উলটোপাক
আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি। নিষ্পাপ একটি শিশু। বড় বড় স্বপ্নভরা দুটি চোখ। কখনও উদাস, কখনও কৌতূহলী। মানুষ যখন প্রৌঢ় হয় তখন তার ভুরুর চুল উঠে যায়। চোখের পাতা ঝরে যায়। শিশুর চোখের পাতা দীর্ঘ হয়। যখন চোখ মেলে তাকায়, মনে পড়ে যায় সেই গানের লাইন—আঁখি-পল্লব-ছায়। একজন জীবন শুরু করছে, আর একজন জীবন শেষ করতে চলেছে। আমার সেই শিশু বন্ধুটিকে একদিন কথায় কথায় জিগ্যেস করলুম-‘রাজু, বাঁচতে কেমন লাগছে রে?’
রাজু বললে, ‘ধুৎ, বিশ্রী!’
‘সে কি রে, বিচ্ছিরি লাগছে কেন?’
‘তুমি অন্য কথা বলো। বেশি জীবন জীবন কোরো না তো!’
রাজু আমাকে ধমকে ছেড়ে দিল। আমি একটা কাজ করছিলুম। রাজু বসেছিল চেয়ারে। রাজুর বাঁচতে কেন বিচ্ছিরি লাগছে, তার মুখে শোনা না গেলেও অনুমান করার চেষ্টা করলুম। ধরা যাক, আমরা যে সমাজে বসবাস করছি, সেইটা একটা অ্যাকোয়ারিয়াম। সেই মৎস্যাধারে আমরা সব বড় বড় রুই, কাতলা, মৃগেল অষ্টপ্রহর ঘাই মেরে চলেছি। আমাদের উল্লম্ভনে ছোট ছোট মাছ ত্রাহি রব ছাড়ছে। শিশুদের শৈশব আমরা বড়রা গিলে বসে আছি। আমাদের জীবন-সমস্যাকে করে তুলেছি তাদের জীবন-সমস্যা। আমাদের নিজেদের উচ্চাশা বাড়ছে, সহনশীলতা কমছে। শিশু শিশুর মতো আচরণ করলে আমরা খেপে যাই। রাজু একবার মেলা থেকে বাঁশি কিনেছিল। ভেঁপু ধরনের। আমাদের বাড়িতে এসে একবার মাত্র ফুঁ দিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে খন্ড-প্রলয়। পাকতেড়ে বড়রা একেবারে মারমুখী হয়ে তেড়ে এল। রাজু যেই আর একবার বাজিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে একজন বাঁশিটা কেড়ে নিয়ে জানলার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। রাজুর চোখ দুটো জলে ভরে এল। একটি শিশুর কাছে একটি বাঁশি হল তার জগৎ। চোখ ছলছলে হলেও রাজু কাঁদল না। একালের শিশুরা আর সেকালের শিশুদের মতো হাউ হাউ করে কাঁদে না। রাজু বললে, ‘বাড়িতে একবার মাত্র বাজালুম, মা তেড়ে এল রুলকাঠ নিয়ে। তোমাদের বাড়িতে বাজাতে এলুম, নর্দমায় ফেলে দিলে। বাঁশিটা আমি তাহলে বাজাব কোথায়?’
রাজুর জন্মদিনে আমাদের বাড়ি থেকে একটা খেলনা বন্দুক দেওয়া হয়েছিল। বন্দুকের ঘোড়াটা টিপে ধরলে ক্রমান্বয়ে খটর-খটর শব্দ হয় আর একটা আলো আগুনের মতো চমকাতে থাকে । সেই বন্দুকটা নিয়ে রাজুর জীবনে ঘোরতর অশান্তি। প্রথমে রাজুর মা জিনিসটা দামি বলে, আলমারিতে প্যাক করে রাখলেন বেশ কিছুদিন। তারপর একদিন রাজুর ঘ্যানঘ্যানানি সহ্য করতে না পেরে বন্দুকটা বের করে রাজুর হাতে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সারা বাড়িতে হুলুস্থুলু পড়ে গেল। আজকাল আবার একধরনের লোমওয়ালা ছোট ছোট কুকুর বেরিয়েছে। তাদের মেজাজ আবার আমাদের চেয়ে তিরিক্ষি। পান থেকে সামান্য একটু চুন খসলেই, কেঁই কেঁই করে বাড়ি মাথায় করে। রাজুর কাকিমা চিৎকার করছেন। রাজুর জ্যাঠাইমা। রাজুর মায়ের আবার মাথাধরার ব্যামো আছে। নিজের চিৎকারে কিছু হয় না। কারণ সেটা নিজের যন্ত্র থেকে বেরোচ্ছে। অন্যের যন্ত্রর সামান্য শব্দ করলেই তিনি ফ্ল্যাট। তাঁর স্বামী আবার একটু বেশি স্ত্রী-সোহাগে। তাঁর মনস্ত্বত্বকে অবশ্য ফেলে দেওয়া যায় না। তিনি মনে করেন, স্ত্রীর জন্যেই সংসার। স্ত্রী হলেন সৃষ্টিতত্ব। ঈশ্বরী। স্ত্রীর মাথায় যন্ত্রণা হলে তিনি চোখে অন্ধকার দেখেন। পারলে ছাদে উঠে আজান দেন। স্ত্রী একবার বাড়াবাড়ি অসুখের সময় তিনি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। সবাই তখন হাতে-পায়ে ধারে বুঝিয়েছিলেন, ঠাকুরপো, ধরো তোমার বউ বেঁচে গেল, তখন তো সে বেচারা বিধবা হয়ে যাবে। তার চেয়ে তুমি সব রেডি রাখো, মরলেই ঝুলে পড়বে। বউ-অন্তপ্রান ভদ্রলোক ছেলেকে প্রথমে র্যাণ্ডাম পেটালেন। তাপর বন্দুকটা ভাঙতে গেলেন; রাজুর মা হইহই করে তেড়ে গেলেন। জিনিসটা দামি সুন্দর। রাজুর কোনও দোষ নেই। শয়তানিটা করেছে তারা যারা দিয়েছে। আমাদের পাগল করে মারার জন্যে এই শয়তানি। বন্দুকটা নিয়ে রাজু একদিন আমাদের বাড়িতে এল। সেই একই অভ্যর্থনা। মারমার করে সবাই তেড়ে এল। রাজু অবাক হয়ে গেল, ‘তাহলে তোমরা আমাকে জিনিসটা দিলেন কেন?’
শিশু শিশুর মতো আচরণ করলেই অসহ্য। তারা চশমা চোখে হেডলাইট জ্বেলে সবসময় পড়বে। তাদের এক পাঁজা বই। একত্রিশটা খাতা। বিশাল একটা ব্যাগ। স্কুলে যায় যখন, মনে হয় শিকারে চলেছে। এপাশে জলের বোতল। ওপাশে রায়নোকিউলার। পেছনে মা হাঁটছেন লক্ষ্মণের ফল ধরে। হাতে ওয়ার্ক এডুকেশানের পালকি। ভেতরে কাগজের গুলি পাকানো আরোহী। একটু হেলেদুলে, টলে গেলেই কেরামতি আঠা খুলে কাঁচামাল হয়ে যাবে। রাজুর মা রাজুকে স্কুলে দিয়ে বাড়ি আসবেন। সংসারের কাজকর্ম ত্যাড়াংব্যাড়াং করেই আবার খেঁটে ছাতাটা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে পড়বেন ছেলেকে বিলিতি পাঠশালা থেকে ফিরিয়ে আনতে। সেখানে বসে মায়েদের পাঠাশালা। ছেলের হোমটাস্ক লেখালেখি। প্রশ্নোত্তর বোঝাবুঝি। মিসিবাবাদের সমালোচনা। রাজু আর রাজুর বাবা দুজনেই সমান ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। রাজুর মা তিন চক্কর মেরেই ছেলে ঠেঙাতে বসে গেলেন।
আজকাল একটা কথা বেরিয়েছে, কম্পিটিশনের যুগ। কেরিয়ার। চরৈবেতির তা হলে এই মানেই দাঁড়াল। সারা জীবন শুধু চরে বেড়াও। বসার উপায় নেই। দিল খুলে কথা বলার সময়ও নেই, এনার্জিও নেই। কোথাও গিয়ে বসতে না বসতেই মায়েদের ছটফটানি—যাই ভাই, ছেলেটাকে ‘ম্যাথস’ করাতে হবে। আজকাল আবার শর্টের যুগ, ‘ম্যাথস’, ‘পল-সায়েন্স’। শর্টের আর শঠে শাঠ্যং-এর যুগ পড়েছে। এরপর হয়তো মায়েরা চাইবেন, শিশু নয়, ভূমিষ্ট হোক এক বৃদ্ধ—চোখে চশমা, ঋষশৃঙ্গ মুনির মতো, চুল আর দাড়ি, হাতে একটা মোটা বই। পকেটে একপাতা অ্যান্টাসিড আর অ্যান্টিহিস্টামিনিক ট্যাবলেট। এক জ্ঞানী সফোক্লিস। ল্যান্ড করেই বলবে, ‘গুড মরনিং মাদার।’ তারপর এপাশে ওপাশে তাকিয়ে বলবে, ‘সাইলেন্স, সাইলেন্স।’ নিয়মটা উলটে যাবে, ক্লকওয়াইজের বদলে অ্যান্টি ক্লকওয়াইজ। বৃদ্ধ থেকে শিশু, অবশেষে মৃত্যু। পোলিও ভ্যাকসিন নিয়ে, হামা দিয়ে ব্যা ব্যা করতে করতে চিতায়। ‘সফট লাগেজ’-এর যুগ। ক্যারি করার সুবিধে। কাঠও কম লাগবে। শুধু, শিশু মৃত্যুর হার একটু বেড়ে যাবে।