ঋজুদার সঙ্গে সিমলিপালে

ঋজুদার সঙ্গে সিমলিপালে

ভর-দুপুর৷ টাইগার প্রোজেক্টের ডিরেকটর সাঙ্খালা সাহেব, যশীপুরের খৈরী-খ্যাত চৌধুরী সাহেব ও আরো একজন দক্ষিণ ভারতীয় একোলজিস্ট, ওড়িশার ন্যাশনাল পার্ক সিমলিপালের পাহাড়ের মধ্যে বড়াকামড়ার ছোটো বাংলোর বারান্দায় বসে লাঞ্চ খাচ্ছিলেন৷

ঋজুদা তাঁদের টা-টা করে বেরিয়ে পড়লেন৷ জেনাবিলের দিকে৷ জিপের মুখটা ঘুরল, কিন্তু ট্রেলারটা ঘুরল না৷ ট্রেলারগুলো বড়ই বেয়াদব হয়৷ জিপ ডাইনে ঘুরলে বাঁয়ে ঘোরে, বাঁয়ে ঘুরলে ডাইনে৷ আমি আর বাচ্চু হ্যাট-হ্যাট করে হালের বলদ তাড়াবার মতো করে, নেমে পড়ে হাত দিয়ে, পা দিয়ে ট্রেলারকে বাধ্য করলাম জিপের কথা শুনতে৷ তারপর বড়াকামড়ার বাংলোর গড়ের উপরের সাঁকো পেরিয়ে এসে জিপ মুখ ঘোরাল ডানদিকে৷

এই সিমলিপালের জঙ্গলে ঋজুদা একা আসেননি৷ সঙ্গে ঋজুদার জঙ্গলতুতো দাদা কানুদা এবং তার জঙ্গল-পাগল স্ত্রী ও শালি, খুকুদি ও মণিদি৷ সঙ্গে দিদি ও জামাইবাবু-অন্তপ্রাণ বাচ্চু৷

এত লোক সঙ্গে থাকায় আমি ঋজুদাকে মোটেই একা পাচ্ছি না৷ আমাকে এইসব নতুন লোকেরা মোটেই পাত্তাও দিচ্ছেন না৷ মন-মরা হয়ে ট্রেলারে মালপত্রের উপরে বসে আছি৷ ‘‘খিদমদগার’’ বাচ্চু এবং ‘‘ইউজলেস’’ আমার জায়গা ডাঁই করা মালপত্র-ভরা ট্রেলারের উপর৷

পাহাড়ি রাস্তা৷ জিপ যখন উৎরাইয়ে নামে, তখন আমরা এ-ওর ঘাড়ের উপর পড়ে একেবারে ট্রেলারের সামনে এসে পড়ে জিপের চাকার তলায় যাই আর কী! আবার জিপ যেই চড়াইয়ে ওঠে, তখন আবার সড়াৎ করে ট্রেলারের পেছনে চলে গিয়ে গড়িয়ে চিতপটাং হয়ে পড়ো-পড়ো, পাথরে৷ অনেক পাপ করলে মানুষকে জিপের ট্রেলারে চড়তে হয়৷

বড়াকামড়ার বাংলোর সামনেই শবরদের একটা বস্তি৷ সার-সার খড়ের ঘর, ওপারে ঝুঁকে পড়া পাহাড়ের গায়ে৷ বর্ষার বাঁক-নেওয়া ভরন্ত পাহাড়ি নদীর পাশে, নরম সবুজ প্রান্তরের উপর৷ দূর থেকে যেন পাণ্ডবদের বনবাসের পর্ণকুটির বলেই মনে হয়৷ এখন চৈত্রের শেষ৷ লক্ষ-লক্ষ শালগাছে মঞ্জরী এসেছে৷ মেঘলা আকাশ৷ মেঘলা আকাশের পটভূমিতে পুষ্পভারাবনত শালগাছগুলিকে যে কী সুন্দর দেখাচ্ছে; তা বোঝাবার মতো ভাষা আমার নেই৷ কাল সকাল থেকে একটানা বৃষ্টি হচ্ছিল৷ আজ ভোরে থেমে গেছে৷ বৃষ্টির পর লাল মাটির কাঁচা রাস্তা, পুষ্পশোভিত কচি কলাপাতা-রঙা শালবন, ওয়াশের কাজের মতো পাহাড়শ্রেণির নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে ট্রেলারে চড়ে জঙ্গলে ঘোরার মারাত্মক ঝুঁকি ও শারীরিক কষ্টও যেন ভুলে গেলাম৷

হঠাৎ মণিদি বললেন, হাতি-হাতি!

কানুদা বললেন, দিন-দুপুরে হাতি না ছাই৷ স্বপ্ন দেখছিস!

ওমা! চেয়ে দেখি, সত্যি হাতি৷ দুটো প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড হাতি ঝাঁটি-জঙ্গলে ভরা ছোট টিলা পেরিয়ে ওপারের উঁচু টিলাতে যাচ্ছে হেলতে-হেলতে, দুলতে-দুলতে৷ আর তাদের পায়ে-পায়ে একটা গাবলুগুবলু বাচ্চা৷ গোলগাল, গোবর-গণেশ, একহাত শুঁড়টাকে নাড়াতে-নাড়াতে চলেছে৷

বাচ্চু একদৃষ্টে তাকিয়েছিল, আমরা সকলেই৷ হঠাৎ বাচ্চু বলল, রুদ্র, হাতির মাংস কখনও খেয়েছ? বোধ হয় পাঁঠার চেয়েও নরম হবে৷ দৌড়ে গিয়ে ধরি?

বলেই, কারো পারমিশানের অপেক্ষা না করে ট্রেলার থেকে এক লাফে নেমে হাতিদের দিকে দৌড় লাগাল ও৷

জিপের মধ্যে সকলে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, কী হল, কী হল?

কী হল, তা জানতে এতটুকু উৎসাহ না দেখিয়ে কানুদা উৎসারিত কণ্ঠে বললেন, আমার ক্যামেরা! ক্যামেরা! বলেই সামনের সিটে বসে পিছন দিকে জোরে গলফ-খেলা তাগড়া হাত ছুড়লেন৷

হাতটা এসে লাগল মণিদির নাকে৷ মণিদি বললেন, উঃ, বাঁবাঁ-রেঁ৷

ঋজুদা চুপ করে ছিলেন, পাইপের ভুড়ুক-ভুড়ুক আওয়াজ হচ্ছিল৷

কানুদা শালিকে ধমকে বললেন, মণি, ক্যামেরা কোথায়? শিগগির দাও৷ এখন ন্যাকামি করো না৷

ন্যাঁকাঁমি নাঁ৷ নেঁই৷ বলেই মণিদি নাকি সুরে কেঁদে উঠলেন৷

ঠিক সেই সময় কানুদা বললেন, নেই মানে? ইয়ার্কি পেয়ছ?

আমি ঘোড়ার পিঠে বসার মতো করে ট্রেলারের দু’দিকে দু’পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে বাচ্চুর কার্যকলাপ রিলে করছিলাম৷

বললাম, এইবার সেরেছে! সর্বনাশ৷

সকলে চেয়ে দেখলেন, বড় হাতিটা বাচ্চুর দিকে ফিরে দাঁড়িয়েছে৷ কিন্তু বাচ্চু নির্বিকার৷ ও হাতির বাচ্চার রোসট খাবেই৷

কানুদা আবার বললেন, মণি, ক্যামেরা!

মণিদি বললেন, ডাঁলমুঁটের ঠোঁঙার মঁধ্যে রেঁখেঁছিলাম৷ ডাঁলমুটের ঠোঁঙাটা কাঁঠের বাঁক্সে৷ কাঁঠের বাঁক্সটা ট্রেঁলারে৷

কানুদা একটা চাপা তীব্র ধমক দিলেন মণিদিকে৷ সংক্ষিপ্তসার—ইডিয়ট৷ মণিদি ভ্যাঁ-অ্যা করে কেঁদে দিলেন৷ ওদিকে হাতি ডেকে উঠল, প্যাঁ-অ্যা-অ্যা-অ্যা৷ ডেকেই শুঁড় তুলে ডান পায়ে শূন্যে ফুটবলে লাথি মেরে এগিয়ে এল৷ শর্টস-পরা ও হাওয়াইয়ান চপ্পল-পরা বাচ্চু দৌড়ে পালিয়ে আসতে গিয়ে একটা হোঁচট খেয়ে পড়ল ধ্বপাস করে৷ তারপর উঠে দৌড়ে এসেই দূর থেকে লং-জাম্প দিয়ে সোজা এসে ট্রেলারে পড়ল৷ প্রায় আমার ঘাড়ে৷ ও-ও ধপ করে পড়ল, কানুদাও বললেন, গেল!

বাচ্চু লজ্জিত হয়ে পিছনে না তাকিয়েই বলল, কী গেল? হাতি? চলে গেল?

তারপর সঙ্গে-সঙ্গে বলল, আমার একপাটি চপ্পলও!

মণিদি বললেন, নাঁ-আঁ-আঁ৷ বোঁধ হঁয় ভেঁঙে গেঁল৷ কাঁনুদার ক্যাঁমেঁরা উঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ৷

কানুদা আবার বললেন, ইডিয়ট৷

ঋজুদা জিপটা জোরে চালিয়ে দিয়ে বলল, কে? বাচ্চু, না মণিদি?

দুজনেই৷ কানুদা রেগে বললেন৷

এরপর আরোহীরা নিস্তব্ধ৷ শুধু মাঝে মাঝে মণিদির নাক টানার শব্দ৷ কিন্তু রাস্তার দৃশ্যের তুলনা নেই৷ কানুদার মতো ঋজুদা ক্যামেরাতে বিশ্বাস করে না৷ চোখের টু-পয়েন্ট লেন্সে এইসব নিসর্গ ছবি তুলে নিয়ে মস্তিষ্কের মধ্যের অন্ধকার ল্যাবরেটরিতে লুকিয়ে রেখে দেয় অবচেতনের ভাঁড়ারে৷ যখন যেমন দরকার পড়ে, তখন তেমন সেই সব মুহূর্তের, দৃশ্যের, পরিবেশের শব্দ, গন্ধ, রূপের সামগ্রিক চেহারাটা তার কলমের মুখ থেকে সাদা পাতায় ছড়িয়ে পড়ে৷ মানুষের মস্তিষ্ক যা পারে, যা ধরে রাখে, পৃথিবীর কোনো ক্যামেরা বা টেপ রেকর্ডারই তা পারে না৷ মানুষ যেদিন গন্ধ-ধরা যন্ত্রও বের করবে—সেদিনও পারবে না৷

পথের বাঁকে হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা বুনো চাঁপার গন্ধ বা মেঘলা আকাশের মৃদু-মৃদু হাওয়ায় আলতো হয়ে ভাসতে থাকা শালফুলের গন্ধকে কি কোনো যন্ত্র ধরতে পারে?

আমরা ময়ূরভঞ্জের রাজার শিকারের বাংলো ভঞ্জবাসার পথ ছেড়ে এসেছি৷ পথটা বড়াকামড়া বাংলো থেকে নদী পেরিয়ে লাল মাটির লালিমা মেখে ছুটে গেছে সবুজ জঙ্গলের গভীরে৷ গতকাল আমরা রাজার বাড়ি চাহালাতে ছিলাম৷ চাহালা নামটার একটা ইতিহাস আছে৷ এখানে রাজা প্রত্যেকবার শিকারে আসতেন৷ একবার হাঁকা শিকারের সময় রাজা এবং তাঁর বন্ধু-বান্ধবেরা অনেক জানোয়ার মারলেন৷ আর সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ হল শিলাবৃষ্টি৷ সে কী শিলাবৃষ্টি! রাজার ক’জন বন্ধু মারা গেলেন, মারা গেল অনেক হাঁকাওয়ালা৷ রাজাও নাকি আহত হয়েছিলেন৷ লোকে বলতে লাগল যে, ভগবানের আসন টলে গেল৷ মরণোন্মুখ ও আহত পশুপাখির কান্নায় ও চিৎকারে ভগবানের আসন টলে গেছিল সেদিন৷ সেই থেকে নাম চাহালা৷ সেই দিন থেকে চাহালাতে শিকার বন্ধ৷ এমন কি, গাছ পর্যন্ত কাটা হত না রাজার আমলে৷ এখনও অনেক বনবিভাগের অফিসার সেকথা মেনে চলেন৷ বাংলোর হাতায় একটা পিয়াশাল গাছ আছে কুয়োয় যাওয়ার পথে, তার চারদিকে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রেখেছেন রেঞ্জার মিশ্রবাবু৷ পাছে ভুল করে গাছটার কেউ ক্ষতি করে৷

এখানে প্রকৃতির পুত্র-কন্যাদের উপর বিন্দুমাত্র অন্যায় হলে আবারও ভগবানের আসন টলতে পারে৷ সকলেই এই ভয় বুকে নিয়ে বাঁচেন৷ চাহালা বেশ উঁচু৷ গরমের দিনেও ঠান্ডা৷ অনেকগুলো ইউক্যালিপটাস গাছ আছে হাতার মধ্যে, বৃত্তাকারে লাগানো৷ বসন্ত-সকালের সোনার রোদ যখন ইউক্যালিপটাসের মসৃণ পাতায় চমকাতে থাকে, সুনীল আকাশের নীচে তখন নীলকণ্ঠ পাখি বুকের মধ্যে চমক তুলে ডেকে ডেকে ওড়ে৷ টিয়ার ঝাঁক শিহরন তুলে একদল ছোট্ট সবুজ জেট-প্লেনের মতো ছুটে যায় নক্ষত্র জয়ের জন্য নীলোৎপল আকাশে৷ একটা পথ বাংলোর ডাইনে দিয়ে বেরিয়ে গেছে হলদিয়ার দিকে, বারো কিলোমিটার৷ অন্য পথ, কাইরাকাচার দিকে৷ এই দু’ জায়গায় বনবিভাগের ছোট্ট মাটির ঘর আছে৷ খড়ে ছাওয়া বাংলো৷ তার চারপাশে হাতি যাতে না আসতে পারে, সেজন্যে গভীর গড় কাটা৷ ছোট্ট নিকানো মাটির উঠোন৷ ছোট্ট বারান্দা৷ স্বপ্নে দেখা ছবির মতো৷ পাশেই ঝরনা৷ বড়-বড় গাছ ঝুঁকে পড়েছে চারধার থেকে৷ মাটির উঠোনে টুপ টাপ পাতা পড়ে ঝরে-ঝরে৷ নির্জন দুপুরে কাঁচপোকা ওড়ে বুঁ—বুঁবুঁ—বুঁ-ই-ই-ই আওয়াজ করে৷ জংলি হাইবিস্কাস-এর সরু ডালে বসে নানারঙা মৌটুসি পাখি শিস দেয়৷ দূর থেকে হাতির দলের বৃংহণ ভেসে আসে, কোটরা হরিণ ডেকে ওঠে ব্বাক, ব্বাক, ব্বাক করে৷ সেই উদাত্ত আওয়াজ অনুরণিত হয় পাহাড়ে-পাহাড়ে, বনে-বনে৷ উঁচু গাছের ডাল থেকে অর্কিড দোলে মন্থর খেয়ালি হাওয়ায়৷ গন্ধ ওড়ে৷

চাহালা থেকে আরও একটা রাস্তা গেছে ন-আনা হয়ে, বড়াই পানি জলপ্রপাতের পাশ দিয়ে৷ যে প্রপাত থেকে বুড়াবালাম নদীর সৃষ্টি৷ তারপর পৌঁচেছে গিয়ে ধুধরুচম্পাতে৷ কী দারুণ নামটা, না? ধুধরুচম্পা৷ এখানে আরো সব সুন্দর-সুন্দর নামের জায়গা আছে৷ যেমন বাছুরিচরা৷ ধুধরুচম্পাতে পৌঁছলে মনে হয় খাসিয়া পাহাড়ের কোনো নিভৃত জায়গায় এসেছি, অথবা কুমায়ুনের৷ চিড় আর চিড়৷ শুধু চিড়ের বন৷ ময়ূরভঞ্জের রাজা বহু-বহু বছর আগে এই উঁচু মালভূমিতে পাইন গাছ এনে লাগিয়েছেন৷ ঘন গহন পাইন বন৷ লোক নেই, জন নেই, দোকান নেই, শুধু বন আর বন৷ হাওয়া ওঠে যখন পাইনের বনে, তখন এমন এক মর্মরধ্বনি ওঠে যে কী বলব! পাইনের গন্ধ ভাসে হাওয়ায়৷ চিড়ের ফলগুলো ঝরা চিড়েপাতার মখমল গালচের উপরে নিঃশব্দে গড়িয়ে যায়৷ গা শিরশির করে ভালোলাগায়৷ তার সঙ্গে মিশে যায় কত না-নাম-জানা ফুলের গন্ধ৷

প্রত্যেক জঙ্গলের গায়েরই একটা নিজস্ব গন্ধ আছে৷ প্রত্যেক মানুষের গায়ের গন্ধের মতো৷ গন্ধ ঋতুতে ঋতুতে বদলায়৷ যেমন বদলায় শব্দ, যেমন বদলায় রূপ৷ চৈত্রের হাওয়ায় বনের বুকে যে কথা জাগে, সে কথার সঙ্গে শ্রাবণের কথা বা মাঘের কথার কত তফাত! সে রূপেরই বা কত তফাত! যার চোখ আছে, সে দেখে, যার কান আছে, সেই শোনে, যার হৃদয় আছে, সেই শুধু হৃদয় দিয়ে তা উপলব্ধি করে৷

অনেকেই জঙ্গলে যান, হৈ-হৈ করেন, পিকনিক করে চলে আসেন, কিন্তু জঙ্গল তাঁদের জন্যে নয়৷ পিকনিক করার অনেক জায়গা আছে৷ জঙ্গলে গেলে নিজেরা কথা না বলে জঙ্গলের কী বলার আছে তা শুনতে হয়৷

ন-আনা জায়গাটার নামটাও ভারী মজার, তাই না? এর একটা ইতিহাস আছে৷ রাজার খাজনা ছিল এখানে ন-আনা৷ তাই জায়গাটার নাম হল ন-আনা৷ ন-আনা জায়গাটাও ভারী সুন্দর৷ ধুধরুচম্পা বা জেনাবিলের মতো এখানকার বাংলো কাঠের দোতলা নয়৷ পাকা বাংলো৷ চাহালাতেও৷ বাংলোটা একটা টিলার মাথায়—বহুদূর চোখ যায়৷ অনেকখানি জায়গা জঙ্গল কেটে ফাঁকা করা আছে৷ পাহাড়ি নদী গেছে এঁকেবেঁকে৷ ধু-ধু উদোম টান—কিন্তু রুক্ষ নয়৷

এই চৈত্রশেষের বৃষ্টিতেও চারিদিক সতেজ সবুজ দেখাচ্ছে৷ আমরা যখন ন-আনায় যাচ্ছিলাম, তখন আমাদের সঙ্গে একজন গোন্দ দম্পতির দেখা হয়ে গেছিল৷ তিরধনুক হাতে নিয়ে চলছিল কালো ছিপছিপে বাবরি চুলের ছেলেটি আর হলুদ রঙে ছোপানো শাড়ি পরা মেয়েটি৷ মেঘলা আকাশের নীচে৷ কানুদাকে শুধোলেন ঋজুদা, রাত্রে কোথায় থাকা হবে?

জেনাবিলে৷ কানুদা বললেন৷

বাচ্চু বলল, এই সেরেছে!

আমি বললাম, কেন? অসুবিধা কিসের?

ও বলল, না, পরে বলব৷

দেখতে-দেখতে আমরা দেও নদীতে এসে পড়লাম৷ বড়-বড় মাছ আছে নদীটাতে৷ একটা দহের মতো হয়েছে৷ বর্ষার লাল মাটি-ধোওয়া ঘোলা জল ভরে রয়েছে৷ কানায়-কানায়৷

হঠাৎ বাচ্চু আমাকে বলল, ‘কানায়-কানায়’ ইংরিজি কী?

আমি অনেক ভাবলাম৷ তারপর বললাম, জানি না৷

কানুদা বললেন, মণি, নাক কেমন?

মণিদি বললেন, ভাঁল৷ এঁকটু রঁক্ত বেঁরিয়েছে৷

খুকুদি বললেন, তোর বাবা একটুতেই বাড়াবাড়ি৷

মণিদি বললেন, হুঁ, তোঁর নিজেঁর বঁর কিঁ নাঁ, হুঁ…!

ঋজুদা বলল, ওঁ মণিপদ্মে হুম৷

কানুদা বললেন, বাঁদিকে নয়, ডানদিকে৷

ভুল করে ঋজুদা বাঁদিকে চলে যাচ্ছিল৷ কানুদা স্টিয়ারিং ডানদিকে ঘোরালেন৷ দেও নদী পেরিয়ে আমরা দেবস্থলীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম৷ জনমানব নেই, লোকালয় নেই—জঙ্গল আর জঙ্গল৷ মাইলের পর মাইল থমথমে নিস্তব্ধতা৷ দেবস্থলীতে একটা ছোট্ট খড়ের ঘর—চারধারে গড় কাটা, হাতির জন্যে৷ টাইগার প্রোজেক্টের বাংলো৷ কোনো ফরেস্ট গার্ড থাকবেন বোধ হয়৷ এখন কাউকে দেখলাম না৷

বাচ্চু বলল, রুদ্র, তুই কখনও বাঘের মাংস খেয়েছিস?

আমি বললাম, না৷ তবে প্রায় সব জানোয়ারেরই খেয়েছি, এক গাধা ছাড়া৷

বাচ্চু বলল, কাক কখনও কাকের মাংস খায়?

আমি বললাম, কী বললি?

বলতেই সামনে থেকে ওঁরা সকলে হেসে উঠলেন৷

আমার কান লাল হয়ে উঠল৷ এই জন্যেই অল্পচেনা লোকদের সঙ্গে আসতে চাই না কোথাও৷ ঋজুদাটা আর নেশার লোক পেল না৷ ভালো লাগে না৷ দূর থেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নীচের সমান প্রান্তরে ছবির মতো জেনাবিল গ্রামটা চোখে পড়ল৷ একটা হাতির কঙ্কাল পড়ে আছে৷ দুটো হাতি নাকি লড়াই করেছিল এখানে, সিমলিপালের রিপোর্টার কানুদা বললেন৷

মণিদি বললেন, নাঁ লঁড়াই নাঁ৷ আঁদর৷

বাচ্চু বলল, বাঁদর৷

কানুদা বললেন, কোথায়?

ঋজুদা বললেন, ট্রেলারে৷

অনেকগুলো বাঁদর পথ পেরিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে গেল৷

কানুদা বললেন, পারফেক্ট হেলথ৷

জেনাবিলের কাঠের বাংলোটা হাতিরা ধাক্কাধাক্কি করে ফেলে দেওয়ার উপক্রম করেছিল৷ বাংলোটা হেলে গেছে৷ বড়-বড় কাঠের গুঁড়িগুলোকে সোজা করে বসাবার জন্যে এবং পাশে-পাশে ঠেকনো দেওয়ার জন্যে বিরাট গর্ত খোঁড়া হয়েছে৷ বাংলো পুরোপুরি সারাবার আগে বহু লোকের যে পা ভাঙবে, মাথা ফাটবে এই গর্তে পড়ে, তাতে সন্দেহ নেই৷

বাংলোটার সব ভালো৷ কিন্তু বাথরুম নেই, কোনো ফার্নিচারও নেই৷ একটা চেয়ার পর্যন্ত নয়৷ মাটিতে শোওয়া, মাটিতে বসা, নীচে গার্ডের ঘরে রান্না করা৷ বেশ দূরের ঝরনাতে চান, হাত-মুখ ধোওয়া৷ সিমলিপালের বেশির ভাগ বাংলোতেই রান্নাবান্না সব নিজেদেরই করতে হয়৷ সেজন্যে অসুবিধা নেই৷ কিন্তু বাঘ-হাতির জঙ্গলে রাত-বিরেতে প্রাকৃতিক আহ্বানে সাড়া দিতে জঙ্গলে যাওয়া একটু অসুবিধের!

বাংলোয় পৌঁছেই খুকুদি বললেন, মণি, তাড়াতাড়ি স্টোভটা বের করো৷ চা বানাই৷ তারপর খিচুড়ির বন্দোবস্ত করে বেরিয়ে পড়ব এক চক্কর৷ সন্ধের মুখে-মুখেই তো জানোয়ার বেরোয়৷

তারপরই আবার বললেন, মুগের ডাল আছে?

ঋজুদা এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি৷ এখন জিপ থেকে নেমে গার্ডের ঘরের দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে পাইপে নতুন করে তামাক ভরতে ভরতে বলল, খুকুদি, তাড়াতাড়ি চা৷

চা খেয়ে-খেয়ে খুকুদি ডিসপেপটিক৷ ঋজুদার মতো চা-ভক্ত লোক পেয়ে খুশি৷ মণিদি স্টোভ বের করলেন৷ খুকুদি বললেন, মুগের ডাল দিয়ে খিচুড়িটা ভালো করে রাঁধতে হবে রাতে৷ সকালবেলা ভালো হয়নি৷

বাচ্চু আতঙ্কিত গলায় বলল, আবার খিচুড়ি!

খুকুদি বললেন, না তো কী! এই জঙ্গলে তোমার জন্যে বিরিয়ানি পাবো কোত্থেকে?

বাচ্চু বলল, না, তা বলছি না৷ মানে, একটু অসুবিধা ছিল৷ তারপরই বলল, ওষুধের বাক্সে কি কিছু আছে?

ও! তোর বুঝি পেট খারাপ হয়েছে? খুকুদি বললেন৷

বাচ্চু বলল, দশদিন তো হল এবেলা খিচুড়ি, ওবেলা খিচুড়ি৷ তারপর চারধারের জঙ্গলে চোখ বুলিয়ে নিয়েই বলল, আমি নেই৷ যা খেয়েছি সকালে, অনেক খেয়েছি৷ আর খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে নেই৷

আমি বললাম, ভয় কীসের? যেদিকে তাকাবি, সেদিকেই তো উদার, উন্মুক্ত৷

বাচ্চু রেগে বলল, তুই যা না, যতবার খুশি৷

মণিদি বললেন, বাঁদর৷

আমি ও বাচ্চু দুজনেই তাকালাম৷ তারপর বুঝলাম যে আমরা নই৷

একটা বড় বাঁদর গার্ডের ঘরের পাশের গাছে বসে আছে৷ তাড়াতাড়ি করে চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম একটা বড় চক্কর ঘুরে আসবার জন্যে—জিনিসপত্র নামিয়ে রেখে জিপের ট্রেলার খুলে রেখে৷

জেনাবিল থেকে ধুধরুচম্পা যাওয়ার এই স্বল্প ব্যবহৃত পথটাতে যে কত জীবজন্তু দেখেছিলাম আমরা আসার সময়, তা বলার নয়; দিনের বেলা দলে-দলে হাতি, ময়ূর, হিমালয়ান স্কুইরেল, বাঁদর, বার্কিং ডিয়ার৷

প্রায় পাঁচ কিলোমিটার মতো গেছি, একদল বুনো কুকুর লাফাতে-লাফাতে রাস্তা পেরুল৷ মুখ দিয়ে অদ্ভুত একটা আওয়াজ করছিল ওরা৷

ঋজুদা বলল, বুনো কুকুর এসেছে যখন, তখন এখানে আর কিছু দেখা যাবে না৷

কানুদা বললেন, চলোই না একটু ভিতরে৷

আসন্ন সন্ধ্যার আধো-অন্ধকারে ময়ূর ডাকছে, মুরগি ডাকছে, বাঁদর হুপ-হুপ-হুপ-হুপ করে উঠছে গভীর জঙ্গল থেকে৷ হাতির দল দূর দিয়ে দিনের শেষে ঘুমের দেশে চলেছে সারি বেঁধে, গায়ে লাল মাটি মেখে৷ মনে হয় স্বপ্ন৷ বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না সত্যি৷

হঠাৎ ঋজুদা জিপটা হল্ট করিয়ে দিয়ে বলল, মামা!

বাচ্চু বলল, কার মামা?

খুকুদির লম্বা হাতটা জিপের পেছনের আধো-অন্ধকারে এসে বাচ্চুর কানে আঠা হয়ে সেঁটে গেছে৷ খুকুদির হাতটা বাচ্চুর কানে পড়তেই বাচ্চুর ও আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল৷

পথের ডানদিকে খাদ—বাঁদিকে পাহাড়৷ সূর্য ডুবে এসেছে৷ মামা আসছে গোঁফে তাড়া দিয়ে সোজা হেঁটে জিপের একেবারে মুখোমুখি৷

সকলে স্ট্যাচু হয়ে গেছে জিপের মধ্যে৷ শুধু ঋজুদার পাইপের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই৷

প্রকাণ্ড বড় চিতা৷ চমৎকার চিক্কণ চেহারা৷ গোঁফ দিয়ে জেল্লা বেরুচ্ছে৷ এ-জঙ্গলে মানুষ বোধহয় একেবারেই আসে না, নইলে চিতার এমন ব্যবহার আমি কখনও দেখিনি৷ জিপের থেকে হাত কুড়ি দূরে চিতাটা সোজা বুক চিতিয়ে দাঁড়াল৷ দিনের শেষ আলোর ফালি এসে পড়ল ওর গায়ে৷ সে এক দারুণ সৌন্দর্য ও স্তব্ধতার মুহূর্ত৷ সেই নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ করে হঠাৎ কানুদা উত্তেজিত হয়ে বললেন, মণি, ক্যামেরা!

বলেই সকালের মতো আবারও হাত ছুড়লেন৷ ‘মা-গোঁ-ও’ বলে মণিদি জিপের মধ্যেই বসে পড়লেন৷ চিতাটা ভীষণ ভয় পেয়ে চমকে উঠে এক লাফে খাদের দিকে দৌড়ে গেল৷ তারপর কী করে নামল খাদ-বেয়ে, তা সে চিতাই জানে৷ ডিগবাজি খেয়ে নিশ্চয়ই ওরও নাক ভাঙল৷

খুকুদি বললেন, এটা বাড়াবাড়ি কানু, তোমার ক্যামেরা তুমি ঠিক করে রাখতে পারো না? মেয়েটার নাক দিয়ে এখনও রক্ত ঝরছে, তার ওপর আঘাত?

কানুদা বললেন, ক্যামেরা কোথায়?

কাঁজুবাঁদামের টিনে৷

মণিদি কোঁকাতে-কোঁকাতে বললেন৷

কানুদা চিতাবাঘটা লাফানোর আগে যেমন ধনুকের মতো বেঁকে গেছিল, তেমনি রাগে বেঁকে গিয়ে বললেন, দেয়ারস এ লিমিট৷ ডালমুটের ঠোঙা থেকে বের করে কাজুবাদামের টিনে—ক্যামেরা?

মণিদি জামাইবাবুকে খুব ভালবাসেন৷ বললেন, তুঁমিই না বঁলেছিলে বৃষ্টিতে লেন্সে ফাঙ্গাঁস পঁড়ে যাবে? আমি তাঁই যত্ন কঁরে-এ-এ-এ৷ উঁঃ-হু-হু—৷ ঋজুদা জিপ থেকে নেমে বলল, এইরকম কোনো জায়গাতেই শূর্পণখার নাক কাটা গেছিল৷ এখানে প্রত্যেকের নাক সাবধানে রাখা উচিত৷ বলে রুমাল বের করে নিজের নাক মুছল৷

খুকুদি বললেন, বাচ্চু, মণির নাকে ওয়াটার বটল থেকে একটু জল দে তো৷

কোথায় বাচ্চু?

তাকিয়ে দেখি বাচ্চু নেই৷ কখন যে হাওয়া হয়েছে, কেউই লক্ষ করিনি৷ বাঘও ডানদিকে খাদে লাফিয়েছে, বাচ্চুও বাঘকে ডোন্ট-কেয়ার করে বাঁদিকে পাহাড়ে চড়েছে৷ ও বলেইছিল যে, ওর একটু অসুবিধা আছে৷ কিন্তু বাঘের চেয়েও যে বেশি ভয়াবহ কিছু আছে, এ-কথাটা সেবারেই প্রথম জানলাম৷ বাঘ তো বাঘই; কিন্তু খিচুড়ি—ঘোগ৷



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *