এই দাহ – ১

মনোরমা তার দেহটা আমাকে দিয়েছিল। মনোরমা ভালবাসা দিয়েছিল তার স্বামীকে। 

এখন রাত কত? 
যতই হোক না, জেনে এমন কী লাভ হবে তোমার? তার চেয়ে লেখাটা শেষ করে ফ্যালো গোলোক। সময় খুব বেশি নেই। 

মনোরমার এত নিবিড় সান্নিধ্যে এসে, এত ঘনিষ্ঠ হয়েও আমি বুঝতে পারিনি, এক মুহূর্তের জন্যেও টের পাইনি, মনোরমা অকাতরে শুধু তার দেহটাই বিলিয়ে দিয়েছিল আমাকে। অথচ তার মন, তার প্রেম, কৃপণের ধনের মতো সঞ্চয় করে রেখেছে তার স্বামীর জন্য। শুধু স্বামীর জন্য। 

যখন টের পেলাম, তখন, তৎক্ষণাৎ কেমন যেন হীন মনে হল নিজেকে। যেন অনধিকার প্রবেশ করেছি মনোরমার দেহে। নিজের দিকে নজর পড়ল আমার। ঠাণ্ডা চোখে মনোরমাকে দেখতে চেষ্টা করলাম। প্রচলিত আইন-কানুন, সংস্কার, পাপ-পুণ্য দিয়ে গড়া পৃথিবীটা জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠল আমার বুদ্ধি-বিবেচনায়। লজ্জায় ঘৃণায় অনুশোচনায় যেন আমার মাথাটা মাটিতে মিশে গেল। নিজেকে লুকিয়ে ফেললাম। পারলে নিজের কাছ থেকেও আড়াল করে রাখতাম। 

এই আজ যেমন রেখেছ? ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে? টেবিলের ওপর ঐ শিশিটা কিসের গোলোক? মাঝে মাঝে যেটাকে নাকের কাছে এনে ধরছ? শুঁকছ? 

ওটা ক্লোরোফর্মের শিশি। বিকেলে ফার্মেসি থেকে কিনে এনেছি। বন্ধু এক ডাক্তারের সই জাল করে। শক্ত করে ছিপি আঁটা আছে। তাই গন্ধ নাকে ঢুকছে না। সময় আসুক তখন ওর ছিপি খুলব। তখন ওটা কাজে লাগবে। ও তো মানুষ নয়, শিশি। যখন-তখন ওর সংযমের ছিপি আলগা হয় না। 

মানুষ প্রবৃত্তির দাস। কথাটা নতুন নয়। বহুবার শুনেছে গোলোক। কিন্তু মানেটা আগে বোঝেনি। কারণ প্রবৃত্তি কাকে বলে জানত না। মনোরমাকে চেনবার আগে এসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এমন কি মনোরমা আর সে যে একই বাসার বাসিন্দা গোলোক তাও জানত না। কোনও দিকে চেয়ে তো দেখত না সে, নিজেকে নিয়েই মগ্ন ছিল। 

এমনিতেই সে কুনো প্রকৃতির। তারপর যক্ষ্মায় ভূগে সে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। দেড় বছর হাসপাতালে ছিল। চিকিৎসার খরচ নিয়মিত জুগিয়েছেন তার দাদা। আরও টাকা পাঠিয়েছেন। এখনও পাঠান। নিয়মিত চিঠি লিখেছেন। এখনও লেখেন। গোলোককে কত উৎসাহ দিয়েছেন। এখনও দিচ্ছেন। গোলোক যেন হতাশ না হয়। যক্ষ্মাকে ভয় করার কিছুই নেই। ম্যালেরিয়ার চাইতেও যক্ষ্মার ধার কমে গেছে আজকাল। 

কিন্তু দেড় বছরের মধ্যে সেই ভর্তি করাতে যা একদিন এসেছিলেন তার দাদা। আর না। না, গোলোক তার দাদাকে দোষ দেয় না। বরং মনে মনে হাসে। বিশেষ করে, তার খালাস হবার দিন যত এগিয়ে এসেছে, ততই তার দাদাকে তার স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বিগ্ন হতে দেখেছে গোলোক। গোলোক যেন এখন দিন কতক কোনও স্বাস্থ্যকর জায়গায় গিয়ে থাকে। এই ঘিঞ্জি কলকাতায়, যেখানে নির্মল বায়ু এক ফোঁটাও নেই, খালি ধোঁয়া আর আবিলতা, সেখানে এখন আসবার দরকার কী গোলোকের? বারবার তার দাদা চিঠি দিয়েছেন। 

বরং গোলোক ছবি আঁকার কাজে এবার মনপ্রাণ ঢেলে দিক না। ভাল ভাল জায়গায় গিয়ে থাকুক, প্রাণ ভরে নিজের কাজ করুক গোলোক, এই তার দাদা চায়। টাকার জন্য একটুও যেন চিন্তা না করে গোলোক। ভাইকে একেবারে নর্মাল করে তুলতে যত টাকা লাগে তার জন্য দাদা যে পরোয়া করেন না, সে-কথাও বারবার তাকে জানিয়েছেন দাদা। গোলোকের হাসি পেয়েছে। আরও অনেকের চিঠি পেত গোলোক। প্রথম প্রথম অনেকেই উদ্বেগ দেখাত। চিঠি লিখত। সহপাঠীরা লিখত। ঝর্নাও। সে কাউকে জবাব দিত না। 

হাসপাতাল থেকে গোলোকের দাদার বাসা মাত্র আড়াই ঘন্টার পথ। সেই পথ পাড়ি মেরে চিঠি এসেছে, টাকা এসেছে। প্রয়োজনের বেশি টাকাই এসেছে গোলোকের দাদার কাছ থেকে। না চাইতেই এসেছে। কিন্তু দাদা আসেনি। বৌদিও না। গোলোক মনে মনে হেসেছে। 

স্যানাটোরিয়ামে গেল না গোলোক। একখানা ঘর ভাড়া নিল টালিগঞ্জের খালের ধারে। বেশ নির্জন। বেশ খোলামেলা। তার ফ্ল্যাটটাই শুধু একখানা ঘরের। হাতের ওপর ঘর। বেশ বড়। 

দাদাকে লিখল, নিরিবিলিতে কাজ করতে চায়, তাই সে এখানে বাসা নিয়েছে। দাদার বাসা থেকে দেড় ঘন্টার পথ এখন। তাই আরও তাড়াতাড়ি জবাব এল। টাকা এল। কিছুমাত্র অসুবিধে হলেই যেন গোলোক লিখে জানায়। নম্যাল লাইফে ফিরে আসছে গোলোক, এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই তার দাদার কাছে। 

হাসপাতালের ডাক্তারবাবুও এমনি আশ্বাস দিয়েছিলেন। —এই দেখুন মশাই এক্সরে-র ছবি, একেবারে ক্লিয়ার। এই স্পুটামের রিপোর্ট দেখুন, অ্যাবসলিউটলি ফ্রি। আর এই দেখুন ব্লাড রিপোর্ট, নেগেটিভ। একেবারে সেরে গেছেন মশাই। এখন যান, নম্যাল লাইফ লিড করুন। নাউ চিয়ার আপ। 

এই দেড় বছরে যা করেনি, গোলোক দুম করে তা-ই করে বসল। এতদিন সে খানিকটা উদাসীনভাবেই থেকেছে। উপযাচক হয়ে কোনও প্রশ্নই করেনি। কিছু জানতে চায়নি। খুঁৎ খুঁৎ করেনি। 

এই প্রথম আচমকা এক প্রশ্ন করে বসল, “বিয়ে করতে পারব?” 

“বিয়ে!” লোকটা যে কথা বলতে জানে, ডাক্তারবাবু যেন এই প্রথম তার পরিচয় পেলেন। একটু হকচকিয়ে গেলেন। মেট্রন মুখ ফিরিয়ে হাসি চাপলেন। 

“বিয়ে? ও অফকোর্স। তবে কেয়ার নিয়ে চলবেন, ডোন্ট গো ফাস্ট। ‘ ডাক্তারবাবু আর মেট্রন হেসে উঠলেন। 

মেট্রন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী, পাত্রী ঠিক হয়েছে নাকি! 

গোলোক আর দ্বিতীয় কথা বলেনি সেদিন। 

গোলোক তার ঘরে টাঙানো আয়নায় দাড়ি কামাচ্ছিল। কামাতে কামাতে কথাটা মনে পড়ায় হেসে ফেলল। একা, একেবারে একা থাকতে খারাপ লাগে না তো। গোলোক কিছুতেই মনে করতে পারল না, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার সময় বিয়ের কথাটাই বা হঠাৎ কেন তুলেছিল। পাত্রী ঠিক আছে না কি? কার কথা মনে পড়েছিল তখন। ঝর্নার? পাগল! ডোন্ট গো ফাস্ট! হুঁ! এক পাও কোথাও নড়তে চায় না গোলোক। 

আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, এই ঘরের বাইরেও জীবন আছে। আমি এখানে নিজের কাজ প্রথম থেকে নিজেই করতাম। নিজের কাজ মানে ছবি আঁকা নয়, ঘরকন্নার কাজ। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সব। কুকার ছিল, রাঁধতাম। বাসন ধুতাম। ঘর সাফ করতাম। বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, জামা-কাপড়-গেঞ্জি-আন্ডারওয়ার নিত্য সাবান দিয়ে কাচতাম। কী পরিষ্কার আমার হাতের কাজ। কোথাও সামান্য একটু ময়লা, একটু নোংরাও লেগে থাকত না। একবারের কাজ দু’বার করে করতাম। এসব কাজ আমার খুব ভাল লাগত। এমন অনেকদিন গেছে বইয়ের একটা পাতাও পড়িনি। রঙ তুলি ক্যানভাস বেরই করিনি বাক্স থেকে। শুধু ঘরকন্নার কাজ করেছি। সারাদিন শুধু ঝাড়া-পোছ করেছি। পরিষ্কার করে রেখেছি ঘরখানাকে। 

এতই যদি পরিষ্কার থাকার ঝোঁক তোমার, তবে নিজেকে সাফ রাখতে পারলে না কেন, গোলোক? 

ঘরের তো প্রাণ নেই। আসবাব, তৈজসের তো প্রাণ নেই, তাই হয়তো ওদের পরিষ্কার রাখা সহজ। কিম্বা আমার হয়তো সেই একচক্ষু হরিণের মতো অবস্থা হয়েছিল। তাই সব নজরটা ঘর, আসবাব আর তেজসের উপরই দিয়েছিলাম। একদণ্ড সুস্থির থাকতাম না তো। সব সময় কাজ নিয়ে থাকতাম। আমাকে সে সময় নম্যাল হবার বাতিকে পেয়েছিল। আর এসব জিনিসপত্রকে খুব ভালবাসতাম। এরা আমার ছোঁয়াচ এড়িয়ে চলত না। আমার স্পর্শ পেলে খুশি হত! ওরা আমার কাছে কাছে, আমাকে ঘিরে ঘিরে থাকত। দূরে দাঁড়িয়ে, তফাতে থেকে উৎসাহ দিত না। 

নিজেকে নিয়েই মত্ত ছিলাম। আমার বন্ধু বলতেও আমি, শত্রু বলতেও আমি। যেন আমার বাইরে পৃথিবী নেই। আমার আগেও কিছু নেই, পরেও কিছু নেই। এমনকি আমার যে একদিন যক্ষ্মা হয়েছিল, হাসপাতালে ছিলাম, সেরে উঠে এই বাসা নিয়েছি, সে-সবও প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। এমন সময়, বাজারের পথে একদিন সত্যব্রতের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সত্য আমার আর্ট কলেজের বন্ধু ছিল। তখন এমন দিনও গেছে, একই পেয়ালায় চুমুক দিয়ে দুজনে চা খেয়েছি। এতদিনে পরে সেই সত্যর সঙ্গে দেখা। 

হাসপাতালে ভর্তির দিন দাদার মুখ দেখেছিলাম, আর তার পরে এই সত্যর মুখ দেখলাম। এই আড়াই বছরে আর পরিচিত কারও মুখ দেখিনি। ওই মাঝে মাঝে যখন বাজারে আসতাম, তখনই যা মানুষের মুখ দেখতাম —আর কখনও-সখনও বারান্দায় এসে দাঁড়ালে, পথে খাল-ধারে, বাড়ির হাতে লোকের সাক্ষাৎ পেতাম। কিন্তু যেহেতু তারা আমার পরিচিত কেউ নয়, তাই তাদের অস্তিত্ব আমার কাছে কখনোই স্পষ্ট ওঠেনি। 

সত্যব্রতের সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্র বুঝলাম, আমি ছাড়াও জগৎ আছে। আমার একটা অতীত আছে। ইতিহাস আছে। পুরনো একটা চেনা জগৎ আছে। কথাটা মনে পড়তেই আমার মনের স্বস্তি চিড় খেল। 

সত্যব্রতের হাতে অনেক কাজ। তবু সে অনেকক্ষণ গল্প করল। আমার শরীর ভাল হয়েছে, গায়ের রং ফর্সা হয়েছে, আগের চেয়ে মোটা হয়েছি, বলল। বারবার বলল, টি. বি. সম্পর্কে নানা ফস্ ধারণা আছে আমাদের, আজকাল টি. বি. কিওরেবল। একটু সাবধানে থাকতে হয়, এই যা। হ্যাঁ, আর জানাল ঝর্নার বিয়ে হয়ে গেছে। লভ ম্যারেজ। সত্যব্রত বলল, তোর পরে আমাদের বঙ্কিম ওকে পড়াত। তার সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে ঝর্না। 

তুমিও তো ঝর্নাকে পড়াতে গোলোক? বছর চারেক পড়িয়েছিলে না?

সত্যব্রত চলে গেল। এককালে খুব চা-খোর ছিল সত্যব্রত। এখন নাকি রেস্টুরেন্টে আর চা খায় না। বড্ড আরিলায়েবল এই সব দোকানগুলো। কাপ-ডিশ ভাল করে ধোয় না। একজনের জার্মস আর একজনের মুখে ঢুকতে কতক্ষণ! 

সেইদিন থেকে বাইরে যাওয়া একেবারে ছেড়ে দিলাম আমি। একটা ঠিকে ঝি রাখলাম। ধীরে ধীরে ঘরকন্নার ভারও তার হাতে তুলে দিলাম। ঝিটাই আমার কাজকর্ম সব সেরে দিত। শেষে কোনও কাজ আর নিজে করতাম না। 

কেন না জোর পেতাম না। উৎসাহ পেতাম না। এতদিন যে কিসের ঝোঁকে এই ঘর, এই পরিবেশ আর আমি এক হয়ে গিয়েছিলাম জানি না। এখন আমাদের সে-সম্পর্কে চিড় খেয়ে গেল। 

সেদিন সত্যব্রতের সঙ্গে দেখা হবার পর গোলোক বাসায় ফিরেছিল অদ্ভুত একটা অস্বস্তি নিয়ে। কী কারণে যে এই অস্বস্তির উৎপত্তি হল, সে বুঝতে পারছিল না। সে কি তবে সত্যব্রতর সঙ্গে নিজের তুলনা করছিল? সত্যব্রত সাধারণ মানুষ। তার সঙ্গে দেখা হলে কত প্রসঙ্গ তোলে তার পরিচিত বন্ধুরা, কিন্তু কখনও এ-কথা কেউ তাকে বলবে কি, কী হে, তুমি তো বেশ নম্যাল হয়ে গেছ। আর কী, এখন আর-পাঁচজনের মতোই জীবন কাটাতে পারবে। 

একথার মানে কি গোলোক বোঝে না? এত সন্দেহ এরা তাকে করে কেন? এত উদ্বেগ তার জন্য দেখায় কেন? গোলোকের স্পুটাম ফ্রি, চেক্ট ক্লিয়ার, ব্লাড রিপোর্ট নম্যাল। গোলোক জানে এ সংবাদে সবাই খুশি হবে। কিন্তু সে খুশির তলায় একটা সন্দেহও পুষে রাখবে। সত্যব্রত যতই বিশ্বাস করুক, গোলোক একেবারে সেরে গেছে, তবু যে-কাপে চা খাবে গোলোক, সত্য সেটাকে সন্দেহ করবে। সে-কাপে মুখ দিতে ভয় পাবে। সত্যব্রতকে লোকে ভাল বলবে, মন্দ বলবে, কিন্তু সে যে নমাল, এ কথা কেউ শোনাবে না। 

গোলোকের অস্বস্তি লাগতে লাগল। খাল-ধারের জানালা খুলে দিল। মেঘে ঢাকা বিবর্ণ এক কলকাতার বিকেল তার চোখে পড়ল। যেন বরফ চাপা দেওয়া বাসী মাছের চোখ। তেতলার দূরত্ব থেকে সে দেখতে লাগল, দুটো লোক ঝগড়া করছে। একটা আধাবয়সী মেয়ে জলের ধারে উবু হয়ে বসে ঘোমটা টেনে প্রাকৃতিক কৃত্য সমাপন করছে। গোটা-চারেক দাঁড়কাক কিসের উপর জটলা করছে। 

দৃষ্টিটা একটু অন্যদিকে ফিরাতেই দোতলা ফ্ল্যাটের বারান্দা তার চোখে পড়ল। শৌখীন লতা, ফুল দিয়ে সাজানো বারান্দার ফালিটা এই প্রথম তার নজরে পড়ল। সবুজ রঙের বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে একটি মেয়ে বসে আছে। ভাল স্বাস্থ্য, সুন্দর চেহারা, তবু যেন নিঃস্ব। গোলোকের তৎক্ষণাৎ মনে হল, এ-বুঝি যক্ষ্মা হাসপাতালের ফিমেল ওয়ার্ডেরই কোনও রোগী। এমন মুখ হাসপাতালে অনেক দেখেছে গোলোক। এখন ও বোধহয় নম্যাল হয়ে ফিরে এসেছে। গোলোক মনে মনে হাসল। বিদ্রুপের হাসি। তারপর জানালাটা বন্ধ করে দিল। 

এক বছর এই বাসায় কাটিয়ে দিল গোলোক। তবু এ-বাড়িতে যে অন্য ভাড়াটে আছে, তা যেন এই প্রথম টের পেল। 

বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। নাঃ, কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। কোথায় যেন ক্ষীণ একটা শুলুনি দেখা দিয়েছে। স্থির থাকতে দিচ্ছে না। অন্যদিন সে এতক্ষণে কত কাজ করে ফেলত। কিছু না করলেও চা বানাতে অন্তত বসত। আজ সে অসহায়ভাবে শুধু সরঞ্জামগুলোর দিকে চেয়ে রইল। র‍্যাকের উপর কেটলি, হিটার, কাপ, ডিশ, কৌটো ভরা চা, চিনি, জমানো দুধ থরে থরে সাজানো আছে। 

কিন্তু ওগুলো আজ আর হাতছানি দিয়ে তুলতে পারল না তাকে। সে জানে উঠেও যখন সুখ পাবে না, তখন উঠে আর লাভ কী? প্রাণপণ চেষ্টায় সে চোখের পাতা দুটো বুজিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু অস্বস্তি যার সত্তায় কুটকুট করে কামড় মারতে শুরু করেছে, সে চোখ বুজে থাকে কী করে? 

গোলোক বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল। পায়চারি করতে লাগল ঘরে। ঘরখানা বেশ বড়। অনায়াসে দুখানা ঘর হতে পারে। হাতের ওপর ঘর। চারিদিক থেকে আলো আসে। অনায়াসেই একটা ভাল স্টুডিও সে করতে পারে। কিন্তু তার কোনও চেষ্টাই করেনি গোলোক। অথচ হাসপাতালে যাবার আগের জীবনে তার কত সাধ ছিল। এমনি একখানা ঘরে সুন্দর একটা স্টুডিয়ো গড়ে তোলার। কিন্তু তখন তার দাদার এ বিষয়ে কোনও আগ্রহ ছিল না। বরং গোলোক জানে, এ-ইচ্ছা প্রকাশ করলে তার দাদা নাকই সিঁটকাত। এখন, গোলোক যাতে নম্যাল জীবন যাপন করতে পারে, তারই জন্য দাদা ছবি আঁকার পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু গোলোক খুশি হত, তার দাদা যদি কেরানিগিরি করবার নির্দেশ দিত। গোলোক যে টালিগঞ্জে এসে ছবি আঁকতে চায়, একথা শুনে দাদা সত্যিকারের খুশি হয়েছে। আর তার সুন্দরী বউ স্বস্তি পেয়েছে, গোলোক একবারও সে বাসার চৌকাঠ মাড়ায়নি দেখে। বৌদির পরামর্শেই দাদা নিয়মিত টাকা পাঠিয়ে যাচ্ছে, গোলোক তা জানে। এটা তার দূরে থাকার মজুরি। গোলোকের এক এক সময় মনে হয়, এ যেন ভয় দেখিয়ে টাকা নেওয়া। সুন্দর এক ব্ল্যাকমেলিং। যেন তার দাদা বৌদি জানে, যে মুহূর্তে তারা টাকা দেওয়া বন্ধ করবে, সেই মুহূর্তেই গোলোক গিয়ে হাজির হবে বাসায়। তাই সে সম্ভাবনা বন্ধ করো, পাঠাও যত টাকা সে চায়। 

টাকার এখন আর অভাব নেই তার দাদার। ঠিকাদারির কল্যাণে তার এখন অঢেল রোজগার। আয়কর দেয়, বাড়ি গাড়ি এবং জীবনের জন্য ইন্সিওরেন্সের প্রিমিয়াম দেয়, স্যানিটারি নিরাপত্তার জন্য কর্পোরেশনের ট্যাক্স দেয়, ডাক্তারের ফি-ও দেয়। তেমনি গোলোকের খাতেও একটা খরচ দাদার বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে। 

তাই গোলোক জানে, চাইলেই এখন সে টাকা পায়। মন করলেই স্টুডিয়ো খাড়া করে তুলতে পারে। কিন্তু কেন? কিসের জন্য? 

গোলোকের মনে এক যন্ত্রণা তীব্রভাবে কামড় মারল। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সে একটানে জানালাটা আবার খুলে ফেলল। এখন খালধারে সে আর কাউকে দেখতে পেল না। কলহরত পুরুষ দুটো নেই, ঘোমটা-টানা সেই মেয়েলোকটা নেই, দাঁড়কাকের জটলাটাও নেই। আছে শুধু মেঘ-চাপা বিবর্ণ দিনের আলোটুকু। আর নীচে চেয়ে দেখল গোলোক, তেমনিভাবেই বসে আছে দোতলা ফ্ল্যাটের ফুল-লতায় সাজানো বারান্দায় সেই মহিলাটি। আগে যে-জায়গায় যে-ভঙ্গিতে বসে ছিল, এখনও সেইখানে তেমনি ভাবেই বসে আছে। একটুও নড়চড় হয়নি তার। যেন একটি মোমে গড়া মানুষের পূর্ণাবয়ব প্রতিমূর্তি। 

না, এতেও স্বস্তি পেল না। জানালাটা আবার বন্ধ করে দিতে যাবে, এমন সময় গোলোক দেখল, মেয়েটি নিস্পৃহ চোখ তুলে তার দিকে একবার চাইল। গোলোক কী জানি কেন জানালাটা বন্ধ করে দিতে গিয়েও দিল না। সে শুধু সরে এল। 

ও কি অসুস্থ? প্রশ্নটা একবার গোলোকের মনে ভেসে উঠেই তৎক্ষণাৎ তলিয়ে গেল। গোলোক আর কিছু না ভেবে চা তৈরি করায় মন দিল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *