উৎসার
সামাজিক অথবা সাংসারিক হিসেবে নন্দা কখনো আমার কেউই ছিল না।
তখন আমি পড়াশুনো শেষ করে সবে চাকরিতে ঢুকেছি। হাতে অবকাশ ছিল, মনে নানারকম রঙিন কল্পনা, আশা। এবং লেখক হওয়ার স্বপ্ন।
সামনের বাড়ির নন্দা তখন সবে কলেজে যাচ্ছে।
ওরা প্রথম যেদিন আমাদের পাড়ায় এল বাক্স, প্যাঁটরা, লটবহর সব লরিতে চাপিয়ে, পোর্ট কমিশনার্সের অফিসের ব্রজেনবাবুর পরিবারের সকলের মধ্যে সবচেয়ে আগে এবং সবচেয়ে বেশি করে ভালো লাগল আমার ওকে।
আমাকে সকলেই নাক-উঁচু বলত। যাকে তাকে আমার ভালো লাগত না। কিন্তু ওর গলার স্বর, ওর ব্যক্তিত্ব, ওর বুদ্ধিমতী স্বভাব সব মিলিয়ে-মিশিয়ে ওকে হঠাৎই ভীষণ ভালো লেগে গেল। ও আমার জীবনে দারুণ দুঃখ ও সুখে ভরা ভালোবাসার অনুভূতি প্রথম বয়ে আনল।
আমাদের ডোভার রোডের বাড়ির একতলায় একটা বসবার ঘর ছিল। কিন্তু সেটা ছাত্রাবস্থায় আমার পড়ার ঘর এবং তার পরে একা বসে ভাবার, সাহিত্যচর্চার, গান-বাজনার এবং ক্বচিৎ আড্ডা দেওয়ার জন্যে আমারই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মালিকানাতে বাবা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাবার, মায়ের এবং পরিবারের সকলের অতিথিরা দোতলার বসবার ঘরে গিয়েই বসতেন।
সেই একতলার ঘরের কাচের জানলার দিকে পেছন ফিরে বসতাম আমি টেবিলের সামনে, শখের লেখাপড়া করতে। জানলার কাচে গলি দিয়ে যাওয়া-আসা করা প্রত্যেকটি মানুষের প্রতিফলন পড়ত। নন্দা যখনই যেত-আসত তার প্রতিফলিত ছায়া আমার জানালার কাচ থেকে উঠে এসে আমার চোখের আয়নার মধ্যে দিয়ে সটান আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে পৌঁছোত।
সব মানুষের জীবনেই একটা বোকা-বোকা রোমান্টিক প্রেমের বয়েস থাকে। আমার সঙ্গে তাদের তফাত এই-ই যে, আমার বয়েসটা বেড়ে গেলেও এই অয়ন রায় নামক ব্যক্তিটি সেই গো-সুলভ মানসিকতাটা কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারল না। নন্দাদের বাড়ি যখনই যেতাম, নন্দা দৌড়ে আসত, বসতে বলত, চা করে আনত নিজের হাতে। যতক্ষণ থাকতাম, আমার সামনে বসে থাকত, দ্বিধাহীন ঝকঝকে সরল ব্যক্তিত্ব ঝরিয়ে কথা বলত। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ তুলে চাইত আমার চোখে। সাহিত্য-আলোচনা করত। নন্দার মধ্যে সবচেয়ে যা ভালো লাগত তা এই-ই যে, ওই সময়ের ওই বয়েসি মধ্যবিত্ত মেয়েদের মধ্যে যে ন্যাকামি স্বাভাবিক ছিল, ওর মধ্যে সেসব একেবারেই অনুপস্থিত দেখতাম।
আমাদের পরিবার উত্তরবঙ্গের গোঁড়া বারেন্দ্র ব্রাহ্মণের পরিবার। ঠাকুরদা, বাবা, কাকারা সকলেই প্রবল-প্রতাপান্বিত, গর্বিত এবং কিঞ্চিৎ দাম্ভিক তীক্ষ্ণনাসা কেউকেটা ছিলেন। সেই পটভূমিতে অ-বারেন্দ্রর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও ভ্রূণহত্যা একইরকম অপরাধ বলে গণ্য হত।
আমি ওই বয়েসে ভীরু ছিলাম; এখনও অবশ্য তাই। সামাজিক, পারিবারিক কোনোরকম নিয়ম ভাঙার মতো মনের জোর বা ব্যক্তিত্ব আমার ছিল না। এখনও নেই। স্বীকার করি।
দেখতে দেখতে পড়াশুনো শেষ করলাম, চাকরিতে ঢুকলাম। চাকরিতে উন্নতিও হল, খুব তাড়াতাড়িই আমার নিজের ইচ্ছা বা চেষ্টা ব্যতিরেকেই।
চাকরির চকচকে মইয়ে আমার ওপরে যাঁরা জাঁকিয়ে বসেছিলেন, তাঁদের দুজন পটাপট দৈব-দুর্বিপাকে পটল তুললেন। একজন চুরির অপরাধে জেলে গেলেন। অন্যজন সেরিব্রাল অ্যাটাকে শয্যাশায়ী হলেন। অতিকম সময়ে আমি ফাঁকা মই বেয়ে বেশ উঁচুতে চড়ে পড়লাম। তার পর সব বাঙালির ছেলের যা তাৎক্ষণিক কর্তব্য তা-ই করতে হল আমাকেও। অর্থাৎ বিয়ে।
আমরা পাবনার লোক। রাজশাহির এক নামজাদা উচ্চবিত্ত বারেন্দ্র পরিবারের ডানাকাটা পরি মেয়ে আমার জন্য গুরুজনেরা অনেক শিঙাড়া, রসগোল্লা খেয়ে নির্বাচন করলেন। মেয়ের নাম ছিল সিন্ধুভৈরবী। ভারতীয় রাগের নামে নাম। আমার ঠাকুমা, বিয়ের পরই তাঁর নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে সিন্ধুর নাম রাখলেন হেমনলিনী। ঠাকুমার নাম ছিল প্রফুল্লনলিনী।
সিন্ধুভৈরবী বা হেমনলিনী অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, স্বাধিকারে, স্বীয় সৌন্দর্যে, ক্ষমতাতে এবং শক্তিতে বিশ্বাসী ছিল। সে বিয়ের একমাস পরেই ফতোয়া জারি করল যে, নন্দাদের বাড়ি অত ঘনঘন আমার যাওয়া চলবে না। নন্দা কিন্তু ওকে খুবই পছন্দ করত। সবসময়ে দৌড়ে আসত বউদি-বউদি করে। সিনেমায় যেতে চাইত ওকে নিয়ে। কিন্তু মেয়েদের নাক সামুদ্রিক পাখির মতো। ভবিষ্যতের ঝড়ের গন্ধ সিন্ধুর নাকে পৌঁছেছিল।
দেখতে দেখতে বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই সে নন্দার কারণে-অকারণে এবাড়ি আসাই বন্ধ করে দিল। তখন নন্দা থার্ড ইয়ারে পড়ে। কিন্তু বাড়ি আসা বন্ধ হলেও নন্দা প্রায়ই আমার অফিসে গিয়ে হাজির হত। ভীষণ পাগলামি করত। বলত, আত্মহত্যাকরবে। ওর জীবনে আমিই প্রথম প্রেমিক ছিলাম। আমাকে হারানোর কথা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারত না। ওর জন্যে আর একটু অপেক্ষা করতে পারিনি বলে আমাকে অত্যন্ত হৃদয়-মন্থন-করা অভিমানের কথা বলত এবং শুনতে শুনতে অনেকই সময় আমার হৃদয় দ্রব হয়ে আসত।
ওকে অনেক বোঝাতাম; কানের লতিতে, গলায়, কপালে চুক করে আদর করে দিতাম। কিন্তু ও অবুঝের মতো করত। মধ্যবিত্ত মানসিকতার কারণে ঠোঁটে চুমু খেতে পারতাম না। সেটা গর্হিত অপরাধের মধ্যে গণ্য করা হত সেই সময়কার মরাল-কোড-এ। দেশ ভাগ হবার আগে আমরা উচ্চবিত্ত বলেই গণ্য হতাম, দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার পরে অবশ্যই মধ্যবিত্ত হয়ে পড়েছিলাম, পরিবারের সব পুরুষ (এক ঠাকুরদা ছাড়া) রোজগেরে হওয়া সত্ত্বেও।
ছেলেবেলা থেকেই জ্যামিতিক জীবনে এক কড়া রেজিমেন্টাশানের মধ্যে আমার ডাকসাইটে ঠাকুরদা আমাদের মানুষ করেছিলেন। চলন-বিলে নৌকোর ওপর গড়গড়া সাজিয়ে, চার্চিল, জেমস পার্ডি, ডাব্লু ডাব্লু গ্রিনার, বত্রিশ ইঞ্চি ব্যারেলের, টোয়েন্টি বোরের টলি ইত্যাদি বাঘা-বাঘা বন্দুক সমভিব্যাহারে তাকিয়া-ঠেসান দিয়ে বসে তিনি উড়ো-হাঁস মারতেন। কথা, মুখে বেশি বলতেন না, চোখে বলতেন। তবে মাঝে মাঝে কন্ঠনালির ঘড়ড়-ঘড় শব্দেও তেজি, বড়ো কুকুরেরা যেমন ভাষায় কথা বলে, বলতেন। গলার জুয়ারি বড়েগোলাম আলি সাহেবের চেয়েও অনেক জবরদস্ত ছিল।
পুজোর সময়ে আমাদের বাড়ি রেডিমেড জামা-প্যান্ট আসত। বাড়ির ছেলেরা, ভাইপো, ভাগ্নে এবং চাকর ঠাকুর জমাদার সকলেই সেই প্যান্ট-জামা এক এক বার করে গলিয়ে নিয়ে যার গায়ে যেটা হত সেটাই নিয়ে যেত। এ ব্যাপারে আদর্শ সমাজতন্ত্র চালু ছিল। ব্যক্তিগত রুচি ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যাপারটা আমার ঠাকুরদা এবং ঠাকুরদাচালিত একনায়কতন্ত্রে অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ বলেই গণ্য হত। সে যুগের চীন ও অথবা সোভিয়েত রাশিয়ারও অনেক কিছু শেখার ছিল আমার ঠাকুরদার কাছ থেকে।
এইসব কারণে সমস্ত-কিছু রেডিমেড ও জোর করে চাপানো ব্যাপারের ওপর আমার ছোটোবেলা থেকেই এক প্রবল বিদ্বেষ ও ক্রোধ জমে উঠেছিল। সেই বিদ্বেষের বলি হল বেচারি সিন্ধুভৈরবী, ওরফে হেমনলিনী। সে নিজেও মহাবলী ছিল। তাই সংঘর্ষ অনিবার্য ও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। ও চাইত আমি ওর প্রজা হই। কখনো চাইত, যখন ভালো মুড-এ থাকত যে, আমি ওর মন্ত্রী হই। কিন্তু যে নিজে রাজা তার কখনো মন্ত্রী হওয়া সাজে? বা মন্ত্রী হওয়ার জন্যে নির্বাচনে দাঁড়ানো সাজে! রাজা-প্রজার সঙ্গে প্রজাপতির সম্পর্কটাও খুব নিকট নয়। সুতরাং…।
একদিন ঠাকুরদা গত হলেন। ঠাকুমা, বাবা, তার পর মা, সকলেই দেখতে দেখতে চলে গেলেন শোভাযাত্রা করে। কীসের অত তাড়া ছিল জানি না। ঊর্ধ্বগগনের কোন জ্যোতিবাবু তাঁদের একইসঙ্গে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডে পৌঁছোতে বলেছিলেন তাও জানা নেই। তবে ঠাকুরদা কমিউনিস্টদের দেখতে পারতেন না। বলতেন, বিশ্বাসঘাতক। ওগুলান মনুষ্য পদবাচ্যই না। থু:!
অতবড়ো বাড়িতে রয়ে গেলাম আমরা দুই ভাই, আমি আর দাদা। ঠিক করে বললে বলতে হয়, রয়ে গেলাম আমি আর সিন্ধু।
দেখা যায়, একনায়কত্ব বংশপরম্পরায় হস্তান্তরিত হয় কিন্তু আমাদের সংসারে ব্যতিক্রম ঘটল। এ সংসারে এখন সিন্ধুই একনায়ক হল। এক ছেলে নিয়ে সিন্ধু নিজেতেই-নিজের সম্পূর্ণতায় বিশ্বাসী হয়ে প্রবল দাপটে সংসার করতে লাগল। তার সংসারে আমি, এই অধম অয়ন রায়, সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজনীয় ও বাড়তি ব্যাপার হয়ে গেলাম।
সিন্ধু সংসার চেয়েছিল। স্বামী চায়নি।
সিন্ধু আমার ঠাকুরদার মতোই অত্যন্ত সক্ষম ও সার্থক নায়ক ছিল। তার সংসারে কোনো নিয়মের ব্যতিক্রম কেউ কখনো দেখেনি। পান থেকে চুন খসবার জোটি ছিল না। আমার কিঞ্চিৎ অযত্ন হবারও উপায় ছিল না কোনো। সময়মতো খাবার, অফিসের জামাকাপড় সব হাতের কাছেই পেতাম। অসুখ হলে ডাক্তার আসত যথাসময়ে। বাড়িঘরে কোথাও এককণা ধুলো কেউ দেখতে পেত না। কিন্তু নিয়মানুবর্তিতার বাইরে, পরিচ্ছন্নতার বাইরে, এই ঝাঁপি-মাপা কর্তব্যবোধের বাইরেও কিছু একটা থাকে প্রত্যেক মানুষের জীবনে, যা সে বড়ো কাঙালের মতোই প্রার্থনা করে, যা হয়তো ধুলোর মধ্যে বেনিয়মের মধ্যেই অবহেলায় পড়ে থাকে। সেই সামান্যতার আহ্লাদ অসামান্য সিন্ধুর চোখে কখনো পড়ল না। খিদের সময়ে খাবার ও অফিস-যাওয়ার সময়ে জামাকাপড় এবং ঝকঝকে তকতকে ঘরদোর ছাড়াও আমার যে ওর কাছে নরম, স্নিগ্ধ, অতিসাধারণ অথচ অসাধারণ কিছু চাইবার ছিল তা সিন্ধু কখনো বুঝল না। ও দাবি করল যে, এই-ই তো যথেষ্ট। এই নিয়েই আমার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। যা পাচ্ছি, যতটুকু পাই, তা আমার পুণ্যবান স্বর্গত ঠ্যাঙাড়ে ঠাকুরদারই আশীর্বাদে। নিজেকে কখনো কখনো অযত্ন ও অনিয়মানুবর্তিতার শিকার করে তোলার অধিকারও যে সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাংবিধানিক অধিকার বলেই গণ্য একথা সিন্ধুভৈরবী মানতে তৈরি ছিল না।
নন্দার বিয়ে হয়ে গেছিল দিল্লিতে। চাকরি-করা একজন ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে আমার বিয়ের তিন বছর পর। সম্বন্ধ করেই বিয়ে হয়েছিল। গত ছ-বছর নন্দা আমার জীবন থেকে মুছে গেছে।
সেদিন হঠাৎ ফোন করল নন্দা অফিসে। বলল, অয়নদা, আমরা দিল্লি থেকে এসেছি গতসপ্তাহে। ফ্ল্যাট পেয়েছি কোম্পানির। আপনার বাড়ি ফেরার পথেই পড়ে একেবারে। একদিন আসুন না বাবা। কত্বদিন আপনাকে দেখিনি। আজকেই আসুন।
সেদিন অফিসফেরতা গেছিলাম। কিন্তু না গেলেই বোধ হয় ভালো করতাম। নন্দা কী সুন্দর যে হয়েছে! বিয়ের পর মেয়েরা যে কত বদলে যায়। কী যে রহস্যময়ী, আর গভীর হয়ে যায়; তা বলার নয়। অবাক হয়ে নন্দার চোখে চেয়ে রইলাম। মনে হল, কাউকে ভালোবেসে, না-পেয়ে থাকলে তার কাছে কখনো যেতে নেই। বড়ো কষ্ট পেতে হয়; বড়ো কষ্ট।
নন্দা বলল, কী দেখছেন অমন করে? আমাকে কি কখনো দেখেননি আগে?
এই নন্দাকে দেখিনি।
কেন?
বলেই, নন্দা মুখ নামিয়ে নিল।
দেখলাম, ও স্বভাবেও অনেক বদলে গেছে। সেই চপলতা নেই, ছটফটে ভাব নেই।
হঠাৎ বলল, আপনার চেহারা এরকম বুড়োর মতো হয়ে গেছে কেন? কী হয়েছে আপনার?
কী হবে? বুড়ো হয়ে গেছি বলেই বুড়োর মতো হয়েছে।
আহা! আপনি মোটেই বুড়ো নন।
তার পর বলল, কী খাবেন বলুন?
কিছু খাব না। আমি কি তোমার কাছে খাওয়ার জন্যেই এসেছি?
বা: তা: কী হয়! আমার বাড়ি প্রথমবার এলেন। দাঁড়ান, আমি চা করে আনছি!
একটি ছোটো ছেলে ছিল, ওর কাজ করার। তাকে চায়ের জল চাপাতে বলে নন্দা আমাকে বসিয়ে রেখে চলে গেল। একটু পরে ফিরে এল হাতে একপ্লেট সন্দেশ আর চা নিয়ে।
বলল, একচামচ চিনি তো?
আমি হাসলাম। বললাম, এত বছর পরেও মনে আছে?
সন্দেশের প্লেটটা তেপায়ায় নামিয়ে রেখে বলল, আছে। কিছু কিছু কথা মনে আছে। মনে থাকবে। মনে থাকার যা, তা মনে থাকেই।
তারপর বলল, সন্দেশ খান।
বললাম, প্লিজ; শুধুই চা খাব।
ও বলল, একটু নিন।
আমি একটুকরো সন্দেশ ভেঙে নিলাম।
নন্দা হাসল। বলল, এই-ই আপনার দোষ। খুঁটে-খাওয়া আপনার স্বভাব; কেড়ে খেতে জানেন না। গোটা খেতে জানেন না।
তার পর চা ও প্লেট তুলে নিয়ে বলল, বলুন, আপনার খবর বলুন। বউদি কেমন আছেন?
ভালো।
বাচ্চা?
ভালো।
ছেলের নাম কী রেখেছেন?
সুনন্দ।
বা:। নন্দা বলল। বেশ নন্দা নন্দা গন্ধ আছে তো!
তোমার বিয়ে তো দেখতে দেখতে ছ-বছর কেটে গেল। নো অ্যাডিশন ট্যু দ্য ফ্যামিলি? কী ব্যাপার?
বেশ আছি। বলল নন্দা। খুব হই হই করছি।
তার পর যেতে যেতে একটু থেমে বলল, ও আমাকে এত ভালোবাসে যে, মধ্যে আর কাউকে চায় না। আমিও চাই না।
ফিরে এসে বলল, আমি ফোন না করলেও এর আগে কি একবারও খোঁজ নিতে পারতেন না? আমাকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন ভাবিনি। আমরা যে এসেছি, এ খবর নিশ্চয়ই কানে গেছিল আপনার।
বললাম, ভুলে যাইনি। বিশ্বাস করো। তোমার সঙ্গে আমার এমন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যে, তা এ জীবনে ভোলার নয়। কিছু কিছু সম্পর্ক সকলের জীবনেই হয়, থাকে; যা ভোলার নয়। দেখা হোক কি নাই হোক। কাজের ফাঁকে, অবকাশের মুহূর্তে অনেক পুরোনো কথা মনের মধ্যে ভিড় করে আসে। তখন মনে হয় জীবনটা সম্পূর্ণ নিজমতনির্ভর হলে খুবই ভালো হত। মনে হয়, সংসারে সামাজিক বাজপাখিরা না থাকলেই জীবনটা অনেক সুন্দর হত। কারো একটু সুখও তারা সহ্য করতে পারে না; ছোঁ মেরে সেই সুখ কেড়ে নেয়।
নন্দার মুখ গম্ভীর হয়ে এল।
ও বলল, আমি বিশ্বাস করি না।
আমি চমকে উঠলাম। বললাম, কী বিশ্বাস করো না?
নন্দা বলল, বিশ্বাস করি না যে, নিজের সুখ অন্যে কাড়তে পারে। সুখকে আগলে রাখার মতো মনের জোর ও সাহস থাকা চাই। আপনি বড়ো ভীরু ছিলেন। নিজে জীবনে কী চান কখনো তা নিজেকে জিজ্ঞেসই করেননি। অবশ্য তা যদি জানতেনও সেই সুখকে অন্যের কাছ থেকে কেড়ে নেবার মতো সাহস আপনার কখনোই হত না। আপনার সে স্বভাব নয়। তাই-ই দুঃখ পান ও দুঃখ দেন অন্যকে।
আমি মুখ নামিয়ে রইলাম।
বললাম, হয়তো তুমি যা বলছ তাই-ই ঠিক। আমি এরকমই।
স্বাধীন অফিস থেকে ফিরবে কখন?
সময় হয়েছে। ফিরবে এখুনি। নন্দা বলল।
তার পরই বলল কেন? আমার স্বামীর অসাক্ষাতে আমার কাছে একা ঘরে বসে আছেন বলে কি আপনার ভয় করছে? ভয় কাকে? নিজেকে না স্বাধীনকে?
আমি থতোমতো খেয়ে গেলাম।
বললাম, না না, ভয় নয়। স্বাধীন যদি কিছু মনে করে, ভাবে। স্বাধীন কি তোমার আমার সম্পর্কের কথা জানে?
জানে মানে, আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি একথা জানে। আপনি আমাকে ভালোবাসেন কি না তা আমি নিজেই যখন কখনো তেমন করে জানিনি, ওর জানার প্রশ্নই ওঠে না। তা ছাড়া ও আমাকে বিয়েই করেছে। বিয়েটা একটা সম্পর্ক বই তো নয়! ওর সঙ্গে আমার স্ত্রীর-সম্পর্ক। স্ত্রীর কাছ থেকে যা যা চাইবার, পাবার তা ও সবই পায়। আমার বিরুদ্ধে ওর কোনো অনুযোগ নেই। কিন্তু এর বাইরে আমার জীবনে কি অন্য কোনো সম্পর্কই থাকতে পারে না? একজন মানুষ কি একটাই সম্পর্কের খুঁটিতে সারাজীবন বাধ্য ছাগলের মতো বাঁধা থাকতে পারে অয়নদা? আপনি কী বলবেন জানি না, আমার মনে হয়, পারে না। যারা তা থাকে, তাদের কোনো বিশেষ জিনিসের ঘাটতি আছে। তারা হয় ভন্ড, নয়তো তাদের বোধ নেই। তাদের মানুষের মন নেই।
নন্দাকে যখন কাছ থেকে জানতাম, তখন আমিই সাহিত্যযশপ্রার্থী রোমান্টিক যুবক হিসেবে অনর্গল কথা বলতাম। আমার সমস্ত অপ্রকাশিত ও অপ্রকাশিতব্য গল্পের নায়ক-নায়িকার ডায়ালগ আমার মুখ দিয়ে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করে নিজের কৃতিত্বের চমৎকারিত্বে নিজেই চমৎকৃত হয়ে যেতাম। তখন নন্দা মাঝে মাঝে শুধু বলত, আপনি ভারি ভালো কথা বলেন।
আসলে, সেই সময়, নন্দাও যে অনেক কিছু ভাবে, ওর মনেও যে গভীর সব ভাবনা নড়েচড়ে তারপর ডিম ভেঙে সকালের আকাশে অনাবিল সহজ পাখির মতো ডানা মেলে ওড়াউড়ি করে এসব আমরা জানা ছিল না। মেয়েদের আমি বুঝি না; জানি না। আমার জীবনে আমি খুব কম নারীরই সংস্পর্শে এসেছি। তাই তাদের মানসিকতার বহি:প্রকাশের স্বরূপ সম্বন্ধে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা কখনোই ছিল না। কিন্তু সেই স্বরূপের রূপ যে বিভিন্ন, এমন একটা অনুমান চিরদিনই ছিল। আজ নন্দাকে দেখে, ওর পরিবর্তন দেখে, ওর কথা শুনে মনে হল, কিছু কিছু নারীর মধ্যে গভীরতাও থাকে। আশ্চর্য! সব নারীই চটুল, খল, জেদি এবং অবুঝ নয়; স্বার্থপর নয়। সত্যিই আশ্চর্য। নিজের সঙ্গে অন্যের সম্পর্কের গভীরতা ও রং যুক্তির সঙ্গে হৃদয় মিশিয়ে বিচার করার ক্ষমতাও তাহলে নন্দার মতো কোনো কোনো মেয়ে রাখে!
যখন নন্দার খুব কাছাকাছি ছিলাম, তখন একটু কাছে থাকা, একটু শারীরিক সান্নিধ্য, কনুইয়ের সঙ্গে কনুই ছুঁয়ে যাওয়ার শিহরন, ওর চোখের সামুদ্রিক গভীরে সাঁতার-না-জানা নাবিকের মতো অসহায়তার মধ্যে কিন্তু বড়ো আনন্দে ডুবে যাওয়া— এইটুকুর মধ্যেই তখন আমার ভালোলাগা নিহিত ছিল। তখন ওর নৈকট্যটাই আমাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করেছিল। আজ অনেক দিন পর যেন হঠাৎই বুঝলাম নন্দার কাছে এসে যে, কাউকে সত্যিই ভালো লাগলে তার বড়ো বেশি কাছাকাছি থাকতে নেই, তাকে রোজ দেখতে চাইতে নেই। তাকে বার বার দূরত্বের মধ্যে, বিস্মৃতির মধ্যে হারিয়ে দিয়ে তাকে আবার তার প্রকৃত সত্তায় খুঁজে পাওয়ার মতো আনন্দ বুঝি বড়ো বিরল। আমার হতাশ, একঘেয়ে, কর্মক্লান্ত জীবনে, ভালোবাসার মতো কিছু যে আছে, থাকতে পারে; একথা আমি পুরোপুরিই ভুলে গেছিলাম। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে, দৈনন্দিনতা থেকে উত্তোলিত করার জন্যে, মানবিক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বৃত্তিগুলোকে নি:শেষে শেষ না হতে দেওয়ার জন্যে জীবনে স্বার্থহীন দেনা-পাওনার বাইরের কোনো একটি; অন্তত একটিও ভালোবাসার সম্পর্ক থাকা বুঝি বড়ো বেশি প্রয়োজন। মানুষের মতো বেঁচে থাকার জন্যেই প্রয়োজন।
কৃতজ্ঞতায় আমার বুকের ভেতরে একসঙ্গে এত কথা কলকল করে উঠল যে, আমি বোবা হয়ে গেলাম।
নন্দা বলল, দিল্লিতে মাঝে মাঝেই দুপুরবেলা যখন একা থাকতাম তখন আপনার চিঠিগুলোবের করে পড়তাম। আপনি সবসুদ্ধু কতগুলো চিঠি লিখেছিলেন আমাকে জানেন?
না:।
আমি বললাম। গুনিনি।
পাঁচ-শোর ওপর।
অবাক হলাম আমি।
কুড়ি গজ দূরের সামনের বাড়ির নন্দাকে পাঁচ-শো চিঠি লেখার মতো ভাবাবেগ ও মূর্খামি কখনো যে আমার ছিল একথা ভেবেই লজ্জা পেলাম। একটু দুঃখও হল এই কথা মনে করে যে, এখন তো কাউকে কুশল সংবাদ জানিয়ে একটা পোস্টকার্ড লিখতেও বড়ো কষ্ট হয়। কী করে, কোন ক্ষমতায় অত বড়ো বড়ো পাতার পর পাতা চিঠি লিখতাম তখন? কে লেখাত? লিখত কোন আমি? আমাকে দিয়ে কি অন্য কেউই লিখিয়ে নিত? আমার নিজের মধ্যে সে ক্ষমতা থাকলে আজ তা সম্পূর্ণ উবে গেল কেন? তাহলে কি চিঠি লেখানোর সব কৃতিত্ব নন্দারই ছিল? নন্দারই একার?
আমি লজ্জিত মুখে বসে থাকলাম।
বললাম, চিঠিগুলো যদি স্বাধীন দেখে। আমাকে কি বোকাই না ভাববে।
নন্দা হাসল। বলল, বোকা হতে সবাই পারে না। বোকা হওয়া বড়ো কঠিন। ভাগ্যিস তখন বোকা ছিলেন।
তার পর বলল, জানেন অয়নদা, আমার গয়নার বাক্সর চেয়েও এই চিঠির ঝাঁপিটা আমার কাছে অনেকই বেশি দামি। কী সুন্দর করে ভাবতেন আপনি, কী সুন্দর করে বলতেন, এমন করে আমাকে কেউ কখনো দেখেনি, দেখবেও না আর এ জীবনে। ভীষণ গর্বিত লাগে; যখন সে-কথা ভাবি।
তার পর একটু চুপ করে থেকে বলল, জানেন, আপনার লেখা-টেখা ছাড়া উচিত হয়নি। চেষ্টা করলে, লেগে থাকলে; আপনি একদিন ছোটোখাটো লেখক নিশ্চয়ই হতে পারতেন।
বললাম, তোমার ভালো লেগেছে বলে কি অন্য সকলেরও ভালো লাগত আমার লেখা? সম্পাদক তো আমার প্রেমিকা নন। আমার লেখার সমস্তটা জুড়েই তো ছিলে তুমিই। তোমার হাসি, তোমার চলা, তোমার বলা তোমার শরীর, মন; তাই তো সহজেই তোমাকে মুগ্ধ করেছে, তোমার মুগ্ধতাটা সত্যি। কিন্তু তোমাকে যা দিয়েছি তা অন্যেরা গ্রহণ করত কেন? তাদের ভালো লাগত কেন?
এসব বাজে কথা। আপনার লেখা উচিত। লেখার আসল কথা হচ্ছে আইডেন্টিফিকেশন। চিঠির মধ্যের আমি, যে আমিকে আপনি এঁকেছিলেন অনেক দরদে, তার সঙ্গে আর লেখকের সঙ্গে হাজার হাজার পাঠিকা এবং পাঠকও, নিজেদের আইডেন্টিফাই করত। এবং তা যদি হত তবে আপনার লেখা তাদের ভালো লাগতই।
দুর। আর হয় না। আর সে জোর নেই, উৎসাহ নেই। লেখা বড়ো পরিশ্রমের। তা ছাড়া, তার চেয়েও বড়ো কথা, আমার মনে হয়, সব লেখকই; যাঁরা আনন্দের জন্যে লেখেন, তাঁরা লেখেন কোনো এক বিশেষ জনের জন্যে। লিখতে তাঁকে কেউ অনুপ্রেরণা দেয়, তাঁকে নিজের বুকের খোলসের মধ্যে থেকে বুকের মধ্যের বহুরূপীটাকে কাগজের পাতায় আনতে বলে। তাঁর যে গোপন কথা তা সকলের করে দিতে বলে। তা ছাড়া জানো, আমার মনে হয়, লেখকরা বড়ো গরিবও। তাঁদের বুকের মধ্যে নিজের বলতে আর কিছুই বাকি থাকে না। সবই যে পাঠকদের দিয়ে রিক্ত, নি:স্ব হয়ে যেতে হয়; সেটা বড়ো দুঃখের। না:। লেখক হওয়ার সাধ আর আমার নেই।
হঠাৎ কথা ঘুরিয়ে নন্দা বলল, আমার এখান থেকে কি সোজাই বাড়ি যাবেন?
আমি চুপ করে থাকলাম।
নন্দা বলল, কী? কথা বলছেন না যে?
বাড়ি তো ফিরতেই হবে। আমরা যদি জানোয়ার হতাম জঙ্গলের, তাহলে কোনো বাঁধা ঠিকানা থাকত না। দিনে রাতে পাহাড়ে বনে চরে-চরে বেরিয়ে এক জায়গায় শুয়ে পড়তাম রাতে। আজ এখানে, কাল সেখানে, নিরুপদ্রবে জাবর কাটতাম। কিন্তু আমার ঠিকানা একটা আছেই, রোজ সেই ঠিকানায় ইচ্ছাতেই হোক, কি অনিচ্ছাতেই হোক, ফিরতেই হয়, পথে-ঘাটে মরে গেলেও আমার মৃতদেহকেও সেখানে ফিরে যেতেই হবে। আমি যে মানুষ। আমি যে ঠিকানাতে বাঁধা আছি নন্দা, শিকলের সঙ্গে; আবহমানকাল ধরে।
আমি বুঝলাম যে, নন্দার সোজা প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে অনেক কথা বলে ফেললাম অপ্রাসঙ্গিক। আজকাল এরকমই করি আমি। যেখানে একটি কথা বললে চলে, সেখানে দশটা কথা বলি। শ্লথ হয়ে গেছি বলেই বোধ হয়, এরকম অতিকথনের দোষ হয়েছে। অথবা মাথার মধ্যে ভাবনা ও ভাবনা প্রকাশের মধ্যে কোনো সাযুজ্য নেই; সমতা নেই।
বললাম, বাড়ি ফেরার কথা জিজ্ঞেস করছিলে কেন?
না! ভাবছিলাম, তাড়া না থাকলে, এখানেই খেয়ে যেতেন। চান করে নিন না। ওর পায়জামা-পাঞ্জাবি বের করে দিচ্ছি। চান করবেন?
না। না। পাগলি একটা তুমি। আমার মিষ্টি পাগলি।
এমন সময় টেলিফোনটা বাজল।
নন্দা ফোন ধরল। বলল, বলো, তুমি এলে না এখনও? অয়নদা এসেছেন।
তার পর বলল, কী বল্লে? দেরি হবে। কেন?
বুঝেছি।
তার পর বলল, আমি তোমার জন্যে বসে থাকব কিন্তু না খেয়ে।
খেয়ে নেব? না। অত দেরি করবে? ভালো লাগে না। আচ্ছা, ঠিক আছে।
ফোন ছেড়ে এসে বলল, ওর কারখানায় ব্রেকডাউন হয়েছে। কাজ পড়ে গেছে। ফিরতে রাত বারোটা হবে। আপনি যাবেন না। যেতে দেব না আপনাকে। আমার সঙ্গে এখন থাকতে হবে। গল্প করতে হবে। আপনিও বরং জানিয়ে দিন বউদিকে। নইলে চিন্তা করবেন যে।
তোমার চিন্তা নেই। জানাতে হবে না। আমার জন্যে কেউ চিন্তাও করবে না বরং জানালেই হাজার বিপত্তি। খাবার ঢাকা দেওয়া থাকবে খাবার টেবিলে। যখনই যাই, খেয়ে নেব।
গলা নামিয়ে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে নন্দা বলল, এতদিন পর আমাকে দেখলেন, একটুও আদর করলেন না তো? আপনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না, না?
তার পর নন্দা গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। দরজার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ালাম আমি। নন্দা এগিয়ে এল আমার কাছে।
চান করেছে ও। সুন্দর করে সেজেছে। কী সাবান মেখেছে জানি না। ওর গায়ে লেবুপাতার গন্ধ। আমি সেই গন্ধে বুঁদ হয়ে গেলাম।
জোরে জোরে নি:শ্বাস পড়ছিল ওর।
আমি বললাম, তোমার বুকের তিলটার রং বদলে গেছে। কালো ছিল না আগে?
নন্দা হাসল, বলল, অসভ্য!
তার পর লাজুক মুখে, অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, বদলায়নি। ওটা নতুন তিল। আগেরটা কালো ছিল। এটা লাল! বোকা!
আবার আমরা মুখোমুখি বসলাম।
ওর সামনে বসে থাকতে থাকতে আমার বড়ো কান্না পেল আনন্দে এবং দুঃখে। এ জীবনে মাঝে মাঝে ওর সামনে এসে একটু বসে থাকা, কখনো সখনো সমাজের চোখ বাঁচিয়ে চোরের মতো ওর গ্রীবায়, ওর কানের লতিতে অথবা ওর স্তনসন্ধিতে একটু ঠোঁট ছোঁওয়ানো। এই-ই সব—এইটুকুই। বাকি যা, তা দুঃখই; বড়ো দুঃখ। দুঃখটুকুই সত্যি; স্থায়ী। আর সবই মিথ্যা, ক্ষণিক।
এই সম্পর্কের কোনো পরিণতি নেই।
আমি জানি, একটু পরেই আমাকে উঠে যেতেই হবে। আমার বাড়িতে নন্দার, নন্দার বাড়িতে আমার স্থান স্থির; নির্দিষ্ট। সেই ছোট্ট, অকুলান ফ্রেমের মধ্যেই আঁটোসাঁটো হয়ে বাকিজীবন কাটাতে হবে আমাদের। আমাদের কেউই বুঝবে না, ক্ষমা করবে না, সকলেই শাস্তি দেবে; আঘাত দেবে। কারণ, সমাজ শুধু আঘাতই দিতে জানে, শান্তি দিতে নয়।
কিছুক্ষণ পর বললাম, আজকে উঠি নন্দা। ন-টা বেজে গেছে। বড়ো ভালো লাগল তোমাকে দেখে। তোমার কাছে এসে। কী ভালো যে লাগল। তোমাকে বোঝাতে পারব না।
বুঝি। বুঝতে পারি।
নন্দা বলল। তারপর বলল, নিজেকে দিয়ে একটু একটু বুঝতে পারি।
বলেই, হাসল একটু।
বড়ো সুন্দর দেখাল ওকে।
ও সিঁড়ির নীচ অবধি এসেছিল। তার পর গাড়ি অবধি এল আমাকে পৌঁছে দিতে।
গাড়ি স্টার্ট করবার আগে বললাম, পরশু তোমার জন্মদিন। কী দিতে পারি তোমায়? দিল্লিতে তো এ ক-বছর ফুল ছাড়া কিছুই পাঠাতে পারিনি। বলো, কী পেলে তুমি সবচেয়ে খুশি হও?
নন্দার চোখে চাঁপাফুলের মতো সুগন্ধি এক হাসি ফুটে উঠল।
বলল, ফুলের চেয়েও যা দামি, তা-ই দেবেন। যা দিয়েছিলেন একদিন, তাই-ই নতুন করে দেবেন।
তার পর আচমকা চোখ তুলে আমার চোখে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, অয়নদা, আমাদের এই সম্পর্কটা কি থাকবে? এ সম্পর্ককে কি বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন? আমি পারব যে, তা জানি। আপনি পারবেন কি? আপনি বড়ো ভীরু। আপনাকে নিয়েই ভয়।
হাসবার চেষ্টা করলাম।
বললাম, চেষ্টা করব। সাহসী হতে চেষ্টা করব।
গাড়িটা ট্র্যাফিক সিগন্যালের লাল আলোতে দাঁড়িয়েছিল পথের মোড়ে। আলোটার দিকে চোখ পড়তেই আমার মনে হল, যেসব সম্পর্কে সমাজের সিলমোহর নেই, সেইসব সম্পর্কের পথেই চোখ-ধাঁধানো একটা গোলাকৃতি কুটিল লাল আলো পথ আগলে থাকে প্রতিমুহূর্ত। এই লাল আলোটা সেই অদৃশ্য ডাইনির রক্তচোখ। এই চোখকে আমরা সকলেই ভয় পাই। মানতে বাধ্য হই। একে মানতে, মানতে, মানতে, আমরা নিজের নিজের বুকের মধ্যে ছোটো হতে, হতে, হতে; এক সময় একেবারে নগণ্য হয়ে যাই।
ট্র্যাফিক পুলিশ হই হই করে উঠল।
আমি জোর অ্যাক্সিলেটারে চাপ দিয়ে বেরিয়ে গেলাম সোজা। খুউব জোরে, আইন, নিষেধ, যুগযুগান্ত ধরে মেনে-নেওয়া বাধার উলটে দিকে।
উলটে দিকে।
আমার মনে হল, জীবনে এই-ই প্রথম, প্রথম লাল রঙের চোখটার মধ্যে দিয়ে, সেই চোখ-রাঙানিকে বিদ্ধ করে, দীর্ণ করে এইমুহূর্তে ভীরু, ভীষণ ভীরু আমি; সাহসের, স্বাভাবিকতার নতুন রাজ্যে নতুন জীবনে একেবারে হঠাৎই নন্দার বুকের লাল তিলটিকে মুখে করে একটি কচি-কলাপাতা রঙা উৎসারিত টিয়াপাখির মতো প্রবেশ করলাম।