ঋত্বিকের প্রজেক্ট
গরমের দীর্ঘ দুপুর শেষ হবার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না যদিও এখন তিনটে। মুকুটের মনে হল একটা বিরতি নেওয়া দরকার। এশিয়াটিক সোসাইটির রিডিং রুমটাও ফার্নেস লাগছে। বারোটার একটু আগেই সে টেবিলে বসেছে। ঋত্বিকের আসার কথা ছিল অথচ এখনও তো এল না। যা কাজপাগল ছেলে! দেখো কোথায় কোন কাজে আটকে গেছে। সেইজন্যেই সে বাইরে কোথাও ‘মিট’ করবার ঝুঁকি নেয়নি। রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথাখারাপ হয়ে যাবে।
—ওই তো, ওই তো ঋত্বিক! হাতে হেলমেট, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছে না। এশিয়াটিকের রিডিং রুমটার সঙ্গে ওর সাক্ষাৎ-পরিচয় নেই। মুকুট উঠে দাঁড়াল। খাতাপত্রগুলো ফাইলের মধ্যে ভরে নিল, একটা হাত তুলে ঋত্বিককে দাঁড়াতে বলল। বই ফেরত দিয়ে, ঝোলাটা সংগ্রহ করতে করতে বলল, কী রে, তোর বাইকে চড়তে হবে না কি এখন? এই রোদ্দুরে?
—তা ছাড়া কী? আজকে তো সোজা বাইপাস, জায়গাটা তোকে দেখিয়ে আনি।
—সব ঠিকঠাক হয়ে গেল?
—সব হয়নি। প্রবলেমটা গিয়ে বলব।
—এই ঋত্বিক প্লিজ, পাশেই একটা রোল-এর দোকান আছে। ভীষণ খিদে পেয়েছে, সেই এগারোটায় বেরিয়েছি।
—নে। নিয়ে নে—ওখানে গিয়ে খাবি।
—না রে। তখন বিশ্রী হয়ে যাবে। একটু সময় দে…
পার্ক স্ট্রিট থেকে ইস্টার্ন বাইপাস নেহাত কম দূরত্ব নয়। তারপর শেষ দুপুর হলে হবে কী, গাড়িতে বাসেতে এখনও ছয়লাপ রাস্তাঘাট। এক এক দিন কপাল এমন খারাপ থাকে, পুরো একটা লাল করিডর দাঁড়িয়ে থাকে সারা পথ জুড়ে। তুমি যাও বঙ্গে লালও যায় সঙ্গে। সুতরাং ওয়ান ওয়ের ভুলভুলাইয়ায় ঘুরতে ঘুরতে ওরা যখন গন্তব্যস্থলে এসে পৌঁছোল, তখন আকাশজুড়ে কমলা আলো।
জমিটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভেতরে একটা ছোট পুকুর। একটা চালাঘর। গাছের মধ্যে, কটা নারকোলগাছ, কিছু দেশি আমগাছ, একটা শিশু, একটা তেঁতুল, বকুল আর দুটো মাঝারি শিরীষ গাছ রয়েছে, ছড়ানো, ছিটোনো৷ মুকুট বলল, এ তো অঢেল জায়গা রে! পুকুরটা নিশ্চয়ই বোজাবি না, বড় গাছগুলোও কাটাকাটি করবি না।
ঋত্বিক বলল, মাথা খারাপ? আমার অলরেডি ভাবা হয়ে গেছে পুকুরটাকে কীভাবে ব্যবহার করব। গাছগুলোর তলা বাঁধিয়ে দিয়ে, বেশ চাতাল মতো করে দিলে, সেখানে বসে ক্লাসও নেওয়া যাবে। ওই বকুলটা দেখ।
—শান্তিনিকেতন?
ঋত্বিক হাসল— বলল, শান্তিনিকেতন কে না গড়তে চায়, শান্তি গিয়ে অশান্তিতে না ঠেকে। যাক, চট করে দেখে নে, ঝপ করে অন্ধকার নেমে যাবে, এখানে এইসব আগাছাটাগাছার জন্যে বিশ্রী সব পোকা আছে, কামড়ে জান বার করে দেবে।
বাইরে বেরিয়ে উলটোদিকে ধাবাটা চোখে পড়ল মুকুটের। মাটির উঁচু চূড়োর মতন উনুন। তার ওপর বিরাট ডেকচিতে কিছু একটা চেপেছে। ওদিকে সর্দারজির পাগড়ি দেখা যাচ্ছে। ফেলে-রাখা বেঞ্চিগুলোর ওপর গোধূলির আলো পড়ে আছে। মুকুট বলল, চল ওখানে একটু বসা যাক। দুটো লস্যি অর্ডার দিয়ে বাইরের একটা বেঞ্চিতে বসল ওরা।
ঋত্বিক একটা অদ্ভুত ছেলে। কলকাতা মেডিকেল থেকে ডাক্তারি পাস করে এফ.আর.সি.এস করতে সে ইংল্যান্ডে যায় কিন্তু সেসব না করে সে সেখানে রেডক্রসের সঙ্গে জুটে যায়। মুকুট অ্যান্টি এডস প্রোগ্রামে ডাবলু.এইচ.ওর. সঙ্গে কাজ করতে করতে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, নরওয়ে হয়ে ইংল্যান্ডে গেলে একটা কনফারেন্সে ঋত্বিকের সঙ্গে আলাপ হয়। ঋত্বিক তখন ঠিকই করে ফেলেছে। রেডক্রস ছেড়ে দেবে, দেশে ফিরে আসবে এবং বাচ্চাদের জন্য কিছু কাজ করবে। মুকুটকে ও অনুরোধ করে ওর সঙ্গে যোগ দিতে। কর্নেল থেকে ডক্টরেট ডিগ্রিটা নিয়ে ডাবলু.এইচ.ওর. সাহায্যে পরিচালিত একটা সংস্থার কাজ নিয়েই মুকুট দেশে এসেছে। দেখে ঋত্বিক ঠিক এসে গেছে, তার যে কথা সেই কাজ। সে অনাথ বাচ্চাদের জন্য একটা প্রতিষ্ঠান খোলবার কাজে তখন মেতে।
একটা বাইক এসে থামল। কালো গগলস্ পরা, জিনস্ আর কালো টি-শার্ট পরা দুটো ছেলে। দেখে সর্দারজি যে রকম শশব্যস্ত হয়ে উঠল, তাতেই ওদের মনে হল এনারা স্থানীয় মস্তান হবেন। একজন বাইক থেকে নেমে সর্দারজিকে নিচু গলায় কীসব জিজ্ঞেস করল। অন্যজন বাইকে বসেই রইল। একটু পরেই রাস্তা কাঁপিয়ে চলে গেল দুজনে।
নিচু গলায় মুকুট বলল, কী রে! তোর শান্তিনিকেতনে এদের উৎপাত হবে না তো!
—আমিও ওই কথাই ভাবছিলাম। কনস্ট্রাকশন শুরু হলেই এসব মাল এসে যাবে। আমার ধারণা ছিল কাছাকাছি লোকালয় নেই, কাজেই… এখন দেখছি ধারণাটা ভুল, যেখানে গুড় সেখানেই মাছি। যাক গে, ওসব কনট্রাক্টর বুঝবে। ওরা জানে কাকে কী মন্ত্রে তুষ্ট রাখতে হয়। আমাদের ওর মধ্যে মাথা না গলালেও চলবে। নামটার কথা কিছু ভাবলি?
—ভেবেছি কয়েকটা। ‘সত্যকাম’ নামটা কেমন?
—সেই ‘অন্ধকার বনচ্ছায়ে সরস্বতী তীরে?’ শুনতে ভাল মুকুট, বুঝতে ভাল নয়।
—তা হলে যদি ‘জীবক’ দিস?
—ইনি কে বটেন?
—এঁকে তোর চেনা উচিত। শিশুচিকিৎসক ছিলেন। আড়াই হাজার বছর আগে। শল্যচিকিৎসা প্লাস্টিক সার্জারি এইসবে নাম করেন।
—তাই নাকি?
—আরও প্রাসঙ্গিকতা আছে ভদ্রলোকের। ওঁর জন্মপরিচয় জানা যায় না। বনের ধারে কাঠকুটো পাতাটাতার মধ্যে পড়েছিলেন। বাঁচবার কথা নয় তবু বেঁচেছিলেন তাই জীবক। খুব সম্ভব রাজগৃহের নটী শালবতীর ছেলে। মানুষ করেন বিম্বিসারের এক ছেলে। চারপাশে কাক ঘুরছিল। কিন্তু ঠোকরায়নি।
—সেই কুকুরগুলোর মতো? ডাস্টবিনে পড়ে থাকা একটা বাচ্চাকে পাহারা দিচ্ছিল।
—ঠিক বলেছিস। একজন ফিল্মস্টার বোধহয় দত্তক নিলেন।
—আশ্চর্য ব্যাপার দ্যাখ, কুকুরেরাই বাগে পেলে হাসপাতালের মেটার্নিটি ওয়ার্ড থেকে বাচ্চা টেনে নিয়ে যায়। আবার সেই কুকুরই… নাঃ, কুকুরের মতিগতিও মানুষের মতোই আনপ্রেডিক্টেবল।
মুকুট বলল, যা বলেছিস। ঠিক মানুষের মতো।
—জীবক, রিবক, সেবক…আওড়াতে আওড়াতে ঋত্বিক বলল, বড্ড কাঠ কাঠ শোনাচ্ছে না? তা ছাড়া যে কারণে ‘সত্যকাম’টা চাইছি না, সেই একই কারণ ‘জীবক’-এও এসেছে। আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেওয়া নটীর ছেলের পরিচয়টা সারাজীবন বয়ে বেড়াবার পক্ষে বড্ড ভারী নয়? যেখানেই যাবে বলবে ‘জীবক’ থেকে এসেছে, জীবক-এর রেসিডেন্ট।
—সে তো অন্য নাম দিলেও বলবে, অনাথ তো বটে!
—হ্যাঁ বলবে, কিন্তু ঠিক কাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে সেটা তো একটু অস্পষ্টও থাকবে! মায়ের জীবিকার পরিচয়ে সারাজীবন ওদের পরিচিত হতে হবে। দিস ইজ ভেরি আনজাস্ট। আচ্ছা, নামটা ‘রচনা’ দিলে কেমন হয়? মানুষ রচনা করা হচ্ছে। গড়বার চেষ্টা করা হচ্ছে!
—খারাপ না। একটা ও-কার লাগিয়ে দে তা হলে—‘রোচনা’।
—‘রোচনা’? শুনতে তো খুবই ভাল লাগছে। মানে কী?
—‘রোচনা’ মানে দীপ্তি, শোভা।
—থ্যাঙ্কস, মুকুট। এটাই থাক।
সামনে, আশেপাশে তাকালে কচুরিপানায় ভর্তি। লম্বা লম্বা ঘাসে আর আগাছায় ছাওয়া জলাজমিই বেশি দেখা যায় জায়গাটায়। দূরে দূরে কিছু নতুন বাড়ির খাঁচা। কনস্ট্রাকশন হচ্ছে। বাজি ফেলে বলা যায় আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এসব জায়গা কংক্রিটের জঙ্গল হয়ে যাবে। চারদিকে এখন ছড়ানো ঝুপড়ি, ন্যাংটা মাটি-মাখা বাচ্চাকাচ্চা। অপুষ্ট অর্ধনগ্ন এইসব পুরুষ-মহিলা পপুলেশন অচিরেই ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে যাবে। কোথায় যাবে? কোথায় যায় স্থানচ্যুত এইসব বাস্তুহীন? এদের কোনও দেশ নেই। প্রথমটা দেখা যাবে এইসব কনস্ট্রাকশনের ভাঁজে ভাঁজে বালির ঝুড়ি নিয়ে গাঁইতি শাবল নিয়ে ওঠানামা করছে ওরা। যতদিন কাজ চলবে ততদিন। তাতে এমন কিছু সংস্থান করে নিতে পারবে না। কোনও ভূখণ্ডে স্থায়ী আস্তানার কোনও প্রশ্নই নেই, নেই কোনও বিশেষ জীবিকা। পোকামাকড়ের মতো অনিশ্চিত, স্বল্পমেয়াদি জীবন। রাজনৈতিক দলগুলো ‘জনগণ’ ‘মানুষ’ এইসব গালভরা নামের গৌরবে ওদের ভূষিত করে থাকে ভোটের স্বার্থে, তারপর বাদলাপোকার মতো এ জীবনগুলো কবে কাবার হয়ে যায়, খোঁজ রাখবারও প্রয়োজন কেউ মনে করে না। পুরুষের পর পুরুষ বয়ে চলেছে এমনই। এদের জন্ম দেবার অধিকার কেউ নিয়ন্ত্রণ করে না। কিন্তু জাত শিশুর পালিত হবার অধিকারটাও যে থাকার কথা, কেউ ভাবে না। তারা খেতে পাবে না, খাটলে পিটুনি খাবে, ভাড়া খাটবে, বিক্রি হয়ে যাবে। তবু আইন হবে না পালন করার ক্ষমতা না থাকলে পৃথিবীতে শিশু আনা দণ্ডনীয় অপরাধ। আইন করলেও অবশ্য কিছু স্ত্রীলোকই ছেঁকে তোলা যাবে শুধু, যেন স্ত্রীলোকে পুরুষলোক ব্যতীত বাচ্চার জন্ম দিয়ে থাকে।
—কী যেন ভাবছিস? ঋত্বিক লস্যিতে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল।
—ধর তুই যদি তোর ‘রোচনা’য় এইসব বাচ্চাগুলোকেও নিতিস… দূরের দিকে হাত দেখাল মুকুট।
ঋত্বিক বলল, ওয়ান অ্যাট এ টাইম মাদমোয়াজেল। ওভাবে আবেগে সেন্টিমেন্টে কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে গেলে চলবে? তা ছাড়াও আমাদের কাজের গণ্ডিটা নির্ধারিত করছে অন্য একটা ফ্যাক্টর।
—কী?
—জমিটা হল একজন পতিতার। তিনি চান ‘পতিতা’দের বাচ্চাদের জন্যই জমিটা ব্যবহার হোক।
—তা হলে তো অন্য প্রশ্নই নেই। কে এই মহিলাটি?
—জনৈকা ললিতা দাসী। এক ব্যারিস্টার সাহেবের রক্ষিতা ছিলেন।
—ছিলেন। এখন?
—এখন সাহেব গত। মেমসাহেব বিগতযৌবনা। টাকাপয়সা বিষয়সম্পত্তির অভাব নেই। চ্যারিটিতে মন গেছে। স্বজাতির কল্যাণ চান।
—ভাল তো! তা তুই কি সেইজন্যেই আমায় চাইছিস?
ঋত্বিক মুখে একটা মজা-পাওয়া হাসি নিয়ে বলল, তোকে ইন এনি কেস চাইছি মুকুট, সেটা কি তুই জানিস না?
মুকুট বলল, রোম্যান্স মচাসনি, রোম্যান্স মচাসনি। আসল কথাটা বল।
ঋত্বিক বলল, ঠিক হ্যায় বাবা, কাজের কথাটা হল ঘটনাচক্রে সত্যকামদের নিয়েই যখন কাম, তখন তোর অভিজ্ঞতা তো কাজে লাগবেই। এখন একটা মুশকিল আসান কর দেখি।
—কী?
—এই ললিতা দাসী বোর্ডে থাকতে তো চাইছেনই। প্রেসিডেন্ট টেন্টও হতে চাইছেন বোর্ডের।
—বোর্ডে থাকতে অসুবিধে কী? আর প্রেসিডেন্ট তো উনি ইচ্ছে করলেই হতে পারবেন না। সেটাতে তো ভোটাভুটির ব্যাপার থাকছে।
—উনি হয়তো সেটাও অ্যারেঞ্জ করতে চাইছেন।
—কীভাবে?
—ওঁর চেনাশোনা অনেককে বোর্ডে ঢোকাতে বলছেন আর কি!
—ইউনিসেফ বোর্ডের কম্পোজিশনের ব্যাপারে কোনও শর্ত দেয়নি?
—দিয়েছে। একজন ফিল্ড-ওয়ার্কের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সোশ্যাল সায়েন্সের লোক চাই, সেখানে তোকে ভাবছি। একজন মেডিক্যাল বা প্যারামেডিক্যাল পার্সন, সেখানে আমি আসছি। একজন ‘মাদার’দের প্রতিনিধি চাই, সেখানে উনি ঢুকতে চাইছেন, যদিও উনি কোনও ‘মাদার’ নন; এ ছাড়া তিনজন যে কোনও শিক্ষিত দায়িত্বশীল নাগরিক হতে পারেন। এখন উনি চেয়ারপার্সন হলে এবং সঙ্গে ল্যাংবোট নিয়ে এলে আমি কাজ করতে পারব বলে মনে হয় না। ওঁকে আমি ছেড়েই দিতাম, কিন্তু তুই তো জানিস প্রথমে কিছু কাজ এবং কিছু নিজেদের খরচাপাতি, আর্থিক সামর্থ্য দেখাতে হয়, না হলে ইউনিসেফের ফান্ডও পাওয়া যায় না, প্রজেক্ট ইন্টারন্যাশনাল থেকেও কিছু পাওয়ার আশা বৃথা। আমার সঞ্চয় তো আমি সবটা ঢালছিই। কিন্তু এই ললিতা ম্যাডামের জমিটা আমাদের একটা বড় অ্যাসেট। এটাই আমার প্রোপজালের প্রধান অংশ। তুই এঁদের সাইকোলজি জানবি। অনেক ডিল করেছিস। দেখ না তুই যদি ব্যাপারটা একটু ম্যানেজ করতে পারিস।
—তা, তুই ওঁকে ডিটেইলস বলতে গেলি কেন?
—ঘোড়েল মহিলা ভাই, তুমি চল ডালে ডালে তো ইনি চলেন পাতায় পাতায়। ব্যারিস্টারের ব্যাপার। বুঝছ না! আমি খুব চিন্তায় আছি।
—চল। আজই চল তা হলে। কাল থেকে আবার পর পর তিনদিন আমার বউবাজারে কাজ। সময় পাব না।
—তা হলে দাঁড়া। একটা ফোন করি ওঁকে।
পার্ক সার্কাসে যে ফ্ল্যাটবাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা, সেটা অনেক দিনের। বেশ নামকরা। চরিত্রটাও বহুজাতিক। ওরা ঢুকতে ঢুকতেই দেখল একটা ওপেল অ্যাস্ট্রা বেরিয়ে যাচ্ছে। চালাচ্ছেন একজন সিন্ধি বা পার্শি ভদ্রলোক, পাশে যে মোঙ্গোলীয় মুখের মেমসাবটি বসে তিনি চিনা না কোরীয় বোঝা শক্ত। কয়েকজন হিপি ধরনের বিদেশি খালি গায়ে তাপ্পি-মারা শর্টস পরে বেরিয়ে গেল। লিফটে ওদের সঙ্গে উঠলেন একজন তামিল বা কেরলীয় ভদ্রলোক।
লিফটের গহ্বরটা ঝুলে ভর্তি। মুকুট বলল, ছিঁড়েটিঁড়ে পড়ে যাবে না তো? ঋত্বিক কাঁধ নাচাল। সহযাত্রী তামিলের কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। লিফটম্যান অবশ্য বিরক্ত চোখে চাইল। অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশীয় বা বিহারি দেখতে হলেও সে বাংলা বোঝে।
ললিতা দেবীর ফ্ল্যাটে অবশ্য রং-চটা কোনও জিনিসই নেই। বরং একটু বেশি চকচকে সবই। ওয়লপেপার দিয়ে মোড়া ঘর। মাস্টার্ড রঙের কার্পেট। হলুদ সোফা-সেট। তাতে নীল-লাল নানা রঙের কুশন। সামনের দেয়ালে আবার একটা বিরাট আয়না। যেখানেই বসুক, আয়নায় অতিথির প্রতিবিম্ব পড়বেই। সামনে আয়নায় নিজের ছবির সামনে বিশ্রী অস্বস্তি নিয়ে বসে থাকতে হয়।
বেশ একটু পরে ওদের পেছনের কোনও করিডর থেকেই আয়নায় ছায়া ফেলে এলেন ললিতা দেবী। অর্থাৎ নিজে যেমন অন্তরাল থেকে অতিথিদের দেখে নেবার সুযোগ নেন, অতিথিদেরও তেমনই নিজে আসার আগেই চেহারাটা দেখিয়ে দেন। বয়স তিয়াত্তর চুয়াত্তর তো নিশ্চয়ই হবে। সাদা চুল, মাশরুম কাট। মাঝারি উচ্চতার আধা-ফরসা মহিলা। কোনও সময়ে হয়তো সুন্দরী ছিলেন, এখন খুবই প্রসাধিত ও কেতাদুরস্ত। একটু মোটার দিকে গড়ন। সুরমা দেওয়া চোখের দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ।
ঋত্বিক বলল, ম্যাডাম এই হল মুকুট রায়, যার কথা আপনাকে বলেছিলাম। ওর বিদেশে বহু কাজের অভিজ্ঞতা আছে। জায়গাটা ওকে দেখিয়ে আনলাম।
উনি বললেন, নাম ঠিক হল?
—ভাবছি। এখনও ফাইন্যাল হয়নি।
এবার মুকুটের দিকে চাইলেন—পছন্দ হল? জায়গাটা?
—হ্যাঁ, খুব সুন্দর। শহর থেকে বেশি দূরে নয়। অথচ পরিবেশটা বেশ গ্রাম গ্রাম। যাতায়াতের অসুবিধে নেই।
—যাতায়াত? কেন? তোমরা ওখানে থাকবে না।
উনি ঋত্বিকের দিকে তাকালেন, তারপর মুকুটের দিকে।
—না, থাকব কেন? —মুকুট বলল, নিয়মিত দেখাশোনার জন্য সুপারিন্টেন্ডেন্ট, মেট্রন এসব ঠিক করতে হবে।
—বেশ কথা। আমি জনাকয়েক ছেলেমেয়ে ঠিক করে দেব এখন।
মুকুট বলল, আপনি কীরকম ছেলেমেয়ের কথা বলছেন জানি না। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞাপন দিয়ে সব ঠিক করতে হবে। নিয়মমাফিক।
—বাঃ —কর্কশ শোনাল ললিতা দেবীর গলা —তা হলে যাদের মঙ্গলের জন্য করা, তারাই কাজ পাবে না?
—ব্যাপারটা ঠিক তা নয় মাসিমা, আপনি যাঁদের কথা বলছেন দরখাস্ত করে যদি তাঁরা যোগ্য বোঝা যায় তো তাঁদেরও নিতে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু আমরা তো গ্র্যাজুয়েট, টিচার্স ট্রেনিং, মন্তেসরি ট্রেনিং, অন্যান্য কারিগরি ট্রেনিংও খুঁজব। আমি যদ্দূর জানি কোনও এন. জি. ও-ই এখনও পর্যন্ত সেরকম ব্যাচ বার করতে পারেনি। সে সময়টাই আসেনি এখনও।
—আমার চেনাপরিচিত কিছু সজ্জন আছেন, আমায় ভক্তি করেন, তাঁদের পরামর্শ আমাদের কাজে লাগবে। এঁরাও শিক্ষিত লোক তোমাদের জোগাড় করে দিতে পারবেন। তা ছাড়া ‘অ আ ক খ’ শেখাতে গ্র্যাজুয়েট, ট্রেনিংমেনিং দরকার হবে কেন, আমি বুঝি না।
মুকুট গ্র্যাজুয়েট ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা বোঝাবার জন্যে একটা বক্তৃতা আরম্ভ করতে যাবে, হঠাৎ ঋত্বিকের গলা শুনে সে থমকে গেল। ঋত্বিক বলছে, আপনার পছন্দমতো একটা প্রতিষ্ঠান তো আপনি ইচ্ছে করলে চালু করতেই পারেন। আপনার আদর্শ, আপনার ধারণামতো। সেক্ষেত্রে আমাদের কোনও দরকার আপনার থাকছে না। প্রজেক্ট ওয়ার্ক, গ্রান্টের টাকাপয়সার জন্য কাগজপত্র তৈরি… এসবও অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ চুপ। ললিতা দেবী হকচকিয়ে গেছেন। তাঁর চোখ ঋত্বিকের ওপর স্থির। একটু পরে উনি কেটে কেটে বললেন, তোমার কথা আমি বুঝলাম না বাছা।
—বোঝার কিছু নেই ম্যাডাম। শর্তসাপেক্ষে আপনার জমি আমি নিচ্ছি না। জমিটা দিলে পুরো ব্যাপারটাই আমাদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। ‘পতিতা’দের ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজটা করব, এই শর্তটুকু আমি মেনেছি। কিন্তু এরপর আপনার যদি কোনওরকম মালিকানার ইচ্ছে, কনট্রোল করবার ইচ্ছে থাকে, তা হলে জমিটা আপনি বরং দেবেন না। আমরা যদি ফান্ড আনতে পারি, তা হলে কাজটা করব একেবারে আমার মনের মতো করে, আমার পছন্দমতো লোক নিয়ে, আমার নিয়মে।
প্রত্যেকটা ‘আমার’-এর ওপর কড়া ঝোঁক দিয়ে ঋত্বিক কথা শেষ করল। ললিতা দেবীর মুখ লাল হয়ে গেছে, বেশ উত্তেজিত। বললেন, বেশ কথা। এই যে এত ভদ্র-সজ্জন ব্যক্তি স্কুল-হাসপাতাল এসবের জন্য জমি বাড়ি দান করছেন, সেখানে তাঁরা চেয়ার নিয়ে থাকছেন না? তাঁদের মা-ঠাকুমার নামে স্কুলটুল হচ্ছে না? খালি আমার বেলাই নিয়ম আলাদা হবে? জানি। বিনোদনী দাসীর টাকায় তৈরি হল কিছুতেই তাঁর নামে হতে দিলে না কেউ। তা সে না-হয় ছিল আগেকার দিনের কথা। এখনও…।
—আপনি ভুল করছেন। এই শর্তে আমরা তথাকথিত ভদ্র-সজ্জনের কাছ থেকেও জমি বা অন্য কিছু নেব না। আপনার কেস আলাদা কিছু না।
—আমি তো ভেবেছিলাম আমার দিদিমা নীহারিকা দাসীর নামে ইস্কুলটা হবে… নীহারিকা স্মৃতি। ধরো… তোমরা তো নাম খুঁজেও পাচ্ছ না!
—একটা নাম আমরা মোটামুটি ভেবে রেখেছি— মুকুট তাড়াতাড়ি বলল।
ঋত্বিক বলল, আপনার মা-দিদিমা এঁদের নামে প্লাক ওখানে রাখাই যায়। কিন্তু নীহারিকা স্মৃতিটৃতি আজকাল চলে না। …আর এটা তো শুধু স্কুলও নয়। নামটার কোনও অর্থই সেভাবে… বলতে বলতে ঋত্বিক উঠে দাঁড়াল।
একটি মেয়ে ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে ঢুকলেন। ললিতা দেবী বিমূঢ়ভাব কোনওক্রমে সামলে বললেন, একটু মিষ্টিমুখ করে যাও অন্তত, ও মেয়ে!
মুকুট একটা মিষ্টান্ন তুলে নিয়ে বলল, এই নিলাম, ঠিক আছে মাসিমা?
ঋত্বিক শুকনো গলায় বলল, আমায় ছেড়ে দিন প্লিজ। এমনিতেই আমার খুব অনিয়ম হয়ে যায়…
ললিতা দেবী তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছু বললেন না।
বাইরে বেরিয়ে মুকুট বলল, তুই তো যথেষ্ট কড়া লোক! আমায় নিয়ে যাওয়ার কোনও দরকারই ছিল না তোর।
ঋত্বিক বলল, সামহাউ তুই থাকাতে কথাগুলো বলবার জোর পেয়ে গেলাম। কেন, কীভাবে তা বলতে পারব না। মাইন্ড করলি?
—আমার একটু খারাপ লাগছিল। মহিলা বোধহয় চেয়ারপার্সন নীহারিকা স্মৃতি গোছের কিছু একটা হওয়ার আশা করছিলেন। ওইভাবে জাতে ওঠা আর কি! ব্যারিস্টার সাহেব ওঁকে সুখ, ঐশ্বর্য, বিলাসের বস্তু সবই দিয়েছেন। খালি কোনও সমাজ, সম্মান দিয়ে যাননি। তোরা বুঝিস না খুব করুণ ব্যাপারটা।
ঋত্বিকের ভুরু কুঁচকে ছিল। সে অধৈর্যভাবে স্টার্টারে লাথি মারছিল। বাইক স্টার্ট নিতেই বলল, বোস। তারপরে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল অফিস-ফেরত ভিড়ের রাস্তাঘাট মাড়িয়ে গুঁড়িয়ে। খুব রেগেছে।
মুকুটকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়েই চলে যাচ্ছিল। মুকুট বলল, শোন, এক কাপ কফি খেয়ে যা।
—ধুত! ঋত্বিক বলল, মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।
—খারাপ হয়ে যাবার কী আছে? ওঁর দিক থেকে একটু ভেবে দেখ।
—তোর সঙ্গে আমার মতে মিলবে না মুকুট। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। দান যদি স্বার্থের কথা ভেবে হয়, উদ্দেশ্যমূলক, তা হলে সে দান না করাই ভাল। সে কোনও পতিতাই তোক আর মহাত্মাই হোক। পতিতা বলে আহা উহু করতে থাকলে— কাজটা হবে না। ওভাবে কিছু হয় না।
মুকুট অবশ্য ঋত্বিকের হতাশাটা বুঝতে পারছিল। নিজের কেরিয়ারের কথা না ভেবে একটা পাস করা ডাক্তার সমাজের প্রতি দায়বোধে বাচ্চাদের জন্য কিছু করবার চেষ্টা করছে। তার ব্লু-প্রিন্ট তৈরি, ভাবনাচিন্তা করে প্রত্যেকটা ধাপ পার হচ্ছে। একটা অতি নগণ্য কারণে যদি এভাবে বাধা পড়ে! কিন্তু সে বলল, দেখ, ওঁর নিজের উচ্চাকাঙক্ষার কথা না হয় ছাড়। কিন্তু মেয়েদের কোনও বিকল্প ব্যবস্থার ভীষণ দরকার। হলে ভাল। উনি খারাপ কিছু বলেননি।
দু-তিন লাফে ওপরে উঠে এল ঋত্বিক। বেল-এর ওপর আঙুল রেখেছে। মুকুটের মা খুলে দিলেন। ওঁর দিকে আবছাভাবে চেয়ে একটা আনমনা হাসি দিল ঋত্বিক। তারপর বলল, মুকুট, যখন কোনও কাজ করবি তোকে আগে থেকে ঠিক করে নিতে হবে তুই কী চাইছিস। একেবারে ষোলোআনা পেশাদারি টেকনিক্যাল অ্যাকিউরেসির সঙ্গে। তোর টার্গেট এরিয়াটা কী? এটা খুব জরুরি।
মুকুটের মা হেসে বললেন, ঋত্বিক ভেতরে এসে তর্ক করো!
—ও হ্যাঁ, স্যরি মাসিমা —ঋত্বিক অন্যমনস্ক হাসল। তারপর কয়েক পা এগিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ে বলল, ধর এই ব্যাপারটায় তোর কাজটা কাদের নিয়ে? পতিতারা? না তাদের ছেলেমেয়েরা?
—ছেলেমেয়েরা অবভিয়াসলি।
—ঠিক আছে। তোর টার্গেট কী? বাচ্চাগুলোর জন্যে ক্রেশফ্রেস তৈরি করতে চাইছিস কি? ব্যবসার সময়ে ওদের জমা রাখা যাকে বলে। ব্যবসার সময়ে রাস্তায় লুটোপুটি খাবে না, বিরক্ত করবে না, ওষুধ-পথ্য পাবে, এই?
—না রে বাবা। ওদের মানুষ করে তুলতে চাইছি। টোট্যাল এডুকেশন। যাতে বড় হয়ে অন্য স্ট্রিমে যায়। প্রসটিটুশন ব্যাপারটার সঙ্গে একেবারে যুক্ত না থাকে।
—রাইট। তা সেটা কি শুধু ‘অ আ ক খ’ শেখালেই হবে? তার জন্যে একটা সুস্থ, স্বাভাবিক, সামাজিক পরিবেশ চাই, না চাইনা? সেখানে যদি এই প্রফেশনের ঘুণ কেউ এসে এদের সুপার হয়ে বসে যায়, পরিবেশটা মাটি হয়ে যাবে না? মানুষ তার পরিবেশকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরে মুকুট। ওদের কথাবার্তায়, চালচলনে, এমনকী আদর বা শাসনের ধরনেও ওদের অভিজ্ঞতার জগৎটা বেরিয়ে পড়তে বাধ্য। তাতে বাচ্চাগুলোর ক্ষতি। এটা বুঝতে তো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়?
মুকুট বলল, ওদের মায়েরা? তাদের সঙ্গে যোগাযোগের কী হবে?
—মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যাবে। সম্পর্ক থাকবে, কিন্তু মাখামাখি থাকবে না।
—জিনিসটা একটু অমানবিক না?
—গোটা ব্যাপারটাই অমানবিক মুকুট। এই বারাঙ্গনা বৃত্তি, তাদের সন্তান হওয়া। সেসব সন্তান যেভাবে বড় হয়, জীবনকে ফেস করতে বাধ্য হয়, সমস্তটাই চূড়ান্ত অমানবিক মুকুট। আমার চেয়ে কম জানিস না তুই। সংস্কার-প্রক্রিয়ায় ছোট ছোট ধাপে কঠিন হতে হবেই। নইলে উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। এনি ওয়ে, হস্টেলে যারা মানুষ হয় সেইসব ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও বাড়ির বন্ধন একটু আলগা হয়ে যায়ই। স্বীকার করিস বা না করিস।
—বাচ্চাগুলো বড় হয়ে মায়েদের ঘৃণা করতে শিখলে?
—ঘৃণা করতে তো শেখানো হবে না। কিন্তু আমরা ওদের নারকীয় পরিবেশ থেকে তুলে এনে সুস্থ পৃথিবীর জলহাওয়ায় বাঁচতে দিতে চাই। তার প্রথম শর্তই হল কিন্তু ভুলে যাওয়া। নরকবাসের সময়টা। এখন এই ভুলে যাওয়া, সুস্থ ভ্যালুজ নিয়ে বড় হয়ে ওঠা মানে যদি অসুস্থতাকে ঘেন্না করা হয় কারও কারও ক্ষেত্রে কিছু করার নেই তা হলে। মায়েরা যদি ওদের বদলের সঙ্গে তাল রাখতে না পারে, সেই পুরনো জায়গায় থেকে যায়, তা হলে কোনও না কোনও সময়ে মায়েদের সঙ্গে ওদের বিচ্ছেদ হবেই। আমরা চাইব বড় হয়ে সব বুঝে ওরা মায়েদের এই দুরবস্থা থেকে মুক্ত করুক। কিন্তু ঘৃণা যদি না-ও করে শ্রদ্ধা করা শক্ত হবে। অতটা আমি প্রমিস করতে পারছি না। যাই হোক, সেটা পরের কথা। বি প্র্যাকটিক্যাল মুকুট। হয়তো করুণা করবে। করুণাও খারাপ জিনিস না। ভবিষ্যৎ কীরকম হবে, সে সম্পর্কে নির্ভুল আন্দাজ দেওয়া সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে কোনও ললিতা বিশাখার আবদারই আমি শুনতে রাজি নই।
কফি এসে গেছে।
মুকুট বলল, ঠিক আছে। এবার একটু হাস৷
মুখের পেশি সামান্য আলগা হল ঋত্বিকের। কিন্তু সে আদৌ হাসল না। বলল, কাজটা হাত থেকে বেরিয়ে গেল রে! আবার কোথায় হা জমি জো জমি করে ঘুরব!
মুকুট বলল, কী আশ্চর্য! এখনই অত হতাশ হবার কী আছে? উনি কি একবারও বলেছেন জমিটা দেবেন না?
জবাবে ঋত্বিক নীরবে কফিটা শেষ করে ফেলল। বলল, চলি রে! দু-তিন কদমে পগার পার।
সত্যিই৷ ঋত্বিকের মতো কঠিন সংকল্প, নিজের ধ্যানধারণায় অবিচল থাকার মতো মনের জোর মুকুট আজও আয়ত্ত করতে পারল না। তার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি, কিন্তু ঋত্বিকের জোর, দৃঢ়তা তার নেই। ভাবা যায়! এফ. আর. সি. এস-টা কমপ্লিট করল না জাস্ট ওয়েবসাইটে ভারতীয় শিশুদের ওপর কতকগুলো ছবি আর ডেটা দেখে? তিনদিন তিনরাত নাকি খালি পায়চারি করেছে আর ভেবেছে। তারপর সেই যে নিজের পথ ঠিক করে নিয়েছে, আর একচুলও নড়েনি।