উপাচার্যদের উপাচার্য

উপাচার্যদের উপাচার্য

ফিলিপ জোসেফ হাটিগ ঢাকায় এলেন। সংক্ষেপে পি জে হাটিগ। নবস্থাপিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে তাঁকে লন্ডন থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ঢাকায় তখন গাড়ি নেই তেমন। ঘোড়ার গাড়ির চল। ঢাকাজুড়ে ঘোড়ার গাড়ির ঠক ঠক শব্দ। হার্টিগ সস্ত্রীক ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বসলেন। হার্টিগ রসায়নে পিএইচডি করা। পণ্ডিত লোক। ইংল্যান্ডের বিদ্বৎসমাজে তার খুব খ্যাতি। গবেষণার চেয়ে প্রশাসনিক দক্ষতায় ছিলেন পারদর্শী। ঢাকায় আসার আগে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ছিলেন। ১৭ বছর কাজ করেছেন সেখানে। ঢাকায় এসে তার সঙ্গে পরিচয় হলো বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে। নরেন্দ্র নারায়ণের ছিল অসম্ভব উদ্ভিদপ্রীতি। তার বাড়ির আঙিনা ছিল বহুজাতের গাছে ভরা। সেই বাগান এখন বলধা গার্ডেন নামে পরিচিত। হার্টিগ সেই বাগান দেখে বিস্মিত, অভিভূত! নরেন্দ্র নারায়ণ সেই বাগানেই হার্টিগকে সংবর্ধনা দিলেন। হাটিগ বিয়ে করেছিলেন ৫১ বছর বয়সে। স্ত্রী ম্যাবল হাদিগের গুন তখন ২৮। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পারিবারিকভাবে ইহুদি। ঢাকায়। তখন হাতে গোনা দুই-চারটি ইহুদি পরিবার। নেই কো” উপাসনালয়–সিনেগগ। ম্যাবল হার্টিগ সিনেগগ না পেয়ে কিছুটা ব্যথিত হলেন।

হার্টিগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই বাছাই করা শিক্ষক নেওয়া। শুরু করলেন। তিনি জানতেন, বৃক্ষের পরিচয় ফলে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় সেটার শিক্ষকদের যোগ্যতায়। তিনি নিয়োগ দিলেন (সত্যেন বোসকে। লন্ডন থেকে ডেকে আনলেন। বাঙালি তরুণ রসায়নবিদ জ্ঞান ঘোষকে। এই জ্ঞান ঘোষকে নিয়ে আমি লিখেছিলাম বিস্মৃত এক বাঙালি বিজ্ঞানী। জ্ঞান ঘোষ ছিলেন প্রবাদতুল্য জ্ঞানী ও দূরদর্শী। কুড়ি বছর বয়সে মাস্টার্সে পড়ার সময় কলকাতায় বসে রসায়নের সবচেয়ে বিখ্যাত জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। তাও একক অথার (Sole Author) হিসেবে। যা-ই হোক, হার্টিগের সময় নিয়োগ পেলেন ড. পি মহেশ্বরী ও ড. ওসমান গনির মতো ডাকসাইটে লোক। প্রফেসর বি এম সেনগুপ্ত, ওলাল্টার এজেনকিনসন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ–এমন পণ্ডিতদের দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করলেন ফিলিপ জোসেফ হার্টিগ।

সত্যেন বোসের মতো লোকের প্রফেসরশিপ আটকে দিয়েছিলেন এই হার্টিগ। চাট্টিখানি কথা নয়! নিয়মের সঙ্গে আপস করেননি। ডক্টরেট ডিগ্রি ছাড়া তাঁর আমলে প্রফেসর হওয়ার নিয়ম ছিল না। সে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন শুধু আলবার্ট আইনস্টাইনের সুপারিশপত্র পেয়ে। হার্টিগ জানতেন, আইনস্টাইন যার পক্ষে লিখেছেন, সে লোক যেন-তেন নয়। কোনো গভর্নরের সুপারিশে হার্টিগ নত হননি। হার্টিগের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল নক্ষত্রদের সমাবেশ। সে সময়ের গভর্নর জেনারেল রোনাল্ডসে তাকে লিখেছিলেন, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রত্যেক প্রার্থীর সঙ্গে পৃথকভাবে বসে আলোচনা করে প্রার্থী নির্বাচন করতে হবে। তাদের সঙ্গে আলোচনায় যেসব বিষয় প্রাধান্য পাবে তা হলো, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। তবে সবার আগে তাদের পেশাগত সুখ্যাতি বা বাজারমূল্য (Market Value) যাচাই করে দেখতে হবে।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ে শত বছর পরও যদি বিস্তর লেখা হয়, সেখানে পি জে হার্টিগের নাম আসবেই। আজকের দিন। পর্যন্ত তার চেয়ে দূরদর্শী, প্রতিষ্ঠানপ্রেমী, প্রাজ্ঞ ও জ্ঞান সমঝদার উপাচার্য বাংলাদেশের কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্ভবত পায়নি। স্বাধীনতার পর তো অবশ্যই নয়! তাই আমি তাকে বলি উপাচার্যদের উপাচার্য–The Vice Chancelor of Vice Chancelors। তাকে নিয়ে আমাদের অনেক লেখালেখি দরকার। তাঁকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবগত করা দরকার। তাহলেই শিক্ষার্থীরা বুঝবেন, প্রায় ১০০ বছর আগেও আমাদের চিন্তা-চেতনা কতটা আধুনিক ও কালযুগী ছিল। পি জে হার্টিগ ১০০ বছর আগে যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতেন, সেই লক্ষ্যের কাজ করত পশ্চিমের দেশগুলো। ইউরোপ-আমেরিকা সেসব লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে পেরেছে বলেই তাদের দেশে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর সেরা প্রতিষ্ঠান। একজন ভিনদেশি ও ভিন জাতের মানুষ হয়েও শুধু জ্ঞান, কর্তব্য ও প্রতিষ্ঠানকে ভালোবেসে তিনি যে কঠোর কঠিন ও আধুনিক হতে পেরেছিলেন, একজন স্বদেশি স্বজাতির মানুষ হয়েও আজকের উপাচার্যরা তেমন হতে পারছেন না কেন?