1 of 2

এই এক নূতন! – সুকুমার সেন

এই এক নূতন! – সুকুমার সেন

শাক্যসিংহ সিদ্ধার্থ রণজিত হইয়া অর্থাৎ মারকে রণে জিতিয়া সবার্থে সিদ্ধিলাভ করিয়া সর্বসিদ্ধার্থ হইয়াছিলেন। তাঁহাকে শেষ সিদ্ধিলাভ করিতে এক একটি জন্ম পার হইতে হইয়াছিল। সে অবস্থায় তিনি বোধিসত্ত্ব ছিলেন। সব শেষে তিনি হইয়াছিলেন বোধিসত্ত্বতম। সেই বোধিসত্ত্বের বিভিন্ন জন্মের আশ্চর্য কীর্তিকাহিনী যাহা প্রাচীন পালি ও সংস্কৃত গ্রন্থে পাওয়া যায় তাহারই আধুনিক প্রতিচ্ছায়া রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় ও সিদ্ধার্থ ঘোষের এই সঙ্কলনের গল্পগুলিতে উপস্থাপিত হইয়াছে। ‘গোয়েন্দা আর গোয়েন্দা’ হাতাহাতি করিয়া আধুনিক বাঙালীর চিত্তকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করিয়াছে। এই তো নূতনের বাণী।

সঙ্কলয়িতা-দ্বয় ক্রাইম সাহিত্যে দক্ষ সমালোচক ও লেখক বলিয়া প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছেন। সুতরাং তাঁহাদের নির্বাচিত গল্পের যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বিচার করিবার কিছু নাই। ইঁহারা আরম্ভ করিয়াছেন ঊনবিংশ শতাব্দী ও ইংরেজ শাসনের গোড়া হইতে—ঠগী-ডাকাতির প্রথম প্রচেষ্টা হইতে, কিন্তু শাসনকার্যে কোন-না-কোন রকমে পুলিশী কায়দা আমাদের দেশে বৈদিক যুগ হইতে প্রচলিত ছিল—ঋগ্‌বেদে অর্বাচীন বেদে সংস্কৃতে প্রাকৃতে ও বাংলায় অর্থাৎ আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব দশম শতাব্দী হইতে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত। এই সব সাহিত্যে প্রাপ্ত গোয়েন্দা প্রসঙ্গ ও গল্পগুলির মধ্যে ভালো রচনার অভাব নাই। একটিমাত্র উদাহরণ দিব, অষ্টাদশ শতাব্দীর রচনা—বাংলায়। অত্যন্ত ছোট ও অত্যন্ত তীক্ষ্ণ গল্প। সংগ্রহ করিয়াছিলেন পাদরি উইলিয়ম কেরী (ছাপাইয়াছিলেন কিন্তু সে গ্রন্থ কোন কারণে প্রকাশিত হয় নাই।)

কেরীর ‘ইতিহাসমালা’য় গল্পটির কোন নাম নাই বলিয়া আমি নাম দিই ‘চতুর ডিটেকটিভগিরি’ (Clever Detection)। গল্পটি এই :

কোনো এক নগরে এক ঘাটের উপর এক ব্রাহ্মণ একশত টাকার তোড়া বস্ত্রে বান্ধিয়া স্নান করিতে জলে নামিলে পর ডুব দিয়া উঠিয়া দেখে আপন বস্ত্রে তঙ্কার তোড়া নাই। ইহাতে বড় দুঃখী হইয়া ঐ স্থানের বিচারকর্তার স্থানে নিবেদন করিলে তিনি আপন অন্তঃকরণে বিবেচনা করিয়া আজ্ঞা দিলেন এবং পাঁচজন পেয়াদা ও দুইজন কোড়াবরদার তাহার সাথে দিয়া আজ্ঞা করিয়া দিলেন, “যে স্থানে ব্রাহ্মণ তঙ্কার তোড়া রাখিয়াছিলেন সে স্থানে পেয়াদারা ঘিরিয়া থাকহ এবং তথা কোড়া ক্ষেপণ করহ।” তারপরে তাহারা সেইমত করিলে যে সে টাকা লইয়াছে সে একজন ভারি জলবহা গোয়ালা সেই স্থানে আসিয়া বলিল যে, “তোমরা এই স্থানে কোড়া মারিলে কি তোমাদের টাকা পাইবা?” তখন পেয়াদারা বলিল, “আমরা টাকা পাইবার ফিকির করিতেছি তুই কিমতে জ্ঞাত হইলি।” এই কহিয়া তাহাকে কর্তার সাক্ষাৎ লইয়া প্রহার করিলে গোপ সে টাকা ফিরিয়া দিল।

এই কৌশলে তথাকার বিচারকর্তা বাঙ্গালি ব্রাহ্মণের হারানিয়া মুদ্রা দেওয়াইলে ব্রাহ্মণ বড়ই সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে আশীর্বাদ করিয়া প্রস্থান করিলেন।

গোয়েন্দা বলিতে দুই শ্রেণীর কর্মী বোঝায়। প্রথম বা উন্নত শ্রেণীর গোয়েন্দা হইল ডিটেকটিভ (সংস্কৃতে চৌরোদ্ধরণিক অথবা দৌঃসাধিক বা দুষ্মন, উর্দু-হিন্দি-বাংলায় দুশমন), দ্বিতীয় বা অবনত শ্রেণী হইল স্পাই (বৈদিকে স্পস্ অথবা স্পস, সংস্কৃতে চর, উর্দু-হিন্দি-বাংলায় যাসুস বা যাসু)। কালিদাসের কথায় প্রথম শ্রেণীর গোয়েন্দা হইল সূচক। আলোচ্য গ্রন্থখানিতে এই স্তরবিভাগের স্বীকৃতি থাকিলে হয়তো ভালো হইত।

তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে,·····
এসো সকল কর্ম-অবসানে
রঞ্জিত-সিদ্ধার্থ দানে।

৭-১১-৯০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *