ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ – মুদির দোকান
রত্নপুর গ্রামের প্রান্তভাগে, মাঠের ধারে একখানি মুদির দোকানে দস্যুত্রয় সেই ঝড়-বৃষ্টির সময় আশ্রয় লইল। তাহারা দেখিল, মুদি মুড়ি-মুড়কি, চাল-ডাল প্রভৃতি দ্রব্যজাত পরিপূর্ণ হাঁড়ি, গামলা, চুবড়ি, চেঙ্গারি পরিবৃত হইয়া গম্ভীরভাবে উপবিষ্ট আছে এবং অপর একব্যক্তি তাহার মঞ্চের নিকট দণ্ডায়মান হইয়া গাঁজা টিপিতে টিপিতে খুব বক্তৃতা করিতেছে। সে যেমন কাল, তেমনই লম্বা-চওড়া, তাহার মাথায় ঝাঁকড়া চুল, ওষ্ঠোপরি ঝাড়াল গুম্ফ এবং চক্ষুদ্বয় সুপক্ক করঞ্জের ন্যায় লাল, সংক্ষেপতঃ এই ব্যক্তিকে “অসুর” বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।
বক্তা অভ্যাগতদিগকে দুইটি মোড়া বাড়াইয়া দিয়া বলিল, “প্রণাম, বসতে আজ্ঞা হয়।”
ব্রাহ্মণ দস্যুদ্বয় আসন গ্রহণ করিলে অপর দস্যু দোকানের দাওয়ায় একপার্শ্বে উপবিষ্ট হইল।
মুদি চকমকি ঠুকিয়া শোলায় ফুৎকার প্রদান করিতে করিতে বলিল, “তাই ত ভীম, লোকে যার নাম করলে সুপ্রভাত হয় বলে, সেই রাঘব সেন এমন লোক?”
ভীম। এইবার ধর্ম্মবতারের বিদ্যা-বুদ্ধি সব প্রকাশ হয়ে পড়বে—এইবার কর্ত্তা, মানুষের হাতে পড়েছেন।
মুদি তামাক সাজিয়া, টিকা ধরাইয়া, কলিকায় ফুৎকার দিতে দিতে বলিল, “ দেওয়ান মহাশয়ের খুব সাহস বলতে হবে।”
ভীম। খালি সাহস? অত শক্তি ক’টা লোকের আছে?
রতন। হাঁ, আমরাও শুনেছি, রাঘব সেনও নাকি খুব বলবান।
মুদি। “এই নিন মহাশয়, তামাক খান” বলিয়া একটি থেলো হুঁকা, পরিহিত কাপড় দিয়া মুছিয়া রতনশর্ম্মার হাতে দিয়া বলিল, “রাঘব সেনের বলের কথা বলেন কেন মহাশয়, অনেকে অনুমান করে, তাঁর দেবাংশে জন্ম।”
রতন। রাঘব সেনের সহিত দেওয়ানজীর বিবাদের সূত্রটা কি?
মুদি। সে মহাশয়, অনেক কথা। তারপর ভীম দাদা! দারোগা আর তার লোকজন সব ত সেই ঘরের ভিতরে চাবি দেওয়া রহিল, তারপর কি হল?
ভীম। তারপর তাদের বেশ করে খাইয়ে-দাইয়ে, কাল বিকালবেলা, হুগলীতে চালান দেওয়া হয়েছে। বাবু চিঠীতে সব খুলে লিখে দিয়েছেন, এবার রাঘব সেনের আর নিস্তার নাই।
মুদি। সে কথা কিছু বলা যায় না ভাই, সাহেব-শুবা সব রাঘব সেনের মুঠার ভিতর, বিশেষ দেওয়ান মহাশয়ের উপরে যে সকল দোষারোপ করা হয়েছে, তাতে বোধ হয়, দেওয়ান মহাশয়কেই বিপদগ্রস্ত হতে হবে।
ভীম। আরে, সে সব সাবুদ হবে কিসে? রেশমের কিস্তি লুঠ করেছে বলছে, কিন্তু মাল কোথা?
এই কথা বলিয়া সে গাঁজা সাজিয়া, ধূমপান করিতে লাগিল। রত্না মনে মনে বলিল, “আমার একটি প্রতিজ্ঞা—উপস্থিত বিপদ হ’তে রাঘবকে উদ্ধার করা; বুঝিলাম, সে প্রতিজ্ঞা সহজেই পূর্ণ হবে। দ্বিতীয় প্রতিজ্ঞা—দেওয়ানের গহনার বাক্স বা তাহার মূল্যস্বরূপ দশহাজার টাকা বলপূর্ব্বক গ্রহণ করা—এই প্রতিজ্ঞাটি পূর্ণ করিতে পারিলেই আমার পাপ-ব্রত উদযাপন হয়; কিন্তু এ বেটা কে?” প্রকাশ্যে বলিল, “বাপু, ক্ষমতাশালী দুর্জ্জন ব্যক্তির অসাধ্য কিছুই নাই; রাঘব সেন, দেওয়ানের উপর যে সকল ‘ দোষারোপ করিয়াছে, তুমি দেখিয়া লইও, সে তাহা আশ্চর্য্যরূপে সপ্রমাণ করিবে।”
ভীম কলিকা ভূমে রাখিয়া বলিল, “তা হ’তে পারে মহাশয়, আমরা ছোট লোক, বড় লোকের কথা কি বুঝিব? (মুদির প্রতি) তবে ভাই, বৃষ্টি ধরেছে এইবার যাই। হাঁ হে, আজ ও পাড়ায় যাত্রা শুনতে যাবে ত?”
মুদি। পরমানন্দের যাত্রা, শুনব না? তুমি ত আমায় ডেকে যাবে? কখন ডাকবে বল দেখি ভীম। এই রাত্রি এগারটা-দুপুরের সময়, কেমন? কিন্তু ভাই, নিশ্চিন্ত হয়ে আজ যাত্রাটা শুনতে পাব না, মাঝে মাঝে এক-একবার এসে আমায় বাড়ীতে চৌকী দিতে হবে। বেটারা কখন এসে পড়বে, তার ত ঠিকানা নাই। এখন আসি।
ভীম প্রস্থান করিলে পর রত্না, মুদিকে জিজ্ঞাসিল, “এ লোকটি কে? কার বাড়ীতে ডাকাতি হবার কথা বলছিল?”
মুদি। ওর নাম ভীম সর্দ্দার, দেওয়ানের বাড়ীর চৌকীদার। রত্নাপাখীর নাম শুনেছেন? তেমন ভয়ানক ডাকাত ভূ-ভারতে আর নাই, সে নাকি বলে গেছে, আজ রাত্রে দেওয়ানের বাড়ীতে ডাকাতি করবে।
রত্না। তাই ত, দেশটা হল কি? নিতান্ত অরাজক হয়ে উঠল যে; আচ্ছা বাপু, এখন আমরা আসি।
মুদি “প্রাতঃ প্রণাম” বলিয়া প্রণাম করিয়া, প্রদীপ জ্বালিবার যোগাড় করিতে লাগিল।
রতন শর্ম্মা অনুচরদ্বয়কে সঙ্গে লইয়া রাজপথে নামিল এবং কিয়দ্দূর গমন করিয়া শূদ্র দস্যুকে সম্বোধন করিয়া বলিল, “দেখ ক্ষুদিরাম, তুই এখনই গঙ্গাপুরে যা, শুধু পায়ে গেলে, অনেক বিলম্ব হবে, তাল-পুকুরের পাড়ে, বেনাঝোড়ের ভিতর দু-জোড়া খড়ম্ লুকান আছে, যে জোড়াটা খুব লম্বা, সেই জোড়া পায়ে দিয়া তীরের মত বেরিয়ে যা, সেনজাকে আমার নাম করে বলগে যা যে, তিনি পঁচিশ গাঁইট রেশম, আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিতে বললেন। সেই পঁচিশ গাঁইট রেশম তুই দেওয়ানের গোলাবাড়ীর খড়ের মাচার ভিতর লুকিয়ে রেখে যাবি; দেখিস, খুব সাবধানে কাজ করিস, কাজ সারা হ’লে চীৎকার করে তিনবার ‘হরিবোল’ ‘হরিবোল’ বলবি। তা হলেই আমি জানতে পারব যে, নির্বিঘ্নে কাৰ্য্য সম্পন্ন হয়েছে, আর যদি কোন বিঘ্ন ঘটে, ‘গুরু পার কর, ‘গুরু পার কর’ বলে দুইবার হাঁক দিবি, এই কথা—বুঝলি? এখন যা—চলে যা। যা বললেম, সব মনে থাকবে ত?”
ক্ষুদি। তা সব মনে থাকবে; কিন্তু কাজটা বড় সহজ নয়।
রত্না। কি! তুই পারবিনি?
ক্ষুদি। পারব না, এমন কি কাজ—তবে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি হবে।
রত্না। জোয়ান মানুষ, পরিশ্রম করতে পেছুস কেন? আচ্ছা, কাল তোকে মদ খেতে একটা টাকা দিব।
ক্ষুদিরাম সহাস্য বদনে বলিল, “দেখো ঠাকুর, কাল দিতে হবে।”
রত্না। আলবাৎ।
ক্ষুদি। প্রণাম হই, আশীর্ব্বাদ কর ঠাকুর, বড় শক্ত কাজ।
রত্না। কুচ্ পরোয়া নাই, চলে যা।
ক্ষুদিরাম চলিয়া গেলে রত্না, হরি ঠাকুরকে বলিল, “দেখ ঠাকুর, তোমায় একটা কাজ করতে হবে।”
হরি ঠাকুর বলিল, “না ভাই, ও রকম কাজ—আমা হ’তে হবে না—আমার বাবা এলেও পারবে না।”
রত্না। কচুপোড়া খাও, একেবারে বলে বসলে, আমা হতে হবে না—আগে কথাটাই শুন! হরি। কি? বল।
রত্না। ঐ যে লোকটা গাঁজা খেয়ে গেল, তাকে বেশ করে দেখে রেখেছ ত?
হরি। হাঁ।
রত্না। সে দেওয়ানের বাড়ীর সর্দ্দার, আজ রাত্রি এগারটার সময় সে মুদিকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুনতে যাবে। তুমি এখন এই দোকানে জলপান করে শুয়ে থাক, সে যখন যাত্রা শুনতে যাবে, তুমিও তাদের সঙ্গে যাবে, তাকে নজরে নজরে রাখবে, সে উঠলে তুমিও উঠে সঙ্গে সঙ্গে যাবে; কিন্তু সাবধান, সে যেন তোমাকে না দেখতে পায়; দেওয়ানের বাড়ীর কাছে এলে, তুমি দূর থেকে যাহা হয়, একটা গান করবে। এ ছাড়া তোমাকে আর কিছুই করতে হবে না।
হরি। এই কাজ? তা আমি বেশ পারব।
রত্না। তবে তুমি দোকানে ফিরে যাও।
হ। খাবার পয়সা?
র। কটা?
হ। চারিটার কম হবে কেন, দাদা?
রতন শর্ম্মা হরিঠাকুরের হস্তে চারিটি পয়সা দিয়া প্রস্থান করিল।