উলটা-রথ

উলটা-রথ

অবতরণিকা

কত না কসরত, কত না তকলিফ বরদাস্ত করে কত চেষ্টা দিলুম, দেশে নাম কেনবার জন্য, আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পিছন পানে তাকিয়ে দেখি সব বরবাদ, সব ভণ্ডুল। পরের কথা বাদ দিন, নিতান্ত আত্মজনও আমার লেখা বই পড়ে না। গিন্নিকে–না, সে কথা থাক, তাঁর সঙ্গে ঘর করতে হয়, ওঁয়াকে চটিয়ে লাভ নেই। অথচ আমার জীবনে মাত্র একটি শখ ছিল, সাহিত্যিক হওয়ার। আপনাদের মনের বেদনা কী বলব– তবে হ্যাঁ, আপনারাই হয়তো বুঝবেন, কারণ সিনেমায় দেখেছি, নায়িকা যখন হা নাথ, হা প্রাণেশ্বর, তুমি কোথায় গেলে? বলে হন্যে-পারা স্ক্রিনে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত অবধি টাটুঘোড়ার মতো ছুটোছুটি লাগান তখন আপনারা হাপুস-হুঁপুস করে অবর্ষণ করেন (যে কারণে আমি হলের ভিতরেও রেনকোট খুলিনে), তাই আপনারা বুঝবেন।

যখন দেখি প্রখ্যাত সাহিত্যিক উচ্চাসনে বসে আছেন, তাঁর গলায় মালার পর মালা পরানো হচ্ছে, খাপসুরৎ মেয়েরা তার অটোগ্রাফের জন্য হদ্দমুদ্দ হচ্ছে, তার জন্য ঘন ঘন বরফজল শরবত আসছে, সভা শেষে হয়তো আরও অনেক কিছু আসবে তখন আমার কলিজার ভিতর যেন ইঁদুর কুরকুর করে খেতে থাকে, আমার বুকের উপর যেন কেউ পুকুর খুঁড়তে আরম্ভ করে। সজল নয়নে বাড়ি ফিরি। পাছে গিন্নি অট্টহাস্য করে ওঠেন তাই দোরে খিল দিয়ে বইয়ের আলমারির সামনে এসে দাঁড়াই– তাকিয়ে থাকি আপন মনে আমার, বিশেষ করে আমার নিজের পয়সায় মরক্কো লেদারে বাঁধানো সোনার জলে আমার নাম ছাপানো আমার বইয়ের দিকে।

আমার মাত্র একজন বন্ধু– এ সংসারে। কিন্তু আর কিছু বলার পূর্বে আগেভাগেই বলে নিই, ইনিও আমার বই পড়েননি। তিনি এসে আমায় একদিন শুধোলেন, ব্রাদার, আমিয়িলের জুনাল পড়েছ?

সে আবার কী বস্তু? বই-ই হবে। না? তা সে কি আমার বই পড়েছে যে আমি তার বই পড়ব?

আহা চটো কেন? জল্লাদ যখন কারও গলা কাটে তখন তার মানে কি এই যে, সে লোকটা আগে জল্লাদের গলা কেটেছিল? অভিমান ছাড়ো। আমার কথা শোনো। এই আমিয়েল সায়েব প্রফেসর ছিলেন। তার বাড়া আর কিছু না। যশ প্রতিপত্তি তার কিছুই হয়নি। নিঃসঙ্গ জীবনে নির্জনে তিনি লিখলেন তাঁর জুনাল।

আমি বাধা দিয়ে বললুম, জুনাল-জুনাল করছ কেন? উচ্চারণ হবে জার্নেল। উচ্চারণ সম্বন্ধে আমি বড্ডই পিটপিটে।

বন্ধু বললেন, কী উৎপাত! ওটার উচ্চারণ ফরাসিতে জুর্নাল। এসেছে ডায়ার্নাল থেকে, সেটা এসেছে লাতিন দিয়েস থেকে–যেটা সংস্কৃতে দিবস। ফরাসিতে তাই দিন দিন প্রতি দিন নিয়ে যখন কোনও কথা ওঠে তখন ওই জুর্নাল শব্দ ব্যবহার হয়। তাই দৈনিক কাগজ জুর্নাল, আবার প্রতিদিনের ঘটনা লিখে রাখলে সেটাও জুর্নাল অর্থাৎ ডাইরি। ফার্সিতে দিনকে বলে রোজ, তাই প্রতিদিনের ঘটনার নাম যেখানে লেখা থাকে সেটা রোজনামচা। আবার

আমি বাধা দিয়ে বললুম, হয়েছে, হয়েছে।

 সেই আমিয়েল লিখলেন তাঁর জুনাল। মৃত্যুর পর সে-বই বেরোতে সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার বসত শহর জিনিভাতে হয়ে গেলেন লেখক হিসেবে প্রখ্যাত। বছর কয়েকের ভিতর তামাম ইউরোপে। ইস্তেক তোমাদের রবি ঠাকুর সে বইয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তাই বলি কি না, তুমি একখানা জুনাল লেখো।

আমি শুধালুম, তুমি পড়বে?

বন্ধু উঠে দাঁড়ালেন। ছাতাখানা বগলে চেপে বললেন, চললুম, ভাই। শুনলুম পাড়ার লাইব্রেরিতে পাঁচকড়ি দের কয়েকখানা অপ্রকাশিত উপন্যাস এসেছে। পড়তে হবে।

ভালোই করলেন। না হলে হাতাহাতি হয়ে যেত।

কিন্তু বিশ্বাস করবেন না, তার সেই মোস্ট সাজেশনের পর থেকে এই জুর্নালের চিন্তাটা কিছুতেই আমি আমার মগজ থেকে তাড়াতে পারছিনে। যে-রকম অনেক সময় অতিশয় রদ্দি একটা গানের সুর মানুষকে দিবারাত্তির হন্ট করে। এমনকি ঘুম থেকে উঠে মনে হয় ঘুমুতে ঘুমুতেও ওইসঙ্গে গুনগুন করেছি।

কিন্তু জুনাল লিখতে যাওয়ার মধ্যে একটা মস্ত অসুবিধে রয়েছে আমার। সংস্কৃতে শ্লোক আছে :

শীতেহতীতে বসনমশনং বাসরান্তে নিশান্তে
ক্রীড়ারম্ভং কুবলয়দৃশং যৌবনান্তে বিবাহম।
 শীতকাল গেলে শীত-বস্ত্র পরিধান।
আহার গ্রহণ যবে দিন অবসান
রাত্রিকাল শেষ হলে প্রেম আলিঙ্গন!
বিবাহ করিতে সাধ যাইলে যৌবন!
—(কবিভূষণ পূর্ণচন্দ্র)

একশো বছর বয়সে আসন্ন মৃত্যুর সম্মুখে অন্তৰ্জলি অবস্থায় সাততলা ইমারত বানাবার জন্য কেউ টেন্ডার ডাকে না।

জুর্নাল লেখা আরম্ভ করতে হয় যৌবনে। তা হলে বহু বছর ধরে সেটা লেখা যায়। পুস্তকাকারে প্রকাশিত হলে পর পাঠক তার থেকে লেখকের জীবনক্রম-বিকাশ, তার সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব পড়ে পরিতৃপ্ত হয়।

আজ যদি আমি জুনাল লিখতে আরম্ভ করি তবে আর লিখতে পাব কটা দিন? তাই কবি বলেছেন, এ যে যৌবনান্তে বিবাহ!

তা হলে উপায় কী?

তখন হঠাৎ একটি গল্প মনে পড়ে গেল।

এক বেকার গেছে সায়েবাড়িতে। কাচুমাচু হয়ে নিবেদন করল, সায়েব, আপনার এখানে যে কী ভয়ে ভয়ে এসেছি, কী আর বলব! এক পা এগিয়েছি কি তিন পা পেছিয়েছি! সায়েব বলল, ইউ গাগা, তা হলে এখানে পৌঁছলে কী করে? বেকারটি আদৌ গাগা অর্থাৎ যে বদ্ধ পাগল শুধু গাগা করে গোঙরায় ছিল না। বরঞ্চ বলব হাজির-জবাব– অর্থাৎ সব জবাবই তার ঠোঁটে হাজির। বলল, হক কথা কয়েছেন, হুজুর। আমিও তাই মুখ করলুম আপন বাড়ির দিকে। এক পা এগোই তিন পা পেছোই। করে করে এই হেথা হুজুরের বাঙলোয় এসে পৌঁছে গেলুম।

তাই যখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, জুর্নাল লেখার মতো দীর্ঘদিনের ম্যাদ যমরাজ আমায় দেবেন না তখন ওই কেরানির মতো পিছন ফিরলে কী রকম হয়? অর্থাৎ বিগত দিনের জুর্নাল? সেই-বা কী করে হয়? পোস্ট-ডেটেড চেক হয়, কিন্তু প্রি-ডেটেড দলিল করার নামই তো জাল। আজ আমি তো আর লিখতে পারিনে :

‘জন্মাষ্টমী ১৩১১ আজ আমার জন্ম হল। মা তখন তার বাপের বাড়িতে। হায়, আমাকে দেখবার কেউ ছিল না। কী হতভাগ্য আমি!’

পুলিশে ধরবে না তো!

বিবেচনা করি আপনারা ক্লাসিকস পড়েছেন– ঋগবেদ, মেঘনাদ, হ-য-ব-র-ল ইত্যাদি। শেষোক্তখানাতে এক বুড়ো ত্রিশ না চল্লিশ হতে না হতেই বয়েসটা ঘুরিয়ে দিত। তখন তার বয়স যেন কমতির ফটকাবাজারে যাকে বলে মন্দি বা বেয়ার দিকে। তখন তার বয়স হত ত্রিশ, উনত্রিশ, আটাশ করে করে আট হয়ে গেলে ফের বাড়তি বা তেজীর দিকে চালিয়ে দিয়ে নয়, দশ, এগারো করে বয়েস বাড়াত।

কিন্তু এ কৌশল রপ্ত করার জন্য মুষ্টিযোগটা শিখি কার কাছ থেকে? হ-য-ব-র-ল সৃষ্টিকর্তা ওপারে যাবার সময় তাঁর ব্যাটা বাবাজি সত্যজিৎকে কি এটা শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন? তাতেই-বা কী? বাবাজি তো তারও আগে ওঁরই কাছ থেকে শিখে নিয়েছেন, গেছোদাদা হওয়ার পন্থাটি–আমি যদি তার সন্ধানে যাই মতিহারি তখন তিনি ছিকেষ্টপুর। আমি ফিলাডেলফিয়ায় তো তিনি ভেরমন্টে। উঁহু, হল না।

ইরানের কবি অন্য মুষ্টিযোগ বাতলেছেন– তার বৃদ্ধ বয়সে :

আজ এ নিশীথে প্রিয়া অধরেতে চুম্বন যদি পাই।
 জোয়ান হইব; এ জীবন তবে গোড়া হতে দোহরাই ॥
 শবি আগর আজ লবে ইয়ার বোসে এ তলবম
জওয়ান শওম জসেরো জিন্দেগি দু বারা কুনম্ ॥

 পাড়ার ছোঁড়ারা ঢিল ছুড়বে।

আমার গুরু রবীন্দ্রনাথ তা হলে কী বলেন?

শিশু হবার ভরসা আবার
 জাগুক আমার প্রাণে,
লাগুক হাওয়া নির্ভাবনার পালে,
 ভবিষ্যতের মুখোশখানা
খসাব একটানে,
দেখব তারেই বর্তমানের কালে।

তার পর তিনি কী করবেন?

জমিয়ে ধুলো সাজিয়ে ঢেলা
তৈরী হবে আমার খেলা—

সর্বনাশ! এই বৃদ্ধ বয়সে যদি সক্কলের সামনে তাই করি তবে ডা. ঘোষ আমাকে রাঁচি পৌঁছিয়ে দেবেন।

মোদ্দা কথায় তা হলে ফিরে যাই। আমাকে খামাখা মেলা বকর বকর করাবেন না। অবশ্য আমার মা বলতেন, আমার দোষ নেই। আমাকে টিকা দেবার সময় ডাক্তার ছুরি আনেনি বলে একটা গ্রামোফোনের নিড়ল দিয়ে টিকা দিয়েছিল।

তা হলে একটা মাস চিন্তা করতে দিন। সামনে হোলি। গায়ে রঙ মাখাব। মনেও।

স্লিস্টলার অর্থ নিম উকিল। উকিলের কাছে যাবার পূর্বে আমার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। সেটি হয়তো পূর্বেও কোনও-কোথাও উল্লেখ করেছি। তাই সেটি আবার বলছি। কারণ মানুষ বিশ্বাস করতে ভালোবাসে যা সে পূর্বেও একাধিকবার শুনেছে–নয়া কথা তার ভালো লাগে না। তাই দেখুন– এটাও আমি আরেকবার বলেছি– একই প্লট নিয়ে ক-গণ্ডা ফিলিম নিত্যি নিত্যি বেরুচ্ছে তার হিসাব রাখেন?

ঘটনাটি সংক্ষেপে এই :

নরক আর স্বর্গের মধ্যিখানে মাত্র একটি পাঁচিলের ব্যবধান। নরক চালায় শয়তান, আর স্বর্গ চালান সিন্ট পিটার। পাদ্রিসায়েবের মুখে শোনা, তাঁরই হাতে থাকে স্বর্গদ্বারের সোনার চাবি।

পাঁচিলটি ঝুরঝুরে হয়ে গিয়েছে দেখে পিটার একদিন শয়তানকে ডেকে বললেন, দেয়ালটা এজমালি। তাই এটার মেরামতি আমি করব এক বছর, তুমি করবে আর বছর। আসলে তোমারই করা উচিত প্রতি বছর। কারণ তোমার দিকে সুবো-শাম জ্বলছে আগুনের পেল্লাই পেল্লাই চুলোতারই চোটে দেয়াল হচ্ছে জখম। আর আমার দিকে সর্বক্ষণ বয় মন্দমধুর মলয় বাতাস। দেয়াল বিলকুল জখম হয় না।

বিস্তর তর্কাতর্কির পর স্থির হল, ইনি এ বছর আর উনি আর বছর দেয়াল মেরামত করবেন। শেষটায় বিদায় নেবার সময় শয়তান ঘাড় চুলকে বলল, দাদা, কিছু যদি মনে না কর, তবে এ বছরটায় তুমিই মেরামতিটা করাও। একটু অভাবে আছি।

পিটার মাই ডিয়ার লোক। রাজি হয়ে গেলেন।

তার পর এক বছর যায়, দু বছর যায়, পাঁচ বছর যায়, দেয়াল পড়ো-পড়ো–শয়তানের সন্ধান নেই। পিটার রেজেস্ট্রি করে চিঠি লিখলেন। ফেরত এল। উপরে লেখা, মালিক না পাইয়া ফেরত। পিটার তখন একাধিকবার শয়তানের বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়লেন। ভিতর থেকে তীক্ষ্ণ বামাকন্ঠ বেরুল– কত্তা বাড়ি নেই। পিটার বাড়ির সামনে লটকাইয়া শমন জারি করলেন। কোনও ফায়দা ওতরাল না।

এমন সময় পিটারের বরাতজোরে হঠাৎ শয়তানের সঙ্গে রাস্তায় মোলাকাত। শয়তান অবশ্য তড়িঘড়ি পাশের গলিতে গা-ঢাকা দেবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এঞ্জেলদের ডানা থাকে। ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে পার্ফেক্ট ল্যান্ডিং করে দাঁড়ালেন তার সামনে। খপ করে হাত ধরে বললেন, বড় যে পালিয়ে বেড়াচ্ছ দেয়াল মেরামতির কী হবে?

শয়তান গাইগুই টালবাহানা আরম্ভ করল। পিটার চেপে ধরলেন, পাকা কথা দিয়ে যাও।

তখন শয়তান শেষ কথা বলল, কিছু মনে কর না ভাই, কিন্তু আমি আমার উকিলদের সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনও পাকা কথা দিতে পারব না।

নিরাশ হয়ে পিটার শয়তানের হাত ছেড়ে দিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বাড়ি ফেরার মুখ করে বললেন, ওইখানেই তো তোর জোর। সবকটা নিয়ে বসে আছিস। আমার যে একটাও নেই।

আমার উকিল অবশ্য নরকে যাবেন না। তিনি বলেন, নরক নেই, স্বর্গ আছে।

আমি বললুম, সে কী কথা! লোক হয় দুটোতেই বিশ্বাস করে, নয় একটাতেও না।

উকিল বললেন, ওইখানেই তো ভুল। তোমরা দর্শনের কিছুই জান না। বুঝিয়ে বলছি। স্বর্গ জিনিসটের কল্পনা আমি করতে পারি। খাসা জায়গা, না গরম না ঠাণ্ডা। তোমাদের পরশুরামই তো বলেছেন, ঝোপে-ঝাপে চপ কাটলেট ঝুলছে। পাড়ো আর খাও, খাও আর পাড়। হুরী-পরীদের সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ কর, কেউ কিছু বলবে না। অতএব স্বর্গ আছে। কিন্তু এই পৃথিবীর চেয়ে বেদনাময় জায়গা আমি কল্পনাই করতে পারিনে। অতএব সেটা নেই। যে জিনিস আমি কল্পনাই করতে পারিনে সেটা থাকবে কী করে?

যুক্তিটা আমার কাছে কেমন যেন ঘোলাটে মনে হল। তবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সপ্রমাণ করতে গিয়ে মুনিঋষিরা যেসব যুক্তি দেন তার চেয়ে অবশ্য বেশি ঘোলাটে নয়। কিন্তু সে-কথা থাক। ওটা নিয়ে আমার শিরঃপীড়া নয়। কথায় বলে, বিপদে পড়লে শয়তানও মাছি ধরে ধরে খায়–আমার উকিলটি নরকে না গেলেও শয়তান তার বাঁ হাতের তেলোতে জল রেখে তাতে ডুবে আত্মহত্যা করবে না। বরঞ্চ একটা উকিলকে যদি কোনওগতিকে স্বর্গরাজ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারে তা হলেই তো চিত্তির। ক্লাইভ তো আর গণ্ডায় গণ্ডায় জন্মায় না! এক ক্লাইভে যা করল, তার ধকল আমরা এখনও কাটাচ্ছি। দ্যাখ তো না দ্যাখ, সেন্ট পিটারের পেটের ভাত চাল হয়ে যাবে, তন্দুরি মুর্গি ডানা গজিয়ে পেটের ভিতর ফুড়ুৎ ফুড়ৎ করতে থাকবে।

আমার শিরঃপীড়া :- আমি যদি প্রি-ডেটেড চেক সই করি, অর্থাৎ শুঁটকিকে তাজা মাছ বলে পাচার করি, অর্থাৎ প্রাচীন দিনের ডায়ারি নবীন বলে চালাই তবে কি আমি ভেজালের ভিটকিলিমিতে ধরা পড়ব না?

উকিল পরম পরিতোষ সহকারে বলল, কিছু ভয় নেই। তবে যা লিখবে তার ন আনার বেশি যেন সত্য কথা না হয়। মিথ্যে লিখতে হবে নিদেন সাত আনা। নতুন আইন।

আমার মিথ্যে বলতে কণামাত্র আপত্তি নেই। লেখক মাত্রই মিথ্যেবাদী। এবং মিথ্যেবাদীকেও সংজ্ঞা দিতে গিয়ে গুণীরা বলেছেন, যে লোক দুর্ভাগ্যক্রমে লেখক হওয়ার সুযোগ পেল না, হতাশ-প্রেমিকের মতো হতাশ-লেখক। তবু অবাক হয়ে বললুম, সে কী কথা?

উকিল বলল, ক্যারেট কারে কয় জানো? ২৪ ক্যারেটে খাঁটি সোনা হয়। এখন আইন হয়েছে, চৌদ্দ ক্যারেটের বেশি সোনা দিয়ে গয়না গড়ানো চলবে না। বাকি দশ ক্যারেটের বদলে দিতে হবে খাদ।

আমি অবাক হয়ে বললুম, আমি কি স্যাকরা যে আমাকে এ-আইন শোনাচ্ছেন!

উকিল আমার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকাল। যেন আমি ফিয়ারলেস নাদিরা বা কাননবালার চেয়েও খাপসুরত। নিজের চেহারার প্রতি ভক্তি বেড়ে গেল।

বলল– এবারে অতিশয় শান্তকণ্ঠে সোনা ভারতবাসীর চোখের মণি, জিগরের টুকরো, কলিজার খুন। তাই দিয়ে যখন আরম্ভ হয়েছে, তখন সর্বত্রই এটা ছড়াবে। যাও, আর মেলা বকর বকর কর না। আর শোনো, তোমার মাথায় যা মগজ তা দিয়ে পুঁটিমাছেরও একটা টোপ হবে না। তুমি নির্ভয়ে লেখো। কেউ পড়বে না। তুমিও পড়বে না– অর্থাৎ ধরা পড়বে না।

আঁতে ফের লাগল। তবে খুব বেশি না। আমার আঁতে গণ্ডারের চামড়ার লাইনিং।

 তা সে যাকগে। আইন বাঁচিয়ে লিখব।

***

 আমার শক্র চতুর্দিকে। বরঞ্চ আমাকে অজাতশত্রু না বলে অজাতমিত্র বলা যেতে পারে। তারা যে আমার কী বদনাম করে বেড়াচ্ছে তার লেখাজোখা নেই। না, ভুল বললুম। পাড়ার ছোঁড়াদের কাছে আছে। তৃষ্ণার্ত ছাত্রদের বিয়ারদার সমিতিতে চাঁদা দিইনি বলে তারা সেগুলো জিগির বা স্লোগানরূপে ব্যবহার করে। মহরমের হায় হাসান, হায় হোসেন রোদনরব এর তুলনায় অট্টহাস্য।

তারই একটা– আমি নাকি অতিশয় সুপুরুষ। আপনারা অবশ্য একথা শুনে সরল চিত্তে শুধোবেন, এটা আবার কুৎসা হল কী প্রকারে?

ওই তো! ছোঁড়াদের পেটে কী এলেম তা তো আপনারা জানেন না। সূক্ষ্ম তালেবরদের দুষ্টবুদ্ধি। বেদে নাকি আছে, স নে বুদ্ধ্যা শুভয়া সংযুক্ত–তার এক অর্থ নাকি, দেবতা শুভবুদ্ধি দ্বারা আমাদের সংযুক্ত করুন– এক করুন। অশুভ বুদ্ধি যে আরও কত বেশি সংযুক্ত করে, ঋষি সেটা জানতেন না। কারণ আমাদের বঁড়শে ব্যালার বুদু খানসামা লেনের ছোঁড়াদের ঐক্য তিনি দেখেননি।

তা হলে আরও বুঝিয়ে বলি! রবীন্দ্রনাথের লেখাতে আছে, এক হাড়কিপ্টেকে শিক্ষা দেবার জন্য পাড়ার ছোঁড়ারা কাগজে মিথ্যে মিথ্যে ছাপিয়ে দেয়, তিনি নাকি অমুক চ্যারিটি ফান্ডে বিস্তর টাকা খয়রাত করেছেন। আর যাবে কোথা? চ্যারিটি না করে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাড়ির সামনে চ্যারিটি ম্যাচের ভিড়।

হুবহু ওই একই মতলব।

তখন স্থির করলুম, একটা ফটো তুলে এই উল্টো-রথের সঙ্গে ছাপিয়ে দেব। শুনলুম, কালীঘাটের কাছে ফটো ফ্ল্যাশের নাকি বাসটিং বিজিনেস ফেটে পড়ার উপক্রম। গিয়ে দেখলুম, কথাটা খাঁটি, ছাব্বিশ ক্যারেট খাঁটি। আমার ছবি তুলতে গিয়ে তাদের তিনখানা লেন্স বার্সট করল। আমার শ্যাটারি সৌন্দর্য সইতে না পেরে।

সেই নব্বই বছরের থুরথুরে ফারসি বুড়ির কাছে বাজ পড়াতে তিনি ভিরমি যান। হুঁশ ফিরে এসে বিড়বিড় করে বলেছিলেন, বাজের কী দোষ? আমি যে বড্ড বেশি অ্যাট্রাকটিভ।

ফটো হল না। অইল পেন্টিং-ওলা বলেন, কালো হলেও চলত, তা সে যত মিশই হোক না। কিন্তু এ যে, বাবা, খাজা রঙ। কালো কালির উপর পিলা মসনে। তার উপর কলাইয়ের ডালের পিছলপারা, না-সবুজ না-নীল না-কিচ্ছ। আমার প্যালেট লাটে।

.

সেই থেকে ভাবছি কী করি?

তা হলে আবার একটা মাস ভাবতে দিন।

 কিন্তু তাতেই-বা কী? দশ ঘণ্টা বাতি জ্বালিয়ে রাখার পর সেটা নিভিয়ে দিলে ঘরে যে অন্ধকার, এক মিনিট জ্বালিয়ে রাখার পর নিভিয়ে দিলেও সেই অন্ধকার।

এক মাস চিন্তা করলেই-বা কী, আর এক মিনিট চিন্তা করলেই-বা কী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *