উপাস্য দেবতা – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

উপাস্য দেবতা – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

ভূতের কোনো ঠিকানা থাকে না। শৈশবে এক রকমের ভূত, বড়ো হয়ে আর এক রকমের ভূত। ভূতেরা নানারূপে নানা ঘটনায় জীবনে হাজির থাকবেই। শৈশবের ভূতের কথাই বলা যায়। যেমন আমাদের দেশে শরৎকালে পূজার বাদ্যি বাজলেই আশ্চর্য এক নেশা জড়িয়ে যেত শরীরে। মা আসছেন। মা আমাদের অন্নপূর্ণা। প্রকৃতই তিনি মা দুর্গা না-খড়কুটোর একটি মূর্তি কখনও ভাবিনি।

মহালয়ার দিনের কথাও মনে হয়। আমার বাবামশায় যাবেন নদীতে ডুব দিতে। সূর্যোদয়ের আগে বাবা ডুব দেবেন গঙ্গায়। তখন দেশ থেকে এসে আমার বাবা সবে জঙ্গলে বাড়িঘর বানিয়েছেন।

তখন আমাদের সম্বল বলতে বাঁশের খলষা দিয়ে খড়ের দুটো কুঁড়েঘর। একটিতে আমরা থাকি। আমরা অর্থাৎ বাবা-মা আমি আর আমার ছোটো দুই ভাই। আর একটায় থাকে একটা বেয়াড়া গোরু। দুধ দেয় না। তবে তার গোবরটুকু বামুনের পরিবারে বড়ো কাজে আসে। কারণ সকালে আমার মা-র কাজই ছিল জলে গোবর গুলে বাড়ির উঠোনে, বাড়ির গাছপালা জঙ্গলে—যাই কিছু থাক না চারপাশে সর্বত্র গোবর ছড়া দিয়ে বাড়িটাকে অশুভ প্রভাব থেকে রক্ষা করবে।

আমাদেরও বিশ্বাস অটুট। রাতের অন্ধকারে যতই ভূতেরা জঙ্গলের মধ্যে নৃত্য করুক, বাড়ির ত্রিসীমানায় তারা যে কিছুতেই ঢুকতে সাহসই পাবে না, কারণ বাড়ি এবং তার চারপাশ এই গোবর ছড়ার গুণে মন্ত্রপূত হয়ে আছে। আমরা নির্ভয়ে তখন তিন-ভাই কোথাও দূরে শনিপূজার প্রসাদ নিতে গেলে, ভূতের জায়গাগুলোতে রাম নাম জপ করতাম। না-গিয়েও উপায় থাকে না, বাবা আমার একাই গেছেন শনিপূজা করতে, জমি গাছপালা জঙ্গল পার হয়ে আবার বড়ো বড়ো আমের বাগানও পার হতে হয়—তখন মানুষজন এ দেশে আসছে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে, সবে দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ায়, আমার বাবা-জ্যাঠারা যেমন যতটুকু সঙ্গে নেওয়া যায় তাই নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন কিছুকাল আগে। তেমন আরও যারা পরে আসছেন, তাদের কাছেও বানজেটিয়ার জঙ্গল এবং পাশের রাজা-মহারাজাদের আমবাগান মাইলের পর মাইল বসবাসের জায়গা হয়ে গেল।

আর আমাদের বাড়ি থেকে রাতে বের হওয়া সোজা কথা ছিল না। সামনে কিছু জমি পার হলেই সিপাইদের ট্রেনিং সেন্টার—সকালে আর সন্ধ্যায় দু-বার নিয়ম করে বিউগিল বাজানো হয়। তখন যতই জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার থাকুক, কিংবা কারবালা কবর ভূমি থেকে যতই ভূতেরা নাচানাচি করার জন্য জঙ্গলের প্রকৃষ্ট অন্ধকারে ঢুকে যাক না, আমরা ভয় পেতাম না। কারণ অদূরেই বিউগিল বাজে। অবশ্য আমাদের বিনা অনুমতিতে পুলিশ সেন্টারে ঢোকার নিয়ম ছিল না। যাই হোক আমরা আমাদের অবধারিত সত্যকে খুঁজে পেয়েছি। আমরা নিশুতি রাতেও ঘর থেকে বের হতে ভয় পাই না।

যেমন বাবা বলতেন, পকেটে ঠাকুরের বেলপাতা আছে তো?

আছে।

কোমরের ঘুনসিতে জালকাঠি আছে তো?

আছে।

আসলে জালকাঠি বস্তুটি লোহার তৈরি। খেপলা জালে মাছ ধরার নিমিত্ত ব্যবহার হয়ে থাকে। বাবার আমার মাছ ধরার স্বভাব আছে বলে, দেশ থেকে, অর্থাৎ আমাদের সেই সুদূর দূর দেশ, অর্থাৎ আমাদের জন্মভূমি থেকে যা আমরা ফেলে এসেছি, যেমন জমি ঘরবাড়ি আমাদের প্রিয় গোপাট, পুকুরপাড়ের সুস্বাদু আম জাম নারকেলগাছ এবং জ্যাঠামশায় বাবাকে ধমকও দিয়েছিলেন, সব চলে যাচ্ছে, আর তোর খ্যাপলা জাল হিন্দুস্থানে কি স্মারক হিসেবে নিয়ে যাবি!

বাবার কাতর উক্তি, কি করি সোনাভাই, মন যে মানে না।

তা মন নাই মানতে পারে। যদি কারও বাবা দেশে শুধু পূজাআর্চা করে বেড়ান, বাড়ির গৃহদেবতারও পূজা দেন দু-বেলা, আর যার কোনো কাজ নেই, কারণ সংসার কীভাবে চলবে, দখিরে বাজার থেকে কোন মুদির ঘর থেকে সওদা হবে, উত্তরের বিলের জমিতে আমনধানের কোন বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হবে, এবং তরমুজের জমি থেকে কোন পাইকারকে তরমুজ বিক্রি করা হবে তার সব সিদ্ধান্ত আমার দুদুকাকার। বাবা, দুদুকাকা অর্থাৎ তার ছোটো ভাইকে বিশেষ সমীহ করতেন। ডালু যখন কইছে নিয়া যাও। আমার দুদুকাকাকে দেশগাঁয়ে অর্থাৎ আমরা যেখানে জন্মেছিলাম, বড়ো হয়েছিলাম তার লোকজন কমবেশি সবাই ডালুকর্তাকেও ভয় পেত। আমরাও পেতাম। অগত্যা বাবা আমার সোনা জ্যাঠামশাইকে করজোড়ে বলেছিলেন, সোনাভাই একখান কথা আছে।

কী কথা! কও।

সোনাভাই, ডালুরে কিন্তু কিছু কইবেক না।

কী কইতে বারণ করছ।

এই খ্যাপলা জালখানার কথা। ডালু জানতে পারলে, কারণ ডালুর মাথা ঠিক নাই, এতগুলি মানুষ তিনটা গয়না নৌকায় নারায়ণগঞ্জে যাইব কী কইরা, সঙ্গে বাক্স-পেঁটারাও মেলা, জালখানার কথা শুনলেই খেইপা যাইব।

তা যাইতেই পারে। তার মাথাও ঠিক থাকার কথা না—হিন্দুস্থানে গিয়া খামু কি, থাকমু কোনখানে তারইত কিছু ঠিক নাই।

আপনে সোনাভাই যাই কন আমি কিন্তু আমার খ্যাপলা জাল ফেইলা যামু না।

আর কী করেন আমার সোনা জ্যাঠামশাই জানেন, বাবা আমার সরল-সোজা মানুষ, আবার নেশার ঘোরে অর্থাৎ মাছের নেশা যারে কয়, ভূতের নেশার চেয়ে মাছ মারার নেশাও জীবনে কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়, তার এই ভাইটি বড়ো পরিবারে যখন যে মাছের দরকার জোগান দিয়ে থাকে, বর্ষাকালে দু-তিন মাস বড়ো বড়ো কইমাছ ধানখেত থেকে তুলে আনেন, বাড়িতে আছে কতরকমের জালই। কইয়া জাল, ধর্ম জাল, খ্যাপলা জাল, কোচ জাল, আরও কত কিছু, তার মধ্যে মাত্র একটা খ্যাপলা জাল নিতে চায় বাড়ির ধনকর্তা, খুবই সামান্য আবদার। কাজেই বললেন, ধনবউর যে বড়ো গাঁটরি আছে, তার মধ্যে লুকাইয়া রাখ। ধনবউ-এর পোটলাপুঁটলি ডালুর খুঁজে দেখার সাহস নাই।

সে যাই হোক সোনা জ্যাঠামশাই আরও বলেছিলেন, আরে ও-দেশে বর্ষাকালে আমাদের দেশের মতো মাঠঘাট নদীনালা জলে ডুবে থাকে না। নদীনালা বিলও নাই শুকনা দেশ, মাছের আকাল, সেখানে ওর খ্যাপলা জাল কোনো কামে লাগব না।

এ-দেশে এসে বাবাও সেটা টের পেয়েছিলেন—এবং এমন জঙ্গলের মধ্যে পড়ে গিয়ে আরও আতান্তরে পড়ে গেছিলেন। জঙ্গলের অনতিদূরে কারবালা, আসলে এটা একটা সুবৃহৎ গোরস্থান, শ্মশান কিংবা গোরস্থান যাই হোক ভূতের একটু বেশিমাত্রায় উপদ্রব থাকে।

সেই ভূতের উপদ্রব থেকে রক্ষা পাবার নিমিত্ত তিনি এক সকালে আমাদের তিন ভাইকে ঘুনসিতে তিনটে জাল-কাঠি ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। আর তার একটাই কথা, যাক এই লোহার জালকাঠি যখন সঙ্গে আছে, তোমাগো ডর নাই। ভূতের বাপেরও সাধ্য হইব না ছোঁয়। আগুন আর লোহাকে ভূতেরা যমের মতো ডরায়। ভূতের গন্ধ পাইলেই কোমরের জালকাঠি স্পর্শ করে রাম নাম জপ করবে। মনে থাকবে তো!

সে-সময় পুত্রদের মতিগতিও বিশেষ সুবিধের ছিল না। পড়াশোনা লাটে উঠেছে। যখন-তখন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যাবার স্বভাব। বিষধর সর্প থেকে শিয়াল খটাশের উপদ্রব কম ছিল না— রাত হলেই শিয়ালের আনাগোনা বাড়ির চারপাশে—আর যখন-তখন হুক্কাহুয়া চিৎকার—রাত হলে এক গভীর সংকট তখন আমাদের। দিনেরবেলায় শিয়ালগুলি থাকে কোথায়, তারা যে বাঁশঝাড়ের দিকটায় থাকে তাও বুঝি। বাড়িতে হাঁস পোষা যায় না। হাঁস কিনে আনার দু-দিনের মধ্যেই তারা শেয়ালের পেটে চলে গেল। আমাদের মন খারাপ, সে-জন্য আমরা এই জঙ্গল চেনার একটা রাস্তাও খুঁজে পেয়ে গেলাম—শুধু মনীন্দ্রকাটার জঙ্গলই নয়, সঙ্গে নানা লতাপাতার ঝোপ, একবার একটা বেলগাছও আবিষ্কার করা গেল, আমার ছোটোভাই পিলু একদিন এসে খবর দিল, সে একটি বাসকপাতার গাছ খুঁজে পেয়েছে। বাবা খুবই খুশি।

বাবা নিশ্চিন্ত হলেন, যাক অসুখ-বিসুখের একটা নিদান পাওয়া গেল। এবার দ্যাখ কোথাও একটা তুলসীগাছ পাওয়া যায় কিনা।

অবশ্য বাবার বিশ্বাস প্রকৃতির মধ্যেই আছে সর্বরোগহর প্রণালী, ভগবানই সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন—

সেই বিশাল জঙ্গলের মধ্যে তখন আমাদেরই একটা বাড়ি। আর কোনো বাড়িঘর নেই। জ্যাঠামশাই এবং কাকারা দু-ক্রোশ দূরের শহরে বাসা ভাড়া করে আছেন। তখনও তাঁরা জঙ্গলে ঘরবাড়ি বানিয়ে থাকতে সাহস পাচ্ছেন না। তাঁরা মাঝে মাঝে এসে খবর নিয়ে যান—আমরা কেমন আছি। অথবা আমরা ঠিকঠাক বেঁচে আছি কিনা।

সুতরাং এ-হেন দুঃসময়ে পিলুই নানা খবর নিয়ে আসত। কারণ জায়গাটার সঙ্গে এবং কিছু স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে সে ভালোভাবেই মিশে যেতে পেরেছে। মানুষজন বলতে জঙ্গল শেষ হলে প্রায় আধক্রোশ দূরে কয়েক ঘর অন্ত্যজ লোকের বাস—সেখানে এক ভূতের ওঝার সঙ্গে যথেষ্ট পরিচয় আছে তার—সেই খবর দিয়েছে জায়গাটা ভালো না। আপনারা জঙ্গলে ঘরবাড়ি করে আছেন কী করে! এবং এই জঙ্গলটা গোরস্থানেরই একটা অংশ সে খবরও দিয়েছে।

বাবা খবরটা পেয়ে শুধু বললেন, ভুল, বাজে কথা। থাকলে তেনাদের সঙ্গে একবার অন্তত দেখা হত না! আমার মাকে ডেকে বললেন, তোমার পুত্র কি বলছে! মা শুধু বললেন, যেমন বাপ তেমন তার ছেলে—এক দণ্ড কেউ বাড়ি থাকে না! জঙ্গলটাই এবারে তোমাদের খাবে।

আমার মার মাথাও ঠিক নেই। কারণ অভাব-অনটনে তখন তিনি যা দেবী সর্বভূতেষু হয়ে আছেন। কথায় কথায় বাবাকে খোঁটা দেবার স্বভাবও ছিল তাঁর।

আরে অত উতলা হলে চলে! বাবার এক কথা।

উতলা না-হলেও যে উপায় নেই। পিলু মাঝে মাঝে জঙ্গল থেকে বন আলু তুলে আনলে মা কেমন জীবনে ভরসা খুঁজে পান। দু-বেলা আমাদের তখন অন্ন জোটে না। বাবা সাত্তিক ব্রাহ্মণ তায় প্রমাণ দেবার জন্য নিমতলার নিবারণ দাসের আড়তে গিয়ে বসে থাকেন। নিবারণ দাস আমাদের দেশের লোক, তিনিই এই ব্রাহ্মণ পরিবারটিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলতেন আমাদের ঠাকুরকর্তার কী ছিল না—আর এখন কী অবস্থা!

এবং পরিবারটিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর বাড়িতে একবার শনিপূজাও করালেন, একবার তার এক পুত্রের বিবাহ দিলেন, এবং নানা পার্বণ উপলক্ষ্যে মাঝে মাঝে ঝুড়ি মাথায় করে চাল ডাল তেল নুন পাঠিয়ে দিতেন।

এভাবে বাবার আমার কিছু যজমানও স্থির হয়ে গেল।

তখনই এক সন্ধ্যায় একটি চিঠি নিয়ে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ এসে হাজির। গায়ে নামাবলি, পায়ে খড়ম, জঙ্গলে ঢোকার মুখেই হাঁকলেন, এখানে কি আমাদের উপাস্য দেবতা থাকেন।

মা একটা কুপি বারান্দায় সবে জ্বালিয়েছেন, ধূপধুনো দিচ্ছেন, তুলসি তলায় গড় হচ্ছেন, আমি বারান্দায় বসে লন্ঠনের আলোয় পড়ছি—পিলুর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না কেউ যে জঙ্গলের বাইরে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত আর্ত চিৎকার করছে বুঝতে পারছি, কিন্তু কে এ-ভাবে ডাকতে পারে। বাবা আজ নিজেই বিকাল থেকে কোদাল মেরে কুপিয়ে জঙ্গলের শেকড়-বাকড় সাফ করার কাজে লেগেছিলেন। আমাকে তিনি আজ আর তার সঙ্গে নেননি—সামনে আমার পরীক্ষা, অগত্যা আমিই বাবাকে ডেকে বললাম দেখুন কে ডাকছে।

মা বললেন, সাঁজবেলায় আবার কোন অতিথি হাজির।

আসলে দেশে আমাদের মেলা যজমান, এবং শিষ্যবাড়ি ছিল। শিষ্যবাড়ি গেলে গুরুদক্ষিণাও যথেষ্ট পেতেন, আমার বাবা। দেশভাগের তাড়নায় শেষে আমাদের এমন পরিণতির কথা কেউ ভাবতেই পারে না।

যাই হোক এতদিনে আমাদের বাড়িতে যে তাঁর বিগ্রহের জন্য একটি ঘরও তুলেছেন বলে রাখা ভালো। আমাদের তিন বিঘে জমির মধ্যে কিছু তালগাছও আছে। আর আছে দুটো বাঁশঝাড়। বাঁশ এবং তালপাতার ছাউনি দিয়ে ঘরটি তুচ্ছ করার কোনও কারণ থাকে না। মা ঘরটিতে দু-বেলা সকাল-বিকাল প্রণাম করেন। আমরাও সকালে প্রথমে এই ঘরটায় মাথা ঠুকি, বাবা স্নান করে বিগ্রহের পূজায় বসে গেলে আর সহজে উঠতে চান না। গরিবের তো ঠাকুর দেবতাই অবলম্বন, আমার মা-র তাড়া শুরু হয়—

আরে তোমার হল! কখন তোমার ঠাকুর সেবা শেষ হবে। সেই কখন ঢুকেছ! তোমার কি ক্ষুধা-তেষ্টা নাই। আমরা বসে আছি।

আরে এতো মহাঝোমেলা! কী আরম্ভ করলে। ঠাকুর সেবার কি শেষ আছে। আমাদের আর আছেটা কী!

তা ঠিক আমাদের এই বনজঙ্গল, পাখপাখালি এবং শিয়াল খটাস বিষধর সর্প ছাড়া আর কিছু অবলম্বন নেই। সবাই যেন পরিবারের সদস্য। কাউকে তাড়া করা যায় না। আছে যখন থাক, তারা তো তোমার কোনও অনিষ্ট করেনি। ইচ্ছে করলেই কাউকে তুমি বাস্তুচ্যুত করতে পারো না।

মা তখন কুপিত হন ঠিক তবে কোনো তর্ক জুড়ে দিতে সাহস পান না। বাস্তুচ্যুত হলে কী হয় তিনিও হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।

তখনই আবার সেই এক কণ্ঠস্বর।

আমাদের উপাস্যদেবতা কি এই জঙ্গলে থাকেন?

বাবা বাধ্য হয়ে আমাকে বললেন, যাওতো, দ্যাখো কে ডাকছে! তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসো।

মা বললেন, তুমি কী! কে না কে ডাকে, তার খোঁজ নিতে ছেলেকে পাঠাচ্ছ! কিছু একটা হলে!

অগত্যা বাবা বললেন ঠিক আছে, আমিই যাচ্ছি।

জনমনিষ্যিহীন এমন নির্বান্ধব জায়গায় এই রাতে কি তিনিই হাজির। জায়গাটা যে ভালো না সে-তো পিলুই বলেছে। কে কখন ভূতের বেশে হাজির হবে ঠিক কী! এক নিবারণ দাস ছাড়া কেউ বড়ো আসে না। নতুন যজমানরা কেউ কেউ আসে ঠিক, তবে সকালেই আসে। কারণ এই জঙ্গলের সামনে অন্ধকারে এসে দাঁড়ালেই গাঁয়ের লোক খাড়া হয়ে যায়। বাবা অগত্যা বাধ্য হয়ে একটি হারিকেন হাতে এগিয়ে গেলেন। কী দেখতে কী দেখে ফেলবেন এই আতঙ্কে তিনিও অস্থির ছিলেন, কোনওরকমে বললেন, আপনি কে! আপনি কোথায়!

আমি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ। আমাকে স্পর্শ করা যায় না, দেখাও যায় না। আমার দায় ছিল তাই দিয়ে গেলাম। নিবারণ দাস আপনার গতিবিধি সব জানে—তাঁরই পরামর্শ মতো দিয়ে গেলাম।

আতঙ্কে বাবা চোখ বুজেই ছিলেন, কেবল বলছেন আপনি কোথায়! কিন্তু কোনো আর সাড়া না-পেয়ে চোখ খুলতেই দেখলেন একটা পুঁটুলি তার পায়ের কাছে পড়ে আছে। খুলে দেখলেন একটি কাঠের ছোটো বাক্স। খুলে দেখলেন কিছু স্বর্ণমুদ্রা, একটি চিরকুট—তাতে লেখা, ঠাকুরের প্রণামী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *