ঋজুদার সঙ্গে অচানক মার-এ

ঋজুদার সঙ্গে অচানক মার-এ



বেলা যদিও হয়েছে, আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম তার পুবে একটি পাহাড় ছিল৷ সেটি ডিঙিয়ে আসতে সূর্যের সময় লাগল প্রায় ঘণ্টাখানেক৷ আমরা বাংলো থেকে অনেকক্ষণ হলই বেরিয়েছি৷ সূর্যটা সবে উঠছে পাহাড়ের ওপাশে৷ তখনও এই অচানক মার-এ শীত শীত ভাব আছে এই মার্চ মাসের মাঝামাঝিতেও৷

কলকাতার মানুষমাত্রই শীতকাতুরে৷ শীত বলতেও সেখানে মাত্র দেড়-দু-মাস৷ তাও তাকে শীত বললে উত্তর ও মধ্যভারতের এমনকী বিহার, ওড়িশা, অসমের মানুষেরাও হাসেন৷

কাল সন্ধেবেলাতেই আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি৷

আমরা মানে, ঋজুদা, আমি আর ভটকাই৷ তিনজনে দাঁড়িয়েছিলাম একটা টিলার উপরে, অচানক মার বনবাংলো থেকে মাইল দুয়েক উত্তরে৷ সামনে দিয়ে দুধলি সাপের মতন এঁকেবেঁকে চলে গেছে একটি পাহাড়ি নদী৷ তার বুকের নুড়িময় সাদা বুকে অতি ধীরে ধীরে পাহাড় টপকানো সূর্যর কমলারঙা আভা লাগছে, যেমন করে স্থলপদ্মর পাপড়িতে সকালে লালের ছোপ লাগে৷ এমন ধীরে, যে বোঝা পর্যন্ত যায় না৷

রোদ আরও জোর হলে সেই কমলা ভাবটি কেটে যাবে৷ দুধলি অস্পষ্টতা মুছে গিয়ে নদীর জল সাদা হবে, বালির রং গেরুয়া, পাথরের কালো৷ তখনও রাতের শিশিরে বনজঙ্গল, দূরের ঝিকারপানির পাহাড় সব ভিজে আছে৷ এই বসন্তের ভোরের বন পাহাড় নদীর এক আশ্চর্য গন্ধ ও মোহ আছে, মুগ্ধতাও৷

তিতির, বটের ও ছাতারে ডাকছে চারধার থেকে৷ টিয়া আর চন্দনার ঝাঁক শন শন করে উড়ে যাচ্ছে ঝাঁক ঝাঁক সবুজ তিরের মতন৷ মাথার উপর দিয়ে৷ এমনই ব্যস্তসমস্ত হয়ে, যেন কোনো খুবই জরুরি খবর তাদের পৌঁছে দিতে হবে এখুনি কারও কাছে৷

রাতের সব পাখিরা এখন চুপ৷ একেবারেই চুপ৷ ধীরে ধীরে পাহাড়শ্রেণির পেছনে পুবেরর আকাশ লাল হচ্ছে৷ আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কতকিছু ঘটবার সম্ভাবনাও যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে৷ অন্ধকার রাত পোয়ালে, সবকিছু স্পষ্ট, আলোকময় করে, রাতের সব ভয় ও অনিশ্চিতি দূর করে একটি দিন আসছে অনেক আশা নিয়ে৷

আমরা মানে, আমি, ভটকাই আর ঋজুদা দাঁড়িয়েছিলাম কতকগুলো কালো পাথরের স্তূপের পাশে৷ এইরকম স্তূপকেই পূর্ব আফ্রিকার ঘাসের দিগন্তলীন সমুদ্র সেরেঙ্গেটিতে বলে ‘কোপি’৷ বানান অবশ্য Kopje৷

আফ্রিকার সোয়াহিলি ভাষার ব্যাপারই আলাদা৷ ডাক্তারি শাস্ত্রে যেমন অনেক শব্দেরই আগে একটি করে ‘p’ যোগ করে দিতে হয়; যেমন নিউমোনিয়া, থাইসিসের (টি.বি).) বানান আরম্ভ হয় ‘p’ দিয়ে, তেমনই সেখানেও অনেক শব্দের আগে ‘N’ বসে৷ অদ্ভুতভাবে উচ্চারণ করে তারা শব্দগুলো৷ যেমন Ngorongoro, Ndutu, অথচ উচ্চারণ গোরোংগোরো, এবং ডুটু৷

এসব কথা আমি, ঋজুদা, আর তিতির জানি৷ ভটকাইচন্দ্র তো মাত্র সেদিন ঢুকেছে আমাদের দলে৷ তাও আমারই লাগাতার সুপারিশে৷ আফ্রিকাতে তো ও যায়নি৷ ‘গুগুনোগুম্বারের দেশে’-তে অবশ্য শুধুই আমি আর ঋজুদাই গেছিলাম৷ তারপর ভুষুন্ডার বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নিতে পরে আবারও যখন ‘রুআহা’-তে গেছিলাম তখন তিতির গেছিল আমাদের সঙ্গে৷ তাই ভাবছিলাম, ভটকাইকে আফ্রিকার কথা বলে লাভ নেই৷ এমনিতেই তো ওর আগবাড়ানো মাতব্বরি আর ডেঁপোমিতে আমি একেবারেই বিরক্ত৷ ঋজুদা যে ওকে শাসন কেন করে না জানি না৷ তিতির এখন দিল্লিতে পড়াশোনা করছে, তাই কিছুদিন হল আমাদের সঙ্গ দিতে পারবে না৷

‘এটা কী নদী? ঋজুদা?’

‘মানে?’

‘মানে, নদীর নামটা কী? তুমি তো এর আগে অনেক বারই এসেছ৷’

ফাটা শুরু হল সাতসকালেই৷ ভটকাইয়ের লাগাতার কথার ধানিপটকা৷ এই চুপ করে দাঁড়িয়ে আমরা মধ্যপ্রদেশের এই অচানক মার-এর আশ্চর্য সুন্দর এক চৈত্রসকালের শান্তিতে যে বুঁদ হয়েছিলাম, সেই শান্তি ছিঁড়েখুঁড়ে গেল৷

ঋজুদার পাইপের ইংলিশ গোল্ডব্লক তামাকের গন্ধে এই মিশ্রগন্ধী সকাল আরও সুগন্ধি হয়ে উঠেছিল৷

পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে ঋজুদা বলল, ‘মনিয়ারী কৈরাহা৷’

‘বাঃ৷’

আমি বললাম অজানিতেই, ‘কী সুন্দর নাম! নদীর নাম মনিয়ারী কৈরাহা?’

‘হ্যাঁ৷’

‘আর সামনে ওই যে পাহাড়টা দেখছিস ওটার নাম ঝিকারপানি৷’

‘তুমি না বললে বিন্ধ্যপর্বতমালা৷’ ভটকাই ফুট কাটল৷

‘তাই তো৷ পর্বতমালা মানেই তো অনেক পর্বতের সমষ্টি৷ পর্বতের মধ্যে কত শত পাহাড় থাকে৷ তাদের নামও থাকে৷ এই ঝিকারপানিরই মতো অসংখ্য নামও দেয় স্থানীয় মানুষেরা তাদের৷ একেকটি পাহাড়ের নামে, নদীর নাম৷ আর শুধু বিন্ধ্যই তো নয়৷ মাইকাল পর্বতমালাও আছে ডান দিকে৷’

তারপর পাইপে একটা টান লাগিয়ে বলল, ‘অমরকণ্টকের নাম শুনেছিস?’

‘হ্যাঁ৷’ ভটকাই বলল৷

তারপর বলল, ‘জ্যাঠাইমা পটলাদাদের সঙ্গে সেখানে তীর্থ করতে গেছিলেন একবার৷ আমি যখন ছোটো ছিলাম৷’

‘তুই এখনও ছোটোই আছিস৷’ ঋজুদা বলল৷

‘যদিও পেকে ঝুনো হয়ে গেছিস৷’ আমি বললাম৷

ঋজুদা বলল, ‘তুই ভুল বললি রুদ্র৷ বল, এঁচড়ে-পেকে গেছে৷’

‘ঠিক তাই৷’

‘ফুঃ! সব এঁচড়ই আজকাল পাকা৷ কলকাতার কোনো বাজারে জেনুইন এঁচড় কি আর পাওয়া যায়? কারবাইডে পাকানো কাঁঠালই চলে এঁচড় হিসেবে৷’

‘তাও ভালো৷ আমার তো মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় যে তোকে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাই৷’

‘তার মানে?’

ভটকাই তার খরগোশের মতন বড়ো বড়ো কান দু-টি তুলে আমাকে আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করল৷

‘মানে আবার কী? কারবাইডে না পাকিয়ে কিল মেরে মেরেও যে এঁচড়কে কাঁঠাল করা যায় তা কি জানিস?’

ভটকাই আমার দিকে একটি জ্বলন্ত চাউনি ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘ঋজুদা, সকালেই আরম্ভ করেছে কিন্তু তোমার অরিজিনাল চেলা৷ আসল ব্যাপারটা কী জান তো?’

‘কী?’

‘সেই নিনিকুমারীর মানুষখেকো বাঘ মারতে যাওয়ার সময়ে আমার সাহস এবং এলেম দেখার পর থেকেই ও জে৷’

‘জে মানে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম৷

‘জে মানে জান না? জে—জেলাসি৷ ঈর্ষা৷ পিওর অ্যান্ড সিম্পল ঈর্ষা৷ আরে ঈর্ষা করেই তো বাঙালি জাতটা গোল্লায় গেল৷ আমাকে ঈর্ষা না করে কী করে আমার মতো ঈর্ষণীয় হতে পারিস তার চেষ্টা কর, ভালো কাজে সময় ব্যয় কর, উন্নতি হবে৷’

ঋজুদা বলল, ‘চল৷ এদিকটা মোটামুটি দেখা হল তবে ব্রেকফাস্ট-এর পরে সারাদিনের মতো বেরোতে হবে চারধার ভালো করে দেখার জন্যে৷’

ভটকাই বলল, ‘একেই তো বলে scouting৷ তাই নয়?’

ঋজুদা কথা না বলে, মাথা নাড়ল৷

আমরা অচানক মার বনবাংলোর দিকে ফিরে চললাম৷

‘এতক্ষণে হয়তো শিকারি ছখু বাইগা এসে বসে আছে৷’ আমি বললাম৷

‘হুঁ৷’ ঋজুদা বলল৷

তারপর বলল, ‘ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার ওসমানসাহেব ব্রেকফাস্ট করবেন আমাদের সঙ্গে৷ অচানক মার-এর ম্যান-ইটিং টাইগার সম্বন্ধে পুরো ব্রিফিং করে যাবেন আমাদের৷ যদিও গত মাসে যখন কলিয়ারির কাজে এখানে এসেছিলাম, কনসার্ভেটরসাহেব মোটামুটি জানিয়েছেন, যা জানানোর৷ মাত্র তিন মাসে পনেরোটি মানুষ খেয়েছে বাঘটা৷ অনেক মানুষখেকো বাঘ ও লেপার্ড দেখেছি, মেরেওছি কম নয়৷ কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে এত মানুষ আর কোনো মানুষখেকো মেরেছে বলে জানি না৷ আমার অভিজ্ঞতাতে অন্তত নেই৷’

‘বাঘটার কোনো wound আছে নিশ্চয়ই, যে কারণে মানুষের মতন প্রতিরোধহীন প্রাণী ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী শিকার করারই ক্ষমতা তার নেই৷’ আমি বললাম৷

ঋজুদা পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে বলল, ‘Could be!’

আমরা টিলা থেকে নেমে আস্তে আস্তে অচানক মার বাংলোর দিকে ফিরে যেতে লাগলাম৷ আমরা নিরস্ত্র৷ শুধু ভটকাইয়ের কাঁধে বারো বোরের দোনলা বন্দুক৷ ঋজুদার পারমিশনে আমাদের খাওয়ার জন্যে একটা মাত্র মুরগি অথবা খরগোশ মারার অলিখিত পারমিট সঙ্গে নিয়ে এসেছে সে৷

বন্দুকটা কিন্তু দারুণ৷ ইটালিয়ান বন্দুক৷ ব্যারেটা৷ ওভার-আন্ডার৷ মানে বন্দুকের নল দু-টি পাশাপাশি নয়৷ উপরে-নীচে৷ ইটালির ব্যারেটা কোম্পানিতে নিজের হাতের ও কনুইয়ের দৈর্ঘ্য, কবজি থেকে তর্জনীর দূরত্ব, নিজের মুখের মাপ সব পাঠিয়ে custom built করিয়েছিল ঋজুদা এটিকে বহুদিন আগে৷ পয়সা অবশ্য ঋজুদা দেয়নি৷ আমরা হাজারিবাগের মুলিমালোঁয়ার অ্যালবিনো রহস্য ভেদ করার পরে বিষেনদেওবাবু ঋজুদাকে জোর করে প্রেজেন্ট করেছিলেন৷ তখনকার দিনেই আমাদের দেশের টাকাতে লাখ খানেক টাকা দাম পড়েছিল৷ ওঁদের অভ্র রপ্তানির পয়সা ছিল অঢেল৷ বিদেশি মুদ্রাতে দিতে কোনো অসুবিধেও হয়নি৷

‘সকালে এক কাপ চা না খেয়ে ভদ্রলোকের পক্ষে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়৷ ঘুম পাচ্ছে এখনও আমার৷’ ভটকাই বলল, ব্যাজার মুখে৷

আমি হাসলাম৷

‘হাসির কী হল এতে? তুমিও কি সকালে চা খাও না? নাকি রবীন্দ্রনাথের মতন নিমপাতার রস খাও?’ ভটকাই বলল৷

‘না৷ সেজন্যে নয়৷ নিজেকে ভদ্রলোক বললি তো! তাই৷ তা ছাড়া, সারাটা জীবনই তো তুই ঘুমোলিই৷ ঘুম থেকে উঠলি আর কখন? কুম্ভকর্ণ incarnated, তোকে মাধবস্যার বলতেন না স্কুলে? মনে নেই?—এই যে বৎস ভটকাই, ঘুম কি ভাঙল? তারপরই মাধবস্যার আমাদের বলতেন, ওরে, তোরা ওকে একটু চটকে দিয়ে দেখ তো মটকা মেরে আছে, না সত্যিই ঘুমোচ্ছে? মাধবস্যারের সেই কথা থেকেই তো, ওরে ওরে ভটকাই আয় তোরে চটকাই এই স্লোগানের উদ্ভব৷’

ঋজুদা বলল, ‘তাই? স্লোগানটা শুনেছিলাম কিন্তু প্রেক্ষাপট জানতাম না৷’

তারপর বলল, ‘চল ফিরে বাংলোতে৷ গরম গরম পরোটা, ডিমের ভুজিয়া, বেগুন ভাজা লাল করে, সঙ্গে শেওতারাই-এর কালাজামুন৷’

ভটকাই বলল, ‘আর বিলাসপুরের বেঙ্গল সুইটস-এর সন্দেশের কথাটাই ভুলে গেলে৷ এস.ই.সি.এল.-এর সুভাষ চৌধুরীসাহেব আনিয়ে দিলেন না?’

ঋজুদা বলল, ‘ঠিক৷’

আমি বললাম, ‘ভারি গুণীমানুষ কিন্তু ভদ্রলোক৷ কী দারুণ ওড়িয়া এবং হিন্দি বলেন৷’

ঋজুদা বলল, ‘চৌধুরীসাহেব আবার মামুলি হিন্দি নয়, একেবারে দূরদর্শনের আগমার্কা হিন্দি বলেন৷’

‘কীরকম?’

‘গতবারে আমাকে স্টেশানে তুলে দিতে এসে একজন চেকারকে বিলাসপুর স্টেশানে শুধিয়েছিলেন, বম্বে-হাওড়া মেইলকি স্থিতি ক্যা হ্যায়?’

‘মানে?’ ভটকাই বলল৷

‘মানে, ট্রেনটার অবস্থিতি আর কী! কত লেট আছে? আদৌ লেট আছে কি না এবং দুর্গ থেকে ছেড়ে এসেছে কি না৷’

‘দুর্গ! কোথাকার দুর্গ?’ ভটকাই বলল৷

সকাল সকাল বাগে পেয়েই একটু কড়কে দিলাম ওকে৷ যাকে বলে ‘nipped in the bud’৷ বললাম, ‘ওরে মূর্খ! সাহিত্য বা বিজ্ঞান এসব তো কিছু পড়িসইনি, ভূগোলটাও কি পড়িসনি? মধ্যপ্রদেশে যে দুর্গ (দুর্গ) বলে একটি বড়ো জায়গা আছে তাও জানিস না? জায়গাটার নাম দুর্গ, পালামৌর বেতলার দুর্গ নয়৷’





অচানক মার বাংলোর কাছাকাছি আসতেই—আমরা বাংলোটির বাঁ-পাশ দিয়ে আসছিলাম, দেখা গেল একটি জলপাই-সবুজ জিপ দাঁড়িয়ে আছে বাংলোর সামনে৷

ঋজুদা বলল, ‘কী হল! ডি.এফ.ও. ওসমানসাহেবের তো আসার কথা সাড়ে আটটাতে৷ বিলাসপুর থেকে আসবেন৷ এত আগে এলেন যে!’

ভটকাই বলল, ‘নিশ্চয়ই কোনো গড়বড়-সড়বর, কোনো গুবলেট, হয়েছে৷’

ভটকাইয়ের বাগবাজারি ভাষাই ওরকম৷

যখন আমরা বাংলোতে গিয়ে পৌঁছোলাম, তখন কিন্তু দেখা গেল ভটকাই ঠিকই ধরেছিল৷

দূর থেকে আমাদের দেখেই ডি.এফ.ও. ওসমানসাহেব এগিয়ে এসে বললেন, ‘ওয়্যারলেসে খবর পেয়ে আসছি, লমনির পেছনে গণিয়া বস্তির একটি যুবতীকে বাঘে নিয়েছে আজই খুব ভোরে৷ চার-পাঁচজনের একটি দল মহুয়া কুড়োতে গেছিল৷ তার মধ্যে থেকে একজনকে নিয়েছে৷ এখুনি গেলে হয়তো আপনাদের পরিশ্রমের লাঘব হবে৷ আজই মানুষখেকো নিধন হবে৷’

ভটকাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঋজুদা বলল, ‘মানুষখেকো কি অত সহজে মারা যাবে? সন্দেহ আছে৷’

ভটকাইয়ের মুখটা কাঁদো-কাঁদো হয়ে গেল৷ ফিসফিস করে আমাকে বলল, ‘ব্রেকফাস্ট?’

‘কিন্তু স্যার চেষ্টা তো করতে হবে৷ আপনিই তো ভরসা৷ কনসার্ভেটরসাহেব তো তাই বলেছেন আমাদের৷ আপনি পারবেনই৷ অন্যেরা বিফল হলেও৷’ ওসমানসাহেব বললেন৷

‘চলুন তাহলে বেরিয়েই পড়া যাক৷ আতারিয়া বনবাংলোতে ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চ দুইয়েরই বন্দোবস্ত করতে বলেছি ওয়্যারলেসে!’ ডি.এফ.ও. বললেন৷

‘আতারিয়া কেন? লমনিতে থাকা নয় কেন?’ ভটকাই বলল৷

সাহস কম নয়! ঋজুদা থাকতে এমন মাতব্বরি! ভাবা যায় না!

‘লমনি বাংলোটা কেঁওচির দিকে যাওয়ার বড়ো রাস্তার ওপরে৷ এপথ দিয়েই তো পেন্ড্রা রোড, অমরকণ্টক, সাউথ ইস্টার্ন কোলফিল্ডস-এর সুহাগপুরের সব কলিয়ারিতে যাওয়ার পথ৷ ঋজু বোসের মতন সেলিব্রিটিকে ওই বাংলোতে রাখলে জানাজানি হয়ে গেলে মি. বোসেরই অসুবিধে হবে৷ মধ্যপ্রদেশ তো এখন বাঙালি টুরিস্টদের স্বর্গরাজ্য হয়ে গেছে৷ শিক্ষিত বাঙালিরা যদি জানতে পারে যে ঋজু বোস লমনি বাংলোতে আছেন, তবে ভিড় সামলাতে পুলিশ ডাকতে হবে৷’

ঋজুদা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই সবই রুদ্রর কাণ্ড৷ যত্ত বাজে সব৷’

তারপর আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘বানিয়ে বানিয়ে আরও গল্প লেখো৷ ‘ঋজুদা কাহিনি’৷ জীবনে যে কারণে সিনেমাতেই নামলাম না, তুই আমাকে নিয়ে গল্প লিখে সেই বিপদেই ফেললি শেষে৷ সেলিব্রিটি হয় মানুষের সাতজন্মের পাপ থাকলে৷ নিজের পার্সোনাল লাইফ বলে কিছু থাকবার জো আছে! ল্যাংড়া পাহান বাঘেরই মতন সকলেই আঙুল তুলে দেখিয়ে বলবে, ওই যায়! ওই যায়!’

ইতিমধ্যে অচানক মার বাংলোর চৌকিদার সন্তুরাম চা নিয়ে এল ট্রেতে করে৷ আমরা বারান্দাতে বসে এক কাপ করে চা খেয়েই আপাতত একদিনের মতন জামা-কাপড়, রাইফেল-বন্দুক-গুলি-দূরবিন সব নিয়ে তাড়াতাড়ি জিপে উঠলাম৷

ঋজুদাই বলল, ‘এখানে সময় নষ্ট করার মানে হয় না৷’

অন্য সবকিছু অচানক মার-এই পড়ে রইল৷ কনসার্ভেটরসাহেব চৌকিদার সন্তুরামকে বললেন, ‘সব ঠিকঠাক করে দেখে রেখো সন্তুরাম৷ সাহেবরা কখন ফিরবেন তা ওয়্যারলেসে জানিয়ে দেব৷’

‘জি সাব৷’

আটেনশনে দাঁড়িয়ে বলল সন্তুরাম, মধ্যপ্রদেশের বন বিভাগেও পুলিশ বিভাগের মতন নিয়মানুবর্তিতা আছে দেখে খুশি হলাম৷ নিয়মানুবর্তিতা, অথবা নিয়মানুবর্তিতার ভান, যাই হোক৷

পৌঁছে দেখলাম, লমনি বনবাংলোটি বেশ বড়ো৷ বাইরে থেকেই দেখা গেল একটি মস্ত গামহার গাছ বাংলোর হাতাতে এবং দু-টি সুপ্রাচীন বটল-ব্রাশের গাছ৷ এত বড়ো বটল-ব্রাশ গাছ আগে কখনো দেখিনি৷ আমরা বাংলোর পাশ দিয়ে গিয়ে মাট্টিনালার উপরের কংক্রিটের সাঁকো পেরিয়ে আরও কিছুটা গভীর গাঢ় জঙ্গলের মধ্যে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে ডান দিকের কাঁচা রাস্তাতে ঢুকে পড়লাম৷ লাল মাটির পথ৷ হাওয়াতে তখনও মহুয়া আর করৌঞ্জের গন্ধ ভাসেনি৷ নানা রঙা মরাপাতার রাশ গালচে পাতেনি প্রতি গাছের নীচে৷ তবে বাংলোর হাতার মধ্যে যেন আমের বোল আর কাঁঠালের মুচির গন্ধ পেলাম৷ পেটভরে নিশ্বাস নিলাম৷ আঃ৷

ভাবছিলাম, আমাদের এই সুন্দর ভারতবর্ষ দেশ হিসেবে কতই বড়ো ও বিচিত্র যে, একেক জায়গাতে একেক সময়ে পলাশ আর শিমুল ফোটে, মাদার, পারুল, জারুল, মহুয়া, করৌঞ্জ থেকে আম-কাঁঠালও৷ কোথাও ফেব্রুয়ারিতেই আমের বোল আর কাঁঠালের মুচি এসে যায়, কোথাও-বা আবার মার্চের একেবারে শেষে৷ এত বিচিত্র আবহাওয়া, জমি, গাছগাছালি বলেই আমার দেশকে এত ভালোবাসি আমি৷ অবশ্য এই ভালোবাসা শিখেছি পুরোপুরি ঋজুদারই কাছ থেকে৷ জানি না, ঋজুদা যখন থাকবে না, তখন কী করব৷ কী করে এই ভালোবাসার দায় বইব৷ কেউই তো চিরদিন থাকে না৷ ঋজুদাও থাকবে না৷ তবে আমি কোনোদিনই চাইনি ঋজুদা বিছানাতে শুয়ে মারা যাক৷ অমন সাধারণ ছা-পোষা মানুষের মৃত্যু ঋজুদাকে আদৌ মানায় না৷

আতারিয়া বাংলোতে পৌঁছেই দেখলাম, পাশ দিয়ে একটি সরু ছোটো নদী বয়ে গেছে৷ গত কয়েকদিন বিন্ধ্য আর মাইকাল পর্বতশ্রেণিতে বেশ ভালো বৃষ্টি হয়েছে৷ তাই জল চলেছে ঢল নামিয়ে৷

ঋজুদা আসবে বলে কয়েকজন মানুষ অপেক্ষা করছিল সেখানে৷ ওসমানসাহেব একজনকে ডাকলেন৷ ঋজুদাকে বললেন, ‘এর নাম চৈতুরাম পোর্তে৷ এ হল লমনির মুখিয়া৷’

লোকটার চেহারা আমার মোটেই ভালো লাগল না৷ অত্যন্ত ধূর্ত বলে মনে হল৷ কয়েকজন মেয়েও ছিল সেখানে৷ যারা সকলে গেছিল মহুয়া কুড়োতে৷ ওরা বলল, অঘটনের জায়গাটা নাকি কাছেই আতারিয়া বাংলো থেকে৷

ঋজুদা বলল, ‘তোমরা থাক কোথায়? কোন গ্রামে?’

‘গণিয়া৷’

‘সেই গ্রামের আশেপাশে মহুয়া গাছ নেই?’

‘একটা মাত্র আছে৷ এদিকে মহুয়া গাছ কম৷’

কথাটা ঠিকই৷ বিহারের মতন মহুয়া গাছ সম্ভবত অন্য কোনো রাজ্যেই নেই৷ বড়ো হতে সময়ও নেয় খুব তারা৷

বাবুর্চিখানা থেকে ফার্স্ট ক্লাস খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে ভাজা পরোটার গন্ধ ছাড়ছিল৷ ভটকাইয়ের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷

ঋজুদা লক্ষ করে একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ভটকাই তুই বাংলোতেই থাক৷ ভালো করে ব্রেকফাস্ট কর৷ বারান্দাতে বসে নদীর শোভা দেখ৷’

বলেই, আমাকে বলল, ‘চল রুদ্র৷’

সাধে কী আর বলে, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু!

কিন্তু ঋজু বোসের মুখ দিয়ে একবার কথা বেরিয়ে গেলে তা রাইফেলের নল থেকে বেরিয়ে যাওয়া গুলিরই মতন আর ফিরে আসে না৷ ভটকাই রীতিমতন কাঁদো-কাঁদো মুখে বলল, ‘আ…আ…আমি!’

ঋজুদা বলল, ‘যা বললাম, তাই কর ভটকাই৷’

তারপর বলল, ‘চলো, চৈতুরাম৷’

মেয়েদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি বয়সি, তার বয়স, এই উনিশ-কুড়ি হবে, তাকে ডেকে নিল ঋজুদা চৈতুরামের সঙ্গে৷ বিষেন সিংসাহেবকে বলল, ‘আপনি চলে যান বিলাসপুরে৷’

‘চলে যাব? আপনার যদি কোনো দরকার…’

‘কোনো দরকার হবে না৷ একটি ওয়্যারলেস টেলিফোন লাগানো জিপ তো রেখেই যাচ্ছেন আপনি৷ তবে আর অসুবিধে কী? তবে আপনি যাওয়ার আগে প্লিজ নাস্তা করে যান৷ মিস্টার ভটকাই আপনাকে কম্পানি দেবে৷ ও খেতে খুব ভালোবাসে৷ বলতে গেলে, ভালো-মন্দ খেতেই এসেছে ও এখানে৷ আমারই চেলা তো!’

আমি বললাম, ‘চেলা তো আমি! ও হল, চামুণ্ডা৷’

ঋজুদা হেসে বলল, ‘ঠিক৷’

বলেই বলল, ‘তুই ব্যারেটা শটগানটা নে৷ যা যা গুলি নেবার সব নিয়েছিস তো?’

বললাম, ‘নিয়ে নিচ্ছি৷’

কাঁদো-কাঁদো মুখে ভটকাই বন্দুক আর গুলির বেল্ট আমাকে দিল৷ আমি তার থেকে বেছে দুটো লেথাল বল আর চারটে এল.জি. নিয়ে আমার বুশ-শার্টের দু-পকেটে রাখলাম৷

ঋজুদা নিয়েছে থার্টি ও সিক্স ম্যানলিকার শুনার রাইফেলটি৷ আর পাঁচটি গুলি৷ তার বুশ-শার্টের বুকের বাঁ-দিকের পকেটের খাঁজে গোঁজা৷ সব গুলিই সফটনোজড বুলেট৷

‘দূরবিনটাও নিয়ে নে রুদ্র৷’

ভটকাইয়ের গলাতে জার্মানির তৈরি জাইস-এর দূরবিনটা তখনও ঝোলানো ছিল মালার মতন, খুলে নিলাম আমি সেটাকে৷ ভটকাইয়ের মুখের ভাবটা এমনই হল যেন আমি শুভদৃষ্টির সময়েই ওর গলার মালাটাই খুলে নিলাম৷

যাক বহু বহু বছর পর ভটকাইকে বেশ মনঃকষ্ট দিয়ে হেভি আনন্দ পেলাম আমি৷ কে জানে! মানুষকে সুখী করে যেরকম আনন্দ পাওয়া যায়, দুখি করে হয়তো তার চেয়েও অনেক বেশি আনন্দ পাওয়া যায়৷ পাজি মানুষেরা তাই পায় অন্তত৷

তারপরই ভাবলাম, আমি কি পাজি?

ঋজুদা বলল, ‘মড়ি নিয়ে আসা হয়েছে দাহ করার জন্যে? মেয়েটির বাড়ির লোকেরা কেউ আসেনি?’

যে মেয়েটি আমাদের সঙ্গে চলল, সে বলল, ‘তার কেউই ছিল না সাহাব৷ বাবা মারা গেছিল সাপের কামড়ে, তার যখন তিন বছর বয়স তখন৷ আর মা মারা গেছিল চীচক রোগে, ওর যখন সাত বছর বয়স তখন৷ তখন থেকে সে একা৷’

‘থাকে কাদের সঙ্গে তাহলে? একা থাকত বস্তিতে?’

‘না৷’

‘তবে?’ ঋজুদা আবার প্রশ্ন করল৷

মেয়েটি একবার মুখিয়া চৈতুরামের মুখের দিকে তাকাল, তারপর বলল, ‘থাকত মুখিয়ার বাড়িতে৷ নানা কাজকর্ম করত আর তার বদলে খেতে-পরতে পেত৷’

‘ও৷’ ঋজুদা বলল৷

আমরা আতারিয়া বাংলোর পেছন দিয়ে একটু এসে একটি পায়ে চলা পথে ঢুকে পড়লাম৷ যাকে বলে game track অর্থাৎ জানোয়ারদের চলাচল করার পথ৷ যে-পথে মানুষেরাও যাতায়াত করে৷ সাবধানে পায়ের দাগ দেখতে দেখতে এগোলাম আমি৷ শুয়োর, শম্বর, কোটরা, চিতল হরিণ, শজারু, একটি মাদি চিতা এবং বাইসনের দলের দাগও দেখলাম৷ সম্ভবত এই পথটির একটি মুখ নদীতে আর অন্য মুখ কোনো নুনিতে আছে৷ নুনি অর্থাৎ salt lick, প্রাকৃতিক৷ বনের মধ্যে কোনো কোনো জায়গাতে লবণাক্ত পাথর অথবা মাটি থাকে৷ তৃণভোজী জানোয়ারেরা সেই নুন চাটতে আসে৷ আর তাদের পেছনে পেছনে আসে মাংসাশী জানোয়ারেরা৷

কিছুদিন পরেই খরা পড়বে৷ নদী আর এমন কলরোলে বইবে না৷ কী আতারিয়া নদী, কী মনিয়ারী কৈরাহা, আর কী মাট্টিনালা৷ তখন জানোয়ারেরা নদীর দিকেই আসবে বেশি করে৷ খরার সময়ে জঙ্গলে জল থাকবে না৷ এখন যায় শোভাযাত্রা করে নুনিতে৷ আসলে কি আর শোভাযাত্রা করে যায়! একেক প্রাণী যায় তার সময়-সুবিধে মতো, রাতের নানা প্রহরে৷ সন্ধে থেকে শেষরাত অবধি৷

আরও কিছুটা যাওয়ার পরে প্রায় কুড়ি মিনিট মতন, একটি টিলা দেখা গেল৷ তার চারদিকে, পায়ের কাছে, আঁচলে, নানা হরজাই জঙ্গল৷ শিশু, বিজা, সাহাজ, কুর্চি, গামহার, আরও নানা গাছ অথচ টিলাটাতে কেবলই মহুয়া৷ খুবই প্রাচীন সব মহুয়া৷

‘নাম কী? এই টিলার?’

‘মহুয়া টিলা৷’ মুখিয়া বলল৷

‘এই টিলার উপরেই ধরেছিল বাঘে মেয়েটিকে?’

‘তা ওই মেয়েটিই বলতে পারবে৷’

‘নাম কী তোমার?’ ঋজুদা শুধোল৷

‘রূপকুমারী৷’

‘তোমার বন্ধুকে বাঘে কোথায় ধরল?’

‘তা দেখিনি৷’

‘মানে?’

‘মানে, আমরা সকলেই মহুয়া কুড়োচ্ছিলাম৷ আলো তো ফুটে ছিলই, সূর্যও উঠে গেছিল৷’

‘যে-অঞ্চলে মানুষখেকো বাঘ এত মানুষ ধরেছে সেখানে তোমরা অন্ধকার থাকতে গ্রাম থেকে বেরোলে কোন সাহসে?’

‘এই বাঘটা তো দিনের বেলাতেই মানুষ ধরে৷ রাতে তো একজনকেও ধরেনি৷ চিতা যদি মানুষখেকো হয়, তবে রাতে ধরে৷ একবার গামহারগাঁও-এ এক চিতা…’

‘আঃ৷ বড়ো বেশি কথা বলিস তুই রূপকুমারী৷ সাহাব কত বড়ো মানুষ জানিস? দেখলি না ডি.এফ.ও. সাহাব পর্যন্ত কীরকম খাতির করলেন সাহাবকে৷ তার সঙ্গে এত বেশি কথা কীসের? যা প্রশ্ন করবেন তারই ঠিকঠাক জবাব দিবি৷ তোর গেঁহু-বাজরার গাই-বলদের কিসসা শোনার সময় সাহাবের নেই৷’

ঋজুদা মুখিয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘না বললে সব জানব কী করে! ওকে থামাবার দরকার নেই!’

মুখিয়া একটু দমে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে সাহাব৷’

‘বলো রূপকুমারী৷’

‘আমরা যখন সকলে মহুয়া কুড়োচ্ছি ও…’

‘ওর নাম কী ছিল?’

‘প্রাণকুমারী৷’

‘তারপর?’

‘ও ওর ঝুড়িটা মাটিতে নামিয়ে রেখে বলল, আমি একটু আসছি৷ বলে মহুয়া টিলার ওই পাশে একটু নেমে গেল৷ একটু নামতেই আমাদের চোখের আড়ালে চলে গেল সে৷ উতরাই ছিল তো!’

‘কী করতে গেছিল?’

‘তা বলতে পারব না৷ জানি না৷’

‘তারপর?’

‘তারপর আমাদের যখন ফেরার সময় হল, তখনও এল না দেখে আমরা সকলে একসঙ্গে এগিয়ে নেমে গিয়েও যখন ওকে দেখতে পেলাম না, তখন হঠাৎ ঝুমকি বলল, ওকে নিশ্চয়ই বাঘে ধরেছে৷ সেকথা শোনামাত্রই আমরা পড়ি কি মরি করে দৌড়ে সোজা গ্রামে৷ তারপর মুখিয়াকে খবর দিতে সে অচানক মার-এর রেঞ্জারসাহেবকে লমনি থেকে একটি ট্রাক ধরে গিয়ে খবর দিল৷’

বলেই, চোখ নামিয়ে নিল রূপকুমারী নীচে৷ লজ্জাতে৷

আমি বুঝলাম, বাথরুম-টাথরুম করতে গেছিল নিশ্চয়ই৷

তারপর ঋজুদা বলল, ‘টিলাটা চড়তে চড়তে, বাঘকে কি কেউ দেখেছিল তোমাদের মধ্যে? একজনও?’

‘না হুজৌর৷’

‘কোনোরকম আওয়াজ শুনেছিলে কেউ? ধস্তাধস্তির শব্দ৷’

‘না হুজৌর৷’

চৈতুরাম পোর্তে একটু শ্লেষের সঙ্গেই বলল ঋজুদাকে, ‘লোকমুখে শুনলাম আপনি নাকি পৃথিবীর সব জঙ্গলেই শিকার করেছেন কিন্তু মানুষখেকো বাঘে বা চিতাতে যখন মানুষ ধরে তখন তার পাশের মানুষও যে টের পায় না তাও কি সাহাব জানেন না? বেড়ালে পায়রা ধরলে, পায়রা তবু ডানা ঝটপট করে কিন্তু মানুষখেকো বাঘ কি চিতা যমের চেয়েও নিঃশব্দ৷’

ঋজুদা পূর্ণদৃষ্টিতে চৈতুরামের মুখের দিকে একবার তাকাল৷ তারপর বলল, ‘তাই বুঝি? তা, তোমরা বনজঙ্গলেই চিরটা কাল থাক, তোমরা আমার মতন শহুরে মানুষের চেয়ে বেশি জানবে বই কী! আমার জ্ঞান তোমাদের জ্ঞানের সঙ্গে তুলনীয়ই নয়৷’

আমি ভাবছিলাম, কথাটা তো ঠিকই৷ একটি ছাগলেরও শিং আছে, পায়ে খুর আছে৷ সেও আক্রান্ত হলে শিং নাড়ে, পা ছোড়ে৷ সেই তুলনাতে মানুষেরই কিছু করার নেই, মানুষই সবচেয়ে অবল৷

ঋজুদা বলল, ‘মেয়েটির মড়িকে দেখেছে কেউ? মানে, লাশ?’

‘সদ্য সদ্য মানুষখেকো বাঘে-নেওয়া মানুষের লাশ দেখতে গিয়ে কে শখ করে নিজেই লাশ বনতে যাবে বলুন সাহাব? তাও যদি, যাকে নিল তার আপনজন কেউ থাকত তো অন্য কথা৷ মানে, মা, বাবা, দাদা, বোন৷ ওর তো কেউই ছিল না৷’

‘কেন? তুমি তো ছিলে মুখিয়া৷ তোমার আশ্রয়েই তো থাকত প্রাণকুমারী৷’

‘হ্যাঃ৷’ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল মুখিয়া চৈতুরাম পোর্তে৷

তারপর বলল, ‘ওই ছোটো জাতের মেয়ের জন্যে নিজের জীবন বরবাদ করব এমন পাগল তো আমি নই৷ আমার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলাম এই ঢের৷ আমি না থাকলে তো ও এই এত বড়োটি হয়েই উঠতে পারত না৷ ওর হাতে আমরা খেতামও না কখনো৷ ভুলুয়া কুকুর আর ওর জন্যে দু-টি আলাদা থালা ছিল৷ জাম গাছের গোড়াতে ওদের দু-জনকে একই সঙ্গে খাবার দিত আমার বউ৷ তার জন্যে অত দরদ তো আমার ছিল না৷ থাকার কথাও ছিল না৷ তা ছাড়া, বড়ো হয়েই মেয়েটা ভারি পাজিও হয়ে গেছিল৷’

‘পাজি?’ বলেই, ঋজুদা চুপ করে গেল৷

ততক্ষণে আমরা মহুয়া টিলার ওই প্রান্তে পৌঁছে গেছি৷

ঋজুদা বলল, ‘তোমরা কেউ প্রাণকুমারীকে বাঘে নিতে দেখনি, তার লাশের খোঁজও করনি৷ বাঘের পায়ের দাগ কি ছিল? মানে কেউ দেখেছিল? তোমাদের গাঁয়ের আর সব মানুষই-বা গেল কোথায়?’

‘তাদের সকলকেই খেটে খেতে হয় সাহাব৷ তাদের কি আপনাদের মতন ভালো অবস্থা যে বসে থাকলেও পেট চলবে! যে যার কাজে গেছে৷ আমিই বলেছি যেতে৷’

‘সে কী? মেয়েটার একটা হদিশ না করেই? তাকে বাঘের উদ্দেশে উৎসর্গ করে দিয়ে চলে গেল তারা!’

মুখিয়া প্রসঙ্গ বদলে বলল, ‘বাঘের পায়ের দাগ ওই ঘাসের মধ্যে কী করে দেখা যাবে?’

‘পায়ের দাগ না হলেও ঘাসের মধ্যে চিহ্ন তো থাকবে কিছু৷ অত বড়ো ভারী বিরাট একটা জানোয়ার চলাফেরা করলে পায়ের ছাপ নাও পড়তে পারে পুরু নরম ঘাসের উপরে, শব্দও না হতে পারে কিন্তু কোনোরকম চিহ্নই পাওয়া যাবে না? এ তো আশ্চর্য কথা!’

‘আপনারা অনেক পড়ে-লিখে বড়ো শিকারি সাহাব৷ আপনারা পেলেও পেতে পারেন৷ আমারা পাইনি৷’

‘হুঁ৷’ ঋজুদা বলল, চিন্তান্বিত মুখে৷

তারপর বলল, ‘পাব কি না জানি না৷ চেষ্টা তো করতে হবে৷ মধ্যপ্রদেশ সরকার এত খরচপত্র করে আমাদের নিয়ে এসেছেন, মেয়েটাকে বাঘে নিয়ে গেল, আর আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব তা তো হয় না৷’

তারপরই কী ভেবে, রূপকুমারীর দিকে ফিরে তার দু-চোখে নিজের দু-চোখ রেখে বলল, ‘তোমার কী মনে হয়? রূপকুমারী?’

রূপকুমারী যেন ভয় পেয়ে গেল৷

বলল, ‘কীসের কী মনে হয় হুজৌর?’

‘না…৷ মানে…৷’

ঋজুদা চৈতুরাম পোর্তের দিকে ফিরে বলল, ‘ঠিক আছে৷ তোমরা সকলেই এবারে যেতে পার৷ তোমাদের গ্রামে তো একজনও নিষ্কর্মা লোক নেই দেখছি৷ এমন কাজ-পাগল গ্রাম ভারতের কোণে কোণে হোক৷ তাহলে দেশের সব দুর্গতিই মোচন হবে৷’

মুখিয়ার সঙ্গে যে আরও দু-জন লোক ছিল তারা বলল, ‘আপনারা এ অঞ্চলে নতুন৷ জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে যেতে পারেন, তা ছাড়া মানুষখেকো বাঘ রয়েছে এ জঙ্গলে৷ আপনাদের ছেড়ে যাই কী করে?’

ঋজুদা বলল, ‘মানুষখেকো বাঘ মারবার জন্যেই তো এসেছি আমরা৷ মানে, আমাদের আনানো হয়েছে৷ বাঘকে ভয় করলে কি আসতাম! প্রাণকুমারীকে বাঘেই খেল না ঘোগে খেল তা আবিষ্কার করে তারপরেই ফিরব৷ আমাদের জন্যে তোমাদের কোনোই চিন্তা নেই৷ তোমরা যাও৷’

তারপর শক্ত গলায়, হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘যাও৷’

ওরা বেজার মুখে ফিরে যাবার জন্যে ঘুরল৷

ঋজুদা মুখিয়াকে জিজ্ঞেস করল, ‘প্রাণকুমারী যে ছোটো জাতের বললে, কী জাত ছিল ওর?’

‘পানকা৷’ মুখিয়া বলল৷

ঋজুদা বলল, ‘ও, তাই?’

তারপর ওরা যতক্ষণ না দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল, ততক্ষণ ওই একই জায়গাতে দাঁড়িয়ে রইল ঋজুদা৷

ওরা চলে গেলে বলল, ‘জানিস রুদ্র, এই পানকাদের ছোটো জাত বলল মুখিয়া, অথচ এই জাতের কোনো পুরুষের সঙ্গে যদি পথে কোনো অনাত্মীয়া নারীর দেখা হয়, সে বিরাশি বছরেরই হোক কি তিন বছরের তারা প্রত্যেককেই, হাঁটু গেড়ে বসে দু-হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে৷ এই ওদের সংস্কৃতি৷ এই পানকাদের যারা ছোটো জাত বলে, তারা নিজেরাই অমানুষ৷’

আমি ঋজুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মধ্যপ্রদেশের এই সব অঞ্চলে কোন কোন আদিবাসী থাকে?’

‘থাকে তো অনেকই রকম কিন্তু তাদের আর তাদের মতন থাকতে দিলাম কোথায় আমরা এই শহুরেরা! আমাদের ভালো যে ওদের ভালো নয়, ওদের নিজেদের ভালোত্ব নিয়েই যে ওরা এত হাজার বছর বেঁচে এল হেসে-খেলে, এবং সবচেয়ে বড়ো কথা সুখে, সে-কথা আমরা মানলাম কই? মনের সুখের সঙ্গে যে বড়োলোকির কোনো সম্পর্কই নেই এই কথাটা আমরা নিজেরা তো বুঝলামই না, ওদেরও কলুষিত করলাম, আমাদের চাই চাই খাই খাই সংস্কৃতি দিয়ে৷ আমাদের সংস্পর্শে এসেই এই সরল, ভালো, আদিবাসীরা এই চৈতুরাম পোর্তেরই মতন ধূর্ত-ধাউর হয়ে গেছে৷ লোকটার চোখ দুটো দেখলি? শেয়ালের মতো৷’

‘দেখেছি৷’ আমি বললাম৷ ‘প্রথম দর্শনেই তাই মনে হয়েছে আমারও৷’

‘এবারে চল৷ কাজে নামা যাক৷ বাঘ তো অনেকই শিকার করেছি আমরা, কিন্তু প্রাণকুমারীকে অচানক মার-এর বাঘে মেরেছে বলে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না৷’

অবাক হয়ে আমি বললাম, ‘তবে কীসে মেরেছে?’

‘মেরেছে যে আদৌ সেকথাও এখুনি বলতে পারছি না৷ তবে তুই তোর বন্দুকের দুই ব্যারেলেই গুলি পুরে রাখ৷ একটা বাঘ, সে মানুষখেকো হলেও তার মোকাবিলা করা সহজ৷ আমাদের হয়তো একই সঙ্গে একাধিক বাঘের মোকাবিলা করতে হবে৷ ভটকাইটাকে শাস্তি দেবার জন্যে বাংলোতে রেখে এলাম৷ এখন দেখছি, ও থাকলে ভালোই হত৷ তৃতীয় gun থাকত৷ কোনো lead-ই তো নেই৷’

‘পেটুক হওয়া এত বড়ো অপরাধ নয় যে, ঋজুদা, তুমি বেচারিকে কলকাতা থেকে এতদূরে নিয়ে আসার পরেও সে মেক-আপ টেক-আপ নেওয়ার পরও তাকে স্টেজে নামতে দিলে না৷ তা ছাড়া পেটুক বদনাম হয় ওর একারই, খাই তো আমি-তুমিও কম নয়৷’

‘সেটা ঠিক৷ অন্যায় হয়েছে আমার৷ তবে নাটকের এই দৃশ্যে নামেনি তো কী হয়েছে? এই মঞ্চ revolving৷ কিছুক্ষণ বাদে বাদেই নতুন নতুন দৃশ্য, নতুন নতুন অঙ্ক আসবে৷ ওর দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই৷ আর ভটকাই তো রীতিমতো ওস্তাদ হয়ে উঠেছে আজকাল৷ ওস্তাদের মার শেষরাত্রেই তো দেখানো ভালো৷ তাই না? দেখবি, মানুষখেকোটাকে শেষ পর্যন্ত ওই হয়তো মারবে৷’

মহুয়া টিলার যেদিকে আঙুল দিয়ে রূপকুমারী দেখিয়েছিল, প্রাণকুমারী নেমে গেছে বলে, ঋজুদা সেদিকে না গিয়ে তার ডান দিকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে গেল আর আমাকে বলল, ‘তুই বাঁ-দিকে নেমে যা৷ খুব ভালো করে খুঁজতে হবে৷ বাঘের কোনো চিহ্ন, মড়ির কোনো চিহ্ন, একটি উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়ের কোনো চিহ্ন, কোনোরকম চিহ্ন, কানের দুল, জামা বা শাড়ির টুকরো, মাথার চুল কিছু পাওয়া যায় কি না৷ আর সেই সঙ্গে সবসময়ে সজাগ থাকবি৷ কান খাড়া রাখবি৷ যে-কোনো মুহূর্তে বিপদ আসতে পারে৷’

‘মানুষখেকোর কাছ থেকে?’

‘না৷’

‘মানুষখেকো এ জঙ্গলে নেই৷’

‘মানে?’

‘মানে, অচানক মার-এ অবশ্যই আছে৷ কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে বড়ো রাস্তার, মানে শেওতারাই থেকে অচানক মার এবং লমনি হয়ে যে পথটি কেঁওচি চলে গেছে তার ডান দিকে ওই বাঘ কখনো আসে না৷ কনসার্ভেটরের ঘরে বসে আমি ম্যাপ দেখে এসেছি৷ যতগুলো kill এই মানুষখেকো করেছে তার একটিও এই বড়ো রাস্তার ডান দিকের কোনো গ্রামেই হয়নি আজ অবধি৷’

‘কেন?’

‘কেন তা বলা মুশকিল৷ তবে কারণ অবশ্যই আছে৷ আমার মনে হয়, বাঘটা এই পথের ডান দিকের কোনো জঙ্গলে গুলি খেয়ে থাকবে৷ যারা বাঘটাকে দেখেছে তারা সকলেই বলেছে বাঘটা কেমন ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে চলে৷ চোট না পেলে, তার শরীরে আঘাত ও অস্বস্তি না থাকলে সে ক্রমান্বয়ে এবং এত ঘন ঘন মানুষই-বা মেরে চলবে কেন? বাঘটা বুড়োও নয়৷’

‘কী করে বুঝলে?’

‘বুড়ো হলে তার এত রাক্ষসের মতন খিদে থাকত না৷ বাঘটা জোয়ান বাঘ৷ পায়ের দাগ যারাই দেখেছে তারা সকলেই বলেছে নাকি৷’

‘এরকম কি হয় কখনো? মানুষ মারছে ধড়াধড় আর রাস্তার ডান দিকে তার No Entry৷ ডান দিকটা out of bounds৷ আশ্চর্য তো!’

‘কিমাশ্চর্যমতঃপরম৷ বৎস, পারক্কালাম৷ পারক্কালাম৷ টিক্কে থই ধরো, সব্ব বুঝি পারিবে৷’

একই সঙ্গে ঋজুদার সংস্কৃত, তামিল এবং ওড়িয়া বাণী শুনে তো আমার অবস্থা কাহিল৷ অতএব ধৈর্য ধরা ছাড়া উপায়ও নেই৷

ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার আগে ঋজুদা মহুয়া টিলার পাশে, মানে আতারিয়া বনবাংলোর দিকে একটি প্রকাণ্ড বড়ো কুসুম গাছ দেখিয়ে বলল, ‘আমি বারোটার সময়ে ওই গাছটার নীচে তোর জন্যে অপেক্ষা করব৷ আগেও আসতে পারি৷ তুইও আগে আসতে পারিস তোর তদন্ত সেরে৷ আশা করি কুসুম গাছটা চিনতে তোর অসুবিধে হবে না কোনো৷’

আমি বললাম, ‘বসন্তবনের কুসুম গাছ চেনা আবার কঠিন কী? নতুন ফিনফিনে ফিকে মেরুনরঙা পাতাতে তো ভরে রয়েছে গাছ৷ যারা জানে না, তারা মনে করে ফুলই ফুটেছে বুঝি৷ চলে আসব আমি ঠিক৷ নো প্রবলেম৷’

তারপরে ঋজুদা বলল, ‘তবে একটা বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ যে, প্রাণকুমারীকে বাঘে নেয়নি৷ ওই চৈতুরাম পোর্তের খারাপ ব্যবহারের হাত থেকে বাঁচতেই হয়তো সে পালিয়ে গেছে৷ নয়তো তার অন্য কিছু হয়েছে৷’

‘মানুষখেকো বাঘ মারতেই তো আমাদের এনেছেন ওঁরা৷ নিরুদ্দিষ্টর তদন্ত করতে তো আনেননি৷’

‘নিমকহারামি করিস না তো! যাদের ঘাড়ে চড়ে মধ্যপ্রদেশের ছত্তিশগড়ে এলি তাদের প্রতি কিছু তো কর্তব্যবোধ থাকবে! It’s all in the game! তা ছাড়া, অচানক মার-এর মানুষখেকো যে আমরা মারতে পারবই এমন গ্যারান্টিই-বা দেব কী করে? ওড়িশার ‘নিনিকুমারীর বাঘ’-এর কথা তোর মনে নেই? আমরা তো হতাশ হয়ে ফিরেই যাচ্ছিলাম না মারতে পেরে৷ হাজারিবাগের অ্যালবিনোর কথাও? সাদা বাঘ মারতে গিয়ে কী গোয়েন্দাগিরিই না করতে হয়েছিল৷ বাব্বাঃ৷’

‘তা অবশ্য ঠিক৷’

আমি নেমে গেলাম৷ খুব সাবধানে মাটির দিকে চোখ রেখে এগোতে লাগলাম৷

ঋজুদা যখন বলেছে যে, বাঘ এদিকে আসে না, তখন তা বেদবাক্য বলেই মেনে নেওয়া উচিত ছিল কিন্তু বনজঙ্গলের নিয়মকানুন আলাদা৷ সেকথা ঋজুদাও জানে৷ বেদবাক্যই হোক কি পিতৃবাক্যই হোক বনেজঙ্গলে এবং বিশেষ করে মানুষখেকো বাঘের বা চিতার ব্যাপারে আমি কারও কথাতেই চলতে রাজি নই৷ ঋজু বোস, ঋজু বোসই৷ কিন্তু আমার শিক্ষানবিশিও তো কম দিন হল না৷ এই শিক্ষা ঋজুদারই দেওয়া৷ ঋজুদা বলে, ‘আমি ভগবান নই৷ ভুল সকলেরই হতে পারে৷ আমার মত বাধ্য ছেলের মতন সবসময়েই মেনে নিবি না৷ নিজের বিচারবুদ্ধিতে চলবি৷ এখন তো তুইও পাকা শিকারি৷’ ঋজুদার শার্গিদ হওয়া আরম্ভ হয়েছিল যখন আমার বয়স ছিল মাত্র দশ-এগারো৷ তারপর আফ্রিকার সেরেঙ্গেটি ও রুআহা, বিহারের হাজারিবাগ, ওড়িশার লবঙ্গি, মধ্যপ্রদেশের সুফকর (অবশ্য সুফকর-এ শিকার করিনি, ঋজুদার মুখে সেখানের সেই মারাত্মক বাঘের গা-শিউরোনো গল্প শুনেছিলাম) আরও কত জায়গাতে কত অভিজ্ঞতাই হল৷ কথাতেই বলে, ‘গুরু মিলে লাখ-লাখ চেলা মিলে এক৷’ যদি ঋজুদার মতন গুরু পেয়েও যোগ্য চেলা এতদিন না হয়ে উঠতে পারি তবে সে তো গুরুরই অসম্মান!

এই চৈত্রদিনের বনের সৌন্দর্য যে কীরকম তা বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ তেমন ভাষা বা বিদ্যা আমার নেই৷ এখন চৈত্রর মাঝামাঝি৷ শোভা এখনও পুরো খোলেনি৷ যত দিন যাবে ততই খুলবে৷ রংবাহারি হবে বনভূমি৷ কাচপোকা উড়বে৷ নানারঙা প্রজাপতির ঝাঁক ঘুরবে৷ মনে হবে, ‘বনময়, ওরা কার কথা কয় রে!’

মুখ নীচু করে কোনোরকম চিহ্ন, বাঘের অথবা মেয়েটির, পাওয়া যায় কি না—তা দেখতে দেখতে চলেছি৷ অথচ মুখ নীচু করে জঙ্গলে চলা আদৌ উচিত নয়৷ বিপদ উপরেও থাকে৷ উপরে তাকিয়ে চলার অভ্যাস নেই বলেই বাঘের মতন মহাবলী প্রাণী এবং পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিকারি, মানুষের মতন চামচিকের হাতে বেঘোরে মারা পড়ে, যেসব শিকারি মানুষ গাছের উপরে মাচা বেঁধে বসে থাকে, সেই সব মানুষের হাতে৷ তাই, মাঝে মাঝে উপরেও তাকাচ্ছি৷ বন্দুকের বাঁটটা ডান বগলের নীচে ধরে আর ডান হাতের আঙুলগুলি দিয়ে ‘স্মল অফ দ্যা বাট’কে ধরে খুব আস্তে আস্তে এক-পা, এক-পা করে এগিয়েও এখন পর্যন্ত কিছুই চোখে পড়েনি সন্দেহজনক৷

প্রায় আধঘণ্টাটাক হেঁটেছি৷ পাহাড় ছেড়ে সমতলে নেমে এসেছি৷ রোদ এখন পুরো জঙ্গলের আনাচকানাচেও পৌঁছে গেছে৷ অনেক পর্ণমোচী গাছের পাতা ঝরে গেছে৷ সেসব গাছে নতুন পাতা আসেনি এখনও৷ অনেক গাছে আবার এসেওছে৷ আবার কিছু গাছ আছে আমাদের বন-পাহাড়ে যেসব গাছের পাতা কখনোই ঝরে না৷ তারা চিরসবুজ৷

জঙ্গলে একা একা এমন করে হাঁটতে হাঁটতে নেশা লেগে যায় আমার এমন যে, মনেই থাকে না, বন কেবল সৌন্দর্যরই নয়, সেখানে নানারকম বিপদও আছে৷ কিন্তু সব বিপদকেই তুচ্ছ করতে ইচ্ছে যায়৷ সামনেই একদল ছাতারে পাখি ছ্যা ছ্যা করছে, কতগুলো পুটুস ঝোপের নীচে৷ পুটুসে ফুল এসেছে৷ গাঢ় কমলারঙা৷ নানারঙা পুটুসের ফুল ফলে যদিও বিভিন্ন অঞ্চলে৷ এমনকী একই অঞ্চলেও৷ এর ইংরেজি নাম lantana৷ ভারতের প্রায় সর্বত্রই এবং সমুদ্রের সমতা থেকে হাজার-দেড় হাজার ফিট অবধি এই ঝাড় দেখা যায়৷ এই পুটুস বা lantana-র ঝাড় চিতা বাঘ আর তিতির-বাটেরের, এবং খরগোশেরও খাসা আস্তানা৷

ছাতারেদের ডান দিকে রেখে একটি ছোটো টিলামতো ছিল সামনে, সেটাতে উঠে ভালো করে নজর করব চারদিকে ভাবলাম, ঠিক তখনই আমার নজর পড়ল একটি পথের উপরে৷ পায়ে-চলা পথ নয়৷ তার চেয়ে চওড়া৷ জিপের চাকার দাগও আছে৷ তবে সম্ভবত ট্রাক যায় না৷ অনেকদিন আগে যখন এই শালের জঙ্গলে coppicing felling হয়েছিল সম্ভবত তখন ঠিকাদারদের ট্রাক যাওয়া-আসা করত৷ এখন অনেক বর্ষাতে নানা আগাছার চারা জন্মে গেছে৷ জঙ্গল পুনর্দখল নিয়েছে তার জমিদারির৷ তবে চারাগাছগুলো কোথাও হাঁটুর চেয়ে বেশি উঁচু নয়৷ তা ঠেলে সহজেই জিপ যেতে পারে এবং হয়তো যায়ও৷ হয়তো চোরাশিকারিদের জিপ৷ রাতের বেলা আসে তারা চেকনাকা এড়িয়ে, ঘোরা-পথে৷

সেই পথে নেমে এলাম আমি আস্তে আস্তে এবং নেমে আসার সঙ্গেসঙ্গেই চমকে উঠলাম৷ একটা মস্ত দাঁতাল শুয়োর, ওজনে প্রায় এক থেকে সোয়া কুইন্টাল হবে সেই পথের উপরে শুয়ে আছে পাশ ফিরে৷ যেন অপেক্ষাতে আছে, কেউ তাকে জম্পেশ করে ঘুমুবার জন্যে একটি কোলবালিশ এনে দেবে বলে৷ পথের সেই জায়গাটি গভীর ছায়াচ্ছন্ন৷ একটু স্যাঁতসেঁতেও৷ তার মানে, জল আছে কাছেপিঠে৷ ভাবছিলাম, খুব বড়ো দাঁতাল বলেই কি একা ছিল? শুয়োর তো দলেরই জীব, মানুষের মধ্যেও অনেক শুয়োরেরা যেমন সবসময়েই দলবেঁধে থাকে৷

বন্দুকটা দু-হাতে ধরে এগিয়ে যেতেই এক বীভৎস দৃশ্য দেখলাম৷ কারও রাইফেলের গুলি লেগেছিল তার পেটে৷ সে কতখানি পথ যে দৌড়ে এসে শেষে এখানে পড়েছে আর চলতে না পেরে, তা জানা নেই, তবে তার নাড়িভুঁড়ির অনেকটাই পথেই পড়ে গেছে৷ আর কিছু জড়িয়ে-মড়িয়ে আছে এই বনপথের আগাছাতে৷ জায়গাটার মাথার উপরে চাঁদোয়া আছে বলেই শকুনদের নজরে পড়েনি এখনও৷ তারা দেখতে পেলে এতক্ষণে এখানে কামড়াকামড়ি খেয়োখেয়ি শুরু হয়ে যেত৷ মানুষদের মধ্যে যেমন শুয়োর আছে তেমন শকুনও আছে৷ সবাই যূথবদ্ধ৷ যারা একলা থাকে তাদের অসাধারণত্বকে ছিন্নভিন্ন করবার জন্যে তারা সদাই উদগ্রীব৷ একলা মাথা উঁচু করে চলা মানুষ বা একলা জানোয়ারকে তারা সহ্য করতে পারে না৷ হীনমন্যতাতে ভোগে সবসময়৷

মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেল৷ যেকোনো মৃত্যুই আমার মন খারাপ করে দেয়৷ তা সে কাচপোকার মৃত্যুই হোক, কি শুয়োরের!

জানি না, এইসব শিকারিরা কী ধরনের শিকারি৷ অত বড়ো দাঁতাল শুয়োরটাকে মাটিতে পায়ে দাঁড়িয়ে মারার সাহস তাদের নেই৷ আহত জানোয়ারের যন্ত্রণা যত কম সময়ের মধ্যে সম্ভব তা লাঘব করা যে প্রত্যেক শিকারিরই কর্তব্য তা এরা নিশ্চয়ই মানে না৷ এইসব শিকারিরা জানোয়ারদের চেয়েও অধম৷

শুয়োরটার ওপরে এখুনি জঙ্গলের বড়ো বড়ো নীল মাছি পড়বে৷ শয়ে শয়ে৷ ক্ষতস্থানে বসবে আর উড়বে৷ তাদের সকলের ডানার শব্দ দূর থেকে শুনলে মনে হবে যেন কোনো মোনো-ইঞ্জিন প্লেন, টাইগারমথ বা বনাঞ্জা উড়ছে, যে প্লেন চালিয়ে ফ্লাইংক্লাব থেকে ঋজুদা পাইলটের লাইসেন্স পেয়েছিল বহুদিন আগে৷

শুয়োরটা পেরিয়ে সেই রাস্তা ধরে, ঋজুদা যেদিকে নেমেছে সেদিকেই আর কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখলাম একটি ছোটো নালা সেই বনপথটিকে আড়াআড়ি পেরিয়ে গেছে৷ নালাটি সম্ভবত আতারিয়া নদী থেকেই বেরিয়েছে৷ কালো ও খয়েরি নুড়ি, পাথর, খয়েরি রঙা কতকগুলো ফুলের ঝোপ নালাটার বুকের মাঝে মাঝে৷ নামেই নালা৷ পায়ের পাতা ভেজে না এমন জল তিরতির করে বইছে৷ আর মাস খানেকের মধ্যে শুকিয়ে যাবে৷

কী মনে হওয়াতে ভাবলাম, নালাটার পাশে পাশে কিছুটা এগোই৷ চল্লিশ-পঞ্চাশ মিটার যেতেই দেখি নালাটা ডান দিকে ঘুরেছে৷ Right angle turn মানে, ঋজুদার যেদিকে বাঘ বা প্রাণকুমারীর চিহ্ন খোঁজার কথা সেদিকে৷ ভাবলাম, ভালোই হল, ঘড়িতেও ততক্ষণে সোয়া এগারোটা বাজে৷ জঙ্গলে কোনো কিছু tracking করতে বাঘেরও যেমন সময় লাগে শিকারিরও লাগে৷ এক-পা থেকে আরেক পা যেতে দু-তিন মিনিট কেটে যায়৷ একেবারে নিঃশব্দে আড়াল থেকে আড়ালে চলতে হয়৷ ভাবছিলাম, মহুয়া টিলা পেরিয়ে নবীন পাতাতে ভরে যাওয়া সেই প্রাচীন কুসুম গাছটির দিকে যাওয়ার আগেই হয়তো ঋজুদার সঙ্গে এই সমতল বনভূমিতেই দেখা হয়ে যাবে৷

নালার বালিতে নানা জানোয়ারের পায়ের দাগ দেখলাম৷ একটি প্রকাণ্ড ময়াল সাপ খুব ধীরে ধীরে নদী পেরোল আমারই সামনে৷ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমি৷ প্রায় চার থেকে ছ-মিনিট নিল সে ওই অল্প চওড়া নালাটি পেরোতে৷ এবারে সামনেই একটা বাঁক নিয়েছে নালাটা৷ সেই বাঁকের মুখে গিয়ে যখন পৌঁছেছি ঠিক সেই সময়ে আমাকে ভীষণই চমকে দিয়ে হঠাৎ একজোড়া red turtle dove সেই বাঁকের মুখ থেকে প্রচণ্ড ভয়ার্তস্বরে ডেকে উঠে নীচু দিয়ে, প্রায় জমির সমান্তরালে উড়ে এল আমার দিকে৷ পরক্ষণেই আমাকে দেখে আরও ভয় পেয়ে, আরেকবার ডেকে অদৃশ্য হয়ে গেল পেছনে৷ ওই জাতের ঘুঘুদের অমন ব্যবহার করতে দেখিনি কখনো আগে আমাদের দেশের কোনো জঙ্গলেই৷ হতবাক হয়ে গেলাম৷ বাঁ-পাশে একটি বাদামি-কালোতে মেশা লম্বা লেজওয়ালা crow-pheasant একা একাই এক্কা-দোক্কা খেলতে খেলতে আমাকে বা অন্যকিছু দেখে হঠাৎই ভয় পেয়ে বাঁদিকের গভীর নলিবাঁশের জঙ্গলে ঢুকে গেল৷ কেন? কে জানে৷ আমার গা ছমছম করে উঠল৷ হতবাক হবার আরও বাকি ছিল আমার, যখন দেখলাম যে বাঁকের ওপাশ থেকে নালাতে যে জল বয়ে আসছে তিরতির করে, তাতে রক্ত মিশে আসছে৷ ফিকে গোলাপিরঙা৷ তার মানে, রক্ত যেখানে আছে সে জায়গাটা সামান্য দূরে৷ খুব কাছে হলে, জলের রং গাঢ় লাল বা লাল দেখাত৷

আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে ফ্রিজ করে গেলাম৷ শুধু নিঃশব্দে বন্দুকটাকে দু-হাতে তুলে ধরে বুড়ো আঙুলটা সেফটি-ক্যাচের উপরে রেখে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ ঠিক সেই সময়েই খপ করে একটা শব্দ হল অথবা চপ করে৷ কিছু কি খাচ্ছে বাঘ? বাঘই কি? কিন্তু কী খাচ্ছে?

বুঝলাম, যদি বাঘই হয়, তবে সে এখন গভীর মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে৷ যাই খাক৷ বাঘ নাও হতে পারে৷ হয়তো চিতা৷ কিন্তু স্বাভাবিক বাঘ বা চিতা কেউই বেলা পৌনে বারোটার সময়ে সচরাচর মড়িতে যাবে না৷ তবে এটাও ঠিক যে, কোনো বাঁধাধরা নিয়মই খাটে না বনেজঙ্গলে৷ সবসময়েই ব্যতিক্রমের জন্যে তৈরি থাকতে হয়৷ বিশেষ করে মানুষখেকোদের বেলাতে৷

ভেবে দেখলাম যে আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেদিক দিয়ে নালার বাঁকে পৌঁছোতে গেলে যে মুহূর্তে আমি বাঁকে পৌঁছোব, সেই মুহূর্তেই বাঘ বা অন্য জানোয়ার আমাকে দেখে ফেলবে এবং সঙ্গে সঙ্গেই সাক্ষাৎ যমদূত হয়ে উড়ে আসবে অমার উপরে৷ উল্কারই মতন৷ যাঁদের তেমন পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে তাঁরাই জানেন যে সেই অভিজ্ঞতা মোটেই মধুর নয়৷

কিছুক্ষণ অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বন্দুক রেডি পজিশানে ধরে আমি খুবই আস্তে আস্তে পিছু হটতে লাগলাম৷ কিছুটা পিছু হটে এসে তারপর ডান দিকের ঘন পুটুসের ও নলি বাঁশের ঝাড়ের আড়ালে আড়ালে নিশ্বাস বন্ধ করে খুব সাবধানে এগিয়ে গেলাম এমন একটি জায়গাতে, যেখান থেকে শব্দ যেখানে হয়েছিল সেই জায়গাটার দেখা পাওয়া উচিত৷ পিছু হটে তারপর এতটুকু পথ এক-পা, এক-পা করে এগোতেই আমার প্রায় পনেরো মিনিট সময় লেগে গেল৷

আমার আন্দাজমতন জায়গামতো পৌঁছে আরও মিনিট দু-তিন দম নিলাম৷ তারপর একটি মস্ত শাল গাছের আড়াল নিয়ে আবার শামুকের গতিতে এগোতে থাকলাম৷ তার আগে দেখে নিয়েছিলাম যে, রোদটা আমার উলটো দিক থেকে আসছে৷ আমার ছায়া যেন বাঘ দেখতে না পায়, তাই৷ এদিক দিয়ে এগোলে আমার ছায়া বাঘ দেখতে পাবে না৷ তারপর সেখানে পৌঁছে শাল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পুরো শরীরটা লুকিয়ে রেখে চোখ দু-টি বের করে যা দেখলাম, তাতে আমার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেল৷

একটি মেয়ে, সেই নালার ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে৷ পুরোপুরি উদোম৷ পিঠময় তার চুল ছড়ানো৷ কিছু চুল ছিঁড়ে গেছে৷ ডান পা-টি হাঁটু থেকে কেটে নিয়ে বাঘ তা চিবোচ্ছে৷ কটাং করে শব্দ হল একবার৷ দেখলাম মেয়েটির পেছনের বাঁ-দিকটাও পুরো খেয়ে ফেলেছে৷ সেখানে কোনোই মাংস নেই আর৷ দগদগে লাল ক্ষত৷

কিন্তু পরক্ষণেই আরও ভয় পেয়ে গেলাম দেখে যে, বাঘ হঠাৎই খাওয়া থামিয়ে আমার ডান দিকে মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখতে লাগল৷ দেখলাম যে, খুব বড়ো না হলেও বেশ বড়ো বাঘ৷ তার মুখে, গোঁফে মেয়েটির শরীরের লাল রক্ত লেগে রয়েছে৷ মনে হচ্ছে, এই মাত্র হোলি খেলে উঠেছে সে-বাঘ৷ ওই দৃশ্য দেখে আমার গা বমি-বমি করতে লাগল৷ তবে বাঁচোয়া এই যে, বাঘ আমার দিকে না তাকিয়ে, অন্যদিকে, অন্যকিছুর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে অথবা কোনো ভয়ে ভীত হয়েছে৷ তাই তার সব মনোযোগ সেইদিকেই৷

আমার দিকে পুরো ব্রডসাইডে দাঁড়িয়ে আছে এখন বাঘ৷ আলো এসে পড়েছে ঝরো ঝরো শাল পাতাদের ফাঁকফোঁকর দিয়ে৷ বুক, গলা মাথা সবই দেখা যাচ্ছে এবং বড়োজোর বারো থেকে পনেরো মিটারের মধ্যে৷ বুঝলাম, এই মোক্ষম মুহূর্ত৷ তখন আমি বাঘের এতই কাছে চলে গেছি এবং পায়ে হেঁটে যে, হয় আমি বাঘকে মারব, নয় বাঘ আমাকে মারবে৷ এসপার নয় ওসপার৷ আর কালক্ষেপ না করে আস্তে আস্তে আমি বন্দুকটাকে তুললাম, তারপর ট্রিগারে তর্জনী ছুঁইয়ে যেই ট্রিগার টানতে যাব, অমনি দাঁড়ানো বাঘ বসে পড়ল৷ ইংরেজিতে যাকে বলে crouching position৷ বাঘ এবারে লাফাবে৷ মানে, আক্রমণ করবে আমার জায়গা থেকে অদৃশ্য কোনো লক্ষ্যর উপরে৷ এই মুহূর্তেই লাফাবে আগুনের হলকার মতন৷ তার ল্যাজটা পিছনে লম্বা সোজা শক্ত হয়ে গেছে৷ আমার দৃষ্টির বাইরে চলে যাবে৷ তাই আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে ঋজুদার ওভার-আন্ডারটার যে ব্যারেলে লেথাল বল পুরেছিলাম সেটির ট্রিগার আগে টানলাম বাঘের ঘাড়ের সঙ্গে শরীরের সংযোগ যেখানে হয়েছে সেখানে এবং সঙ্গে সঙ্গেই অন্য ব্যারেলের এল.জি.ও. ফায়ার করে দিলাম ব্যারেলটাকে সামান্য ডাইনে ঘুরিয়ে বাঘের কান লক্ষ্য করে, বিহারে যাকে বলে ‘কানপাট্টিয়ামে’৷

বাঘের লাফানো আর হল না৷ মনে হল, সেও যেন ফ্রিজ করে গেল৷

সেই বাঘের মাথাটি তার সামনের দু-পায়ের মধ্যে নেমে এল৷ ধীরে ধীরে চোখ দু-টি বন্ধ হয়ে এল৷

গলা দিয়ে কুলকুচি করার মতন আওয়াজ উঠল মনে হল একটা৷ অতি সংক্ষিপ্ত৷ তারপর স্থির হয়ে গেল৷ ঠিক সেই সময়ে সেই red turtle ঘুঘু-জোড়া যেমন করে উড়ে এসেছিল আমার দিকে, তেমন করে খুব নীচ দিয়ে উড়ে ডানায় সাট সাট শব্দ তুলে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই ফিরে গেল৷ পরপর, প্রায় একই সঙ্গে হওয়া বন্দুকের গুলির শব্দে সারা বন গমগম করে উঠল৷ হনুমানেরা হুপ-হুপ-হুপ করে বড়ো বড়ো গাছের পাতাতে ঝুপ ঝুপ শব্দ করে ঝাঁপাতে লাগল৷ বাদামিরঙা বড়ো বড়ো হিমালয়ান স্কুইরেল উঁচু এ-গাছ থেকে সে-গাছে পাতায় পাতায় ঝরঝরানি তুলে চঁক চঁক আওয়াজ করতে লাগল৷

মিনিট দুয়েক পরে বাঘটা যেদিকে লাফাতে যাচ্ছিল সেদিক থেকে আমাকে প্রচণ্ড চমকে দিয়ে ঋজুদা বলল, ‘তুই আমার প্রাণ বাঁচালি আজ রুদ্র৷ ওই ব্যারেটা ওভার-আন্ডারটা তোকেই দিয়ে দেব৷ বাঘটা তো আমাকে শেষই করে দিত আজ৷ আমি বোধ হয় বুড়ো হয়ে গেছি৷’

‘তুমি এতক্ষণ আওয়াজ দাওনি কেন?’

‘হতবাক হয়ে একটা পাথরে বসে পড়েছিলাম৷ বাঘ প্রাণকুমারীকে কোথায় ধরেছিল তা চোখে পড়ার পরে সেই trail-এর পিছু পিছু আসাতে ভেবেছিলাম যে বাঘকে আমিই দেখতে পারব আগে, ও আমাকে দেখার চেয়ে৷ বাঘকে অথবা মড়িকে৷ তাই তোর বিপদের কোনোই আশঙ্কা করিনি৷ তোর তো এদিকে আসার কথাও ছিল না৷ আশ্চর্য! এত কাছে এসেও আমি বাঘটাকে দেখতে পেলাম না!’

‘কটাং করে হাড় ভাঙার আওয়াজও পাওনি?’

‘না তো!’ ঋজুদা হতভম্ব গলাতে বলল৷

‘আশ্চর্য! তোমার কানটা একবার কোনো ভালো E.N.T.-কে দেখাও৷’

‘ওটা কানের জন্যে হয়নি৷ যখন মৃত্যুর সময় আসে, মানুষ তখন অন্ধ এবং বধির হয়ে যায়৷ আমার মৃত্যু ট্যাঙ্গো নাচছিল আজ আমার সঙ্গে৷ তুইই বাঁচালি৷ সত্যিরে! আমি সত্যিই বুড়ো হয়ে গেছি৷’

‘বুড়ো না ছাই৷’ আমি বললাম৷ ‘এখনও বুড়ো-হাড়ে ভেলকি দেখাও যখন-তখন!’

তারপরই বললাম, ‘আচ্ছা মেয়েটিকে বাঘ ধরেছিল কোথায়?’

ঋজুদা বলল, ‘মহুয়া ঘেরা টিলাটার অনেকই নীচে৷ বেচারির হয়তো পেটের গোলমাল হয়েছিল৷ নইলে, নালার দিকে আসতে যাবে কেন অতখানি নেমে৷ এই নালাটা আর মহুয়া টিলার মাঝামাঝি জায়গাতে আমি ওর ব্লাউজের রক্তমাখা একটা ফালি পাই৷ আরও একটা ভুল করেছিলাম আমি৷ ভেবেছিলাম, বাঘ নিশ্চয়ই মড়িতে নেই এই অবেলায়৷ দূরে কোথাও আছে৷ যেমন সব মানুষখেকো বা গোরুখেকো থাকে সচরাচর৷’

‘তাহলে তোমার কনসার্ভেটরের থিয়োরিটা ভুল বলে প্রমাণিত হল৷ বলো?’

‘না৷ আমারই ভুল৷ কনসার্ভেটর তো বইপড়া শিকারি৷ আজকালকার আর্মচেয়ার কনসার্ভেশানিস্টদের মতন৷ তাঁরা অভয়ারণ্যর প্রায় পোষা বাঘ দেখেই ভাবেন সব জেনে গেছেন বাঘ সম্বন্ধে৷ যেহেতু একটিও kill এপাশে হয়নি সেইহেতু যে কখনো হবে না এমন ভাবাটাই পরম মূর্খামি হয়েছিল আমার পক্ষে৷ ওঁর মানুষখেকো বাঘের অভিজ্ঞতা না থাকতে পারে, আমার তো ছিল!’

আমরা দু-জনে মহুয়া টিলার দিকে ধীরে ধীরে উঠতে লাগলাম৷ প্রথমদিনেই যে কার্যসিদ্ধি হবে এ অভাবনীয় ছিল৷ নামবার সময়ে এক-পা, এক-পা করে নেমেছিলাম৷ ওঠবার সময়ে কোনোরকম সাবধানতার প্রয়োজনই ছিল না তাই তাড়াতাড়িই উঠছিলাম৷ তা ছাড়া সত্যি বলতে কী, আমার নাকেও সকালের খাঁটি ঘিয়ে ভাজা পরোটার গন্ধটা যেন উড়ে এল৷ খিদেও পেয়েছিল জব্বর৷

ঋজুদা বলল, ‘দুটো চার নম্বর ছররা আকাশের দিকে মুখ করে ছুড়ে আওয়াজ কর৷ ভটকাই আর ওরা এ গুলির শব্দ শুনতে পাবে পাহাড়ের উপর থেকে৷ ওরা না এলে, বাঘটা কোথায় আছে তা তাদের জানাব কী করে! পাঁচ-দশ গ্রামের মানুষ দেখতে আসবে তাদের যমকে৷’

পরীক্ষা যেদিন শেষ হয় সেদিন যেমন হালকা লাগে, আমার তেমন মনে হচ্ছিল৷ বিশেষ করে, ভালো পরীক্ষা দেবার পর৷

তাই করলাম, মানে ঋজুদা যেমন বলল৷ তারপর একটি মোটা শাল গাছে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম৷ ঋজুদা পাইপে নতুন টোব্যাকো ভরে পাইপ ধরাল৷

কতক্ষণ আমরা সেখানে বসেছিলাম জানি না৷ সংবিৎ ফিরল হঠাৎ বন্দুক-হাতে ভটকাই আর তার পেছনে পেছনে চৈতুরাম পোর্তে এবং আরও জনা দশেক মানুষকে দেখে৷ তারা দৌড়োতে দৌড়োতে, লাফাতে লাফাতে আসছিল৷ এমনকী রূপকুমারীও৷

ঋজুদার কাছে সংক্ষেপে প্রাণকুমারীর কী হয়েছে তা শুনে মুখিয়া চৈতুরাম পোর্তে ডুকরে কেঁদে উঠল৷

ঋজুদা রূপকুমারীকে বলল, ‘তোমরা মেয়েরাই যাও ওখানে আগে, একটি শাড়ি নিয়ে৷ প্রাণকুমারীকে ঢাকা দিয়ে নিয়ে এসো অথবা ওখানেই দাহ করার বন্দোবস্ত করো৷ ওর আপনজন তো তোমরাই৷ ছেলেরা পরে বাঘটা বয়ে আনবে৷’

রূপকুমারী বলল, ‘না না জঙ্গলে দাহ করব না৷ তা ছাড়া ওকে তো দাহ করা যাবেও না৷ অপঘাতে মৃত্যু৷ ওকে আমরা আমাদের কবরস্থানে কবর দেব৷’

ভটকাই তক্ষুনি বাঘটা দেখতে পারছিল না বলে হাত কামড়াচ্ছিল৷ ঋজুদা বলল, ‘আগে মেয়েরা যাক৷ মরে গেলেও কি লজ্জা যায় মানুষের! মেয়েটা ভারি লজ্জা পাবে৷ এখন যাস না৷ আমাদের নেহাত না গিয়ে উপায় ছিল না, তাই!’

চৈতুরাম তখনও হাউ হাউ করে কাঁদছিল৷

আমি ভাবছিলাম, মানুষের বাইরের চেহারা দেখে কখনো কারওকে বিচার করাটা উচিত নয়৷ ও হয়তো মেয়েরই মতন ভালোবাসত প্রাণকুমারীকে৷ কিন্তু কী করবে? সমাজ৷ জাতপাত! ও যে আবার মুখিয়া!

এইজন্যেই আমি শুয়োরই হোক কি মানুষই হোক, কাউকেই পছন্দ তো করিই না, রীতিমতো ঘেন্না করি, যারা দলে থাকে তাদের৷ সমাজও একটি মস্ত দল৷ সমাজে যারা থাকে তারাও আস্তে আস্তে তাদের অজানিতে যূথবদ্ধ জানোয়ারের মতনই হয়ে যায়৷ বোধ হয়৷

ঋজুদা বলল, ‘ওরে ভটকাই৷ আতারিয়া বাংলোয় গিয়ে বল সব খাবারদাবার এখানেই নিয়ে আসতে৷ গরম করা তো প্রবলেম নয় কোনো৷ আজ এই মহুয়া টিলাতেই খাব৷ কাল তো অচানক মার থেকে চলেই যাব৷’

‘কালই চলে যাব? তাহলে জঙ্গল তো দেখাই হবে না৷ আমার কী হবে? অচানক মার-এর বাঘও তুমি মেরে দিলে৷ আমার কি কোনোই কনট্রিবিউশান থাকবে না?’

‘থাকবে৷’

‘দাও তোমার পা-টা একটু টিপে দিই ঋজুদা৷’

ঋজুদা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, ‘আমার নয়, আমার নয়৷ পা টেপ তোর জানি-দুশমন রুদ্র রায়ের৷’

‘কেন?’

‘বাঘটা ওই মেরেছে৷ শুধু মারেইনি, আমার প্রাণও বাঁচিয়েছে ও আজ নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে৷’

‘নিনিকুমারীর বাঘের হাত থেকে যেমন বাঁচিয়েছিল?’

‘ইয়েস! কিন্তু এখন তুই কী করবি?’

‘যাই করি, বাজে লোকের পা আমি টিপব না৷ আমার ইনিংসও আসবে৷ এক মাঘে শীত যায় না!’ ভটকাই বলল, ভটকাইসুলভ গলাতে৷

নানা পাখি ডাকছিল চৈত্রর আগুয়ান সকালে, চারধার থেকে৷ নববর্ষের সময়ে এইসব বন-পাহাড়, কচি-কলাপাতারঙা জমির শাড়িতে সেজে উঠবে৷ নানারঙা পোলকা ডট থাকবে সে শাড়িতে৷

যখন আমার খুবই আনন্দ হওয়ার কথা ছিল, গর্বিত হওয়ার কথা ছিল, ঠিক তখনই প্রাণকুমারীর জন্যে মনটা দুঃখে ভরে গেল৷

ভাবছিলাম, ঋজুদা, আমি আর ভটকাই ক-টা মানুষখেকোই-বা মেরেছি বা মারতে পারব৷ এই জাতপাত-এর মানুষখেকোদের যতদিন না নির্মূল করা যাচ্ছে, ততদিন হাজার হাজার প্রাণকুমারীরা আমাদের অজানিতেই নিরুপায় হয়ে নিয়তই মারা যাবে৷ আর সেই সব মৃত্যুর কতই-বা রকম!



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *