উৎসব
এখন আনোয়ার আলির বেশ মুডে থাকার কথা। এইতো কিছুক্ষণ আগে সে বড়োলোক বন্ধুর বৌ-ভাতের নিমন্ত্রণে ধানমণ্ডির মস্ত এক বাড়িতে গিয়েছিলো। ভিতর ধানমণ্ডির খুব সুসজ্জিত, অভিজাত ও আধুনিক বাড়ি। প্রচুর পরিমাণে ভালো ভালো মেয়ে দ্যাখা গেছে, কয়েকজনের সঙ্গে এমনকি আলাপও হলো। সমস্ত বিয়ে বাড়ির কুলীন কলরব অন্তত সপ্তাহখানেক সমস্ত শরীরে সুখ উদ্রেক করবে।
কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা অন্যরূপ। ওদের সরু গলির মুখে ঢুকেই আনোয়ার আলি বিরক্ত ও দুঃখিত হয়ে পড়লো। তার বিরক্তির কারণ এইসব: গলির নালায় হলদে রঙের ঘন জল ল্যাম্পোস্টের ফ্যাকাশে আলোতে ঘোলাটে চোখে নির্লিপ্ত তাকিয়ে থাকে। নালার তীরে মানুষ ও কুকুরের অপকর্ম কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমায়। আর, আর এইসব লোকজন! পাড়ার অধিবাসীরাও তার বিরক্তির একটি কারণ। নাইট শো ছবি ভাঙতে এখনো আধঘণ্টা, পাড়ার তরুণ সমাজ মেয়ে দেখবে বলে এখন থেকেই পায়তারা কষে। গলির বাঁ দিকে বড়ো রাস্তায় চলছে জুয়ার জমাট আড়া। আহমদিয়া হোটেল এ্যান্ড রেস্টুরেন্টে বিশ বছর আগেকার ‘ছোড়ে বাবুল কা ঘর’ বিরতিহীন বাজে। এখন রাত্রি সোয়া এগারোটা, আরো ঘন্ট দুয়েক এই কর্কশ কোলাহলের কাল।
আলোয়ার আলির দুঃখের কারণ : এই অঞ্চল এবং সন্ধ্যাবেলার উৎসবমুখর বাড়ি ও ঐ এলাকা তার বিরক্ত চিত্তে পাশাপাশি অবস্থান করে। ধানমণ্ডির রাস্তা সবই চওড়া, মসৃণ, নোতুন ও টাটকা। দুধেল আলোর নিচে গা এলিয়ে তারা আলো পোহায়; শুয়ে শুয়ে দ্যাখে, মাথার ওপর অনন্তকাল বিরাজ করছে রহস্যময় মহাশূন্য। দেশী-বিদেশী মেয়েমানুষভরা গাড়ি একেকটা রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে, উড়াল দিচ্ছে অন্য কোনো ইন্দ্রপুরীর দিকে। সম্মানজনক দূরত্ব নিয়ে পকেটে হাত দাঁড়িয়ে আছেন মনিমুক্তাখচিত বড়ো বড়ো সব প্রাসাদ। বোঝা যায় ঐসব নিষিদ্ধ গ্রহ নক্ষত্রে কোয়ার্টার ডজন হাফ ডজন রূপসী অন্য কোনো ভাষায় বাক্যালাপ করে। এই সেতারে মালকোষ ধরলো কি হাই তুলতে তুলতে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছে মন্থর আঙুলে। মুনতাসির কি ইশতিয়াক কি আহরার এলে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এল. পি চালিয়ে দিয়ে স্যোসালিজম সম্বন্ধে গল্প করছে কি নরম গলায়। আবার এরই ফাঁকে ফাঁকে সময় করে লোনলিনেসে কি মিষ্টি কষ্ট পায়। তখন আর উপায় থাকে না, পুরো দুটো ঘন্টা এয়ার কণ্ডিশনের ওপর ফুল স্পীড়ে পাখা চালিয়ে ডিউক এলিংটন শোনে।
আর দ্যাখো এখানে! এই দুপুর রাতে আটটা-নটা কুত্তা দৌড়ে বেড়াচ্ছে একবার গলির এমাথায়, একবার ওমাথায়। কুকুর কি আর ওদিকে নেই? ওদিকেও আছে। বিয়ে বাড়িতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন। কি গম্ভীর তাঁর মুখ, কি তাঁর চেহারা! কি ডাঁটে দাঁড়িয়ে ল্যাজ নাড়ছিলেন মৃদু মৃদু। মনে হয় বাঙলা ফিলোর জমিদারবাবু দোতলার ব্যালকনিতে ডেক চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে সূর্যাস্ত উপভোগ করছেন। এইসব কুকুর দেখলেও মনের মধ্যে ভক্তিভাব জেগে ওঠে।
আর দ্যাখো, পাড়ার কুত্তার বাচ্চাদের একবার দ্যাখো! সবগুলো শালা নেড়ি, গায়ে লোম নেই এক ফোঁটা, শরীর ভরা ঘা নিয়ে কেবল কুঁই কুঁই গোঙায়। একেকটা আবার কোনো কোনো ছোটো লোকের বাচ্চার মতো যা তা খেয়ে ধ্যাবড়া মোটা হয়েছে, তাকিয়ে থাকে ভাবলেশহীন চোখে, ল্যাম্পোস্ট পেলেই ছিরছির পেচ্ছাব করে।
নিজের ঘরে ঢুকলে মনে হয়, এই ঘর ঐ গলিরই একটা বাইলেন। সেই ভিজে ভিজে ভ্যাপসা ভোঁতা গন্ধ, ৪০ পাওয়ারের টকটক আলোর ভেতরে ঘুম থেকে ওঠা সালেহা বেগমের পুরু ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটা হলুদাভ ও একটা শাদা দাঁত নির্লজ্জ উঁকি দেয়। সালেহা বেগম তার স্ত্রী, তার স্ত্রীর ঠোঁটের কোণে লালার আভাস, সমগ্র মুখমণ্ডলে গ্রাম্যতা, কেবল গ্রাম্যতা তোতলায়।
‘পলির লুঙিটা কোথায়?’ আজ অক্টোবরের ৫ তারিখ, মাসের প্রথম দিকে সে তার স্ত্রীকে সালেহা বলে সম্বোধন করে, রিকশায় উঠলে বলে শেলী। কিন্তু দুঃখ ও বিরক্তি তাকে দিয়ে আজ প্রথা ভাঙায়।
সালেহার ঘুমঘুম হাসি এড়াবার জন্য আনোয়ার আলি উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে লুঙি পরতে থাকে। তার ক্ষোভ হয়, এই মেয়েটা বছরখানেক হলেও তো কলেজে পড়েছে, বিয়ের আগে এমনকি একটু প্রেম মতোনও করলো। অথচ এমন জবুথবু হয়ে থাকে কেন? শাড়ির ভেতর বুক নেই পাছা নেই, দিনরাত হেঁটে বেড়াচ্ছে একটা বেঢপ কোলবালিশ।
‘রাত অনেক হলো, না? ক’টা বাজে, এ্যা?’ বলতে বলতে সালেহা বেগম চলে গেলো উঠানে। কলতলায় দুটো ইঁটের ওপর ধ্যাবড়া দুটো পা রেখে সে এখন গ্যালন খানেক পেচ্ছাব করবে। মেয়েমানুষের এরকম বারবার পেচ্ছাব পায়খানা করা, দলা দলা থুতু ফেলা—এসব আনোয়ার আলির মনঃপুত নয়। তো কি আর করা যাবে? এসব মেয়েমানুষ শোধরায় না কোনো দিন। করুক, সালেহা যতো খুশি পেচ্ছাব করুক, এই ফাঁকে সন্ধেবেলাটা ভেবে নেওয়া যাক। এক হাত আলনায় প্যান্টের ওপর রাখা, আরেক হাতে স্যাতস্যাতে হলুদাভ আণ্ডারওয়্যার –ছোটো ঘরের স্বল্প শূন্যতায় উৎসব দ্যাখার জন্য আনোয়ার আলি নিবিষ্টচিত্ত হলো।
কিন্তু উৎসব, বা উৎসবের কোনো মহিলা গোটা শরীরে কখনো আসে না। ঝলমল আলোর নিচে সমস্ত বিবাহ উৎসব কখনো একটিমাত্র ঝাপশা চিত্রে, কখনো ছিঁড়ে ছিঁড়ে চোখের লাল লাল রেখায় চোখ টেপে। একবার মনে হয়, এ বিয়েতে না গেলেই ভাল হতো। কাইয়ুম তার কি এমন বন্ধু? সেদিন স্টেডিয়ামে হঠাৎ দ্যাখা না হলে সে তো এই বিয়ের কথা জানতেও পারতো না। কলেজে একসঙ্গে পড়েছিলো বছর দুয়েক, একই ছাত্র প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছিলো বলে, এবং একটা ধর্মঘট আয়োজন করবার সময় দুজনে একটু ঘনিষ্ঠ হয়েছিলো। বেশ বড়োলোকের ছেলে, বামপন্থী রাজনীতি করে, ছাত্রও খুব তুখোড়, সবাই কাইয়ুমের কাছে ঘেঁষতে চাইতো। এই বিয়েতে না এলে কে আর ওর অভাব বোধ করতো? এসে দু’তিনজন পুরোনো সহপাঠির সঙ্গে দ্যাখা হলো।
কে কাইয়ুমের বেশি কাছে ঘেঁষতে পারে, এই নিয়ে হাফিজের সঙ্গে ওর একটু প্রতিযোগিতামতো ছিলো। ওকে দেখে দশ বছর পর সেই ঈর্ষাবোধ কিলবিল করে উঠলো। প্রথম যখন কলেজে ভর্তি হয়, হাফিজ তখন একটু গ্রাম্য ধরনের ছেলে, উচ্চারণে আঞ্চলিক টান এখনো কানে বাজে। ছাত্রজীবনে চাঁদা তুলে একুশে ফেব্রুয়ারির সংকলন বার করতো, এখন এখানেই কোন কলেজে বাঙলা পড়ায়, একুশে ফেব্রুয়ারির প্রতি দায়িত্ব আজো পালন করে চলেছে। লোকটা বড়ো বকে, বড়ো বেশি কথা বলে। উৎসবের রূপসীরা চোখের সামনে আসে, ফের চলে যায় কিন্তু হাফিজের আত্মাজীবনী পাঠ বিরতিহীন, ‘আমি ভাই এইসব ফাংশন এ্যাভয়েড করি। আমি বাবা প্রফেসর মানুষ, পড়াশোনা নিয়েই সময় কাটে। হৈ চৈ ভাল্লাগে না। পলিটিক্স তো ছেড়ে দিয়েছি ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েই। লেখাও প্রায় স্টপ তা রেডিও টিভির লোক পেছনে লেগেই আছে, ওদের চাপেই এখনো গান লিখি, এই গানই লিখি কেবল।
আনোয়ার আলির এক হাত তখনো প্যান্টের ওপর রাখা, এক হাতে খামচে ধরে আছে নরম আণ্ডারওয়্যার। আহমদিয়া রেস্টুরেন্টে উচ্চ কন্ঠে লতা মুঙ্গেসকর বাজে, রেকর্ডে অধ্যাপক ও গীতিকার হাফিজুর রহমানের আত্মজীবনী শোনা যায়। আনোয়ার আলি এদিক দ্যাখে, ওদিক দ্যাখে, মেয়ে কোথায়, ভালো ভালো মেয়ে খুব ভালো করে দেখে নেওয়া দরকার। একসঙ্গে এতো ভালো মেয়ে আর কোনো দিন পাওয়া যাবে না। জায়গাটা ও পেয়েছিলো সব চেয়ে ভালো। ঘন সবুজ লনে অজস্র চেয়ার ছড়ানো। অনেকে বসেছে, কেউ কেউ ঘুরে ঘুরে কথা বলছে। বাইরে বিশেষ ট্রাফিক পুলিস, গাড়ি পার্ক করে রেখে লোকেরা মেয়েরা লনে আসছে। কাইয়ুম কিম্বা কাইয়ুমের বাবা প্রায় সকলের সঙ্গেই একটু হাসছে। খুব সামান্য রসিকতা কিম্বা অরসিকতাতেও লোকেরা মেয়েরা হো হো করে দমকা হাসি ছাড়ছে। কোনো কোনো মহিলা লন পেরিয়ে বারান্দায় উঠে ঘরের দিকে চলে যাচ্ছে, ঐ জায়গাটাও আনোয়ার আলির চেয়ার থেকে বেশ স্পষ্ট দ্যাখা যায়।
একটি কোণে আলোকিত কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বাঙালি সংস্কৃতি ও সমাজতন্ত্র চর্চায় কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ লোক ও মেয়ে বেশ সুন্দর একটি কর্নার তৈরি করে নিয়েছে। আনোয়ার আলির কাঙাল সাধ হয় সেও ঐখানে ওদের সঙ্গে ভিড়ে যায়। এদের মেয়েরা অল্পের মধ্যে সুন্দর সাজতে পারে। খুব মনোহারী কণ্ঠে কি সুন্দর বাচনভঙ্গি এদের। আজকাল ১৪/১৫ থেকে ৩০/৩২, এমন কি কোথাও কোথাও ৩৯/৪০- এই বয়সের অনেক মেয়ে এদের কণ্ঠ ও বাচনভঙ্গি নকল করে। তবে বাইরে ইমিটেশন শোনা এক কথা, আর একেবারে ওরিজিন্যাল শোনা – কোনো তুলনা হয়? ওখানে যাওয়ার জন্যে সে উসখুস করে, কিন্তু ওখানে কাউকেই তো চেনে না, কি করে যায়?
‘তোমার ভাবী, বুঝেছো, এসব ব্যাপারে খুব ইন্সপায়ার করে। আমার মাদার-ইন-ল ওয়েস্ট বেঙ্গলের খুব এ্যারিস্টোক্র্যাট ফ্যামিলির মেয়ে। সৈয়দ বদরুদ্দোজা সাহেবদের সঙ্গে রিলেটেড, খুব কালচার্ড ফ্যামিলি। আমার মেজো শালাকে চিনবে, শাহরিয়ার, সৈয়দ শাহরিয়ার হোসেন, এবার সিএসেসে এ্যাপিয়ার করেছিলো, সিভিল সার্ভিসই পেয়েছে, লাহোরে ট্রেনিং চলছে, সেও গান-বাজনার ভক্ত। আমার একটা গান শুনেছো বোধহয়, খুব পপুলার হয়েছে, প্র্যাকটিক্যালি ওরই ইনিশিয়েটিভে রেকর্ড হলো। খোন্দকার রফিক আহমদ গেয়েছে, খুব হিট গান, “ওগো বন্ধু, আমায় তুমি দিলে ওগো কেয়ার কাঁটা আজ, কারে তুমি পরালে গো কেয়া ফুলের সাজ?” – তো এই গান’— কাইয়ুম একজন যুবতীকে নিয়ে এদিকে এলে হাফিজের আত্মজীবনী পাঠের আকস্মিক বিরতি ঘটে। যুবক সুবেশধারী ও সুপুরুষ, তার চেহারা খুব ধারালো। পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় কাইয়ুম হাফিজের সাহিত্যকীর্তির প্রশংসা করলে আনোয়ার আলির বুকটা চিনচিন করে ওঠে। ঐ যুবকের নাম ইকবাল হোসেন চৌধুরী, পশ্চিম ইউরোপের এক রাজধানীতে পাকিস্তানী দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র ছিলো যখন, সে আজ তেরো চোদ্দো বছর তো হবেই, বাম রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রায়ই আমতলায় বক্তৃতা করতো, বরীন্দ্র সঙ্গীত ও গণসঙ্গীত এই দুই ধরনের গান গাইতো এবং তখনকার নিয়ম অনুসারে সংগ্রামী কবিতা লিখতো। সেই সময় তার লেখা একটি কবিতা ‘আমরা সূর্যটা আনবোই’ পড়ে আনোয়ার আলি অন্তত দিন তিনেক খুব চাঙা সময় যাপন করেছিলো। প্রাক্তন কবি ইকবাল হোসেন চৌধুরী আজ ফের অনুপ্রেরণা দিলো গীতিকার অধ্যাপক হাফিজুর রহমানকে। তার আত্মচরিত বর্ণনা করবার প্রধান ইন্দ্রিয় জিহ্বা রূপান্তরিত হয় একটি ল্যাজে, লোমহীন ছোটো ল্যাজ মুখগহ্বরের ধ্বনিপুঞ্জে কি কারুকাজ করে যার ফলে এই সব বাক্য উৎসারিত হতে থাকে : আপনার নাম আমি বহুদিন থেকেই জানি। ইফ ইউ ডোন্ট মাইণ্ড, লেখা ছেড়ে দিয়ে আপনি ভারি অন্যায় করেছেন। রাদার, শুড আই বি এ্যালাউড টু সে দ্যাট ইউ কমিট এ ক্রাইম? উই হ্যাভ বিন গিফটেড উইথ এ্যান এ-ক্লাস ডিপ্লোম্যাট, নো ডাউট এ্যাবাউট ইট, বাট এ্যাট দ্য কষ্ট অফ এ্যান এ-ক্লাস পোয়েট।’
ইকবালের তৈরি-করা ইউরোপিয়ান হাসি দেখে আনোয়ারের ঠোঁট একটু একটু ব্যথা করে। এর মধ্যে লোকজন অবিরাম আসছেই। কাইয়ুম গেটে গিয়ে শেরোয়ানি পরা একজন নামকরা রাজনীতিবিদ ও তাঁর তিন চারজন স্তাবককে নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। সংস্কৃতি কর্নারের পরিমিত হাসি হঠাৎ একটু উচ্চকণ্ঠে শোনা গেলে আনোয়ার আলির শরীরে বড়ো কোলাহল সৃষ্টি হয়। কাইয়ুম ফের এদিক এলো, তখনো হাফিজের লাঙ্গুলচর্চা চলছেই, ‘আমি বলি, লোকে যাই বলুক না, আমি অলঞ্জ বলে আসছি, আমার ছাত্রদেরও বলি, এই ফরেন সার্ভিস, সিভিল সার্ভিসের কিছু এনলাইটেণ্ড লোকের জন্যেই আমাদের আর্ট কালচার এখনো টিকে আছে। কর্তাদের যা এ্যাটিচুড, অন্তত সো ফার এ্যাজ আর্ট এ্যাণ্ড কালচার ইজ কনসার্নড, সেটা ঠিক, আই মিন –
‘নট ভেরি এগ্রিয়েবল।’ ইকবাল নিজেই হাফিজের বাক্য সম্পূর্ণ করে দিলে কাইয়ুম আনোয়ার আলির সঙ্গে ইকবালের পাঞ্জাবি স্ত্রীর পরিচয় করিতে দেয়, উই আর ফ্রেণ্ডস সিন্স আওয়ার আর্লি ইউথ।’
মিসেস ইরশাত হোসেন চৌধুরী আনোয়ারের চোখের মণিতে ও বুকের খাঁচায় লাল ও শাদা হাসি ফোটায়, ‘আচ্ছা! আপনারা কি য়েক সোঙে স্কুলে পোঢ়তেন?’ এই বাঙলা শুনতে বেশ মিষ্টি কিন্তু কামোদ্রেক করে না।
কাউয়ুম বলে, ‘না, আমরা কলেজে একসঙ্গে পড়তাম। উই সাবক্রাইবড টু দ্য সেম পলিটিক্যাল ভিউজ। কলেজে খুব পলিটিক্স করতাম আমরা।’
‘ইজ ইট?’ রূপসীর কণ্ঠ, নেত্রকোণ ও ঠোঁটে ছায়াছবির পর্দা কাঁপে, ‘মাই গড! আই অ্যাম এ্যাফরেড অফ পলিটিশিয়ান্স। পলিটিক্স টেরিফাইস মি লাইক এনিথিং।’
আনোয়ার আলি সালেহা বেগমের ছেলে কলি একটা পা তুলে দিয়েছিলো তাদের মেয়ে পলির গায়ের ওপর। ছেলেমেয়ের মা ছেলেমেয়েদের ঠিকঠাক করে শুইয়ে একপাশে সরিয়ে রাখে। ছেলেমেয়ে অঘোরে ঘুমায়। বাইরে দ্বৈতকণ্ঠে কারা ‘আরমান’ চলচ্চিত্রের একটি গানের একটুখানি গেয়েই থেমে গেলো। সালেহা ফ্যাসফ্যাসে গলায় কি বলে, আনোয়ার আলি তার কথাও শোনে, কয়েক ঘণ্টা আগে শোনা মিসেস ইরশাত হোসেন চৌধুরীর গুঞ্জরণও তার কানে বাজে। উচ্চপদস্থ রাজপুরুষের সামনে সরকার-বিরোধী কথা বলবার তৃপ্তিতে হাফিজ খুব অভিভূত হয়ে পড়ে। মিসেস চৌধুরী কথার জবাবে আনোয়ার কি বলবে কি বলবে ভাবতে ভাবতে রূপসীর মনোযোগ চলে যায় অন্য কোথাও, অন্য কোনো প্রসঙ্গে। আনোয়ার আলি শোনে হাফিজ তার কানের কাছে মুখ এনে বলছে, ‘আমি কাউকে কেয়ার করি নাকি? দেখলে না, কেমন মিষ্টি কথায় গভর্নমেন্টকে দিলাম এক চোট।’ মিসেস চৌধুরীর চেহারা একটুও মনে নেই। তার সংলাপ সবই স্পষ্ট মনে পড়ে, কিন্তু চেহারা কোথায়? মেয়েটাকে কতো মনোযোগ দিয়ে দেখলো, থেকে দেখলো, ওদিক থেকে দেখলো, কয়েকটা ঘন্টা যেতে না যেতেই সমস্ত ভুলে বসে আছে। দিনদিন স্মৃতিশক্তি ক্ষয় হতে হতে কোথায় এসে ঠেকলো? বয়স বেড়ে যায়, এতো তাড়াতাড়ি বয়স বাড়লে কি পোষায়? আনোয়ার আলি খুব জোরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই দীর্ঘশ্বাসে সমস্ত উৎসব একটু উড়ে গিয়ে বড়ো এলোমেলো হয়ে যায়।
সালেহা বেগম বালিশ সাজায় পাশাপাশি। ‘কি গরম! ইস্ কী পচা গরম’ বলতে বলতে সে গলায়, ঘাড়ে ও বগলে পাউডার ঢালে। এসব দেখে আনোয়ার আলি বড়ো বিব্রত হয়। চোখের ঘুম ঘুম ছায়া কেটে যাচ্ছে সালেহার, ঘুমের জায়গার আসছে কাম, সরাসরি কাম। তার ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠ ক্রমশ ঘর্ঘর হচ্ছে, তার কথাও বেশ বোঝা যায় এখন : আসতে এতো দেরি করলে কেন? খুব খেয়েছো, না? তোমার বন্ধু খুব বড়োলোক, না? ধানমণ্ডিতে কি নিজেদের বাড়ি? মেয়ে দেখতে কেমন? মেয়ের বাবা কি কি দিলো তোমার বন্ধুকে? তুমি কোনো কাজের না। আমি গেলে ঠিক জেনে আসতাম, বুঝলে। খুব লোক হয়েছিলো, না? কি খাওয়ালো, এ্যাঁ?’
শুয়ে পড়তে পড়তে আনোয়ার আলি তার স্ত্রীর প্রশ্নমালার সংক্ষিপ্ত ও মোটামুটি সন্তোষজনক উত্তর দেয়। এখন নিয়মিত প্রাক-নিদ্রা রতিক্রিয়ার পালা। এই মেয়েটিকে অন্তর মিনিট বিশেক ভালোবাসতে হবে। ভয় হয়, সালেহা তার মূল্যবান সন্ধেবেলাটা তছনছ না করে ফেলে। তবে ভালো ভালো মেয়ে দ্যাখা গেছে বহু, সুখ তো আজ ওদের নিয়ে, সালেহা উপলক্ষ মাত্র।
আনোয়ার আলি অভ্যস্ত হাতে স্ত্রীর ব্লাউজের বোতাম, ব্রার হুক খুলতে গেলে সালেহা নিয়মিত ও ঘর্ঘর কণ্ঠে আওয়াজ করে, উঁহু, আজ থাক।’ এবং আনোয়ারের আরো কাছে সরে আসে। অথচ আনোয়ারের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়ে সেখানে ঠাণ্ডা সর পড়ছে। শীতল শরীরে একটু ধ্বনি শোনা যায়: কি হলো আজ একটুও ইচ্ছা করছে না কেন? কোনো কোনো দিন দুপুরবেলা অফিসে বসে সে পর্নোগ্রাফি পড়ে, সেদিন রাত্রিবেলা কিন্তু এই মেয়েটার শরীরেই বেশ টাটকা স্বাদ পাওয়া যায়। আজ ক্ষোভ হয়; যতোই সেক্সি হোক না, কায়দাটা এরা ঠিক রপ্ত করতে পারে না, -এই সালেহা টাইপের মেয়েরা। অথচ পারভেজের বৌটাকে দ্যাখো। পারভেজের বৌও তো বড়োজোর আই.এ ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে। বিয়ের সময় কলেজে কেবল ভর্তি হয়েছিল, পরে আই.এ কি আর পাস করেছে? অথচ দ্যাখো তার কথা বলবার ঢং কি, কি তার তাকাবার কায়দা! মেয়েটার সঙ্গে আলাপ হলো একেবারে শেষের দিকে, ওরা তখন বেরিয়ে যাচ্ছে, আনোয়ার আলির ঘাড়ে হাত দিলো পারভেজ।
‘আমি অনেকক্ষণ থেকে মার্ক করছি। অনেক মোটা হয়ে গেছো আনোয়ার, চিনতে অসুবিধা হয়।’
তারপর পরিচয় করিয়ে দিলো পাশে দাঁড়ানো বৌয়ের সঙ্গে, ‘আমার স্কুলের বন্ধু। আমরা একই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেছি, একই কলেজে পড়েছি, কলেজ থেকে বেরিয়ে আমি ইঞ্জিনিয়ারিতে গেলাম, ও গেলো ইউনিভার্সিটি।’
আনোয়ার আলি ইউনিভার্সিটিতে পড়েনি। ঐ কলেজেই ১ বার ফেল করে অন্য কলেজ থেকে বি. কম পাস করেছিলো। তার শৈশবকালের বন্ধু এ খরবটিও জানে না দেখে আনোয়ার বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে মেয়েটিকে দ্যাখে। যে ধরনের চেহারা তাতে তার চোখেমুখে কলকল করে কথা বলবার কথা। কিন্তু সে খুব নিবিষ্ট-চিত্তে সংস্কৃতিসেবীদের অনুসরণ করছে। সুতরাং তার কণ্ঠে রুগ্ন সৌজন্য ও উচ্চারণে ঝাপসা কাম, ওর ছেলেবেলার বন্ধু আপনি? কতোকাল থেকে আলাপ আপনাদের অথচ একদিনো তো আসেননি আমাদের বাসায়। কি আশ্চর্য!
আনোয়ার সমস্ত মন দিয়ে স্থায়ীভাবে তার স্মৃতিতে এঁকে নিতে চেষ্টা করছে মেয়েটাকে। সমস্ত শরীর দেখছে গোগ্রাসে, দেখে নিচ্ছে তার জামা, তার জামদানি শাড়ির কারুকাজ, কপালের লাল টিপ, হাতের রোগা চুড়ি, ফর্সা আঙুল, নখের রঙ।
‘তুই তো অনেক আগেই বিয়ে করেছিস, না? ছেলেমেয়ে কটা হলো? আয় না একদিন।’ আনোয়ার আলি পারভেজের ঠিকানা নেয়, তার কথার যথাথ জবাব দেয় আর সুগঠিত একটি বাক্য বোনে পারভেজের বৌয়ের উদ্দেশ্যে, ‘কতোকালের বন্ধুত্ব, কিন্তু দ্যাখাও তো হয় না কতোকাল। যাবো, একদিন অবশ্যই যাবো, আপনাদের বিরক্ত করে আসবো।’ কিন্তু বলবো বলবো করতে করতে পারভেজের বৌ বলে, ‘মিসেসকে নিয়ে চলে আসুন না একদিন, যে কোন রোববার সকালে আসবেন। প্লীজ আসবেন। না এলে ভারি রাগ করবো কিন্তু।
পকেট থেকে গাড়ির চাবি বের করে হাতের তালুতে খেলা করতে করতে পারভেজ চলে গেলো বৌকে পাশে নিয়ে। এতো সাজানো বাক্যটি আনোয়ার আলির বলাই হলো না। এরকম সুযোগ কি আর পাওয়া যাবে?
মৃদু সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছিলো মেয়েটার শরীর থেকে। খুব মৃদু গন্ধ, খুব স্নিগ্ধ। এইতো কিছুক্ষণ আগে এতো কাছে দাঁড়িয়ে কথা হলো, অথচ মনে হয় কতোকাল আগেকার কথা। আবার দ্যাখো, এর চেয়েও কতো কাছে হাতের একেবারে ভেতরে সালেহার স্তন, এতো কাছে, তবু তাকে স্পর্শ করা যায় না কেন? দুটো ফাপা বেলুনের মত স্তনজোড়া ধরে আছে যে হাতে সেই হাতে কি রাবারের পুরু গ্লাভস?
‘প্লীজ আসবেন, না এলে খুব রাগ করবো কিন্তু’ সংলাপ মনে থাকে, নাকে এসে লাগে সুবাস, কিন্তু তবুও উৎসব, উৎসবের মহিলারা কতো দূরে রয়ে যায়। এদিকে সালেহার মুখ থেকে, বুক থেকে, হাত থেকে রক্তের নোনা ধোঁয়া বেরিয়ে ঘর মেঘলা করে দিলো। তার স্তনজোড়া ফুটছে টগবগ করে। কিন্তু আনোয়ার আলির শক-প্রুভ গ্লাভস খুলবে কে?
রেস্টুরেন্টের মাইকে এখন ‘আওয়ারা হুঁ’। সিনেমা হল থেকে ফিরে যাচ্ছে সুখী জনগণ, তারা সবাই এ ছবির নায়ক, তাদের কারো কারো কণ্ঠে এই ছবির হিট গান। মাত্র ১ বার খুব জোরে সিটি দেওয়ার আওয়াজ শোনা গেলো, বোঝা যায় মেয়েদের সংখ্যা কম। সাময়িক নীরবতার পর সমবেত কণ্ঠের ধ্বনি ক্রমেই বাড়তে থাকে। জুয়ার আড্ডায় কি কোনো গোলমাল হলো? কিন্তু এই ধ্বনির টোন থেকে বোঝা যায়, উল্লসিত জনগণ কোনো সুখের ঘটনা উদ্যাপন করছে।
কিন্তু আওয়াজ তো ওখানেও ছিলো। কতো লোক এসেছিলো বিয়ের অনুষ্ঠানে, কতো মেয়ে। কি শান্ত, কি সিগ্ধ সেই ধ্বনি, আস্তে আস্তে চলছিলো টেপরেকর্ডার। বেশির ভাগই ওয়েস্টার্ন মিউজিক, মাঝে মাঝে রবীন্দ্রসঙ্গীত। ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো, আমার ঘরে’ এই গান শুনতে শুনতে একজন মহিলা বললো, ‘বৌভাতের ফাংশনে খুব এ্যাপ্রোপ্রিয়েট, না?’ সেই মহিলা কে?
এখানে সমবেত ধ্বনির সঙ্গে আওয়ারা হুঁ’ অস্পষ্ট হয়ে আসছে। একবার রেকর্ড পাল্টানো হলো। এবার গানের কোনো কথাই আর বোঝা যাচ্ছে না। জনতা কি নিয়ে এতো উল্লাস করে?
আনোয়ার আলি তার শরীরের ভঙ্গি একটুও না পাল্টে কান পেতে বুঝতে চেষ্টা করে শব্দটা কিসের। সালেহার উত্তপ্ত মুখ থেকে বলকানো শব্দ বেরিয়ে আসে, কি হলো বাবা এতো রাতে? ইস্! মড়ারা কি নিয়ে হৈ চৈ করে?’
‘দমাদম মস্ত কালান্দার-কার ভরা-স্বরে তীব্র আওয়াজ হলে জনতা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। বাইরের প্রবল শব্দে আনোয়ার আলির শিথিল হাত কাঠের টুকরার মতো পড়ে যায় তার নিজের ঠাণ্ডা বুকের কাছে। সে উঠে বসলো, ‘দেখি তো এতো রাত্রে শালাদের কিসের এত সুখ দেখে আসি।’
দরজা খুললেই সরু বারান্দা, ৩ ধাপ সিঁড়ি, তারপরই রাস্তা। এই গলির মুখে ক্ষুদ্র ১টি জনতার ভীড়। এই ভীরে নানা বয়সের লোক, ছোটো ছোটো ছেলেও আছে কয়েকজন। এরা কোনো বাড়ির না, বস্তিরও নয়। বাজারে ঝাঁকা বয়ে, সিনেমায় টিকেট ব্ল্যাক করে ও লোহার পুলে রিকশা ঠেলে ওরা দিনাতিপাত করে এবং এর ওর বারান্দায় ও ফুটপাথে ঘুমিয়ে ও না ঘুমিয়ে এরা রাত্রিযাপন করে। এদের ১ জনকে আনোয়ার আলি ডাকলো ‘এই ব্যাটা, কি হইছে?’ ছোকরা আনোয়ার আলির দিকে একবার তাকায়, তারপর প্রবল স্বরে চ্যাঁচায়, ‘দমাদম মাস্ত কালান্দার।
গোটা দৃশ্য এবার স্পষ্ট হলো। ওদের গলির মুখে খিজির আলির বাকেরখানির দোকানের গা ঘেঁষে, ১টা ল্যাম্পোস্টের নিচে ১টি পুরুষ কুকুর ও ১টি মহিলা কুকুর যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হয়েছে। জনতা কুকুররতি দ্যাখার উৎসবে মুখর, তারা নানাভাবে কুকুরদের উৎসাহিত করে। বড়ো রাস্তার উঁচু রোয়াকে জুয়াড়িদের আড্ডা থেকে কে ১টি গানের কলি ভাঁজছে, ১টি জনপ্রিয় গানের প্যারোডি, ‘এই কার্তিক মাসে, দুই কুকুর এসে – কিন্তু এ আডডা থেকেই আরেকটি উচ্চকণ্ঠ ধ্বনি ওঠে, ‘আরে হালায়, এক খামচা নিমক লইয়া আয় না বে। নিমক দিলেই তো ছুইটা যায় গিয়া; যা না পিচ্চি, লইয়া আয় না হালায়, কইতাছি নিমক দিয়া ফালা!’ ফলে গানের বাকি অংশ আর শোনা যায় না। কিন্তু কে যাবে লবণ আনতে? কেউই তার অবস্থান পরিবর্তন করতে চায় না। জুয়াড়িদের জায়গাটা এমন যে এখান থেকে খেলতে খেলতেও সমস্ত দৃশ্যটা স্পষ্ট দ্যাখা যায়।
চার চাকার ঠেলাগাড়িতে স্তিমিত চুলার ওপর রাখা শাহী হালিমের মস্ত ডেকচি; এই পাড়ার ১জন লোক সন্ধ্যা থেকে রাত্রি ১২টা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত হালিম বিক্রি করে রথখোলার মোড়ে। রাত্রি ১টার দিকে তার গাড়ি ঠেলে ঠেলে এই গলির ভেতর দিয়ে সে ঘরে ফেরে। গলির মুখে ভীড়, লোকটা বাধ্য হয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে উৎসবে যোগ দেয়। ছোটো মাটির মালসায় করে হালিম ঢেলে দিচ্ছে সে তলানির হালিম, ১ টুকরা মাংসও যাচ্ছে না। অল্প দামে প্রায় ঠাণ্ডা হালিম কিনে খাচ্ছে লোকজন। আহমদিয়া রেস্টুরেন্টের সামনে যে ছেলেটা রেকর্ডের গানের সঙ্গে শিষ দিয়ে পান বিড়ি সিগ্রেট বেচে, জুয়াড়িদের রোয়াক ঘেঁসে দাঁড়িয়ে সে এখন হালিম খাচ্ছে। জুয়ার আড্ডা থেকে ১ স্কুটার ড্রাইভার তাস ফেলতে ফেলতে কুকুরজোড়া দ্যাখে এবং ১ মিনিট পর পর সিগ্রেটওয়ালাকে ধমকায়, ‘আব্বে দে না হালায় চুতমারানি।’ কিন্তু সিগ্রেটওয়ালার গলায় ঝোলানো পান বিড়ি সিগ্রেটের ডালা, ১ হাতে হালিমের বাটি, আরেকটা হাতে এ্যালুমিনিয়ামের চামচ, তার ২ হাত জোড়া, কি করে সে সিগ্রেট দেয়?
‘এই যে আনোয়ার সাব’, আনোয়ার আলি ঘুরে দেখলো নসরুল্লা সর্দার তার শোবার ঘরের জানলা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। নসরুল্লা সর্দার এককালে এই মহল্লার প্রধান ছিলো; নবাব সলিমুল্লাহ সাহেব নিজে নসরুল্লার বাবাকে সর্দারীর তাজ দিয়েছিলেন ১৯০৭ সালে। এখন নসরুল্লার তেমন পাত্তা নেই। আনোয়ার আলি তার জানলার কাছে এসে দাঁড়ালে সর্দার সাহেব গজগজ করে, ‘শুওরের বাচ্চাগো কারবারটা দ্যাহেন। হালায় বেশরম বেলাহাজ মানুষ, কি কই এ্যাগো, কন? মহল্লার মইদ্যে কতো শরীফ আদমী আছে, ঘরে বিবি বাল-বাচ্চা আছে, আর দ্যাখছেন খানকির পুতেরা কি মজাক করতাছে রাইত একটার সময়? দ্যাখছেন?’
নসরুল্লা নিজেও বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। এই জায়গাটা তার জন্যে ভালো হয়েছে, আনোয়ার আলির জন্যেও। এখান থেকে গোটা দৃশ্যের সম্পূর্ণটা চোখে পড়ে।
‘আপনাগো অফিসের মইদ্যে ছাটাই ছটাই হইলো?’ বোঝা যায় নসরুল্লা আনোয়ারের সঙ্গে জমাতে চাইছে। ৩০৩ এর মইদ্যে আছে নাকি?’
‘হ্যাঁ, আমাদের চেয়ারম্যান তো আপনার প্রথমদিকেই আছে।’
‘মালপানি তো বহুত বানাইয়া রাখছে আগেই। অহন অগো ধইরা ফায়দা কি? কিন্তু আনোয়ার আলি কথা বলে সময় নষ্ট করতে চায় না। এই লোকটা সুযোগ পেলেই আত্মজীবনী বলতে শুরু করে। আত্মজীবনীর ব্যাকগ্রাউণ্ডে নবাব সলিমুল্লাহ ও নবাব হাবিবুল্লাহর সময়ের সৎ বৃটিশ রাজপুরুষদের সঙ্গে পাকিস্তানী সরকারী কর্মচারীদের তুলনামূলক আলোচনা।
১ হাতে জলের বালতি, বালতিতে ছোটো কাঁচের গ্লাস, অন্য হাতে ছোটো ১টি কয়লার উনুনে চায়ের কেতলি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ‘চা-গ্রাম’। আপন মনে বিড়বিড় করতে করতে নসরুল্লা ঘরে চলে যায়। জানলা দিয়ে কুকুরজোড়া শেষবারের মতো দেখে নিয়ে সে সশব্দে জানালা বন্ধ করে।
নসরুল্লার জানালা বন্ধ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ১টা কুকুরের গায়ে এসে পড়লো ইঁটের ছোটো ১টি টুকরা। দম্পতি লজ্জা কিংবা ভয়ে, অথবা লজ্জা এবং ভয়ে একটু একটু সরতে থাকে। কিন্তু এই অবস্থায় হঠাৎ বিছিন্ন হওয়া ওদের পক্ষে অসম্ভব। কিংবা সেরকম ইচ্ছাও বোধ হয় ওদের নেই।
হেমন্তকালের আকাশ জুড়ে গাভীর মতো চরে বেড়ায় মেঘশাবকের দল। পাতলা স্বচ্ছ কুয়াশার মাথায় জলে লালচে হলদে রঙের মস্ত চাঁদ; চাঁদ থেকে জ্যোৎস্নার সঙ্গে ফর্সা হাওয়া বয়ে এসে আনোয়ার আলির করোটির ভেতরে সুড়সুড়ি দিলে তার বড্ডো হাসি পায়। ওর ভাগ্যটা ভালো, জুয়াড়িদের আড্ডা থেকে ১টা তীক্ষ্ণ ধ্বনি শোনা গেলো, হায়রে বাইল্য বন্দু! সমস্ত জনতা ফেটে পড়লো অট্টহাসিতে। আনোয়ার আলিও প্রাণ খুলে হাসে। সম্প্রতি ১টা বাঙলা ফিল্মে এই কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। আনোয়ার আলি সেই ছবি দেখেছে, ছবি দেখতে দেখতে সালেহা বেগমের সঙ্গে সেও খুব হেসেছিলো।
রাস্তার অন্যান্য কুকুর বড়ো রাস্তার অন্য দিকে জটলা পাকায়। শুয়ে আছে কেউ শিথিল ভঙ্গিতে, কেউ দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করে হাসে। নিঃসঙ্গ ১জন কুকুর, মানুষ ও বোধহয় কুকুরদেরও দুর্বোধ্য কোনো যন্ত্রণায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ১জন আবেগপ্রবণ কুকুর উৎসব থেকে একটু দূরে, রাস্তার মোড়ে রাখা ঠেলাগাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে গোলগাল মিষ্টিমিষ্টি চাঁদের দিকে বিষণ্ন চোখ তুলে মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে খুব করুণ সুরে কাঁদে।
‘জুম্মন আলি, আব্বে জুম্মন আলি’ ১টি নতুন কণ্ঠস্বরে কুকুর ও মানুষ সবাই ফিরে তাকায়। রুটির দোকানের মালিক তোতামিয়া তার বালক কর্মচারীর খোঁজে চিৎকার করে, ‘আব্বে চুতমারানী, এহেনে খাড়াইয়া কিয়ের রং দ্যাহো? রাইত বাজে একটা, আর তুমি হালায় খানকির বাচ্চা এহেনে রঙবাজি করো? তোমার কোন বাপে গিয়া কাউলকা দোকান খুলবো?’
জুম্মন আলি একটু আবদেরে গলায় বলে, ‘কি হইছে? ব্যাকটি রুটিই তো পাকিন কইরা রাখছি।’
‘আব্বে মাদারচোদ, তামানটি রাইত বায়োস্কোপ মারলে বিয়ানে দোকান খুলবার পারবি?’ জুম্মন আলি খুব পরোয়া করে বলে মনে হয় না। শেষবারের মতো কুকুররতি দেখে তোতামিয়ার সঙ্গে চলে গেলো।
জুয়াড়িদের ভেতর থেকে কে যেনো জোরে বললো, ‘জুম্মন আলি তো কুত্তার বায়োস্কোপ দেইখা গেলো, অহন তুমি হালায় বায়োস্কোপ মারো জুম্মনরে লইয়া, হেইডা দ্যাখবো ক্যাঠায়?’
কুকুরজোড়ার ধার ঘেঁষে আরেকটি ঢিল পড়লো। এই ঢিলটা তাক করা হয়েছিলা ল্যাম্পোস্টের বাল্বে। ল্যাম্পোস্টে টং করে আওয়াজ করে ঢিল ফিরে আসে। স্যাঁতস্যাঁতে আলোর ঘোলাটে বাল্ব অখণ্ড প্রতাপে জ্বলতেই থাকে।
ঘরে ঢুকে আনোয়ার আলি দরজা বন্ধ করতে করতে খুব ভরা ও সম্পূর্ণ কণ্ঠে ডাকলো, ‘সালেহা!’
ঘুম ঘুম গলায়, আদুরে ভঙ্গিতে সালেহা বলে, এতোক্ষণ তুমি কি করছিলে, এ্যা? বাইরে কি হয়েছে, বলো না!’
‘বাইরে লোকজনের জটলা দেখে একটু মোড়ে গিয়েছিলাম। বিছানায় শুয়ে ‘আমার শেলী’ বলে আনোয়ার আলি স্ত্রীকে কাছে টেনে নিলো।
‘এতো হৈ চৈ কিসের এ্যা, বলো না?’
‘আর বলো না শেলী, দুটো কুকুরের ইয়ে দেখে লোকজন শালা!’ আনোয়ার আলির হাত থেকে রবারের পুরু গ্লাভস খুলে গেছে। চামড়ার আবরণটাও উঠে যাচ্ছে নাকি?
‘রাত একটার সময় আর কাজ নেই, যতো সব ভালগার লোকজন!’
সুখ ও উত্তেজনায় আনোয়ার আলির উত্তপ্ত কণ্ঠ থেকে, মুখ থেকে আঠালো ধ্বনি ছুঁয়ে পড়ে।