এইবার যাই কোথায়!
মেজাজ কেন এমন হচ্ছে। রক্তে সব সময় যেন ‘গোরা ব্যান্ড’ বাজছে। সব অদৃশ্য কেউ একজন অর্ডার দিচ্ছে—’ফায়ার’! বাইরের ঘরে বসে এক গেলাস জল চাইলুম, ‘এক গেলাস জল দাও।’ পাঁচ মিনিট গেল, দশ মিনিট গেল। অন্দরমহলে কেউ শোনেনি। এরপর বোধহয় ‘রিলে’ হল। কাজের মহিলা আমার চটির ওপর দিয়ে দ্রুত ঘর মুছছিল। দশ বাড়ি কাজ। অত সময় নেই। স্রেফ টেনে দাও। সেলুনে দাড়ি কামাবার মতো। ডানদিকে জুলপির কাছে ক্ষুর বসাও ‘কাপ’ করে, মারো হড়কা টান। হাফ-রাউন্ড দাড়ির কাছে স্টপ। বাঁদিকে একই অ্যাকশান। এরপর চিবুকের তলায় দুটো আঙুলের আর্টিস্টিক ঊর্ধ্বে ঠেলা, গলনালি উন্মুক্ত। ক্ষুর-স্থাপন, ঝটিতি উলটো টান। কান কাটার মতো ঠোঁটের দুপাশে দুটো জবাই-টান। গোঁফ সাফ। ফুসকুড়ি-মুসকুড়ি দু-একটা যা ছিল এই ‘কুইক অ্যাকশানে’ উপড়ে গেল। রক্তাক্ত গালে এবড়ো-খেবড়ো ফটকিরি ঘর্ষণ। জ্বলতে জ্বলতে গৃহে প্রত্যাবর্তন।
‘ইনডিজেনাস মেথড অফ বিয়ার্ড ম্যানেজমেন্ট।’ ঘর মোছার পদ্ধতিও এক রকম। যা পড়ে আছে তার ওপর দিয়ে সপাটে ন্যাতো মেরে দাও। সদ্যোজাত শিশুটিকে মা মেঝেতে শুইয়ে রেখেছিলেন রোদে, তার ওপর দিয়ে ন্যাতা চলে গেল। যাই হোক, সে গিয়ে বলল, কাকাবাবু কী বলছে গো! সে-ও পুরোটা শোনেনি। শোনার সময় নেই। কেউ আজকাল পুরোটা শোনে না। সবাই শোনাতে চায়।
রন্ধনশালা থেকে ভয়ংকরী মূর্তিতে গৃহিণী প্রকাশিত হলেন, ‘কী বলছ কী? এই তাড়াহুড়োর সময়?’
‘কিচ্ছু বলিনি।’
‘বলোনি তো বলোনি।’ সবেগে পাকশালায় প্রস্থান। ঝনঝন শব্দে বাসনের পতন। ক্ষিপ্ত বচন। পদাঘাত। নিরীহ একটি গেলাস পেনাল্টি এরিয়া থেকে গোলে ঢুকে গেল। গোলকিপার পুসি বাইরের ঘরে পালিয়ে এল। মারাদোনার ‘কিক’ আটকাবার মুরোদ তার নেই।’
ঘরের কোণে একটা আধপোড়া মালসা ছিল। মশা মারা ম্যাট নীল থেকে সাদা হয়ে গেলে ছোবড়া জ্বেলে সেই নিবু নিবু আগুনে ফেলা হয়। মশা মরে কিনা জানি না, মানুষ কাশতে কাশতে পালায়।
এত রাগ, সেই মালসা হাতে রাস্তার কলে। পাশেই পান-বিড়ির দোকান। এক সপ্তা আগেও কাকাবাবু বলত, আজ বলছে দাদু—’কী করছেন দাদু?’
‘দাদু’ বলায় রাগের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। কোনও উত্তর দিলুম না। তখন আমি রাগের গোলা। জল ভরে চুমুক দিতে যাচ্ছি। লাফিয়ে এসে সে বাধা দিলে, ‘কচ্ছেন কী! মরে যাবেন যে। কাঁপছেন কেন?’
‘দাদু’ বললেও ছেলেটি দরদি। পাশেই চায়ের দোকান। এক কাপ চা খাওয়ালে। রাগে ভাঁটা পড়ছে। অস্তিত্বের চরা জাগছে। ধীরে ধীরে বাড়ি ঢুকছি। হাতে পোড়া মালসা, যেন শ্মশানে রাত জেগে মহেশ্বর ফিরছেন। কানে এল, গৃহিণী বলছে, ‘যদ্দিন বাঁচবে, তদ্দিন জ্বালাবে।’
আবার চড়াক। ‘এইবার যাই কোথায়?’
চড়াক মানে রাগ চড়ে গেল। একটা ঘটনার কথা বলি। প্রেম করে বিয়ে হয়েছিল। প্রেমের মতো ব্রাত্য আর কিছু নেই। সেকালে নিষিদ্ধ মাংস খেলে, খ্রিশ্চান হলে বা যবনী-সঙ্গ করলে পতিত হত। সমাজচ্যুত হত। একঘরে হত। ধোপা-নাপিত বন্ধ হত। সেইরকম প্রেমিকাকে বিয়ে করলে—মায়ের মুখ তোলো হাঁড়ি। পিতা গম্ভীর। আত্মীয়-স্বজনের ছি-ছি—বিধু এটা তুমি কী করলে! প্রেমের বিয়েতে মেয়েদের তেমন সমস্যা নেই ছেলেটি যদি ভালো হয়। বাপ-মা বলবেন, ‘রেখার ক্যালি আছে বটে! দেখতে-শুনতে এমন আর কী—একটাকে খেলিয়ে তুলেছে তো!’
সেই রকম এক প্রেমের বিয়ে। সবাই পরিত্যাগ করেছে। প্রেমের বিয়েতে ফাটাফাটির সম্ভাবনা বেশি। প্রথমে একটু একটু, ছাড়া ছাড়া। তারপর বেশি বেশি, বাড়া বাড়া। তারপর মুখোমুখি হলেই ফ্যাঁস ফোঁস। আত্মীয়-স্বজনের কাছেও বলা যাবে না। তারা হ্যাহ্যা করে হাসবে আর বলবে—জেনে শুনে বিষ করেছ পান। একেই বলে, ‘কিল খেলে কিল হজম করা।’
সেই রকম একটা কেস। গৃহত্যাগ করে যাওয়ার জায়গা নেই। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। সোজা শ্বশুরবাড়িতে। তিন বছর হয়ে গেল। শ্যালিকার আদর যত্নে বেশ ভালো আছে। ইতিমধ্যে শ্বশুর, শাশুড়ি গৃহত্যাগ করে মেয়ের বাড়িতে এসে উঠেছেন।
শ্বশুরবাড়িটা বাপের বাড়ি হল, আর বাপের বাড়িটা শ্বশুরবাড়ি হল। সে না হল, আমার কী হবে! গৃহত্যাগ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। শ্বশুরবাড়ির পাট চুকে গেছে। দুজনেই ওপরে। আমার রাগের ওপর স্ত্রীর মোলায়েম কথার প্রলেপ পড়লে সব ভুলে যাই। ‘কথায় কথায় অত রেগে যাও কেন? তোমারও কেউ নেই, আমারও কেউ নেই। থাকার মধ্যে আমি আর তুমি, তুমি আর আমি।’
তখনই আমার বোধোদয় হয়। এই রাত। নির্জন পল্লি। শ্বাপদসংকুল এই পৃথিবী। সুখ-দু:খের সুটকেস হাতে আমরা দুজন রাত্রির যাত্রী। জীবনসাথী যদি আগেই নেমে যায়, বাকিটা পথ আমাকে তো একাই যেতে হবে।
নিজেই নিজের চৌকিদার হয়ে অন্তরের অন্দর মহলে চিৎকার করি—জাগতে রহো।