১৫
অনেকদিন পরে গোলোকের মনের গুমোট ভাবটা কেটে গেল। এমন নিশ্চিন্ত, এমন আরামের ঘুম সে অনেকদিন ঘুমোয়নি। ঘুম ভেঙে এত তাজা তাজা ভাবও তার অনেকদিন বোধ হয়নি। বেশ প্রফুল্ল মনেই সে বিছানা ছেড়ে উঠল। বেশ সকাল-সকালই আজ ঘুম থেকে উঠেছে। মুখ ধুল। হাল্কা শরীরটা নিয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াল। ঝি আসার দেরি আছে এখনও। হিটার জ্বেলে চায়ের জল বসিয়ে দিল। খাটে এসে বসে দেখল, আর কিছু তার করার নেই। অন্যদিন হলে সে আবার গা এলিয়ে দিত বিছানায়। আজ আর সে ইচ্ছে করল না। আলস্যে সময় কাটানো ঠিক না। একটা কিছু কাজ করতে পারলে ভাল লাগত। হঠাৎ একখানা খবরের কাগজের অভাব বোধ হল তার। পৃথিবীর সঙ্গে অসহযোগ করে ছিল সে, তাই কাগজ পড়তে চাইত না। এ-বাড়িতে আসা ইস্তক খবরের কাগজের মুখ সে দেখেনি। আজ ঠিক করল, এবার থেকে একখানা করে খবরের কাগজ রাখবে।
বসে বসে এ-ও ভাবল, অনর্থক সময় আর নষ্ট না করে আবার ছবি আঁকতে শুরু করবে কি না। না, এভাবে জীবন নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।
চায়ের জল ফুটে উঠতেই অভ্যস্ত হাতেই সে চা তৈরি করে ফেলল। পেয়ালায় চুমুক মেরে দেখল, বেশ চমৎকার চা হয়েছে। এতদিন ঝিয়ের তৈরি চায়ের পাঁচন গিলেছে শুধু। না, বোকামো করার সত্যিই মানে হয় না। চা তৈরি সে ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু যেই তাতে হাত দিল, দেখল বিদ্যেটা সে একটুও ভোলেনি। মনে আশা হল তার। তবে আঁকাটাও সে ভুলে যায়নি বোধহয়। আজই সে সরঞ্জামগুলো বের করবে। দেখবে সব ঠিক-ঠিক আছে কি না। তারপর লেগে পড়বে কাজে।
আচ্ছা, মনোরমার একটা ছবি আঁকলে কেমন হয়। বিষণ্ণতার মধ্যে যে আশার দীপ্তি মনোরমার চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ে, ওই অতল চোখেও যে প্রচণ্ড আস্থা উকি মারে তার ছবি আঁকতে ইচ্ছে হল গোলোকের। মনোরমাকে রাজি করানো হয়তো কঠিন হবে না। মনোরমার আন্তরিকতা গোলোকের মধ্যে নতুন উৎসাহ সঞ্চারিত করেছে। ‘এ-জগতে আপনার চেয়ে আপন আর কেউ নেই।’ স্বল্প সময়ের পরিচয়ে এমন কথা জোর দিয়ে এক মনোরমাই বলতে পারে। অথচ কথাটার মধ্যে ফাঁকি নেই, প্রগল্ভতা নেই, গোলোক তা বুঝেছে। তা হলে গোলোকের এত পরিবর্তন হত না, সে তা জানে। মনোরমা আশ্চর্য মেয়ে!
দরজার কড়া নড়ল। ঝিটা এল এতক্ষণে। গোলোক আজ আর উদাসীন থাকবে না ঠিক করল। ঝিকে দিয়ে ঘরটা পরিষ্কার করিয়ে নেবে। গোলোক দরজা খুলেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
“এতে হাঁ হবার কী আছে?” মনোরমা হাসতে হাসতে বলল, “রিটার্ন ভিজিট।”
একরাশ তাজা ফুলের মতো দেখাচ্ছে মনোরমাকে। গোলোকেরও সাধ্য নেই আজকের মনোরমাকে যক্ষ্মা হাসপাতালের রোগী বলে ভাবে। মিঃ মল্লিকও যে পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন, এখন দেখল গোলোক।
একগাল হেসে গোলোক অভ্যর্থনা জানাল।”কী ব্যাপার, আসুন আসুন!”
ওরা দুজনে ঘরে ঢুকল। গোলোক ব্যস্ত হয়ে পড়ল অতিথিদের বসাতে।
মিঃ মল্লিক বললেন “অত ব্যস্ত হবার কিছুই নেই, আপত্তি না থাকলে বিছানাতেই বসি।”
গোলোক হাসতে হাসতে বলল, “স্পুটাম ফ্রি, ঘামে জার্ম থাকে কি না জানিনে! মিঃ মল্লিক হোহো করে হেসে উঠলেন। বললেন, “রসিকতাটি করছেন ভাল। তবে আমি ইমিইউনড।”
“বাঃ ঘরখানা বেশ খাশা তো।” মনোরমা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল।”একটু গোছগাছ করে রাখেন না কেন?”
সুবোধ বালকের মতো গোলোক বলল, “রাখব।”
মিঃ মল্লিক বললেন, “নিজে কিছু করতে যাবেন না মশাই। অন্যমনস্কভাবে ভারী জিনিস কিছু তুলতে যাবেন, ব্যস্ তারপর হাসপাতাল। যা রয়-সয় তা-ই করবেন। হাসপাতাল থেকে ফিরে রমারও কাজের বাতিকে পেয়েছিল। একদিন দেখি খাটের ওপর ভারী একটা সুটকেশ তুলেছে। বুঝে দেখুন ব্যাপারটা। আমার তো প্রাণ উড়ে গেল ভয়ে।”
“তোমার প্রাণ তো রাতদিন উড়েই আছে।” মনোরমা বেজায় চটে গেল।”মাঝে মাঝে জ্ঞান-গম্যিই হারিয়ে ফেল?”
গোলোককে হাসতে দেখে মনোরমা বলল, “না, না, হাসির কথা নয়। পাহারার চোটে প্রাণ অস্থির হয়ে উঠেছে আমার। ওর সঙ্গে ঘর করতে হলে হাসি বেরিয়ে যেত আপনার। হাল্কা খালি একটা সুটকেস তুললে যে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়!”
“ভাগ্যক্রমে না হয় ওটা খালিই ছিল—” মিঃ মল্লিক বললেন, “কিন্তু ধরো ওটা যদি ভরা থাকত, কি ওটা একটা ট্রাঙ্ক হত—”
“কি ওটা যদি একটা গডরেজের সিন্দুক হত” মনোরমা কথা জুগিয়ে দিল।”বলে যাও, থামলে কেন?”
“না, তুমি রাগছ বটে রমা,” মিঃ মল্লিক মোলায়েম করে বললেন, “কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় একবার ভেবে দ্যাখো, ওর থেকে যদি অঘটন একটা ঘটে যেত ক্ষতি হত কার?”
গোলোক ব্যাপারটা আর গড়াতে না দিয়ে ওখানেই থামিয়ে দিল, “চা খাবেন কি? তা হলে চাপিয়ে দিই। এটা এতই হাল্কা কাজ যে, বিপদ-আপদের কিছুমাত্র সম্ভাবনা নেই।”
মিঃ মল্লিক বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, লাইট ওয়ার্ক করবেন বই কী!”
‘তা হলে আমিই বানাই।” মনোরমা শান্ত হয়ে বলল।”এতে তোমার আপত্তি নেই তো?”
“কিছুমাত্র না। হ্যাঁ, যে-কথা বলতে এলুম। আচ্ছা মশাই, আপনি তো বললেন, আপনার নাম গোলোক মজুমদার। একজন গোলোক মজুমদার তো ছবি-টবি—”
গোলোক বাধা দিয়ে বলল, “আমিই সেই ব্যক্তি। আপনি সে খোঁজ পেলেন কী করে?”
মিঃ মল্লিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।”যাক, সঠিক খোঁজটা যে ঠিক সময়ে পাওয়া গেছে, এই ভাগ্যি। আমাদের অফিসের একটা ক্যালেন্ডার তৈরি হবে। আমাদের পি-আর-ও আবার আর্ট-ফার্ট বোঝে। এবারে নাকি তরুণ বাঙালি শিল্পীদের ছবি ছাপা হবে। সেই লিস্ট তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে এক গোলোক মজুমদারের নাম দেখলাম। তার আবার ঠিকানা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আমার কেমন সন্দেহ হল। তা ভালই হল মশাই।”
গোলোক বলল, “ভাল আর কী হল! আমার তো কোনও ছবিই নেই। আড়াই বছর ধরে হাতই দিইনি। আর তার আগের সব ছবি কোথায় গেছে কে জানে!”
মনোরমার দিকে চেয়ে বলল, “বললে বিশ্বাস করবেন কি না জানিনে, একটু আগেই মনে মনে ভাবছিলাম, ছবি আঁকা আবার শুরু করব কি না?”
“শুরু করবেন বই কী। নিশ্চয়ই করবেন—” মিঃ মল্লিক উৎসাহ দিলেন, “আমাদের পি-আর-ও সাহেব যখন লিস্টে নাম তুলেছেন, তখন আপনি সামান্য লোক নন।”
গোলোক বলল, “মিঃ মল্লিক, যদি একটা অনুমতি দেন তবেই আমি কাজে হাত দিতে পারি।”
মিঃ মল্লিক বললেন, “আমার আবার এত মান বাড়াচ্ছেন কেন? কী চাই বলুন না।”
মনোরমার দিকে আঙুল দেখিয়ে গোলোক বলল, “ওঁর একখানা ছবি আঁকতে চাই!”
কৃতজ্ঞতার হাসিতে মিঃ মল্লিকের মুখখানা ভরে গেল। গোলোকের হাত দুখানা জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, “বলেন কী মশাই! এ তো আমার সৌভাগ্য। রমা, শুনলে? চমৎকার হবে। এর আবার পারমিশান কী?”
মনোরমা হাসতে হাসতে বলল, “গোলোকবাবুকে দেখতে ভালোমানুষ হলে হবে কী, আইন বাঁচিয়ে কাজ গুছিয়ে নিতে চান। ওঁর অনুমতি তো নিলেন ওঁর স্ত্রীর ছবি আঁকবেন বলে, কিন্তু যার ছবি আঁকবেন, তার অনুমতি নিলেন না তো?
গোলোক মনোরমার দিকে চেয়ে বলল, “তিনি তো আমার আপন জন, তাঁর আবার অনুমতি নিতে হবে কেন?”
মনোরমার মুখে দেহের সব রক্ত যেন হলকে পড়ল। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “আসল কথাটাই তো বললে না।”
মিঃ মল্লিক বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ। দেখুন আমরা একটা জমি দেখতে বেরুচ্ছিলাম। বাড়ি করার শখ আমার অনেকদিনের। তা এমনই কপাল, সুযোগই আর পাইনে। বুঝলেন না, যার জন্য বাড়ি করা সে তো এতদিন হাসপাতালে স্যানাটোরিয়ামেই কাটাল। যাক, এবার যখন সুযোগ এসেছে তখন শুভস্য শীঘ্রম। একটা জমির সন্ধান পেয়ে দেখতে যাচ্ছিলাম দুজনে। রমা বলল, চলো ওঁকেও ডেকে নিই। ভাবলাম এ-প্রস্তাব মন্দ নয়। কী, যাবেন না কি?
মনোরমা বলল, “আবার নাকি-ফাকি কিসের? এখন ওঁর কাজটাই বা কি! চলুন, চলুন। জামা-কাপড় বদলে নিন। আর আজ দুপুরে আমাদের ওখানে আপনার নেমন্তন্ন।”
মনোরমার ওই কীটদষ্ট দেহটার মধ্যে কী এমন শক্তি ছিল গোলোক, যা তোমাকে বার বার ভাসিয়ে নিয়ে গেছে? তার যখন খুশি সে তোমাকে নাচিয়েছে, খেলিয়েছে, প্রয়োজনে কাজে লাগিয়েছে, অপ্রয়োজনে জীর্ণ বস্ত্রের মতো পরিত্যাগ করেছে!
না না, মনোরমা আমাকে ছাড়তে চায়নি। আমি মনোরমার সত্তারই একটা অংশ যেন হয়ে গিয়েছিলাম। মনোরমা আমারও অনেকখানি ছিল। আর যে যাই বলুক, মনোরমা আমার সঙ্গে একটুও ছলনা করেনি। যা সে দিতে পারত, যা তার সাধ্যে ছিল, তা-ই আমাকে দিয়েছে, দিয়ে সে তৃপ্তি পেয়েছে। কিন্তু আমার দাবি আরও উচ্চগ্রামে বাঁধা ছিল। আমি তার সব চেয়েছিলাম, শুধু দেহটাই নয়। কিন্তু মনোরমা কী করবে! তার ওই দেহটি ছাড়া আর সব কিছুর দাবিদারই তো ছিল তার স্বামী। তার দেহের দাবিদার কেউ ছিল না। আর সেখানেই তো তার জ্বালা, তার দাহ।
১৬
আর সে-দাহ যে কত তীব্র তা গোলোকের চাইতে ভাল করে আর কে জানে! মনোরমার সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা যত বেড়েছে ততই সে-দাহের তাত পেয়েছে গোলোক। সেও পুড়েছে মনোরমার সঙ্গে।
তবে শুরুতে গোলোক এ-দাহের আঁচ পায়নি। সে কী করে জানবে, যে পরিবারটাকে সে আদর্শ সুখী পরিবার বলে মনে করেছিল, তার মধ্যে এত অ-সুখ লুকিয়ে আছে। মানুষের চোখ কত ভুল দেখায় মনোরমাদের সংস্পর্শে এসে গোলোক জানল, শুধু সুখ বলে সংসারে কিছু নেই। ঝর্নাকে পায়নি বলে সে দুঃখ পেয়েছে, কিন্তু তাকে পেলেও সে শুধু সুখ পেত কি না, সন্দেহ। গোলোকের এই অভিজ্ঞতাও হল, পরিবার একটা অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। তাতে দুঃখ আছে, তবু মনুষ্যজন্মের পরিণতিতে পৌঁছতে হলে ঘর তোমাকে বাঁধতেই হবে। এর আগে সব সংসারকেই গোলোক দূর থেকে দেখেছে। তার নিজেদের পরিবারেরও সে অংশবিশেষ ছিল না, ছিল প্রায় অতিথি। মনোরমা তার চোখ খুলে দিয়েছে।
.
যেদিন থেকে মনোরমার ছবি আঁকতে বসল সে, সেদিন থেকেই একটু একটু করে পরতে পরতে মনোরমাকে জানতে শুরু করেছে। গোলোককে সঙ্কোচ করত না সে। সব বলত। বলে হাল্কা হত! বুকের বোঝা নামিয়ে আবার তাজা হয়ে উঠত। প্রত্যহ সিটিং দিতে বসত মনোরমা তার নিজের বারান্দায়। গোলোকই জায়গাটা পছন্দ করেছিল। মনোরমাদের ফ্ল্যাটে ঢোকামাত্র সুন্দর একটা গন্ধ গোলোকের নাকে ঢুকত। খুব ভাল লাগত গোলোকে। এটা বোধ হয় মনোরমারই প্রসাধনের কোনও গন্ধ। লতায় ফুলে ঢাকা বারান্দাটাও সৌরভ বিতরণ করত অকৃপণভাবে।
আকাশের দিকে পিছন ফিরে মনোরমাকে একটা সবুজ বেতের চেয়ারে বসিয়ে দিত গোলোক। তারপর গল্প জুড়ত। বেশির ভাগ গল্পই মনোরমার ঘর-সংসারের। মনোরমা বলতে শুরু করত। আর গোলোক তাকিয়ে থাকত মনোরমার মুখের দিকে। অপেক্ষা করত বিষণ্ণতার রাত্রি পেরিয়ে কখন তার চোখে-মুখে ফুটে উঠবে আশার উজ্জ্বল আভা। তার চোখ দুটো আন্তরিকতায় ভরে উঠবে। অতলস্পর্শ চোখে নেমে আসবে গভীর সমুদ্রের মায়া। সেই প্রথমদিন এ-বাড়িতে আসামাত্র গোলোক যে-মনোরমার দেখা পেয়েছিল, ঠিক তাকে দেখার প্রত্যাশায় হাত গুটিয়ে বসে থাকত। কখনও কখনও তার আভাস পেলেই তুলি বুলাত ক্যানভাসে। গোলোক দেখল, যত সহজে সে ঝর্নার ছবিটা এঁকে ফেলতে পেরেছিল, তত সহজে মনোরমার ছবিতে এগোতে পারছে না।
গোলোকের ভাব দেখে মনোরমা হাসত। বলত “জানি বাবা, সব জানি, তুমি কি কম চালাক!”
গোলোক জিজ্ঞাসা করত, “কি জান মনো?”
“এই ছবি আঁকা-ফাঁকা সব তোমার ছল।”
“বলো কী।”
“ঠিকই বলছি। আমি জানি।”
গোলোকের হঠাৎ মনে হল ঝনাই বুঝি কথা বলছে।
“তবে কী জন্য আমি রোজ-রোজ এ-বাড়িতে আসি?”
“আসো শুধু আমার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে বসে থাকতে।”
মনোরমার কথা শুনে গোলোক হেসে ফেলল। বেশ বলেছ,” গোলোক হাসতে হাসতে বলল, “এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো মুখখানাকে স্থির করে রাখ দেখি। নড়ো না।”
“আমি কি কাঠের পুতুল।” মনোরমার লঘু স্বর মুহূর্তে তিক্ত হয়ে উঠল। “যেমন ইচ্ছে দাঁড় করিয়ে রাখবে!”
“না, তুমি মোমের পুতুল।”
“তা জানি, তা জানি। তোমাদের চোখে আমি তা-ই।” মনোরমা কর্কশ স্বরে বলে উঠল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রেলিং ধরে উদাস চোখে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। একটু পরে ভাঙা ভাঙা গলায় মনোরমা বলল, “পুতুলের চেয়ে বেশি গুরুত্ব তোমরা আমাকে দাও না কেন, গোলোক? শুধু সাজিয়ে গুছিয়ে, শুধু ঝাড়গোছ করে আলমারিতে তুলে রাখলে পুতুলের চলতে পারে। কিন্তু আমার, আমার কি তাতে চলে!” মনোরমা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
গোলোকের মনে হল, মনোরমার এই কথাগুলো যেন অন্তহীন গহ্বর থেকে উঠে আসছে। কিন্তু এর যে কী কারণ থাকতে পারে, গোলোক তা বুঝে উঠতে পারল না। গত এক মাস এই দম্পতিকে খুব কাছ থেকে দেখছে সে। মনোরমার জন্য মল্লিকদার দুশ্চিন্তা আন্তরিক। তার প্রকাশটা কিছুটা কমিক কমিক লাগতে পারে, প্রথম দিকে গোলোকের তা-ই লাগত। কিন্তু ক্রমশ দেখল, তার মধ্যে ভেজাল নেই এক ফোঁটা। স্ত্রীর প্রতি, অন্ধভাবে অনুগত এমন লোক আর আছে কি না সন্দেহ। মনোরমার কর্তৃত্ব তাঁর উপর অসাধারণ। কিসে মনোরমা ভাল থাকবে, প্রফুল্ল থাকবে, গোলোক দেখেছে, মল্লিকদার সেই চিন্তা। মনোরমা জমি পছন্দ করল, তো সেই জমি দু’দিনের মধ্যে কেনা হয়ে গেল। যে জিনিস সকালে চায় মনোরমা, বিকেলেই তা এসে যায়। এমন স্বামী পেয়েছে মনোরমা, তবু তার এত অশান্তি কেন?
তুলি হাতে করে বসেই থাকল গোলোক। মনোরমা ঝাঁ করে এগিয়ে এসে গোলোকের হাত থেকে রঙ তুলি কেড়ে নিল। ছুড়ে ফেলে দিল নীচে।
প্রচণ্ড রাগতস্বরে বলল, “মোমের পুতুলের ছবি আর আঁকতে হবে না, তুমি যেতে পারো।
মনোরমা এমনভাবে কথটা বলল যেন গোলোক ভাড়া করা আর্টিস্ট। তার কাজ পছন্দ হয়নি বলে মনোরমা তাকে ছাঁটাই করছে। গোলোক অবাক হয়ে মনোরমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। ঠাট্টা করছে নাকি? কিন্তু না, চোখে-মুখে তো ঠাট্টার লেশমাত্রও নেই। যে-চোখ একটু আগেই জলভরা ছিল, এখন সেখানে আগুন ছুটছে।
“পরস্ত্রীর মুখের দিকে ছুতো করে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা হওয়া উচিত।”
শপাং করে গোলোকের গালে যেন চাবুক মারল মনোরমা। কী বলছে ও! ক্ষেপে গেল নাকি?
“কী যা-তা বলছ মনো!”
“যা-তা নয়, ঠিক বলেছি। কী উদ্দেশ্যে রোজ রোজ আসো তুমি ছবি আঁকার নাম করে? এই নির্জন দুপুরে। যখন আমার স্বামী বাড়ি থাকে না? আমি সত্যিই পুতুল নই, রক্তমাংসের জীব। মনে রেখো সেটা।”
“ছিঃ ছিঃ—” গোলোক দপ করে রেগে উঠল। থরথর করে কাঁপতে থাকল। “তুমি, তোমার মনটা এত নীচ!”
“হ্যাঁ, আমি নীচ, আর তোমরা খুব মহৎ। এখন যাও। আর এসো না এখানে। পুতুল, পুতুল, পুতুল! ন্যাকামি।”
গোলোক অপমানে, রাগে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে গেল। ওর পিছনে মনোরমার দরজা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। গোলোকের তখনও বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, সত্যিই অমন একটা কাণ্ড ঘটে গেছে একটুখানি আগে। সে যেন এই মাত্র এক দুঃস্বপ্ন দেখে উঠল। স্বপ্ন যে নয়, এটা যে নিষ্ঠুর বাস্তব, তার সব থেকে বড় প্রমাণ, এখনও সে দাঁড়িয়ে আছে মনোরমাদের ফ্ল্যাটের দরজায়। আর বন্ধ দরজাটায় মনোরমার কঠোর মুখখানা যেন আঁকা। মনোরমার কঠোরতাই দরজার রূপ গ্রহণ করেছে!
১৭
আকস্মিক এই অপমানের পর গোলোক চাইছিল না যে মনোরমার নামও সে উচ্চারণ করে। কিন্তু কী আশ্চর্য, তবু বারবার ঘুরে-ফিরে ওই নামটাই তার মনে আসছিল। এই এক মাসে গোলোক দেখল, আশ্চর্য এক অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে তার! মনোরমার সঙ্গ পাবার অভ্যাস। এ সম্পর্কে সে বিশেষ সচেতন ছিল না। আজ চারদিন সে একবারও যায়নি। জানালাটাও খোলেনি ওই ধারের। একবারও মনোরমার মুখ দেখেনি। প্রথমদিন রাগটা গনগনে হয়ে জ্বলছিল। তার মনের মধ্যে কাণ্ডাকাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে সে যা-ইচ্ছে হয়েছে মনে মনে সেই গালই দিয়েছে মনোরমাকে। রাগের তেজ পরদিনই ফুরিয়েছে। তার অপমানবোধটা এখনও আছে কী এমন অন্যায় করেছে গোলোক? অপমানজনক কী এমন বলেছে? মোমের পুতুল! এতে ক্ষেপে যাবার কী আছে? তা ছাড়া, ও তো কথার পিঠে কথা। সত্যি বলতে কী, পুতুলের কথাটা মনোরমাই আগে তুলেছে। মনোরমা বলল, আমি কাঠের পুতুল? গোলোক ঠাট্টা করে বলেছে, না, তুমি মোমের পুতুল। এতেই মনোরমা এত ক্ষেপে গেল যে, অপমান করে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েই দিলে! তাজ্জব! গোলোক বার বার বিস্মিত হয়, ঘটনাটা মনে পড়লে।
অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই তো কিছু? মনোরমা যা বলল, এ হয়তো ওর কথা নয়। বদনাম রটাল নাকি কেউ তাদের নিয়ে? নাকি, মল্লিকদাই কিছু বলেছেন মনোরমাকে? তা সে-সব কথা আমাকে ভালভাবেই তো জানাতে পারত মনোরমা। এত গোপন কথা বলতে পেরেছে আর এই সহজ কথাটা জানাতে পারল না। অন্য কোনও ব্যাপার আছে!
আসলে মনোরমাই তাকে সহ্য করতে পারছিল না। ইদানীং, যেন তার উপর ক্ষুব্ধ, বিরক্ত হয়ে উঠেছিল মনোরমা। তাকে যেন এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছিল। কয়েকদিন আগেকার একটা ঘটনা মনে পড়ল। তখন এর তাৎপর্য বোঝেনি গোলোক। এখন বুঝতে পারছে ওকে এড়িয়ে যাবারই সেটা হল। দুজনে বসে বসে গল্প করছিল। হঠাৎ মনোরমা উঠে চলে গেল। তারপর আর এলই না। গোলক ডাকল, বার কয়েক প্রথমে তো সাড়াই দিল না। তারপর বলল, বড্ড মাথা ধরেছে, তাই শুয়ে পড়েছে সে। তারপর আর কিছু বলল না। গোলোকও আর ডাকল না। চুপচাপ বসে ক্যানভাসে রঙ ঘষতে লাগল। ঘন্টা দেড়েক পরে বেরিয়ে এল মনোরমা। গোলোক বলল, ছাড়ল মাথা ধরা?…মনোরমা নিস্পৃহ স্বরে বলল, “মাথা ধরেনি তো। তোমার সঙ্গে শুধু শুধু কাঁহাতক আর বকবক করা যায়, তার চাইতে শুয়ে থাকা ঢের ভাল। তা তুমি যে এতক্ষণ আছ?” গোলোক ভাবল ঠাট্টা। বলল, “কী আর করি, তোমার ছবিটাতেই রঙ বুলোচ্ছিলাম।” মনোরমা শুধু একবার ওঃ বলে, আবার এসে বসল।
এখন গোলোক ভাবল, তখন থেকেই তাকে এড়াতে চাইছিল মনোরমা। এই রকম স্পষ্ট ইঙ্গিতগুলোও যে কেন বোঝেনি, তা ভেবে গোলোক অবাক হল, বিরক্ত হল নিজের উপর। তখনই যদি মানে মানে সরে পড়ত সে! এ-অপমানটা তা হলে আর সইতে হত না।
কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছে না গোলোক। মনোরমা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই তো গোলোককে কাছে টেনে নিয়েছিল, তবে আবার নিজেই এমন করে ঠেলে দিল কেন?
নিজের চিন্তায় এতই মগ্ন ছিল গোলোক যে দরজার কড়া নাড়ার শব্দ সে শুনতে পায়নি। হঠাৎ তার কানে গেল কড়া খটখট করছে। দরজাটা খুলে দিল। ঝি। ও বাবা, বিকেল হয়ে গেল!
ঝি বাসন নিতে গিয়ে অবাক হল।”দাদাবাবু গো, এ কী, ভাত খাননি?”
গোলোকের মনে হল, ওই যা, তাই তো। টের পেল তার ক্ষিধে পেয়েছে বেশ।
বলল, “একটু চা বানাও তো।”
আরেকটা সকাল গড়িয়ে গেল গোলোকের। অন্য দিনের মতো হিসেব নিতে নিতে। সেই এক হতাশা, একই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়েই দুপুর এসে গেল। গ্রীষ্মের রুদ্র দুপুর। বৃষ্টি নেই। শুধু দাহ। গোলোকের মনে হল, তার মনের রসও বুঝি শুকিয়ে গেছে। বাইরের আর ভেতরের তাপে সে অস্থির হয়ে উঠল। সে প্রায় সিদ্ধান্তই নিয়ে বসল, এ-বাসা ছেড়ে যাবে। কাল থেকেই বাসার খোঁজে বেরোবে। দূরে, মনোরমার কাছ থেকে যত দূরে পারে, সে বাসা নেবে। মনোরমার সান্নিধ্যে সে আর থাকবে না।
তা-ই যদি তার ইচ্ছা, তবে গোলোক কলকাতা ছেড়ে চলে যাক না কেন? এখানে তার কে আছে?
কলকাতা ছাড়বার কথা মনে হতেই বিষাদে ডুবে গেল সে। ‘আমি আপনার আপনারজন।’ বোগাস। যত বাজে কথা দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছিল মনোরমা ছেলেমানুষ যেমন ঝুমঝুমি পেলে ভুলে যায়, গোলোকও তেমনি মনোরমার ঝুমঝুমিতে ভুলে গিয়েছিল। গোলোকের হাই উঠল। শরীর এলিয়ে দিল।
কে যেন কড়া নাড়ল। গোলোক কান পেতে রইল। খট খট খট। হ্যাঁ, কড়াই নাড়ছে কে। দরজা খুলেই থ মেরে গেল। ঝর্না! অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে ঝর্নার। একটু ভারিক্কি হয়ে উঠেছে। ঝর্না হাসল। …দরজা ছাড়ন মাস্টারমশাই, ভেতরে যাই। …ভেতরে কোথায় যাবে ঝর্না। তুমি পরস্ত্রী। …তা হোক মাস্টারমশাই, আমি আপনাকেই ভালবাসি। এখনও বাসি। ভেতরে গিয়ে একটু বসি মাস্টারমশাই। …না ঝর্না, তা এখন আর হয় না। তুমি ভেতরে আসবে আবার নতুন করে যন্ত্রণা দেবে। তোমাদের এ খেলা আমি জানি। .. ঝর্নার চোখে জল, মুখে মিনতি। …আপনার কাছেই এসেছি আমি, ভিতরে যাব। যেতে দিন মাস্টারমশাই। …ঝর্না এগিয়ে এল। …তুমি পরস্ত্রী ঝর্না, দূরে থাকো। কাছে এসো না। যাও ঝর্না, চলে যাও। অনেক ভুগেছি আমি, অনেক ভুগেছি, দোহাই তোমার, আর না, আর না। …পাছে ঝর্না ঢুকে পড়ে, গোলোক তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল। ঝর্না কড়া নাড়ছে বাইরে থেকে। নাড়ুক। দুম দুম ধাক্কা দিচ্ছে, দিক। খুলবে না, গোলোক কিছুতেই দরজা খুলবে না…
খট খট খট খট খট খট। গোলোকের তন্দ্রা ছুটে গেল। উঃ কী গরম। কী স্বপ্নই দেখল গোলোক! এখনও যেন ঝর্না কড়া নাড়ছে। ঘামে ভিজে গেছে সর্বাঙ্গ। দরজা জানালা বন্ধ। ঘরে আবছা অন্ধকার।
খট খট খট। গোলোকের বুকের রক্ত ছলকে উঠল। এ তো স্বপ্ন নয়। দরজার কড়াই নাড়ছে। ঝর্না সত্যিই তবে এসেছিল নাকি। নাকি ঝিটাই এসে গেল। গোলোক দরজা খুলে দিল।
মনোরমা ঘরে ঢুকেই অপরাধীর মতো বলল, “কখন থেকে কড়া নাড়ছি। ঘুমুচ্ছিলে। এত গরমেও ঘুম হয় তোমার?”
মনোরমা হাসতে চেষ্টা করল। হাসিটা ভাল ফুটল না। ব্যাপারটা এতই বিস্ময়কর যে হৃদয়ঙ্গম করতেই গোলোকের সময় লাগল কিছুটা। গোলোকের মুখে কথা ফুটল না। কোনটা স্বপ্ন? আগে যেটা দেখল, না এখন যেটা দেখছে? না, এটা স্বপ্ন নয়। মনোরমা এসেছে। কারণ ও আসামাত্র ঘরে এক পরিচিত সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে। সেটা স্বপ্ন নয়। এই ঘ্রাণ থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল মনোরমা, বঞ্চিত করেছিল গোলোককে তার সঙ্গ-সুখ থেকে; বিতাড়িত করেছিল তার দরজা থেকে। এখন সে নিজেই এসেছে। আরও একদিন এসেছিল মনোরমা। বলেছিল রিটার্ন ভিজিট দিতে এলাম। এবার গোলোক তাকে বের করে দিয়ে বলবে নাকি, রিটার্ন দিলাম মনোরমা।
মনোরমা ইতস্তত করে বলল, “কী অন্ধকার।” একটু পরে আবার বলল, “এই গরমে থাকো কী করে? পাখা নেই?”
কী মতলব মনোরমার? গোলোক সতর্কভাবে মনোরমার গতি লক্ষ করতে লাগল। মনোরমাও গোলোকের হাবভাবে অপরিচিত প্রচ্ছন্ন বিরুদ্ধতার এক আভাস পেল। অভিমানে উথলে উঠল তার স্বর। কাঁপা কাঁপা গলায় মনোরমা বলল, “আমার অন্যায়ের মাপ চাইতে এসেছি।”
এতক্ষণ পরে গোলোকের আপাদমস্তক জ্বলে উঠল। কত রকম ন্যাকামিই জানে! একবার এমন ইচ্ছেও হল, ঠেলে বের করে দেয় ওকে ঘর থেকে।
“আমি সত্যি অন্যায় করেছি গোলোক। হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় ও-কথা বলে ফেলেছিলাম। ওর একটাও আমার মনের কথা নয়। কী, তুমি কিছু বলছ না যে! কথা বলবে না? বলবে না? বলবে না?”
মনোরমা কি কাঁদছে?
“বেশ, আমি চললাম। তোমাকে আর বিরক্ত করব না। কাউকেই না গোলোক। এ-জীবন আর রাখব না, এত বিড়ম্বনা আর সহ্য হয় না।”
মনোরমা আর দাঁড়াল না। তরতর করে নেমে চলে গেল। এতক্ষণে অপমানের শান্তি হল গোলোকের। খুশি হল। বোঝো এখন যন্ত্রণাটা কেমন লাগে! আত্মতৃপ্তিতে মত্ত হয়ে খাটের উপর আরাম করে বসল গোলোক। বসেই লাফিয়ে উঠল। সর্বনাশ! কী বলে গেল মনোরমা! জীবন আর রাখবে না। ভয়ে প্রাণ উড়ে গেল গোলোকের।
লাফে লাফে সিঁড়ি ডিঙিয়ে মনোরমার ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছল। দরজা খোলা। ভিতরে ঢুকে দেখল মনোরমা নেই। শোবার ঘরে গেল। দেখল মনোরমা একটা বাক্স থেকে জিনসপত্র ফেলে কী যেন বের করল। ক্ষুর!
“মনো!” বলে লাফ মেরে হাত চেপে ধরল।
হিস্টিরিয়া রোগীর মতো মনোরমা হাত-পা ছুঁড়তে লাগল।
“ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও। যাও এখানে থেকে। যাও! যাও!”
“মনো, মনো, কী হচ্ছে!”
অতিকষ্টে মনোরমার হাত থেকে ক্ষুরতটা নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল গোলোক! আতঙ্কে, পরিশ্রমে, উত্তেজনায় গোলোক শ্রান্ত কুকুরের মতো হাঁফাতে লাগল। মনোরমা হঠাৎ গোলোককে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। ওর বুকে মুখ ঘষে ঘষে কাঁদতে লাগল। আর অস্ফুটস্বরে পাগলের মতো বলতে লাগল, “তুমি কেন এলে, কেন এলে, কেন এলে?”
অকস্মাৎ গোলোকের সর্বদেহ থরথর করে কেঁপে উঠল। রক্ত উন্মাদ হয়ে উঠল। কী করছে, ভাবনা চিন্তা করার ফুরসত পেল না। সবল আলিঙ্গনে মনোরমাকে টেনে নিল বুকে। প্রচণ্ড চাপে দুটো দেহকে যেন মিশিয়ে ফেলতে চাইল। তার ঠোঁটে চুমুর পর চুমু এঁকে দিল। মনোরমাও যেন এই পাগল করা খেলায় মেতে উঠল। আবেগের প্রথম ধাক্কা সামলে নিয়ে ওরা দুজনে বিছানায় গিয়ে বসল। দুটো অস্থির চোখ অন্য দুটো অবাধ্য চোখের দিকে চিকচিক করে উঠল। জ্বালা যন্ত্রণার চিহ্নও নেই কোথাও।
মনোরমা ফিসফিস করে বলল, “এই, এই, দরজাটা খোলা আছে যে, ছাড়ো দিয়ে আসি।”
গোলোক বোকার মতো হাসল। ছেড়ে দিল মনোরমাকে। কিন্তু মনোরমা উঠে দু’পা যেতে যেতেই গোলোক হাত বাড়িয়ে মনোরমার আঁচলে টান দিল। বুক থেকে কাপড় খসে গেল মনোরমার। বিব্রত হয়ে উঠল সে। গোলোকের দিকে ফিরে দাঁড়াল। তার চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে গেছে। কিসের ঘোর লেগেছে চোখে নাকের ডগায় অজস্র ঘাম জমেছে। প্রতি লোমকূপের গোড়াতেই কে যেন এক একটি মুক্তাবিন্দু বসিয়ে দিয়েছে। অসহ্য তাপ সঞ্চারিত হয়েছে মনোরমার দেহে। অসহ্য উত্তেজনা, অসহ্য স্ফূর্তি যেন উপচে পড়ছে। থরথর করে কাঁপছে সে। হাঁপাচ্ছে সে! ‘এই!’ মিনতি করল মনোরমা। ‘ওকী? বাধা দিতে গেল গোলোককে! কিন্তু হাত আর তুলতে পারল না। কিচ্ছু জোর নেই। কোনওমতে বলল, “দাঁড়াও লক্ষ্মীটি, দরজাটা দিয়ে আসি।” কিন্তু তার আগেই মনোরমা গোলোকের উত্তাল আবেগের তীব্র জোয়ারে আত্মসমর্পণ করেছে।
শেষ পর্যন্ত কে যে দরজাটা দিয়েছিল, গোলোক না মনোরমা, সেটা ওদের কারওই মনে নেই।
মধুর এক অবসাদে আচ্ছন্ন হয়ে দুজন পাশাপাশি শুয়ে ছিল বিছানায়। গোলোক অনুভব করছিল, বিছানাতেও অপূর্ব সুন্দর ঘ্রাণটা ছড়িয়ে রয়েছে। মনোরমার অজস্র চুলেও মাখামাখি হয়ে আছে সেই একই সুঘ্রাণ। গোলোকের বুকে মাথা গুঁজে নিশ্চল পড়ে আছে মনোরমা।
যেন উম্মত্ত উত্তাল সুখের স্রোতে বেপরোয় ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ত ওরা। যেন উন্মাদ, কুটিল, অজস্র ঢেউ, সবেগে আছড়ে পড়ত ওদের উপর। যেন তীরের মতো শক্ত মাটি থেকে টেনে নিয়ে অটল বিক্ষুব্ধ এক আবর্তে ওদের ছুঁড়ে ফেলে দিত। ওরা অসহায় হয়ে ডুবত, হাবুডুবু খেত। তখন কোনও জ্ঞান থাকত না ওদের। ধীরে ধীরে চৈতন্যের উদয় হতে থাকলে ওরা আবিষ্কার করত, অবসন্ন শিথিল দুটি দেহ একই বিছানায় পাশাপাশি পড়ে আছে। গোলোকের মনে হত, মনোরমা আর সে জন্ম-জন্মান্তর ধরেই বুঝি এইভাবে, একই শয্যায় শুয়ে আসছে।
তোমার অনুশোচনা হত না গোলোক। গ্লানি বোধ করতে না মনে মনে? না তো। অনুশোচনা কেন? গ্লানি কিসের? না, কোনও গ্লানিবোধ করিনি। দংশন অনুভব করিনি অনুশোচনার। এ-সব প্রশ্নই ওঠেনি তখন। না আমার দিক থেকে, না মনোরমার দিক থেকে। জানিনে, মনোরমা কখনও গ্লানিতে ভুগেছে কি না। সম্ভবত আজও তার মনে অনুশোচনা নেই। আমার মনেই এ-প্রশ্ন একদিন দেখা দেয়।
১৮
তখন মনোরমার বাড়িটা প্রায় তৈরি হয়ে এসেছে। সেদিন ছুটি ছিল। রবিবার। মল্লিকদা গোলোক আর মনোরমাকে বাড়ি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সুন্দর ছোট্ট দোতলা বাড়িটা। একতলার কাজ শেষ। দোতলার কাজ দ্রুতগতিতে চলেছে।
মল্লিকদা মনোরমাকে সব খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখাতে লাগলেন। মনোরমা খুশিতে উপছে পড়তে লাগল। ঘুরে ঘুরে নিবিড় আগ্রহে দেখতে লাগল সে। প্রতিটি খুঁটিনাটি সম্পর্কে প্রশ্ন করতে লাগল মনোরমা। মল্লিকদা সমান উৎসাহে জবাব দিতে লাগলেন। বোঝা গেল, মনোরমার এই আগ্রহে তিনিও খুব খুশি হয়েছেন। মনোরমা তার পছন্দ নিয়ে তর্ক জুড়ে দিল। বসবার ঘর, রান্নাঘর আর দোতলার বাথরুম নিয়ে মনোরমার সঙ্গে মল্লিকদার মতোভেদ হল। মনোরমা স্পষ্টই জানাল, এ তিনটে জিনিস তার একেবারে পছন্দ হয়নি। ঢেলে সাজাতে হবে। প্রথমে আবদারের স্বরে বলতে আরম্ভ করেছিল, পরে জেদ ধরল। মল্লিকদা বিব্রত হলেন। যুক্তি-তর্ক দিয়ে প্রথমে বোঝাতে গেলেন। কেন যে এই রকম করা হয়েছে, বললেন। গোলোকের মনে হচ্ছিল, তিনি যেন কন্ট্রাক্টার আর মনোরমা তাঁর কাজে ফাঁকি ধরে ফেলে বিল আটকে দেবার ভয় দেখাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত মনোরমা যেন চরমপত্র দিল। নিজের বাড়িতেই যদি থাকতে হয়, তা হলে মনোরমার পছন্দমতোই বাড়িটাকে ঢেলে সাজাতে হবে। গোলোকের খুব বিরক্ত লাগছিল। একটা বাজে ব্যাপারে দুটো বয়স্কলোক অনর্থক সময় নষ্ট করছে। গোলোককে যেন ভুলেই গেছে ওরা। গোলোক দেখল, মল্লিকদা আর মনোরমা, এই দুজনে মিলে যে-গণ্ডি রচনা করেছে, তা গোলোক ভেদ করতে পারছে না। সে বাইরেই পড়ে আছে। অন্যদিন যে-মনোরমার নিবিড় আলিঙ্গনে বাঁধা পড়ে সে আর মনোরমা একত্বে মিশে যায়, এ যেন সে-মনোরমা নয়। এখানে এসেও মনোরমা একত্বে মিশে গেছে, কিন্তু অন্য আরেকটা পুরুষের সঙ্গে। অন্য আরেকটা ভূমিতে। এই মনোরমার কাছে সে পৌঁছতে পারছে না। তার অস্বস্তি লাগছে। তার বিরক্তি লাগছে। নাও বাবা, তাড়াতাড়ি এই খেলাটা শেষ করে ফ্যালো। বাড়ি চলো। -গোলোক মনে মনে বলে ফেলল।
শেষ পর্যন্ত মনোরমারই জিত হল। মল্লিকদা রাজমিস্ত্রিকে ডেকে মনোরমার প্রস্তাবটা জানালেন। বুড়ো মিস্ত্রি মাথা চুলকে বলল, “ভালই হবে হুজুর, তবে অনেক খরচা বেড়ে যাবে।”
মল্লিকদা মনোরমার দিকে চেয়ে হাসলেন। বললেন, “মালিকের ইচ্ছাই বড় কথা। খরচা তো তার চাইতে বড় নয় মিস্ত্রি।”
মিস্ত্রি তৎক্ষণাৎ মনোরমাকে সেলাম করে বলল, “সে তো ঠিক বাত হুজুর।”
মনোরমার মুখের রূঢ় রেখাগুলি খুশির উজ্জ্বলতায় কোমল হয়ে এল। মল্লিকদার হাত ধরে ছোট্ট খুকির মতো ঝুলতে ঝুলতে বলল, “যাই বলো, জিনিসটা ভালই হবে। কিন্তু আর না, এবারে যাই চলো।”
দুজনে পাশাপাশি এগিয়ে গেল। মনোরমা একবার বলল, “এসো গোলোক।” কিন্তু গোলোকের মনে হল, সে ডাকে আন্তরিকতা নেই। সারা পথ দুজনের কেউই নজর দিল না গোলোকের প্রতি। বাড়ি নিয়ে, ওদের ভবিষ্যৎ সংসারের স্বপ্ন নিয়ে, ওরা মশগুল হয়ে রইল। এই মনোরমার দেহে যে কোনও তীব্র দাহ আছে, মনে যে অসহ্য জ্বালা আছে অতৃপ্ত কামনার, সে-কথা এখন কে বলবে!
.
পরদিন দুপুরে নিজের ঘরে বসে বসে এই কথাই ভাবছিল গোলোক। অন্যদিন এতক্ষণ সে মনোরমাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হয়। এই দুপুরের নির্জনতায় সে আর মনোরমা প্রকাণ্ড শয্যার আশ্রয়ে মিশে যায়। চিন্তা-ভাবনার কোনও বালাই আর থাকে না। বাইরে কী ঘটছে, পৃথিবীটার অস্তিত্ব আছে কি না, তারা দুজনেই আছে কি না, সে খেয়াল থাকে না। চেতনা অবলুপ্ত হয়ে যায়।
আজ আর যেতে চাইছিল না গোলোক। মনের ভেতর একটা প্রশ্ন ঝাপসা হয়ে উকিঝুঁকি মারছিল। গোলোক অনেক চেষ্টা করছিল সেটা স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলতে। কিন্তু পারছিল না। শুয়ে থাকতে ভাল লাগল না। উঠে পড়ল। ঘরের মধ্যে পায়চারি করল খানিক। আবার এসে শুয়ে পড়ল। একটুক্ষণের জন্য হয়তো অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সে! হঠাৎ তার নাকে মনোরমার দেহের সেই অপূর্ব ঘ্রাণটা এসে লাগল। ধ্বক করে লাফিয়ে উঠল তার হৃদপিণ্ড। উচ্চকিত হয়ে উঠল গোলোক। মনোরমা এল নাকি? কই, না তো। সে এখানে আসবে কেন? সে তো তার ঘরে, খাটে শুয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে গোলোকের জন্য। গোলোকের সারা দেহে দেখতে দেখতে প্রভূত উত্তাপ আর প্রবল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। মনোরমার দেহের আহ্বান দুর্বার হয়ে উঠল। আর স্থির থাকতে পারল না গোলোক। দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল মনোরমার কাছে।
দরজা খোলাই ছিল। গোলোক অসহ্য দাহে দগ্ধ হতে হতে নিবিড় শান্তিতে অবগাহন করবার জন্যে হুট করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। থরথর কাঁপা হাতে খিলটা আটকে দিল সদরের। তার পা দুটো এগিয়ে চলল অভ্যস্ত ঠিকানায়, মনোরমার শোবার ঘরের দিকে।
মনোরমা নানা রকম ক্যাটালগ বিছিয়ে বসে ছিল একটা চেয়ারে। অন্যদিন তার দেহটাকে ঢেলে দেয় বিছানায়। গোলোকের দিকে একনজর চেয়েই আবার ক্যাটালগের পাতায় চোখ নামাল। বলল, “আচ্ছা গোলোক, তুমি তো শিল্পী, বলো তো শোবার ঘরের দেওয়ালে সবুজ রঙ ভাল, না ফিকে গোলাপি ভাল।” মনোরমার গলার স্বরে, দেহের ভঙ্গিতে শান্ত শীতলতা। কামনার চিহ্নমাত্রও তার অবয়বের কোনওখানে নেই। গোলোক প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেল। পূর্ণবেগে যে জাহাজটি এতক্ষণ চলছিল, সে যেন হঠাৎ ডুবো চরে আটকে গেল। ঘরে ঢোকামাত্র মনোরমার দেহের ঘ্রাণ মাতাল করে তুলেছিল গোলোককে। ছুটে গিয়েছিল সেই মাদকের দিকে। কিন্তু মনোরমা শীতলতার বোতলে সেটাকে ছিপিতে পুরে গালার মোহর মেরে দিয়েছে। গোলোক তার নাগাল না পেয়ে জ্বলতে লাগল।
মনোরমার চোখে এখন নতুন সংসারের স্বপ্ন। তার ঘোর এখনও কাটেনি। ঘরের দেওয়ালে, দরজা জানালায় কী রঙ লাগাবে, কী ধরনের পর্দা কিনবে, চেয়ারগুলোর ক’টা বেতের আর ক’টা বার্মা টিকের, পর্দাগুলো কোথাকার হবে, মেঝে মোজাইক করবে, না কার্পেট কিনবে—এ ছাড়া কথা নেই মনোরমার মুখে। গোলোক হতাশায় মুষড়ে পড়ল। এক মুহূর্তও আর দাঁড়াল না। নিজের ঘরে এসে যন্ত্রণাকাতর দেহটাকে বিছানায় ছুঁড়ে দিল। বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে পড়ে থাকল।
একটু পরেই মনোরমা এসে ঢুকল তার ঘরে। গোলোকের ঘরের বদ্ধ বাতাস একটু একটু করে ভরে উঠতে লাগল পরিচিত এক সৌরভে। গোলোকের মগজে প্রচণ্ড ঝড় বইতে লাগল। অতি কষ্টে সামলে রাখল নিজেকে।
‘কী হয়েছে গোলোক? হঠাৎ অমন করে চলে এলে যে?” উৎকণ্ঠায় মনোরমার স্বর কেঁপে উঠল।
গোলোক একটুও নড়ল না।
“এই, কী হয়েছে? বলবে না আমাকে?”
গোলোকের দেহে যেন বিস্ফোরণ ঘটল। সে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে নিজেও ভেসে চলল, মনোরমাও ভেসে গেল।
আবার সেই মনোরম অবসন্নতা। ক্লান্ত দেহ, নিস্তরঙ্গ মন। মনোরমা নির্জীব হয়ে চোখ বুজে পড়ে আছে। গোলোক তার চুল নিয়ে খেলা করছে।
গোলোক হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, “ও বাড়িতে কবে যাবে মনো?”
মনোরমা যেন অনেক দূর থেকে জবাব দিল, “আর মাস দুয়েক পরে।”
মনোরমা চুপ করল। গোলোকও।
একটু পরে মনোরমা বলল, “পুরো দুমাস আর নেই। এক মাস পঁচিশ দিন আছে।”
আবার সব চুপ।
একটু পরে গোলোক বলল, “ওটা বুঝি শুভদিন?”
“ওটা আমার জন্মদিন।
আবার দুজনে চুপ।
“এই দিনটা কে বাছলো?”
“ও।”
দুজনে চুপ। ধীরে ধীরে ঘোরটা কেটে আসছে। জড়ানো জড়ানো কথাগুলো ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ফুটছে।
“মল্লিকদা বুঝি তোমাকে খুব ভালবাসে?”
“খুব।”
“আমার চাইতেও?” আরও স্পষ্ট করে বলল গোলোক।
“হ্যাঁ।”
এই স্পষ্ট সংক্ষিপ্ত স্বীকারোক্তি গোলোকের হৃৎপিণ্ডে যেন হুল ফুটিয়ে দিল। চুপ করে ব্যথাটা হজম করল সে।
“আর তুমি?”
“আমিও বাসি।
“কাকে বেশি?”
“তোমার আজ কী হয়েছে বলো তো?”
“কাকে বেশি ভালবাসো, মনো? আমাকে না তোমার ওকে?”
“তোমার কী মনে হয়?”
“আমি স্পষ্ট জবাব চাই।”
“স্পষ্ট জবাবই পাবে। বলো না, তোমার কী মনে হয়?”
“আমি বুঝতে পারিনে।
“কেন? তোমার কাছে আমার তো কিছু গোপন নেই। তবে কেন বুঝতে পারো না?”
গোলোক চুপ করে গেল। পরক্ষণেই আবেগ দিয়ে বলল, “আমি তোমাকে পেতে চাই মনো।”
“আমি কি আমাকে দিইনি?”
“কী জানি, এখন কেমন মনে হচ্ছে, সব হয়তো দাওনি।”
“কী দিইনি গোলোক? কী পাওনি বলো?”
“তোমার মন। তোমার ভালবাসা। প্রেম।”
মনোরমা এ-কথার জবাব দিল না। গোলোক অসহিষ্ণু হয়ে উঠল।
“কী জবাব দিচ্ছ না যে?”
“কী জবাব এর হতে পারে তাই ভাবছি।”
মনোরমার বলবার ঢঙে যে বিষণ্ণ আন্তরিকতাটুকু ছিল, তা গোলোকের মনকে স্পর্শ করল।
গোলোক বলল, “আমাকে তো এক মুহূর্তও ভাবতে হয় না মনো। আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। একটি দিন, একটি মুহূর্তও না। এ-কথা আমার কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। আর তোমাকে আমার প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য ভাবতে হবে? আশ্চর্য!”
“তুমি তা হলে আমার চাইতে সুখী গোলোক।”
মনোরমার অন্তরে যত বিষণ্ণতা জমা হয়ে উঠেছিল, তা নিঃশেষে ঢেলে দিল গলায়। চিত হয়ে শুল। গোলোক দেখল, মনোরমার অবয়ব যেন বিষাদের ঘেরাটোপ দিয়ে মোড়া রয়েছে। তার দৃষ্টি উদাস। কপালে রেখা ফুটে উঠেছে। মনোরমা কী যেন ভাবছে। অনেক ব্যবধানে চলে গেছে সে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনোরমা বলল, “তুমি সুখী, কারণ তুমি তোমার মনকে নিশ্চিতভাবে জেনে ফেলেছ। সংসার নেই তোমার। তোমাকে মিথ্যে বলব না গোলোক, আমি আমার মনকে জানিনে। তুমি যে আমার কতখানি, সে তুমিও জানো। প্রতিদিন জেনেছ। মুখের কথায় তার চেয়ে স্পষ্ট করে জানানো যাবে না। তবে তুমি আমার সব কি না, সে-বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছিনে। আমি জানিনে গোলোক, সত্যিই জানিনে। এ-প্রশ্ন যে উঠতে পারে, এ তো জানতাম না। তুমি আমার জীবনে ঝড়ের রথে সওয়ার হয়ে এসেছ। ভেবে-চিন্তে দেখবার সময় পাইনি তো আমরা।”
মনোরমা গোলোকের একখানা হাত মুঠো করে ধরল। আবেগ ভরে বলল, “আর তাই তো চেয়েছিলাম আমি। ক্রমাগত আট বছর মৃত্যুর দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে যখন জীবনের সীমানায় ফিরে এলাম, তখন বাঁচার আস্বাদ পাবার জন্য আমার দেহ, আমার মন লালায়িত হয়ে উঠল। কিন্তু সংসারে ঢুকতে গিয়েই বাধা পেলাম। আট বছর আগে কালান্তক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে যখন সংসারের সীমান্ত ছাড়িয়ে হাসপাতালে গেলাম তখন যারা আমার জন্য চোখের জল ফেলেছিল, হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে অনেক আশা নিয়ে আবার যখন সংসারে ঢুকতে গেলাম তখন তারাই আমার বৈরী হয়ে দাঁড়াল। সকলের চোখে সে কী চাপা আতঙ্ক, সে কী ভয়, কী সংশয়! উঃ সে ভাবা যায় না। এই দ্যাখো, এখনও আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে।”
মনোরমা ভয়ে শিউরে উঠল।
“ওরা আমাকে ঠাঁই দেবে না, ঠিক করেছিল।” মনোরমা বলে চলল, “যত রকম ষড়যন্ত্র করবার, সব করেছে। কিন্তু একটি লোক সে-সব ব্যর্থ করে দিয়েছে। সে আমার স্বামী। সে আমাকে সুস্থ করে তোলার জন্য প্রাণপাত চেষ্টা করেছে। ভারতের কোনও স্পেশালিস্ট আর বাকি রাখেনি। আমাকে আশা দিয়েছে, ভরসা দিয়েছে, অভয় দিয়েছে। সংকটতম মুহূর্তে পাশে পাশে থেকেছে। সংসার ছেড়ে আমাকে নিয়েই ঘর বেঁধেছে। প্রচণ্ড তার ভালবাসা। তার পরিচয় প্রতি মুহূর্তে দিয়েছে, দিচ্ছে। তাকে আমি বেশি ভালবাসি কি না জিজ্ঞাসা করেছ। এর কি এক কথায় জবাব দেওয়া যায়! বলো?”
অবুঝ গোলোককে যেন মিষ্টি কথায় প্রবোধ দিচ্ছে মনোরম।
গোলোক বলল, “কিন্তু তোমার অতৃপ্তি, তোমার জ্বালা তাতে মেটেনি!”
“না, একটুও না।” মনোরমার কথায় দ্বিধা নেই।”তুমি আমার জ্বালা মিটিয়েছ গোলোক। আমার দেহের দাহে শান্তির প্রলেপ লেপে দিয়েছ। পরিপূর্ণ বাঁচার স্বাদ তোমার কাছ থেকেই আমি পেয়েছি। আমার নারীজন্মের চরম সুখের সন্ধান তুমিই আমাকে দিয়েছ। যার জন্য আমি কাঙাল হয়ে উঠেছিলাম। আমি যে সেরে গিয়েছি, বেঁচে উঠেছি, মায়া-মমতা-স্নেহ শুধু নিতেই আসিনি, দিতেও এসেছি আমাকে উজাড় করে, আমার স্বামী একথা বুঝতে পারেনি। দেবার মধ্যেও যে সার্থকতা আছে, পূর্ণতা আছে, তোমার কাছ থেকেই তা জেনেছি। তুমি আমার পঙ্গুত্ব ঘুচিয়েছ। কী করে বলব তোমাকে ভালবাসি না। এ কি এক কথায় রায় দেওয়া যায়? বলো।”
গোলোক অস্থির হয়ে মনোরমাকে কাছে টেনে নিল। মনোরমার বুকে নিজের মুখখানা ডুবিয়ে দিল। মনোরমার বাঁ দিকের বুকটা চুপসানো। দু-দুবার অপারেশন হয়েছে। অন্য বুকটার উদ্ধত ভঙ্গিতে মনে হয়, সে যেন একাই অন্যের ঘাটতি পূরণ করে দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। গোলোকের অকস্মাৎ মনে হল, এবং এই প্রথম মনে হল, মনোরমার শরীরটাও আজ যেন দুই সুরে কথা বলছে।
গোলোক অবুঝ শিশুর মতো বায়না ধরল, “ওসব আমি জানিনে, জানতে চাইনে মনো। আমি তোমাকে চাই, তোমার সবটুকু চাই।”
গোলোকটা ছেলেমানুষ। মনোরমা হাসল। জবাব দিল না। গোলোকের আদরের প্রতিদান দিতে লাগল।
“তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না।” গোলোক একই সুরে আবৃত্তি করল। যেন মনোরমাকে কেউ তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, তাই প্রাণপণ শক্তিতে বুকে আঁকড়ে ধরল মনোরমাকে।
“উঃ, লাগে গোলোক, ছাড়ো ছাড়ো লাগছে।” মনোরমা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। তার ফুসফুসে প্রচণ্ড চাপ পড়েছে। কয়েকটা পাঁজর কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। আর সেইখানেই না জেনে চাপ দিয়েছে গোলোক।
গোলোক মনোরমার এই যন্ত্রণা টের পেল না। আলিঙ্গন শিথিল করল না। নিজের আবেগে বলে চলল, “আমি চাই, তুমি একান্ত করে আমার হবে, শুধু আমার।”
অসহ্য যন্ত্রণায় শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। দম আটকে এল। ভিতরটা যেন চৌচির হয়ে যাবে। ভয় পেল মনোরমা। সাংঘাতিক ভয়।
“ছাড়ো, ছাড়ো।” এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। হাঁফাতে লাগল। খুব রেগে গেল গোলোকের কাণ্ডজ্ঞানের অভাব দেখে। কোথায় চাপ দিয়েছে গোলোকের সে খেয়ালই নেই। আবার যদি কিছু হয়? যদি রিলান্স করে? হায় ভগবান! তা হলে আবার হাসপাতাল, স্যানাটোরিয়াম। সুস্থ নীরোগ জীবনের সীমান্তের বাইরে তা হলে আবার নির্বাসন! গোলোকের দুটো হাত আবার তাকে জড়িয়ে ধরতে আসছে। আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিবশে হুঁশিয়ার হল মনোরমা। একটু সরে গেল। গোলোকের একটা হাত আস্তে এসে মনোরমার সুস্থ স্তনের উপর আশ্রয় নিল। মুহূর্তে একটা শিহরনের তরঙ্গ খেলে গেল। কিন্তু তখনও যন্ত্রণার উপশম হয়নি মনোরমার। ফুসফুসে এখনও খচখচ করছে। আস্তে আস্তে তাই গোলোকের হাতখানা সরিয়ে দিল আবার।
হঠাৎ গোলোক প্রস্তাব করল, “চলো মনো, এখান থেকে আমরা চলে যাই কোথাও।”
মনোরমা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, “কেন?”
“কেন!” মনোরমার প্রশ্নে গোলোক বিস্মিত হল। বলল, “কেন তা বুঝতে পারছ না। দুজনে আলাদা করে ঘর বাঁধব। শুধু তুমি আর আমি, আর কেউ না।”
মনোরমা গোলোকের প্রস্তাবের কোনও উত্তর দিল না। বিছানা থেকে নেমে পড়ল। কাপড় চুল ঠিকঠাক করতে করতে শ্রান্তভাবে বলল, “ওঁর আসবার সময় হয়ে এল। এখন যাই।
গোলোক তড়াক করে লাফিয়ে উঠে মনোরমার পথ আটকে দাঁড়াল। একটু রেগে গেল। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, “জবাবটা দিয়ে যাও।”
মনোরমা অসুস্থ বোধ করছে। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। গোলোকের মুখের দিকে চেয়ে চমকে উঠল সে। গোলোকের চোখ দু’টো যেন জ্বলছে। বলল, “কি ছেলেমানুষি হচ্ছে!”
গোলোক চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “আমি ভিখিরি নই মনোরমা। তোমাকে সম্পূর্ণ করে পাবার অধিকার আমার আছে কি না জানতে চাই।
মনোরমা কাতরভাবে বলল, “বিশ্বাস করো, আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। শরীরটা খারাপ লাগছে। কাল বলব, যা জানতে চাও, কাল জিজ্ঞাসা কোরো!”
“না, না, এড়িয়ে গেলে চলবে না,” গোলোক আবার অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে।”আজই, এখনই তোমাকে বলতে হবে।
মনোরমা এবার খাটে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে বলতে লাগল, “তোমার আজকের ব্যবহার দেখে ভয় পাচ্ছি গোলোক! আমার বলতে ইচ্ছে করছে, আমার স্বামীকেই আমি ভালবাসি। কিন্তু মিথ্যে আমি বলব না। যদি জানতাম, একমাত্র তোমাকেই ভালবাসি, তোমার সঙ্গে চলে গেলে আর কাউকে বঞ্চিত করার পাপ আমায় বর্তাবে না, তবে তোমার সঙ্গে চলে যেতে একটুও দ্বিধা করতাম না।”
গোলোক বিরক্ত হল। “তুমি কি সরল ভাষায় কথা বলতে পারো না? কী বলছ, তা হয়তো তুমি নিজেই জানো না। স্বামীকে বঞ্চিত করতে চাও না তো খুব বললে, কিন্তু আমার সঙ্গে শুতে যখন, তখন তোমার এই বঞ্চনা-টঞ্চনার কথা মনে পড়ত না।”
“না,” মনোরমার চোখে-মুখে আত্মপ্রত্যয়ের দৃঢ় ছাপ পড়ল। “ও কখনও আমার দেহ দাবি করেনি। ও সদা-সর্বদা ভয় করত, স্বামীর অধিকার খাটাতে গেলে আমি আবার হয়তো রোগে পড়ব। তাই নিজেকে বঞ্চিত করেছে, আমাকেও। কিন্তু আমি রক্তে মাংসে গড়া। আমাকে আমি বঞ্চিত করতে চাইনি। তাই আমার দেহটা তোমাকে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি, এইমাত্র অনুভব করলাম, ভালবাসিনে তোমাকে। তোমার চাইতে আমার স্বামী অনেক সহৃদয়, তাঁর অনুভূতি অনেক বেশি, তাঁর স্বার্থত্যাগ, দায়িত্ববোধও তোমার চাইতে অনেক বেশি।”
মনোরমা হতভম্ব গোলোকের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। একটু পরেই ফিরে এল আবার। গোলোক তখনও সেইভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। মনোরমার চোখদুটো টলটল করছে জলে। বলল, “তোমাকে অদেয় কিছুই আমার নেই। যা আমার একান্ত, যা আমার নিজস্ব, তার সবটুকুই তোমাকে দিয়েছি গোলোক, যা আমার নয় তা দিই কী করে? আমাকে ভুল বুঝো না। কিন্তু এইভাবেই কি আমরা থাকতে পারিনে?”
গোলোক যেন ঘুম ভেঙে উঠল। ওর রাগ বিরক্তি মনোরমার এই করুণ আবেদনে অনেক কমে এল। মনোরমাকে হারানোর বেদনাই প্রধান হয়ে উঠল। ভারী গলায় বলল, “তা আর হয় না মনোরমা।”
“তবে কি এই শেষ, গোলোক?” মনোরমার চোখের কোণ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ল।
গোলোকের মনে হল তার বুকটা খালি হয়ে যাচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াল। বলল, “এই শেষ মনোরমা, আর আমাদের যেন দেখা না হয়।”
কিছুক্ষণ আর কোনও সাড়াশব্দ পেল না গোলোক। ফিরে দেখল, কেউ নেই। তার বুকটা হুহু করে উঠল। ফাঁকা ফাঁকা ফাঁকা। অকস্মাৎ সব ফাঁকা হয়ে গেছে।
তারপর? সব যদি শেষই হয়ে গেল এখানে, তবে আবার কেন মনোরমার দেহের ফাঁদে জড়িয়ে পড়লে গোলোক? চারুলতার আত্মহত্যার নিমিত্ত হলে কেন?
দুর্বলতার জন্য। নাটকের অঙ্ক যেমন হিসেব কষে কষে শেষ করা যায়, মানুষের জীবনে তা পারা সম্ভব কি না জানিনে। অন্তত আমি পারিনে। না-হলে চারুলতাকে পেয়ে যে-উদ্যমে ঘর বাঁধতে গিয়েছিলাম, মনোরমার একটি প্রবেশেই তা ভেস্তে যাবে কেন। আর চারুলতাও তো পোড়খাওয়া মেয়ে। অনেক ভুগেছে, অনেক দেখেছে। তবু একদিন আকস্মিকভাবে মনোরমাকে আর আমাকে এই বিছানায় সে শুয়ে থাকতে দেখল আর তারপর সে বাড়ি ফিরে আত্মহত্যা করল! কিন্তু ওকে দেখে কখনও আমার মনে হয়নি, এত কাঁচা কাজ করতে পারে। কিন্তু মনোরমা আর আমি এমন কাজ করব আবার, তাই কি ভেবেছিলাম!
১৯
মনোরমা চলে গেল। প্রথমে গোলোকের ঘর থেকে। তারপর কিছুদিন বাদে, সেই বাড়িটা থেকে। মনোরমা চলে গেল। গোলোকের মনে গভীর দুটো দাগ রেখে গেল। একটা তীব্র অনুশোচনার। অপরটা প্রবল অতৃপ্তির।
যে-মুহূর্তে জানল গোলোক যে মনোরমার ষোলো আনা অধিকার এক নয়, সে বড়জোর তার তরফের ভাগিদারমাত্র, সেই মুহূর্তেই তার অভিমান এবং অভিমানের সঙ্গে তার ব্যক্তিত্ব চুরচুর হয়ে ভেঙে গেল। সে খুব ছোট হয়ে গেল। গোলোক সমস্ত জমাখরচের পর দেখল, সে একটা কামুক ছাড়া আর কিছু নয়। ছি ছি করল নিজেকে। কী করেছে সে? খতিয়ে দেখতে লাগল গোলোক। দেখল, নিতান্ত পেশাদার এক লম্পটের মতো পরস্ত্রীর সঙ্গে দিনের পর দিন শুয়েছে। সমাজ ও আইনের অনুশাসন ভঙ্গ করেছে। কৃতকর্মের অনুশোচনায় গোলোকের অন্তর পুড়ে যেতে লাগল। সে তো এ চায়নি। মনোরমার জার হবার বাসনা ছিল না তার। তবে কী চেয়েছিল গোলোক? মনকে প্রশ্ন করে গোলোক কোনও জবাব পেল না। সে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। সে জানে না। জানে না। না না, জানে বই কী! সাফাই গাইল গোলোকের মন। মনোরমাকে নিয়ে ঘর বাঁধবার গোপন এক আকাঙ্ক্ষা তার ছিল। এর কি কোনও অর্থ হয়? গোলোকের বিবেচনা প্রশ্ন তুলল। অভিমান জবাব দিল, কেন, অর্থ হয় না কেন? অন্য লোকের স্ত্রীকে নিয়ে তুমি ঘর বাঁধবে, এটা কি নাবালকের আব্দার নয়? বিদ্রুপ করল গোলোকের বিবেচনা। মনোরমা কার স্ত্রী কি স্ত্রী নয়, সেটা আমার প্রশ্ন নয়। ও সব বিন্দুমাত্রও কেয়ার করিনে আমি। গোলোকের অভিমান গোলোককে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল। মনোরমা যদি আমার হত, শরিকহীনভাবে আমার, তা হলে আর কিছু গ্রাহ্য করতাম না আমি। মনোরমাকে নিয়ে ঘর বাঁধতাম। সার্থক হতাম।
গোলোকের আফশোস, কামনার স্রোতে অন্ধের মতো, এমন অসহায়ের মতো ভেসে যাচ্ছে সে যে এসব প্রশ্ন তোলবার অবকাশই পায়নি। মনোরমা যাবার সময় এক ঠেলায় তাকে যেন বুদ্ধি বিচার বিবেচনার কন্টকিত চরায় তুলে দিয়ে গেছে। তার শ্রান্ত অনাবৃত দেহে এখন সে-সব খচখচ করে বিধছে। গোলোক অসহায়ের মতো সে-পীড়ন সহ্য করছে।
সেই সঙ্গে গোলোকের অভ্যাসটাও খারাপ করে দিয়ে গেছে মনোরমা। কয়েকমাস ধরে উপোসি গোলোককে যে-তৃপ্তি মনোরমা ক্রমাগত জোগান দিয়ে গেছে, এখন মনোরমার হঠাৎ প্রস্থানে (অনুশোচনার প্রবল দংশন সত্ত্বেও) গোলোক তার অভাব নিদারুণভাবে বোধ করতে লাগল। দুপুর নিবিড় হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে গোলোকের রক্ত চঞ্চল হয়ে আসে। তার শরীরের প্রতিটি কোষে তীব্র ক্ষুধা জেগে ওঠে, প্রবল অস্থির হয়ে ওঠে গোলোক। বিগত দিনের স্মৃতিগুলির তীক্ষ্ণ দংশনে গোলোক ছটছট করতে থাকে। কত নিঃসঙ্গ সে। কী ভয়ঙ্কর রকম একা!
গোলোক দেখল, এমন সঙ্গিহীন থাকলে সে পাগল হয়ে যাবে। বহুদিন পরে সে পরিচিত লোকদের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। শিল্পীদের আড্ডায় ঢুঁ মারল। কোনও সুখ পেল না। তবে আঁকবার তাগিদ অনুভব করল। দু’মাস ধরে ছবি আঁকল গোলোক। সাতখানা ছবি সে শেষ করল। একদিন বিচারকের দৃষ্টি নিয়ে সে পরীক্ষা করল ছবিগুলো। তেমন উত্তরোয়নি। পরিশ্রম বরবাদ হয়ে গেছে। হতাশায় ডুবে গেল গোলোক। সে শেষ হয়ে গেছে। একেবারে খতম। কী করবে গোলোক? এখন? কলকাতা ছেড়ে চলে যাবে? এখান থেকে চলে গেলেই কি এ ব্যাধির হাত থেকে মুক্তি পাবে সে? নিঃসঙ্গতা দূর হবে? পুনর্জন্ম পাবে? জোর দিয়ে হ্যাঁ বলার মতো প্রত্যয়ের দেখা পেল না গোলোক। যেখানে তুমি যাও গোলোক, তার অভিমান বলে উঠল, এই ক্ষুধা, এই জ্বালা, এই দাহ তোমাকে তাড়া করে ফিরবে, নিস্তার পাবে না। তা হলে কী করবে সে? কেমন করে নিবৃত্ত করবে এই রাবণ-চিতার দহন? বিয়ে করো। গোলোকের মন উত্তর দিল। চমকে উঠল গোলোক। এই কীটদষ্ট দেহটাকে কোনও মেয়ে নিশ্চিন্ত মনে গ্রহণ করবে? কাকে চেনে সে? কার কাছে গিয়ে বলবে, আমাকে এনেছি। এই নাও। অসম্ভব প্রস্তাব। গোলোক তিক্ত হাসি ছড়িয়ে দিল ঠোঁটে।
চারুলতা কি তোমার প্রস্তাবে আপত্তি করেছিল গোলোক :
চারুলতা? না আমার প্রস্তাবে সে আপত্তি করেনি। ঠোঁট টিপে হেসেছিল। তারপর একটা হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙেছিল। হ্যাঁ না কিছুই বলেনি। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সে আদৌ বিশ্বাস করেনি। তার হাসিতে ছিল চাপা বিদ্রুপ, তাই হাই তোলার ভঙ্গিতে ছিল প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্য। জগতের কোনও কিছুতেই বিশ্বাস ছিল না তার। কিন্তু রাত কি শেষ হয়ে এল?
চারুলতার প্রসঙ্গ শেষ করো, গোলোক। এবার কলমটা কিছু জোরে চালাও।