের আশ্রয়ই হোক, দু’পাতা বর্ণ পরিচয়ই হোক, কি বৃত্তিশিক্ষাই হোক, কি কোনও কাজকর্মের ব্যাপারই হোক, তার জন্য চারুলতাকে বেতন দিতে হয়েছে, দেহের মূল্যে। চারুলতা দৃঢ়ভাবে জানে পৃথিবী অবৈতনিক নয়। এ-সব কথা স্পষ্ট করে যখন চারুলতা বলেছে, ওর স্বকীয় প্রকাশভঙ্গিতে, তখন সে-কথা কখনও কখনও অশ্লীল বলেও মনে হয়েছে গোলোকের। কিন্তু আদ্যোপান্ত ইতিহাস শোনার পর গোলোকের ধারণা বদলেছে। বুঝেছে চারুলতা সত্য বই মিথ্যা বলে না। আর তার সত্য এত তিক্ত যে হজম করা শক্ত। গোলোকের মনে হয়েছে, এ-যদি অশ্লীলতা হয়, তবে সত্যও অশ্লীল। 

চারুলতার দুর্ভাগ্য, সে পৃথিবীর একটা দিকই দেখেছে। জগতের অন্য পিঠটাও এবার তাকে দেখাতে চায় গোলোক। বোঝাতে চায় এ-ও সব নয় চারুলতা। এ-পৃথিবীর আরও একটা দিক আছে। সেদিকের বাসিন্দারা ভালবাসে, ঘর বাঁধে, ভালবাসার লোকের জন্য নিজের স্বার্থ বিসর্জন দেয়। গোলোক নিয়মিত মনে মনে কাতরভাবে আবেদন জানায় চারুলতাকে, একটা সুযোগ সে তাকে দিক। কিন্তু মুখে সে এ-কথা একদিনও বলতে পারেনি। যেন ঠোঁটের কাছে এসেও আটকে গেছে। 

…আমার ধারণা বদলে দেবার জন্য আপনার এত মাথাব্যথা কেন, গোলোকবাবু?…গোলোক যেন স্পষ্ট দেখতে পায় তার কথা শোনার পর জেরা শুরু করেছে চারুলতা। সব জানি হাসিটা ছড়িয়ে পড়েছে তার ঠোঁটে। যেন বলছে, কী চাই, সোজা কথায় বলুন না। বাজে ভনিতায় দরকার কী? ঘর বাঁধতে চান? ওঃ তাই বলুন। তা এর জন্যে এত ধানাই-পানাই কেন করছেন। আমাকে রাখতে চান। এই তো? বেশ, আজ থেকেই তা হলে থেকে যাই এখানে? বস্তির ঘরটা ছেড়ে দেব। আপত্তি? না, আপত্তি কিসের গোলোকবাবু। অনেকদিন পরে ভাল ঘরে থাকব, ভাল বিছানায় রাত কাটাব। এতে আপত্তি করব কেন? স্যাঁতসেঁতে মেঝেয় ছেঁড়া কাঁথায় শুলে বুঝতেন, লোকে কেন ভাল বিছানার কাঙাল হয়। আর ভদ্দরলোকের বিছানায় এই তো প্রথম শুচ্ছিনে। সত্যি বলতে কী ভদ্দরলোকেদের পরিষ্কার যদি কিছু থেকে থাকে তো এই বিছানাটাই আছে। 

গোলোকের দিব্যচক্ষে চারুলতার এই মূর্তিখানি ভেসে ওঠে। আর তার সাহস লুপ্ত হয়। কিছুই জানাতে পারে না গোলোক। অথচ এ কথা জানাবার একটা তাগিদ, প্রবল তাগিদও অনুভব করে গোলোক। তার কেমন ধারণা হয়, সে পারবে। চারুলতার মরুভূতি-মনে সে বিশ্বাসের, ভরসার, ভালবাসার ফুল ফুটিয়ে তুলতে পারবে। ওর ঠোঁট থেকে অবিশ্বাসী হাসিটা মুছে ফেলতে পারবে। পারবেই। এটা একটা মহৎ কাজ বলে গোলোকের মনে হল। এটা তার মিশন। 

এই চিন্তাটা গোলোককে ক’দিন ধরে আনন্দ দিতে লাগল। চারুলতা একটা কথা কিন্তু ঠিকই বলেছে, এ-জগতে কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। তবে তা-ই দেবে গোলোক। চারুলতার মনে ভালবাসা ধরাতে তার যা কিছু ভাল আছে, সব দেবে। এক নতুন তপস্যায় মগ্ন হবে গোলোক। গোলোকের মধ্যে যদি সত্য থাকে, সেই সত্যই চারুলতার চোখ ফোটাবে। এই চারুলতার পুরনো কাঠামোয় গোলোক তিল তিল করে নতুন এক চারুলতার সৃষ্টি করবে। সে হবে গোলোকের একান্ত আপন। কায়মনে তারই। 

গোলোকের ভিতর সৃষ্টির প্রেরণা তীব্রভাবে জেগে উঠল। বাসনা প্রবল হল, চারুলতাকে মডেল করে ছবি আঁকার। 

চারুলতাকে বলল, “তোমার কয়েকটা ছবি আঁকব চারুলতা, আপত্তি নেই তো?”

চারুলতার ঠোঁটে সেই হাসি। বলল, “মডেল হতে হবে?” 

“বাঃ তুমি তো সব জানো দেখছি।”

“জানব না কেন,” চারুলতা তেমনি হাসতে হাসতে বলল, “এক বাবু যে মডেল করে রেখেছিলেন আমাকে। এক মাস ছিলাম। দু টাকা রোজ পেতাম। প্রথম তিন-চারদিন একটা টুলে বসালেন। তারপর শোয়ালেন বেশ পুরু গদি আঁটা বেঞ্চিতে। তারপর আর সেখান থেকে প্রাণে ধরে নামাতে পারেননি। পাঁচ-সাতদিনের টাকা বাকি ফেললেন যখন, তখন কড়া তাগাদা শুরু করলাম। একদিন গোটা পাঁচেক টাকা হাতে দিয়ে বললেন, তোমার বুকের গড়ন ভাল নয় চারু, এ মডেল আমার চলবে না।”

সঙ্গে সঙ্গে গোলোকের মুখ-চোখ ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। চারুলতা কী ভেবেছে তাকে? কিন্তু না, রাগ করে লাভ নেই। সংযত হল গোলোক। 

দুঃখের সঙ্গে বলল, “সবাইকে খারাপ ভাবো কেন চারুলতা?” 

“ছি ছি. সে কী কথা!” জিভ কাটল চারুলতা। নিতান্ত সরলভাবে বলল, “খারাপ তো আমি কাউকে ভাবিনে। আসল ব্যাপারটা আমি তো বুঝেই ফেলেছিলাম। বাবুর রেস্ত ফুরিয়ে গিয়েছিল। নইলে অত তাড়াতাড়ি আমাকে বিদেয় দিতেন না। কিন্তু আমার ভবিষ্যৎটাও আমাকে দেখতে হবে তো। সেই গদি আঁটা বেঞ্চিতে শুয়ে শুয়ে তো আর জীবন কাটবে না।”

“না, না,” গোলোক বিব্রত হয়ে বলল, “আমি সে-কথা বলছি না। আমি বলছি, জগতের সব লোককে এক রকম দ্যাখো কেন? একজন তোমার উপর অন্যায় করেছে বলে যে সবাই তোমার উপর অন্যায় করবে, এটা তোমার ভুল ধারণা।”

চারুলতা বলল, “তা হয়তো হবে। তবে কি জানেন, দিন আনে দিন খায় যারা, তাদের যদি সামান্য টাকাও মার যায় তবে খুব বিপদে পড়তে হয়। টাকা পয়সার ব্যাপারে আগে আমার এত নজর ছিল না। পরে ঠেকে ঠেকে এ-রকম হয়েছে। অনেক মার গেছে কিনা।”

গোলোক বলল, “আমি সে-কথা বলছিনে চারুলতা, তোমাকে আমি বোঝাতে পারছিনে কী বলতে চাইছি। আমি বলছিলাম কি–আচ্ছা চারুলতা, তোমাকে নিয়ে কেউ ঘর বাঁধতে চায়নি?” 

চারুলতা হাসতে হাসতে বলল, “আমি কি চিরকাল এই বস্তিতেই আছি নাকি? এমন বাবুও পেয়েছিলাম, যিনি আমাকে কলেজের মেয়ে সাজিয়ে নিয়ে বেড়াতেন। দু’মাস হোটেলে ছিলাম আমরা। অবিশ্যি তিন বছর আগে আমার চেহারাটা আরও ভাল ছিল।”

“না না, ও-রকম ঘর নয়, আমি সংসার পাতার কথা বলছি।” গোলোক বলল, “তোমাকে কেউ বিয়ে করতে চায়নি?” 

“ওমা, চাইবে না কেন?” চারুলতার ঠোঁটে সেই পরিচিত হাসিটা উকিঝুঁকি মারতে লাগল। বলল, “সোহাগের মানুষ কি কম এসেছে আমার! তবে বিয়ের কথা শুনলে আমি ভয় পাই। আমল দিইনে।”

“কেন চারুলতা, বিয়ে করা কি খারাপ?” 

“খারাপ কি ভাল তা জানিনে। তবে এটা দেখেছি যারা আমাকে বিয়ে করবে বলে লাফ-ঝাঁপ করত, কত রকম মিষ্টি কথা আমায় বলত, তারাই সব থেকে বেশি টাকা মেরেছে। শুধু কথায় কি পেট ভরে? তাই এখন আমি বলি, বাবা ওসব ধোঁয়া ধোঁয়া কথা রাখো, কী চাও স্পষ্ট করে বলো—ফ্যালো কড়ি মাখো তেল। 

“আচ্ছা, চারুলতা!” গোলোক গম্ভীরভাবে বলল, “এই তো তুমি এতদিন আমার এখানে আসছ, আমি কি তোমার খারাপ কিছু করেছি?” 

“ছি ছি, সে-কী কথা!” চারুলতা জিভ কাটে।”কিন্তু এসব কথা বলছেন কেন? আমার কাজকম্মে কি অসন্তুষ্ট হয়েছেন?” 

গোলোক বলল, “না। তোমার প্রত্যেকটি কাজ আমার ভাল লাগে। (তোমাকেও আমার ভাল লাগে, খুব ভাল লাগে। তোমায় আমি ভালবাসি চারুলতা। বিশ্বাস করো তোমাকে আমি খুব ভালবাসি। ) আমি কাজ সম্পর্কে কিছু বলছিনে। আচ্ছা চারুলতা—” 

গোলোক থেমে গেল। চারুলতা গোলোকের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। 

“আমি তো তোমাকে শাড়ি কিনে দিয়েছি। তুমি কি বলতে চাও তার পিছনে আমার কোনও মতলব আছে।”

চারুলতা অম্লান বদনে বলে ফেলল, “আপনার মনে কী আছে, আমি কী করে জানব?” 

ঠিক এ-উত্তরটা যেন আশা করেনি গোলোক। ব্যথা পেল সে। চারুলতার কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। 

“না, কোনও মতলব আমার নেই। ছিল না। তুমি এতদিন আছ, কোনও অন্যায় সুযোগ তোমার কাছ থেকে নিইনি। যদি চিরকাল থাকো, তখনও দেখবে, কোনও অন্যায় তোমার উপর করব না।”

গোলোক একটু উত্তেজিত হয়ে এতগুলো কথা বলে একটু থামল। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “আমাকে তোমার কী মনে হয় চারুলতা? আমার সম্পর্কে কী তোমার ধারণা?” 

“কোনও ধারণা নেই।”

চারুলতার উত্তরে জড়তা নেই। 

“কোনও ধারণা নেই!” গোলোক মনে মনে কেমন যেন অসহায় বোধ করল।”ভালমন্দ কোনও রকম ধারণাই নেই?” 

চারুলতা বলল, “আমি তো এসব কথা ভাবিনে।”

“আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই চারুলতা।” আবেগ দিয়ে বলে উঠল গোলোক। “তোমাকে বিয়ে করে ঘর বাঁধতে চাই। না, না, তুমি যা ভাবছ তা নয়। এ বিয়ে সত্যিকারের বিয়ে। তোমাকে নিয়ে আমি সুখী হতে চাই চারুলতা। তোমাকে সুখী করতে চাই।”

গোলোক আবেগভরে চারুলতার দুখানা হাত চেপে ধরল। চারুলতা হাসতে লাগল। তার চোখদটো যেন বলতে লাগল, এ খেলা এমন কিছু নতুন নয়। 

হঠাৎ চারুলতা বলে উঠল, “বেশ তো সাধটা মিটিয়ে ফেলুন। আজ থেকেই সুখী হবেন?” 

গোলোক বলল, “তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না। ভাবছ সেই আগের বাবুদের মতো আমিও ফাঁকা আওয়াজ করছি। কিন্তু আমি, তাদের মতো নই। তুমি বিশ্বাস করছ না, বুঝতে পারছি। কী করে তোমাকে বিশ্বাস করাব জানিনে।”

চারুলতা বলল, “আমাকে বিশ্বাস করাবার জন্য এত কষ্ট করার দরকার কী, তার চেয়ে যা প্রাণ চায় করে ফেলুন, অনেক সহজে সে-কাজ হবে। আমাকে সহজেই পাওয়া যায়।” 

“না না চারুলতা,” হতাশা গ্রস্ত গলায় গোলোক বলল, “সে পাওয়া নয়। আমি কী চাই তুমি বুঝছ না। আমি তোমার সব চাই। শুধু স্থূল শরীরটাই নয়, তোমার মনটাও চাই।”

চারুলতা হাসল আবার। স্পষ্টাস্পষ্টি বলল, “কিন্তু মনের সঙ্গে তো শোয়া যায় না গোলোকবাবু?” 

আরও হতাশ হল গোলোক। তবু হাল ছাড়ল না। বলল, “আমি আজ তোমাকে এ কথা বোঝাতে পারব না। কিন্তু একদিন তুমি বুঝবেই চারুলতা—” 

চারুলতা হঠাৎ বাধা দিল। বলল, “আপনি আমাকে মডেল করবেন বলছিলেন না?” 

“হ্যাঁ, কেন?–বাধা পেয়ে আশ্চর্য হল গোলোক। 

চারুলতা হাসতে হাসতে বলল, “তার জন্য আলাদা টাকা দেবেন তো?” 

গোলোকের গালে যেন ঠাস করে এক চড় মারল চারুলতা। এই তবে ভেবেছে সে? চারুলতার মনটা সত্যিই খুব ছোট। মহত্তর কোনও কিছু সেখানে রেখা ফেলতে পারে না। কখনও কী সেখানে দাগ ফেলতে পারবে না গোলোক? 

গোলোক বলল, “নিশ্চয়ই দেব চারুলতা। শুধু শুধু তোমাকে খাটাব কেন?” 

২২

চারুলতার নগ্ন শরীরটা অজস্র রেখার ঢেউ তুলে গোলোকের বিছানায় পড়ে ছিল। মুখটা গোলোকের দিকে ঈষৎ বাঁকানো। গোলোক তন্ময় হয়ে পটের উপর রঙ লাগাচ্ছিল। রঙে রঙে আরেকটা চারুলতা সৃষ্টি হচ্ছিল। এ চারুলতা গোলোকের একান্ত আপন। অজস্র মুহূর্ত নিঃশব্দে ঝরে পড়ছিল তাদের ওপর। গোলোকের তলির টানে দেখতে দেখতে দুটো চারুলতা আলাদা হয়ে গেল। পটের চারুলতা আসল চারুলতার দেহের রেখা ধরে ধরে এগোচ্ছিল! হঠাৎ পরিচিত নিশানা ছেড়ে দিয়ে ভাবলোকের মোহানায় ঢুকে পড়ল। এর মুখে কোমলতা, এর ঠোঁটে তৃপ্তি, এর চোখে বিশ্বাস। 

ছবিটা শেষ হতেই গোলোক উঠে পড়ল, চারুলতাও। সে অবাক হয়ে গেছে। ভাল করে ধরতে পারছে না। বুঝতে পারছে না। তবু কেমন ভাল লাগছে। গোলোক খুঁতখুঁত করছে। ভালই হয়েছে ছবিটা। তবু কোথাও যেন একটা ফাঁক রয়ে গেছে। কোথায়? ধরতে পারছে না। বারবার করে দেখল তবু ধরতে পারছে না। খচখচ করছে মনটা। ছবিটার সামনে চুপচাপ বসে রইল সে। কী যেন নেই? কী যেন একটা থাকা উচিত ছিল? না, ধরতে পারছে না। অস্থির হয়ে উঠল গোলোক। চারুলতা ওকে বিরক্ত করল না। নিজের মনে কাজ সেরে বাসায় চলে গেল। 

ভাদ্রের স্বচ্ছ বিকেল পার হতেই চারুলতা আবার ফিরে এল। তখনও ঠায় বসে আছে গোলোক। প্রায় একভাবেই। চারুলতার সাড়া পেতেই সে তার দিকে একবার ফিরে চাইল। ভাল করে হয়তো দেখল না। চারুলতা এবারও তাকে বিরক্ত করল না আপন কাজ যতটা নিঃশব্দে পারে সারতে লাগল। রান্নাবান্না করে গোলোককে খেতে ডাকল। গোলোক খাবার চাপা দিয়ে রাখতে বলল। রাত বাড়তেই চারুলতা যাচ্ছি বলে বেরিয়ে গেল। গোলোক সাড়া দিল না। কিসের অভাব? কোথায় ফাঁক? তার মগজে খালি এই প্রশ্ন ঘুরছে। এমন সময় তার মগজে যেন বিদ্যুতের লহর খেলে গেল। টিউব থেকে রঙ বার করে ছবিটা মেরামতো করতে লাগল। 

চারুলতা সকাল বেলায় ফিরে এল। দেখে দরজা খোলা। ঘরে আলো জ্বলছে। রাতের খাবার ঢাকা দেওয়াই আছে। গোলোক এলোমেলো হয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমচ্ছে। সারা শরীর যেন ক্লান্তিতে ডুবে পড়েছে। ছবি দেখে চারুলতা চমকে উঠল। এ তো সম্পূর্ণ নতুন ছবি! তারই ছবি? 

একটা মেয়ে শিথিল দেহ এলিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। পেটটা তার ঈষৎ স্ফীত। বুঝতে একটুও ভুল হয় না, সে মা হতে চলেছে। একটা হাত আলগোছে পেটের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। সন্তানকে যেন পরম মমতাভরে স্পর্শ করছে। সেই আবেশে মুখের উপর মাতৃত্বের কোমলতার ঢল নেমেছে। ঠোঁটে অপরিসীম তৃপ্তি। চোখে মধুর সম্ভাবনার প্রগাঢ় স্বপ্নের প্রলেপ। চারুলতা থ মেরে গেল। এই ছবি সে নয়, সে জানে। কিন্তু তবু তার মনে হল, এ যেন সে-ই। আগাগোড়া ছবিটায় কেমন পবিত্রতার ছোঁয়া লেগে রয়েছে। চারুলতা ভাবল, ছবির একটা মস্ত সুবিধে, তার জীবনে নোংরা লাগে না। ছবিখানার দিকে একমনে চেয়ে থাকতে থাকতে চারুলতার মনে হতে লাগল, সেও যেন এই ছবির মতো পবিত্র। কোনওদিন তার গায়ে কাদামাটি লাগেনি। তার ঠোঁটের পরিচিত হাসিটা মিলিয়ে গেল। মনের ভিতর কেমন যেন করছে। আনন্দ হচ্ছে। কান্না পাচ্ছে। কেমন যেন লাগছে। কেমন যেন মনে হচ্ছে, এ-চারুলতা আসল নয়, ঐ পটের চারুলতাই আসল। 

তার মনে পড়ল, তিন-চার বছর আগে তার পেটেও এক সন্তান এসেছিল। তখনকার বাবু জানতে পেরে অনেক হাঙ্গামা করে সেটা নষ্ট করিয়ে দেয়। সেই সন্তান সম্পর্কে তার কোনও মমতাও জন্মায়নি। কোনও ধারণাও না। শুধু দিনকতক ভুগতে হয়েছিল বলেই সে কষ্ট পেয়েছিল। সেটা শারীরিক। এতদিন পরে সেই সন্তানই বুঝি পটের চারুলতার পেটে আশ্রয় নিয়েছে। হয়তো ভেবেছে মানুষ চারুলতার চেয়ে পটের চারুলতার আশ্রয়ই বেশি নিরাপদ। কেমন যেন করছে তার মন। একটা কী রকম আকুলি-বিকুলি ঠেলে ঠেলে উঠতে চাইছে বুকের ভিতর থেকে। তার যেন আনন্দে হাসতে ইচ্ছে করছে। না, কান্না পাচ্ছে। 

তাড়াতাড়ি ছবির কাছ থেকে সরে গিয়ে হিটারে চায়ের জল চাপিয়ে দিল চারুলতা। আর তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। সে নিজেই অবাক হয়ে গেল। 

গোলোক যখন উঠল, দেখল চারুলতা চা তৈরি করে রোজকার মতই বসে আছে। 

চারুলতাকে যদি পেতে তাহলে সুখী হতে, না গোলোক? 

সুখী? নিশ্চয়ই সুখী হতাম। আমরা আবার নতুন করে জীবন আরম্ভ করতাম। আমার কামনা ছিল একটা স্বাভাবিক সংসারের আর চারুলতার ছিল সুস্থ এক সন্তানের। যে-সন্তানকে পিতৃপরিচয় নিয়ে লজ্জা পেতে, বিব্রত হতে হবে না, সেই রকম এক সন্তানের। শেষ পর্যন্ত আমি অসাধ্য সাধন করেছিলাম। চারুলতার মনের পরতে পরতে অবিশ্বাসের যে-কাঠিন্য ছিল, আমি তা সম্পূর্ণ দূর করে দিয়েছিলাম। ঘর বাঁধবার তীব্র কামনা চারুলতার মনেও জেগে উঠেছিল। কিন্তু মনোরমা সব ভেস্তে দিল। না, মনোরমার দোষ কী? 

এ তো আমার পাপেরই শাস্তি। 

পাপ পুণ্যে তুমি বিশ্বাস কর গোলোক? 

না, করি নে। কিংবা হয়তো করি। ঠিক জানি নে। তবুও এ-কথা মনে হয়েছে আমার। কেন, তাও জানিনে। আজ নয়, আবার মনোরমাকে পেয়ে যেদিন সংযম হারালাম, সেই তখনই একথা, এই পাপের ভয়, আমার মাথায় ঢুকেছে। 

২৩ 

তা গোলোক অসাধ্য সাধনই করল। ধীরে ধীরে চারুলতার মনে স্বপ্নের চারা বুনে দিল সে। একটু একটু করে বিরাট পরিবর্তন সত্যিই সে চারুলতার ঘটাল। গোলোকের নিজেরও পরিবর্তন হয়েছে। সেই হতাশা নেই, অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানো নেই। ছবি আঁকায় মন বসেছে। প্রেরণা পাচ্ছে। এই সময়ের আঁকাগুলোই গোলোকের মতে তার শ্রেষ্ঠ রচনা। তার নিজের ভাল লাগে দিন সাতেক আগে যেখানা শেষ করেছে। নাম দিয়েছে ‘যশোমতীর স্বপ্ন’। যশোদার সর্ব অঙ্গে মাতৃত্বের তীব্র কামনা ফুটে উঠেছে, ছবিখানার মূল ভাবটা এই। এ-ছবিতে চারুলতাকে মডেল করেনি গোলোক। তবু চারুলতার আকাঙ্ক্ষাটাই রূপ ধরেছে পটে। 

গোলোক আরও খুশি হয় চারুলতার হাবভাব দেখে। মুখোশ খুলে আর একটা মূর্তি যেন বেরিয়ে এসেছে। গোলোক এখন প্রতি মুহূর্তে আশা করে এই বুঝি চারুলতা তাকে সুযোগ দেবে বিয়ের প্রস্তাবটা পাড়বার। সে ঠিক করল, কোনও বাসনাই অপূর্ণ রাখবে না চারুলতার। অনুষ্ঠান করে বিয়ে করবে তাকে। নেমন্তন্ন করবে পরিচিত বন্ধু-বান্ধবকে। ঝর্নাকে বলবে (ঠিকানা বার করতে অসুবিধে হবে না), মনোরমাকে বলবে। ঘটা করে ফুলশয্যার বাসর সাজাবে। যা-কিছু করবে, পাড়া জানিয়ে। চারুলতাকেও বলবে তার পরিচিত জনদের আমন্ত্রণ জানাতে। আসুক, যারা তার গত ইতিহাসের সাক্ষী, তারা আসুক, দেখুক, চারুলতা কেমন ঘর পেতেছে, অস্থায়ী নয়, স্থায়ী। অসম্মানের ভিতের উপরে নয়, সম্মানের বনেদে। গোলোক প্রস্তুত। এখন চারুলতা ইঙ্গিত করলেই হয়। 

চারুলতার চেহারাও যেন কিছু বদলে গেছে বলে গোলোকের মনে হয় আজকাল। মুখ-চোখের সেই সদা-সতর্ক ভাবটা নেই। ঠোঁট থেকে ‘সব-জানি’ হাসিটাও বিদায় নিয়েছে। এখন চারুলতার সঙ্গে আর পাঁচটা নিতান্ত সাধারণ মেয়েরও তফাত বোঝা হয়তো একটু মুশকিল। আপাত-নজরে তাকে বেশ বোকাসোকাই ঠেকবে এখন। এ-মেয়েকে গোলোকের আর ভয় করার কিছু নেই, এটা সে বুঝে গেছে। তার অহমিকা তৃপ্ত হয়েছে। 

চারুলতা আজকাল কী যেন ভাবে। কথায় কথায় অন্যমনস্ক হয়ে যায়। অস্থির হয়ে উঠে। আগের মতো বেশিক্ষণ থাকেও না। সে-ই এখন গোলোকের সামনে ভয়ে ভয়ে থাকে। কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে সে গোলোকের দিকে চেয়ে থাকে মাঝে মাঝে। চারুলতার চোখে কেমন ঘোলাটে বিভ্রান্তি। যেন বলতে চায়, এ-ও কী হয়? স্বপ্ন কী সত্যিই সত্য হয়? চারুলতার ব্যক্তিত্ব যে অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়েছিল, আজ সেই ভিতে ভাঙন ধরেছে। নতুন জমিতে পা দেওয়া নিরাপদ কি না, তাও বুঝতে পারছে না; আবার এ যে মিথ্যে, প্রকাণ্ড ফাঁকি, সেটাও আগের মতো জোর দিয়ে বলতে পারছে না। আগে যে-কথাগুলোকে ফাঁপা ফাঁপা বলে মনে হত, তার জোর যে তার অভিজ্ঞতার চাইতেও বেশি, সেটা দেখে অবাক হল চারুলতা। এখন তার মন এই কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারলেই যেন খুশি হয়। 

চারুলতার চেহারা এর মধ্যেই কেমন শুকিয়ে উঠেছে। চোখের নীচে কালি পড়েছে। গোলোকের মনে হয় ও বোধহয় রাত্রে ঘুমোয় না। চারুলতাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য, ওকে বুকে টেনে নিয়ে আদরে আদরে ভয় ভাঙাবার জন্য প্রবল ইচ্ছা হয় গোলোকের। চারুলতা ভুগছে যে-যন্ত্রণায়, সেটা উপশম করে দেবার লোভটাও দুর্নিবার হয়ে ওঠে। সে নিজেও ভোগে। তবু সংযত করে নিজেকে। বহুদিন নিরুদ্দেশে জাহাজ চালিয়ে গোলোক দিক-চক্রবালে এক ডাঙার সন্ধান পেয়েছে, এখন মুহূর্তের দুর্বলতায় তার কাছ থেকে আর ভেসে যেতে চায় না। সতর্কভাবেই তার লক্ষ্যে সে পৌঁছতে চায়। পুড়ুক, জ্বলুক চারুলতা। খাঁটি সোনা হয়ে বেরিয়ে আসুক। গোলোকও বিশুদ্ধ হয়ে তার জন্য অপেক্ষা করবে। 

হঠাৎ চারুলতা বলল, “দুদিনের ছুটি চাই।” 

“কেন?” আঁতকে উঠল গোলোক।”

চারুলতা বলল, “কেন তা জানিনে। আমার ভাল লাগছে না।”

কী করবে, বুঝতে পারল না গোলোক। চারুলতা কী সরে পড়তে চায়? গোলোক চোখে অন্ধকার দেখল। না কী তাকে আরও পরীক্ষা করতে চায়? গোলোক নিজেকে সামলে নিল। 

ধীরে ধীরে বলল, “যেতে চাও, বাধা দেব না চারু। কিন্তু ফিরে আসবে তো?”

চারুলতা বলল, “কী জানি, ঠিক বলতে পারছিনে। যদি ফিরি, মন ঠিক করেই ফিরব যাতে আর কখনও ফিরতে না হয়।” 

গোলোকের রক্ত ছলাত করে উঠল। তার মন বলল, তবে চারু ফিরবেই। তার একটা চুমু খাবার ইচ্ছে হচ্ছিল। হঠাৎ মনে হল, কাকে চুমু খাবে গোলোক? চারুলতাকে? কোন অধিকারে? তাই ইচ্ছেটা দমন করল। 

চারু জানতে চেয়েছিল কাজ করার লোক সে ঠিক করে দেবে কি না? গোলোক বলল, না। নিজের কাজ সে নিজেই করে নিতে পারবে এ দু’দিন। লোক তার দরকার নেই। 

সকালে ঘুম ভাঙতেই গোলোকের মনে হল আজ চারু আসবে। আসতেই হবে তাকে। চরম প্রত্যাশায় সে থরথর করে কেঁপে উঠল। সে তাড়াতাড়ি উঠে হিটার জ্বালল, নিপুণ হাতে চা তৈরি করল। আজ সে আসবে। পরিপাটি করে দাড়ি কামাল গোলোক। আয়নায় চকচকে মুখখানা দেখে খুব খুশি হল সে। আজ চারু আসবে। পরশু থেকে এ-ঘরে পা পড়েনি চারুর। সমস্ত বোঝাপড়ার নিষ্পত্তি করে আজ সে আসবে। কালকের দিনটা যেন কাটতেই চায়নি গোলোকের। প্রতি মুহূর্তে সে অধৈর্য হয়ে উঠেছে। মনে হয়েছে এ দিনটা বুঝি জীবনে কাটবে না। মনে হয়েছে, এতগুলো ঘন্টা, এতগুলো মিনিট, পল অনুপল একটা দিনের পক্ষে একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। এই একটা দিনের মাল-মশলা দিয়ে অনায়াসে হাজার হাজার দিন গড়া যেত। এই অপব্যয়ে সে বেশ বিরক্তি বোধ করছিল। কাল কোনওও উত্তেজনা ছিল না, কোনওও আশা ছিল না, শুধু ক্লান্তি। হতাশার, নিঃসঙ্গতার একঘেয়েমি। স্বাদহীন বিড়ম্বনা। 

আজ সে আসবে। দিনের রঙই বদলে গেছে। এক সময় গোলোক দেখল, সব কাজ সারা হয়ে গেছে তার। পরিপাটি করে চান করল গোলোক। কোথাও এক ছিটেফোঁটাও মালিন্য থাকতে সে দেবে না। চারু আসবে আজ। ধোয়া শরীর ধোয়া মন নিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাবে গোলোক। দুপুর গড়িয়ে যেতেই দিনের ঢিলেমি আবার আরম্ভ হল। চারুলতা এল না। তবে কী সে আসবে না? আসবে, আসতেই হবে তাকে। গোলোকের বিশ্বাস একটুও টলল না। 

কিন্তু, চারুলতা এল না। হুড়মুড় করে মনোরমা এসে ঢুকল। কেউ যেন তাকে তাড়া করেছে। সে হাঁফাচ্ছে। মুখখানা পরিশ্রমে টকটকে হয়ে উঠেছে। চোখে দারুণ উত্তেজনা। সেই মনোরমা। সে ঘরে ঢোকামাত্র ঘরময় সেই পরিচিত মাতাল করা সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। তার ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল গোলোকের ঘ্রাণে, মগজে, প্রতিটি লোমকূপে। গোলোকের হৃদয়স্পন্দন দ্রুততর হল। সে ভয় পেল। সতর্ক হবার চেষ্টা করল। 

হাঁফাতে হাঁফাতে নিচু গলায় মনোরমা বলল, “পালিয়ে এলাম গোলোক, পালিয়ে যেতে এলাম। আর পারছিনে।”

“কোথায় যাব?” গোলোক প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। খাটটা শক্ত করে চেপে ধরল। এক্ষুনি যেন তাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবে মনোরমা। 

মনোরমা দৃঢ় পায়ে এগিয়ে এল গোলোকের কাছে। একেবারে কাছে। তার শাড়িটা গোলোকের গায়ে ঠেকল। এই সেই পরিচিত দেহ। এখন তার নাগালের মধ্যে। এই দেহে কী দুর্নিবার আমন্ত্রণ। ঐ চোখের কুহকে কী অনিবার্য আকর্ষণ। গোলোকের দেহের গ্রন্থিগুলো দ্রুত ঢিলে হয়ে আসছে। যে-সব বাঁধনে তার অবয়বটা জোড়া লেগে আছে, পটপট করে যেন তা ছিঁড়ে যাবে। তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, অণু-পরমাণু যেন খুলে খুলে আলাদা হয়ে পড়ছে, তারপর প্রচণ্ড চৌম্বক টানে সবগুলো দ্রুতবেগে আছড়ে পড়তে চাইছে মনোরমার উপর। 

“ভুল করেছি গোলোক, তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে ভুল করেছি।”

(ভালই করেছিলে মনোরমা, তোমার ভুলকে ধন্যবাদ দিই। তাই তো আমি চারুলতাকে পেয়েছি। ) 

“কথা বলছ না কেন গোলোক, এই দ্যাখো সেই ভুল শোধরাতে আজ আমি বেরিয়ে পড়েছি।” 

(বাড়ি ফিরে যাও মনোরমা, আজ আর আমি তোমার নই। ) 

“আজ আমি তোমার গোলোক।”

(আজ আমি চারুর, মনোরমা। ) 

“সেই আগের মতোই তোমার, কায়মনে তোমার।”

(তোমার স্বামীকে তুমি ভালবাসো, মনোরমা। আমি চারুকে। ) 

“আমি অনেক যুঝেছি গোলোক, আর পারিনে। পারিনে। পারিনে। সেদিন জীবনের ক্ষুধার চেয়ে স্থায়িত্বকে, নিরাপত্তাকে বড় বলে মনে করেছিলাম। ভেবেছিলাম তাতেই সুখ। ভেবেছিলাম স্বামীর চোখ একদিন না একদিন পড়বেই। এই চারমাস চেষ্টার ত্রুটি করিনি। কিন্তু একটুও টলাতে পারিনি। তার সদা সর্বদা ভয়, আবার যদি অসুখ করে আমার। শেষে মরিয়া হয়ে একদিন সব বলে দিলাম। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা খোলাখুলি বলে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে ওর মুখ শুকিয়ে গেল। সেই বিকালেই আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল ডাক্তারের কাছে। যখন শুনল, না, বাচ্চা-টাচ্চা হবার সম্ভাবনা নেই, তখন নিশ্চিন্ত হল। বাড়ি এসে ধমক দিল। না গোলোক, একটুও ঈর্ষা জাগেনি ওর মনে। সেই সেদিন ভারী সুটকেশটা তুলেছিলাম বলে যেভাবে ধমকেছিল, এইদিনও তেমনিভাবেই ধমকাল। বলল, এমন কিছু করো না রমা, যাতে আবার অসুখটা ধরে। তবে, আমি কী সারলাম গোলোক, কী এমন স্বাভাবিক হলাম! আমি যে সুস্থ হয়েছি, সেরে গিয়েছি, স্বাভাবিক হয়েছি—এ ওরা কেউ বিশ্বাস করে না। আমি মানুষের মতো বাঁচতে চাই, গোলোক। রক্ত-মাংসে গড়া মানুষের দাবি মিটিয়েই বাঁচতে চাই। চিরকাল শো-কেসে তোলা মোমের পুতুল হয়ে থাকতে চাইলে—” 

মনোরমার চোখে জল এসে গেল। সমবেদনায় গোলোকের মন টনটন করে উঠল। এ-ব্যথা গোলোক বোঝে। তার শরীরও যে দীর্ণ। গোলোক কোনও কথা লুকায়নি চারুলতার কাছে। তাই কী চারু পিছিয়ে গেল? সেও ভয় পেল নাকি? 

গোলোক মনোরমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য ওর দুখানা হাত নিজের হাতে নিতেই অনিবার্য বিপর্যয় ঘটে গেল। ধীরে ধীরে তার চেতনা যখন ফিরে এল, তখন দেখল তার বুকে মুখ গুঁজে মনোরমার শিথিল দেহ পরম নির্ভয়ে পড়ে আছে। 

এ কী! এ কী করল সে! শপাং করে গোলোককে তার বিবেক যেন চাবুক মারল। তৎক্ষণাৎ উঠে পড়ার চেষ্টা করল। পারল না। মনোরমার দেহটা তাকে যেন টিপে ধরে থাকল। গোলোক অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করল। 

তারপর কী হল, গোলোক? বাকিটুকু তাড়াতাড়ি শেষ করো। রাত আর বেশি নেই। 

হ্যাঁ, আর বেশি বলবারও নেই। খুব ভাল করে মনেও নেই সব। শুধু মনে আছে, মনোরমার দেহের নীচে চাপা পড়ে আমি অনুশোচনায় জ্বলে-পুড়ে মরছিলাম। এ-কথাটা এখন আমার নিজের কাছেই ন্যাকামির মতো লাগছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার যে অনুশোচনা হচ্ছিল, তাতে ন্যাকামির লেশমাত্রও ছিল না। আমার অন্তর তখন বলছিল, পরস্ত্রীর (আশ্চর্য! এই প্রথম বোধ করলাম মনোরমা পরস্ত্রী, আমার কেউ নয়) সঙ্গে এই ব্যবহার অবৈধ, অন্যায় এবং পাপ (চট করে ‘পাপ’ কথাটা আমার মনে উদয় হল)। 

বেলা যে গড়িয়ে গিয়েছে সে খেয়ালই ছিল না। খেয়ালটা হল, চারুলতা ঢুকতে। চারুলতাকে দেখেই আমার চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। কে যেন আমাকে অন্ধকারের অতল গহ্বরে ছুড়ে ফেলে দিল। আমি ঘুরতে ঘুরতে নিরুদ্দেশের গভীরে তলিয়ে যেতে লাগলাম। প্রাণপণ চেষ্টায় মনোরমাকে ঠেলে ফেলে উঠে পড়লাম। মুহূর্তে মনোরমার তৃপ্তির ঘোর কেটে গেল। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ধড়মড় করে উঠে বেশবাস সামলাতে লাগল। চারুলতা স্থির দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়ে রইল। তার ঠোঁটে অনেকদিন পরে সেই ‘সব-জানি’ হাসিটা অনেক তীব্রতা নিয়ে ফুটে উঠল, দেখলাম। এতদিনে যেন চারুলতা হিসেবটা মেলাতে পারল। কয়েক মুহূর্তেই নতুন চারু, পুরনো চারুর মধ্যে মিলিয়ে গেল। তবু আমার মনে হতে লাগল, ও যেন অন্য মানুষ। দেহপশারিনী নয়, এক সম্রাজ্ঞী। আমি যেন ওর মনিব নই, ছিঁচকে চোর একটা। ধরা পড়ে মুখ নিচু করে বসে আছি। মনোরমার অবস্থা যে আরও খারাপ, সে তো না বললেও চলে। অবশ্য সে তখন কী করছিল কী ভাবে সামাল দিচ্ছিল নিজেকে, আমি দেখিনি। একবার মনোরমা যখন যাবার জন্য উঠল তখন চারুকে বলতে শুনলাম——এখনই উঠছেন কি, এক কাপ চা খেয়ে যান। তা ছাড়া এ-ভাবে পথে বোরোয় নাকি, মুখখানা আয়না দিয়ে দেখুন তো। যান, কলঘর থেকে ছিরি ফিরিয়ে আসুন। 

মনোরমা বাথরুমে গিয়েছিল কি না, চা খেয়েছিল কি না জানি না। মাথা তুলতে পারিনি। আরেকবার চারুলতাকে বলতে শুনলাম (তখনই বোধহয় মনোরমা চলে গেল) ও, আপনার সঙ্গে বাবুর বুঝি টাকা-পয়সার লেন-দেন নেই। আপনারা, ভদ্দর ঘরের মেয়েরাই এইভাবে বাজারটা নষ্ট করে দিচ্ছেন। 

মনোরমার কিসের প্রাণ জানিনে। তবু সে মরল না। আশ্চর্য! লাঠি-খাওয়া কুত্তির মতোই (আমার বোধহয় এ-কথাটা বলা ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু বলে বেশ সুখ পাচ্ছি কিন্তু) মনোরমা যে সেদিন চলে গিয়েছিল, সেটা আন্দাজ করতে পারি। 

একটু পরে চারুলতা বলল, “এবার আমিও যাই। পাওনা চুকিয়ে দিন।”

এত সহজে নিষ্কৃতি পাব ভাবিনি। আমি আর চারুলতাকে সহ্য করতে পারছিলাম না। হাত দিয়ে ড্রয়ারটা দেখিয়ে দিলাম। টাকা গুনে নিয়ে চারুলতা বেরিয়ে গেল। এতক্ষণে সব খেলা সাঙ্গ হল। আঃ, অদ্ভুত আরাম লাগতে লাগল। যেন মুক্তি পেয়ে গেছি। আমার মনে কেউ নেই আর। মনোরমা নেই। চারুলতা নেই। কয়লা তুলে নেবার পর খাদের শূন্যতা যেমন বালি ঢেলে ঢেলে ভর্তি করা হয়, আমার মন থেকেও তেমনি মনোরমা আর চারুলতা বেরিয়ে যাবার পর মনের শূন্যতা ভরে উঠল ক্লান্তি আর অবসাদে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। 

২৪ 

বেশ টেনে একটা ঘুম দিয়েছিল গোলোক। ভোর হল, আলো ফুটল, বেলা বাড়ল। তখনও গোলোক ঘুমুচ্ছে। দরজায় খটখট আওয়াজ হল। চমকে ঘুম ভাঙল গোলোকের। চারু! গোলোকের মনে হল, চারুলতাই এসেছে। গোলোক বিব্রত হল। আবার খুশিও। তৈরি হল, কঠিনতর এক সংগ্রামের মহড়া নিতে। চারু ফিরে এসেছিল, গোলোকের মনে পড়ল। তার মানে, সে ধরা দিতে এসেছিল সংসারের নিবিড় বন্ধনে। গোলোক মুহূর্তের দুর্বলতায় চারুকে আবার ঠেলে ফেলে দিয়েছে অবিশ্বাসের অকূল দরিয়ায়। জগতে ভাল কিছু ঘটে না, এই বিশ্বাস নিয়েই কাল চারু ফিরে গিয়েছিল। অভিযোগও করেনি, হা হুতাশও না। এ তো তার জানাই ছিল। এমনই হয়। হয়ে থাকে। মাঝখানে গোলোকের মিষ্টি কথার ছবিতে নিজেকেই ভুল বুঝতে শুরু করেছিল চারুলতা। এতকাল যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে চারুলতা জীবন কাটিয়ে এল, তা মিথ্যে। সত্য শুধু গোলোকের আঁকা ছবি! কথার ফুলঝুরিতে এতদিন তার চোখে যে-সব ছবি ফুটিয়ে তুলেছে গোলোক, সত্য শুধু তা-ই! গোলোক জানে চারুলতার মনে এসব কথাই উকি মারছে। বন্ধ দরজার ওপিঠে দাঁড়িয়ে এখনও নিশ্চয়ই এসব কথাই ভাবছে চারুলতা। গোলোক যে-বিশ্বাসের ভিত কাল ভেঙে দিয়েছে, তা কী আবার কখনও গড়তে পারবে নতুন করে; মনে হয় না। না পারুক, হাল ছাড়বে না গোলোক, ভাঙা ভিতের ওপরেই ভালবাসার ইমারত আবার সে গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। এই চেষ্টাতে সারাটা জীবনই যদি তার খরচ হয়ে যায়, যাক। সে দুর্বল, তাই সে ভুল করেছে। তা বলে চারুর প্রতি তার ভালবাসা মিথ্যে হয়ে যায়নি। এখনও না। সেই ভালবাসাই তাকে জোর দেবে, সেই জোরেই এগিয়ে যাবে গোলোক। আর ভুল নয়। আর লক্ষ্য হারাবে না গোলোক। এতক্ষণে সে সাহস পেল। খট খট খট। দরজার কড়ায় অসহিষ্ণু শব্দ উঠল। গোলোকের মনে হল, চারুলতা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। তবে কী সে বোঝাপড়াই করতে এসেছে? আসুক না। আজ আর ভয় করবে না গোলোক। কাল সে চোরের মতো ছিল, আজ সে মানুষের মতো দরজা খুলে দাঁড়াবে চারুলতার সামনে। 

দরজার খিল খুলতে আদৌ বিব্রত বোধ করল না সে। একটুও হাত কাঁপল না তার। তবুও সে চমকে গেল পুলিশের লোক দেখে। একজন অফিসার, আর একজন সেপাই। 

অফিসারটি নমস্কার করে বললেন, “আপনিই গোলোকবাবু?” 

গোলোক বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ। আমাকে কী প্রয়োজন?” 

অফিসারটি বললেন, “প্রয়োজন খুবই জরুরি। কিন্তু তার আগে জানা দরকার আপনার পুরো নামটি কী?”

“গোলোক মজুমদার।”

“চারুলতা নামে কোনও মেয়েকে চিনতেন?” 

সাংঘাতিক আশঙ্কায় গোলোকের বুক দুরু দুরু করে উঠল। প্রায় চেঁচিয়েই উঠল, “কী হয়েছে চারুলতার; কী করেছে সে! মারা যায়নি তো!” 

“আজ্ঞে ঠিক তা-ই। আত্মহত্যা করেছে। মানে, আমার সেই রকমই সন্দেহ। কিন্তু দেখছি, আপনি ব্যাপারটা জানেন।” 

গোলোকের কানে পুলিশ অফিসারের কথা ভাল করে ঢোকেনি। তার মনে প্রবল ঝড় বইছিল তখন। হ্যাঁ সে জানে। না, জানে না। তার সঙ্গে পরামর্শ করে মরেনি চারুলতা। তবু, এখন তার মনে হচ্ছে যেন, এটা নিতান্ত অজানাও নয়। কিন্তু আগে এটা অনুমান করতে পারেনি কেন গোলোক? কালকেই কেন এই সন্দেহ হয়নি তার! কেন সে চারুলতাকে যেতে দিল অমন করে। গোলোকের অন্তরে কেউ যেন ধারালো ছুরি বসিয়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ ছটফট করল গোলোক। তারপর তার মন ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে পড়ল। 

থানায় গিয়েও তার এ জড়ত্ব পুরোপুরি কাটল না। দারোগার জেরায় চারুলতা সম্পর্কে যা জানত সবই বলল। ঝিগিরি করতে এসেছিল চারুলতা। গেরস্থালির সব কাজই করত, কিছুদিন মডেলও হয়েছিল গোলোকের। হ্যাঁ, গোলোক আর্টিস্ট। চারুলতা তার প্রেরণার উৎস ছিল —এ কথা সত্য, সে গভীরভাবে ভালবেসেছিল চারুলতাকে। যে-ভালবাসা মনকে মহৎ করে, অন্তরকে বিশুদ্ধ করে, যে-ভালবাসা দেহের দাহ শীতল করে, সেই ভালবাসা জন্মেছিল গোলোকের মনে। একথা সত্য, পরম সত্য। কী জানি কেন মনোরমার প্রসঙ্গ একেবারেই তুলল না গোলোক, হয়তো ভাবল, মনোরমার ভূমিকা প্রকাশ পেলে চারুলতার মৃত্যু মহান হয়ে উঠবে না। (চারুলতা মনোরমার কাছে হেরে গেছে। সেই পরাজয় ভুলতেই হয়তো জীবন দিয়েছে। শুধু-শুধু আর এক সংসারে আগুন জ্বলবে। কাজ কী? গোলোক নিজের কাঁধেই সব দোষ চাপাল। সে-ই তো দোষী। তার পাপেই মরেছে চারুলতা। ) 

গোলোক পুলিশের কাছ থেকে শুনল, এক শিশি ক্লোরোফর্ম খেয়ে চারুলতা মরেছে। ভোর প্রায় চারটের সময়। চারুলতার লাশটা দেখে পুলিশের ধারণা হয়েছে সেই রকমই। টকটকে লালপেড়ে সিল্কের শাড়ি পড়েছিল চারুলতা। আনকোরা নতুন সায়া, নতুন বডিস, নতুন ব্লাউস, সব সেই দিনই কেনা। ক্যাশমেমো পাওয়া গিয়েছে তার ঘরে। (হ্যাঁ, চারুলতা পাওনা টাকা সেইদিনই গোলোকের কাছ থেকে মিটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ) হাতে শাঁখা ছিল তার, সিঁথেয় সিঁদুর। দেখে মনে হয় সেইদিনই পরা, যেন নতুন কনে। সদ্য বাসর থেকে উঠে এসেছে। চারুলতা ক্লোরোফর্ম কোথায় পেল, পুলিশ সে-সন্ধান পায়নি। গোলোকের সামনেই লাশ-কাটা ঘর থেকে ময়না তদন্তের রিপোর্ট এল। 

দারোগাবাবু রিপোর্ট দেখে বললেন, “আত্মহত্যা। যান মশাই বাড়ি যান। আপনাকে আর দরকার নেই। 

গোলোক ফ্যাল ফ্যাল করে দারোগাবাবুর মুখের দিকে চেয়ে রইল। 

দারোগাবাবু বললেন, “পেট-ফেটও তো বাধেনি, ক্লিয়ার রিপোর্ট, তবে মরতে গেল কেন—জানেন কিছু?” 

গোলোক সে কথার জবাব দিল না। চুপ করে বসে রইল। 

আর কতক্ষণ বসে থাকবে, গোলোক, শিশিটা সামনে রেখে? সময় হয়েছে, ছিপিটা এবারে খোল। চারটে বাজে। এত থাকতে তুমি ক্লোরোফর্ম আনলে কেন? 

চারুলতা যে তা-ই খেয়েছিল। আমি তো জানি, সে কিছুদিন নার্সগিরি করেছে। এসব বিষয় সে আমার থেকে অনেক বেশি জানে। তাই, জ্বালা জুড়োতে সে যখন ক্লোরোফর্ম খেয়েছে, তখন আমিই বা তার অনুসরণ করব না কেন? আমারও তো ওই একই জ্বালা। 

এতক্ষণে চারটে বাজল। সে এই সময়েই বিষ খেয়েছিল! গোলোক শেষবারের মতো তার কথাই ভাবল। ধীরে ধীরে শিশিটা হাতে তুলে নিল, ছিপিটা খুলতে খুলতে আলতো করে ক্লোরোফর্মের গন্ধটা একবার শুঁকল। বেশ মিষ্টি মিষ্টি লাগল। খেতেও কী এমনি মিষ্টি? উত্তরের অপেক্ষা না করেই গোলোক শিশিটা উপুড় করে তরল পদার্থের সবটুকু গলায় ঢেলে দিল। তার দেহটা একবার থর থর করে কেঁপে উঠল, একটু পরেই স্থির হয়ে গেল। আরও পরে শীতল। আর কোথাও দাহের লেশমাত্র নেই। গোলোক এবার আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *