১০
সত্যব্রত নেহাত খারাপ পরামর্শ দেয়নি সেদিন। যদিও গোলোক সে-পরামর্শ রাখেনি। তখন গুরুত্ব দেয়নি সে-কথার।
এটা তোমার কাছে আশ্চর্য লাগে না গোলোক? শিল্পী হয়েও তুমি এত বড় একটা সুযোগ কাজে লাগাওনি। সত্যব্ৰতও তো ঝর্নার ছবি এঁকেছে। আর তুমি পারতে না।
না, আমি পারতাম না। সত্যব্রতের চোখে ঝর্না তো শুধু ছিল একটা মডেল। আমার কাছে ঝর্না ছিল ভালবাসার ধন। ঝর্নাকে মডেল করে তো ছবি আঁকতে হয়নি আমাকে। আমার কল্পনাতেই ঝর্না মূর্ত হয়েছিল। সত্যব্রতের পরিশ্রমই সার হয়েছে। একটা পোরট্রেটও জীবন্ত হয়ে ওঠেনি। সে-কথা ঝর্না বলেছে। সত্যব্রতও বলেছে।
তুমি ছবিটা ঝর্নাকে দিয়ে আবার চেয়ে এনেছিলে কেন গোলোক? আনলে যদি আর ফেরৎ দিলে না কেন?
সত্যি বলতে কী, কেমন ঈর্ষা হয়েছিল আমার। কারণ, দেখতে পাচ্ছিলাম, ক্রমশ ঝর্নার কাছে আমার চাইতেও আমার আঁকা ছবি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছিল। তখন আমি খুবই মনস্তাপে ভুগছিলাম। সত্যব্রত যখন ঝর্নার বাড়িতে গিয়ে ঘটা করে তার ছবি আঁকতে বসত, তখন লক্ষ করতাম, সে সত্যব্রতকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। ঝর্না আমার আসনে আর কাউকে বসাচ্ছে, এ-চিন্তাও আমার কাছে অসহ্য ঠেকত। সে যে কী দাহ, কী করে বোঝাব! আমি জানতাম, ঝর্নার কাছে সত্যব্রত ছিল শুধু একজন শিল্পী। আমি জানতাম ঝর্না আমাকে ভালবাসতে শুরু করেছে। কিন্তু তবুও, সে কেন অন্য পুরুষকে সঙ্গ দেবে? যে সন্ধ্যায় ঝর্নার সঙ্গ পাবার জন্য আমি উন্মাদের মতো ছুটে যেতাম, গিয়ে দেখতাম ঝর্নার চারপাশে অন্য লোকের অধিকারের গণ্ডি পড়ে গেছে। ঝর্নার বাবা বৈঠকখানার প্রশস্ত ঘরে আরাম কেদারায় বসে চুরুট ফুঁকছেন, টুলের উপর পাকা মডেলের মতো ঝর্না বসে আছে। সত্যব্রত ছবি আঁকছে। আমার অস্তিত্ব যেন শূন্য মানে নেমে এসেছে। সত্যব্রত শিল্পী হিসাবে আমার চেয়ে অনেক বেশি সিরিয়াস, সেটা আমি স্বীকার করি। কিন্তু সে কেন আমার অধিকারে হাত বাড়াবে।
আর এর জন্য দায়ী যদি কেউ থাকে তো আমার ওই ছবিখানা। ওই ছবিখানাই তো সবাইকে ঝর্নার ঠিকানা জানিয়ে দিয়েছে। রক্তমাংসের ঝর্নাকে আর্টের ঝর্নায় পরিণত করেছে। তাই সব অনর্থের মূল সেই ছবিখানাকে একজিবিশনে দেব বলে ঝর্নাদের বাসা থেকে নিয়ে এসেছিলাম। ইচ্ছে ছিল ওটাকে নষ্ট করে দেব। কিন্তু পারিনি। এখনও আমার কাছে রয়েছে সেটা। ওই কালো ট্রাঙ্কে বন্দি হয়ে।
১১
গোলোকের যে পরিবর্তন হচ্ছে, সে যে অহরহ অশান্তিতে ভুগছে, এটা ঝর্নার নজর এড়ায়নি।
একদিন পড়তে বসে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে আপনার মাস্টারমশাই?”
গোলোকের মুখখানা হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল। বলল, “কেন?”
ঝর্না কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে গোলোকের দিকে চেয়ে রইল। তার চোখের কোনায় বেদনার ছায়া খেলে গেল। বলল, “বলুন না কী হয়েছে?”
গোলোক ঠাণ্ডা গলায় বলল, “আজেবাজে কথা না বলে টাসক্টা শেষ করো।”
ঝর্নার চোখ দুটো টলটল করে উঠল। পরক্ষণেই সামলে নিল। বলল, “বেশ।” –তারপর মাথা নিচু করে পড়তে লাগল। গোলোকও একটু ব্যথা পেল মনে।
একটু পরে গোলোক গলাটা মোলায়েম করে বলল, “কী বলছিলে তখন?”
ঝর্না অভিমানে কথা বলতে পারল না। মাথা নিচু করে পড়তে লাগল।
গোলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, “তোমার বাবাকে মাস্টার ঠিক করতে বলো ঝর্না।”
ঝর্না এবার চমকে উঠল। মুখখানা মুহূর্তে শুকিয়ে গেল।
বলল, “কেন, কেন মাস্টারমশাই!”
বড় বড় চোখ করে গোলোকের মুখের দিকে দমবন্ধ করে হাঁ করে চেয়ে রইল ঝর্না। যেন গোলোক এক্ষুনি ফাঁসির হুকুম দেবে।”
গোলোক বলল, “এখন তোমার কলেজের পড়া। ভাল মাস্টার রাখা উচিত। আমার দ্বারা এ কাজ হবে না।
“না না না না না।” ঝর্না কেঁদে ফেলল ঝরঝর করে।”আমি কি কোনও অপরাধ করেছি? বলুন, আপনার পায়ে পড়ি। কোনও অন্যায় করেছি আমি?”
গোলোক দেখল, ঝর্না এক মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে। ভুগছে যে তার পরিচয় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে ঝর্নার মুখে-চোখে, তার প্রতিটি অভিব্যক্তিতে। এই চোখে একদিন বিদ্যুতের ছটা দেখেছিলাম, গোলোক ভাবল। আজ সেখানে শুধু মেঘ। এই ঠোঁটে একদিন লাস্য ফুটেছিল। আজ সেখানে কাতরতা। এই চোখই, এই ঠোঁটই, এই মুখখানাই একদিন স্বপ্নের মায়াজালে ঢাকা পড়েছিল। আরেকদিন প্রশান্তিতে ভরে উঠেছিল। সেই ঝর্না আর এই ঝর্না! না, এক ঝর্না নয়, প্রত্যেক সময়ে সে নতুন নতুন ঝর্নাকে রূপ নিতে দেখেছে। এই যে যে-ঝর্না এখন তার সামনে বসে তার ব্যবহারে কষ্ট পাচ্ছে, কাঁদছে, ভয় পেয়েছে, এ-ঝনাও নতুন সৃষ্টি। এ তো কখনও তাকে ভোগায়নি। আগের কোনও ঝর্না জ্ঞানতই হোক কি অজ্ঞানতই হোক, যদি তাকে যন্ত্রণা দিয়েই থাকে, যদি তার দাহের কারণ হয়েই থাকে, তার জন্য এই ঝর্নাকে সাজা দেওয়া কেন। গোলোকের মন বিষণ্ণ হয়ে এল। ঝর্না ব্যথা পাচ্ছে। পাচ্ছে তারই কারণে এই কথা ভেবে গোলোকও কষ্ট পেতে লাগল। ঝর্নার চোখের জল মুছিয়ে দেবার জন্য প্রবল ইচ্ছে হল। কিন্তু সব বারের মতো এবারও সে ইচ্ছেমতো কাজটা আর করে উঠতে পারল না। কোথা থেকে যে এই প্রবল বাধাটা আসে, তাকে পঙ্গু করে দেয়, বুঝতে পারে না গোলোক।
গোলোক সস্নেহে বলে উঠল, “ঠাট্টা করছিলাম ঝর্না।”
ঝর্না সঙ্গে সঙ্গে যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, “সত্যি! সত্যি যাবেন না তো? আমার গা ছুঁয়ে বলুন।”
আজ আর গোলোক সঙ্কোচ করল না। ঝর্নার হাত দুটো টেনে নিল। বলল, “তোমার গা ছুঁয়ে বলছি যাব না।”
ঝর্না বলল, “উঃ কী সাংঘাতিক লোক আপনি। আমি কিন্তু সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম।”
গোলোক বলল, “যদি সত্যিই আমি চলে যাই, ধরো—”
ঝর্না হেসে ফেলল। অগাধ বিশ্বাসে ভর করে ঝর্না বলল, “আর আপনি যেতে পারবেন না, আমি জানি।”
গোলোক বলল, “কী জানো?”
ঝর্না বলল, “আমাকে কথা দিয়ে সে-কথা আপনি ভাঙতে পারেন না।”
গোলোক চুপ করে গেল।
ঝর্না বলল, “আপনি চলে গেলে আমি হয়তো বাঁচতাম না, মাস্টারমশাই।”
গোলোকের চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হল। যে প্রবল উন্মাদনা সঞ্চিত হয়েছে তার দেহে, প্রকাশের পথ না পেলে তার ভিতরটায় যেন বিস্ফোরণ হবে।
ঝর্না স্পষ্ট করে বলল, “আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না!”
“ঝর্না, এ কি সত্যি?”
“সত্যি মাস্টারমশাই।”
“কী করে এমন হল?”
“তা তো জানিনে।”
“ঝর্না, ঝর্না, আজ একবার বাইরে যাবে?”
“না না, আজ নয়, আজ আমি আপনার সঙ্গে কোথাও বেরুতে পারব না মাস্টারমশাই।”
“তবে এখানেই বসি। তোমার হাতদুটো ধরি।”
“না না–” কাঁপা কাঁপা গলায় ঝর্না বলল, “আজ নয়, আজ নয়, আজ আপনি যান। আমি, আসি—”
ঝর্না এক ছুটে ভিতরে চলে গেল।
১২
না, ঝর্নার সঙ্গে আর বাইরে বেরুনো হয়নি আমার। তার পরদিনই ঝর্নার মা ঝর্নাকে নিয়ে এলাহাবাদে চলে যান। ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে। সারা পশ্চিম ঘুরে দুমাস পরে যখন ঝর্না মায়ের সঙ্গে কলকাতায় ফিরল, আমি আর তখন সেই আগের আমি নেই। যক্ষ্মাদষ্ট, অন্য জীবনের মানুষ। ঝর্না চিঠি লিখত হাসপাতালে। একটা চিঠিরও আমি জবাব দিইনি। কী লাভ? প্রথম প্রথম চিঠিগুলো খুলে পড়তাম। অনেক আশা-ভরসার কথা থাকত তাতে। তাই পরের দিকের চিঠিগুলো না খুলেই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি।
সবই বললে, শুধু বললে না, সেই ছবিখানা কেন রেখেছ?
সে আমি নিজেই জানিনে। সত্যি জানিনে।
১৩
আগের দিন জানালায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছিল গোলোক। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিল। তাই সকাল থেকে বিছানায় শুয়ে গড়াচ্ছিল। ঝিটা আসেনি তখনও। একবার ইচ্ছে হল চা-টা নিজেই করে খায়। পরক্ষণেই ভাবল, তবে লোক রাখা হয়েছে কেন? আর উঠল না। তবে ঝি আসার দেরি দেখে মনে মনে বিরক্ত হল খুব। মাথাটা টিপটিপ করছে। জ্বর জ্বর ভাব।
দরজায় খুট খুট শব্দ হতেই গোলোক দরজা খুলতে উঠল। দেখল এর মধ্যেই তার গা-গতর দিব্যি ভারী হয়ে উঠেছে। মাথা তো তুলতেই পারছে না। দরজা খুলতেই ঝি ভিতরে ঢুকল।
“বাব্বা, যা বিষ্টি আরম্ভ হয়েছে। ভিজে পুড়ে একশা হয়ে গেল।” বিরক্তস্বরে ঝিটা বোধ করি তার দেরির সাফাই গাইল।
গোলোক বলল, “আগে বেশ কড়া করে একটু চা বানাও তো। শরীরটা খারাপ লাগছে।”
“কী হল, জ্বর হল নাকি বাবু!”
“ঠিক বুঝতে পারছিনে। আজ আর ভাত খাব না ভাবছি।”
হিটারে জল চাপাতে চাপাতে ঝি বলল, “সেই ভাল। সাবধানে থাকাই ভাল। ট্যাকা দাও, পাউরুটি নিয়ে আসি।”
“আচ্ছা, আর দ্যাখো, ঐ সঙ্গে ডাক্তারখানা থেকে ইনফ্লুয়েঞ্জার বড়ি নিয়ে আসবে।”
চা খেয়ে একটু আরাম বোধ করল গোলোক। ঝিটা ঘরের কাজ সারছে। শুয়ে শুয়ে দেখছে। দেখল কত দায়সারা কাজ করছে ঝিটা। একদম যত্ন নেই কোনও কাজে। নিজে হাতে যখন গোলোক ওই সব কাজ করত, তখন ঘরখানা তকতক করত। যেন হাসত। এই ক’দিন মাত্র তো ঝিটা এসেছে। কিন্তু এর মধ্যেই কত ম্রিয়মাণ হয়ে এসেছে ঘরখানা। বিরক্ত হল গোলোক। কিন্তু কিছু বলল না। লাভ কী?
সেইদিনই প্রবল জ্বর এসেছিল গোলোকের। সঙ্গে সর্দি আর কাশি। দু-তিনদিন প্রায় বেহুঁশ হয়েই থাকল। তারপর জ্বর কমল, কিন্তু সর্দি-কাশি থেকেই গেল। দুর্বলতাও। ভয় পেয়েছিল সে। মৃত্যুভয় কি? বোধহয় না। তবে ভোগার ভয়, দীর্ঘদিন হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে থাকার ভয়, ছিল বই কী? নইলে এত তাড়াতাড়ি সে টি. বি. স্পেশালিস্টের দ্বারস্থ হল কেন? ডাঃ দত্তের পশার খুব। চেম্বারের ওয়েটিং রুমে বসতে হল অনেকক্ষণ। অনেক অপরিচিত মুখের মধ্যে দুটি তার চেনামুখ বেরিয়ে পড়ল। একটি সেই দোতলা ফ্ল্যাটের মেয়েটি। গোলোক তার আন্দাজ ভুল হয়নি দেখে মনে মনে খুশি হল। আর অপরটি তার সঙ্গী, নিশ্চয়ই স্বামী। গোলোক দেখল, মহিলাটি তাকে প্রথম দেখেই যেন একটু বিস্মিত হলেন। সঙ্গীর কানে কানে কী যেন বললেন। সঙ্গীটি পরমুহূর্তেই গোলোকের উপর একবার নজর বুলিয়ে নিলেন। গোলোকের অস্বস্তি লাগল। পরমুহূর্তেই সে দেখল, ওরা দুজনে এক আমেরিকান সচিত্র পাক্ষিক পত্রিকার পাতা ওল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ভদ্রলোকটি যে দ্বিতীয়বার তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেননি, গোলোক তা লক্ষ করেছে। কিন্তু ভদ্রমহিলাটি তার দিকে বারেবারেই চাইছিলেন। একবার গোলোকের সঙ্গে তাঁর চোখাচোখিও হল।
গোলোক একটু বিব্রত বোধ করল। তার কিছু করার নেই। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও দৃষ্টিটা গিয়ে বারবার ভদ্রমহিলার উপর পড়ছে। অন্যদিকে মন ফেরাবার জন্য সে বার কয়েক ঘরে পায়চারি করল। তারপর একটা পত্রিকা আনতে এগিয়ে গেল। যে-র্যাকে অনেক পত্রিকা তাগাড় দেওয়া ছিল তার কাছেই ওঁরা দুজন বসে আছেন। গোলোক দেখল ভদ্রমহিলার কোলে বেশ বড় একটা খাম। ওর ভিতরেই রয়েছে ভদ্রমহিলার ফুসফুসের এক্স-রে ফটো, গোলোক সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ। ভদ্রমহিলা যদিও স্বাস্থ্যবর্তী এবং এখন যদিও তাঁকে বেশ সতেজ সজীব দেখাচ্ছে, তবুও গোলোকের অভিজ্ঞ চোখ বলল, উনি কীটদষ্ট। তোমারই সগোত্র। খামের উপর নাম লেখা রয়েছে। গোলোক কিছুতেই কৌতূহল চাপতে পারল না। পত্রিকা খোঁজার ভান করে নামটা পড়ে নিল। মিসেস মনোরমা মল্লিক। গোলোকের চোখ তাকে ফাঁকি দেয়নি।
বেছেগুছে একটা পত্রিকা নিয়ে দাঁড়াতেই মনোরমা বলল, “আপনাকে আমাদের বাসাতেই দেখেছি যেন?”
গোলোক দেখল মনোরমার চোখদুটো খুশিতে চকচক করছে। গোলোকের কী হল কে জানে, মনোরমার চোখে সোজা দৃষ্টি ফেলে গলায় জোর দিয়ে বলল, “হ্যাঁ।”
মনোরমা সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গীকে ঠেলা দিয়ে বলল, “দেখলে!” মনোরমা যেন ধাঁধার উত্তর মিলিয়েছে, তেমনি হাসি হাসল। ভদ্রলোকও হাসলেন।
বললেন, “তাই তো দেখছি।” গোলোককে বললেন, “কতদিন হল এসেছেন? খুবই রিসেন্টলি নিশ্চয়।”
গোলোক বলল, “আজ্ঞে না। এক বছর ধরে আছি। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই ওখানে বাসা নিয়েছি।”
“বলেন কী!” ভদ্রলোক অবাক হলেন।”এতদিন এক সঙ্গে আছি! কই জানিনে তো!”
মনোরমার দৃষ্টিতেও বিস্ময় ফুটে উঠতে দেখল গোলোক। এতটা যেন সেও আশা করেনি। গোলোক মনোরমার চোখে চোখ রেখেই হাসল। অর্থাৎ এতে অবাক হবার কী আছে।
“মিঃ মজুমদার, প্লিজ!”
ডাক্তারবাবুর সহকারী তাকে ডাকতেই সে ভিতরে চলে গেল।
ডাঃ দত্ত বেশ যত্ন করেই তাকে দেখলেন। বুক পিঠ ঠুকে বেশ জোরের সঙ্গেই বললেন, “নাথিং, কিছু পেলাম না। কমন কোল্ড। ইনফ্লুয়েঞ্জার মতন হয়েছিল আর কি।”
সহকারীকে বললেন, “মিসেস মল্লিক।”
গোলোকের সংশয় দূর হয়নি। সে বলল, “একটা প্লেট তোলালে হত না?”
ডাঃ দত্ত প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বললেন, “স্যাটিসফ্যাকশানের জন্য যদি তোলাতে চান, তোলান না। তবে বুকে আপনার কিছু নেই। ক্লিয়ার। এই নিন, এই ফাইলটা কিনে নিয়ে যান। ব্যবস্থামত খাবেন। ঠাণ্ডা যেন লাগাবেন না। – মিসেস মল্লিক?”
মনোরমা ঘরে ঢুকতেই গোলোকের দিকে চাইল। তার মুখে আবার একফালি সন্তুষ্টির হাসির রেখা ফুটে উঠল। গোলোক বেরিয়ে যেতে যেতে ভাবল সে হাসি যেন বলল, আমরা তাহলে একই ঝাঁকের পাখি।
বাস-স্টপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোলোক যখন প্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তখন দেখল মিঃ মল্লিক আর মনোরমা তার কাছাকাছি এসে পড়েছেন।
“এই যে” মিঃ মল্লিক বললেন, “এখনও দাঁড়িয়ে আছেন। হোয়াট এ সিটি!”
গোলোক হেসে বলল, “যা ভিড়, বাসে উঠতেই পারলাম না।
“কোনদিকে যাবেন?” মনোরমা জিজ্ঞাসা করল, “বাসায়?”
গোলোক বলল, “হ্যাঁ।”
মিঃ মল্লিক বললেন, “বেশ তো। আমাদের সঙ্গেই চলুন না। এই ট্যাক্সি!”
ট্যাক্সিতে উঠে মিঃ মল্লিক বললেন, “আসুন, এইবার পরিচয়টা শেষ করি। আমি পানু মল্লিক।”
মনোরমা হাসতে হাসতে বলল, “মিঃ পি. এন. মল্লিক। আমি মনোরমা। মিসেস মল্লিক।”
“আমি——” গোলোক গোটা গোটা করে বলল, “গোলোক মজুমদার।”
গাড়ি থেকে নেমে গোলোক ধন্যবাদ জানিয়ে সরে পড়ছিল। মনোরমা বলল, ”এত তাড়া কিসের আপনার? আসুন না, একটু চা খেয়ে যান।”
গোলোকের খুব ক্লান্তি লাগছিল। যাতায়াতে বেশ পরিশ্রম হয়েছে। এখন বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারলে সে যেন বাঁচে।
ক্লান্তস্বরে সে বলল, “শরীরটা খুব খারাপ। আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না। কিছু যদি মনে না করেন, আলাপ যখন হলই তখন আরেকদিনই—একাই থাকি আমি, “সঙ্গী-সাথি তো কেউ নেই। ‘
“না না না, সে কী কথা।” মিঃ মল্লিক বলে উঠলেন।”খান, আপনি যান। আমরা তো আর পালাচ্ছি না। আসবেন, সুবিধা পেলেই আসবেন। যখন খুশি।”
“হ্যাঁ আসবেন, ডুব মেরে থাকবেন না।” মনোরমা হাসতে হাসতে বলল।”আমাকেও বড় একা থাকতে হয়। মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে উঠি!
গোলোক দেখল, মনোরমা হাসির আড়ালে এক জমাট বিষাদকে ঢাকবার চেষ্টা করছে। পারছে না।
১৪
ডাঃ দত্তের কাছ থেকে ফিরে এসেও খুঁতখুঁতি যায়নি গোলোকের। এক্স-রেটা না/ করানো পর্যন্ত সে যেন শাস্তি পাবে না। অথচ সেটা করতেও মনের জোর পাচ্ছিল না। গোলোক লক্ষ করছে, দিনের পর দিন, কী যেন হচ্ছে তার। উৎসাহ উদ্যম, সব ধীরে ধীরে নষ্ট হতে বসেছে। কোনও কাজে মন লাগে না, কোনও কাজে জোর লাগে না। সে যেন মেরামতের আযোগ্য মোটর গাড়ি। ফেলে রাখা হয়েছে একপাশে। ধীরে ধীরে কলকব্জায় মরচে ধরে আসছে।
চারদিন পরে সে আবার ঘর ছেড়ে বেরবার উদ্যোগ করল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে সদর দরজায় আসতেই মনোরমা ডাকল, “এই যে গোলোকবাবু, শরীর ভাল তো? বরুচ্ছেন না কি?”
গোলোক দেখল মনোরমা বারান্দায় ঝুঁকে আছে। মনোরমার মুখ-চোখের ভাব দেখে মনে হল, সে যেন অকূল সমুদ্রে একা একা ভাসছিল, এইমাত্র একটি মানুষের দেখা পেল।
মনোরমা ম্লান হেসে জিজ্ঞাসা করল, “কী, খুব ব্যস্ত?”
গোলোকও হাসল।”না, ব্যস্ত আর কি।”
“তবে আর কি, চলে আসুন ওপরে। একটু সময় নষ্ট করে যান।”
গোলোক দ্বিরুক্তি না করে ওপরে উঠে গেল। মনোরমা দরজা খুলে দিয়ে হাসল। মনোরমার চুলের সুবাস যেন ফ্ল্যাটটায় ছড়িয়ে রয়েছে। মনোরমা দরজা বন্ধ করে বারান্দাটায় এগিয়ে গেল। পিছনে গোলোক। কত চুল মনোরমার। সারা পিঠ ঢেকে পাছা পর্যন্ত নেমে গেছে।
দুটো চেয়ার টেনে দুজনে মুখোমুখি বসল। গোলোক একবার ঘাড় বেঁকিয়ে নিজের ঘরটা দেখে নিল। এ-দিকের জানলাটা বন্ধ আছে।
মনোরমা হাসতে হাসতে বলল, “ক’দিন আর জানলা বন্ধ করে থাকবেন?”
গোলোক বলল, “না, এবার খুলে দেব।
গোলোক দেখল এ-কথায় মনোরমার চোখে যেন আলো খেলে গেল।
মনোরমা বলল, “সেই ভাল। খুলেই রাখবেন। নইলে লোকে নানারকম সন্দেহ করতে পারে।”
“সন্দেহ করবে কেন?”
“করবে না-ই বা কেন, বলুন! আমারই তো ধারণা ছিল, আপনি হয় ফেরারি আসামি, আর না হয় নোট জাল করছেন!”
গোলোক মনোরমার কথা শুনে হঠাৎ ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। এমন হাসি সত্যিই সে আর হাসেনি। হাসতে হাসতে তার মনের অবসাদ অনেক কেটে গেল।
“তাই বুঝি লুকিয়ে লুকিয়ে চেয়ে দেখতেন। ফেরারি আসামির চোখাচোখি হবার ভয় ছিল না কি। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।”
“ওমা, আপনি কী সাংঘাতিক—” মনোরমাও শরীরে ঢেউ তুলে হাসতে লাগল।”এটাও লক্ষ করেছেন। না, সত্যি বলছি, আপনার সম্পর্কে আমার প্রচণ্ড কৌতূহল ছিল। তাই ডাঃ দত্তের চেম্বারে আপনাকে দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। আরও অবাক হলাম, আপনি যখন বললেন, এক বছর ধরে এই বাড়িতে আছেন। আমরাও বছরখানেক হল এখানে এসেছি। গত জুলাইয়ে। আপনি?”
“মে মাসের শেষে।
“তা হলেই দেখুন, ভাগ্য কেমন আমাদের জুটিয়ে দিয়েছে এক জায়গায়! আপনিও হাসপাতাল ফেরত, আমিও তা-ই। রোগটাও এক। আপনি কতদিন হাসপাতালে ছিলেন? কোথায়?”
এ এক অদ্ভুত আলাপ। গোলোক কারও সঙ্গে রোগ সম্পর্কে আলাপ করত না। খুব বিরক্ত হত। কিন্তু মনোরমার কথায় তার রাগ হল না। কারণ, মনোরমাও তারই পর্যায়ের। সত্যি বলতে কী, গোলোক এই প্রথম এক দোসর পেল, যার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলা যাবে।
গোলোক বলল, “আমি ছিলাম কাঁচড়াপাড়ায়। প্রায় দেড় বছর।”
মনোরমা বলল, “তবে তো কিছুই না।”
গোলোক ভাবছিল মনোরমার কথা জিজ্ঞাসা করা সমীচীন হবে কিনা।
মনোরমা নিজেই বলল, “আমার আর কোনও হাসপাতাল, কোনও স্যানাটরিয়াম বাদ নেই বোধ হয়। আট বছর ভুগেছি। বার তিনেক অপারেশনই করতে হয়েছে। এই বছর-দুই হল ভাল হয়েছি। আমার কথা আর বলবেন না।”
মনোরমা করুণ মুখে হাসল। গোলোকের বুকটা টনটন করে উঠল সমবেদনায়।
মনোরমা বলল, “বিয়ে হয়েছিল ষোলো বছর বয়সে। চার মাস পরেই এই কাল রোগে ধরল। তারপর থেকে দেখুন, হাসপাতালের বেডে বেডে শুয়েই প্রায় বুড়িয়ে গেলুম। ভাগ্যিস, মিঃ মল্লিকের মতো স্বামী পেয়েছিলুম তাই!” মনোরমার মুখে গর্বের রেখা ফুটে উঠল।”না হলে আমার অবস্থা যে কী হত, ভাবতেও ভয় হয়।”
মনোরমার মুখে-চোখে আতঙ্কের ছায়া খেলে গেল।
“আমার জন্য ও যে কী করেছে আর না করেছে, তা ওই জানে। আট বছর ধরে বেস্ট ডাক্তারকে দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছে, বেস্ট হাসপাতালে রেখেছে। কত টাকা খরচ হয়েছে বলুন তো!”
মনোরমাকে কথায় পেয়েছে। গোলোককে কথা দিয়ে দিয়েই যেন আঁকড়ে ধরতে চায়। গোলোকের খারাপ লাগছে না, কেন না বহুদিন পরে সে-ও যেন নিঃসঙ্গত্বের খোলশটি ফেলে মুক্তির আস্বাদ পাচ্ছে। নিজের চারদিকে গণ্ডী টেনে রাখার কোনও মানে হয় না। এই সাজানো ফ্ল্যাটটা খুব ভাল লাগছে গোলোকের। রেলিং বেয়ে বেয়ে মাধবীলতা উঠেছে টব থেকে। ছোট বড় নানা টবে ফুল ফুটে আছে। মৃদু গন্ধ ভেসে আসছে। সুন্দর, সত্যি সুন্দর এক জগৎ সৃষ্টি করে বসে আছে মনোরমা মল্লিকরা।
“টাকাও বড় কথা নয়—” মনোরমা বলছে।
: মনোরমা যদি পারে, এমন সুন্দর এক সংসার রচনা করতে, আমি কেন পারব না। —গোলোক ভাবছে।
মনোরমা বলল, “জানেন, আমার জন্যে বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কও তুলে দিয়েছে ও।” গোলোক ভাবল, মনোরমার আঁকড়ে ধরার অবলম্বন আছে।
মনোরমা বলছে, “কারণ কী জানেন?”
গোলোক ভাবছে, আমার এমন অবলম্বন কই?
“শাশুড়ি ওকে আবার বিয়ে করতে বলেছিল। বিয়ে করলে অবশ্য একটা অবলম্বন হত। তাইতে বাবুর কী রাগ!”
: হ্যাঁ, বিয়ে করতে পারলে-
“রাগ করে, ঝগড়া করে বেরিয়েই এল বাড়ি থেকে—”
: সংসারের দায়িত্ব নিতে পারলে—
“তারপর আমায় নিয়ে সংসার পাতল। কত কীর্তিই না হল।
: হয়তো এই জড়ত্ব কাটত–বিষণ্নতার অবসান হত-
“আমি কতবার ওকে বলেছি—”
: মনোরমা তো আমার চেয়েও বেশি ভুগেছে—
“আমার জন্যে সকলকে ছাড়ছ কেন?”
: তবু তো সে কেমন সংসার পেতে বসেছে—
“বলে কী জানেন, বলে, ও-কথা বোলো না, তোমাকে ওরা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায়, আমার সব সুখ তোমাকে ঘিরে।”
: সত্যি কত সুখী এরা—
“বুঝুন, এমন স্বামী কজনের হয়—”
: খুব সুখী এরা-
“পাখি যেমন তার ডানা দিয়ে অসহায় বাচ্চাকে ঘিরে রাখে, আপনাদের মিঃ মল্লিকও তেমনিভাবেই আমাকে ঘিরে রেখেছেন।”
: বিয়ে করলে আমিও–
“কী জানেন গোলোকবাবু- ”
: আমিও কি সুখী হতাম-
“ও গোলোকবাবু!”
: হয়তো হতাম, হয়তো না-
“আরে বাঃ, বেশ লোক তো, ও গোলোকবাবু–” বেশ জোরেই ডেকে উঠল মনোরমা।
“অ্যাঁ—” ডাকটা কানে যেতেই গোলোক সাড়া দিল। এতক্ষণ খুব দূর থেকে তাকে যেন কেউ ডাকছিল। এবার সে কানের কাছে মুখ এনে বুঝি চেঁচিয়েছে। গোলোক চমকে উঠল। দেখল মনোরমা খিলখিল করে হাসছে।
“বাঃ বাঃ, বেশ লোক, আমি এদিকে বকে মরছি আর উনি দিব্যি ঘুমুচ্ছেন।”
“না না,” গোলোক অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “আমি আপনার কথাই শুনছিলাম তো।”
“থাক আর মিথ্যে কথা বলতে হবে না।”
“সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন, ঘুমোই নি আমি।”
“তবে নিশ্চয়ই কারও ধ্যান করছিলেন। নইলে মানুষ এত অসাড় হয়ে যায়? কানের কাছে ঢাক-ঢোল পিটলেও সাড়া মেলে না।” মনোরমা হাসতে লাগল। অকস্মাৎ অন্তরঙ্গ কৌতূহলে সে প্রশ্ন করে বসল, “কার কথা ভাবছিলেন, বলুন না!”
গোলোক বিষাদ-ভরা দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। চোখে চোখ রেখে সোজা। তারপর তেমনিভাবে চেয়েই বলল, “আপনি কি বলতে চাইছেন জানিনে, তবে আপনাকে সত্যি কথাই বলছি, বিশ্বাস করুন, তন্ময় হয়ে ভাবার মতো কেউ এখন আমার নেই!” গোলোক লক্ষ করল তার মনে ঝর্নার নামটা এসে পড়েছিল। তাই হয়তো সে তার স্বীকারোক্তির সঙ্গে ‘এখন’ কথাটা জুড়ে দিল।
গোলোক দেখল, তার কথা শুনতে শুনতে মনোরমার চোখেও বিষাদের ছায়া ঘনিয়ে এল আর সেই সময়ই গোলোকের মনে হল মনোরমার চোখ দুটো কত সুন্দর। এত গভীর, এত অতল চোখ সে আর আগে দেখেনি। এখানে নির্ভয়ে আশ্রয় নেওয়া যায়।
মনোরমা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কথা বলতে গিয়ে দেখল, গলাটা তার ধরে গেছে। একটু কেসে গলাটা সাফ করে নিল মনোরমা। বলল, “আপনার কে আছেন গোলোকবাবু?”
গোলোকের অনেকদিন পরে বাড়ির কথা মনে পড়ল। আশ্চর্য, সে প্রায় ভুলতেই বসেছিল।
বলল, “দাদা আর বৌদি।”
“তবে বাড়িতে কেন থাকেন না? আপনার তো আর শাশুড়ি নেই।”
মনোরমার এই সরল বিদ্রূপে গোলোক একটু হেসেই আবার গম্ভীর হয়ে গেল। জবাব দিল না।
মনোরমা তিক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, “বুঝেছি।” তারপর আবেগে অস্থির হয়ে উঠল, উত্তেজিত হল। বলল, “মুখে ওরা যতই বলুক আমরা সেরে উঠেছি, একেবারে ভাল হয়ে গেছি, কিন্তু মনে মনে ওরা তা মানে না। ওরা ভাবে ভাল আমরা হইনি, কখনোই হব না। তাই আমাদের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতে চায়। আমি বুঝি, সব বুঝি। তাই কোনও সংসারে আমাদের আশ্রয় মেলে না।
মনোরমার চোখ জলে ভরে উঠল।
“আমার স্বামী অস্বাভাবিক মানুষ, হ্যাঁ অস্বাভাবিকই বলব। আমার শাশুড়ি, আপনার দাদা-বৌদি যদি স্বাভাবিক মানুষের নমুনা হয়, তবে আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, মিঃ মল্লিক একজন অস্বাভাবিক ব্যক্তি, নয় কি বলুন? তাই আমি আশ্রয় পেয়েছি। তবু একটা নিজের সংসার গড়ে নিয়েছি। না হলে আমার অবস্থা কী হত ভেবে দেখুন তো। উনি আবার বিয়ে করতেন। ঈশ্বরের ইচ্ছায় টাকার খুব একটা অভাব নেই ওঁর। আমাকে সারাজীবন ভাল স্যানাটরিয়ামে থাকার মাসোহারা ঠিক জুগিয়ে যেতেন। শাশুড়িরা এই সব পরামর্শই ওঁকে দিয়েছিলেন। ওনার মতো লোক বলে তাই সে-সব পরামর্শে কান দেননি। রাগ করেছেন বাড়ির লোকের ওপর। আমাকে নিয়ে এই নিভৃতে যেন পালিয়েই এসেছেন।”
মনোরমা হাঁফ নেবার জন্য থামল। কিছুক্ষণ অন্য দিকে চেয়ে রইল। বুঝি একটুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
তারপর যেন আপন মনেই বলে উঠল, “আমার ভয় কোথায় জানেন? আমার আশঙ্কা হয়, আমি যে সেরে উঠেছি, সত্যি সেরে উঠেছি একথা হয়তো উনিও বিশ্বাস করেন না।”
গোলোক চমকে উঠল। মনোরমার দিকে চেয়ে দেখল, সে মুখ ফিরিয়ে দূর আকাশে চোখ মেলে বসে আছে। এই সেই চেহারা, প্রথম দিন জানালা খুলে যার দিকে গোলোকের নজর পড়েছিল। এ যে যক্ষ্মা হাসপাতালের মেয়াদি রোগী, এখন আর তাতে একটুও ভুল হয় না। এমন অনেক দেখেছে গোলোক। সেখানে নিস্পৃহভাবে দেখত গোলোক, এখন আর তেমন নিস্পৃহ থাকতে পারল না। মনোরমাকে সান্ত্বনা দিতে মন চাইল।
বলল, “এ-আশঙ্কার কোনও ভিত্তি নেই, মিসেস মল্লিক।”
“হয়তো তাই,” মনোরমা উত্তর দিল। তারপর গোলোকের দিকে ফিরে বলল, “কিন্তু না, মিসেস মল্লিক-টল্লিক নয়, মনোরমা, সোজাসুজি মনোরমা বলবেন। এ-জগতে অন্যের চাইতে আপনি আমার আপন। কারণ, আমরা একই যন্ত্রণার ভাগী। আমরা দুজনেই পতিত। সেই সম্পর্কে আমিও সমানভাবেই আপনার আপনজন।”
খুব সুন্দর করে বলতে পারে মনোরমা। গোলোক আশ্চর্য হয়ে গেল। তার মনের অনেক চাপা অশান্তি এই সময়টুকুর মধ্যেই দূর করে দিল মনোরমা। গোলোক দেখল মনোরমাও অনেক শান্ত হয়ে এসেছে। তার শ্রান্ত মুখ-চোখে খুশির আভা ছড়িয়ে পড়েছে।
মৃদু হেসে বলল, “আজ যত কথা বললাম, এত বুঝি গোটা জীবনেও বলিনি। উনি জানতে পারলে ভড়কে যাবেন। ওঁর ধারণা সামান্য পরিশ্রম হলেই বুঝি রোগটা রিল্যাপস করবে।”