উল্কার আলো
এ গল্পের নামকরণ ভুল হইয়াছে। শেষ পর্যন্ত পড়িবার ধৈর্য যাঁহার আছে, তিনিই একথা বুঝিতে পারিবেন। যাঁহার সে ধৈর্য নাই, তাঁহাকে গোড়াতেই জানাইয়া দেওয়া প্রয়োজন যে ইহার নাম হওয়া উচিত ছিল—‘স্ত্রিয়াশ্চরিত্রং’; কিংবা ‘পুরুষস্য ভাগ্যং’; অথবা ‘দেবা ন জানন্তি’—। বম্বে ফিল্মের মতো শুনাইতেছে, কি করিব, আমি নাচার।
গল্পের শীর্ষদেশে একটা নাম জুড়িয়া দিবার প্রথা কোন্ অর্বাচীন আবিষ্কার করিয়াছিল? গল্পের আখ্যানবস্তুর সহিত ঐ শিরোনামার একটা অর্থগত সংযোগ থাকিবারই বা আবশ্যকতা কি? ‘শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনী’র পরিবর্তে বইখানার নাম ‘বিরূপাক্ষের বীরত্ব’ হইলেই বা পৃথিবীর কি অনিষ্ট হইত? ‘যোগাযোগ’ যদি ‘তিন পুরুষ’ই থাকিত, তাহা হইলে কি সৃষ্টি রসাতলে যাইত? বর্তমান লেখকের একটা নাম আছে কিন্তু নামের সঙ্গে মানুষটার একটুও সাদৃশ্য নাই। তাহাতে কি ক্ষতি হইয়াছে? What’s in a name?
এ সকল গুরুতর প্রশ্নের উত্তর আপনারা দিতে পারিবেন না, অতএব সেজন্য অপেক্ষা করিয়া আপনাদের অপ্রতিভ করিব না। তৎপরিবর্তে যে নিদারুণ সংবাদটি দিয়া আপনাদিগকে সচকিত করিয়া তুলিবার অভিলাষ করিয়াছি, তাহা এই—সুনীলা ওরফে বিল্লুর বয়স এখন সতেরো বৎসর; এবং তাহার মতো ফাজিল, চপল ও হৃদয়হীনা যুবতী আমি আজ পর্যন্ত দেখি নাই। অনুরূপকে সে—
কিন্তু সব কথাই শুরু হইতে বলা কর্তব্য। কবিবর বলিয়াছেন, আরম্ভের পূর্বেও আরম্ভ আছে। সন্ধ্যাবেলায় দীপ জ্বালার আগে সকালবেলায় সলতে পাকানো—অর্থাৎ বাবারও বাবা আছে; অন্তত থাকিলে ভাল হয়।
এই বিল্লুর বয়স যখন আট বৎসর ছিল তখন তাহার কাঁচা রকম একটা বিবাহের সম্বন্ধ হইয়াছিল। নিতান্তই হাসিঠাট্টার মধ্যে জন্মগ্রহণ করিয়া এই সম্বন্ধ ভ্রূণ অবস্থাতেই বিনষ্ট হইয়া যায়। বিল্লুর বাবা প্রথম শ্রেণীর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বেহারীবাবু সদরে বদলী হইয়া আসিয়াছিলেন এবং তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র পঞ্চদশ বর্ষীয় বিজয়লালের সহিত স্থানীয় বড় উকিল নিমাইবাবুর পুত্র অনুরূপচন্দ্রের বেজায় বন্ধুত্ব জন্মিয়া গিয়াছিল। এইসূত্রে অনুরূপ প্রায়ই বিল্লুদের বাড়ি যাইত। এমন কি শেষ পর্যন্ত বন্ধুত্ব এমনই গাঢ় হইয়া উঠিয়াছিল যে স্কুলে এবং স্কুলের বাহিরে এই দুটিকে কদাপি পৃথক অবস্থায় দেখা যাইত না। বিজয়কে বাড়িতে না পাইলে সকলে বুঝিত, সে অনুরূপের বাড়িতে আছে এবং অনুরূপকে বাড়িতে না পাওয়া গেলেও—তথৈবচ।
হুঁ। পাঠক ভাবিতেছেন—কিন্তু তাহা ভুল। বরঞ্চ ঠিক তাহার উল্টা। বন্ধু-ভগিনীর অত্যাচারে অনুরূপের জীবন দুর্বহ হইয়া উঠিয়াছিল। পাতলা মুখের উপর বড় বড় বিস্ফারিত দুইটি চোখ, লাল টুকটুকে দুইখানি ঠোঁট-বিল্লুকে দেখিয়া সহসা কেহ কল্পনাও করিতে পারিত না যে, তাহার ঐ আট বছরের ক্ষুদ্র মস্তকের মধ্যে এতপ্রকার দুষ্ট বুদ্ধি সঞ্চিত হইয়া আছে, বয়োজ্যেষ্ঠদেরও তাহাকে আঁটিয়া উঠিবার জো নাই। অনুরূপ এক সময় উদ্ভ্রান্ত হইয়া ভাবিত, জ্বালাতন করিবার এমন অপরিসীম শক্তি এই ক্ষুদে মেয়েটা কোথা হইতে লাভ করিল? নেহাৎ বন্ধু-ভাগিনী বলিয়াই সে নীরবে সহ্য করিয়া যাইত, নচেৎ-—
কাল্পনিক প্রতিহিংসা-বিলাসে দাঁত কড়মড় করিয়াই তাহাকে নিবৃত্ত হইতে হইত।
প্রথম দিন বন্ধুর গৃহে পদার্পণ করিবামাত্রই বিল্লু কর্তৃক অনুরূপের নির্যাতন আরম্ভ হইয়া গিয়াছিল। বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বিল্লু গম্ভীরভাবে তাহার সম্মুখে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, ‘তুমি বুঝি দাদার একটা বন্ধু? দাদা সব জায়গায় তোমার মতো একটা বন্ধু করে। তোমার নাম কি?’
অনুরূপ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া নিজের ডাকনামটা বলিয়া ফেলিয়াছিল।
নাম শুনিয়া বিল্লু নাক সিঁটকাইয়া বলিয়াছিল, ‘নাকু? এ রাম! বিচ্ছিরি নাম। আমার নাম বিল্লু—ভাল নাম সুনীলা। তোমার চুল অমন খোঁচা-খোঁচা কেন?’
প্রশ্নের উত্তর দিতে দেরি হইতেছে দেখিয়া বিল্লু অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করিল, ‘তুমি কান নাড়তে পারো—না? হাঁ পারো। অত বড় বড় কান নাড়তে পারো না? নিশ্চয় পারো। একটু নাড়ো না দেখি।’ বলিয়া ঘাড় হেলাইয়া স্থিরদৃষ্টিতে তাহার কানের দিকে তাকাইয়াছিল।
অনুরূপ কান নাড়িতে পারে নাই, কেবল উদ্দিষ্ট ইন্দ্রিয় দু’টা অতিরিক্ত মাত্রায় লাল হইয়া উঠিয়াছিল।
এইভাবে আরম্ভ হইয়া চক্রবৃদ্ধি হারে বিল্লুর অমানুষিক উৎপীড়ন বাড়িয়া চলিয়াছিল। ইহার আনুপূর্বিক ইতিহাস লিখিয়া পৃথিবীর দুঃখভার আর বাড়াইব না, দুই একটা ছোটখাটো উদাহরণ দিয়া এই নৃশংসতার চিত্রের উপর যবনিকা টানিয়া দিব।
বিজয় ও অনুরূপ দুই বন্ধুতে মিলিয়া একত্র একটা ফটোগ্রাফ তোলাইয়াছিল। ছবিটি বিজয়ের পড়িবার টেবিলের উপর সযত্নে সাজানো ছিল। একদিন স্কুল হইতে ফিরিয়া বিজয় দেখিল, ছবি হইতে অনুরূপের মুণ্ডটি কে সাবধানে কাঁচি দিয়া কাটিয়া লইয়াছে এবং তৎপরিবর্তে সচিত্র রামায়ণ হইতে হনুমানের মাথাটি কর্তিত করিয়া সেই স্থানে জুড়িয়া দিয়াছে। এ কাহার কার্য, তাহা বুঝিতে বিজয়ের বিলম্ব হইল না। বন্ধুর প্রতি এই অপমানে সে ভীষণ ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল। বিল্লুর চুলের বিনুনি ধরিয়া টানিয়া আনিয়া ছবির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া সগর্জনে কহিল, ‘এ কি করেছিস?’
বিল্লু ঘাড় বাঁকাইয়া বলিল, ‘আমি জানি না!’
‘জানি না? রাক্ষুসী কোথাকার! শিগ্গির আসল মুণ্ডটা দে।’
‘আমি জানি না! আসল মুণ্ডই তো রয়েছে—’ বলিয়া বিল্লু খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। ইহা হইতে প্রতীয়মান হইবে যে, এই আট বৎসর বয়সেই বিল্লু মেয়েটি কিরূপ পরিপক্ক ও ফাজিল হইয়া উঠিয়াছে।
বিজয় তর্জন করিয়া বলিল, ‘দিবিনে আসল মুণ্ড? দে বল্ছি—’
‘দেব না, যাও।’
এমন সময় অনুরূপ আসিয়া উপস্থিত হইল। ছবিতে নিজের মুখাবয়বের শোচনীয় পরিবর্তন দেখিয়া সেও নিরতিশর ক্রুদ্ধ ও মর্মাহত হইল; কিন্তু অনেক ধস্তাধস্তি করিয়াও দুই বন্ধুতে বিল্লুর নিকট হইতে অনুরূপের আসল মুণ্ড আদায় করিতে পারিল না। শেষ পর্যন্ত অত আদরের ছবিটা ফেলিয়া দিতে হইল।
বলা বাহুল্য, সে মুণ্ড আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই। পাঠক জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, বিল্লু সে মুণ্ড লইয়া কি করিল? এ প্রশ্নের উত্তর আছে—পাঠক খুঁজিয়া দেখুন।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটিয়াছিল আর একদিন সকালবেলা। অনুরূপ বিজয়ের পড়িবার ঘরে একাকী বসিয়া অঙ্ক কষিতেছিল এমন সময় বিল্লু আসিয়া পিছন হইতে তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া আদরের সুরে বলিল, ‘নাকুদা—’
নিরুৎসুকভাবে নিজের কণ্ঠ বাহুমুক্ত করিয়া লইয়া অনুরূপ বলিল, ‘কি?’
বিল্লু ভাসা ভাসা ডাগর চোখ দু’টি তুলিয়া বলিল, ‘আমায় দুটো ফুল পেড়ে দেবে ভাই?’
সন্দিগ্ধভাবে অনুরূপ বলিল, ‘কি ফুল?’
‘চাঁপা ফুল। ফটকের পাশে ঐ বড় গাছটায় অনেক ফুটেছে। পেড়ে দাও না—খেলাঘরের শিবপূজা করব।’
‘আমি এখন পারব না—অঙ্ক কষছি। মালীকে বলগে যাও।’
‘মালী দিচ্ছে না। —তুমি চল না, নাকুদা, লক্ষ্মীটি। তুমি খুব গাছে চড়তে পার—তোমার মতো কেউ পারে না।’
অনুরূপের সন্দেহ দূর হইল না; কিন্তু এতখানি কৈতববাদ প্রতিরোধ করিবার ক্ষমতাও তাহার ছিল না। সে বলিল, ‘আচ্ছা, চল।’
গাছের কাছে উপস্থিত হইয়া সে একবার ভাল করিয়া চারিদিক দেখিয়া লইল, কোথাও বিপদের আশঙ্কা আছে কিনা। তারপর গাছে চড়িতে প্রবৃত্ত হইল।
বিল্লু গাছের শীর্ষদেশ অঙ্গুলি দিয়া দেখাইয়া বলিল, ‘ঐখানে অনেক ফুল আছে, নাকুদা,—একেবারে আগায়।’
গাছের ডগা পর্যন্ত অসন্দিগ্ধ-চিত্তে উঠিয়া হঠাৎ অনুরূপ বুঝিতে পারিল কি সাংঘাতিক ফাঁদে সে পা দিয়াছে। সে একটি চিৎকার ছাড়িয়া যথাসম্ভব দ্রুত নামিতে নামিতে বলিতে লাগিল, ‘পোড়ারমুখী বাঁদরী, দাঁড়া, আজ তোকে মজা দেখাচ্ছি।’ গাছের অর্ধেক নামিয়া সেখান হইতেই সে মাটিতে লাফাইয়া পড়িল। কিন্তু বিল্লু তখন উচ্চকণ্ঠে হাসিতে হাসিতে গ্রীবাভঙ্গে পিছু ফিরিয়া চাহিতে চাহিতে হরিণশিশুর মতো ছুটিয়া অদৃশ্য হইয়াছে।
অনুরূপ সেখানেই বসিয়া পড়িয়া দুই হাতে সর্বাঙ্গ চুলকাইতে লাগিল। কিন্তু তখন শত শত মধুপিঙ্গলবর্ণ বিষধর কাঠ-পিঁপড়া তাহার সারাদেহে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। অনুরূপ তাহার গায়ের জামাটা টানিয়া খুলিয়া ফেলিল, কিন্তু কেবল জামা খুলিলে কি হইবে? একটু ইতস্তত করিয়া, শেষে গায়ের জ্বালায় অস্থির হইয়া সে একটা যুঁই ফুলের ঝোপের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল এবং সেখানে বসিয়া নগ্নদেহে বিষাক্ত অন্তঃকরণে প্রাণপণে গা চুলকাইতে লাগিল।
বন্ধু বিজয় আসিয়া যখন তাহাকে উদ্ধার করিল, তখন তাহার সবঙ্গ ফুলিয়া রাঙ্গা হইয়া উঠিয়াছে। নূতন কাপড় পরিতে পরিতে অনুরূপ হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘আর কখখনো তোদের বাড়ি আসব না, বিজয়। ঐ বিল্লুটা যতদিন—’ বলিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে হনহন করিয়া বাড়ি চলিয়া গেল। বিল্লুর দুষ্কৃতির কথা জানিতে কাহারও বাকী রহিল না। সে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করিয়া বলিল, ‘গাছে পিঁপড়ে ছিল, আমি কি করে জান্ব?’ কিন্তু তাহার এ কৈফিয়ত ধোপে টিকিল না, মালীর নিকট হইতে প্রকাশ পাইল যে, বিল্লু দিদি তাহাকেই প্রথমে গাছে চড়িয়া ফুল পাড়িতে অনুরোধ করিয়াছিল; কিন্তু গাছে ভয়ানক কাঠ-পিঁপড়া আছে বলিয়া মালী রাজী হয় নাই। ইহার পর—
ফলে বিল্লু মা বাবার কাছে বিস্তর তিরস্কার ও বিজয়ের কাছে একটা কিল ও দুইটা চড় খাইল। বিল্লু রাত্রিতে তাহার বিবাহিতা দিদি অনিলার কাছে শয়ন করিত। অনিলা শুইতে গিয়া বিল্লুকে বলিল, ‘তুই যে নাকুর ওপর অত উৎপাত করিস, ওর সঙ্গে আমরা তোর বিয়ের সম্বন্ধ করেছি, তা জানিস? ও যখন উল্টে তোর ওপর শোধ তুলবে, তখন কি করবি?’
বিল্লু ঘৃণাভরে দুই আঙ্গুল দিয়া নাক টিপিয়া ধরিয়া বলিল, ‘এ রাম—ওকে আমি বিয়ে করব না। খরগোসের মতো কান, চুল খোঁচা-খোঁচা—ওরকম বর আমি চাই না।’
‘চাই না বললেই তো আর হবে না—ওকেই বিয়ে করতে হবে। নইলে তুই জব্দ হবি না-ও প্রত্যেকবার ক্লাসে ফার্স্ট হয় জানিস?’
‘হোগগে। ঐটুকু ছেলেকে আমি বিয়ে করব না।’
‘আ গেল। তোর কি এক্ষুনি বিয়ে হচ্ছে নাকি? তোরা বড় হবি, তখন বিয়ে হবে।’
বিল্লু দৃঢ়ভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘ওকে আমি বড় হয়েও বিয়ে করব না। ওরকম বর আমার একটুও পছন্দ হয় না।
বিল্লুর পাকা কথায় সকলেই অভ্যস্ত ছিল, অনিলা জিজ্ঞাসা করিল, ‘তবে তোমার কি রকম পছন্দ শুনি?’
বিল্লু তৎক্ষণাৎ বলিল, ‘কেন, জামাইবাবুর মতো—ঐরকম লম্বা ফর্সা—চোখে চশমা।’
তাহার পিঠে একটা চড় মারিয়া অনিলা বলিল, ‘ও! লোকটিকে বড্ডই মনে ধরেছে দেখছি! আচ্ছা দাঁড়াও, তাঁকে চিঠি লিখে দিচ্ছি, তিনি এসে তোমাকে নিয়ে যান,—তুমিই গিয়ে তাঁর কাছে থাকো। আমি না হয় এখানেই পড়ে থাকব। সতীনের ঘর করা আমার পোষাবে না। তাও যেমন তেমন সতীন নয়—তোমার মতো সতীন—”
পরিহাসচ্ছলে উক্ত হইলেও আসলে অনিলার কথাটা সত্য। সুন্দরী কন্যা দেখিলেই পুত্রবতী বাঙালী-গৃহিণীর তাহাকে পুত্রবধূ করিবার ইচ্ছা হয়—অনুরূপের মাতারও তাহা হইয়াছিল। দুই পরিবারে বেশ ঘনিষ্ঠতা হইয়া যাইবার পর অনুরূপের মা বিল্লুদের বাড়ি বেড়াইতে গিয়া একদিন বলিয়াছিলেন, ‘বিল্লুর মতো একটি মেয়ে পাই—আমার বৌ করি।’
বিল্লুর মা উত্তরে বলিয়াছিলেন, ‘বিল্লুর মতো দরকার কি ভাই,—বিল্লুকেই নাও না!’
সেই অবধি দুই গৃহিণীর মধ্যে বেয়ান সম্পর্ক পাতানো হইয়া গিয়াছিল; যদিও কর্তারা এই মেয়েলি ব্যাপার শুনিয়া নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করিয়া বলিয়াছিলেন, একেই বলে গাছে কাঁঠাল গোঁপে তেল! মেয়ের বয়স আট বছর, ছেলের পনেরো—এরি মধ্যে বিয়ের কথা! আরে, বড় হোক, বেঁচে থাক, তারপর দেখা যাবে। সাধে কি আর মেয়েদের দশহাত কাপড়ে—’
অনুরূপও হাসিঠাট্টার সূত্রে বৌদিদিদের কাছে কথাটা শুনিয়াছিল। উত্তরে সে মনে মনে প্রকাণ্ড একটা ‘হুঁ’ বলিয়াছিল। বিল্লুকে বিবাহ করার চেয়ে এক লক্ষ মাছি, মশা, বোলতা ও কাঠ-পিঁপড়াকে বিবাহ করা যে ঢের বেশী বুদ্ধিমানের কাজ একথা সে প্রকাশ করিয়া না বলিলেও তাহার মনের ভাব কাহারও নিকট অগোচর ছিল না।
তারপর একদিন হঠাৎ কি কারণে বেহারীবাবু বদলী হইয়া অন্য জেলায় চলিয়া গেলেন। বিজয় ও অনুরূপ কিছুদিন সজোরে পত্রবিনিময় চালাইল। কিন্তু দূরত্বের প্রভাবে ক্রমশ অনুরাগের বন্ধন শিথিল হইয়া গেল। উভয় পরিবারও ক্রমে পরস্পরকে প্রায় ভুলিয়া গেলেন। সে আজ প্রায় নয়-দশ বৎসরের কথা।
এই নয়-দশ বৎসরে বহু পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে। এই প্রাচীনা পৃথিবীর বয়স আরও নয়-দশ বৎসর বাড়িয়াছে। যাহারা কিশোর ছিল তাহারা যুবক হইয়া পড়িয়াছে, অনেক বৃদ্ধ বৈকুণ্ঠ লাভ করিয়াছে; ততোধিক শিশু জন্মগ্রহণ করিয়াছে,—এবং আরও অনেক প্রকার বিচিত্র দার্শনিক ব্যাপার সংঘটিত হইয়া গিয়াছে।
বেহারীবাবু জেলার ম্যাজিস্ট্রেট হইয়া পুরাতন শহরে ফিরিয়া আসিয়াছেন। অনুরূপ এখানকার পড়া শেষ করিয়া বিলাত গিয়াছিল, সেখান হইতে কি একটা পাস করিয়া রেলের কভেনান্টেড চাকরি লইয়া দেশে ফিরিয়াছে। উপস্থিত বাড়িতেই আছে, মাসখানেকের মধ্যে টুণ্ডলার অফিসে যোগ দিতে হইবে। তাহার চুল এখনও খোঁচা-খোঁচাই আছে বটে, কিন্তু ততটা নহে; কান দুইটিও বোধ করি শরীরের অনুপাতে বাড়ে নাই বলিয়া এখন আর তত বড় দেখায় না। ওদিকে সুনীলা ওরফে বিল্লুর বয়স এখন সতেরো বৎসর এবং তাহার মতো ফাজিল, চপল, হৃদয়হীনা যুবতী—
সর্বাপেক্ষা বেশী পরিবর্তন ঘটিয়াছে কিন্তু বেহারীবাবুর পারিবারিক জীবনে। যত দিন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ততদিন তিনি সাধারণ বাঙালী ভদ্রলোকের মতোই পুরাতন প্রথায় জীবন কাটাইতেছিলেন। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট হইয়াই হঠাৎ পুরাদস্তুর সাহেব বনিয়া গিয়াছেন। আগে কেবল তাঁহার অফিস-রুম ছিল, এখন উপরন্তু ড্রয়িং-রুম হইয়াছে। মৈথিলী পাচক নির্বাসিত হইয়া বাবুর্চি নিযুক্ত হইয়াছে—টেবিলে বসিয়া সপরিবারে খানা ভোজন করেন। ম্যাজিস্ট্রেট-গৃহিণী বেড়াইতে বাহির হইলে কোঁচানো শাড়ি ও হাই-হিল জুতা পরেন। পর্দা একেবারে উঠিয়া গিয়াছে। কন্যা বিল্লু ম্যাট্রিক পাস করিয়া উপস্থিত টেনিস ও বৃজ্ খেলিতেছে। বিজয় একটি ব্রাহ্ম মেয়েকে বিবাহ করিয়া বাপের সহিত পৃথক হইয়া স্বাধীনভাবে পুরুলিয়ায় ওকালতি করিতেছে। ছুটিছাটায় সস্ত্রীক বাপের কাছে আসে, দুই-চার দিন থাকিয়া আবার সস্ত্রীক চলিয়া যায়।
অনুরূপ বিলাত হইতে বাড়ি ফিরিবার দিন পাঁচ-ছয় পরে তাহার মা বলিলেন, ‘ওরে, বেহারীবাবুকে মনে আছে তো?—তোর বন্ধু বিজয়ের বাবা? তিনি যে জেলার কর্তা হয়ে বসেছেন।’
তিন বৎসর পরে বাড়ি ফিরিয়া এ কয়দিন অনুরূপ পারিবারিক চক্রের বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিবার অবকাশ পায় নাই, কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তাই নাকি? কদ্দিন এসেছেন?’
‘এই তো মাস দুই হবে।’
‘তোমাদের সঙ্গে দেখাশুনা হয়েছে?’
‘হাঁ, আমরা একদিন গিয়েছিলুম। যদিও এখন ওঁরা পুরোপুরি সাহেব হয়ে গেছেন, তবু আমাদের খুব আদর-যত্ন করলেন। এখনও আগেকার কথা ভোলেননি—তোর একবার যাওয়া উচিত।’
‘বেশ তো, যাব। বিজয় কোথায়? এখানেই আছে নাকি?’
‘না, সে তো পুরুলিয়ায় ওকালতি করছে।’
অনুরূপ হঠাৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আর বিল্লু? তার বোধ হয় বিয়ে হয়ে গেছে—না?’
‘কই আর হয়েছে। এখন কি আর তাঁরা তার বিয়ে দেবেন? মেয়ের যে মোটে সতেরো বছর বয়স।’ বলিয়া মা-ও মুখ টিপিয়া হাসিলেন।
সেই দিনই বৈকালে অনুরূপ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাংলায় দেখা করিতে গেল। বাংলার সামনে একটা শান্-বাঁধানো চাতাল ছিল, সেখানে বসিয়া বেহারীবাবু সস্ত্রীক সকন্যা চা-পান করিতেছিলেন। অনুরূপ সেখানে গিয়া হাত তুলিয়া নমস্কার করিয়া স্মিতমুখে দাঁড়াইল।
বেহারীবাবু আরাম-কেদারায় অঙ্গ প্রসারিত করিয়া শুইয়াছিলেন, বিস্মিতভাবে ঈষৎ ভ্রূকুটি করিয়া তাহার দিকে চাহিলেন। গৃহিণী অপরিচিত ব্যক্তি দেখিয়া কাপড়টা মাথায় তুলিয়া দিবার চেষ্টা করিলেন; বিল্লু বিস্ফারিত-দৃষ্টিতে মুহূর্তকাল চাহিয়া থাকিয়া উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল, ‘নাকুদা! মা, চিনতে পারছ না? দাদার বন্ধু, নাকুদা—মনে নেই?’ বলিয়া আবার সেই নিতান্ত পরিচিত, কৈশোরের বহু নির্যাতনের স্মৃতি-অনুবিদ্ধ হাসি হাসিল।
‘ওমা, তাই তো! চিনতে পারিনি—কতদিন পরে দেখলুম! এস বাবা। এই সেদিন বিজয় তোমার কথা বলছিল। —’
‘By Jove! Young man, you have grown out of all recognition! Well! Well! Very glad to see you. Sit down. Sit down.’
অনুরূপ একটি চেয়ার টানিয়া বসিল। বিল্লু এক পেয়ালা চা ঢালিয়া তাহার দিকে অগ্রসর করিয়া দিয়া বলিল, ‘নাকুদা, চা খাও।’ তাহার ঠোঁটের কোণে একটু চাপা হাসি। অনুরূপ সচকিত হইয়া ভাবিল, সে কি এখানে আসিয়াই হাস্যকর কিছু করিয়া ফেলিয়াছে? নিজের কথাবাতার উপর একটা কড়া পাহারা বসিয়া গেল।
নানা রকম কথা হইতে লাগিল; অনুরূপ বিলাতে গিয়া কোথায় ছিল, কি পাস করিয়াছে, কোথায় চাকরি পাইল; বেহারীবাবু কতদিন ম্যাজিস্ট্রেট হইয়াছেন, কোন্ কোন্ জেলা ঘুরিয়াছেন, কমিশনার সাহেব তাঁহার নামে সরকারের কাছে কি কি প্রশংসাসূচক ডি. ও. দিয়াছেন,—এই সব আলোচনার মধ্যে অনুরূপের মনটা কিন্তু বিল্লুর দিকেই সতর্ক হইয়া রহিল। দুই একবার বিল্লুর মুখের উপর চোখ পড়াতে দেখিল, সে তাহারি দিকে তাকাইয়া আছে ও পূর্ববৎ মুখ টিপিয়া টিপিয়া আসিতেছে। যেন সে একটা ভারী হাস্যোদ্দীপক জীব,—তাহাকে দেখিলে কিছুতেই না হাসিয়া থাকা যায় না।
অনুরূপ উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিতে লাগিল।
হঠাৎ এক সময় অন্য কথার মাঝখানে বিল্লু বলিয়া উঠিল, ‘মা, দেখেছ, নাকুদার চুল আর আগেকার মতো খাড়া-খাড়া নেই—একটু নরম হয়েছে। আচ্ছা, নাকুদা, তুমি ছেলেবেলার মতো এখনও তেমনিই বোকা আছ? না বুদ্ধি বেড়েছে?’
অনুরূপ হাসিবার মতো মুখ করিয়া বলিল, ‘কি জানি। তোমার কি মনে হয়?’
‘এখনই কি বলা যায়? আরও দু’দিন দেখি।’
‘তুই চুপ কর, বিল্লু। আমাদের কি কথা হচ্ছিল।’ এইভাবে কন্যাকে মৃদু তিরস্কার করিয়া গৃহিণী আবার ব্যাহত প্রসঙ্গ আরম্ভ করিলেন।
ঘণ্টা দেড়েক পরে অনুরূপ যখন বিদায় লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, তখন বিল্লু ঠোঁটের একটা সহাস্য ভঙ্গিমা করিয়া বলিল, ‘নাকুদা, কাল আবার আসবে তো?’
অনুরূপ তাহার দিকে ফিরিয়া কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসুভাবে তাকাইয়া রহিল, কথাটার মধ্যে কোনও প্রচ্ছন্ন পরিহাস আছে কিনা, তাহাই যেন নিরূপণ করিবার চেষ্টা করিল; তারপর বলিল, ‘আসব বৈ কি! যে ক’দিন আছি, রোজই আসব।’
অনুরূপ বাড়ি ফিরিবার পথে ভাবিতে লাগিল, তাহার প্রতি বিল্লুর মনের ভাবটা কি?—বিদ্রুপ? উপহাস? তাচ্ছিল্য?
কিন্তু কেন? ছেলেবেলায় বিল্লু তাহাকেই বিশেষ করিয়া নিজের উৎপাত ও নিষ্ঠুরতার লক্ষ্যবস্তু করিয়া লইয়াছিল,—এখনও কি তাহার সে ভাব যায় নাই? কিংবা সকলের সঙ্গেই সে এইরূপ ব্যবহার করিয়া থাকে?
সবচেয়ে অনুরূপকে বিঁধিয়াছিল বারবার ঐ ‘নাকুদা’ সম্বোধনটা; যেন ঐ নামটা কিরূপ হাস্যকর তাহাই বিল্লু পুনঃ পুনঃ খোঁচা দিয়া দেখাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছিল। সত্য বটে, নামটি শ্রুতিসুখকর নয়, কিন্তু তাই বলিয়া সেও কি উপহাসের পাত্র?
অনুরূপ ঈষৎ তিক্ত-মনে ভাবিল, আমাদের মেয়েরা একটু লেখাপড়া শিখিলেই মনে করে, কেহ তাহাদের সহিত কথা কহিবার সমকক্ষ নহে।
কিন্তু—বিল্লু কি অপরূপ সুন্দরী হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহার দিকে বেশীক্ষণ তাকাইতে যেন ভয় করে!–অথচ ইহাকেই সে একদিন কিল মারিয়াছে, চড় মারিয়াছে, কান ধরিয়া টানিয়া দিয়াছে, বাঁদরী, পোড়ারমুখী বলিয়াছে—
পাঠক নিশ্চয় এইখানে বিল্লুর একটি রূপ বর্ণনার জন্য উন্মুখ হইয়া আছেন, কিন্তু তাঁহাকে নিরাশ হইতে হইবে। আমি ধর্মভীরু লোক, রূপ বর্ণনা দিব না, পরের ভাল জিনিসের প্রতি লুব্ধতা সঞ্চার করিয়া নরকে যাইতে পারিব না। আমি শুধু দু’ছত্রে তাহার আজিকার বেশভূষার একটি অসম্পূর্ণ তালিকা দিব, তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে। গায়ে তাহার ছিল গাঢ় সবুজ রঙের হাতকাটা ব্লাউজ, পরিধানে ছিল ঐ রঙেরই সিল্কের শাড়ি, পায়ে ছিল লাল বনাতের স্লিপার, চুলগুলি কিভাবে জড়ানো ছিল তাহার শিল্পরহস্য আমি ভেদ করিতে পারি নাই; সুতরাং বলিতে পারিলাম না। অলঙ্কার তাহার গায়ে ছিল না বলিলেই হয়—কেবল দু’গাছি সরু সোনার রুলি সুগোল হাতে যেন চাপিয়া বসিয়া গিয়াছিল, আর গলায় ক্ষীণ একটি হার—তাহার নিম্নপ্রান্তে একটি হীরার লকেট—
আর এই সব বেশভূষা যে তরুণ তনুটিকে আশ্রয় করিয়া ছিল—
ঐ রে! আর একটু হইলেই আরম্ভ করিয়া দিয়াছিলাম আর কি!
সে রাত্রিতে বেহারীবাবু ও তাঁহার স্ত্রীর মধ্যে কথা হইল। গৃহিণী বলিলেন, ‘অনুরূপের সঙ্গে বিল্লুর বিয়ে হলে মন্দ হয় না। আগেও তো একবার সম্বন্ধ হয়েছিল।’
কর্তা বলিলেন, ‘বেশ তো, ওরা আসুক না আমার কাছে, প্রস্তাব করুক—’
‘কিন্তু তা কি ওরা করবে! হাজার হোক, ওরা বর পক্ষ। আমাদের দেশে যে উল্টো নিয়ম, মেয়ের বাপকেই ছুটোছুটি করতে হয়।’
‘কিন্তু তাই বলে আমি তো আর উপযাচক হয়ে যেতে পারি না। বুঝলে না?’
গৃহিণী বুঝিলেন, হাকিমি মর্যাদায় বাধে। কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘দেখা যাক, আরও দু’দিন আসা যাওয়া করুক। শেষ পর্যন্ত হয়তো নিজেই—বিলেত ফেরত তো।’
কর্তা বলিলেন, ‘সে হলে তো কোনও গোলই থাকে না। তার উপর আর একটা কথা আছে। বিল্লুর পছন্দ অপছন্দ জানা দরকার। ও আবার যে রকম মেয়ে! মনে আছে তো, হাজারিবাগের সেই মুনসেফ ছোকরা! তাকে তো হেসেই উড়িয়ে দিলে, যেন সে মানুষের মধ্যেই গণ্য নয়। The heartles little minx!’ বলিয়া সস্নেহে হাসিতে লাগিলেন।
পরদিন সন্ধ্যাবেলা অনুরূপ ম্যাজিস্ট্রেটের কুঠিতে উপস্থিত হইয়া শুনিল—সাহেব ও মেমসাহেব একটা পার্টিতে গিয়াছেন,—কেবল মিসিবাবা বাড়িতে আছেন, উপস্থিত বাগানে বেড়াইতেছেন। অনুরূপ মিসিবাবার সন্ধানে প্রবেশ করিল।
একটা লোহার বেঞ্চির উপর বিল্লু পিছন ফিরিয়া বসিয়াছিল, তাহার বসিবার ভঙ্গি দেখিয়া অনুরূপের মনে হইল, সে কোলের উপর বই রাখিয়া পড়িতেছে। ছাঁটা ঘাসে ঢাকা লনের উপর দিয়া অনুরূপ নিঃশব্দে তাহার দিকে অগ্রসর হইল।
বেঞ্চির কাছে পৌঁছিতে যখন আর হাত ছয়-সাত বাকী আছে, তখন বিল্লু হস্তস্থিত জিনিসটা মুখের কাছে তুলিয়া চুম্বন করিল, তারপর সচকিতে কিছুক্ষণ ফিরিয়া চাহিয়াই অনুরূপকে দেখিয়া তড়িদ্বেগে উঠিয়া দাঁড়াইল।
এইরূপ অবস্থায় যে ধরা পড়ে, তাহার যেমন লজ্জার অবধি থাকে না, যে ধরিয়া ফেলে, সেও কম লজ্জা পায় না। অনুরূপ আরক্ত-মুখে আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
যে লকেটে বিল্লু চুম্বন করিয়াছিল, তাহা তখনও তাহার হাতে ধরা ছিল, সেটা বন্ধ করিয়া বুকের কাপড়ের তলায় চাপা দিয়া বিল্লু শুষ্ক হাসিল, বলিল, ‘চুপি চুপি একেবারে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছ যে!’ তাহার কণ্ঠস্বরে বিরক্তি ও অসন্তোষ সুস্পষ্ট।
অনুরূপ চুপি চুপি আসে নাই, পায়ের তলায় ঘাস ছিল বলিয়াই বিল্লু তাহার পদশব্দ শুনিতে পায় নাই। কিন্তু সে কৈফিয়ত দিতে যাওয়া বৃথা। হয়তো তাহার গলা-ঝাড়া দিয়া আগমন-বার্তা ঘোষণা করা উচিত ছিল। সে চুপ করিয়া রহিল।
বিল্লু বলিল, ‘এখানেই বসবে, না, ভেতরে যাবে? মা-বাবা পার্টিতে গেছেন।’
অনুরূপ চেষ্টা করিয়া বলিল, ‘যেখানে হয়—এখানেই বোসো।’
দুইজনে বেঞ্চিতে বসিল।
কিছুক্ষণ অস্বচ্ছন্দভাবে দুই একটা কথা হইল, তাহার পর বিল্লুর মুখের অপ্রসন্নতা কাটিয়া গেল। সে হাসিয়া বলিল, ‘আচ্ছা নাকুদা, বিলেতে থাকতে তুমি ইংরেজ মেয়েদের সঙ্গে মিশতে?’
অনুরূপ সাবধানে বলিল, ‘কিছু কিছু মিশেছি।’
বিল্লু জিজ্ঞাসা করিল, ‘তারা তোমায় দেখে হাসত না?’
অধর দংশন করিয়া অনুরূপ বলিল, ‘না। হাসবে কেন?’
‘অমনি’ বলিয়া বিল্লু নিজেই জোরে হাসিয়া উঠিল।
ক্ষুব্ধভাবে কিয়ৎকাল চুপ করিয়া থাকিয়া অনুরূপ বলিল, ‘আমাকে দেখলেই তোমার হাসি পায়—না?’
‘হ্যাঁ—বড্ড।’ —বলিয়া হাসির বেগ রোধ করিতে না পারিয়া বিল্লু মুখে রুমাল চাপিয়া ধরিল।
ধীরভাবে অনুরূপ জিজ্ঞাসা করিল, ‘কেন বলতো?’
‘কি জানি—তোমাকে দেখলেই—’ কথাটা বিল্লু শেষ করিতে পারিল না।
মিনিট দুই শক্তভাবে বসিয়া থাকিয়া অনুরূপ হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল, ‘আচ্ছা, চললুম!’
রুমাল হইতে মুখ তুলিয়া বিল্লু বলিল, ‘রাগ হল নাকি?’
‘না।’
কয়েক পা যাইবার পর বিল্লু তাহাকে ফিরিয়া ডাকিল, ‘নাকুদা, তুমি বৃজ্ খেলতে জান?’
‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ ভাবে দাঁড়াইয়া অনুরূপ বলিল, ‘জানি সামান্য।’
বিল্লু বলিল, ‘গোড়ায় সবাই ঐ কথাই বলে; তোমারও আবার বিনয় হচ্ছে নাকি?’—কাল সন্ধ্যের পর আমাদের বাড়িতে একটা বৃজ্ পার্টি বসবার কথা আছে। খেলতে জানে এমন দু’জন লোক পাওয়া গেছে—কেবল একজনের অভাব হচ্ছে। তুমি আসতে পারবে?
উদাসভাবে অনুরূপ বলিল, “যদি অভাব হয়—আসতে পারি। কিন্তু আমি ভাল খেলতে জানি না—’
হাসি গোপন করিয়া বিল্লু বলিল, ‘এসো তাহলে। ঠিক সাতটার সময়!’
রাত্রিতে ঘুমাইয়া অনুরূপ স্বপ্ন দেখিল,—বিল্লু পিছন হইতে তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া আবদারের সুরে বলিতেছে, ‘নাকুদা, আমায় দুটো ফুল তুলে দেবে ভাই?’
অনুরূপ ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল—আট বছরের বিল্লু নহে, সতেরো বছরের বিল্লু। ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইতেই—ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল।
এমন বিশ্রীভাবে ঘুম ভাঙ্গিয়া যায় কেন, কেহ বলিতে পারেন?
পরদিন সন্ধ্যায় অনুরূপ যথাসময়ে উপস্থিত হইয়া দেখিল, দুইজন ভদ্রলোক হাজির আছেন। তাঁহাদের সহিত পরিচয় হইল, দুইজনেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, বয়সে তরুণ, বেশ সুপুরুষ। একজনের নাম সমরেশ, অন্যের নাম সুধাংশু। বিন্দু পরিচয় করিয়া দিতে গিয়া বলিল, “ইনি আমার দাদার ছেলেবেলার বন্ধু—অনুরূপবাবু,—ওঁর একটা ডাকনাম আছে, কিন্তু সে নামটা আর শুনে কাজ নেই।’ বলিয়া হাসিয়া ফেলিল।
অনুরূপ লক্ষ্য করিল, এই দুইজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে বিল্লুর ব্যবহার সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের। তাহাদের দেখিয়া সে হাসিতেছে না, কথার মধ্যে তীক্ষ কাঁটার খোঁচা নাই। বেশ সহজ সমপূর্ণ বন্ধুত্বের ভাব।
তাস খেলিতে বসিয়া বিল্লু অনুরূপের খেঁড়ী হইল। কিন্তু তবু খেলা জমিল না। খেলিতে খেলিতে অনুরূপ কেবলই ভাবিতে লাগিল, এই দুইজনের মধ্যে কাহার ছবি বিল্লুর বুকের মধ্যে লকেটের ভিতর লুকানো আছে? কে তিনি? সুধাংশু না সমরেশ?
এইরূপ প্রশ্নসঙ্কুল মন লইয়া ভাল বৃজ্ খেলা চলে না। আধ ঘণ্টা পরে বিল্লু তাস ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; বলিল, ‘নাঃ নাকুদা, তুমি একেবারে কিছু খেলতে জান না। —আসুন, তার চেয়ে অন্য কিছু করা যাক।’
অনুরূপ আরক্ত-কর্ণমূলে বলিল, ‘আমি তো বলেছিলুম, আমি ভাল জানি না—’
তাহার কথার উত্তর না দিয়া বিষ্ণু বলিল, ‘সুধাংশুবাবু, আপনি তো চমৎকার গাইতে পারেন। চলুন, ও ঘরে অর্গান আছে।’
রসশাস্ত্রের বড় বড় পণ্ডিতরা বলিয়াছেন, করুণ রস বেশী ফেনাইতে নাই; নিতান্তই যদি জবাই করিবার দরকার হয়, তবে চটপট সে কাজ সারিয়া ফেলাই বিধি। সুতরাং এই পতঙ্গ ও দীপশিখার উপাখ্যান টানিয়া দীর্ঘ করিয়া আর শাস্ত্রবিধি লঙঘন করিব না।
মোট কথা, অগ্নিশিখার সংস্পর্শে পতঙ্গের পাখা পুড়িয়া গেল, গায়েও সর্বত্র ফোস্কা পড়িল। কিন্তু তবু সে পলাইতে পারিল না এবং মুখ ফুটিয়া বলিতেও পারিল না—‘ওগো দীপ্তিময়ী শিখা, আমি তোমাকে চাই, তুমি আমাকে নিঃশেষে পুড়াইয়া ছাই করিয়া দাও।’ সে প্রত্যহ সন্ধ্যায় নিয়মিত শিখার কাছে আসিতে লাগিল এবং নীরবে পাখার খানিকটা পুড়াইয়া দহনক্লিষ্ট-দেহে ফিরিয়া যাইতে লাগিল।
এইভাবে একমাস কাটিয়া গেল। অনুরূপের টুণ্ডলায় গিয়া অফিসে যোগ দিবার সময় উপস্থিত হইল।
বিদেশে যাত্রার আগের রাত্রিতে বেহারীবাবুর বাংলায় অনুরূপের নিমন্ত্রণ হইল—বিদায়-ভোজ। নিতান্তই ঘরোয়া ব্যাপার—আর কেহ নিমন্ত্রিত হয় নাই, শুধু অনুরূপ!
সন্ধ্যার পর হইতে ড্রয়িং-রুমে বসিয়া চারিজনে অলসভাবে গল্প করিয়া শেষে আহার করিতে গেলেন। তারপর প্রায় নীরবে ডিনার শেষ করিয়া ড্রয়িং-রুমে আসিয়া বসিলেন। অনুষ্ঠানটার গোড়া হইতে শেষ পর্যন্ত কেমন যেন প্রাণসঞ্চার হইল না, কোন্ অজ্ঞাত কারণে উহা কুণ্ঠিত ও কৃত্রিম হইয়া রহিল।
আহারাদি শেষ হইবার পরই বিল্লু উঠিয়া গিয়াছিল, অনুরূপকে একটা বিদায়-সম্ভাষণ করিয়া যাওয়াও প্রয়োজন মনে করে নাই। তাহার এই অবহেলা তাহার মা বাবাও লক্ষ্য করিয়াছিলেন, তাই রাত্রি দশটার সময় অনুরূপ যখন তাঁহাদের পদধূলি লইয়া বিদায় চাহিল, তখন তাহাকে যথারীতি আশীর্বাদ করিয়া গৃহিণী একটু অপ্রস্তুত ভাবে বলিলেন, ‘বিল্লুর আজ শরীরটা ভাল নেই, সকাল থেকেই বলছিল। বোধ হয় শুয়ে পড়েছে।’
‘থাক, তাকে বিরক্ত করে কাজ নেই।’
অনুরূপ বাহির হইয়া পড়িল। চন্দ্রহীন রাত্রি—বোধ হয় অমাবস্যা। বাড়ির সদর হইতে কম্পাউন্ডের ফটক প্রায় একশ’ গজ দূরে। অন্ধকারে পরিচিত পথ ধরিয়া যাইতে যাইতে অনুরূপ ভাবিতে লাগিল—এই একমাস ধরিয়া কি উৎকট পাগলামিই না সে করিয়াছে! বিল্লু আর কাহাকেও ভালবাসে (বোধ হয় তিনি সুধাংশুবাবু), তাহা স্পষ্ট বুঝিয়াও নিজেকে এমন ভাবে খেলো করিবার কি দরকার ছিল? উঠিতে বসিতে বিল্লু তাহাকে বিদ্রুপ করিয়াছে, অন্যের সম্মুখে হাস্যাস্পদ করিয়াছে, সে যে অতিশয় কৃপার পাত্র, তাহা বুঝাইয়া দিতে ত্রুটি করে নাই। তবু সে নির্লজ্জ মূঢ়ের মতো লাগিয়াছিল কোন্ দুর্দৈবের প্ররোচনায়? ভাগ্যে তাহার মনের কথা প্রকাশ হইয়া পড়ে নাই, নহিলে আরও কত বিড়ম্বনা সহ্য করিতে হইত, কে জানে? কিন্তু যাক, আজ এই হাস্যকর অভিনয়ের সমাপ্তি হইয়াছে, প্রহসনের শেষ দৃশ্যে যবনিকা পড়িয়া গিয়াছে। অভিনয়কালে দর্শকরা আসিয়াছিল বটে, কিন্তু অভিনেতার মনে সুখ ছিল না। এখন সুখ না হোক অন্তত সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিবে।
ফটক খুলিবার জন্য হাত বাড়াইতেই কাহার হাত হাতে ঠেকিয়া গেল, অনুরূপ চমকিয়া উঠিয়া বলিল, ‘কে?’
‘নাকুদা নাকি? যাচ্ছ?’—বিল্লুর কণ্ঠস্বর।
অনুরূপ হঠাৎ হাসিয়া উঠিল। তাহার মনের মধ্যে একটা আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটিয়া গেল। এতটা স্বচ্ছন্দ বেপরোয়া ভাব সে অনেক দিন অনুভব করে নাই, যেন মস্ত একটা সংশয়ের বোঝা বুক হইতে নামিয়া গিয়াছে, এমনি ভাবে বলিল, ‘হ্যাঁ ভাই, চললুম। কাল বিকেলেই রওনা হতে হবে, কাজেই এ-যাত্রা আর বোধহয় তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে না। ভালই হল, আমি তো ভেবেছিলুম, তুমি শুয়ে পড়েছ—’
‘না—আমি রোজ এই সময় একটু বেড়াই।’
এতক্ষণে অনুরূপের ঠাহর হইল যে বিল্লু ফটকে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া কথা কহিতেছে, —অন্ধকারে কৃষ্ণতর একটা ছায়ামাত্র, মুখ চোখ কিছুই দেখা গেল না।
সে বলিল, ‘কিন্তু আর বাইরে থাকা বোধ হয় ঠিক হবে না। রাত কম হয়নি। এ সময় একটু হিমও পড়ে!’
সে কথার উত্তর না দিয়া বিল্লু জিজ্ঞাসা করিল, ‘তোমার কর্মস্থল কোথায় বলছিলে? কানপুরে?’
অন্ধকারে অনুরূপ হাসিল, ‘না—তবে কাছাকাছি বটে। টুণ্ডলায়।’
‘ও’—কিয়ৎকাল দুইজনেই নীরব।
সহসা অনুরূপ তরল কণ্ঠে বলিল, ‘আমি চলে গেলে কিছুদিন তোমার ভারী কষ্ট হবে—না?’
‘কষ্ট হবে? কেন?’—তাহার উত্থিতভ্রূ ঈষৎ বিস্ময়ের ভঙ্গি দেখা না গেলেও বুঝা গেল।
‘এমন একটা target— একটা সঙ—আর কি সহজে খুঁজে পাবে? যাকে দেখলেই হাসি পায়, এমন লোক তো পৃথিবীতে বেশী নেই কি না, তাই ভাবছি প্রথম প্রথম হয়তো একটু কষ্ট হবে। তাহার কণ্ঠস্বরে গ্লানির লেশমাত্র নাই।
কিছুক্ষণ বিল্লু জবাব দিল না, তারপর বলিল, ‘তোমাকে আজ ভারী খুশি মনে হচ্ছে।’
‘খুশি?’ অনুরূপ অল্পকাল আত্মানুসন্ধান করিয়া বলিল, ‘না, ঠিক খুশি নয়—তবে মনটা একটু হাল্কা বোধ হচ্ছে—কাজকর্ম নেই চুপ করে বসে থাকতে আর ভাল লাগছিল না—সেই জন্যই বোধ হয়—’
বিল্লুর হাসি শুনা গেল, ‘তুমি আজকাল ভারী কাজের লোক হয়ে উঠেছ—না?’
‘হইনি এখনও—তবে পাকে-চক্রে পড়ে হয়তো শেষ পর্যন্ত হয়ে পড়তে পারি।’
‘তুমি কোনও কালে কাজের লোক হতে পারবে না।’
‘পারব না? কেন বল দেখি?’
‘তুমি একেবারে—একেবারে অপদার্থ।’—সঙ্গে সঙ্গে চাপা হাসির শব্দ।
কিছুক্ষণ সমস্ত নিস্তব্ধ,—যেন অন্ধকারে দুইজন মুখোমুখি দাঁড়াইয়া নাই। পাঁচ মিনিট কাটিয়া গেল।
অন্ধকারে একটা গভীর নিশ্বাস পড়িল। অনুরূপ বলিল, ‘তোমার সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে, কে জানে! হয়তো আর কখনও—আচ্ছা বিল্লু, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? কিছু মনে করো না, আমি রাগ বা অভিমান করে বলছি না, শুধু একটা কৌতূহল হচ্ছে। তুমি যে আমাকে কথায় কথায় ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে, লোকের কাছে হাস্যাস্পদ করতে—আমার কি সত্যিই কোনও দোষ ছিল? আমি নিজে অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারিনি, তাই জান্তে চাইছি। কি জানি, হয়তো না জেনে প্রতিপদেই এমন নির্বুদ্ধিতা কিংবা অসভ্যতা করে ফেলেছি—’
বিল্লু আবার হাসিয়া উঠিল, তাহার চাপা অথচ দুর্নিবার হাসির ঢেউ অনুরূপের কথাগুলি ভাসাইয়া লইয়া গেল।
অত্যন্ত আহতস্বরে অনুরূপ বলিল, ‘বিল্লু! হাসি নয়। সত্যি বল আমি কী অন্যায় করেছিলুম—’
‘চুপ কর। আমি আর পারছি না—তোমার মতো বোকা—’
‘বোকা! তাই হবে বোধ হয়। আর একটা নিশ্বাস পড়িল, ‘আচ্ছা চললুম।’
অনুরূপ ফটক খুলিল।
‘যাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ’—অনুরূপ ফটকের বাহির হইল।
‘—আচ্ছা—এস’—আবার সেই হাসি।
ঠিক এই সময়—উস্কার আলো!
অন্ধকার আকাশের একপ্রান্ত হইতে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত আলোর দাগ কাটিয়া একটা উল্কাপিণ্ড ফাটিয়া পড়িল। কয়েক মুহূর্তের জন্য তাহারই উজ্জ্বল নীল প্রভায় অনুরূপ দেখিল, বিল্লুর চোখের জলে মুখ ভিজিয়া গিয়াছে এবং সে দু’হাতে বুক চাপিয়া ধরিয়া—
যাহা অনুরূপ চাপা হাসি বলিয়া ভুল করিয়াছিল, তাহা অদম্য রোদনের উচ্ছ্বাস!
আবার অন্ধকার।
‘বিল্লু!’
‘কি?’—স্বর ক্ষুদ্র ও ক্ষীণ।
‘আমি বুঝতে পারিনি। আমি ভেবেছিলুম—তুমি আর কাউকে’— বিল্লুর নিকট হইতে কোনও জবাব আসিল না।
‘তোমার লকেটে—’ অনুরূপের এ কথাটাও অসমাপ্ত রহিয়া গেল।
কিয়ৎকাল পরে বিল্লুর হাত অনুরূপের হাতে ঠেকিল, বিল্লু একটা ঈষদুষ্ণ ক্ষুদ্র বস্তু তাহার করতলে রাখিয়া হাত টানিয়া লইল। অনুরূপ অনুভব করিয়া বুঝিল—লকেট।
বলিল, ‘এ কি হবে?’
‘নাও। ওর মধ্যে একটা মুণ্ডু আছে, চিনতে পার কি না দেখো।’
‘বিল্লু!’
উত্তর নাই। অনুরূপ আবার ডাকিল, ‘বিল্লু!’
বিল্লুর সাড়া পাওয়া গেল না। সে বোধ হয় পা টিপিয়া চলিয়া গিয়াছে।
প্রশ্ন হইতে পারে, বিন্দুর মনে যদি ইহাই ছিল, তবে সে এমন ব্যবহার করিল কেন? ইহার উত্তর বোধ করি বিল্লু নিজেও দিতে পারিবে না। তাই গোড়ায় বলিয়াছিলাম, এ গল্পের নাম হওয়া উচিত ছিল—স্ত্রিয়াশ্চরিত্রং—কিংবা—
২৩ চৈত্র ১৩৩৯