উৎপাতের ধন চিৎপাতে
এক
জগন্নাথ গোস্বামীর গাড়িটা বড়মামা শেষে কিনেই ফেললেন।
বড়মামার যাঁরা ভালো চান, তাঁরা সকলেই বারণ করেছিলেন, ‘সুধাংশু কাজটা ভালো করলে না। জগন্নাধ ঘোড়েল লোক। বোকা পেয়ে তোমার মাথায় টুপি পরাতে চাইছে। গাড়িটা পেট্রলে চলে না। ইঞ্জিনের অশ্বশক্তিতে নড়তে দেখিনি। মনুষ্যশক্তিতেই এতকাল চলে এসেছে। কিনতে হয় নতুন গাড়ি কেনো। তোমার কি বাপ অত ঠেলাঠেলির লোক আছে! ধড়ধড়ে জিনিস। খোলটাই আছে। ভেতরে আত্মা নেই।’
জীবনে যে মানুষ কারুর কথাই শোনেননি, শুধু নিজের কথাই শোনাতে চেয়েছেন তিনি বুক ঠুকে গাড়িটা কিনেই ফেললেন।
গাড়ি সোজা চলে গেল কারখানায়। ছিল কালো, ফিরে এল গাঢ় বাদামী হয়ে। ফোম লেদারের ঝকঝকে গদি। বাম্পারে মরচে ধরেছিল, নিকেল পড়ে ঝকঝকে হয়েছে। হাতল-টাতল সব ঝিলিক মারছে। কার-রেডিও-স্টিরিও। আয়োজনে কোনও খুঁত নেই। পেছনের কাচে আধুনিক স্টিকার! ঘোড়া ছুটছে। বড়মামার ইচ্ছে গাড়ি চলবে কীর্তনের সুর ছড়াতে ছড়াতে।
‘তুই একবার ভেবে দ্যাখ পিন্টু, কারুর পাশ দিয়ে হুস করে গাড়ি বেরিয়ে গেল, কানে ঠোক্কর মারলো ইঞ্জিনের শব্দ নয়, প্রেমদাতা নিতাই। পৃথিবীতে প্রেমের বড় অভাব রে!’
মেজোমামা বললেন, ‘তোমার এই কীর্তনাঙ্গ গাড়ি চলবে না দাদা। আসল যে ইঞ্জিন সেইটাই তো নেই।’
‘কি করে বুঝলি মেজো? তুই তো সারাজীবন ফিলজফি পড়িয়ে এলি। ঈশ্বর আছেন না নেই। আজ পর্যন্ত সে সমস্যার সমাধানও হল না। ইঞ্জিনের তুই কি বুঝিস!’
‘সবাই বলছে!’
‘আজও তুই প্রতিবেশীদের চিনলি না। প্রতিবেশী মানে প্রতিবাঁশি। বেসুরে বাজাই হল তাদের কাজ। বাগড়া ছাড়া তার আর কি দিতে জানে? এই গাড়ি চেপে তুই কলেজে যাবি। কুসি স্কুলে যাবে। আমার কুকুর ডগ-হসপিটালে যাবে। ছুটির দিনে আমরা সবাই মিলে পিকনিকে যাবো। জীবনটা একেবারে অন্যরকম হয়ে যাবে। সায়েবদের মতো। লোকের কথায় নেচো না ব্রাদার। কানপাতলা লোক জীবনে সুখী হতে পারে না।’
মেজোমামা বললেন, ‘ভালো হলেই ভলো, তবে দশ হাজার টাকায় গাড়ি হয় না দাদা। ছ্যাকড়া গাড়ি হতে পারে।’
‘আচ্ছা দেখাই যাক না কি হয়। নো রিস্ক, নো গেন। ইংরেজিটা ভোলোনি নিশ্চয়?’
বড়মামা একটা ফ্ল্যানেলের টুকরো দিয়ে গাড়ির পালিশকে আরও পালিশ করতে লাগলেন। পেয়ারের কুকুর লাকি পাশে দাঁড়িয়ে ন্যাজ নাড়ছে। আমার দায়িত্ব লাকির ওপর নজর রাখা। লাকির স্বভাব হল, আদরের জিনিসে সামনের দুটো পা তুলে দিয়ে পেছনের পায়ে খাড়া হয়ে জিভ বের করে হ্যাহ্যা করা। মানুষের গায়ে আঁচড় লাগলে হরেক রকম ওষুধ আছে। গাড়ির পালিশে আঁচড় লাগলে একমাত্র ওষুধ আবার পালিশ চড়ানো।
নিকেলের হাতল ঘষতে ঘষতে বড়মামা লাকিকে অনবরত সাবধান করে চলেছেন ‘লাকি খুব সাবধান, পা তুলবে না।’
আমার একটাই প্রশ্ন, আজ পর্যন্ত যার সঠিক উত্তর কারোর কাছেই পেলুম না, কুকুরের চারটেই পা, না সামনের দুটো হাত, পেছনের দুটো পা?
প্রশ্নটা বড়মামাকে আবার একবার করতুম, সুযোগ পেলুম না। বাঘাদা এসে গেলেন। বড়মামাকে গাড়ি চালানো শেখাবেন। সাংঘাতিক চেহারা। রয়াল বেঙ্গলের মতো গোঁফজোড়া। প্রায় ফুট-ছয়েক লম্বা। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতি। বাঘের মতো গলা। টাইট প্যাণ্ট-জামা পরা। আমাকে একটা টুসকি মারলে উলটে পড়ে যাব। লাকি যথারীতি হাত তিনেক পেছিয়ে গিয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করল। বাঘাদা বললেন, ‘আপনার কুকুরটা আমাকে দেখলেই অমন করে কেন বলুন তো?’
বড়মামা বললেন, ‘ওর তো দৈত্য দেখার তেমন অভ্যাস নেই। দু-একদিন দেখতে দেখতেই অভ্যাস হয়ে যাবে।’
বাঘাদা বাঘের মতো গলায় হেসে উঠলেন। লাকি আরও এক পা পেছিয়ে গিয়ে আরও জোরে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল।
মাসিমা দোতলার বারান্দায় বেরিয়ে এসে বললেন, ‘তোমরা সাত-সকালেই কি আরম্ভ করলে? লোকে সকালে প্রভাতী গান শোনে, কীর্তন শোনে, এ বাড়ির যেন সবই অদ্ভুত। রাতে ছুঁচোর কীতন, সকালে কুকুরের কনসার্ট।’
বাঘাদা ওপর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাকে ঠিক সহ্য করতে পারছে না দিদি!’
‘তোমাকে নয়,’ তোমার ওই কাঠবেড়ালীর ল্যাজের মতো গোঁফ ও সহ্য করতে পারছে না। কাল আসার আগে কামিয়ে এসো।’
মাসিমা ভেতরে চলে গেলেন। বাঘাদা করুণ গলায় বললেন, ‘আচ্ছা সুধাংশুদা, আমার ভেতরে কি একটা চোর আছে? শুনেছি কুকুর মানুষ চিনতে পারে!’
‘তুমি কি আচার চুরি করে খাও?’
‘ছেলেবেলায় খেতুম।’
‘অ্যায়, ঠিক ধরে ফেলেছে। কুকুরের নাক বড় সাংঘাতিক। আমি যেদিন সিরাপ চুরি করে খাই, আমাকে খুব ধমকায়।’
‘সিরাপ চুরি?’
‘ওই যে গো, ডাক্তারখানায় সিরাপ থাকে না! মিকশ্চার তৈরি হয়। ওই জিনিসটার ওপর আমার অনেকদিনের লোভ। যেই দেখি কম্পাউন্ডার চা কি সিগারেট খেতে গেছে অমনি বোতল খুলে খানিকটা মুখে ঢেলে দি।’
‘সিরাপ তো আপনার নিজেরই জিনিস, নিজে খেলে চুরি হয় না কি?’
‘ধুস, সিরাপ তো রুগিদের। মাঝে মাঝে কম্পাউন্ডার ধরে ফেলে, কি হল, এই দেখে গেলুম আধ বোতল সিরাপ এরই মধ্যে সিকি বোতল হয়ে গেল! আমি ভয়ে চুপ করে থাকি। ফ্যাঁস ফোঁস করে খুব মন দিয়ে রুগির ব্লাড-প্রেশার দেখতে থাকি। চুরি করে খাওয়ার যে কি আনন্দ কুকুর বুঝবে কি করে!’
বাঘাদা বললেন, ‘চলুন এইবার বেরিয়ে পড়া যাক। এরপর রাস্তাঘাট আর ফাঁকা পাওয়া যাবে না।’
বাঘাদা স্টিয়ারিং-এ, বড়মামা পাশে। আমি পিছন। লাকিও আসার জন্যে বায়না ধরেছিল। বেশ মোটা একটা মাংসের হাড়ের লোভ দেখিয়ে হরিয়ার কোলে তুলে দিয়ে আসা হয়েছে।
গাড়ি বি-টি রোডে বেরিয়ে এল। সবে রোদ উঠেছে। চারপাশ ঝকঝক করছে। দু-চারটে লরি হুসহাস করে আসছে যাচ্ছে। গাড়িটাকে রাস্তার বাঁ-পাশে দাঁড় করিয়ে বাঘাদার সঙ্গে বড়মামার জায়গা বদল হল। বাঘাদা এক রাউন্ড বক্তৃতা দিয়ে নিলেন ক্লাচ কাকে বলে, ব্রেক কোন পায়ে, গিয়ার কাকে বলে।
বড়মামা বললেন, ‘হাত-পা কেন কাঁপছে বলো তো?’
‘ভয়ে। ও ভয় এখুনি কেটে যাবে। ভয়ের কি আছে! একটা জিনিস শিখিয়ে দি, অসুবিধে দেখলেই থেমে পড়বেন। থামার আগে জানালা দিয়ে ডান হাতটা বের করে দেবেন।’
‘তার মানে?’
‘মানে বুঝবে পেছনের গাড়ি। মানে তোমরা পাশ দিয়ে এগিয়ে পড় আমি একটু বিপদে পড়েছি। আপনাকে রোডসাইনের যে বইটা দিয়েছি সেটা ভালো করে দেখেছেন? নো রাইট টার্ন, নো লেফট টার্ন, ক্রসিং অ্যা-হেড।’
‘ও আমি সব দেখে নেবো। এখন তো আর লাগছে না। এখন তো সোজা যাবো, সোজা ফিরে আসব।’
‘না না, ওটা আপনি সবার আগে ভালো করে বুঝতে শিখুন। সোজা রাস্তায় সব সময় চলা যায় না। জীবন অত সোজা নয়। পদে পদে বাঁক, ক্রসিং, বাম্প।’
বড়মামা ক্লাচ ছাড়লেন, গাড়ি সাংঘাতিক রকমের একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উল্কার বেগে সামনে এগিয়ে আবার একটা ঝাঁকানি মেরে থেমে পড়ল। স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। ঝড়ের বেগে একটা লরি দু-ইঞ্চি তফাত দিয়ে চলে গেল। আমি ভয়ে চোখ বুজিয়ে ফেলেছিলুম।
বাঘাদা জিগ্যেস করলেন, ‘এটা কি করলেন?’
‘কি জানি কি করলুম, কোন পা কোথায় চলে গেল!’
‘কোন পা কোথায় চলে গেল মানে? একটা পা ক্লাচে, একটা পা ব্রেকে, স্টিয়ারিং-এ গিয়ার। এই তো আপনার মোট তিনটে যন্ত্র। এটা ছাড়াবেন, প্রয়োজন হলে ওটা চাপবেন।’
‘আমি ভুলে লেফট-রাইট করে ফেলেছিলুম। অনেক দিনের অভ্যাস তো।’
‘এখুনি তো আমরা তিনজনেই মারা পড়তুম।’
‘তুমি তো আমার পাশে আছ।’
‘পাশে আছি, কিন্তু পায়ে তো নেই।’
‘নাও, নাও অনেক বকেছ। আর ভুল হবে না।’
গাড়ি স্টার্ট নিয়ে আবার চলতে শুরু করল। একটু লগবগ করলেও বেশ চলছে। সোজা রাস্তা চলে গেছে ব্যারাকপুরের দিকে। টিটাগড়ের কাছে এসে গাড়ি হঠাৎ গোঁত করে রাস্তার বাঁ পাশ থেকে ছুটে সোজা নেমে গেল পাশে। স্টিয়ারিং নিয়ে শিক্ষক আর ছাত্রের যুদ্ধ চলছে। ধামা, কুলো, ধুচুনি সাজানো ছিল, মড়মড় করে মাড়িয়ে দর্মার বেড়া ঠেলে গাড়ি সোজা ঢুকে পড়ল আটচালায়। চারদিকে গেলো গেলো শব্দ।
একটা উনুনের দু-হাত দূরে গাড়ি থেমে পড়ল। মনে হচ্ছে দরমার বাড়ি। যমদূতের মতো গোটা চারেক লোক চারপাশে দাঁড়িয়ে। নামলেও মারবে, না নামলেও মারবে। এত বিপদেও বাঘাদার সেই এক প্রশ্ন, ‘এটা কি করলেন?’
মারমুখী লোক চারটির একজন বড়মামার রুগি। বড়মামা লোক বুঝে, অবস্থা বুঝে বিনা পয়সার চিকিৎসা করেন। এ সেই রকম একজন রুগি। বড়মামাকে দেখেই চিনেছে, ‘আরে ডাক্তারবাবু যে!’
বড়মামা হাসিমুখে দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। যেন প্লেন থেকে পাইলট নেমে এল। বড়মামা বললেন, ‘রামু হিসেব কর কত টাকা গেল।’
রামু বললে, ‘হিসেব পরে হবে। রামজী আপনাকে পাঠিয়েছেন। ওই দেখুন আমার বহু, বোখার হয়ে পড়ে আছে।’
হাত-পাঁচেক দূরে মাচার ওপর একজন মহিলা শুয়ে আছেন আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে। গাড়ি আর কিছু দূর এগোলেই অসুখ সেরে যেত!
রুগির মুখ দেখেই বড়মামা বললেন, ‘ম্যালেরিয়া। পিলে বেশ বড় হয়েছে রে। ডিসপেনসারিতে আয় ওষুধ দিয়ে দেবো। এক পুরিয়ার ব্যাপার।’
রুগি দেখতে দেখতে হিসেবও হয়ে গেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ শ-তিনেক টাকা।
বাঘাদা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন, ‘ছ-টা দরমা আর গোটাকতক ঝুড়ির দাম তিনশো টাকা। ভালোমানুষ পেয়ে টুপি পরাতে চাইছ? ধর্মে সইবে?’
‘ধর্মটর্ম বলবেননি বাবু, দিন-কাল কি পড়েছে?’
বড়মামা বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ তাতো বটেই। তাতো বটেই!’
‘তাতো বটেই? বাঘাদা হুঙ্কার ছাড়লেন। ‘ওই দরমা আর ঝুড়ি সব আমি নিয়ে যাবো।’
‘আঃ, বাঘা নীচ হয়ো না।’ বড়মামা শাসনের গলায় বললেন।
‘রাখুন মশাই আপনার নীচ। মূল্য যখন ধরে দিতেই হবে, মাল আমাদের।’
‘কী করবে?’
‘পুড়িয়ে দেব, জ্বালিয়ে দেব।’
বাঘাদার গোঁ বাবা। দরমা আর ভাঙা ঝুড়ি নিয়ে গাড়ি বাড়ি ফিরে এলো নটার সময়! এবার আর বড়মামা নয়, বাঘাদাই গাড়ি চালালেন। রাস্তার দুপাশ থেকে বড়মামার যাঁরা চেনা, তাঁরা চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘ভালো সওদা হয়েছে ডাক্তারবাবু। তবে একটু দেখেশুনে আস্ত মাল কিনতে পারলে আরও ভালো হত!’
মাসিমা বাগানে খরগোশদের ঘাস খাওয়াচ্ছিলেন; দেখেই হইহই করে উঠলেন, ‘একি, একি? মিউনিসিপ্যালিটির ময়লা তোলা গাড়ি না কি? এ সব কোথা থেকে তুলে নিয়ে এল?’
বাঘাদা বললেন, ‘তুলে আনিনি। কিনে এনেছি দিদি। তিনশো টাকা দাম।’
মেজোমামা আমগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একমনে জগিং করছিলেন। তিনশো মনে হয় এখনও হয়নি। মাঝপথেই থেমে পড়লেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘মাথায় আবার কি ব্রেনওয়েভ খেলে গেল, ভাঙা কঞ্চি আর বাঁখালি দিয়ে কী বানাবে, গ্রীন হাউস?’
বড়মামা এতক্ষণে কথা বললেন, ‘আরে না রে বাবা। এরা চাপা পড়েছিল। এসব হল ডেডবডি, ক্যাজুয়েলটিস।’
‘অ্যাঁ বলো কি! এক চাপাতে অনেক নামিয়েছ তো প্রায় লরির রেকর্ড।’
মাসিমা বললেন, ‘উঃ মানুষ হলে কি করতে? তোমাকে নিয়ে আর পারি না বড়দা! তোমার ভাবনা ভাবতে ভাবতে আমার রাতের ঘুম গেছে। মেজদা তুমি বললে কিচ্ছু ভাবিসনি কুসি ও গাড়ি চলবে না। গাড়ি চলছে না শুধু চাপা দিয়ে বেড়াচ্ছে।’
বাঘাদা বললেন, ‘চাপা নয়, ভাঙা দিদি। এটা একটা দরমা ছাউনির ভাঙা অংশ আমরা ভেঙে ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলুম। আপনি কলও বলতে পারেন। ওঁরা মনে মনে ডাক্তারবাবুকে ডাকছিলেন। গাড়ি একেবারে রুগীর বিছানার পাশে গিয়ে থামল। ডাক্তারবাবু নেমেই রুগির নাড়ি টিপে ধরলেন। ভালো ডাক্তার তো, শুধু ওষুধের ব্যবস্থা নয়, তিনশো টাকা দিয়ে পথ্যের ব্যবস্থাও করে দিলেন।’
‘ভিটে-মাটির যে-টুকু আছে যেটুকু এবার খেসারত দিতে দিতেই শেষ হয়ে যাক। তারপর একদিন ভালো করে পাবলিকের হাতে আড়ং-ধোলাই হোক। তবে যদি তোমার চেতনা হয়!’
মেজোমামা আবার জগিং-এর জন্যে প্রস্তুত হতে হতে বললেন, ‘তুমি চালিয়ে যাও বড়দা। এইভাবে রেকর্ড করতে করতে একদিন তুমি ট্রাক-ড্রাইভার হতে পারবে। এখন থেকে পাগড়ি বাঁধাটা অভ্যাস করে রাখো, খইনি ধরো, তোমার ব্রাইট ফিউচার।’
মেজোমামা লাফাতে শুরু করলেন এক-দুই-তিন।
বাগানের একপাশে ধামা ধুচুনি দরমা ভাঙা পড়ে রইল। গাড়ি ব্যাক করে ঢুকে গেল, গ্যারেজে। বাঘাদা হাসি হাসি মুখে মাসিমাকে বললেন, ‘দিদি অনেক বকেছেন, এবার বেশ বড় এক কাপ চা।’
দুই
দিন পনেরো হয়ে গেল, বড়মামা গাড়ি চালানো শিখছেন। মাসিমা আমাকে আর বড়মামার সঙ্গে যেত দেন না। বিপদ হলে কে দেখবে! তাছাড়া সকালে লেখাপড়া করবে না বড়দের সঙ্গে হইহই করে বেড়াবে? বাঘাদা বলছেন বড়মামার হাত পা দুটোই নাকি বেশ ধাতে এসে গেছে।
আজ রবিবার। পড়ার ছুটি। বড়মামা বললেন, ‘কুসি, বাঘা সার্টিফিকেট দিয়েছে। আজ আমি পিন্টু আর লাকিকে নিয়ে বেরোই? ছেলেটা রোজ মুখ শুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, আর লাকিটা একদিনও গাড়ি চাপেনি। কুকুর বলে কি মানুষ নয়!’
বাঘাদা বিশাল গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আজ ওরা চলুক। ঘরে থেকে থেকে সব ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছে এ যুগ হল ফাইটিং-এর যুগ। কিন্তু…।’
কিন্তুতে এসে বাঘাদা কেমন যেন কিন্তু কিন্তু হয়ে গেলেন। বড়মামা বললেন ‘থামলে কেন, শেষ করো, শেষ করো।’
‘কিন্তু লাকি যদি পেছন থেকে ঘাড়ে ঘ্যাঁক করে দেয়!’
‘আমার কুকুর সে কুকুর নয় বাঘা। ও মানুষ হলে নেতা হত, বুঝলে! ধমকায়, ভয় দেখায়, কদাচ কামায় না। চলো বেরিয়ে পড়ি। হাত পা নিসপিস করছে।’
মাসিমা হ্যাঁ না বলার আগেই আমরা বেরিয়ে পড়লুম। লাকি চনমন করছে। বেড়াতে যাবার নাম শুনলেই আনন্দে আটখানা! পেছনের ডান পাশের জানালায় লাকির জিভ বের করা মুখ। বাঁ পাশের জানালায় আমার মুখ। ফরফর করে গাড়ি চলছে! জানি না এই কদিনে বড়মামা কি কি করেছেন। তবে অনেকেই দেখলুম, গাড়ি দেখে হয় নর্দমা টপকে রকে, না হয় খুব দ্রুত পা চালিয়ে কোনও দোকানে ঢুকে পড়ছে।
বাঘাদা খালি বলছেন, ‘অত শক্ত হচ্ছেন কেন? বেশ নরম হয়ে চালান, নরম হয়ে চালান।’
আজ আবার গান চলেছে, ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে।’
শুকচর চলে গেল, চলে গেল সোদপুর। টিটাগড়ের সেই ধামা-ধুচুনি-ভাঙা জায়গাটা পার হয়ে গেল। লাকি মাঝে মাঝে নেচে উঠছে! বাতাসে ফুরফুর লোম উড়ছে। ফুটফুটে, খুশি খুশি মুখ, ঢুলুঢুলু চোখ। গান চলেছে ‘এরে পরতে গেলে লাগে, এরে ছিঁড়তে গেলে বাজে। কণ্ঠ যে রোধ করে…!’
বড়মামা অকারণে মাঝে মাঝে হর্ন বাজাচ্ছেন। বাঘাদা বলছেন, শুধু হর্ন দিচ্ছেন কেন? মিসিয়ুস অফ হর্ন।’
‘যাঃ, ওটাও তো রপ্ত করতে হবে। শিখছি যখন সব ভালো করে শিখব। ফাঁকিবাজি আমার কোষ্ঠীতে নেই। সাফল্যের চাবিকাঠি কার হাতে? নিষ্ঠার হাতে।’
কথা শেষ করেই একবার হর্ন দিলেন। বাঁ পাশ দিয়ে ভুঁসকো চেহারার গোটা কতক মোষ যাচ্ছিল; একটা ভীতু মোষ চমকে লাফিয়ে উঠতেই, লাকি বিকট সুরে ঘেউ ঘেউ করে পেছনের আসন টপকে সামনের আসনে।
তারপর পরপর সব ঘটতে লাগল। গাড়ি কোণা মেরে রাস্তা ছেড়ে গড়িয়ে একটা মাঠে নেমে গেল। বাঘাদা বলছেন, ‘ব্রেক ব্রেক।’
বড়মামা বলছে ‘ব্রেক কোনটা, ক্লাচ কোনটা?’
লাকি বলছে ‘ঘেউ ঘেউ।’
স্টিরিও বলছে, ‘কণ্ঠ যে রোধ করে সুর তো নাহি সরে।’
ওদিকে হু হু করে এগিয়ে আসছে একটা জলা। কচুরিপানা ভাসছে। আমার বেশ মজা লাগছে। মনে হচ্ছে ইংরেজি সিনেমা দেখছি।
বাঘাদা কোনওরকমে পা বাড়িয়ে, হেলে কাত হয়ে কি একটা করলেন। পুকুরপাড়ে এসে গাড়ি থেমে পড়ল। চান করা আর হোলো না।
বড়মামা হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘কি রকম হোলো?’
বাঘাদা বললেন, ‘দারুণ, তুলনাহীন! আর একটু হলে ভরাডুবি হত।’
বড়মামা, নেমে পড়লেন, ‘আঃ কি সুন্দর! সবুজ সবুজ, যেন সবুজের সাহারা। ঘাসের গন্ধ, জলের গন্ধ, মাটির গন্ধ। মাথার ওপর নীল আকাশ উপুড় হয়ে আছে। ফড়িং দেখেছো ফড়িং?’
বাঘাদা বললেন, ‘আপনি প্রাণ খুলে ফড়িং দেখুন। আমি ততক্ষণ বেল ঘর থেকে একটা ক্রেন নিয়ে আসি। টো করে গাড়িটাকে ওপরে তুলতে হবে।’
বড়মামা করুণ মুখে বললেন ‘তুমি কখন ফিরবে?’
‘তা তো বলতে পারছি না।’
বাঘাদা দূরে ক্রমশ ছোট হতে হতে একটা পুতুলের মতো হয়ে গেলেন। গাড়ির ভেতরে গান বাজছে ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ।’
বড়মামা হঠাৎ আনন্দে লাফাতে লাফাতে ললেন, ‘উঃ! কোথায় নেমে এসেছি দ্যাখ। একবার তাকিয়ে দ্যাখ। রাস্তাটা মনে হচ্ছে পাঁচতলা উঁচুতে।’
ছিপ হাতে দুজন এদিকেই আসছেন। বড়মামা বললেন, ‘সেরেছে, চেনা হলেই বিপদ।’
চেনা হবে না মানে! বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র বড়মামার রুগি ছড়িয়ে আছে।
‘আরে ডাক্তারবাবু যে!’ দুজনেই একসঙ্গে উঠলেন, ‘গাড়ি চান করাচ্ছেন?’
‘না হে না, এসেছিলুম মাছ ধরতেই, তোমাদের চিন্তায় আজকাল সব ভুলে যাই। এখন দেখছি ছিপ আনতেই ভুলে গেছি।’
‘আর তার জন্যে মাছ ধরা আটকাবে? আমরা কি করতে আছি! একস্ট্রা ছিপ আছে। চলুন বসে যাই। আপনার খুব সাহস ডাক্তারবাবু, গাড়ি নিয়ে নামলেন কি করে?’
বড়মামা বীরের মতো হাসলেন, হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে পুকুর ধারে চলে গেলেন। হয়ে গেল আজ। বড়মামার সাংঘাতিক মাছ ধরার নেশা। একবার বসে পড়লে সহজে আর উঠছেন না।
‘লাকি, আজ আমাদের উপোস।’
লাকি উত্তরে আমার গাল চেটে দিল। কখন যে বাঘাদা আসবেন ক্রেন নিয়ে, ঈশ্বরই জানেন। মাসিমার কথা শুনলে এই দুর্ভোগ আর হত না। এতক্ষণ ছাদে উঠে চাঁদিয়াল ঘুড়িটা ওড়াতুম ফড়ফড় করে। বড়মামা ওদিকে চার করে ছিপ নিয়ে বসে পড়েছেন। চচ্চড়ে রোদ উঠেছে। আকাশ একেবারে ঘন নীল! হাত নেড়ে রঙ-বেরঙের ঘুড়িকে—আয়, আয়, উঠে আয় আমার বুকে। পকেটে একটা চকোলেট আছে। মুখে ফেলতে পারছি না লাকির জন্যে। ও বেচারা কি খাবে?
মনে মনে বাঘাদাকে ডাকতে লাগলুম। বাঘাদা এসো, বাঘাদা এসো। ডাকের কোনও জোর নেই। ঘণ্টা ছয়েক পরে বাঘাদা এলেন পান চিবোতে চিবোতে। সঙ্গে ক্রেন নয়, ভীম ভবানীর মতো চারটে লোক, মোটা একটা কাছি। আমার কাছে এসে বললেন, ‘ফাসক্লাস।’
‘কী ফাসক্লাস?’
‘তরুণের দোকানের ফিসফ্রাই। এক একটা প্রায় আধ হাত চওড়া। স্যালাড আর রাই দিয়ে খেতে যা লাগল না, টেরিফিক। অনেক ঝামেলা তো, তাই গায়ে একটু জোর করে নিলুম। পেটে খেলে পিঠে সয়। সুধাংশুদা গেলেন কোথায়?’
‘ওই তো মাছ ধরতে বসে গেছেন।’
‘অ্যাঁ, একেই বলে ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বয়। যাক আমার কাজ আমি করে যাই।’
পেছনের বাম্পারে দড়ি বাঁধা শুরু হল। সে এক এলাহি ব্যাপার। লাকি তারস্বরে ঘেউ ঘেউ করছে। এক দৈত্যতেই ওর মাথা খারাপ হয়ে যায়। সামনে পাঁচ-পাঁচটা দৈত্য।
একজন দৈত্য বললে, ‘ইতনা চিল্লাতা কেঁউ।’
লাকি উত্তর দিল, ‘ঘেউ ঘেউ।’
বেলা বারোটার সময় আমরা তিনজন বাড়ি ফিরে এলুম। বড়মামা পুকুর ধারেই রয়ে গেলেন। কার ক্ষমতা ওঠায়। মাসিমার ভয় দেখালুম, তাতেও কোনও ফল হল না। হাত নেড়ে বললেন, ‘তোমার মাসিমাকে গিয়ে বলো, আমি হারিয়ে গেছি, এ লস্ট চাইলড!’
মাসিমা শুনে বললেন, ‘দাঁড়া, আমি ওই গাড়ি টুকরো টুকরো করে জলে ভাসিয়ে দোবো। বড়কত্তার বড় বাড় বেড়েছে!’
মেজোমামা বললেন, ‘কি করে খুলবি?’
‘হাতুড়ি মেরে তাল তুবড়ে দোব। এতবড় সাহস বলে কিনা তোমার মাসিকে গিয়ে বলো, আমি হারিয়ে গেছি। হারাচ্ছি দাঁড়াও, আমাকে চেনে না?’
তিন সেন্টিমিটার একটা মাছ হাতে সন্ধ্যের মুখে বড়মামা বাড়ি ঢুকলেন। সারাদিনের রোদে আর মাসিমার ভয়ে মুখ শুকিয়ে ফিসফিস করে জিগ্যেস করলেন, ‘কুসি কোথায়?’
‘বাথরুমে চান করছেন।’
‘মেজাজ?’
‘ফায়ার। বলেছেন, নিলডাউন করিয়ে রাখবেন আপনাকে, আর গাড়িটাকে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলে দেবেন জলে।’
‘এসে কী বলেছিস?’
‘যা বলেছিলেন।’
‘ইস এখন কি হবে? কে আমাকে বাঁচাবে? মশারি ফেলে শুয়ে পড়ি। খোঁজ করলে বলবি, হাই ফিভার। তোর কাছে রসুন আছে?’
‘রসুন কি করবেন?’
‘সেই যে ছেলেবেলায় যেমন করতুম। চেপে শুয়ে থাকব। দেখতে দেখতে জ্বর এসে যাবে।’
তিন
বাঘাদা বটতলায় দাঁড়িয়ে বললেন, ‘নাঃ, আপনার হাত মোটামুটি ভালোই তৈরি হয়েছে। এখন দরকার সাহস।’
বড়মামা হাসলেন, ‘সাহস? পৃথিবীতে কুসিকে ছাড়া আমি কাউকে ভয় পাই না বাঘা।’
গাড়ির পেছনে একটা এল অক্ষর লেগে আছে, বড়মামা লাইসেন্স পেয়ে গেছেন।
‘আপনাকে ব্যাকগিয়ারটা আর একটু ভালো করে সাধতে হবে।’
‘এখন থেকে দিনকতক তাহলে অনবরত পেছন দিকেই চালাই।
‘না, তার দরকার নেই। সেটা আবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। গ্যারেজ থেকে বার করতে গ্যারেজে ঢোকাতে ঢোকাতেই অভ্যাস হয়ে যাবে। আজ গাড়িটা আপনি একা বের করুন। দেখি কেমন পারেন।’
গ্যারেজের উলটো দিকে নিত্যবাবুর বাড়ি। রাস্তাটা তেমন চওড়া নয়। বাঘাদা একবারেই গোঁত করে বের করে ফেলেন। বড়মামা স্টার্ট দিলেন। স্টিয়ারিংকে নমস্কার করলেন। বাঘাদা সামনে দাঁড়িয়ে হাতের ভঙ্গি করে নির্দেশ দিচ্ছেন।
বাঘাদা যেভাবে বের করেন, বড়মামা সেইভাবে ওস্তাদী কায়দায় সাঁৎ করে ঘুরে বেরবার চেষ্টা করলেন। হলো না। বাঘাদা লাফিয়ে সরে গেলেন। গাড়ি ত্যারাচে হয়ে নিত্যবাবুদের দেয়ালে ধাক্কা মারার আগেই বড়মামা ব্রেক কষলেন। গাড়ি টুক করে দেয়ালে ঠোককর মারল।
সাহসী বড়মামা সঙ্গে সঙ্গে ব্যাক করলেন। এবার গাড়ির পেছন দিকটা গ্যারেজের দেয়ালে লেগে গেল। তারপর সামনে পেছনে পরপর এমন সব কায়দা করলেন, দুবাড়ির দেয়ালের মাঝে গাড়ি কোণাকুণি আটকে গেল। এগোতেও পারে না, পেছতেও পারে না।
বাঘাদা স্টিয়ারিং-এ বসে নানাভাবে চেষ্টা করলেন। ঘেমে নেমে গেছেন। ‘অসম্ভব। কি করে এমন করলেন?’ বড়মামা হেসে বললেন, ‘সে এক রকমের কায়দা।’
‘কায়দা? সারাজীবন গাড়ি এই কায়দাতেই পড়ে থাক।’
‘অ্যাঁ, সে কি?’
‘হ্যাঁ, সে কি!’
‘কেন তুমি একে ম্যানেজ করতে পারবে না? তোমার তো পাকা হাত।’
‘স্বয়ং ঈশ্বর এলেও পারবেন না।’
বাঘাদা গাড়ি থেকে নেমে এলেন। বড়মামা চিন্তিত।
‘বাঘা, কী হবে তাহলে? ওই নিত্যবাবুর বাড়িটাকে ঠেলে একটু পেছিয়ে দিতে পারলে বেশ হত।’
‘গাড়ি ঠ্যালা যায় সুধাংশুদা, বাড়ি ঠ্যালা যায় না।’
গাড়ির এপাশে-ওপাশে ঘুরে ঘুরে দুজনের নানা রকম গবেষণা চলেছে। বড়মামা মাঝে মাঝে হতাশ মুখে নিত্যবাবুর নতুন তিনতলা বাড়িটার দিকে তাকাচ্ছেন, পারলে ডিনামাইট দিয়ে ভেঙে উড়িয়ে দিতেন। এদিকে সারি সারি সাইকেল রিকশা দাঁড়িয়ে পড়েছে দু-পাশে! মানুষের লাইন পড়ে গেছে। কারুর হাতে বাজারের ব্যাগ, কারুর মাথায় ঝাঁকা, কারু কাঁধে ফুলঝাড়ু। পিঠে কাগজের বস্তা। একটি দুঃসাহসী ছেলে গাড়ির চাল টপকে চলে গেল। বড়মামা হাঁ হাঁ, করে উঠলেন।
সোনপাপড়িঅলা হাঁকছে, ‘চাই সনপাপড়ি!’
কাগজওয়ালা হাঁকছে, ‘পুরনো কাগজ।’
ফুলঝাড়ু হাঁকছে, ‘চাই ঝাড়ু।’
এরই মধ্যে একটি সাইকেল রিকশায় মাইক নিয়ে বসে কবিরাজী দাঁতের মাজন। তিনিও চুপ করে বসে নেই, ‘দাঁত কন কন, গরম খেতে পারেন না, ঠান্ডা সহ্য হয় না, মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ে, মুখে দুর্গন্ধ হয়, এই কবিরাজি কালো দাঁতের মাজনটা…।’
রিকশা, সব ক’টা হাঁসের মতো প্যাঁক প্যাঁক করছে!
‘কি হল দাদা!’
বাঘাদা চিন্তিত মুখে বললেন, ‘এ তো দেখছি ল অ্যাণ্ড অর্ডার প্রবলেম! গ্যারেজটা ভাঙা ছাড়া উপায় নেই।’
‘তাহলে যে দোতলাটাও নেমে আসবে বাঘা?’
‘উপায় কি? কতক্ষণ এদের আটকে রাখবেন?’
হই হট্টগোলে মাসিমা আর মেজোমামা এসে গেছেন।
মাসিমা বললেন, ‘যা চেয়েছিলুম তাই হয়েছে। বাঘাদা এই আপদটাকে খণ্ড খণ্ড করে লণ্ডভণ্ড করে দাও!’
বড়মামা আর্তনাদ করে উঠলে, ‘না, কুসি, না!’
‘না মানে? এছাড়া আর কি উপায় আছে? বাড়ি তুমি ভাঙতে পারবে না। তোমার এই ভাঙা গাড়ি কিন্তু ভাঙা যায়। উৎপাতের ধন চিৎপাতেই যাক।’
বড়মামার সেই গাড়ি আজও আছে। সবটাই আছে। গ্যারেজেই আছে। জুড়ে নিলেই হয়। চারটে চাকা চার দেয়ালে চলতে চায়, পারে না, কারণ ইঞ্জিন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একপাশে। গাড়ির খাঁচায় আমাদের পুষি ছ’টা বাচ্চা নিয়ে চোখ বুজিয়ে ধ্যানস্থ। সামনের আর পেছনের গদি বড়মামার ঘরে। লাকি চাখাচাখি করছে। ফোম লেদার তেমন সুবিধে করতে পারছে না। ব্যাটারাটি খুব সার্ভিস দিচ্ছে। আলো চলে গেলে দুটো ফ্লোরেসেন্ট বাতি জ্বলে।
সবই আছে। নেই কেবল বড়মামার উৎসাহ। তিনি এখন রিসার্চ করছেন অন্য বিষয় নিয়ে। গোটা তিরিশ বাঁদর এনে বারান্দায় রেখেছেন, সার সার খাঁচায়। যুগান্তকারী একটা কিছু করবেন। নোবেল পুরস্কার নাকি আর বেশি দূরে নেই।