“উৎপল আমার জন্যই স্মরণীয় সব চরিত্র সৃষ্টি করেছিল”

“উৎপল আমার জন্যই
স্মরণীয় সব চরিত্র সৃষ্টি করেছিল”
বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের হেলেনে ভাইগেল

[দূরদর্শনের একটি অধুনালুপ্ত চ্যানেল, এ-টি-এন ওয়ার্ল্ডে বিগত ২০০৪ সালের প্রারম্ভে ‘বাংলা থিয়েটার’ সম্পর্কে এক সপ্তাহব্যাপী একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়েছিল। সেই সময় অনুষ্ঠানের উপস্থাপক রূপে আমি বাংলা মঞ্চের বিভিন্ন প্রজন্মের সাতজন নাট্যব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। সদ্যপ্রয়াত অভিনেত্রী শোভা সেন-এরও সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

শোভা সেনের এই সাক্ষাৎকারটি যখন গ্রহণ করা হয়, তখন তার বয়স ৮০ পেরিয়ে গেছে (শ্রীমতী সেনের জন্ম ১৯২৩-এর ১৭ সেপ্টেম্বর)। পারিবারিক সমস্যা, অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক প্রতিকূলতা, স্বামী উৎপল দত্তের উপর্যুপরি গ্রেপ্তার ও কারাবাস, থিয়েটার দলের ভাঙন ও তীব্র বিতর্কে উথালপাথাল তার বর্ণময় জীবন। এযাবৎ অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি বর্তমানে মুদ্রিত হল।]— লেখক।

আমার বয়স ৮০ পেরিয়েছে, ৮০+ চলছে। আমার অতি সম্প্রতি হাঁটু প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হলো। আমি এর পরেও নিশ্চয়ই মঞ্চে অভিনয় করবো। অভিনয় করার জন্যই তো এই অপারেশনটা করলাম। না হলে তো পঙ্গু হয়ে যেতাম। আমাকে এত সিরিয়াস সব রোল করতে হচ্ছে। এগুলো আমার থিয়েটার গ্রুপের প্রয়োজনেই আমাকে করতে হয়। উৎপলের অবর্তমানে আমাকে অনেকটাই হাল ধরতে হয়, হয়েছে। প্রত্যেক অভিনেতা অভিনেত্রী, যতক্ষণ সে পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, ততক্ষণ তার অভিনয় করা উচিত— এটা আমার মত, উৎপলও তাই বলতো। যখন সে শুয়ে পড়বে, তখন তো সে আর (অভিনয় করতে) পারবে না। আমি এখনও সেই আদর্শটা মেনেই চলছি।

আমি কীভাবে ভারতীয় গণনাট্য সংঘে এলাম? জানানোর মধ্যে সবচেয়ে প্রথম কথা এটাই যে আমি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমি পড়তাম বেথুন কলেজে— সেই স্টুডেন্ট লাইফ থেকেই আমি পার্টির সঙ্গে জড়িত এবং পার্টির কাজকর্ম করতাম।

পড়াশুনা ছিল বলে খুব সিরিয়াস কিছু করতে পারতাম না। কলেজ লাইফ থেকেই অভিনয় করতাম। বেথুন কলেজে প্রত্যেক বছরই দুটো করে নাটক হতো— তাতে অভিনয় করতাম। আমার নাটকের ওপর উৎসাহ ছিল ছোট থেকেই। আমি স্কুলে থাকাকালীন তখনই একটা নাটক পরিচালনা করেছি। নাটকটা বাচ্চাদের নিয়েই করেছিলাম। সেই থেকে আমার অভিনয়ের, থিয়েটারের প্রতি একটা আকর্ষণ জাগে, আমি নাটকের প্রতি আকৃষ্ট হই। যদি কোনও সুযোগ আসে, তবে সেটাকে ব্যবহার করবো, এটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। আমি বি.এ. পরীক্ষা যখন পাশ করলাম তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে নাটকের একটা প্ল্যাটফর্ম ভালোমতো তৈরি হয়ে গেছে। প্রথমে দু-একটা ছোট নাটক করার পর, বড় নাটক হিসেবে নবান্নতে হাত দেওয়া হয়। নাটকটি লিখেছিলেন বিজন ভট্টাচার্য— তিনি তখনই বিখ্যাত লেখক, অভিনেতা ও পরিচালক হয়ে উঠেছেন। তাঁর সাথে যোগ দেন শম্ভু মিত্র। তিনিও তখন অভিনয়ে বেশ নাম করেছেন— তিনি তখনই শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে অভিনয় করেছেন। বিজন ভট্টাচার্য এবং শম্ভু মিত্র— এই দুজনে মিলে নবান্ন’ নাটকের পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। তখন আমাদের পার্টির সূত্রে বন্ধু ছিলেন, সুধী প্রধান, তিনি এই নবান্ন নাটকের সংগঠক হিসেবে পার্টির পক্ষ থেকে নিযুক্ত ছিলেন। পার্টির থেকে তাকেই দায়িত্ব দিয়ে নিযুক্ত করেছিলো। আমার নন্দাই, প্রফেসর শান্তিময় রায়, তিনিও সুধী প্রধানের বন্ধু ছিলেন, আমার স্বামীর বন্ধু ছিলেন। তিনি জানলেন যে আমি নাটক করতে চাই, অভিনয় করতে চাই। তারা তখন যে রকম একজন অভিনেতা চাইছিলেন, আমার সঙ্গে তা মিলে যায়।

আমাকে সুধী প্রধান নিয়ে গেলেন বিজন ভট্টাচার্যের কাছে। মূলত দেখাবার জন্য। তখন গণনাট্যের পানু পাল, উষা দত্ত, এঁরা নাচ এবং অভিনয় প্র্যাকটিস করছিলেন। আমি সেগুলো দেখতে যাই। আমারও এগুলো বেশ ভালো লাগলো। এই মহড়াগুলোর সহায়তায় টাকা তোলা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির উদ্দেশ্য। দুর্ভিক্ষের জন্য তখন এখানের অবস্থা খুবই খারাপ। স্বাধীনতা তখনও আসেনি। রাস্তায় কাতারে কাতারে মানুষ— রাস্তায় মানুষ। মরে পড়ে থাকছে। সে এক ভয়ঙ্কর সময় গেছে। এদিকে যুদ্ধ আর অন্যদিকে কালোবাজারী শুরু হলো। কী ভয়ঙ্কর অবস্থা— মানুষ রাস্তায় মরে পড়ে থাকছে। বাড়িতে তখন ভাতের ফ্যানটুকুও ফেলা যেত না। (সেই ফ্যান নেওয়ার জন্য) মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো।

আমরাও তখন টাকা তোলার কাজে নেমে পড়লাম। তখন ছিল রাজনৈতিক আদর্শ আর এর ফলে একটা দায়বদ্ধতা এসে গেল। আমরা থিয়েটারকে বিনোদন হিসেবে দেখিনি— মানুষকে আনন্দ দেব এই চিন্তা ছিল না। এইভাবেই নামলাম। আমরা আসল জায়গাটা বেছে ফেললাম— আমার মনে হল এটাই আমাদের প্রকৃত জায়গা। এই দুটো কারণে।

এখন আমার অভিনয় জীবনের ষাট বছর হয়ে গেলো। আমরা সেই আদর্শ থেকে আজও বিচ্যুত হইনি। অবশ্য গণনাট্য সংঘে এত বছর থাকিনি। আমি প্রথমে গুরু হিসেবে পেয়েছিলাম বিজন ভট্টাচার্য ও শম্ভু মিত্রকে। পরে পেলাম উৎপল দত্তকে।

গণনাট্য সংঘ এক সময় শেকসপিয়ারের জন্মদিন পালন করেছিল। আমাকে তারা তখন ডেকেছিলেন লেডি ম্যাকবেথের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য। পুরো ম্যাকবেথ নাটকটি অভিনীত হয়নি— কেবল প্রথম অঙ্কটি করা হয়েছিল। এই নাটকে (আমন্ত্রণ পেয়ে) আমার খুব আনন্দ হয়েছিল এই জন্য যে শেকসপিয়ারের নাটক করলে যে কোনো অভিনেতা কিন্তু (নাটক করার জন্য) তৈরি হয়ে যান। লেডি ম্যাকবেথের চরিত্রটিও ছিল অসাধারণ। নাট্যজগতে এর সমতুল্য কোনও চরিত্র তৈরি হয়েছে কিনা। আমার জানা নেই। প্রত্যেকটি অভিনেত্রীর জীবনে একটা স্পৃহা থাকে ঐ পার্টটা করার।

লিটল থিয়েটার গ্রুপ বা এলটিজি (পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি) সেইসময় সবে বাংলা নাটক করতে শুরু করেছে। সেই সময় (ওদের পক্ষ থেকে আমার কাছে) ডাক এল। সেই ডাকটি আমি গ্রহণ করি। খুব যে ভুল করিনি তা পরে বুঝেছি। কেননা তখন গণনাট্য সংঘের কাজকর্ম, বিশেষত নবান্নর পরে ধুম-ধাড়াক্কা করে কিছু হয়নি। ওরা আর একটা নাটক বেছেছিল— জীয়নকন্যা। বিজনবাবুরই লেখা। কিন্তু, এই নাটকের প্রতি অভিনেতা-অভিনেত্রীকেই গান-নাচ-অভিনয় এই তিনটি বিষয়েই পারদর্শী হতে হবে। সেটা পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।

এলটিজিতে যোগ দিয়ে আমি প্রথমে ঐ লেডি ম্যাকবেথেরই ভূমিকায় অভিনয় করি। তারপর একের পর এক ক্লাসিক নাটকে অভিনয় করি। তখনও উৎপল দত্ত নাটক লিখতে শুরু করেননি। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘লোয়ার ডেপথস্’-এর অনুবাদ, ‘নিচের মহল’ আমরা অভিনয় করি। আমাদেরই একজন, উমানাথ ভট্টাচার্য এই অনুবাদটি করেন। এই নাটকটি আমরা খুব সিরিয়াসলি করতে লাগলাম— নাটকটি খুব আলোড়ন ফেলে। এই সময় মাইকেলের ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’ অভিনয় করা হয়— এই নাটকে প্রথমে আমি ফতির ভূমিকায় ও পরে পুঁটি-র চরিত্রে অভিনয় করি। দুটি চরিত্রেই অভিনয় করি। দুটো চরিত্রই সম্পূর্ণ বিপরীত। ফতি খুবই মিষ্টি একজন নায়িকা, খুব সাবলীল। পুঁটি হচ্ছে একেবারে বিপরীত। পুঁটি একজন বেশ্যার দালাল। সে জমিদারকে মহিলা সরবরাহ করে। দুটোতেই আমার অভিনয় উত্‌রে যায়। তখন আমাদের প্রতিবছরই একটা করে নাট্য উৎসব হত। এলটিজি এই উৎসব করত। আমাদের অভিনীত ম্যাকবেথ এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে আমাদের দলের নামই হয়ে যায় ‘ম্যাকবেথ পার্টি’, গ্রামে-গঞ্জে, যেখানে শেকসপিয়ার কখনও ঢুকতে পারতো না, সেখানেও নাটকটি অসামান্য সাফল্য লাভ করে। আমরা গোগোলের ‘ইনসপেক্টর জেনারেল’ নাটকটিও করি। মিনার্ভা থিয়েটার ভাড়া নেওয়াটা আমাদের একটা যুগান্তকারী কাজ। হলটি দলের নামে লীজ নেওয়ার কথা হয়। আমাদের তখনকার মালিক কিন্তু দলের নামে করতে চাইলেন না। আমাদের দলের একজন, অজিত গঙ্গোপাধ্যায় এসে জানালেন যে মিনার্ভার মালিক লীজ দিতে চাইছেন। এই মওকায় আপনারা চেষ্টা করুন। থিয়েটার নিয়ে ব্যবসা করবো বা কোনো ব্যবসায়িক বুদ্ধি তখন আমাদের একেবারেই ছিল না। এই বিষয়ে আমাদের কোনো রকম অভিজ্ঞতাই ছিল না। কিন্তু উৎসাহী একদল তাজা ছেলেমেয়ে— তাদের কীরকম যেন জেদ চেপে গেল। আমরা করবই— রাস্তার কলের জল খেয়েও আমরা করবো। চিনা বাদাম খেয়েই করবো। কিন্তু করতে হবে। এই একটা প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমরা নেমে পড়লাম।

কিন্তু আমাদের কাছে টাকা তো নেই। আমাদের আর এক বন্ধু তিনি টাকা জোগাড় করে দেবেন, কিন্তু একজন গ্যারেন্টার চাই। তখন গ্যারেন্টার হিসেবে আমি ছাড়া এমন কোনো ছেলে বা মেয়ে ছিল না, যার বাড়ি ছিল। সেই বাড়ি বন্ধক দিয়ে টাকার সংস্থান হল।

‘অঙ্গার’-এ অসাধারণ সাফল্য এল ঠিকই কিন্তু আমরা তো শুরু করেছিলাম ‘নিচের মহল’ বা ‘ছায়ানট’ দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘তপতী’ নাটকও আমরা মাঝে মাঝে করতাম। কিন্তু সেটা জমলো না। একটা বিষয় আমাদের বুঝতে ভুল হয়েছিল। মিনার্ভা থিয়েটার যেহেতু উত্তর কলকাতায়, আমাদের দর্শক ছিল হাতিবাগান বাজারের আলুওয়ালা, পটলওয়ালাবাজার শেষ হলে তারা নাটক দেখতে আসতো। সেই দর্শকদের ‘নিচের মহল’ দেখালে তো চলবে না। এই বিষয়টা বুঝতে আমাদের বেশ কিছুদিন কেটে গেল। প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হল আমাদের প্রচুর লস খেলাম। আমাদের পুরো টেকনিসিয়ান দলের ভার বইতে হত। এই সব পাওনা মিটিয়ে আমরা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা একটা পয়সাও পেতাম না।

যখন টাকা থাকতো, তখন হয়তো ট্যাক্সি ভাড়া পেতাম— তাও মাঝে মাঝে জুটতো না। ‘অঙ্গার’ নাটক ভারতীয় থিয়েটারে এই প্রথম লেখা যেখানে শ্রমিকরা স্টেজে এলেন এবং নায়কের ভূমিকায়। নাটকটি লিখলেন উৎপল দত্ত। সঙ্গে ছিল তাপস সেনের আলো এবং রবিশঙ্করের আবহসঙ্গীত। প্রত্যেকটি শো-তে নির্মলেন্দু চৌধুরী তাঁর দল নিয়ে এসে গান করতেন। তার জন্য উনি কোনো পয়সা নিতেন না। যখন পারতাম তখন আমরা কিছু যাতায়াত ভাড়া দিতাম। তিনি নিজের থেকে, থিয়েটারকে ভালোবেসে, উৎপল এবং আমাদের সকলকে ভালোবেসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। সঙ্গে ছিল টিমের অভিনয়— ‘অঙ্গার’ অসাধারণ সাফল্যলাভ করল। স্টেজের বৈজ্ঞানিক দিকটি এই প্রথম বাঙালি দর্শক দেখলো— এখানে একজন কারুর নাম বিশেষ করে বলা যাবে না। যদি আদৌ কোনো নাম করতে হয় তো আমি রবি ঘোষের নামটাই বলব। কিন্তু প্রত্যেকটি চরিত্রের অভিনয় অসাধারণ হয়েছিল। এই টিম ওয়ার্কের যে জোরের জায়গাটা, সেটা আমরা গণনাট্য থেকেই পেয়েছিলাম।

উৎপল থিয়েটারের প্রত্যেকটি অংশ ব্যবহার করেছে। একটি সামগ্রিক থিয়েটার— মঞ্চের ওপর নিচ, পুরোটাই সে ব্যবহার করেছে। এই সবই ছিল আমাদের সাফল্যের মূল।

একটা কথা এখানে বলতে হবে যে আমরা কখনও কোনো কাগজ থেকে বা রাজনৈতিক দল বা শাসক পার্টির কারোর কাছ থেকেই কোনো সাহায্য পাইনি। বরং আমাদের বহু বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া আমাদের কেউ সমর্থন করেনি। এত ভালো ভালো নাটক আমরা করেছি, কিন্তু কাগজে তার বিরুদ্ধ সমালোচনাই হয়েছে। ষাটের দশকে আমাদের একটা অসাধারণ নাটক ‘ফেরারী-ফৌজ’ হয়েছিল, কিন্তু কাগজে তার সমালোচনা বেরুলো যে তা ‘আবর্জনার স্তুপ’।

‘কল্লোল’ নাটকটার ছক কিন্তু আগেই উৎপল দত্তর কাটা ছিল। তখন নাটকে এই সব পারিবারিক বিষয় নিয়ে লেখাটা হয়নি। সে তখন নৌ-বিদ্রোহ আর স্বাধীনতা সংগ্রামটা নিয়েই লিখছিল। তাও পুরোপুরি লেখা হয়নি— তবে খসড়াটা তৈরি ছিল। আমরা এই সময়ে ভাবছিলাম কী নাটক করা যায়। উৎপল তখন রাজনৈতিক ভাবে খুব সক্রিয়—সামনের সারিতে। প্রায় জননেতা হিসেবেই উঠে এসেছে। তখন এই নাটকটাই আমরা লুফে নিলাম। ওকে সময় দিলাম, বললাম, তুমি লিখে শেষ করো। আমরা তখন আর একটা জিনিস করতাম। যেমন ‘অঙ্গার’ নাটকের আগে একটা টিম নিয়ে উৎপল নিজে কয়লাখনির নিচে গেছে। সেখানে পুরো বিষয়টা সরেজমিনে দেখে, তারপর চরিত্র তৈরি করেছে এবং নাটক লিখেছে। তেমনি ‘কল্লোল’ লেখার সময় সম্পূর্ণ ইতিহাস দেখে, কিছু নৌ-বিদ্রোহের নাবিকদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের ইতিহাস জেনে বই পড়ে তথ্যকে ভিত্তি করে লিখে ফেলে। উৎপলের সব কিছু নিখুঁত হওয়া চাই। এই যে ‘কল্লোল’-এ নাবিকদের পোষাক, সে একেবারে নাবিকদের ডেকে, দেখে যারা নৌ-বিদ্রোহে ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলে তবে সে প্রত্যেকটি জিনিস করতো। আমাদের যিনি দর্জি হিসেবে এসেছিলেন, সেই রসিদ সাহেব, তিনিও ঐ সব পোষাক দেখে-শুনে, তাদের পোষাকের ওপরে যে ল্যাপেলগুলো থাকতো, সেগুলো পর্যন্ত সব একেবারে নিখুঁত করে করা হয়েছিল। পোষাকের দুটো সেট করা হতো— কারণ প্রথম দিকে খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ভালো পোষাক। কিন্তু নৌ-বিদ্রোহের শেষের দিকটা, যখন সেই গুলি গোলা চলতে শুরু হয়েছে, তখন পোষাক হয়ে। যাবে ছেঁড়া, পোড়া। সেই জন্য আর এক সেট।

আমাদের ‘কল্লোল’ নিয়ে প্রচণ্ড সংগ্রাম করতে হয়েছে। শাসক শ্রেণী তখন আমাদের বিরুদ্ধে জেহাদ শুরু করে দিয়েছে। উৎপলকে তারা জেলে পুরে দেয়। ওরা ভাবলো যে উৎপলকে জেলে পুরলেই নাটক বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের ধারণা উৎপলের পরে এমন কেউ আর নেই, যে সংগ্রামটা চালিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু উৎপল তার দলকে এমনভাবে তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিল যে কেউই ঘাবড়ালো না। কত রকম হুমকি, ফোন আসতো আমাদের কাছে, বিরোধিতাও আসতো। আমরা স্টার’ থিয়েটার বুক করে নাটক করতে যাবো, শুনলাম তার আগেই থিয়েটার হলের উপর হামলা হয়েছে। আরও সংগ্রামের জন্য আমরা প্রস্তুত হতে লাগলাম। (নাট্য দলের) প্রত্যেকটি সভ্য তার জন্য তৈরি ছিল। যখন যেই নাটকের জন্য যাচ্ছে, তখন বাধা দিচ্ছে। শাসক শ্রেণী যে কোনো উপায়ে আমাদের করতে দেবে না বলে স্থির করেছে। তারা তাদের সব হাতিয়ার ব্যবহার করেছে। পুলিশ কিন্তু কোনো হস্তক্ষেপ করছে না, সব কিছু দেখেও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু করছে না। তারা অপেক্ষা করছে আমি আর উৎপল সেখানে কতক্ষণে পৌঁছাবো। আমাদের মারধোর করে— আমাদের ওপর প্রতিশোধ নেয়। অথচ সেইসময় পুরো পাবলিক আমাদের দিকে। তারা বলছে আমরা (গুণ্ডাদের) বাধা দেবো এবং এর বিরুদ্ধে লড়ে আমরা জিতব। আমাদের প্রত্যেকটি সদস্যও এই মনোভাব নিয়ে লড়াই করেছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা জিতলাম। ‘কল্লোল চলছে, চলবে’ শ্লোগান কার্যকর হল, ‘কল্লোল’ চললো এবং আমাদের প্রচণ্ড সুনাম হয়েছিল। সারা ভারতে, এমনকি বিদেশেও আমাদের সংগ্রামের কথা পৌঁছেছিল। এরপর আমাদের ‘কল্লোল’-এর একটা বিজয়-উৎসব হয়েছিল—ময়দানে বিরাট করে হয়েছিল।

‘তীর’ নাটকের ক্ষেত্রেও একটা ঘটনা ঘটেছে। উৎপল বার বার গ্রেপ্তার হওয়ায় পারিবারিক দিক থেকে আমাকে মানসিক ভাবে সংগ্রাম করতে হয়েছে। মানসিক দৃঢ়তা বজায় রাখতে হয়েছে, দৃঢ়চেতা হয়ে এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি ওর পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছি। যেমন স্টার থিয়েটার। যখনই উৎপল গাড়ি করে পৌঁছলো, ওমনি ওকে চারদিক থেকে ঘেরাও করল। ওখানে আমাদের লোকও ছিল। তারা আমাদের বললো, আপনারা শিগগির এখান থেকে সরে যান। আপনাদের ওপর এবার আক্রমণ আসবে। কিন্তু আমি রাজি হলাম না। বললাম, আমরা (ওদের) ফেস করবো। সরে যাবো কেন! (আমাদের বন্ধুরা) বলল, না, এ ভুল করবেন না। আপনারা আর একটু শক্তি সংগ্রহ করে পরে লড়াইটা করুন।

তারপর আমাদের মিনার্ভা ছেড়ে দিতে হলো। এত আর্থিক দায় মাথায় নিয়ে আমরা চালাতে পারলাম না। প্রচুর দেনা হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু আমাদের নামে লীজ, তাই সমস্ত (আর্থিক) দায়টাই উৎপলের ওপর পড়ল। (মিনার্ভা) ছেড়ে আমরা তখন বাইরে এসে শো করতে লাগলাম। ১৯৭১-৭২ থেকে। কিন্তু প্রথম নাটকই হিট করে গেল—‘টিনের তলোয়ার’। অসাধারণ একটি নাটক, যার মধ্যে কোনও পলিটিক্স ছিল না। বাংলা স্টেজকে নিয়ে একটা অসাধারণ নাটক লেখা হল।

‘ব্যারিকেড’ নাটকে আমার ভাগে যে চরিত্রটি ছিল তা অসাধারণ। উৎপল আমার জন্যই এই সব চরিত্রগুলো সৃষ্টি করেছিল। এইগুলো বাংলার নাটকের ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকবে। আমাকে পরে অনেক অভিনেত্রীই বলেছেন, যেমন কেয়া চক্রবর্তী, তৃপ্তি ভাদুড়ি (তখন সে তৃপ্তি মিত্র হয়ে গেছে) বলেছে যে তুমি এত ভালো বিদেশি রোলগুলো করতে পারো, কেননা তুমি তো বিদেশে ঘুরেছো, দেখেছো এমনকি বিদেশি নাটকও দেখেছো।

আমি ব্রেখট পত্নী, হেলেনে ভাইগেল, তার সঙ্গে দেখা করেছি, কথাও বলেছি। সেটা এত একটা ইনসপায়ারিং ব্যাপার! তিনি ব্রেখটের সাথী ছিলেন, আমিও উৎপলের সাথী। তাকে দেখে আমার ইনসপিরেশনটা আসছে। সবাই তার ফিল্ম দেখে, আমি কিন্তু তাঁর নাটকে অভিনয় দেখেছি। স্টেজে তাঁকে দেখেছি। আমি তার বাড়িতে গেছি, তার সঙ্গে কথা বলেছি, তার রান্নাঘর দেখেছি। উৎপলের যেমন খুব রসনা ছিল, ব্রেখটেরও নাকি তেমন প্রবল রসনা ছিল। হেলেনে অস্ট্রিয়ার মেয়ে, তিনি রান্না-বান্না খুব ভালো জানতেন। তাঁর রান্নাঘর অদ্ভুত সাজানো বাসন পত্র থেকে সব কিছু।

অনেকে ভাবে আমি খুব বড়োলোক, উৎপল দত্ত বুঝি (আমার জন্য) প্রচুর টাকা রেখে গেছে। আসলে (ব্যাপারটা) তা নয়। আমাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে, আমার ওপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা গেছে।

-‘অনীক’, নভেম্বর, ২০১৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *