উৎস প্রেম
বিয়ে করলে কি হয়, না করলেই বা কি হয়, বোকার মতো এমন একটি প্রশ্ন দিয়ে যদি শুরু করা যায় তো কেমন হয়। বিয়ে করলে সংসার হয়। অদ্ভুত একটা বন্ধনে জীবন জড়িয়ে যায়—আজীবন বন্ধন। সেই বন্ধন সুখের না দু:খের হলফ করে বলা শক্ত। বিভিন্ন জীবন পর্যালোচনা করে সমীক্ষা করে তবেই সিদ্ধান্তে আসা চলে। হঠাৎ কোনও সিদ্ধান্তে না আসাই ভালো। তবে বহুকালের একটি প্রবাদ চালু আছে—দিল্লিকা লাডডু, যো খায়া পস্তায়া, যো নেহি খায়া ও ভি পস্তায়া। এ দেশে মেয়েদের বিয়ের বয়স হলেই বাপ-মায়ের ঘুম চলে যায়। শুরু হয় ভালো পাত্রের সন্ধান। সাঁড়াশি অভিযান। সেই অভিযানে, বিয়ে করব না ভাই, বেশ ঝাড়া হাত-পা হয়ে আছি, বলে কোনও ছেলের পাশ কাটিয়ে যাবার সম্ভাবনা ক্রমশই কমতে থাকে। সেই সব ছেলের যাঁরা ভালো চাকরি করেন, ভালো রোজগার করেন, সে যেভাবেই হোক বউ ম্যানেজ করতে পারবে অথচ বিয়ে করবে না—এ কেমন কথা। তার মানে বদ মতলব। তিনি ফুলে-ফুলে মধু খেয়ে বেড়াবার ধান্দায় আছেন—কালো ভ্রমর। রোজগারী, জোয়ান ছেলে বিয়ে করবে না? মামার বাড়ি। সুস্থ শরীরের একটি দাবি নেই। প্রশ্নটা ঘুরে গেল বায়োলজির দিকে। নানা ধরনের ইঙ্গিত। সামাজিক, পারিবারিক, ব্যক্তি স্বাস্থ্যের জন্য বিবাহের ভীষণ প্রয়োজন। বিয়ের বয়সে বিয়ে না করলে চরিত্র নষ্ট হবার সম্ভাবনা প্রবল। বায়োলজিক্যাল নিডস বলে বহুদর্শী মানুষ এমন একটা ভাব করবেন, যেন কত বড় অপরাধী, বিয়ে না করে ঘুরে বেড়াচ্ছে ধর্মের ষাঁড়ের মতো। তা হলে সন্ন্যাসী হয়ে যাও। সংসারে থাকা কেন! আইবুড়ো ছেলেরা খুবই বিপজ্জনক। অবিবাহিত পুরুষ সম্পর্কে সামাজিক ভীতির কয়েকটি নমুনা—কোথাও ঘর ভাড়া নিতে গেলে বাড়িওয়ালার আপত্তি। একা একটা পুরুষ নিচের ফ্ল্যাটে, কি পাশের ফ্ল্যাটে থাকবে, কি কখন করবে, এই ভাবনায় মহা দুশ্চিন্তা। বন্ধুবান্ধব এনে আড্ডা জুড়বে। তার মধ্যে মহিলা থাকাও অসম্ভব নয়। তা ছাড়া বাড়িওয়ালার পরিবার-পরিজনের দিকেও ঠেলা মারতে পারে। বেড়াতে গিয়ে অবিবাহিত কি একা পুরুষ ধর্মশালায় থাকার সুযোগ পায় না। সস্ত্রীক হওয়া চাই। হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস, সন্ন্যাসীর কথা আলাদা, বিবাহ ছাড়া স্ত্রী-পুরুষের দেহসংস্কার, মানসসংস্কার কিছুই হয় না। যে কারণে পরমহংসদেব বিবাহ করেছিলেন। কামিনী-কাঞ্জনজয়ী অবতার পুরুষের বিবাহের কি প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল এই কারণে, পুরুষ নিষ্ক্রিয়, শক্তির আশ্রয়ে পুরুষকে কাজ করতে হয়। শক্তির সহায়তা না পেলে পুরুষ অকেজো। পুরুষ ও প্রকৃতি দুয়ে মিলে পূর্ণ শক্তির আধার। আমরা যদি মা কালীর দিকে তাকাই তাহলে আমাদের এই বোধেরই প্রতিফলন দেখতে পাব। পুরুষ শিব শায়িত, সমাহিত, কালী মহাশক্তি শিবের বুকে জাগ্রত, শিবোত্থিত। শিবেরই শক্তি কালি। ঠাকুর রামকৃষ্ণ স্ত্রীর দুটি বিভাগ করেছিলেন—বিদ্যারূপিণী, অবিদ্যারূপিণী। বিদ্যা স্ত্রী স্বামীর জীবনকে এগিয়ে দিতে সাহায্য করেন। সংসারে থেকেও তৈরি করেন শিবের সংসার। কামনা বাসনার রাশ টেনে ধরেন। পথ বিপথ চিনিয়ে দেন। কামনার আগুনে ঘৃতাহুতির ফলে সংযমের মধু সিঞ্চন করেন। একথা খুবই ঠিক—পুরুষরা নারীর বশ। নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে চাইলে সহজেই তা পারবেন। বলাই তো হয়, জরু কা গোলাম। বউয়ের কথায় ওঠ বোস করে। বউ হল বউ, মা আর গর্ভধারিণী হলেন মা-মাগী। হয় বলেই তো বলা হয়। বাস্তব সত্য। ঠাকুর বলতেন—বড় মানুষটিকে ধরলে কিছু হবে না, ধরতে হবে তার মেয়েমানুষটিকে। সঙ্গে সঙ্গে সব কাজ উদ্ধার। অবিদ্যা স্ত্রী পুরুষকে সংসারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখেন। মাথা তোলার অবকাশ রাখেন না। বিষয়ে মজিয়ে যাকে বলে, পঞ্চভূতের ফাঁদে ফেলে দেন। যে অবস্থার সংগীত ‘লোহারই বাঁধনে বেঁধেছে সংসার দাসখত লিখে নিয়েছে হায়!’ গানের পরের লাইন প্রাত:কালে উঠেই আমরা নিজেদের জুড়ে দিই সংসারের ঘানিতে। কত কি যে করি তার কোনও ঠিক ঠিকানা থাকে না। দারা-পুত্র হল পায়ের শৃঙ্খল। আবার আর একটি সংগীত আছে—’যার জন্যে মরো ভেবে, সে কি তোমার সঙ্গে যাবে, সেই প্রেয়সী দেবে ছড়া অমঙ্গল হবে বলে। অর্থাৎ আমার বউ, আমার বউ করে লাফাও ঝাঁপাও, ডনবৈঠক মারো, মরার পর যদি ভূত হয়ে প্রেমের আকর্ষণে দর্শন দিতে আসো—তোমার বউ ভূ-ভূ-করে ভিরমি যাবে।
সেটা কোনও কথা নয়—আসল কথা হল, বিয়ে না করে থাকা যায় না, মনটা কেমন যেন ফসফস করে। একটা বয়সে বেশ একটা প্রেম-প্রেম ভাব আসে মনে। প্রেমে যদি কেউ নাও পড়ে, চাকরি বাকরি ধরতে পারলে একজন শ্বশুরমশাই অবশ্যই খেপলা জালে বাবাজীবনকে ধরবে। বেশ একটা খাতিরটাতির করে—একটা খাটিয়া, ছোবড়া আড়াই মন, মানে একটি গদি সহ জীবনের অর্ধাঙ্গটি যুক্ত করে দিয়ে যাবেন। হার্ট ট্রানসপ্ল্যান্টের ব্যাপারে আমরা জানি রিজেকসন হয়। অনেকে নিতে পারেন, অনেকে পারেন না। হৃদয়ে হৃদয় জুড়ে গেল তো, বেশ চলল, চলে মেলগাড়ি। আর যদি না লাগল তো হয়ে গেল। প্যাকেটে-প্যাকেট সিগারেট ধু ধু পুড়ছে। কর্তা বারান্দায়। গৃহিণী বিছানায়। নৈশ আকাশে তারা ঝুলছে। সারমেয় হাহাকার পল্লী প্রান্তে। কবি হতে পারি। হয়ে যেতে পারি সমাজসেবী। দেবদাস হতেও আপত্তি নেই। আত্মহত্যা নৈব চ। কারণ এই যে চোট, ঈশ্বরের এমন খেলা, এরও একটি স্বাদ আছে। সমগ্র নারী জাতির প্রতি একটা অদৈহিক ভালোবাসা আসে। বিশ্বপ্রেম। কোথাও একজন আছেন তারার চোখ মেলে তিনি আমাকে ভালোবাসেন। বউয়ের কিক না খেলে ভগবানের দিকে মন ফেরে না। ধর্ম বিবাহ দেহ-বাসনা সবেরই উৎস প্রেম। প্রেমই তো জীবন। প্রেমই ঈশ্বর।