উৎপীড়িতের প্রতিহিংসা – দীনেন্দ্রকুমার রায়
১
সিপাহী-বিদ্রোহ তখন শেষ হইয়াছে। ইংরেজের প্রবল পরাক্রমে আত্মরক্ষায় অসমর্থ হইয়া বিদ্রোহীগণ শান্তভাব অবলম্বন করিয়াছে। কিন্তু ইংরেজের ক্রোধবহ্নি তখনও নির্বাপিত হয় নাই। অস্ত্রধারী সিপাহী-দেখিলেই ইংরেজ সৈনিকগণ তাহাদিগকে ধরিয়া আগুনে পোড়াইয়া মারিতেছে, কিংবা গাছে লটকাইয়া সঙ্গীনের আঘাতে উদর-বিদারণ-পূর্বক নিদারুণ প্রতিশোধ-পিপাসা প্রশমিত করিতেছে।
সিপাহী বিদ্রোহের বিভীষিকা তখনও দূর হয় নাই। এক একদিন এক-একটা নতুন হুজুগ উঠিয়া রণশ্রান্ত ইংরেজ-সৈনিকগণের হৃৎঙ্কম্প উপস্থিত করিতে লাগিল। এই সকল হুজুগ হয়তো সর্বৈব মিথ্যা। কিন্তু একদিনের হুজুগে আর কাহারও সন্দেহ রহিল না। একদিন সকালে জনরব উঠিল, —ছত্রভঙ্গ সিপাহীরা আবার জোট বাঁধিতেছে, টুপিওয়ালার গোঁফে আগুন লাগাইয়া দিবে, বেরেলী বিদ্রোহী সিপাহীদিগের প্রধান আড্ডা হইয়াছে। এই জনরব প্রচারের পর একদিন বেরেলীর ইংরেজ-দুর্গ হইতে আধ ডজন বন্দুক চুরি গেল। সকলে বুঝিল, ইহা নিরস্ত্র সিপাহীদিগেরই কাজ।
চারিদিকে হুলুস্থূল পড়িয়া গেল। ইংরেজ-সেনাপতির আদেশে বেরেলী দুর্গ হইতে দলে দলে অশ্বারোহী সৈন্য বন্দুকচোর সিপাহীদিগের সন্ধানে ছুটিল। কিন্তু চোর ধরা পড়িল না, তথাপি নিদোষ ব্যক্তিগণ চৌর্যাভিযোগে দণ্ডিত হইতে লাগিল। যিনি ফরিয়াদী, তিনিই বিচারক, সাক্ষী ইংরেজসৈন্য; অপরাধ সপ্রমাণ ও অপরাধীর প্রতি দণ্ডদান উভয়ই সমান উৎসাহের সহিত চলিতে লাগিল।
কিন্তু ইহাতে চুরির হ্রাস হইল না। বন্দুকচুরির সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ক্রমে তাহা চতুর্দিকে সংক্রামিত হইয়া পড়িল, ইংরেজের উৎকণ্ঠার সীমা রহিল না। শেষে সেনাপতিগণ মন্ত্রণা করিয়া এক মিলিটারী কমিশন বসাইলেন। তাহার সভ্যসংখ্যা দশজন। কমিশনের সভাপতির প্রতি অপরাধীগণের সরাসরি বিচার করিয়া দণ্ডদানের ক্ষমতা প্রদত্ত হইল। এই সভাপতি মহাশয়ের নাম কাপ্তেন থরন্টন্।
১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসের মধ্যভাগে একদিন অপরাহ্নে কাপ্তেন থরন্টন্ অশ্বারোহণে বায়ুসেবনার্থে সেনানিবাস হইতে বহির্গত হইবেন, এমন সময় একজন এডজুটান্ট একখানি আদেশপত্র তাঁহার স্বাক্ষরের জন্য লইয়া আসিল। মিঃ থরন্টন্ অশ্বগতি সংযত করিয়া তাঁহার সহকারী এডজুটান্টকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এ কি?’
‘আবদুল গফুর নামক একজন মুসলমান সিপাহীর কোতলের পরওয়ানা। একজন সারজেন্ট তাহাকে পাহাড়ের উপর গ্রেপ্তার করিয়াছে।’
‘আসামীর জবাব কি?’
‘কোম্পানীর সৈন্য দেখিয়া সে তাহার হাতের বন্দুক তাড়াতাড়ি পাহাড়ের এক গুহার মধ্যে ফেলিয়া দিয়াছে। আসামী বলে, সে তাহার ভাই আবদুল আব্বাসের সঙ্গে দেখা করিতে যাইতেছে, তাহার কোন কু-মতলব নাই। আবদুল আব্বাস পাঞ্জাবে সওদাগরী করে, আজ কয়েকদিন এদেশে আসিয়াছে। আসামী আবদুল গফুরের এ কথায় বিশ্বাস করা যায় না। সে সরকারের বন্দুক চুরি করিয়া বিদ্রোহীদিগের সাহায্যের জন্য যাইতেছিল। তাহার প্রাণদণ্ড হওয়া উচিত।’— এই বলিয়া এডজুটান্ট নীরব হইল।
‘ঠিক কথা। বদমায়েসকে গুলি করিয়া পশুর মত হত্যা কর।’ কাপ্তেন অশ্বপৃষ্ঠ হইতেই অকম্পিতহস্তে হত্যার আদেশ লিপিবদ্ধ করিলেন।
অবিলম্বে এই আদেশ নির্বিঘ্নে প্রতিপালিত হইল।
২
যাহাদিগের চক্ষুর উপর এই হত্যা ব্যাপার সংসাধিত হইল, তাহাদের মধ্যে আবদুল গফুরের ভ্রাতা আবদুল আব্বাস একজন দর্শক ছিল। নীরবে সে তাহার ভ্রাতার শোচনীয় হত্যা সন্দর্শন করিল। তাহার শোকসন্তাপবিদ্ধ হৃদয়ের সমস্ত প্রবৃত্তি উজ্জ্বল হইয়া তাহার হৃৎপিণ্ডকে সবলে বিদলিত করিতে লাগিল, তাহার অশ্রুহীন চক্ষে প্রতিহিংসার অনল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল।
আবদুল আব্বাস তাহার ভ্রাতার গৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিল, তাহার বিধবা ভ্রাতৃবধূ ধরাতলে পড়িয়া অশ্রুধারায় মৃত্তিকা সিক্ত করিতেছে, শিশুপুত্র দুইটি তাহাদের মায়ের কোলের কাছে পড়িয়া মাটিতে লুটাইতেছে। আবদুল দেখিয়া আত্মসম্বরণ করিতে পারিল না। এই অত্যাচারের প্রতিশোধ দানের জন্য ভীষণ প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিল। গৃহে একটা পিস্তল ঝুলিতেছিল—পিস্তলটি কিছু পুরাতন ও মরিচা-ধরা। সেই পিস্তলে কাপ্তেনের প্রাণবধের জন্য সে কৃতসঙ্কল্প হইল।
ঠিক এই সময়ে একজন হিন্দু সন্ন্যাসী আবদুল গফুরের কুটীরে প্রবেশ করিলেন। সন্ন্যাসী প্রাচীন কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়াই বুঝিতে পারা যায়, তাঁহার দেহে যুবজনোচিত সামর্থ্য বর্তমান। সন্ন্যাসীর নাম কি, তাহা কেহ জানিত না। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান সকলেই তাঁহাকে সমভাবে ভক্তি করিত। মুসলমানেরা তাঁহাকে ফকির সাহেব বলিয়া ডাকিত, হিন্দুরা বলিত—স্বামীজি। কোম্পানীর নফরেরা তাঁহাকে কোন বিদ্রোহপরায়ণ ক্ষত্রিয়রাজার ‘পলিটিক্যাল স্পাই’ মনে করিয়া তাঁহার প্রতি তীব্র দৃষ্টি রাখিয়াছিল। কিন্তু কোন বিষয়েই তাঁহার ভ্রূক্ষেপ ছিল না। সংসারের সুখদুঃখ ও জাতিভেদের গণ্ডীর অনেক ঊর্ধ্বে তিনি বিচরণ করিতেন।
সন্ন্যাসী একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ভূম্যবলুষ্ঠিতা বিধবা ও তাহার রুদ্যমান সন্তানদ্বয়ের দিকে চাহিলেন। তাহার পর আবদুল আব্বাসকে আহ্বান করিয়া বলিলেন, ‘আব্বাস মিঞা, প্রতিহিংসার জন্য প্রস্তুত হইতেছ?’
আবদুল আব্বাস অবিচলিতভাবে বলিল, ‘যাহারা আমার নিরপরাধ ভ্রাতাকে অবিচারে হত্যা করিয়াছে, তাহাদের স্বহস্তে বধ করিয়া ভ্রাতৃশোক নিবারণ করিব। প্রাণ যায়, তাহাও স্বীকার।’ সে অবিচলিত উৎসাহের সহিত বন্দুক ঘষিতে লাগিল।
সন্ন্যাসী বলিলেন, ‘বৎস, শান্ত হও। অত্যাচারের দণ্ডবিধানের কতা স্বয়ং ভগবান, তোমরা যাহাকে খোদা বল, তিনিই। প্রতিদিন প্রচুর রক্তস্রোত প্রবাহিত হইতেছে, তুমি আর সে স্রোতের বৃদ্ধি করিও না। পরমেশ্বর তাঁহার কাজ করিবেন, অনুতাপে পাপীর হৃদয় দগ্ধ হইবে। রক্তপাত করিয়া আর তুমি তাহার অপেক্ষা কি অধিক দণ্ড বিধান করিবে।’
আবদুল আব্বাস দৃঢ়হস্তে বন্দুক চাপিয়া ধরিয়া সন্ন্যাসীর মুখের উপর স্থির দৃষ্টি সংস্থাপন পূর্বক বলিল, ‘ফকির সাহেব, আপনি হিন্দু, তাই হিন্দুর মত পরামর্শ দিয়াছেন। কাফেরের প্রাণবধেই মুসলমানের পরম পুণ্য, তাহাই মুসলমানের পরম ধর্ম। আমি সেই ধর্ম পালন করিব, আপনি বাধা দিবেন না।’
সন্ন্যাসী বলিলেন, ‘আব্বাস মিঞা, তোমার এই ক্রোধের জন্য আমি তোমাকে অপরাধী করিতে পারি না। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান সকল ধর্মের উপর এক ধর্ম আছে তাহা পরমেশ্বরের হস্তে আত্মসমর্পণ। আমি নিশ্চয়ই বলিতে পারি, তুমি এই হিন্দু সন্ন্যাসীর অনুরোধ রক্ষা করিলে কখনো কর্তব্যচ্যুত হইবে না। আমি কাহাকেও কখনো অন্যায় অনুরোধ করি নাই।’
আব্বাস মিঞা বন্দুক হাতে করিয়া কতক্ষণ কি ভাবিল, তাহার পর বলিল, ‘আমরা সকলে আপনাকে পীরের ন্যায় মান্য করি, কখনো আপনার অবাধ্য হই নাই, আজও হইব না। প্রতিজ্ঞা করিলাম, এ হস্ত শত্রু-শোণিতপাতে বিরত হইবে। কিন্তু প্রতিশোধস্পৃহায় হৃদয় জ্বলিয়া যাইতেছে। কতদিনে এ অন্যায় অত্যাচারের প্রতিফল প্রদত্ত হইবে?’
সন্ন্যাসী একবার আকাশের দিকে চাহিলেন তখন সন্ধ্যা হইয়াছিল। সেই স্তব্ধ সান্ধ্য আকাশে নবোদিত তারকার দিকে তীক্ষ দৃষ্টি স্থাপন করিয়া তিনি ক্ষণকাল কি চিন্তা করিলেন। তাহার পর দূরবর্তী বনভূমির দিকে চাহিয়া স্বপ্নাবিষ্টের ন্যায় বলিলেন, ‘এক বৎসরের মধ্যে’।
বন্দুকটা যেখানে ঝুলান ছিল কক্ষমধ্যে প্রবেশপূর্বক আবদুল আব্বাস সেখানেই ঝুলাইয়া রাখিল। তাহার পর ধীরে ধীরে বাহিরে দেখিল, সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে সন্ন্যাসী অন্তর্হিত হইয়াছেন।
৩
রাত্রি আটটা। কাপ্তেন থরন্টন্ তাঁহার শয়নগৃহের বারান্দায় পদচারণ করিতেছেন। তাঁহার মন আজ চিন্তাপুর্ণ। আজ হঠাৎ তাঁহার মনে হইয়াছে, এই যে তিনি ক্ষমতাদর্পে অন্ধ হইয়া প্রতিনিয়ত মনুষ্যবধের আদেশ প্রদান করিতেছেন, ইহা তাঁহার পক্ষে কতদূর সঙ্গত বা বৈধ হইতেছে, তাহা কি কোনদিন ভাবিয়া দেখিয়াছেন? কতকগুলি অসহায় দুর্বল মনুষ্যকে ধরিয়া তিনি তাহাদিগের বধের আদেশ দান করিতেছেন, কিন্তু তাহাদের কতটুকু অপরাধ আছে, তাহারা সত্যই অপরাধী কি না, তাহার কি কোনদিন প্রমাণ গ্রহণ করিয়াছেন? তিনি ক্ষমতা লাভ করিয়াছেন বলিয়াই তাঁহার দায়িত্ব বিস্মৃত হইবার কিছুমাত্র অধিকার নাই। তিনি তাঁহার এই ব্যবহারে বৃটিশ রাজমহিমাই যে কলঙ্কিত করিতেছেন তাহা নহে, তাঁহার কর্তব্যজ্ঞান ও মনুষ্যত্বকে পর্যন্ত অবজ্ঞাত করিতেছেন। —এ সকল চিন্তা আজ প্রথম তাঁহার মনে উদিত হইয়াছে। তিনি মনের মধ্যে কিঞ্চিৎ অস্বচ্ছতা, কিছু কষ্ট অনুভব করিতে লাগিলেন।
একজন দেশীয় অশ্বারোহী সৈনিকযুবা সহসা তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দণ্ডায়মান হইল। সে মিলিটারী প্রথায় কাপ্তেন সাহেবকে অভিবাদন করিয়া তাঁহার হস্তে গালামোহর করা নীলবর্ণের লেফাফা-মোড়া একখানা পত্র প্রদান করিল। কাপ্তেন থরন্টন্ যদি সে সময় একবার তাহার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতেন, তাহা হইলে দেখিতে পাইতেন, তাহার মুখ মলিন ভীতি-বিস্ময়সমাকুল, তাহার সর্বাঙ্গ থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে জ্বলন্ত গোলা অগিস্রোতের ন্যায় সবেগে ছুটিয়া আসিতে দেখিলেও তাহার মনের ভাব হয়তো এরূপ হইত না, আজ সহসা তাহার এ ভাব কেন?
কিন্তু সেদিকে লক্ষ্যপাত মাত্র না করিয়া মিঃ থরন্টন্ লেফাফার গালামোহর ভাঙিয়া পত্রখানি টানিয়া বাহির করিলেন। দেখিলেন, নীলবর্ণের চিঠির কাগজ, ভিতরে ইংরেজীতে এই কয়টি কথা মাত্র লিখিত।
‘১৮৫৮ সালের ১৭ই জুলাই আবদুল গফুর নিহত হইয়াছে।
১৮৫৯ সালের ১৭ই জুলাই কাপ্তেন থরন্টন্ প্রাণত্যাগ করিতে হইবে। পাপের প্রায়শ্চিত্তের আর এক বৎসর মাত্র বিলম্ব।’
পত্রের নিচে একটা স্বাক্ষর, অতি অস্পষ্ট স্বাক্ষর। তাহা কাহার হস্তাক্ষর, কাপ্তেন সাহেব বহু চেষ্টাতেওতাহা নির্ণয় করিতে পারিলেন না।
কাপ্তেন থরন্টন্ ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া পত্রবাহী পদাতিককে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কে এই পত্র আনিয়াছে?’
‘আবদুল গফুর, একজন মুসলমান সিপাহী।’ ভগ্নস্বরে পদাতিক এই উত্তর দিল।
‘অসম্ভব! আবদুল গফুরের প্রাণদণ্ড হইয়াছে।’
‘হাঁ খোদাবন্দ, যাহাদের গুলিতে আবদুল গফুরের প্রাণ বাহির হইয়াছে, আমি তাহাদের মধ্যে একজন। তাহার প্রাণদণ্ডের পর যখন তাহার মৃতদেহ পর্বতগুহায় নিক্ষিপ্ত হয়, তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু আমি আমার চক্ষুকে অবিশ্বাস করিতে পারি না। আবদুল গফুর এই কেল্লার ভিতর আসিয়া স্বহস্তে আমাকে এই পত্র দিয়া গিয়াছে।’
কাপ্তেন থরন্টন্ কুসংস্কারান্ধ লোক ছিলেন না। সুতরাং তিনি স্থির করিলেন, পদাতিকের নিশ্চয়ই কোনরকম চক্ষের দোষ ঘটিয়াছে। তথাপি একটা অজ্ঞাত ভয়ে ক্ষণকালের জন্য তাঁহার হৃদয় বিকম্পিত হইল। সংক্ষিপ্ত ও সর্বপ্রকার বাহুল্যবর্জিত ভাষায় লিখিত পত্রখানি প্রেতলোকের এক অপরিজ্ঞাত রহস্যময় ইঙ্গিতের ন্যায় তাঁহার বোধ হইল। কিন্তু তিনি ইংরেজ গবরমেন্টের একজন সাহসী কাপ্তেন, স্বহস্তে অনেক সিপাহী বধ করিয়াছেন। এক সপ্তাহের মধ্যেই এই অপ্রীতিকর পত্রের কথা তিনি সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হইলেন।
৪
কাপ্তেন থরন্টনের স্ত্রী বিবি থরন্টন্ তখন আগ্রায় ছিলেন। ১৬ই আগস্ট রাত্রে কাপ্তেন সাহেব বেরেলী হইতে স্ত্রীকে দেখিবার জন্য আগ্রায় আসিলেন। স্ত্রীর নিকট হইতে এক জরুরী পত্ৰ পাইয়া হঠাৎ তাঁহাকে আগ্রায় চলিয়া আসিতে হয়। ১৭ আগস্ট প্রভাতে কাপ্তেন সাহেব দুগ্ধফেননিভ শয্যায় সুখসুপ্তিমগ্ন ছিলেন। পূর্বদিনের পথশ্রমে তাঁহার শয্যাত্যাগে কিছু বিলম্ব হইল। বেলা প্রায় আটটার সময় তিনি শয্যাত্যাগ করিয়া মশারির বাহিরে আসিতেই, বিবি থরন্টন্ তাঁহার হস্তে একখানি পত্র দিলেন। পত্রখানি সেই পূর্বের পত্রের মত নীল লেফাফায় আঁটা। পত্রখানি দেখিয়াই সহসা কাপ্তেনের মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করিল। কম্পিত হস্তে মেমসাহেবের নিকট হইতে পত্র লইয়া রুদ্ধ নিশ্বাসে তিনি তাহা খুলিয়া ফেলিলেন। দেখিলেন, পত্রের ভাষা ও নামস্বাক্ষর অবিকল পূর্বের ন্যায়। প্রভেদের মধ্যে এই পত্রে লেখা আছে, ‘পাপের প্রায়শ্চিত্তের আর এগার মাস মাত্র বিলম্ব।’
কাপ্তেন কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া তাঁহার পত্নীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি এ পত্র কোথায় পাইলে?’
‘সাতটার সময় বাংলোর বারান্দায় বেড়াইতেছিলাম। একটা দীর্ঘদেহ মুসলমান সিপাহী পত্ৰখানা আমার হাতে দিয়া কোনো কথা না বলিয়া চলিয়া গেল।’
কে এই সিপাহী? সাহেব শয়নের বস্ত্র পরিবর্তন না করিয়াই কক্ষমধ্যে অধীরভাবে পদচারণ করিতে লাগিলেন। বিবি থরন্টন্ সহসা স্বামীর এই প্রকার বিচলিত ভাব লক্ষ্য করিয়া স্তম্ভিত হইলেন, উদ্বেগের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কাহার পত্র, কি সংবাদ?’
‘কিছু নয়’,—বলিয়া কাপ্তেন পত্রখানি শতখণ্ডে ছিন্ন করিয়া বাতায়নপথে কক্ষের বাহিরে নিক্ষেপ করিলেন। এক খণ্ড উড়িয়া তাঁহার মুখের উপর আসিয়া পড়িল। সাহেব সেই কাগজ-টুকরা হাতে করিয়া পুনর্বার বাহিরে ফেলিতে যাইবেন, হঠাৎ তাহার উপর দৃষ্টি পড়িল। লেখা আছে— ‘এগারো মাস।’
কাপ্তেন সাহেবের হৃদয় চিন্তাভারে প্রপীড়িত হইতে লাগিল। আজ তাঁহার মনে হইল নিশ্চয়ই কোন অতিপ্রাকৃত ঘটনার সহিত এই পত্রের সংস্রব আছে। তিনি বেরেলী হইতে পূর্বরাত্রে হঠাৎ আগ্রায় আসিয়া পৌঁছিয়াছেন। তাঁহার বেরেলী ত্যাগের কথা তাঁহার দুই একটি বিশ্বস্ত বন্ধু ও ঊর্ধতন কর্মচারী ভিন্ন অন্যের বিদিত ছিল না। তথাপি কে কিরূপে তাঁহার আগ্রা আগমনের সংবাদ পাইয়া এই পত্র পাঠাইল? ইহা কি কেবল মিথ্যা ভয়প্রদর্শন মাত্র? কোনক্রমে তাঁহার দুশ্চিন্তা দূর হইল না। এক চিন্তার পর আর এক চিন্তা আসিয়া তাঁহার হৃদয় অধিকার করিতে লাগিল। তাঁহার ক্ষুধা নিদ্রা দূর হইয়া গেল। হুইস্কির সাহায্যে তিনি এই চিন্তা, এই অজ্ঞাত ভয় নিবারণের চেষ্টা করিলেন। কিন্তু সকল চেষ্টা বৃথা হইল, ঘোর অস্বচ্ছন্দ চিত্তে তাঁহার দিন কাটিতে লাগিল।
এই ঘটনার পর কোন রাজকার্যোপলক্ষে তাঁহাকে দিল্লী যাইতে হইল। ১৭ই সেপ্টেম্বর রাত্রি নয় ঘটিকার সময় দিল্লীর ইংরেজ-সেনাপতির গৃহে এক প্রকাণ্ড ‘ডিনারের’ আয়োজন হইয়াছে। কাপ্তেন কর্নেল লেফটেনান্ট মেজর প্রভৃতি উত্তর পশ্চিম প্রদেশের ছোটবড় সকল ‘মিলিটারী জিনিয়াস’ টেবিল পরিবেষ্টন করিয়া বসিয়াছেন। মিলিটারী কুললক্ষ্মীগণ দেশের টেলরশপ অন্ধকার করিয়া সুপক্ষ্ম প্রজাপতিবৃন্দের ন্যায় যোদ্ধৃবর্গের পার্শ্বে উপবেশন পূর্বক—“None but the brave deserves the fair”— সুকবি ড্রাইডেনের এই স্মরণীয় উক্তির সারবত্তা প্রমাণ করিতেছেন। ব্রোচ্ ব্রেসলেট নেকলেসের ঔজ্জ্বল্যে প্রদীপ্ত, আলোকে পুলকে উদ্ভাসিত, সুন্দরীগণের রূপজ্যোতি সৌরকর-প্রতিফলিত নির্ঝর-ধারার ন্যায় বিচ্ছুরিত হইতেছে। কাপ্তেন থরন্টন্ একটি সুন্দরী যুবতীর স্বাস্থ্যপানের আকাঙ্ক্ষায় গ্লাসটি তুলিয়াছেন, এমন সময় একজন আরদালি টেবিলের সন্নিকটবর্তী হইয়া তাঁহার হস্তে একখানি পত্র প্রদান করিল। পত্রখানি নীল লেফাফার ভিতর গালামোহর করা। পত্রখানি দেখিয়াই সাহেবের হাত হইতে গেলাস পড়িয়া গেল, তাঁহার মুখ শুকাইয়া গেল, সর্বশরীর বাতাহত পত্রের ন্যায় কাঁপিতে লাগিল। সহসা তিনি ভয়ানক অসুস্থ বোধ করিতেছেন বলিয়া ডিনার টেবিল পরিত্যাগ পূর্বক অন্য কক্ষে প্রবেশ করিলেন। প্রথমে পত্ৰ খুলিতে সাহস হইল না। অনেক চেষ্টার পর পত্র খুলিয়া দেখিলেন, সেই এক কথা। নূতনের মধ্যে তাঁহার পরমায়ূর আরো একমাস হ্রাস হইয়াছে, তাহাই লেখা আছে। পরদিন কাপ্তেন সাহেব দিল্লী ত্যাগ করিলেন। তিনি যেখানেই থাকুন, পর পর কয়েক মাস ঠিক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হইতে লাগিল।
৫
কয়েকমাস পরে একদিন কাপ্তেন সাহেব দেরাদুনের সন্নিকটবর্তী কোন পার্বত্য অরণ্যে শিকার করিতে গিয়াছিলেন। দিবাবসান কালে আগ্রায় প্রত্যাবর্তন করিবার সময় তিনি অত্যন্ত শ্রান্তিবশত একটি ক্ষুদ্রকায়া গিরিতরঙ্গিনী-তীরে সংকীর্ণ পার্বত্যপথের উপর বিশ্রামার্থ উপবেশন করিলেন। দেখিতে দেখিতে কোথা হইতে একটি মনুষ্যমূর্তি নিঃশব্দ পদসঞ্চারে তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, এবং অদূরবর্তী গিরিগুহা-প্রান্তে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল। সন্ধ্যার অন্ধকার তখনও ঘনীভূত হয় নাই। কাপ্তেন সাহেব তীক্ষ দৃষ্টিতে সেই আগন্তুকের মুখের দিকে চাহিলেন, দেখিলেন—সেই নিশ্চল নির্বাক দেহ আবদুল গফুরের।
সেই সায়ংকালে নির্জন গিরিনদীতটে অপরিসর পথের উপর ছয়মাস পূর্বে নিহত ব্যক্তির মৃতদেহ সজীব দণ্ডায়মান দেখিয়া কাপ্তেন থরন্টন্ নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করিতে পারিলেন না। ভয়ে তাঁহার সর্বাঙ্গ কন্টকিত হইয়া উঠিল, তাঁহার মস্তক ঘুরিতে লাগিল। কিন্তু তিনি বীরপুরুষ, কাপুরুষের ন্যায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইলেন না। মুহূর্তমধ্যে তাঁহার কক্ষস্থিত চর্ম-নির্মিত কোষ হইতে একটি রিভলবার আকর্ষণ পূর্বক আগন্তুকের মস্তক লক্ষ্য করিয়া গুলি ছুড়িলেন। কিন্তু আগন্তুক নিশ্চল। গুলি খাইয়া অক্ষত দেহ সে হা হা করিয়া হাসিয়া যেদিকে পূর্বে অঙ্গুলি নির্দেশ করিতেছিল, সেই দিকেই দ্বিতীয় বার তাহার অকম্পিত হস্ত প্রসারিত করিল। তাহার সেই অবজ্ঞাপূর্ণ, জীবনের হর্ষোচ্ছ্বাসবর্জিত, নীরস উচ্চহাস্য সেই মৌন সায়াহ্নের শত গিরিগুহা প্রতিধ্বনিত করিয়া ধীরে ধীরে শূন্যে বিলীন হইয়া গেল। তাহার নির্নিমেষ চক্ষুর তারকাদ্বয় দীপ্তিমান অগ্নিগোলকের ন্যায় জ্বলিতে লাগিল। সেই অবজ্ঞাব্যঞ্জক, রোষানলপ্রদীপ্ত তীব্র দৃষ্টি মনুষ্যেরও নহে, পশুরও নহে। তাহা উৎপীড়িত, আহত, প্রতিহিংসা-লোলুপ পৈশাচিকতায় পরিপূর্ণ। কাপ্তেন থরন্টন্ চক্ষু অবনত করিলেন। তাহার পর চক্ষু তুলিয়া যখন তাহার দিকে পুনর্বার চাহিলেন, দেখিলেন, কোথাও কেহ নাই, অস্তমান অংশুমালীর অন্তিম কিরণরেখার ন্যায় তাহা অদৃশ্য হইয়াছে। শব্দহীন, গতিহীন ভাবে সে ছায়ামূর্তি কোথায় অন্তর্হিত হইল? ছায়া না কায়া? কিছুই তিনি স্থির করিতে পারিলেন না। সেই মূর্তি যে স্থান নির্দেশ করিয়াছিল, কাপ্তেন অবসাদশিথিল পদক্ষেপে অত্যন্ত মন্থরগমনে সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। গুহাপ্রান্তে চাহিয়া দেখিলেন, নীল লেফাফায় মোড়া একখানা পত্র, পূর্ব পত্রের ন্যায় গালাগোহর করা, সেখানে পড়িয়া আছে। লোফার উপরে তাঁহারই শিরোনামা! সাহেবের ললাটে স্থূল ঘর্মবিন্দু সঞ্চিত হইল, বক্ষের স্পন্দন দ্রুততর হইল। তিনি সেই গুহাপ্রান্তে বসিয়া পড়িলেন। তাহার পর পত্রখানি তুলিয়া মোহর ভাঙিয়া সন্ধ্যার মৃদু আলোতে তাহা পাঠ করিলেন। পত্রখানি পূর্ব পূর্ব বারের ন্যায়ই সংক্ষিপ্ত। পত্রে তাঁহাকে জ্ঞাত করা হইয়াছে, তাঁহার আয়ুকাল আর ছয়মাস মাত্র অবশিষ্ট আছে।
৬
ইহা নিশ্চয়ই যে অনৈসর্গিক ঘটনা, কাপ্তেন সাহেবের অতঃপর সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ রহিল না। তাঁহার মানসিক অশান্তি ও উদ্বেগ শতগুণ সংবর্ধিত হইল। তাঁহার মুখ হাস্যহীন, পাংশুবর্ণ। চক্ষু জ্যোতিন, কোটরগত। দেহের লাবণ্য নাই, মনের দৃঢ়তা নাই, সংকল্পের কিছুমাত্র স্থিরতা নাই। এক একখানি পত্র কেবল যে তাঁহার পরমায়ুহ্রাসের সংবাদ বহন করিয়া যথা নিয়মে তাঁহার সম্মুখে আবির্ভুত হইতে লাগিল, তাহা নহে। প্রত্যেক পত্র তাঁহার দেহের শোণিত শোষণ করিতে লাগিল। ক্রমে তিনি অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়িলেন। কি দিবসে কি নিশীথে কি আলোকে কি অন্ধকারে, কি জাগরণে কি নিদ্রায়, বিধাতার অসংখ্য কঠোর বিধানের ন্যায়, অনির্দেশ্য হস্তলিখিত সেই সংক্ষিপ্ত পত্র সর্বক্ষণ তিনি তাঁহার হৃদয়পটে মুদ্রিত দেখিতেন।
বেরেলী ক্যান্টনমেন্টের বাহিরে একদিন কাপ্তেন থরন্টন্ অশ্বারোহণে প্রাতে ভ্রমণ করিতেছিলেন। অন্যমনস্কভাবে অশ্বচালন করিয়া অবশেষে অনেক দূরে একটি সেতুর উপর আসিয়া উপস্থিত হইলেন। একটি অনতিদীর্ঘ খালের উপর এই সেতু প্রসারিত।
সংকীর্ণ সেতু। কাপ্তেন সাহেব সেতুর অপর প্রান্তে উপস্থিত হইলেন। সম্মুখেই দেখিলেন, একটি বৃদ্ধ। বৃদ্ধের নাম—রামহিত তেওয়ারি। মিঃ থরন্টন্ রামহিতকে চিনিতেন। তাহার পুত্র পরীক্ষিৎকে বিদ্রোহী সন্দেহে সাহেব তোপের মুখে উড়াইয়া দিয়াছেন, তাঁহার আদেশে তাঁহার অধীনস্থ সিপাহীরা তাহার সর্বস্ব লুণ্ঠন করিয়াছে, অবশেষে তাহার একমাত্র অবলম্বন ক্ষুদ্র কটীরে অগ্নিসংযোগ করিয়া তাহা ভস্মস্তূপে পরিণত করিয়াছে। পৃথিবীতে রামহিত তেওয়ারির আপনার বলিতে আর কেহ নাই, কিছু নাই।
সেই শিরাবহুল জীর্ণ বাহুদ্বয় প্রসারিত করিয়া সেই জীবিত কঙ্কাল মিঃ ধরন্টনের গতিরোধ করিয়া দাঁড়াইল। পরে সাহেবের দিকে চাহিয়া গম্ভীর স্বরে বলিল, ‘কাপ্তেন সাহেব, চিনিতে পার কি? আমি তোমার অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া আছি।’
সাহেব বলিলেন, ‘আমার অপেক্ষায়? আমার কাছে বিদ্রোহীর পিতার কি দরকার থাকিতে পারে? ভিক্ষুক, পথ ছাড়িয়া দে। নতুবা বুকের উপর আমার অশ্বের ক্ষুর বিদ্ধ হইবে।’
‘আমি সে ভয়ে ভীত নহি। ভগবান নিরাশ্রয়ের আশ্রয়, উৎপীড়কের দমনকর্তা। তোমার দমনের জন্য তাঁহার ন্যায়দণ্ড উত্তোলিত রহিয়াছে। সাহেব, সাবধান’।
কাপ্তেনের দেহের সমস্ত রক্ত তাঁহার মুখে আসিয়া জমা হইল। তিনি বলিলেন, ‘নিমকহারাম, আমার অপমানে সাহসী হইতেছিস?’—সাহেব বন্দুক তুলিয়া রামহিতের মস্তক লক্ষ্য করিলেন।
বৃদ্ধ অচঞ্চল। বস্ত্রাঞ্চল হইতে একখানি পত্র উন্মোচন করিয়া দক্ষিণহস্ত সাহেবের দিকে প্রসারিত করিল। বলিল, ‘সাহেব, তুমি দীনদুনিয়ার মালিক হইয়া দাঁড়াইয়াছ। তোমার অপমান করি, আমার এমন কি সাধ্য? খাপা হইও না। তোমার নামে একখানি পত্র আছে, লও’।
সেই নীল লেফাফা, গালামোহর করা পত্র। সাহেবের হস্ত হইতে বন্দুক খসিয়া পড়িল। বৃদ্ধ রামহিত সেদিকে দৃষ্টিপাতমাত্র না করিয়া পত্রখানি কাপ্তেনের মুখের উপর নিক্ষেপ করিয়া ধীরে ধীরে সে স্থান ত্যাগ করিল। মিঃ থরন্টন্ মন্ত্রৌষধিরুদ্ধ ভুজঙ্গের ন্যায় ক্ষণকাল নিশ্চলভাবে সেখানে অবস্থান করিলেন। তাঁহার চক্ষুর উপর চরাচর ঘুরিতে লাগিল, প্রভাতের উজ্জ্বল দিবালোক নিবিয়া গেল। দেহ অবসন্ন হইয়া আসিল। কিন্তু অনেক কষ্টে আত্মসম্বরণ করিয়া অশ্ব হইতে অবতরণপূর্বক পত্রখানি খুলিয়া পড়িলেন, সেই ভীষণ দৈববাণী। স্পষ্টাকারে লিখিত আছে—তাঁহার পরমায়ু আর একমাস!
‘মেডিক্যাল লিভ’ লইয়া সাহেব পরদিন বিলাতযাত্রা করিলেন। এতদিনে তাঁহার প্রতীতি হইয়াছে, একমাস পরেই তাঁহাকে দেহ বিসর্জন করিতে হইবে। দেশত্যাগ করিয়া যদি কোনক্রমে অব্যাহতি লাভ করা যায়।
৭
মিঃ ম্যাক্ফারসন্ বোম্বের একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। তিনি কাপ্তেন থরন্টনের ভগিনীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। কাপ্তেন সাহেব জীর্ণদেহ, উদ্বেগতাড়িত হৃদয় লইয়া বোম্বে নগরে ভগিনীর গৃহে উপস্থিত হইলেন। স্নেহময়ী ভগিনী দীর্ঘকাল পরে ভ্রাতার দেহ ও মনের অবস্থা দেখিয়া অশ্রুসম্বরণ করিতে পারিলেন না। বলিলেন, এ অবস্থায় তুমি কোনক্রমেই জাহাজে উঠিতে পাইবে না, আমার এখানে থাকিয়া কিছু সুস্থ হও, পরে দেশে যাইও’।
কাপ্তেন ভগিনীর অনুরোধ ব্যর্থ করিতে পারিলেন না। বলিলেন, ‘এই রৌদ্রদগ্ধ অভিশপ্ত ভারত-বক্ষে আমার সমাধি রচনা না করিয়া তুমি ছাড়িবে না। আর একমাসের মধ্যেই আমার জীবনের অবসান হইবে।’
‘এ বিশ্বাস তোমার কেন হইল? তোমার মস্তিষ্ক খারাপ হইয়াছে দেখিতেছি। তুমি সংসারের সকল চিন্তা ছাড়িয়া দাও।’
‘চিন্তা আমি ছাড়িয়াছি, কিন্তু সে রাক্ষসী আমাকে ত্যাগ করিবে না। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে সে আমার বক্ষে বসিয়া আমার হৃদয়শোণিত শোষণ করিতেছে—আমি আর সহ্য করিতে পারি না।’ —কাপ্তেনের মস্তক সোফার উপর লুণ্ঠিত হইতে লাগিল।
মিঃ থরন্টনের স্ত্রীও তাঁহার সঙ্গে ছিলেন। বিবি ম্যাক্ফারসন্ তাঁহার নিকট প্রকৃত ঘটনা কি, তাহা জানিবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু বিবি থরন্টন্ কিছুই জানিতেন না।
ভ্রাতার সুখশান্তি বিধানের জন্য বিবি ম্যাকফারসন প্রাণপণ যত্ন করিতে লাগিলেন। আমোদ ও আনন্দের মধ্যে সর্বদা তাঁহাকে ডুবাইয়া রাখিবার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করিলেন। কিন্তু আমোদের প্রবৃত্তি কাপ্তেনের হৃদয়পিঞ্জর পরিত্যাগপূর্বক অন্তর্হিত হইয়াছিল। সহস্র চেষ্টাতেও পিঞ্জরের বিহঙ্গম পিঞ্জরে ফিরিয়া আসিল না।
ভগিনীর আগ্রহে কাপ্তেন থরন্টন্ কোন খ্যাতনামা বিলাতী থিয়েটারে একদিন সায়ংকালে অভিনয় দেখিতে গমন করিলেন। সেদিন মহাকবি শেক্সপীয়রের হ্যামলেট নাটকের অভিনয় ছিল।
অভিনয় দেখিতে দেখিতে ‘বক্সের’ উপর হইতে কাপ্তেন সাহেব আর্তনাদ করিয়া উঠিলেন। আত্মীয়বন্ধুগণ নিকটেই ছিলেন। তাঁহারা যুগপৎ উঠিয়া ব্যস্তভাবে তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইলেন। দেখিলেন, কাপ্তেন মূৰ্ছিত। বহু চেষ্টায় তাঁহার মূছ ভঙ্গ হইল। সাহেব বলিলেন, “তোমরা হ্যামলেটের পিতার প্রেতাত্মা দেখিয়াছ? আমি দেখিয়াছি সে প্রেতাত্মা হামলেটের পিতা নহে, আবদুল গফুরের প্রেতাত্মা।’
বিবি ম্যাক্ফারসন্ ভ্রাতার মস্তকে পাখা করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সে কি? আবদুল গফুর কে?’
‘একজন সিপাহী। বিনা বিচারে তাহার প্রাণদণ্ড করিয়াছি।’
কাপ্তেন সাহেবকে তৎক্ষণাৎ গৃহে লইয়া যাওয়া হইল। ডাক্তার আসিয়া বিবিধ যন্ত্র সংযোগে তাঁহার দেহ পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, ‘কাপ্তেনের ‘ব্রেন ফিবার’ হইয়াছে। অনেক দিনের রোগ—অবস্থা জটিল হইয়া উঠিয়াছে।’
তিন দিন সাহেব শয্যাগত রহিলেন।
চতুর্থ দিন সাহেবের অবস্থা অল্প ভাল বোধ হইল। অপরাহ্ণে একখানি ইজিচেয়ারে তিনি বারান্দায় আসিয়া বসিলেন। বাংলোর সম্মুখে প্রকাণ্ড প্রান্তর। সমুদ্রের দিক হইতে মুক্ত বায়ুপ্রবাহ আসিয়া ললাটের ঘর্মবিন্দু ধীরে ধীরে অপসারিত করিতেছিল।
নীল-পরিচ্ছদধারী, নীল-উষ্ণীষশোভিত, নীল-পতাকাধারী একজন মুসলমান সৈনিকপুরুষ সেই বারান্দায় আসিয়া একেবারে সাহেবের সম্মুখে দাঁড়াইল। কাপ্তেন তাহাকে দেখিয়াই চমকিয়া উঠিলেন। সৈনিকপুরুষ একখানি নীলবর্ণের পত্র বাহির করিয়া সাহেবের স্থির নিষ্প্রভ চক্ষুর উপর ধরিল। আজ পত্র লেফাফায় আবদ্ধ নহে। খোলা পত্র—অক্ষরগুলি লোহিত কালিতে অঙ্কিত। সাহেব নির্নিমেষ দৃষ্টিতে স্পষ্টাক্ষরে পাঠ করিলেন—
‘আজ ১৮৫৯ সালের ১৭ জুলাই।
সূর্যাস্তের সঙ্গে তোমার পরমায়ু শেষ হইল।’
সাহেব চিৎকার করিয়া মূৰ্ছিত হইয়া পড়িলেন। তাঁহার সে মূর্ছা আর ভঙ্গ হইল না। বিবি ম্যাক্ফারসন্ নিকটেই ছিলেন। তিনি ছুটিয়া আসিয়া তীব্রস্বরে সেই মুসলমান সিপাহীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কে তুই?’
‘উৎপীড়িতের প্রতিহিংসক।’
সন্ধ্যার অন্ধকারে সেই ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে মিলাইয়া গেল।