উলট-পুরাণ

উলট-পুরাণ

বাইরের জরুরি কাজ সেরে ফিরতে এবার একটু দেরিই হল বজ্রবাহুর। কাজটাও ছিল ঝামেলার আর দূরত্বটাও বড়ো কম নয়। তবে দেরি হলেও বাড়ির খবর নিয়মিতই পেয়েছেন। তাঁর মা, বাবা, স্ত্রী এবং খোকা—খুকিরা ভালোই আছে। আড়াই হাজার বছরে আর এমন কী—ই বা বিশেষ পরিবর্তন হবে।

এই আড়াই হাজার বছর শুনতে যতটা, কার্যত তো ততটা নয়। কারণ মহাকাশ পাড়ি দিয়ে ভিন্ন নক্ষত্রপুঞ্জে যেতে যেতে আপেক্ষিক নিয়মে যতটা সময় লাগে, তার ঢের বেশি সময় পৃথিবীতে অতিক্রান্ত হয়। আর কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে সময় তো টেরও পাওয়া যায় না। বজ্রবাহু যে—নক্ষত্রের মণ্ডলে গিয়েছিলেন সে—নক্ষত্রটি সূর্যের চেয়ে দশগুণ বড়ো। আর তার মণ্ডলে রয়েছে অন্তত আড়াইশো সবুজ সজীব গ্রহ, যার প্রত্যেকটিই মানুষের পক্ষে বাসযোগ্য। তাদের মধ্যে অন্তত কুড়িটিতে অতি সুসভ্য সব জীবের বাস, যারা অনেকটাই মানুষের মতো। তবে বিজ্ঞানে তেমন উন্নতি করেনি। এইসব গ্রহ—গ্রহান্তরে ঘুরে ঘুরে বিস্তর গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে বজ্রবাহু ও তাঁর দলকে। তাঁদের সফর খুবই সফল হয়েছে, পৃথিবীতে তাঁদের খুবই প্রশংসা হচ্ছে। আলোর চেয়েও বহু—বহুগুণ গতিবেগসম্পন্ন কণিকা তরঙ্গের মাধ্যমে পৃথিবীর সঙ্গে তাঁদের নিত্যই কথাবার্তা হত। নতুন এই মণ্ডলের সুসভ্য প্রাণীদের কয়েকজনকে নিয়ে আসতে পারলে ভালো হত। কিন্তু জীবগুলি খুবই আদুরে। তাদের গ্রহগুলিতে এত খাদ্যশস্য, এত ভালো আবহাওয়া এবং এমনই আরামে তারা আছে যে, মাথা ঘামিয়ে বা খেটেখুটে কিছুই করতে হয় না। ফলে তারা বিজ্ঞান—প্রযুক্তি এসব নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায় না। খায়দায়, দিনরাত ফুর্তি করে। তবে মোটরগাড়ি বা এরোপ্লেনের মতো সেকেলে যানবাহন তাদের আছে। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, বিজলি বাতি আছে। তার চেয়ে বেশিদূর আর এগোয়নি। এগোতে বিশেষ আগ্রহও নেই। বজ্রবাহু প্রায় এক হাজার বছর ধরে এইসব গ্রহ ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বুদ্ধিমান জীবকে উন্নত প্রযুক্তিতে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। তারা একটু শেখে, তারপর আর গা করে না। এমনকী যে—বিজ্ঞানের বলে পৃথিবীর মানুষ অমরত্ব অর্জন করেছে তাও তারা একরকম প্রত্যাখ্যানই করেছে। তাদের ভাবখানা হল, প্রকৃতির নিয়মে যা হওয়ার হবে, আমাদের বেশি আকাঙ্ক্ষা নেই। ফলে তারা কেউই বজ্রবাহুর সঙ্গে পৃথিবীতে আসতে চায়নি। এই একটা ব্যর্থতা ছাড়া বজ্রবাহুর সফর খুবই সফল। তিনি নানা অদ্ভুত উদ্ভিদ ও মাটি, ধাতু ও শিলাখণ্ড এনেছেন। এনেছেন ওইসব গ্রহের নানা শিল্পের নমুনা। আরও অনেক কিছু।

পৃথিবীর মহাজাগতিক অবতরণ—কেন্দ্রে তাঁদের খুব জাঁকালো রকমের স্বাগত জানানো হয়েছে। বিশ্বরাষ্ট্রপতি স্বয়ং এসে তাঁদের অভ্যর্থনা ও সংবর্ধনা জানিয়েছেন। বজ্রবাহু ও তাঁর দলের পাঁচ—শো জন সদস্য পৃথিবীতে নেমে দেখলেন সবই সেই আড়াই হাজার বছর আগেকার মতোই আছে। তেমন সাংঘাতিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিছু নতুন বাড়িঘর, রাস্তাঘাট হয়েছে মাত্র। পৃথিবীর বিজ্ঞান এমন চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে গেছে যে, নতুন কিছু আবিষ্কারও আর তেমন ঘটে না। মানুষ অমরত্ব অর্জন করায় আর নতুন মানুষ জন্মায় না। তবে কিছু মানুষ যখন অন্য গ্রহে স্থায়ীভাবে বাস করতে চলে যায় তখন কিছু মানুষকে জন্মগ্রহণ করতে দেওয়া হয়।

অভ্যর্থনাকারীদের মধ্যে বজ্রবাহুর বাবা, মা, স্ত্রী ও ছেলে—মেয়েরাও ছিল। সকলেই একই রকম আছে। কারও বয়সই তিন—চার হাজারের কম নয়। শুধু ছোটোরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে, এ ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন নেই। বজ্রবাহুকে দেখে তাঁরা সকেলেই যথোচিত আনন্দ প্রকাশ করলেন। বাড়িতে ফিরে বজ্রবাহু বহুদিন পরে পোস্তচচ্চচড়ি আর চালতার অম্বল দিয়ে ভাত খেলেন। যেসব গ্রহে গিয়েছিলেন সেখানকার খাদ্যদ্রব্য অন্যরকম। পুরোনো অভ্যস্ত খাবার খেয়ে বহুকাল পর ভারি খুশি হলেন বজ্রবাহু। সকলের সঙ্গে বসে গল্প—টল্প করলেন কিছুক্ষণ। তারপর বিভিন্ন মিটিং ও সংবর্ধনা সভায় যেতে হল।

এরকমই একটা মিটিঙে তাঁর সফরসঙ্গীদের অন্যতম পুণ্ডরীক বজ্রবাহুকে কানে কানে বলল, ‘ওহে বজ্রবাহু, মানুষের হাসিখুশির ভাবটা বেশ খানিকটা কমে গেছে, লক্ষ করেছ?’

বজ্রবাহুর হঠাৎ মনে হল, পুণ্ডরীক মিথ্যে কথা বলেনি। সত্যিই, ওপর ওপর সবাই একটা খুশিয়াল ভাব দেখাচ্ছে বটে, কিন্তু কেমন যেন প্রাণহীন। নিজের স্ত্রী, ছেলে—মেয়ের মধ্যেও যেন এটাই আজ লক্ষ করেছেন তিনি, কিন্তু ধরতে পারেননি।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার বলো তো পুণ্ডরীক! আড়াই হাজার বছরে এমন কী হল?’

পুণ্ডরীক মাথা চুলকে বলে, ‘কিছুই তো হওয়ার কথা নয়। পৃথিবীর কোনো পরিবর্তন দেখছি না। বিবর্তনও বহুকাল হল থেমে গেছে। মানুষের কোনো দুঃখ বা অভাব নেই। সুতরাং কী ঘটতে পারে তা বুঝে ওঠা মুশকিল। তবে একটা জিনিস লক্ষ করছি, পৃথিবীতে আগের তুলনায় গাছপালা কিছু বেড়ে গেছে।’

বজ্রবাহু ভ্রূ কুঁচকে বলেন, ‘গাছপালা বেড়ে গেছে? কিন্তু সেরকম তো কথা নয়! আবহমণ্ডলের জন্যে যতটা প্রয়োজন ঠিক ততটাই গাছপালা পৃথিবীতে থাকার কথা।’

পুণ্ডরীক মাথা সামান্য নেড়ে বলে, ‘উদ্ভিদ—উপদেষ্টার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনি এ—ব্যাপারে বেশি কিছু বলতে চাইছেন না। শুধু বললেন, গাছ বাড়লে শেষ অবধি মানুষের উপকারই হবে। কথাটা হেঁয়ালির মতো ঠেকল। কিন্তু উনি আর ভাঙলেন না।’

বজ্রবাহু নিজে আবহাওয়া ও উদ্ভিদের একজন বিশেষজ্ঞ। কথাটা তাঁরও হেঁয়ালির মতো ঠেকল। মানুষজন, জন্তুজানোয়ার এবং আবহাওয়ার একটা অনুপাত হিসেব করেই গাছপালার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। গাছ বাড়লে মানুষের কী উপকার হবে তা বজ্রবাহুর মাথায় এল না।

পৃথিবীতে আড়াই হাজার বছরের মেলা বকেয়া কাজ জমে আছে। ফলে বজ্রবাহু ও তাঁর দলবল এসব সামান্য ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামালেন না। তাঁরা বকেয়া কাজ সারতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তবে আজকাল কাজকর্ম বেশিরভাগই যন্ত্রের মাধ্যমে সমাধা হয়ে যায় বলে তেমন গা ঘামাতে হয় না। বজ্রবাহুদের খাটতে হচ্ছিল অন্যান্য গ্রহ থেকে আনা তথ্যাবলি রেকর্ড করে রাখতে এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করতে।

বজ্রবাহুর বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। বাড়ির সবাই তাঁর জন্যই অপেক্ষা করছেন। বজ্রবাহু সকলের মুখই খুঁটিয়ে লক্ষ করলেন। বাস্তবিকই, কারও মুখেই খুব একটা স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের ভাব নেই। কিন্তু কেন? বিজ্ঞানের কল্যাণে পৃথিবী থেকে রোগভোগ মৃত্যু বিদায় নিয়েছে। অভাব, কষ্ট নেই, পরিশ্রম নেই। তাহলে চাপা বিষণ্ণতা দেখা যাচ্ছে কেন?

খাওয়ার টেবিলে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। মস্ত টেবিল ঘিরে সবাই খেতে বসেছেন। বজ্রবাহুর দু—ধারে তাঁর স্ত্রী এবং বোন। হঠাৎ পিঠে একটু সুড়সুড়ি লাগায় বজ্রবাহু চমকে উঠে পিছনে হাত বাড়িয়ে খপ করে একটা সাপকে ধরে ফেললেন। তারপর সভয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘সাপ! সাপ! বাবা রে!’

তাঁর স্ত্রী অত্যন্ত লজ্জিত গলায় বললেন, ‘সাপ নয়। ছেড়ে দাও।’

‘সাপ নয় মানে!’ বলে লাফিয়ে উঠলেন বজ্রবাহু। টেবিলে সবাই নিঃশব্দে নতমুখে বসে আছেন। বজ্রবাহু সবিস্ময়ে দেখলেন, তিনি যা ধরেছেন তা সত্যিই সাপ নয়।

‘কী এটা!’ বলে ফের বজ্রকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন বজ্রবাহু।

তাঁর নতমুখী স্ত্রী বললেন, ‘ছেড়ে দাও। ওটা আমার লেজ।’

‘লেজ!’ বলে হাঁ করে রইলেন বজ্রবাহু। তাঁর শিথিল হাত থেকে সর্পিল জিনিসটা খসে পড়ল।

বজ্রবাহুর বাবা মৈনাক গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘তুমি পৃথিবীতে ছিলে না, এর মধ্যেই এই একটা অঘটন ঘটতে শুরু করেছে। দু—হাজার বছর আগে হঠাৎ ক্রমে ক্রমে মানুষের লেজ হতে শুরু করেছে। প্রথমে একটা গ্যাঁজের মতো বেরোয়। তারপর ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে। লেজ খসানোর অনেক প্রক্রিয়া করেও লাভ হয়নি। এখন আমাদের প্রত্যেকেরই এক হাত, দেড় হাত দু—হাত লম্বা লেজ হয়েছে। কাপড়চোপড়ে ঢাকা থাকে বটে, কিন্তু সত্যটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই।’

বজ্রবাহু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। ‘লেজ! লেজ হচ্ছে কেন? একটা কারণ তো থাকবে!’

মৈনাক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘লেজ গজানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্বভাবও একটু একটু পালটাচ্ছে। ঘরে থাকার চেয়ে আজকাল কেন যেন আমাদের গাছের ডালে উঠে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। তুমি জান না, আমরা সবাই এখন খুব ভালো গাছ বাইতে পারি, এ—ডাল থেকে ও—ডাল লাফিয়ে লাফিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াই। আমাদের স্বভাবে বেশ একটা পরিবর্তন এসেছে।’

বজ্রবাহু খুব রেগে গিয়ে বললেন, ‘কই, আমার তো হয়নি!’

মৈনাক বললেন, ‘তুমি এই বিবর্তনের সময়টায় পৃথিবীতে ছিলে না, তাই বেঁচে গেছ।’

বজ্রবাহু খাওয়া ফেলে উঠে রাষ্ট্রপতিকে ফোন করলেন, ‘আপনার কি লেজ আছে মহামান্য রাষ্ট্রপতি?’

‘আছে বজ্রবাহু।’

উপরাষ্ট্রপতি বললেন, ‘আছে হে আছে।’

অন্তত পঞ্চাশ জনকে ফোন করে নিঃসংশয় হলেন বজ্রবাহু। মাথা গরম হয়ে গেল। ঘরময় পায়চারি করতে লাগলেন, ‘এর মানে কী? কারণই—বা কী?’

মৈনাক ছেলের অস্থিরতা দেখে তাঁর কাছে এসে নরম গলায় সান্ত্বনা দিলেন, ‘অত অস্থির হোয়ো না। মানুষের কোনো কাজ নেই, সব কাজ যন্ত্র করে দিচ্ছে। মানুষের মস্তিষ্ক কাজ করছে না, যন্ত্রই তার হয়ে ভাবছে। মানুষের মৃত্যুও নেই, হাজার হাজার বছর সে খামোখা বেঁচে থাকছে। তাই বিবর্তন থেমে গেছে। কিন্তু প্রকৃতি তো থেমে নেই। সে তাই মানুষের বিবর্তনের প্রগতি প্রত্যাহার করে নিয়ে তাকে উলটো বিবর্তনের পাল্লায় ফেলে দিয়ে শিক্ষা দিচ্ছে।’

বজ্রবাহু রেগে যেতে গিয়েও রাগলেন না। রেগে লাভ নেই। কারণ, কথাটা মিথ্যে নয়।

এতক্ষণ যেটা লক্ষ করেননি, তা পরদিন সকালেই লক্ষ করলেন বজ্রবাহু। গাছে গাছে প্রচুর মানুষ দোল খাচ্ছে, লাফালাফি করছে, আনন্দে চ্যাঁচাচ্ছেও কেউ কেউ। লক্ষ করলেন, অনেকেই আবার নিজেদের লেজ নির্লজ্জভাবেই প্রদর্শনও করছে। এও লক্ষ করলেন, মানুষের গায়ে বেশ ঘন ও বড়ো বড়ো লোম গজাচ্ছে আজকাল।

উত্তেজিত বজ্রবাহু গিয়ে পুণ্ডরীককে ধরলেন, ‘এসব কী হচ্ছে বলবে?’

পুণ্ডরীক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আবার গোড়া থেকে আমাদের সব শুরু করতে হবে মনে হচ্ছে। মানুষ বানরে রূপান্তরিত হয়ে গেলে ফের উলটো পথে বিবর্তন যদি আবর্তিত হয় তাহলে দূর ভবিষ্যতে আবার মানুষ দেখা দেবে পৃথিবীতে। আপাতত আমাদের কিছু করার নেই বজ্রবাহু।’

‘আর আমাদের কী হবে?’

‘আমরা অন্য গ্রহে পালিয়ে যেতে পারি বটে, কিন্তু তাতে লাভ কী? আমাদের আপনজনেরা তো বানর হয়ে যাবেই।’

‘তা হলে?’

আর—একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুণ্ডরীক বলল, ‘আমরা অপেক্ষা করব। আর কিছুদিনের মধ্যেই আমাদেরও…’

বাস্তবিক, মাত্র এক হাজার বছরের মধ্যেই বজ্রবাহু, মৈনাক এবং তাঁদের দলবলের লেজ গজাতে লাগল। আর অন্যদিকে, পৃথিবীতে গাছে গাছে বানরের ভিড়। হুপহাপ, দুপদাপ শব্দ। গাছাপালায় সভ্যতা ঢেকে যেতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *