ঋক্ষ মেষ কথা

ঋক্ষ মেষ কথা

[প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৩। অনেকেই এই বইটিকে প্রথম বই বলে। কারণ আছে। বইটিতে রচনাকাল লেখা আছে ১৯৭৪-১৯৮৩। বইটি ছাপা হয়ে বেরিয়ে আসে ৮৩ সালে। আসলে ৭৪-৭৫ সালের কবিতা এখানে আছে। কিন্তু বেশিটাই লেখা এম.এ পরীক্ষার আগে, রাত জেগে, লেখাপড়ায় ফাঁকি দিয়ে। এই সময় বাড়ি থেকে দুটি কবিতার ডায়েরি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়।

বইটির প্রকাশক: অভিমান, হাওড়া। কবি টিউশানির পয়সা বাঁচিয়ে বইটি ছাপিয়েছিলেন। উৎসর্গ করেছিলেন কবি মণীন্দ্র গুপ্তকে। ছাপা হয়েছিল আড়াইশো কপি। কৃষ্ণনগর থেকে মাত্র ১০ কপি কলকাতায় ঢুকতে পেরেছিল। প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন মণীন্দ্র গুপ্ত। দাম: চার টাকা। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬৪।]

দু’জন দ্রষ্টা

যশ

যশ চেয়েছিলাম

চোখ বেঁধে উলঙ্গ করে এ কোন গন্ধর্ব দেশবাসীর সামনে

নিয়ে এসেছ আমাকে?

পাখি, পুষ্প, অন্ন, অর্থ, কাম

প্রণাম প্রণাম।

স্ত্রী চেয়েছিলাম

স্বপ্নচারী সহকর্মী এক

আজ রাতে দেখি তার স্ত্রীগহ্বর ও মুখগহ্বর এক হয়ে গেছে।

মল, মূত্র, পুঁজ, অর্থ, কাম

প্রণাম প্রণাম।

মাতৃঋণ

মাথা মুণ্ডন করে কোমরে লোহা বেঁধে ঘুরতে হবে পথে।

মাতৃঋণ শোধ: বাড়ি বাড়ি আমি হাম্বা হাম্বা ডেকে বলছি—আমাকে দেখুন।

মুণ্ডিত মাথায় মলত্যাগ করে উড়ছে শকুন।

গলা অব্দি জলে পুবদিকে মুখ করে এরপর তর্পণ আরম্ভ

গালের দু’পাশ দিয়ে গড়িয়ে নামছে কালো থুতু।

মা জল জল বলে ডেকেছে আমাকে; আমি ছিলাম না

আমারই আর এক ভাই উকিল সাক্ষী রেখে শেষ অব্দি দাঁড়িয়ে থেকেছে।

ব্যভিচার

প্রভুপত্নীর সামনে দু’বার মৈথুন করার পর—আমার একটি পায়ে পচন ধরে যায়। এক গুনিন ওই পা কেটে একটি ঘোড়ার পা লাগিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয় আমাকে। আমি কাক, মূষিক, কূর্ম ও মৃগ পরিবৃত হয়ে একদিন ভেলকি দেখিয়েছিলাম রাজসভায়।

আজ এক অন্ধের যষ্ঠি নিয়ে তার আগে আগে খুঁড়িয়ে চলেছি। তার স্ত্রীও সঙ্গে রয়েছে। তার তিনটি স্তনের একটিকে নিয়ে কুশবনে এরপর ব্যভিচার শুরু করি। কৃষ্ণসাপের বিষে অন্ধ চোখ ফিরে পেয়ে দেখে তার স্ত্রীর পেটের মধ্যে থেকে টেনে টেনে বের করছি আমার আটকে যাওয়া পা।

ওঠে চাঁদ

গলি শেষ, জলে ডুবে মারা গেছে লাল ব্রথেলের দুটি মেয়ে।

দু’ টাকা নব্বই তবে আগুনে পোড়াও

ওঠে চাঁদ, তারপরই

দেখি কুমারীরা নাচছে থাম ঘিরে ঋতুর খবরে,

খুব ঢিমে

তালে। মাসি, যদি মরি, যারা বাকি আছে,

তাদেরকে নিয়ে যেন মরি।

আচার্যর পায়জামা

পালকির দরজা খোলা। মঠের আচার্য মারা গেছে।

রোদ উঠে আসে সিঁড়ি থেকে বিছানায়, কদমের

নীচে তার সাইকেল, ওষুধের বাক্স, পায়জামা

চুরি করে চেরির বাগান দিয়ে চলে যায় চোর।

এ ডোবার জলে যতটুকু দেখা যায়, তাই লাভ

বলে শ্যাওলা সরিয়ে মেঘ না ঈগল বিশ্বলোক

কী দেখবে? ভেবেছ কখনও? বকুলডালের

পাশে আরও একটি যুদ্ধের মহড়া চলছে।

নির্জন মালঞ্চে তবু ফুল তুলছিলেন সুপ্রভা

দুশো একরের লনে যদি কোনও গন্ধবণিকের

ছায়া পড়ে, মাড়িয়ো না ঘাস, অল্প কাপড় তুলেই

বাকি পথ দ্রুত হেঁটে মঠের উঠোনে এসে দেখো:

সূর্যাস্ত নামছে। বেনেপাড়া থেকে এল আরও অর্ঘ

ভিক্ষে করে আনা চাল, কাঁসার রেকাবে মৃদু রোদ

রোমহর্ষ করে তোলে জামবাটি, মধু ও গোচোনা

কী ভাবছ? সিঁড়ি দিয়ে আমি এই প্রথম উঠছি?

অশোকবনের পথে পালকি থেমেছে। পাল্লা নেই

ভেতরের দিকে যত যাই, তত চেরির বাগান

দেখি আচার্যর পায়জামা ওড়ে, আর কলাবন

থেকে বাগদিদের ইট এসে পড়ে, পালাও পালাও!

একটি প্রার্থনা

ফ্রন্টিয়ারে বৃষ্টি। দ্রুত হ্রদের কিনারে চলে এসে

শেষ গান শেষ করে মারা যাচ্ছে রাজহাঁসগুলি

ভয়াবহ। পালটে দাও খুলির ভেতর পুরে রাখা

তুলো দিয়ে ঢাকা ব্যাটারির সেল, ভাল্‌ভ, কাঠগুঁড়ো

ঘুমালেও পায়ের চেনের শব্দ কম্বলের নীচে

মোম আর কটু অ্যামোনিয়া ছাড়া এবার বসন্তে

আমের বৌলের গন্ধ পেয়ে যাব জানলা খুললে

ভয় হয় যদি সব গোলমাল করে ফেলি; দূর

মরুভূমি দিয়ে যেতে যেতে ফাঁকা সরাইখানায়

যদি দেখি সেই দীর্ঘ শাদা দাড়ি বৃদ্ধ চা খাচ্ছেন?

কার বেশি চমকাবার কথা, কুড়ি দিনে যে আমাকে

তৈরি করে ফেলে গিয়েছিল বনে, তার না আমার?

গোধূলির আগে যদি কোনও দোষ করে থাকি, তবে

ফ্রন্টিয়ারে হ্রদের কিনারে এসে তাও ভুলে গেছি।

অন্ধ কোকিলের ডাক

টাওয়ারের নীচে এসে দাঁড়িয়েছি; ঘন জ্যোৎস্নায়

মথের মৃত্যুর দৃশ্য ছাড়া কোনও অনন্য ঘটনা

এভাবে দেখিনি আর, পাতাবাহারের ঝোপ যেই

সরে গেল সূর্যাস্তের দিকে, ঠিক সেখান থেকেই

অপরাধবোধ শুরু। বেতারতরঙ্গে নিয়ে আসা

মৃত হৃদয়সংকেত, তার মধ্যে তৃতীয় শ্রুতির

জন্ম: কোকিলের ডাক ধরতে পারছি, তবে ঠিক

কে পাঠাচ্ছে, কোনদিক থেকে কোন দুর্গের সিপাহি

জানতে পারিনি: আরও একটা বসন্ত লেগে যাবে।

ল্যাবরেটরির শূন্য ছাদ থেকে গোলাপের গন্ধ

নেব ভেবে উঠে দেখি আরও কয়েক কিলোমিটার

মরুভূমি এগিয়ে এসেছে—চালাঘর, মাইক্রো ওয়েভ

জ্যোৎস্নায় তারকাঁটা, পপির বাগান ডুবে যাচ্ছে

একটু একটু করে। এবার আমাকে ছেড়ে দাও

ক্যাপটেন, তোমার ছেলের গায়ে সোয়েটার, আর

মথের মৃত্যুর দৃশ্য—এই দুই খারাপ ঘটনা

থেকে আবার আরম্ভ হবে অন্ধ কোকিলের ডাক।

স্নানঘাট, লুনার স্টেশন

বন্ধ চোখ খুলে গেছে লুনার স্টেশনে, জাহাজের

থেকে নেমে সেই রাত্রে পালিয়ে গেলাম টয়লেটে

নিয়নের লাল আলো তার সঙ্গে তীব্র হুইসেল

কাচের জানলা খুলে পরে দেখি সূর্য অস্ত গেছে।

কাদার ভেতর যে সামান্য মিথেন এখনও আছে

তাও ছেঁকে নিতে হবে—ভাবছিল, ঠিক সে সময়

দীর্ঘ, ভারী দেহ নিয়ে প্রায় মানুষের মতো ধীরে

M-16 এসে দাঁড়াল পেছনে, ভোর হচ্ছে

মরুভূমি থেকে অল্প দূরে লাল ল্যাবরেটরিতে

মুহূর্তটি যে-কোনও পাখির কাছে শুদ্ধ উষাকাল

অথচ জাহাজ থেকে পালানোর পর টয়লেটে

প্রথম যেদিন ডাহুকের ডাক শুনি—মরে গেছি

কোটি কোটি মেগাওয়াটের চেয়ে বেশি বাষ্পশক্তি

মাথার ভেতর নিয়ে গাছপালা ঠেলে চলে আসি—

ক্রমে দূরে সরে যায় স্নানঘাট, লুনার স্টেশন

ভোর হচ্ছে মরুভূমি ঘুরে লাল ল্যাবরেটরিতে।

আমি পূর্ণ

এই হিংস্র পাঠানকে নিয়ে আজ রাতে আমি শুতে যাব। বিপদসংকুল বহ্নি উঠেছে ওপরে। সব ছারখার করে দাও। বলিষ্ঠ শক্তির মধ্যে যেন আজ আবিষ্কার করি আমি পূর্ণ, আমি বসুন্ধরা, আমি নারী। আমার হিরের আংটি পড়ে থাক মৃত্তিকায়। আমি যেন ভোরবেলা উঠে দেখি উষার আলোর নীচে আমার স্তনের জন্য হাহাকার পড়ে গেছে পিতা ও পুত্রের মধ্যে।

আপনার দাসী

আপনার বিছানা গুছিয়ে রাখি ভোর হতে হতে

আপনার মশারি টাঙিয়ে দিই রাত আটটায়।

এই দুই ঘটনার মধ্যে আমি আপনার দাসী

নাপিতের নাবালিকা, আপনার কোনও পাপ নেই।

রাতে তবু মুখ গুঁজে দেন কেন আমার দু’পায়ে?

কোষে কোষে যদি ফের দেখা দেয় ঋতু? নামে ঘাম?

পুত্রহীনা; তবু আগে নারী, পরে নিজেই নিজের

স্তন চুষে ফেলে দেব; আপনার দোষ নেই কোনও।

এক টাকা

পরপর তিনজন বলাৎকার করে তার অজ্ঞান শরীর

দড়ি বেঁধে টেনে আনে গলির ভেতর, নীল বৈকুণ্ঠের পথ

শুরু হতে দেখা গেল শ্রীমাধব বন্ধ্যা নরনারীদের হাতে

পরিয়ে দিচ্ছেন লোহা, তাঁর তামারং তনু দেখে গুটিপোকা

রতির উচ্ছ্বাস শেষে মারা যায়; হুঁকো কটু হল তামাকেও।

কূপমণ্ডূককে কারা গবাক্ষ উন্মুক্ত করে দেখিয়েছে চাঁদ?

বাজিমাত; মাছের আঁশের থেকে স্বর্ণআভা ঝিলকে উঠেছে

তিনজনে মাধবকে একসঙ্গে দেখে মেয়েটির দেহ গলা

থেকে ছিন্ন করে রেখে ছোটে। নতুন হুঁকোয় ঝিমোতে ঝিমোতে

এসে দেখলেন: শেষ; যোনিমুখে পুরে রেখে গেছে এক টাকা।

অন্য বসুন্ধরা

বর্শা ছুড়ে মারি চাঁদে; ভিখিরির মতো আমি পরশ্রীকাতর

চোখের সামনে থেকে সোনার বৃশ্চিক তুলে নাও; তীব্র ক্ষোভ

নিয়ে দেখি অস্তরাগ; প্রথমে ছিলাম রাজা, এখন রাক্ষস

হয়ে ত্রস্ত যামিনীতে বাগানে বাগানে ঘুরি, ভেনাসের ঊরু

শিরীষ কাগজ দিয়ে ঘষে রজোগুণ উসকে নিই, কোটালের

চর হাঁকে: কে ওখানে? গুহার ভিতর দিয়ে মাথা নিচু করে

দুই, তিন, চার মাইলেরও দূরে এসে দেখি: অন্য বসুন্ধরা

শান্ত ঝরনা, জনহীন—গিয়ে বসি একশো ছেলের হাত ধরে।

বৃংহণ

আমি ঘাতকের কাছে এলাম; সে নিচু হয়ে আমার পায়ের খুর দেখতে লাগল। আমি ছুটে মা-র কাছে এলাম; মা আমার বড় বড় লোমে হাত বুলিয়ে দিল। আমি আত্মজের কাছে এলাম; সে জীবনে প্রথম কোনও হস্তীর শুঁড় দেখছে এভাবে তাকাল— দেখছে দুটো বিশাল কান, মাঝখানে ফুটো। আমি স্ত্রীর কাছে এলাম সবশেষে; সে আমার দুটো হাত নিজের গ্রীবায় পরিয়ে আমূল কাঁপিয়ে দেবে যেই—আমি চিৎকার করে উঠলাম যন্ত্রণায়।

আমি কি দানবের মতন দেখতে?

আমি কি ভগবানের চেয়েও রূপবান?

আপাদমস্তক কালো কম্বল জড়িয়ে আমি কাঁদতে কাঁদতে—আমি বৃংহণ

করতে করতে ছেড়ে এসেছি তোমাদের লোকালয়।

হত্যাকাণ্ড

কৃষ্ণপক্ষ। টগর ফুটছে। ভোর হতে ক’মিনিট

মাত্র বাকি। বেরিয়ে পড়ল দুটি লাল প্লেন।

দু’রকমভাবে দেখা গেল লাইটহাউসের আলো

দু’রকম গোলাবাড়ি, পিরামিড, গমখেত সেও

ভূমি থেকে সোজা উঠে আবার মিলিয়ে গেল দ্রুত

ফেলে আসা কয়েকশো একরের শান্ত ভেনাসের দেশে।

টগর ফুটছে। শুধু এইজন্য এখনও পারিনি

মাইক্রো ওয়েভ থেকে মুহুর্মুহু নির্দেশ আসছে:

বোতাম টিপুন; ভোর হতে মাত্র ক’মিনিট বাকি

ভোর হচ্ছে থমথমে পান্থপাদপের বন ঘুরে।

গেল বসন্তের রাতে কৃষকেরা এখানে প্রথম

হাতে তুলে নেয় টমিগান আর আশ্চর্য পতাকা।

টোকা গড়িয়ে নামছে, পাতা ফেটে টপটপ করে

জল পড়ছে মৃতের কপালে, বহুদূর ছুটে গিয়ে

অট্টালিকার অর্গল খুলে ভয়ে ভয়ে দেখি: আর বাষ্প

নেই টগরবাগানে, রোদে ভরে গেছে শান্ত ভেনাসের দেশ।

দু’জন পাদরির মধ্যে

চসারের চার্চে আর কখনও যাব না, ঘুরে ঘুরে

নতুন যবের খেতে এসে বহুকাল বাদে আজ

একটু জিরিয়ে নিই; ফিরে যাচ্ছে, নিতে এসেছিল

যে লাল রঙের গাড়ি, তার অসমাপ্ত এভিনিউ

কুশের জঙ্গলে ঢুকে মুছে যায় ক্ষুব্ধ মৃগয়ায়।

ওইতো সাহেব সোনা চুরি করে পাদরিকে দিচ্ছেন

আর ফাঁকা দুরন্ত ফিটন ছুটে চলেছে যুদ্ধের

খবর আনতে, চার্চ বাদে সমস্ত বাড়ির নীচে নীচে

শস্য ও গন্ধক রেখে দাও, চালাঘরে আগুন লাগিয়ে

সরে এসো, এক রাতে বাগদিপাড়া শেষ, ওখানেই

বাকাসের রথ থেকে কুমারী মেয়েরা নেমে এসে

নতুন নগরী নয়, চেয়ে বসলেন দক্ষিণের

নাচঘর, নীল মোজাইক, দুটি করে পুংমূর্তি।

আমি বিকেলে একাই হাঁটছি, ভূত মাথা থেকে টুপি

খুলে ফেলে দিল পানাপুকুরের জলে: কী দেখছিস?

স্বর্গের সমস্ত পথ খোলা শুধু একখানা ছাড়া।

সেখানেই দু’জন পাদরির মধ্যে ঝগড়া চলেছে

বাটখারা নিয়ে, সোনা নিয়ে, দূরে আমি হেঁটে যাই

চৌধুরীবাড়ির উপকথা

সেই দিন তিনি খুব ভোরে উঠে উপভোগ করে ফেললেন বর্ষাকাল

কোকিল ও স্ত্রী

সাগরদ্বীপের বাড়ি, বাড়িতে দাসদাসী, বউ, নাপিত

স্ত্রীর জন্যে এনে রেখেছেন কিছু মেয়ে

রাত্রে ভাল না লাগলে সিঁড়ির ঘরে গিয়ে পড়াশোনা করেন

ভোরে ঘুমিয়ে, বিকেলে উঠে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান

শেষজীবন তিনি কবিতা লিখে কাটিয়ে দেবেন স্থির করলেন।

ঝড় হোক বৃষ্টি হোক চৌধুরীবাড়ির পালকি হ্রদ দেখাতে নিয়ে যেত

সাথে থাকত কাঁচা কফি, দুধ, দ্রাক্ষা

এবং স্ত্রীকে বলা থাকত সেসব রাত্রে তাঁর বাড়ি ফিরতে দেরি হয়

যে কোনও একটি ময়ূর হলে তাঁর চলে যাবে— এই যা একটু বিমিশ্রতা

তাও—শেষজীবন তিনি কবিতা লিখে কাটিয়ে দিচ্ছেন, স্থির করলেন।

এবার নয়টি প্রদীপ জ্বেলে মানুষকে স্থাপত্য, থইথই ও কীর্তন থেকে রস

দিতে নামলেন।

শিষ্যরা তাঁর পায়ে গ্রীষ্মকালে কলা ও কুমড়ো দিয়ে যেত

এবং সেখান থেকে তারা সংখ্যায় সংখ্যায় ছড়িয়ে পড়ত পরগনার ভেতর

শেষজীবন তিনি কবিতা লিখে কাটিয়ে দিচ্ছেন, স্থির করলেন।

’৭১ সালে পূর্ত বিভাগ থেকে তাঁকে একটি পক্ষীঘোড়া উপহার দেওয়া হল

তিনি বোকা ও ধীমান উভয় শ্রেণিকে সাহায্য করেছিলেন

রোমহর্ষ গুহাগুলি চিনিয়ে দিতে

যেগুলির ভেতর বসে কাজ করতেন অধ্যাপক ও কিছু তরুণ

আজকাল যে কোনও সমিতি থেকে ফিরে এসে বাগানে গিয়ে বসেন

বাগানে তখন হেমন্তকাল থাকে, ভৃত্য চা দিয়ে যায়

আর ডান দিকে মগ্ন হয়ে বসে থাকেন গৃহপালিত স্ত্রী।

শেষজীবন তিনি কবিতা লিখে কাটিয়ে দিচ্ছেন—স্থির করলেন।

আমাদের গল্প

আমাদের পাঁচ কাঠা জমি ও একটি করে গোরু দেওয়া হল

আমরা একটা গাছকে চতুর্দিক করে আমাদের গ্রাম প্রতিষ্ঠা করলাম

স্থির করা হল, গ্রামে কোনও নপুংসক থাকবে না

একটা সম্পূর্ণ শীতকাল আমরা ব্যয় করব কাঠ সংগ্রহের ব্রতে

গাছের নীচে বেজে উঠল শাঁখ ও ঘুঙুর

একখণ্ড ধাতু স্পর্শ করে শপথ করলাম আমরা পরশ্রীকাতর নই।

আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি পরস্পর তামাকে ও কলহে লিপ্ত—

লোহার কুচি, দাবার ঘুঁটি, হ্যারিকেন, ইঁদুর, উল্কা প্রভৃতি উড়ে আসত

তাতে আমাদের গোরুগুলি, ঘাস খাওয়া বন্ধ করে আকাশে তাকাত

আর ধীরে ধীরে পশ্চিমাঞ্চলের বনে প্রসার ঘটত হরিণের চাষ।

আমরা তির ছোড়া ও তাঁত চালনায় বিশ্বাস রাখি

কোনও জুজুবুড়ি, বা কোনও শুয়োরের ছানা গ্রামে প্রবেশ করলে

আমরা তাকে কচুবন, হাঁস ও ইক্ষুরস দিয়ে মুগ্ধ করে ফেলব

একটি সরোবর স্থাপনের জন্য প্রবীণেরা বায়না করেন,

যাতে হুঁকো খেতে খেতে হেমন্তের বিকেল কাটাতে পারেন তীরে বসে,

পদ্ম দেখে।

একদিন, রাত্রে আমরা ঘুমিয়ে পড়ব তড়িৎপুঞ্জের সাথে

কোনও কিন্নর বা চৌকিদার নন

একজন মানুষ শাসন করবেন আমাদের গ্রাম

তাঁর এক হাতে আমরা তুলে দেব একটি বেত, অন্য হাতে শান্ত এক ঋতু

তখন নক্ষত্র থাকবে,

আর

আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি তামাকে, কলহে, পুষ্পে, ইঞ্জিনে লিপ্ত

থেকে যাবে।

চোঙ

একটি নিম্নমধ্যবিত্ত লাফ দিয়ে ফস করে তোমার জানুর ভেতর মিলিয়ে গেলাম

দৈর্ঘ্য ছিল না—

যদি চোঙ আমাকে গ্রাস করে নিত—ওই নির্জন গলি, সিঁড়ি নেই

একটু দূরে একটা ঝরনা

ফাঁকা বেজে যাচ্ছিল এস্রাজ, আমি আচমকা পড়ে গেলাম

দৌড়ে বাগানে গিয়ে দেখি: সাপ চলে যাচ্ছে

ছুটে ছাদে যেতে, সেখানে তারা ভেঙে পড়ল হুড়মুড় করে।

আমি কি কাঁধে করে ছায়া নিয়ে যেতে যেতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?

একটা বিরাট বাটির ওপর উঠে দুটি মেয়ে আমাকে হাওয়া করেছিল?

পেট থেকে পা পর্যন্ত যা ইচ্ছে তুমি হও, গলা থেকে মুখ, চুল সব আমার

ভাসমান, জৈব, লম্বা—ধরে ঝুলে আছি

তুমি কি গাছপালা, বাড়িঘর, বৃষ্টি, শনিদেবতা নিয়ে জট পাকিয়ে ফেলছ?

চোঙের ভেতর বসে দেখতাম একঝাঁক বক উড়িয়ে দিয়ে

তুমি চিৎকার করে উঠতে: বিকেল!

আর যেদিন চোঙ ভেদ করে নেমে এলাম, দেখি পৃথিবীতে

ছায়া নামছে, সরু, শাদা, অসমাপ্ত ছায়া।

গাভীর শৃঙ্গার

বিষুব পর্যন্ত গিয়ে ভাগ্য ঘুরে গেল গন্ধকেশরের নীচে।

সোনার থালায় রাখো মাছ, বটের পাতায় রাখো আয়না, সিঁদুর

এর চেয়ে শুভচিহ্ন আর কিছু নেই;

দয়াময়ী তাঁর সত্তর বছরে আরও একবার উঠে এসে বললেন:

দু’ভাগের এক ভাগ যাবে ঘোষালবাড়িতে, আর এক ভাগ

পাঁচ এয়োতির হাত ঘুরে উনুনে উঠবে;

কুমার গন্ধর্ব তবু ডাকে, এসো, মরুভূমি শেষ হচ্ছে—তিসরি মঞ্জিল।

তবে কম্যুনিস্টদের ফিরিয়ে এনেছে আমার ছেলেরা? সুচে সুতো

পরাবার ছলে বিরাশির মে মাসে দিগন্তে তাকালেন দয়াময়ী

ঝড়ে দেখা গেছে ঘূর্ণির আবর্তে ধরা একচক্ষু মাথা—

সেই ত্রিনয়ন

কালো কুচকুচে জামফল—ভৃগুর তাণ্ডব,

সেই চালাচ্ছে জগৎ।

শ্রীচরণেষু বড়দি—আপনার স্বামী, দেখবেন, এবার শ্রাবণে

ঠিক ফিরে পাবে চোখ

কাঁদবার জন্য ওই অপরূপ আঁখি খুব দরকার ছিল।

হেড লাইটের আলো নাচে হরিদ্রার বনে, আমি ভয়ে ভয়ে

এক পা পিছেই, এক পা এগোই

এরকম করতে করতে সন্ধ্যাকালে ধরা পড়ে গেছি

সরাসরি প্রেতের পেছনে

লাল ত্রিকোণের মধ্যে এক ফুটো—সেটা লক্ষ করে

আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে ঢুকে গেল।

অন্য পিঠে বের হয়ে দেখি একেবারে ভিন্ন জগৎ

হিজড়েরা হাতে চেরিফুল নিয়ে বাড়ি বাড়ি নবজাতক নাচাচ্ছে

তাদের কুৎসিত মুখে সানগ্লাস—প্রতিদিন সূর্যাস্ত পিছিয়ে

দিচ্ছে জটিল স্ত্রীরোগে

কুলোয় বিছানো দোক্তাপাতা

সেখানে পাহারা দিতে দিতে

দয়াময়ী ভাবলেন: দুয়োরে এলেও পাপ, অমঙ্গল হবে

ছোটবউমার—

আজ এ বয়সে

সবই সমান—বাটা হলুদ, রক্ত, গুটিবসন্ত, পুঁইবীজ

সবই চোখে এক ফুট থেকে কাছে আসে, ফের

ধীরে ধীরে এক ফুট দূরে সরে যায়

এইভাবে, একদিন, মাত্র দুই হাত দূরে তাঁর ছোট নাতনিকে

দাঁড় করাতেই

মনে হল নষ্ট হয়ে গেছে তাঁর আশ্চর্য ভিশন—

লং, মিড, ক্লোজ একাকার হয়ে গলির ভেতর স্থির বস্তু

উইকেটে আটকে গেল।

কুমার গন্ধর্ব ডাকে মরুভূমি শেষ হয়ে যায় তিসরি মঞ্জিল

গুঁড়ো দোক্তাপাতা বমি হয়ে উঠে এল—

তার দুই টন মোটা ভারী দেহে থমথম করে গাভীর শৃঙ্গার

আর এতদিন পরে চুনকাম করা গোলাবাড়ির দেয়াল দেখা গেল ফাঁকা

সেই চুনকাম করা শাদা চুনের ভেতর আজ থেকে থেকে

দেখা দিচ্ছে: ভেলভেট, পীত, জেডব্ল্যাক, দোক্তা, কামরাঙা।

ষাট, ষাট, ষাট

তখনও ওঠেনি চাঁদ; গুঁড়ি ধরে লাল জামা গায়ে আততায়ী

অপরাধবোধে কাঁদছে আর দূরে পুড়ছে টায়ার

শামুকের দাগ চিনে চিনে

বেলাতটে গণ্ডি কেটে ঘণ্টায় একশো কুড়ি কিলোমিটারের ঝড়

সহ্য করে অপেক্ষা করছি

তরুণী ভার্যার জন্য

পরিবর্তে দেখি এক মিশকালো তফসিলি নারী—

তার এক চোখ কানা

অশ্বের গ্যালপ্‌—একবার চাঁদ আছে, একবার নেই

এই করে করে আমাকে গুহার মধ্যে যেই ঠেলে ফেলে দিল

দেখি: একটা নয়, শত শত গুহা

প্রত্যেক গুহার মুখে একজোড়া জুতো উলটো করে রাখা, মানে

যে গেছে, সে

বেরিয়ে এলেই তবে আমি যাব।

মাথার ওপরে আঁকা কর্কটের ছবি, যার আঁকা তার হাত কুষ্ঠে ভরে যাক

তবু জুতোজোড়া কী আশ্চর্যের; পাশের অলিন্দ খুলে দেখি:

রক্তে ভিজে গেছে বেডশিট, মা বাবাকে জাপটে ধরে কাঁদছে আর বলছে:

এ কি রোগ তুমি নিয়ে এলে

এ বংশে! কত নম্বরে গিয়েছিলে?

অশ্বের গ্যালপ্‌—একবার চাঁদ আছে, একবার নেই

কাঁচা বাঁশে হলুদ মাখিয়ে

মা তাঁর ছেলের বউ ঘরে তুললেন

বছর যেতে না যেতে ছেলের ঘরের বন্ধ দরজায় এসে ভেঙে পড়লেন:

‘বউ, তুই আমার ছেলেকে ফিরে দে।’

উলটে দেখি: ১৩ নম্বর গুহার সামনে বুকে মুখ গুঁজে

পড়ে আছে এক অন্তঃসত্ত্বা

কটিদেশ মুক্ত, চাঁদের আলোয় মুক্ত লোয়ার অ্যাবডোমেন—

পাঁচ মাস হল

ফুলে ঢাকা ফোড়া, তার ভেতরেই চালু হয়ে গেছে হার্ট

ভয় নেই

একটুও লাগবে না, তুমি চন্দ্রের জাতক।

‘আমিই আমার শত্রু’—তোর মুখে ছাই, ছাই আমার মুখেও

দেখি রাসমণি পাটি পেতে বসে, সাতকাল গিয়ে আজ

জন্ধুবনে মেঘ, আজ আর চোখে দেখেন না

তবু ঝিকে লক্ষ্মীর বাতাসা আনতে খুঁট খুলে দুই হাত দিয়ে

ধরে ধরে দেখছেন: আধুলি না কাঁচা টাকা!

বারো মাসে তেরো ষষ্ঠী—যাট, ষাট, ষাট

সুখে থাক রাসমণি—যাট, ষাট, ষাট

সুখে থাক ১৩ নম্বর—ষাট, ষাট, ষাট

ফোড়ার ভেতর হার্ট—যাট, ষাট, ষাট

দুধে ভরে থাক বুক—যাট, ষাট, ষাট

শুকনো গুঁড়ি ধরে আততায়ী কাঁদছে আর দূরে পুড়ছে টায়ার

পেছনে দগদগে, চুলকে চুলকে রক্তঝরা ক্ষতের মতো দিকচক্রবাল

এই দুই দৃশ্যের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছি

ঘুরে দেখি: এক খঞ্জ তার ভিক্ষালব্ধ দিনান্তের চাল ও পয়সা

ছুড়ে মারছে আমাকে।

চুম্বকের ঝড়

লোহার বাঁকানো সিঁড়ি উঠে গেল; টানতে টানতে

আমাকে দু’জন অন্ধ নিয়ে যাচ্ছে ভরগোধূলিতে।

ঘাড় কামড়ে কেশরে মুখ ঢাকি; চুম্বকের ঝড়

অতিক্রম করে যাবে স্নানঘাট, ডালিয়া বাগান।

বধির করতে হয় যদি সূর্যাস্তের আগে করো

ছায়া যাতে টগবগ করে কাঁটা চামচে ও প্লেটে

এরপর স্ত্রীপর্বের শুরু; শতরঞ্জি পেতে লাঞ্চ

মুখ থেকে গ্লাস কেড়ে জল খাচ্ছি, বলো, আমি ভ্রষ্ট?

থাকবে না

আশির দশক বলে আলাদা করি না—যারা গেছে

তারা গেছে, তাদের দু’লক্ষ ভাই যেন ভাল থাকে।

আশির দশক বলে আলাদা করি না; তবু শুনি

ছেলেরা প্রস্তুত; শুনি ই.এফ.আর. নেমেছে জেলায়।

আশির দশক বলে আলাদা করি না; ট্রাউজার

নদীতে ভাসছে; পাড়ে ভ্যান, ভিড়; যার গেল, গেল

চূড়া থেকে দেখি সার সার জিপ শহরে ঢুকছে

আমি থাকব না জেনো, থাকবে না আশির দশক।

মড়কের আগে

দেখেছেন এই সারা গায়ে দাগ? থাবা দিয়ে আঁচড়ানো?

আমাকেই ওরা বিষাক্ত সব লতাপাতা দিয়ে মেরেছিল

দেখেছেন এই মুখের এপাশে গ্যাংগ্রিন, পোড়া ঘা

আমাকেই ওরা মধু ও পারদ দিয়ে বলেছিল, খা

মড়কের আগে গন্ডার হয়ে হা হা করে চেঁচিয়েছি

কেঁদেছি শরতে ঘোটকের পিঠে জ্বলে যাওয়া ধান দেখে

ওসব কিছু না, হাভাতের দল, যা যা বাড়ি ফিরে যা

দেখেছেন এই বিশ্ব, এখানে গলি চিনে চিনে এসেছিলাম

টপকে চলেছি সাপ ও গরুড়, গণিকার খোলা গা

দেখছেন দাগ, মুখের এপাশে ফেটে যাওয়া গনোরিয়া

আজও লম্পট, লোভী আমি, পাপে ভারী হয়ে আসে পা

অরণ্যদেব

তেইশ বছর এই বনে আমি ডাকাতি করেছি ঝড়ে জলে

আমার মা, ভাই, বোন যেন দুটো খেতে পায়—

তেইশ বছর এই মরুভূমি আমি চালিয়েছি—এই একা

তাতার দস্যু কেটে নিয়ে গেছে ডান হাত

আমার মা, ভাই, বোন যেন দুটো খেতে পায়

চিৎকার করে গ্রাম পুড়িয়েছি, ভেঙেছি স্থাবর, জঙ্গম

আমি ভয়ানক এখনও, আমার ভাই বোন যেন খেতে পায়

অকৃতদারের কবিতা

এই হল এক বিকলাঙ্গ দারোগার বাড়ি।

লাল ত্রিকোণের স্বপ্ন দেখে আরাম চেয়ারে বসে আছে।

এই তৃণভূমি, অস্ত্রাগার, কাফে

ক্ষিতি, লয় ও প্রলয়

সব ছেলেদের হাতে চলে যাবে?

কে? কে ফিসফিস করে এত রাতে বাইবেল পড়ছ?

মলদ্বার, মূত্রদ্বার থেকে আজ ফের রক্ত পড়েছে।

মাও সে তুঙের মুখ ভেসে ওঠে

হবে না, হবে না

আর কোনওদিন এই তৃণভূমি, অস্ত্রাগার, কাফে আমার হবে না।

ঋক্ষ মেষ কথা

আমার মাথার রং ও আয়তন দেখে চমকে উঠেছিল মা।

আজ, আমার আর কষ্ট হয় না,

প্রথম প্রথম অনেকেই ভয় পেত।

আয়নার সামনে এসে দেখি মানুষের না, আমার মাথা এক মেষের

আয়নার সামনে এসে দেখি মানুষের না, আমার মাথা এক ঋক্ষের

এই ঋক্ষ মেষ গল্পের ভেতর কোনও হাহাকার নেই, কৌতুক ঢোকেনি

কোথাও

এক গন্ধর্বের ছেলেমেয়ে সূর্যাস্ত দেখতে এসেছে

আমি তাদের মাঝখানে পিঠে কুঁজ নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছি

কুঁজের অগণিত মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে কীট।

তুঁতে রং ঘর

যার সাথে কাল শুয়েছ, তাকাও

আজ তার নীল মাথা

ফেটে বের হল অর্ধমানব

সারা গায়ে বিষপাতা।

খোলো পিঠ; কারা এঁকে রেখে গেছে

দাঁত-নেই-মাড়ি, ঠোঁট

জঠরে কি আজও হু হু করে জ্বলে

গিলে ফেলা আখরোট?

যে নারী ডেকেছে তুঁতে রং ঘরে

স্বামী ছেড়ে গেছে তাকে

লোমে ঢাকা পায়ু, বাঁ দিকের স্তন

সারারাত খোলা থাকে

এরপরও যদি শুতে যাই, যদি

গলিপথে পাপ করি

তোমার সঙ্গে সংগমরত

রাত্রিতে যেন মরি

দু’জন দ্রষ্টা

আমার মৃতদেহ নিয়ে চলেছে শকট

পেছনে দু’জন নারী, দু’জনেরই শোকের আরম্ভ

আমার মৃতদেহ নিয়ে চলেছে শকট

পেছনে দু’জন দারোগা, ত্রিকালদর্শী

আমার মৃতদেহ নিয়ে চলেছে শকট

পেছনে দু’জন পুরোহিত, অপমানিত, বধির

আমার মৃতদেহ নিয়ে চলেছে শকট

পেছনে দু’জন কবি, দু’জন দ্রষ্টা, দু’জনেরই চোখ ছিল নীল

.

দুষ্কৃতকারীর সঙ্গে

অন্নলীলা

বাঁশফুলের অশুভ গন্ধ বের করে আনে সব ইঁদুরকে

গ্রাম ছেড়ে যায় এক এক গোষ্ঠী, যারা যেতে চায় না, মাইলো

খেতে খেতে দেখে জ্যোৎস্নায় ইঁদুর উঠছে বাঁশের মাথায়

কিছুই পড়েনি পেটে, তবু গর্ভে এক পাঁচ মাসের শত্রুকে

নিয়ে যে মেয়েটি এল পুকুরে ডুবতে, দেখে কালো জল ফাঁক

হয়ে সরে যাচ্ছে আর কাদা থেকে উঠে আসছে টাকার গাগরি

অপদেবতা নয়তো? দেবতার দুই হাত ভরতি কাঁচা সোনা।

তিনটি ডাকাত খোঁজে খাদ্য—দূরে জ্যোতির্ময়—এভাবে দূরকে

তারা আরও দূর ভেবে চাঁদকে পা তুলে লাথি মারতে চাইল।

শুক্লাতিথিতে তার হাতের ওজন কমে, আট সের মাথা

ভেসে ওঠে, মুখে জল কুলকুচি করে বলে: এভাবে মৃত্যুকে

জানো, কোনও ক্ষোভ নিয়ে ভুবনে এসো না, কারা বলে রাখ্‌ রাখ্‌

কখনও ছুঁবি না কলসি; খোল করতাল বাজে মাঠে, তবে হরি

খেতে দেবে ভাবো? তাঁর অন্ন নিয়ে ছেলেখেলা এখনও গেল না?

গল্পে আদিরস

খল চরিত্রের নায়কেরা জেদি, তারা এসে দাঁড়াল সীমান্তে

প্রেতাত্মা হলুদ নিয়ে ছেড়ে যায় জামগাছ সন্ধ্যার বিষুবে

আর দেখি নায়কের মাথা থেকে লাল মাঙ্কিক্যাপ নিল খুলে।

মর্ষকামী তবু তারা ত্রিযামার কোলে নবজাতক দিয়েছে

জাতকের পেট খুলে গেল আর দেখা দিল দামি পদ্ম, দস্তা,

মৃতের চোখের পাতা দু’হাতে উপড়ে দেখে তারকার জ্যোতি,

সিন্ধুবারি, বাঘছাল পরে লঙ্কার আচার খায় নারীসহ

হিজড়েরও ঋতুস্নান হয় করমচার বনে একথা মানতে?

মহাপ্রয়াণের আগে তারা নায়কের সঙ্গে একরাত শোবে,

ফুলের ভেতর দ্রুত সন্তান প্রসব করে দেখে তার চুলে

বিষাক্ত গ্যাসের স্তর, ডাক্তার পরীক্ষা করে বলে যদি বেঁচে

যায়, শরীরের অগণিত ফুটো বন্ধ করে দিয়ে গালা পুরে

এইখানে—এই গল্পে আদিরস বেশি বলে টেনে দিই যতি

আর নারী ও উকিল নিয়ে আমাদের রাত্রি কাটে দুর্বিষহ।

অশনি আড়াল হল

তৃতীয় প্রহরে যেই অশনি আড়াল হল, ব্রোঞ্জের ঈগল

দৃষ্টিলাভ করে। গর্ভভার রাখতে না পেরে অদিতি বমন

করে এক লালবর্ণ ডিম, সেই ডিম ফেটে চব্বিশ ঘণ্টার

মধ্যে জন্ম নেয় অশ্বমুখসহ এক মোটা, প্রকাণ্ড জাতক,

নারী ও জন্তুর ছবি সারাগায়ে, আমি দেখি চোরা পর্নোগ্রাফি

মা তবু অশ্বের মুখে নিজের উন্মত্ত স্তন জোর করে পুরে

সমস্ত নারীত্ব দিয়ে দুধের উৎসমুখ চেনায় শিশুকে।

অশনি আড়াল হল পুনরায়, হাঁড়ি করে জাতকের ফুল

ফেলে দিয়ে আসি। রাত্রে সেই নীল মল ঘেঁটে তারা তিনজন

সোনা বের করে নেয়; যারা চাঁদ দেখে ভাবে এমন ধাঁধার

চেয়ে ব্লোহট অপেরা বেশি ভাল, উপকূলে বসে তারা শোক

করবে না; তারকার দিকে দু’বার পিস্তল থেকে গুলি ছুড়ে

দেখে, থেকে গেছে কিনা এখনও বিদ্বেষ। এই কুরূপের ফল

সে মায়েরই, সন্তানের পুংঅঙ্গ অনুভব করি ছুঁয়ে, শুঁকে।

ব্যঙ্গ

আমিই আমার ব্যঙ্গ, বীরের পোশাক পরে ছেড়ে আসি মঞ্চ।

উট ও নারীর মাঝামাঝি আমার পতন, সাগরের জলে

ভেসেছে গামছা, এরও চেয়ে বড় সত্য, আমি সমস্ত গরল

পান করে দেখি আর জলরাশি নেই,—ঠান্ডা বালির ভেতর

শুয়ে অবসর নিচ্ছে কুমারীরা, তাদের স্তনের মুখ কালো।

আমিই আমার ব্যঙ্গ, উট নিয়ে ঘুরি, বালি ছেড়ে মন চলো

বিষাদে আবার, শূন্য থেকে হাত বের হয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে,

চুল টানে, আবার লুকিয়ে রাখে শূন্যে। বলো, তবে কি সরল

ভাবে বাঁচতে চাইনি? যারা অন্ধত্বের ভয় আমাকে দেখাল

তাদের কি শোক নেই, পুত্রের মৈথুন দেখে কাঁপে না অধর?

আমি ভারমুক্ত হতে এসে দেখি ঘুষ নিচ্ছে সেই কুমারীরা

যারা মরালীর মতো শুয়ে অবসর নিত। টাকা কি পবিত্র

নয়—প্রেতাত্মারা বলে; চোখের সামনে আমি যত টাকা দেখি

একা সব খেয়ে ফেলতাম যদি, পাপ এসে আমাকে ঘিরত?

রূপ আর দাম

লেবুপাতা নাকে ঘষি। ভাঙা সরাইখানায় ঢুকে কুমারীরা

অন্ধের চোখের সামনে অন্তর্বাস খুলে ফেলে দিল, সারারাত

বহু লাল স্ফটিকের জ্যোতিমুখ ফেটে যায়, রঙের গোলক

থেকে শত শত ট্রেন নৈর্ঋত লক্ষ করে উঠল দুর্গমে

সরাইখানার নাচঘরে চোর ঢুকে দেখে কাঁদছে অন্ধরা

চোর চাবি নিয়ে মৌরি খেতে খেতে অন্য ঘরে ঢোকে, হিন্দুস্থানি

মেয়েদের ঘর, একা পেয়ে কেড়ে নিচ্ছে টাকা, সোনার বোতাম।

বাবার মাথার কাছে দাঁড়িপাল্লা, একে একে সমস্ত পরিরা

ছেড়ে গেছে, খাবার ওজন করে খাবে, তবু ঈগল বিরাট

হয়ে নামে স্বপ্নে; চোর সেখানেও, গিয়ে বলি, কীরকম লোক

আপনারা? আসুন আমার সঙ্গে, এই বলে অর্ধেক বিভ্রমে

গিয়ে আমি ঢেলে দিই খালের ওপারে এনে টাকা ঘড়া ঘড়া

চাঁদের আলোয় আজও কানা বক বসে আছে, বলে ‘জানি জানি—’

চোরসহ একযোগে দেখি ছড়ানো টাকার রূপ আর দাম।

অপরাধস্পৃহা

মলমাস থেকে দুধ, শাদা ভাত, তেজপাতা ও শুকনো খেজুর

এই খেয়ে খেয়ে একদিন ঘন অন্ধকারে জায়ের ছেলেকে

দেখে স্পষ্ট বুঝে গেল, তার অপরাধস্পৃহা একেবারে নষ্ট

হয়ে গেছে; স্বামী কি ফিরবে? হ্যারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে

তার মন যতদূর পারে চলে যায়— দুর্গম অরণ্যে ডাকঘর

শাদা বেসিনের গায়ে বমি করবার সে বাসনা এসেও আসেনি

ডাক্তার বলেছে: আপনার কোনও ত্রুটি নেই, স্বামীকে দেখান।

অশ্ব থেকে নেমে তিন যোদ্ধা এসে বলে আন ওকে ধরে আন

মোতিঝিলে—তবে এরা তিনজনে একসঙ্গে অর্থ খুঁজে নিক

আমাকে বলাৎকার করে। আয়নার বেয়নেট এরপর

আত্মগোপন করল। তবু জানি, তুমি স্বামী, তোমাকেই আস্তে

সরিয়ে দিয়েছি, ঠোঁটে লেগে গেছে লোম। জানলা খুলে দেখি অস্ত

গেল চাঁদ; শাশুড়ি ক্রোধান্ধ হয়ে ঢাকা কেড়ে নেয় বুক থেকে

স্বপ্নে দেখি: গৃহযুদ্ধ, চোর ঢুকে ভাত খেয়ে চলেছে তখন।

নবদম্পতি

অকালকুষ্মাণ্ড এক পুরুষের মনোলোক ভরিয়ে তোলার

জন্য সে দুপুরে বসে বসে ধাঁধা তৈরি করে, রোজ তার কটি

মোটা হয়, পেটে আঁকে মিথুনের ছবি, আর দু’খানা জোকার

দুই বুকে নিয়ে সারা মুখ চুন করে গিয়ে বসে চন্দ্রালোকে

যেন লোকান্তর থেকে ফিরে গোমূর্খটি স্ত্রীকে ডাকে: সোনামোনা

এসো, হামি দিই নাকে; রাতে তাকে চুমু খায় আর ওয়াক তোলে।

দৃষ্টি ভরে দেখে তবু গামলার মতো দুটি কুৎসিত স্তন।

আমি ধনুকের মতো বেঁকে মরে যাই যেন, ভাবি ধুতুরার

বাটা বিষ খাব; যদি ফের জন্ম নিই, যেন এবার ভাস্বতী

হয়ে আসি—তুঁতে রং তনু, তখন নিলাম হবে আমি কার?

সাতকুলে কেউ নেই; অঙ্কিত জোকার বুকে আসন্ন শোকের

কথা ভুলে, উঠে খেলা শুরু করে—আগুনের বল, টিন, সোনা

কামড়ে কামড়ে খেয়ে ফেলে, হাসে, পড়ে যায় আর কান মলে।

জোকারের চোখ মুছে দেয় এক কর্মচারী—তার অধস্তন।

ভিক্ষা

নারীধর্ষণের আগে ঘাতক যেখানে যায়, সেখানে বৃশ্চিক

শস্য নষ্ট করে ফেলে: জীবন্ত ভেড়ার মিহি লোমে কেরোসিন

ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেখে, মূত্রধারা বেয়ে বিষাক্ত পিঁপড়ে

পুংঅঙ্গ দিয়ে ঢুকে সব শুক্র শুষে নেয়, রক্তাক্ত থলিতে

শুধু জ্বালা, নীল বিষ আর আঠা; ময়ূরের মতো তার গায়ে

তখন অসংখ্য চোখ রোদ লেগে বন্ধ হয় খোলে, পশুপাখি

দেখে অর্ধনারীশ্বর নিয়ে লোকালয় ছেড়ে চলেছে ঘাতক।

তখন দু’ভাবে নামে সমকাল, একদিকে নেমে আসে বৃষ্টি

যেদিকে উটের সারি, কুঁজের মতন স্তন, শক্ত ও কঠিন

চামড়া পরানো; দাঁতে কেটে কেটে সে চামড়া করেছে ছিবড়ে

তবু শান্তি নেই আজ, কালপুরুষের সাত বাহু গ্যালাক্সিতে

লুঠ ও সন্ত্রাস করে ফেরে; পূর্ণিমায় বাড়ি এসে স্ত্রীর পায়ে

কামড়ে তাকিয়ে থাকে কোমরে বিছের দিকে, যত কষ্ট হোক

তুমি কি দেবে না ভিক্ষা নিজের ভিক্ষান্ন থেকে যদি হাত পাতি?

গ্লানি

এগিয়ে গিয়েছি একবার, পিছিয়ে এসেছি ফের তস্করের

পেছনে পেছনে বর্ণ চিনে আমি খঞ্জ, আমি অন্ধ, আমি ভাঁড়

অসহ্য লেগেছে উষাকাল, গিনি ওজন করার বাটখারা।

শোবার ঘরের দিকে চললাম: অপরাধ ছাড়া বাঁচব না

চাঁদ—আমি দেখি তুমি দেখো, যেন আর কেউ না দেখে কখনও।

পেশাদার এক রাজস্থানি মেয়ে সন্ধ্যাকালে যত আয় করে

গলির ভেতর তার চেয়ে বেশি লাভ ভেবে মেয়েটি আবার

খদ্দের ভাবল আমাকেই; মৃত বলে আজ কিংবদন্তি যারা

আমি কি তাদের প্রেত? গাধার পেটের মধ্যে থাকি? এ ঘটনা

জানা যার, তার থেকে আরও কি ছড়িয়ে যাবে এই আত্মগ্লানি?

আমি ব্যাধ ও পাখির মাঝামাঝি এক জ্যোতির্ময় শঙ্কা থেকে

দেখি শোবার ঘরের খাটে উঠে পড়ে গাধা, তার চন্দন ও

ঘন পুঁজে মুখ দেয়, ফুল খেয়ে ফেলে, অভাবের দিন জানি

অন্যায় না করে তবু টাকা নিতে গিয়ে কেন হাত গেল বেঁকে?

সরকার শতবর্ষে

যুদ্ধ জয় করে ফিরে সৈন্যদের মনস্তাপ আরও বেড়ে যায়

যে যার বাড়িতে বসে অন্ধকারে কার্পেট বিছিয়ে একা একা

লুডো খেলে—সাপ আর মই বেয়ে নিরানব্বইয়ের ঘরে উঠে

দেখে ভারতের ন্যায়, ধর্ম ব্যবসায়ীরাই হাতে তুলে নিল

ট্রাকভরতি সৈন্যদের ছেলেমেয়ে চুপ করে থাকে, পিপাসার্ত

তাদের পিতারা রাত্রে দোকানে দোকানে ঘোরে, ক্যাবারে রুমের

গায়ে লুকিয়ে নিজের নাম লিখে চলে আসে, পড়ে থাকে চটি।

গুপ্তচর দিয়ে দেয় ম্যাপ, সে মুখ তোলে না, ব্যারাকে সম্প্রতি

কোনও শোক নেই, তবু তাঁবুগুলি ফুলে ওঠে এই মরশুমে

স্ত্রীরা পুরুষগামিনী বলে যেসব কর্নেল চাবুক মারত

আজ তারা করজোড়ে বলে: আমি কি বর্বর, যারা ছিল ছিল,

ভালবাসিনি তোমাকে? পাতা ডিনামাইটের সঙ্গে বিদঘুটে

এ জীবন যেন চুরমার হয়ে উড়ে যায়। সরকার দেখা

দেয় শতবর্ষে, স্ত্রীরা রাইফেল জমা দিতে সূর্যাস্তে দাঁড়ায়।

চুনের হিসাব

ওপরে সপ্তর্ষি—নীচে ‘জল নেই, জল নেই’ বলে সে কী আর্ত

ডাক ছেলেমেয়েদের; গুমটি ঘরের থেকে থেমে থাকা ট্রেন

টেনে এনে বাৰ্চবনে আগুন লাগিয়ে দিল; ওদিকে স্বামী স্ত্রী

বাড়ি ছেড়ে পালানোর আগে সোনা জড়ো করে বাঁধছে রুমালে

রাত্রে সেই দামি ট্রেন পুড়ছে যখন, শাদা রথের চাকার

দাগ ধরে ধরে একা ব্যাবসা করতে এসে মেয়েটি দেখল:

তার ভবিষ্যৎ নেই, এত কম টাকা নিয়ে কি চালানো যায়!

যদি লাল ফলে হাত দিতাম কখনও তবে আমাকে মারত

ডাকাতেরা? আমাকে ভ্যানিশ করে দিত ভেলভেটে? তীক্ষ্ণ পেন

পুরে দিত চোখ দিয়ে সচল মস্তিষ্কে। দেশে খরা, রাজমিস্ত্রি

চুনের হিসাব ভুলে যায়, বাড়ি ফিরে বলে তুমি কি ঘুমালে?

বউ মারা গেছে, ভূত বলে, আমার গহনা বেচে যত টাকা

পেলে—গ্যালারিতে, লোকে লোকান্তরে, ততজন ফুঁপিয়ে চলল

জল নেই, আর চাঁদ থেকে পাথর পড়ছে দূরের চড়ায়।

মাকে ও দিদিকে

কাহিনিকারেরা বেইমান; মরুবিজয়ের আগে একা পেয়ে

আমাকে বধির করে ছেড়ে দিল জিরো জিরো সেভেনের দেশে

আবার ঊষর হোক মা-ভূমি, যেখানে এক্স-রে রুমের পাশে

চুপচাপ বসে থাকি সূর্যাস্ত পর্যন্ত; অন্ধ শিশুকে স্ট্রেচারে

তুলে নিয়ে যন্ত্রের তলায় রেখে গেছে। রাক্ষসের আলখাল্লা

পরে আমি ঢুকে পড়ি মুদির দোকানে, দেখি চালের বদলে

ইন্দ্রজালে জড়িয়ে পড়েছে ভাই ও বোনেরা, আর অন্য দিকে

একটি ইঞ্জিন অতি উন্নতমানের, এই সত্য দেখে কাঁপে

কলকবজাসহ। আমি দুই জিরোর একটির মধ্যভাগে এসে

আত্মহত্যা করে বেঁচে থাকি, কথাসাহিত্যের ভিলেনরা হেসে

পিস্তল দেখিয়ে তবু বলে: চলো গুপ্তধন নদীর ওপারে

আমার দু’হাতে গিনি, কোহিনুর, তাও জেনে গেছে দালালরা

যে হোটেলে থাকি তার কর্মচারীদের ঘুষ দিয়ে, দলে দলে

লোক আসে আমাকে দেখতে—এই কথা বোলো মাকে ও দিদিকে।

সৎকার

অষ্টম গর্ভের থেকে নেমে এসে আমি একা দাঁড়িয়েছিলাম।

আমার দু’হাতে দুটো পারিজাত দিয়ে পর্দা পড়বার আগে

গণিকারা চলে গেছে; তারা কি বুঝতে পারে জাতক অশুভ?

বেহালাবাদক নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে তারা গান করে খরা

দুর্ভিক্ষের, মড়কের, মারী ও দাঙ্গার, দেখি পুলিশের গাড়ি

তাদের পেছনে চলে থেমে থেমে; বাবা দিদিদের বকছেন

অন্নভিক্ষা মহাপাপ; সরে যেতে বলছেন দূর অন্তঃপুরে।

আমার দু’দিকে মরু, দু’জন যশোদা, যেন আমাকে নিলাম

করে দেখছেন ভাটিখানার ভেতর; তবে আমি কি দু’ভাগে

ভাগ হয়ে মেষ ও রাক্ষসের কাছে ক্ষমা চাব? চাদরের শুভ্র

পশম কি আমাকে জড়াবে? নদী ছেড়ে পাপ ক্রমশ চড়ার

দিকে উঠে আসে; দেখি রাক্ষসের সঙ্গে বাজপাখি মারামারি

করে উড়ে যায় মন্বন্তর যেদিকে তখন, যেদিকে যক্ষের

দৃষ্টি, গগনেন্দ্র গণিকার শব নিয়ে চলেছেন বহু দূরে।

পাখি ও বানর

যে মূহূর্তে তোমাকে চেয়েছি, ভস্ম হয়ে গেছে আমার অঙ্কুশ

তবে কি তোমার থেকে আমাকেও দূরে সরে যেতে হবে শূন্য

ট্রামে করে, যদি দেখি আমার পাশেই বসে আছে গুজরাতি

দীনদুঃখীরা, ‘ভাই’ বলে জড়িয়ে ধরব তাদের দু’হাত?

চক্ষুষ্মান বলে আমি তোমার অর্ধেক দেখি যারা কানা

তারা দেখে নিয়ন, আলেয়া, বিছে, কাঁকড়ার উত্থানপতন

কানার ত্রিমুখী ক্রোধ ফুলের ভেতর রাত্রে করল মৈথুন।

শেষ হয়ে যাবে তোর রূপ যদি অন্য বিছানায় গিয়ে শুস

আমাকে অভুক্ত রেখে,—রাত্রিকালে অশ্বডাক আবার শুনল

নদীর দু’ধারে যারা, তাদের খেলার ট্রেন, আজ রাতারাতি

গলি থেকে ছুটে গেল হিরের খনিতে, চাঁদে—যেখানে কিরাত

ধনুক যোজনা করে দেখে ক্রোশ ক্রোশ দূরে গরুড়ের ডানা

নিমেষে মিলিয়ে গেল মেঘে। তবে জলহীন মীনের মতন

চেয়েছি তোমাকে? পাখি ও বানর নিয়ে ঘুরি, হয়েছি ক্লাউন?

বিধ্বস্ত সৈকতে

এবার আমার পক্ষে দেখি কারা জড়ো হয় কামরাঙা বনে

দৃষ্টিহীনদের আমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভুল পথে তেপান্তরে

এনে দাঁড় করিয়ে দিলাম। যেন এই পূর্ণ আত্মহত্যার

পেছনে রয়েছি আমি। ডাকঘর আর বাড়ি—এ দুই কেন্দ্রের

ভেতরে কোথাও কোনও অশ্ব নেই, ট্রাম নেই, কাদাজল ভেঙে

ছাতা নিয়ে বর্গাদারদের জমি পার হচ্ছি, আমার সম্মুখে

এক শ্বেতবর্ণ হাঁস, আগে আগে সেই পথ দেখিয়ে চলেছে।

অভিশাপ কাকে দেব? তুমি প্রাণী না পলাশ আগে ঠিক হোক

তারপর রাত্রি হলে তোমার এপাশে অল্প শোয়ার জায়গা

করে নেব। আর সে মুহূর্ত থেকে বিধ্বস্ত সৈকতে ডাক্তারের

ধীর পায়চারি দেখে ভেসে উঠছি স্ট্রেচারে। বায়ুকোণ থেকে

প্রথমে শূন্যেই গুলি ছোড়া হল, মানুষ তো ছার, যদি শোনে

সেই শব্দে কোকিলও বধির হয়ে যাবে। নবজাতকের মুখে

ফেনা ভরতি স্তন যারা দেখেছিল, অন্ধ হয়ে গেছে তারপর।

ব্রাত্য

জাদুকর ও গণক একসঙ্গে ভিক্ষা করে আজ, অস্তরাগ

চলেছে তাদের নিয়ে নীল নৈর্ঋতের দিকে, তাদের পসার

নেই আর, তবু শীর্ণ, শঠ, কুরূপ, দরিদ্র মেয়েদের বলে

মড়কের পর এই শতকের শেষে তোরা হবি ইন্দ্রাণীর

মতো রজস্বলা, মহিষীর কানে ভাঁড় যেই একথা পৌঁছবে

আবার আরম্ভ হবে অপবিত্র ব্ল্যাকআর্ট। তাসবংশের

শেষ মুদ্রা খেয়ে ফেলে গাধা, চশমা মিলিয়ে যায় মহাকাশে।

যব থেকে তৈরি মদ শুঁকে শুঁকে গেল জিভ—অপ, তেজ, সোরা

মিশিয়ে যাহোক কিছু করো; কোনও লন্ডভন্ড না হলে অসাড়

লাগে শৃঙ্গারের সূত্র, পাখি ও পিঁপড়ে। যাবে জ্যোতিষ বিফলে!

আমরা এতই ব্রাত্য, ঘৃণার? যে গ্রাম দিয়ে গেলে শস্যহানি

হতে পারে এ বছর? শৃগালকে দেবতার মতন দেখাবে?

থাকতে না পেরে তারা আগুন লাগিয়ে দেয় চাঁদে ঢুকে, ফের

পারদমিশ্রিত মাটি মুঠো মুঠো খায়, বমি করে, আর কাশে।

কর্ণাটকে সোনার ব্যাবসা

তেলেগু নারীর কাছে এসে দেখি আমাদের চোখে জল, তার

থমথমে ভারী দেহে মাকাল ফলের মতো রূপ, যেন আর্য

পুরুষের দু’কূলে জোয়ার নামে, চেনে বাঁধা পোষা মর্কট

ঢুকে পড়ে রুদ্ধ ঘরে। কলা চিবোতে চিবোতে মুখ ভ্যাংচায়

অতীত নতুন করে শুরু এর পর—গবাক্ষের থেকে দূরে

তুষার নামছে, আর মুখে মাংসের হাড় নিয়ে দীর্ঘ সারি

অন্ধ কুকুরের। এ সময় গুদামের চাবি খুলে ঢুকে পড়ি

রূপ খুঁজি খটখটে ঘুঁটের ভেতর শুয়ে, গঁদের আঠার

টিন উলটিয়ে আমাদের গায়ে পড়ে যায়, যেন আর জোর

নেই কোনও হাতে, শুধু বুঝি গোমলের মধ্যে জ্বলে মরকত।

রাত্রি হয়, গঙ্গার নিস্তব্ধে নেমে হাত দিয়ে জলের তলায়

দুই বুক ধরে দেখে, আর ভাবে, যারা থেকে গেল ভবঘুরে

কর্ণাটকে সোনার ব্যাবসা জমে ওঠে যার, হোক স্বামী, ভারী

বয়ে গেছে একবার দেখে যেতে—জুয়ো খেলে যাক এ শর্বরী।

চাঁদের হাট

গর্ভকেশরের শেষে আবার আরম্ভ হয় থিয়েটার রোড

অশ্ব থেকে নেমে আমি দুষ্কৃতকারীর সঙ্গে টানা এক ঋতু

ধরে হেঁটেই চলেছি, বসন্তের বাইরেও—হোক গোঁজামিল

আরও এক তিথি, মাস, তারিখ আসছে যাচ্ছে, তাদের কী হবে?

দুষ্কৃতকারীর নাম কালা, ব্রণ আর একজিমার ভেতর

নেমেছে চাঁদের হাট সারা মুখে। এমন দ্বীপের কথা ভেবে

রেখেছে সে, যার মাটি হাতে নিয়ে একদিন লাফিয়ে উঠবে।

পাতাবাহারের দেশে শান্ত হয়ে আছে থানা, কুমার বিনোদ

রং কালো, গাঁট্টাগোট্টা, বাঁ হাতে আঙুলগুলো ছোট, বেশ ভীতু

ক্রাইমে নিশ্চল তবু, একটি চোখের পাতা বোজা, বহু তিল।

আজ নারী ও নরক সব এক হয়ে গেছে যে যার সংস্রবে

এসে, খাবার টেবিলে আমি দু’বেলা অতিথি। বলে, খাও, জোর

আনো গায়ে। মেঘ করে আসে, এবার নম্বরগুলো লিখে নেবে

গুজরাত থেকে কোন কোন গাড়ি এসে গর্ভকেশরে ঢুকবে।

কর আদায়কারীর সঙ্গে

কর আদায়কারীর সঙ্গে বহু ঘুরে ঘুরে সবশেষে আমি

চিড়িয়াখানায় আসি। বাঘের দু’চোখ ভরতি জল নেমে

যায় লোমের ভেতর: এর চেয়ে বড় সত্য নেই, জেনে রেখো

আমি টাকা তুলি বাড়ি বাড়ি ঘুরে, খুব ছোট কাজ, গৃহিণীকে

ঘুম থেকে ডেকে দরজার গায়ে লিখে দিই নতুন নম্বর

স্বপ্নে কতদিন দেখি আমার ব্যাগের মধ্যে শুধু লাল চক

স্ত্রীর গায়ে কত সংখ্যা, রত্ন, জুঁই; তবু বুঝি আমি বাটপাড়।

তখন সূর্যাস্তে কাঁচা মরিচের বনে এসে যেন ফকরামি

করে যাচ্ছি মাসির মেয়ের সঙ্গে, মারামারি একবার থেমে

ফের শুরু, ঋতুর শেষের দিকে তিনদিন স্পর্শ করে দেখো

ঐশ্বর্য লুটছ তুমি, নীল লিটমাস যেন হয়ে এল ফিকে,

তেঁতুল গোলার ক্কাথ এক কাপ করে, সঙ্গে ভল্লুকের জ্বর।

প্রেতের দু’খানা জামা, দু’জনাই পরে দেখি এঁকে রাখা বক

ভুবনে উড়িয়ে নিল আমাদের, করো যা যা এবার করার।

অশ্রু জরায়ুতে

বাবাকে আবার দেখি হাঁটুর ভেতর মাথা রেখে মাঝরাতে

উঠে বসে আছে; তবে কি কাঁদতে গিয়ে অন্ধ হয়ে গেছে চোখ?

অন্যদিকে, যে নারীর সঙ্গে শুয়েছিল, সেও অতৃপ্ত বাসনা

নিয়ে দাঁড়াল গাছের নীচে; তার মনে হল যদি কোনও জন্তু

তাকে পিঠে করে উঠে যেত গিরিপথে, ছারখার করে দিত

কুহকের পদ্মবন! পিতার শিশ্ন থেকে রেতঃপাত নয়

চোখের গরম জল ঝরে পড়ে ফোঁটাফোঁটা তার জরায়ুতে।

তবে কি অশ্রুর ভেতরও ছিল প্রাণ? এই ঘোর রাত্রি কাটে

কী করে তোমার? দূরে বাস্কেট বলের মাঠে যখন তক্ষক

মণি রেখে চলে আসে গোরুর পায়ের কাছে; জন্মলগ্নে শোনা

মায়ের ধিক্কার আমি ভুলতে পারি না; দেখি কী ভীষণ তুষ

জ্বলে ওঠে; তবু শুধু একটি পুত্রের জন্য যে নারী তৃষিত

আমি তার পেছনের বেডে ভূমিষ্ঠ হয়েছি; কে কাকে অভয়

দেবে শোকে? বাবা ঘরে ঢুকে প্রদীপ নিভিয়ে দিল এক ফুঁয়ে।

দেহ পিঞ্জর

খুবই খারাপ কেটেছিল তাঁর শেষক’টা মাস, আত্মজের

দিকে এক প্রবল ঘৃণার চোখে তাকাতেন, স্ত্রীর দিক থেকে

দৃষ্টি তুলে নিয়ে সন্ধ্যাকাশ দেখে ভাবতেন: এ দেহ পিঞ্জর!

কাল এরা জড়ো হয়ে আমাকে মেরেছে, দেখো পিঠে কালশিটে

অপমান আমি কি ভুলব? তবু একদিন গোপনে আমার

ঘরে ঢুকে রেখে গিয়েছিলেন গোলাপ আর সঙ্গে কিছু টাকা;

ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যেতাম যখন; উনি পথে কাঁদতেন।

অসুস্থ মনের মধ্যে নেমে কে আর নিজের মতো করে খোঁজে

নীহারিকা; বস্ত্রহীন তাঁকে হেঁটে যেতে দেখে স্ত্রী বলেছে: এ কে?

সমস্ত বারণ—হাঁটা, চলা, স্নান; রাত্রে দড়ি ছিঁড়ে তিন জ্বর

নিয়ে চন্দ্রালোকে চিৎকার করছেন মাঠে এসে, এই শীতে

কুকুর পালাচ্ছে; উনি দেখছেন জ্যোতির্ময় আলো, পরমার

সে কী রূপ, ড্রাগনের পিঠে চড়ে ছুটে চলেছেন, চোখ ঢাকা।

বাতাস উঠেছে আজ বাতাস উঠেছে ফের গভীর বাতাস।

সন্তানের মতো

কে কার আড়ালে যাবে? অমরাবতীর থেকে বিষন্ন খবর

এল কাল রাত্রে মাঠে বাবাকে উলঙ্গ হয়ে পায়চারিরত

অবস্থায় দেখা গেছে; বহুবর্ণ ঠোঙা দিয়ে মাথা মুখ ঢাকা

পঞ্চান্ন বছরের ওই পিঙ্গল শরীর কী করে সবার

সামনে ঘুরে বেড়িয়েছে ভাবি; পাড়ার ছেলেরা এসে বোনেদের

নিয়ে যায় অন্যবাড়ি, আর যে আমাকে চোখ বেঁধে নিয়ে এলে

সে কি সন্তানের মতো? বাবাকে করাও পান দ্রাক্ষা, চোনা, সুরা।

অরণ্যে ঢোকার আগে প্রেত বলেছিল আমি তেমন বর্বর

নই আজও; যাও, ফিরে এলে দেখে যেও আমি আছি, তবে যত

প্রাণ পশুপাখি ও প্রবাদ দেখে গেলে, তারা থাকবে না, ফাঁকা

প্রাসাদের টি. ভি. খোলা থেকে যাবে দিকচিহ্নহীন, পরপার

থেকে বোন ও মায়ের কান্নার গোঙানি উঠে আসে; ওদের যে

মুখ দেখি তা নারীর নয়, পুরুষের নয়; দেখি আলো জ্বেলে

বাবাকে রাতের ছাদে ডেকে পোশাক পরাচ্ছে বাবার বন্ধুরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *