ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলমহলে

ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলমহলে

বিকেলে খেলে ফিরতেই ছোড়দি বলল, ‘এই রুদ্র, তোকে ঋজুদা ফোন করেছিল৷’

খেলার ঘেমো জামাকাপড় না ছেড়েই ঋজুদাকে ফোন করলাম৷ বললাম,‘হ্যালো, ঋজুদা আমি বলছি৷ ফোন করেছিলে কেন?’

ঋজুদা একটু চাপা হাসি হাসল৷ বলল, ‘স্কুল খুলছে কবে?’

‘তেইশে জুন৷’

‘পড়াশোনা, হোমটাস্ক, সব হয়েছে?’

‘সব নয়; হয়েছে কিছু কিছু৷’

আমি বিরক্ত হলাম৷ ঋজুদার মুখে পড়াশোনার কথা শুনতে ভালো লাগে না৷ ঋজুদা বলল, ‘না হয়ে থাকলে, সাত দিন সময় দিলাম, তার মধ্যে সব করে নে৷ আমি অসমে যাচ্ছি, মিকির হিলসে৷ অসম গভর্নমেন্ট নেমন্তন্ন করেছে—খুব একসাইটিং ব্যাপার৷ পরে সব বলব৷ তোর বাবা-মাকে আমি রাজি করাব এখন৷ তবে হোমটাস্ক সব শেষ না করলে নিয়ে যাওয়া হবে না৷’

আমার গলার কাছে একরাশ আনন্দ আমসত্ত্বর মতন দলা পাকিয়ে গেল৷

বললাম, ‘ওসব ভেবো না—আমি এক্ষুনি আরম্ভ করছি, সব শেষ করে ফেলব৷ তবে মা বলছিলেন, পুরী যাবেন, আমাদেরও নিয়ে যাবেন৷ আহা! আমি কি ছোটো আছি যে, সমুদ্রের পাড়ে বসে বালি নিয়ে খেলা করব? তোমার সঙ্গে গেলে কত সব আডভেঞ্চার! তা নয়, গুডি-গুডি ছেলেদের মতন, লক্ষ্মী মেয়েদের মতন মায়ের আঁচল ধরে ঘুরে বেড়ানো; ভালো লাগে না৷ তুমি কিন্তু কেস খারাপ করে দিয়ো না৷ প্লিজ, দেখো ঋজুদা৷’

ঋজুদা হাসল৷ বলল, ‘ঠিক আছে৷ আমি চেষ্টা করব৷’



নাওয়া-খাওয়া ভুলে লেগে পড়লাম৷ পাঁচ দিনেই প্রায় পুরো সামার ভেকেশনের টাস্ক শেষ করে আনলাম—এমন সময় ঋজুদার ফোন এল একদিন সকালে৷

ঋজুদা গম্ভীর গলায় বলল, ‘তোর মামিমার হঠাৎ খুব অসুখ করেছে—হাসপাতালে রিমুভ করেছে সকালে৷ আজই অপারেশন৷ অপারেশনের পরে আটচল্লিশ ঘণ্টা ক্রাইসিস৷ সেই কারণে আপাতত অসম গভর্নমেন্টের নেমন্তন্ন রাখা যাচ্ছে না৷ তবে, তোকে যখন নাচিয়েছি, তখন নিয়ে যাবই৷ শিকারে নয়—বেড়াতে৷ পালামৌর বেতলা ন্যাশনাল পার্কে৷’ তারপর বলল, ‘তোকে আবার ফোন করব পরশু, তোর মামি কেমন থাকে দেখে৷’

ফোনটা নামিয়ে রেখেই মামিমার উপর এমনই রাগ হল যে, কী বলব৷ অসুখ বাধাবার আর সময় পেল না৷



একদিন ভোরবেলা রাঁচি এক্সপ্রেসে আমরা রাঁচি এসে পৌঁছোলাম৷

ভোররাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল৷ আমি জানালার পাশে বসে বাইরের অপূর্ব সব দৃশ্য দেখছিলাম৷ কত পাহাড়, নদী, উপত্যকা, আর জঙ্গল৷

এখন গরমকাল, মে মাস, জঙ্গলের বেশির ভাগ গাছের পাতা ঝরে গেছে৷ লালে লাল হয়ে আছে পাহাড়-উপত্যকা, পলাশে-অশোকে-শিমুলে৷

কী একটা স্টেশনের আউটার কেবিনের সামনে ট্রেনটা দাঁড়িয়েছিল—

যেই ট্রেনের চলার শব্দ থেমে গেল অমনি বাইরের পৃথিবীর সব শব্দে কান ভরে গেল৷ ফিসফিস হাওয়ার শব্দ—পাখির ডাক, দূরে কাঠ-কাটার শব্দ, মোষের গলার গম্ভীর হাম্বা রব৷ কী যে ভালো লাগতে লাগল, তা কী বলব!

স্টেশনে, ঋজুদার খুবই জানাশোনা, ঋজুদা বলে ছোটো ভাই, ডালটনগঞ্জের মোহনবাবু তাঁর ড্রাইভার কিষানকে পাঠিয়েছিলেন গাড়ি নিয়ে৷ সঙ্গে রমেনবাবু৷

কিষানের চেহারা ভারি সুন্দর৷ চমৎকার ফিকে-খয়েরিরঙা পোশাকপরা৷ রমেনবাবু বেঁটেখাটো, ঋজুদা ডাকছিল রমেনদা বলে৷ দারুণ মজার লোক৷

বি.এন.আর. হোটেলে আমরা চা-টা খেয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম৷ কিষান আর ঋজুদা সামনে৷ আমি আর রমেনদা পিছনে৷

হু-হু করে গাড়ি চলতে লাগল৷ লোহারডাগার পথে আমরা অনেকদূরে গিয়ে কুরু বলে একটা ছোট্টো গ্রামে ডান দিকে মোড় নিলাম৷ তারপর চাঁদোয়া টোড়ি৷

ঋজুদা বলল, ‘জানিস রুদ্র, যখন ছোটো ছিলাম, একবার মা-বাবার সঙ্গে এই ঘাটে একটা বড়ো বাঘ দেখেছিলাম৷ সে খুব মজার গল্প৷ তোকে পরে বলব৷’

গাড়িতে নানারকম জঙ্গলের, পুরোনো ঘটনার গল্প হচ্ছিল৷ হু-হু করে হাওয়া লাগছিল চোখে-মুখে, মহুয়ার গন্ধ আসছিল নাকে, চারদিকের চমৎকার দৃশ্য, আমি অবাক হয়ে বসেছিলাম আর দেখছিলাম৷ দেখছিলাম না বলে গিলছিলাম বলা ভালো৷

একসময় লাতেহারে একটু দাঁড়ানো হল৷ চা, পণ্ডিতজির দোকানের শেউই ভাজা আর প্যাঁড়া খেয়ে আমরা আবার চললাম৷

বেলা বারোটা নাগাদ কের বাংলোয় গিয়ে পৌঁছোলাম৷ কের বাংলোয় মোহনদা ঋজুদার জন্যে অপেক্ষা করছিল৷ বাবুর্চি ছিল, জুম্মান৷ ঋজুদা বলল, ‘জুম্মানের রান্না খেলে তুই অজ্ঞান হয়ে যাবি৷’

মোহনদা, বাবলুদা, শান্টুদা, রমেনদা, খোকনদা, সকলেই ঋজুদাকে পেয়ে খুব খুশি হল৷

আমি ঋজুদাকে একটু একা পেয়ে বললাম, ‘তোমাকে এঁরা খুব ভালোবাসেন না?’

এই স্বার্থহীন ভালোবাসার কোনো তুলনা নেই৷ এতে শুধুই আনন্দ; কাঁটাহীন৷

বেতলাতে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের রেস্ট হাউস আছে৷ তাতে ঋজুদা থাকে না৷ ঋজুদা বলে, ‘শহরের আদেখলে লোকগুলো এসে এমন দাঁড়কাকের মতো হল্লাগুল্লা করে ওখানে, গাঁকগাঁক করে খায়, তারপর গোল হয়ে বসে শুধু তাস খেলে৷ চুপচাপ একটু নির্জনতা উপভোগ করবি যে, তার উপায় নেই৷’

মোহনদারা সব বন্দোবস্ত-টন্দোবস্ত করে ডালটনগঞ্জ চলে গেলেন৷ শান্টুদা ও নিমাইদা গেলেন ছিপাহোদরে৷ নিমাইদাকে দেখতে একেবারে ‘সোনার কেল্লা’র জটায়ুর মতো৷

কের-এর বাংলো পুরোনো দিনের ফরেস্ট বাংলো৷ এখান থেকে বেতলা তিন মাইল৷ ছিপাদোহরও তাই৷ বিরাট বিরাট ঘর, বিরাট বিরাট বাথরুম৷ বড়ো টাবে জল রাখা আছে চান করার জন্যে৷

আমরা চান-টান করে খেতে বসলাম৷

বিউলির ডাল, আলুপোস্ত, মুরগির পাতলা ঝোল, কাঁচা আম-আদা লংকা দিয়ে বাটা চাটনি, পুদিনার চাটনি এবং পুডিং৷

খেয়েদেয়ে উঠে, বারান্দার ইজিচেয়ারে ঋজুদা একটা বই নিয়ে পাইপ ধরিয়ে বসল৷

আমিও অন্য একটা ইজিচেয়ারে বসলাম৷

বাংলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগল এই বারান্দাগুলো৷ সামনে ও পিছনে প্রকাণ্ড চওড়া বারান্দা৷ আমরা এখন সামনের বারান্দায় বসে আছি৷ সামনেই পাহাড় ঢালু হয়ে নেমে গেছে৷ এখন একটু লু-এর মতো হাওয়া বইছে৷ গরম রুক্ষ হাওয়া৷ একটু বসলেই চোখ শুকিয়ে আসে৷

ধুলোর ঝড় উঠছে পাহাড়ে পাহাড়ে শুকনো শাল পাতা উড়িয়ে, গড়িয়ে, নাচিয়ে, ভাসিয়ে যাচ্ছেতাই করছে হাওয়াটা৷ মচ মচ সড় সড় শব্দ উঠছে হাওয়ার তোড়ে৷ আবার যেই হাওয়াটা শান্ত হচ্ছে অমনি বনের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠছে যেন—চাপা৷ যেন বনের কত কষ্ট৷

কের বস্তি কাছেই৷ কোনো মাটির ঘরে কে যেন ধান কি অন্য কিছু কুটছে৷ তার একটানা গুপ গুপ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে৷ কুয়োতলায় ল্যাংটা ছেলে চান করছে ভরদুপুরে—লাটাখাম্বা উঠছে নামছে ক্যাঁচোর কোঁচোর৷ রোগা গোরু ল্যাজ দিয়ে গায়ে-বসা মাছি তাড়াচ্ছে৷ বলিরেখাময় মুখ নিয়ে এক আদ্যিকালের বুড়ি একটা সাদা-জমিন লাল-পাড়ের ময়লা দেহাতি শাড়ি পরে বসে ছুঁচের মাথায় নীল সুতো পরিয়ে কী যেন সেলাই করছে৷ ঘুঘু ডাকছে একটানা ঘুমপাড়ানি সুরে—ঘুরররর-ঘু, ঘুঘুর-র-র-র—ঘু৷

সব কিছু মিলিয়ে, আর কিছু করার না থাকাতে, কখন যে ইজিচেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই৷

ঘুম ভাঙল ঋজুদার কথাতে৷

দেখলাম ঋজুদা জামাকাপড় পরে আমার কাঁধে হাত দিয়ে ডাকছেন, ‘রুদ্র, রুদ্র, চল—চল, মুখ ধুয়ে চা খেয়ে নে, তোকে পালামৌয়ের গড় দেখিয়ে আনি৷’

মুখ-হাত ধুয়ে জামাকাপড় পরতে পরতেই দেখি, ট্রেতে সাজিয়ে সুন্দর কেটলি ও কাপে চা এনে হাজির জুম্মান৷ সঙ্গে বিস্কিট, সন্দেশ, ফল ইত্যাদি৷

ঋজুদা হাসল৷ বলল, ‘ও জুম্মান, আমরা তো কোম্পানির বড়োসাহেব নই—আমাদের অত খাতির না করলেও চলবে৷ তা ছাড়া এই-ই তো খেয়ে উঠলাম৷’

এককাপ করে চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম৷ সঙ্গে আমার বড়ো টর্চটা নিয়ে নিলাম৷

মোহনদা একটা জিপ গাড়ি রেখে গিয়েছিল আমাদের জন্যে৷ জিপটার হুড খোলা ছিল৷ সামনের কাচও নামানো ছিল৷

ঋজুদা বলল, ‘রুদ্র, চালাবি নাকি?’

আমি খুবই খুশি হলাম৷ কিন্তু লাজুক লাজুক ভাব করে বললাম, ‘পুলিশে ধরলে?’

ঋজুদা হাসল৷ বলল, ‘এই জঙ্গলে তোর লাইসেন্স পরীক্ষা করবে কে? যদি বাঘের কি বাইসনের পেছনে ধাক্কা মারিস, তাহলে তারা হয়তো তোর ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখতে চাইতে পারে—’

ঋজুদার কথামতো জিপ চালিয়ে চললাম৷ কলকাতায় লুকিয়ে লুকিয়ে ধ্রুবদার পাশে বসে স্কুল থেকে আসার পথে একটু একটু করে চালিয়ে গাড়ি চালানোটা প্রায় শিখেই ফেলেছিলাম—কিন্তু বাড়িতে কেউ জানে না—একদিন ছোড়দি দেখে ফেলেছিল বন্ধুর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, ছোড়দিকে অনেক করে পটিয়ে-পাটিয়ে কথাটা বাবা-মা-র কানে তুলতে দিইনি৷

এইরকম জঙ্গল-পাহাড়ে জিপ চালানো দারুণ একটা ব্যাপার৷ মনে হয়, কী একটা বিষম অ্যাডভেঞ্চারাস কাণ্ড করছি বুঝি৷

একটু গিয়েই ডান দিকে একটা বিরাট দহ পড়ল৷ একটা মজা পাহাড়ি নদী৷ মধ্যে মধ্যে বড়ো বড়ো পাথর৷ ওঁরাও ছেলের মতো চ্যাটালো বুক চিতিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছে৷

ঋজুদা বলল, ‘দেখ রুদ্র এ জায়গাটার নাম কমলদহ৷ ভারি সুন্দর জায়গা না? এখানে বসলে অনেক জানোয়ার দেখা যায়৷ যখন জল থাকে, তখন হাতির দল এসে শুঁড় দিয়ে জল তুলে চান করে, বাচ্চাদের চান করায়৷ ভারি সুন্দর দেখতে লাগে৷’

আমি বললাম, ‘আমরা হাতি দেখতে পাব?’

ঋজুদা চারধার দেখে বলল, ‘দেখতে তো পাওয়ার কথা৷ তবে এখানে একটা একলা হাতি—দাঁতাল—কিছুদিন হল বড়ো ঝামেলা করছে৷ সেটাকে না দেখাই ভালো৷’

আমি উৎসুক গলায় শুধোলাম, ‘সেই টুম্বকার হাতির মতো পথ জুড়ে দাঁড়াবে না কি?’

‘তোর মনে আছে দেখছি?’ ঋজুদা বলল৷

আমি বললাম, ‘কী বল তুমি? মনে আবার থাকবে না!’

দেখতে দেখতে আকাশজুড়ে পাহাড়ের মাথায় বনজঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে গড়ের সীমানা দেখা গেল৷

অবাক হয়ে আমি গিয়ার চেঞ্জ করতে ভুলে গেলাম৷ অ্যাকসিলেটর টিপতেও ভুলে গেলাম৷

জিপটা কট কট কট কট আওয়াজ করে একটা ঝাঁকি দিয়ে থেমে গেল৷

ঋজুদা সুইচ বন্ধ করে দিয়ে হাত তুলে আমাকে দেখাতে লাগল গড়ের সীমানা৷ যুদ্ধ করার জন্যে গড়ের দেওয়ালে যেসব ফুটো ছিল, তারপর দেওয়ালের উপর দিয়ে সৈন্যদের হেঁটে যাওয়ার জন্যে যে-সমস্ত রাস্তা ছিল, সবই দেখা যাচ্ছে৷

আরও একটু এগিয়ে গিয়ে জিপটা রেখে আমরা গড়ে উঠলাম৷ অনেকখানি পথ উঠতে হয়৷

একদল ময়ূর-ময়ূরী আমাদের দেখে ভর ভর করে ভারী ডানার আওয়াজ তুলে জঙ্গলের গভীরে চলে গেল৷ একটা ময়ূর বড়ো গাছের ডালে বসে বুকের মধ্যে চমকে দিয়ে ডাকল, কেয়াঁ-ক্কেয়াঁ-ক্কেঁয়া৷

ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া, টুঁই, হরিয়াল উড়ে যাচ্ছিল কোনাকুনি৷ নীচ থেকে বনমুরগি, তিতির, ছাতারে, বটের, ঘুঘু আরও কত কী পাখি ডাকছিল৷

গড়ের উপরে উঠেই থমকে গেলাম৷

এখান থেকে অদূরে অন্য একটি ছোটো গড় দেখা যাচ্ছিল৷

ঋজুদা বলল, ‘দেখ রুদ্র, ওটা পুরোনো গড়৷’ তারপরই বলল, ‘পালামৌ সম্বন্ধে তুই জানিস কিছু?’

আমি বললাম, ‘মানে তুমি কী বলতে চাইছ?’

ঋজুদা বলল, ‘তুই কোনো বই-টই পড়েছিস?’

আমি বাহাদুরি করে বললাম, ‘সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’৷’

‘বাঃ তবে তো পড়েইছিস৷ তবে সে পালামৌ আর আজকের পালামৌ-এ অনেক তফাত৷’

তারপরই ঋজুদা আমাকে জব্দ করার জন্যে বলল, ‘পালামৌ নামটা কী করে হল বলতে পারিস?’

আমি টক করে বলে দিলাম, ‘পল-আম্ম-উ—এই তিনটি দ্রাবিড় শব্দ নিয়ে পালামৌ৷ পালামৌ মানে দাঁত-বের-করা-নদী৷’

ঋজুদা দুষ্টু দুষ্টু চোখ করে আমার দিকে চেয়ে রইল৷

বলল, ‘করেছিস কী? এত তুই জানলি কী করে? আমি তো সেদিন ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে একটা বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে নামটা কী করে হল জানলাম৷’

আমি হাসছিলাম৷ জীবনে এই প্রথমবার ঋজুদাকে অন্তত একটা ব্যাপারে সমানে সমানে টেক্কা দিতে পারায় আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল৷

আমি কনফেস করলাম৷ বললাম, ‘আমি পড়িনি, ছোড়দি একটা বইয়ে পড়েছিল৷ আমি তোমার সঙ্গে এখানে আসছি শুনে ছোড়দিই আমাকে বলেছিল৷’

ঋজুদা বলল, ‘এই যে গড় দেখছিস, এই গড়ের পেছনেই উরঙ্গা নদী৷ বর্ষাকালে উরঙ্গাতে যখন বান ডাকে তখন উরঙ্গার বুকের কালো কালো পাথরগুলো দাঁতের মতো উঁচু হয়ে থাকে৷ চেরোদের দুর্গ ছিল এটা৷ দুর্গের উপর থেকে উরঙ্গাকে দেখে চেরোরা বলত, দাঁত-বের-করা-নদী৷ ওরা দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছিল—দ্রাবিড় ছিল ওদের ভাষা৷ পল-আম্ম-উ—এই তিনটি শব্দ মিলে হল পলাম্ম্যু৷ সাহেবরা তাকে চিবিয়ে করে দিল প্যালাম্যু৷ আমরা বলি, পালামৌ৷’

আমরা ওখানে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছি, এমন সময় টাঁউ টাঁউ টাঁউ করে ডাকতে ডাকতে একদল চিতল হরিণ পুরোনো দুর্গটার দিকের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এদিকে চলে এল রাস্তা পেরিয়ে৷

আমরা চুপ করে অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম৷

ততক্ষণে বেলা পড়ে এসেছিল৷ গরম আর নেই তখন৷ বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজ৷ সন্ধ্যাতারাটা শান্ত নীল নরম হয়ে ধীরে ধীরে দিগন্তরেখার উপরে উঠল৷ কয়েকদিন পরই পূর্ণিমা৷ একটু পরেই চাঁদ উঠবে৷

ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন মনে হচ্ছিল৷ ঝিরঝিরে মন্থর বাতাসে মহুয়া আর করৌঞ্জের গন্ধ৷ শাল ফুলের গন্ধও যেন মিশে গিয়েছিল ওইসব গন্ধের সঙ্গে৷ আধো-অন্ধকার জঙ্গলের আঁচলের গভীর ছায়ায় মধ্যে মধ্যে হাটিট্টি—টি-টি—করে হট্টিটি পাখি ডেকে ফিরছিল৷

কত কী ভাবনা মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে যাচ্ছে—লাট্টুর গায়ে লেত্তির মতো৷ এমন সময় ঋজুদা আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘চল রে রুদ্র, এবার নামি৷ জিপটা তো একেবারে উদোম জায়গায় একেবারে খোলা অবস্থায় পড়ে আছে৷ নীচে নেমে হয়তো দেখবি একজোড়া ভাল্লুক বসে আছে সামনের সিটে৷’

আমি হাসলাম৷ বললাম, ‘বলা যায় না৷ জিপটা আবার রেখেও এলাম তো একটা ঝাঁকড়া মহুয়া গাছের নীচে৷’

নীচে যখন নামলাম আমরা, তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে৷

জিপটার কাছে পৌঁছেছি, এমন সময় জিপের একেবারে পাশ থেকে একটা হুতোম প্যাঁচা দুরগুম দুরগুম দুরগুম করে ডেকে উঠল৷

আমি টর্চ জ্বালতেই প্যাঁচাটা আলোর চারপাশে আমাদের মাথার উপরে ঘুরে ঘুরে উড়তে লাগল৷

এমন সময় কমলদহের দিক থেকে একটা কীরকম গম্ভীর বুক-কাঁপানো আওয়াজ ভেসে এল৷ আওয়াজটা গড়ের দেওয়ালে, পাহাড়ে, বনে-জঙ্গলে গুমগুমানি তুলে প্রতিধ্বনিত হল৷

আমি কানখাড়া করে শুধোলাম, ‘কীসের ডাক ঋজুদা?’

ঋজুদা বলল, ‘চুপ কর৷ আবার শুনতে পাবি৷’

ঠিক৷ একটু পরেই ডাকটা আবার শোনা গেল৷ পর পর কয়েকবার৷

ঋজুদা হাসল৷ বলল, ‘এবার তুই সরে বোস, আমিই চালাই৷ দেখি বাঘবাবাজির সঙ্গে তোর মোলাকাত করানো যায় কি না৷’

এতক্ষণ বেশ ভালোই ছিলাম—কিন্তু ঋজুদার যে আমারই সঙ্গে বাঘবাবাজির মোলাকাত করানোর এত শখ কেন, তা বুঝলাম না৷ সত্যি কথা বলতে কী, আমার কেমন অস্বস্তি লাগল, যদিও ঋজুদার সঙ্গে টুম্বকাতে—বাই ফ্লুক—ইতিপূর্বে একটা চিতাবাঘ মেরেও ফেলেছিলাম৷ সে ব্যাটা বাঘ আত্মহত্যা করবেই—আমি ছাড়া তাকে মারবে এমন শিকারি সে পাবে কোথায়? দুঃখ এই যে, বেচারির মরেও স্বর্গলাভ হবে না৷ আমার মতো রংরুট শিকারি যাকে মারল, তার স্বর্গে যাওয়ার সব রুটই বন্ধ৷’

কমলদহের দিকে এগিয়ে চলছি আমরা৷ জিপটা থার্ড গিয়ারে চলছে৷ কাঁচা কাঁকরময় পাথুরে লাল ধুলোর রাস্তায় চাকাতে একটা কির কির শব্দ তুলে সে এগিয়ে চলেছে৷ হাওয়াতে ঝলক ঝলক গন্ধ আসছে নানা ফুলের৷

কমলদহের পাশে জিপটা থামিয়ে, আমার হাত থেকে টর্চটা নিয়ে, ঋজুদা এদিকে-ওদিকে ফেলতে লাগল৷ তারপর একটা কোটরা হরিণ বাঁ-দিকের পাহাড় থেকে ডেকে উঠতেই ঋজুদা আমার কাঁধে হাত দিয়ে ইশারা করে আমাকে নামতে বলেই, টর্চটা হাতে করে, কিন্তু না জ্বালিয়ে একটা সরু পথ ধরে কমলদহের দিকে কুঁজো হয়ে নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল৷ আমিও পেছন পেছন চলতে লাগলাম৷

হঠাৎ ঋজুদার পায়ের সামনে দিয়ে কী একটা প্রাণী সড় সড় করে শুকনো পাতার ভিতরে ভিতরে বাঁ-পাশ থেকে ডান পাশে চলে গেল৷ যেতে অনেক সময় লাগল৷

ঋজুদা বাঁ-হাত পিছনে এগিয়ে আমাকে দাঁড়াতে বলে, নিজেও একটু থমকে দাঁড়াল৷ না-দেখা প্রাণীটা চলে যেতেই ঋজুদা আবার এগোল৷

কমলদহের পাড়ে এসে দাঁড়াতেই, ঋজুদা দশ-পনেরো ডিগ্রি বাঁ-দিকে টর্চ ফেলল৷ কমলদহের দুধ-সাদা বালির পটভূমিতে কালো কালো বড়ো বড়ো পাথরগুলো আলোটাকে শুষে নিল যেন৷ দেখলাম সেই পাথরের উপরে বারোয়াড়ির দিকে মুখ করে একটা প্রকাণ্ড বড়ো পাটকিলেরঙা রয়াল বেঙ্গল টাইগার এক-গাল এক-গলা গোঁফ-দাড়ি নিয়ে বসে আছে৷

আলো পড়তে বিরক্ত মুখে বাঘটা একবার আমাদের দিকে তাকাল৷ তারপর হুলো বিড়ালের মতো গলা দিয়ে একটা ঘড়ঘড়—গড়গড় শব্দ করল৷ তবে শব্দটা অ্যামপ্লিফায়ারের সামনে বেড়াল গড়গড় করলে যেমন আওয়াজ হয়, তেমন৷

ঋজুদা আলোটা বাঘের গা থেকে সরিয়ে নিল৷ ফিসফিস করে বলল, ‘খালি হাতে বাঘের সঙ্গে ইয়ার্কি করা ভালো নয়৷’

আরেকবার আলোটা জ্বালিয়ে ঋজুদা বলল, ‘দেখ, ভালো করে দেখে নে রুদ্র৷’

একটু পরে আলোটা নিবিয়ে আমরা ফিরে আসতে লাগলাম জিপের কাছে৷ মাঝামাঝি এসেছি, এমন সময় কমলদহের ডান দিক থেকে কীরকম জোর দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ শুনলাম৷ অনেকগুলো দীর্ঘশ্বাসের৷

ঋজুদা বলল, ‘বুঝেছি৷’

বলেই, তাড়াতাড়ি জিপের দিকে এগিয়ে গেল৷ জিপে বসেই জিপ স্টার্ট করে একটু এগিয়ে গিয়ে জিপ থামিয়ে বাঁ-দিকে আলো ফেলল৷ আলোতে দেখি একদল বড়ো বড়ো বাইসন মাথা উঁচিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাদের পায়ের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বালিতে একটা বাইসনের বাচ্চা পড়ে আছে৷ তার পেটের কাছ থেকে, পায়ের কাছ থেকে বাঘ মাংস খেয়ে নিয়েছে৷ বাচ্চাটার কপালের কাছে, হাঁটুর কাছে, সাদা জায়গাগুলো রক্তে লাল হয়ে গেছে৷ আরও একটা জ্যান্ত বাচ্চা ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে বড়োদের পায়ের মধ্যে৷ ঋজুদা বলল, ‘বাঘ ওই পাথর ছেড়ে নেমে এলে ওর কপালে দুঃখ আছে৷ কাছে পেলে বাইসনেরা ওকে ছেড়ে দেবে না৷’

তারপরই বলল, ‘ব্যাপারটা বুঝলি?’

ব্যাপারটা বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না৷

তাই ঋজুদা আবার বলল, ‘আজই সন্ধের মুখে হয়তো বাঘটা বাচ্চাটিকে একলা পেয়ে মেরে দিয়েছিল৷ বাইসনের দল কাছেই ছিল, তারা সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে এসে বাঘকে ধাওয়া করে৷ বাঘ বুদ্ধিমান লোক৷ এতগুলো বাইসন দেখে ও আপাতত পাথরের উপর গিয়ে বসে গোঁফে তা দিতে দিতে মগজ হাতড়ে, কী করা যায় সেই বুদ্ধি বের করছে৷’

আমি শুধোলাম, ‘অতগুলো বাইসনের মধ্যে থেকে ও অর্ধভুক্ত বাচ্চাটাকে নিয়ে যেতে পারবে?’

‘বাঘের পক্ষে সবই সম্ভব৷ তবে ঝামেলা হবে বিস্তর৷ বাঘের পেটও ফেঁসে যেতে পারে৷ পেট থাকলে জীবনে অনেক খাবে, পেট ফেঁসে গেলে তো আর খেতে হবে না৷’

আমি বললাম, ‘এরকম অবস্থায় ওরা কতক্ষণ থাকবে?’

ঋজুদা হাসল৷ বলল, ‘ওরাই জানে৷ ওদের তো আর তোর বাবার মতো অফিসের তাড়া, কি তোর মতো স্কুলের তাড়া নেই—ওদের হাতে অফুরন্ত সময়—এই-ই ওদের রোজগার, খাওয়াদাওয়া সব৷ ওদের বেঁচে থাকলেই লড়তে হবে, লড়তে গেলেই মরতে হবে; খিদে পেলেই কষ্ট করতে হবে; ওদের বেঁচে থাকাটাই একটা প্রধান কাজ—এবং বেশ কঠিন কাজ—সে হরিণই হোক আর বাঘই হোক৷’

একটু এগিয়ে গিয়ে পাইপ ধরাবার জন্য, ঋজুদা জিপটা একটু থামাল৷

এই ফাঁকে আমি শুধোলাম, ‘তোমার পায়ের সামনে দিয়ে সড়সড় করে চলে গেল, ওটা কী জিনিস ঋজুদা?’

ঋজুদা অবাক গলায় বলল, ‘সে কী রে? এখনও বুঝিসনি? সাপ৷’

আমি লজ্জিত হয়ে বললাম, ‘বুঝেছিলাম যে সাপ, কিন্তু অতবড়ো?’

ঋজুদা এবার স্বগতোক্তির মতো বলল, ‘হ্যাঁরে, অতবড়ো গহুমন সাপ আমিও বেশি দেখিনি৷’

আমি চোখ বড়ো বড়ো করে বললাম, ‘তোমাকে কামড়াল না?’

ঋজুদা পাইপ-মুখেই হেসে উঠল৷ বলল, ‘খামোখা কামড়াতে যাবে কেন? আমি কি চ্যুয়িংগাম না চকোলেট?’

আমি বললাম, ‘ধেৎ৷’

এরপর জিপটা ঘুরিয়ে নিয়ে আমরা ফের বাংলোর দিকে চললাম৷

পথে যে কত জানোয়ার দেখলাম তা কী বলব৷ ঝাঁকে ঝাঁকে চিতল হরিণ৷ দুটো কোটরা৷ একদল শম্বর৷ একটা বড়ো দাঁতাল একরা শুয়োর৷ খরগোশ৷ একটা শজারু৷ শজারুকে ওরা এখানে বলে সাহিল৷

বেতলার চেকনাকার কাছে প্রায় চলে এসেছি, এমন সময় সামনে রাস্তার পাশে মড়মড় শব্দ হল৷

ঋজুদা জিপটা দাঁড় করাল৷

রাস্তার পাশেই, জঙ্গলের মধ্যে সেই দাঁতাল হাতিটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডাল ভেঙে খাচ্ছে৷ রাস্তার উপরেও ভাঙা ডাল এসে পড়েছে৷

ঋজুদা বলল, ‘ঝামেলা করল৷ খালি হাতে এসব ঝামেলা আমার বরদাস্ত হয় না৷’

আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে কোনো অস্ত্রই আনতে দেয় না?’

ঋজুদা বলল, ‘না৷ পিস্তলও না৷’

‘যদি হাতি কাউকে মেরে দেয়?’

‘মেরে দেবে৷ যারা শখ করে জানোয়ার দেখতে আসবে তাদের এই ঝুঁকি নিয়েই আসতে হবে৷ যাদের ভয় লাগে তাদের না আসাই ভালো৷’

আমাদের ফিসফিসানি শুনতে পেয়ে হাতিটা জঙ্গলের আড়াল ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল৷ দাঁড়িয়েই শুঁড় উঁচু করে বিকট এক প্যাঁ-অ্যা-অ্যা আওয়াজ করল৷ চারদিকের বন-পাহাড়ে সে-আওয়াজ ছড়িয়ে গেল৷

পরক্ষণেই কী হল বোঝবার আগেই, দেখি, হাতিটা শুঁড় তুলে সোজা জিপের দিকে চার্জ করে আসছে৷

তখন আর ব্যাক করে পালিয়ে যাওয়ারও সময় নেই৷

আমি শুধু শুনলাম, ‘রুদ্র শক্ত করে ধরে বোস জিপ, পড়ে যাস না৷’ তারপরই শুনলাম, ‘তবে রে…৷’

‘তবে রে’ বলেই ঋজুদা জিপের হেডলাইট দুটো ডিমার থেকে ব্রাইটার করে সেকেন্ড গিয়ারে দিয়ে অ্যাকসিলারেটর প্রচণ্ড জোরে চেপে ইঞ্জিনের একটা কানফাটানো গোঁ গোঁ আওয়াজ করে তার সঙ্গে পুরো হর্ন টিপে হাতির দিকে সোজা জিপ চালিয়ে দিল৷ মনে হল, হাতিটা যে শক্তের ভক্ত, নরমের যম, একথা ঋজুদা বুঝে ফেলেছে৷

আমার মনে হল, জিপটাও একটা হাতি হয়ে গেছে৷ তফাতের মধ্যে খালি শুঁড় আর ল্যাজটা নেই৷

হাতিও দৌড়ে আসছে, জিপটাও দৌড়ে যাচ্ছে৷ হাতির প্যাঁ-অ্যা-অ্যা-অ্যা আর জিপের প্যাঁ-অ্যা-অ্যা-অ্যা মিলিয়ে সমস্ত বেতলার জঙ্গল বেতালা আওয়াজে ভরে গেছে৷

আড়চোখে দেখলাম, ঋজুদা শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে৷ পাইপটাতে এমন কামড় দিয়েছে যে, মনে হচ্ছে এখুনি ভেঙে যাবে বুঝি পাইপটা৷ আর সোজা তাকিয়ে আছে হাতিটার দিকে৷ ঋজুদার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে৷ মনে হচ্ছে, খুব বিরক্ত হয়েছে ঋজুদা৷

একেবারে শেষ মুহূর্তে যখন আর আমাদের বেঁচে থাকার কোনোই সম্ভাবনা নেই—হাতির গায়ে জিপসুদ্ধু বডি-থ্রো দেবার ঠিক আগে এক অদ্ভুত কাণ্ড করল ঋজুদা৷

হঠাৎ—একেবারেই হঠাৎ গিয়ার চেঞ্জ করে, থার্ড গিয়ারে দিয়েই ডান দিকে বাঁই-বাঁই করে পুরো স্টিয়ারিং কাটিয়ে রাস্তা ছেড়ে পাশের শুকনো জঙ্গলে নেমে গেল৷ একরাশ ধুলো উড়ে গেল৷ ধুলো আগে থেকেই উড়ছিল৷ ধুলোয় মাথা-মুখ ঢেকে গেল, অতবড়ো হাতিটা ধুলোর মেঘে ঢেকে গেল৷

আমি আমার সামনের হ্যান্ডেল দু-হাতে ধরে পিছনে তাকিয়ে যা দেখলাম, তা বলার নয়৷ দেখি অতবড়ো হাতিটা অতজোরে দৌড়ে আসার পর তার আক্রমণের বস্তুটি হঠাৎ হাওয়া হয়ে যাওয়ায় সামনের ও পিছনের পায়ে প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষল৷ ব্রেক কষতেই সমস্ত শরীরটা সামনে ঝুঁকেই নড়ে উঠল৷ পরক্ষণেই হাতিটা অ্যাবাউট টার্ন করে জিপের পিছনে আবার তেড়ে এল৷ এবার মনে হল দাঁতাল সত্যিই খেপে গেছে৷

ঋজুদা এদিকে গাছ কাটিয়ে কাটিয়ে বড়ো রাস্তায় ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করছে৷ বাঁ-দিকে স্টিয়ারিং কাটিয়ে প্রায় বড়ো রাস্তায় উঠে এসেছেও, এমন সময় দেখি একটা পাহাড়ি নালা৷ নালাটায় জল নেই, কিন্তু বড়ো বড়ো পাথর, কাঁটাঝোপ বালি এবং ওদিকে পাড় বেশ খাড়া৷

এদিকে হাতি এসে গেছে কাছে৷ এসে যাচ্ছে৷ এসে গেল৷



সার্কাসে মরণকূপে মোটরসাইকেল চালানো দেখেছিলাম, ছোটোবেলায়! মনে হল, আজ ঋজুদাই মোটর সাইক্লিস্ট৷ আজ আর বাঁচা নেই কপালে৷ এত জঙ্গলের, এত জানোয়ার ঘেঁটে এসে শেষে কিনা এই খেলাচ্ছলে দেখতে আসা অভয়ারণ্যের মধ্যেই ঋজুদার প্রাণ যাবে! সঙ্গে আমারটাও!

মায়ের মুখটা একেবারে ভেসে উঠল চোখের সামনে! ছোড়দির মুখটা৷ ঋজুদার চোখের সামনে কার মুখ ভেসে উঠেছিল জানি না৷ হয়তো হাতির শুঁড়টাই৷ কিন্তু দেখলাম মুহূর্তের মধ্যে ঋজুদা স্পেশাল গিয়ার চড়াল জিপে, চড়িয়েই এক অদ্ভুত কাণ্ড করল৷ নালা পেরোবার চেষ্টা না করে—নালা ধরে জঙ্গলের গভীরে চলতে লাগল৷

আমি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম৷

হাতিটা নালার পাশে এসেই দাঁড়িয়ে পড়ে আবার ব্রেক কষল৷ ব্রেক কষেই, নালায় নেমে আমাদের পিছনে ধেয়ে এল৷

ঋজুদা দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলল, ‘এমন বদমাশ হাতিকে মেরে দেওয়া উচিত৷’

আমার তখন কানে কিছু শোনার বা দেখার অবস্থা ছিল না৷

ঋজুদা কাঁটাঝোপের উপর দিয়ে, ঘাস-পাথর-বালির উপর দিয়ে জিপ চালিয়ে যাচ্ছে৷ সাইলেন্সার পাইপে সড়সড় আওয়াজ হচ্ছে৷ একবার বোধ হয় পাথর লাগল নীচে কোথাও৷

বিচ্ছিরি চিৎকার করছে হাতিটা—নানারকম ঘোঁত ঘোঁত ফোঁৎ ফোঁৎ আওয়াজ৷

ঋজুদার চোখ বাঁ-দিকে ছিল৷ হাতিটা আর জিপের মধ্যে বড়োজোর কুড়ি গজ ফাঁক এখন হঠাৎ পুরো বাঁ-দিকে স্টিয়ারিং কাটিয়ে ঋজুদা নালা পেরিয়ে জঙ্গলে উঠে এল অনেকগুলো শালের চারা পটাপট করে ভেঙে৷ উঠে না এসে গড়িয়েও নীচে পড়তে পারত জিপ, হাতির ঘাড়ে৷ প্রায় নব্বুই ডিগ্রি কোণে জিপ আকাশের দিকে মুখ করে কোনোক্রমে পরের ল্যাজ-ধরে ওঠার মতো করে উঠল৷

জঙ্গলে উঠেই এবার বাঁ-দিকে গাছ কাটিয়ে, পাথর বাঁচিয়ে ঋজুদা যে-পথ ছেড়ে আমরা নেমেছিলাম, সেই পথের দিকে আন্দাজে আন্দাজে অন্ধের মতো এগোতে থাকল৷

ইঞ্জিন গরম হয়ে ধোঁয়া বেরোতে লাগল৷ একে গরমের দিন, তারপর ইঞ্জিন ও গাড়ির উপর এই অত্যাচার৷ রেডিয়েটরে জল ফুটছিল বগ বগ করে৷

আমি ভেবেছিলাম যে, হাতিটা নালা পেরিয়ে আর এপাশে আসবে না৷

ঋজুদা তাড়াতাড়ি বলল, ‘তুই পিছনে দেখ রুদ্র৷ দেখ তো এখনও আসছে কি না?’

আমি তাকিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ৷’

ঋজুদা বিশ্বাস করল না৷ বলল, ‘বলিস কী রে? এখনও?’

আমি ভয় ভয় গলায় বললাম, ‘কী হবে?’

ঋজুদাও তাকাল ঘাড় ফিরিয়ে৷ দেখলাম, তিনি তবুও আসছেন হন্তদন্ত হয়ে—একটা এসপার-ওসপার করবার জন্যে৷

ঋজুদা সামনে রাস্তাটা দেখতে পেয়েছিল৷ রাস্তার পাশেই জঙ্গলের মধ্যে অনেকখানি সমান ফাঁকা জমি৷ খোয়াই-টোয়াই নেই৷ দুটো-একটা শালের চারা আছে শুধু৷

ঋজুদা বলল, ‘আমরা এমন করে যদি পালিয়ে যাই, তবে ভবিষ্যতে ও জিপ দেখলেই এমনি করে ঝামেলা পাকাবে৷ যাওয়ার আগে ওকে একটু শিক্ষা দিয়ে যেতে হবে৷’

ঋজুদার উপর আমার খুব রাগ হল৷

আমার গলায় ততক্ষণে ভয়ে থুথু আটকে গেছিল৷ এ যাত্রা প্রাণে বেঁচেছি, ফের বাংলোয় গিয়ে কোথায় পোলাও, মাংস, রায়তা এসব খাব, মোহনদারা সকলে আসবেন বলেছেন ডালটনগঞ্জ থেকে, শান্টুদারা হিপাদোহর থেকে, এখন হাতিকে শিক্ষা দেওয়ার কী দরকার? তুমি কি হাতির দিদিমণি?

কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলাম না৷ বলার সময়ও ছিল না৷ তিনি আসছেন৷ এবার আর দৌড়ে দৌড়ে নয়, গজদন্ত সামনে নিয়ে গজগমনে গজপতি আসছেন৷

ঋজুদা ওই সমান জায়গাটাতে হাতির দিকে পিছন ফিরিয়ে জিপ দাঁড় করিয়ে দিল৷

আমাকে বলল, ‘যখন একেবারে কাছে এসে যাবে, প্রায় ঘাড়ে পড়ার মতন, তখন বলবি৷’

দেখলাম স্পেশাল গিয়ার ছাড়িয়ে নিয়েছে ঋজুদা, ফার্স্ট গিয়ারে রেখেছে জিপটাকে আর স্টিয়ারিংটা পুরো ডান দিকে কাটিয়ে তৈরি হয়ে বসেছে৷

হাতিটা আমাদের দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে এবার গজগমন ছেড়ে দুলকি চালে পা তুলে তুলে জোরে এগিয়ে আসতে লাগল৷ এসে গেছে, এসে গেছে; শুঁড় তুলেছে সামনে৷ আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘ঋজুদা…!’

ঋজুদা সঙ্গেসঙ্গে জিপ চালিয়ে দিল৷ হতভম্ব হাতিটার সামনে, আলো জ্বালানো, হর্ন বাজানো ঘুরন্ত জিপটা বাঁই বাঁই করে ঘুরতে লাগল৷ পুরো স্টিয়ারিং কাটানো অবস্থায় জিপটাকে চক্রাকারে অল্প জায়গার মধ্যে ঘোরাতে ঘোরাতে বৃত্তটাকে বড়ো করতে করতে গিয়ার বদলে যেতে লাগল ঋজুদা৷ একে একে ফার্স্ট থেকে টপ গিয়ারে এল৷ এখন জিপটা ঘুরছে একটা উল্কাপিণ্ডের মতো৷ জিপে বসে আমাদেরই মাথা ঘুরে যাচ্ছে; তা দেখে হাতির মাথা তো ঘুরবেই৷

হাতিটা একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল৷

এই যন্ত্রকে চিরদিন সামনে, এবং কখনো কখনো পিছনে যেতে দেখেছে ও৷ কিন্তু এই ইঞ্জিনের এবং হর্নের বিকট আওয়াজে, হেডলাইটের ঘুরন্ত আলোয় এবং পুরো যন্ত্রটার ক্রমান্বয়ে গুবরে পোকার মতো পাক খাওয়া ব্যাপারটা তার সমস্ত বুদ্ধি দিয়েও হাতিটা বুঝতে পারল না৷ তা ছাড়া জিনিসটা এত তাড়াতাড়ি ঘুরছে ও এত আওয়াজ করছে যে, কোনখানটায় কেমন করে যে সে শুঁড় দিয়ে বাগে আনবে তাই তার মগজেই আসছিল না৷



এদিকে বৃত্তটা বড়ো করতে করতে ঋজুদা হাতিটাকে পিছু হটিয়ে দিচ্ছে—এক-পা, এক-পা করে এই ঘূর্ণমান জানোয়ারের কবলে পড়ে হাতি ব্যাকওয়ার্ড মার্চ করছে৷ এইভাবে যে কখন সে নালার খাড়া পাড়ে এসে পৌঁছেছে—তা হাতিও বোঝেনি, ঋজুদাও না৷

হঠাৎ এক কাণ্ড হল৷ পিছন দিকে হাঁটতে হাঁটতে হাতি চিতপটাং হয়ে নালার মধ্যে পড়ে গেল৷ হাতির চিতপটাং পড়ে যাওয়া যে না দেখেছে, সে কখনো জানতে পারবে না যে, তা দেখে না হেসে উপায় নেই৷

ওই বিপদের মধ্যেও আমি হি-হি করে হেসে উঠলাম৷

হাতিটা নালায় পড়ে যেতেই—ঋজুদা জিপের মুখ রাস্তার দিকে সোজা করে রাখল৷

অধঃপতিত অবস্থা থেকে নিজচেষ্টায় উত্থিত হয়েই হাতিটা আর ঝামেলা না করে প্যাঁ-অ্যা-অ্যা-অ্যা করে ডাকতে ডাকতে জঙ্গলে দৌড়ে গেল উলটোদিকে৷ অতবড়ো জানোয়ারের পেছনে একটা কেলে টিকটিকির মতো ল্যাজটা নড়তে নড়তে গেল৷

এবার ঋজুদা হাঁফ ছেড়ে বেতলার দিকে এগিয়ে চলল৷

বড়ো রাস্তায় পড়েই সামনে বেতলার চেকপোস্ট দেখা গেল৷

হেডলাইটের আলোতে দেখলাম সেখানে রীতিমতো গাড়ির প্রসেশান দাঁড়িয়ে আছে৷ সকলেই নাকি ওখান থেকে আমাদের এবং হাতির এই বিনাটিকিটের সার্কাস দেখে খুবই মজা পেয়েছেন৷ ভিড়ের মধ্যে মোহনদা, শান্টুদা, রমেনদা এবং নিমাইদাকে দেখে খুবই ভালো লাগল৷

একজন ফরেস্ট গার্ড এসে বলল ঋজুদাকে, ‘আপনি হর্ন বাজাচ্ছিলেন কেন জঙ্গলে? জানেন না এটা বেআইনি?’

ঋজুদা হেসে বলল, ‘এখানে হর্ন না বাজালে যে স্বর্গে গিয়ে বাজাতে হত বাবা!’

গার্ড বলল, ‘নহি, নহি৷ আপ ঠিক কাম নেহি কিয়া৷ হাম বড়া সাব কা রিপোর্ট করে গা৷’

ঋজুদা পার্স থেকে একটা কার্ড বের করে বলল, ‘তুম মেরা পেয়ার রাখখো, ঔর ই কার্ড রাখখো বড়া সাব কা লিয়ে৷’

ইতিমধ্যে মোহনদা এসে পড়লেন৷ ডালটনগঞ্জের মোহন বিশ্বাসকে এখানে সকলেই চেনেন৷

মোহনদাকে গার্ড বলল, ‘আপনি এঁকে চেনেন হুজৌর?’

মোহনদা বললেন, ‘আমারই জিপ চালাচ্ছেন আর আমি না চিনব কী করে?’

তারপর মোহনদা ঋজুদাকে দেখিয়ে গার্ডকে বললেন, ‘ওঁকে সকলেই চেনেন৷ তুমি ওঁকে জঙ্গলের নিয়মকানুন শেখাতে যেয়ো না—বড়োসাহেবের কানে গেলে তুমিই বকুনি খাবে৷’

ঋজুদা বলল, ‘ছাড়ো ছাড়ো মোহন৷ ক্যান্টিনে চলো, সবাই মিলে একটু চা খাওয়া যাক৷’



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *